শ্রাবণ ধারা পর্ব-০৫

0
640

#শ্রাবণ_ধারা
//পর্ব_৫//
#সাদিয়া

শ্রাবণ নিজের কথা থামিয়ে ধারার মায়ের কাছে এক গ্লাস পানি চাইলো।আকিবা শেখ পানি দিতেই শ্রাবণ এক ঢোকে তা শেষ করে ফেললো।শ্রাবণের কর্মকান্ডে রিতীমত বিরক্ত হচ্ছে আবির।শ্রবণের কারসাজ তার ঠিক লাগছে না।এই ছেলেকে বিশ্বাস নেই।যে ছেলে মিথ্যা বলে বিয়ে করতে পারে সে আরো অনেক কিছু করার ক্ষমতাই রাখে।বিরক্তি আর রাগের একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে আবিরের মধ্যে।
কিয়ৎকাল নিরবতা পালন করে শ্রাবণ আবার বলা শুরু করে,
—নাজমুল ভাইয়ের কথা শুনে তাকে আমি অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি।অনেক অনুরোধ করেছি।কিন্তু নাজমুল ভাই তার কথা আর সিদ্ধান্তে অটুট।যেকোনো মূল্যে তিনি ধারাকে বিয়ে করতে চান।বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। তখন হুট করেই তাকে ধারা আর আমার সম্পর্কে মিথ্যাটা বলে দিলাম।নিজের ভালোবাসাকে পাবার এই এক রাস্তাই ছিলো আমার।

শ্রাবণের কথা শেষ হতেই খেঁকিয়ে উঠে আবির।
—এটাকে ভালোবাসা বলে?ভালোবাসা বলে এটাকে?আরে তুই যদি এতোই আমার বোনকে ভালোবাসবি তাহলে একবার তোর পরিবারকে বলে ওদের পাঠাতে পারতি বিয়ের কথা বলতে।আমার বোন মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছে ওকে তো আমরা আজ না হয় কাল অবশ্যই বিয়ে দিতাম।আর একজন ভাই হিসেবে আমি আমার বোনকে তার হাতেই তুলে দিতাম যে তাকে ভালোবাসবে।বিষয়টা সুষ্ঠু ভাবে হ্যান্ডেল করা যেতো। কিন্তু তুই কি করলি? সর্বনাশ করে দিলি আমার বোনটার।তুই একবারও ভাবলি না সত্যিটা জানার পর আমরা তোকে ধারার জীবনে মেনে নিবো কি না?

আবিরের কথায় মাঝেই শ্রাবণ বলে উঠে,
—আমি একটু ধারার সাথে কথা বলতে চাই।

আবির কিছু বলতে যাবে তার আগেই আনোয়ার শেখ বলে উঠে,
—তুমি ভাবলে কি করে এতো কিছুর পরেও আমার মেয়ের সাথে তোমাকে কথা বলতে দেবো।নরক করে দিয়েছো তুমি আমার মেয়ের জীবনটা।

আনোয়ার শেখের কথায় শ্রাবণ মুচকি হেঁসে উঠে। শ্রাবণের হাসির মানে কেউ বুঝতে পারলো না।সৈকত রহমান তাকে জিজ্ঞেস করে,
—হাসছিস কেন?

—আঙ্কেল একবার ভেবে দেখুন তো আপনার মেয়ের জীবন কি আমি একা নরক করে তুলেছি?আপনারা কিছু করেন নি?রাস্তার কুকুরের মতো মেয়েটাকে মেরেছেন। আত্মা কাঁপেনি?ও তো আপনাদের একমাত্র মেয়ে তার উপর বিশ্বাস ছিলো না?

শ্রাবণের কথায় আনোয়ার শেখ আর আকিবা শেখের মাথা নিচু হয়ে যায়।আনোয়ার শেখের চোখে স্পষ্ট অপরাধবোধ ফুটে উঠেছে।ঘটনার সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই তিনি তার একমাত্র মেয়েটাকে এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন।আনোয়ার শেখ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্রাবণ আর ধারার সম্পর্কের ইতি টানবেন।আর যাই হোক শ্রাবণের মতো নিচু মানসিকতা সম্পন্ন ছেলের সাথে তিনি তার মেয়েকে সারাজীবনের জন্য ছেড়ে দিতে পারেন না।কিছু একটা ভেবে আনোয়ার শেখ ধারার রুমের দিকে পা বাড়ায়। আনোয়ার শেখকে ধারার রুমের দিকে যেতে দেখে শ্রাবণও সেদিকে পা বাড়ায়। শ্রাবণের পিছু পিছু আবির আর আকিবা শেখও যায়।

.

বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে ধারা।কোন এক অজানা করণে ধারার এই মূহুর্তে প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। কিন্তু পরিবেশটা এতই গম্ভীর যে সে হাসতে পারছে না।সকল নিরবতার অবসান ঘটান আনোয়ার শেখ,
—ধারা…

আনোয়ার শেখকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধারা বলে উঠে,
—আব্বু খালামনিকে বলে দাও আমি সামনের মাসে তাদের কাছে চলে যাচ্ছি।

আনোয়ার শেখ ভীষণ অবাক হলেন।
—তোমার তো ফাইনাল পরীক্ষার পর যাওয়ার কথা ছিলো।আর তুমি তো রাজি ছিলে না তাহলে এখন নিজে থেকে যেতে চাইছো?

—হ্যাঁ চাইছি যেতে।এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত এখানে থাকার মতো শক্তি আমার নেই আব্বু।এখানে থাকলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো।এই পরিবেশটা আমার জন্য খুব বাজে ভাবে দূষিত হয়ে গেছে আব্বু। এখানে থাকলে আমি উল্টো পাল্টা কিছু করে না বসি।এগুলো আমি আর নিতে পারছি না।

আনোয়ার শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।শ্রাবণ অসহায় ভাবে ধারার দিকে তাকিয়ে আছে।ধারা এব্রোড চলে যাবে ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো শ্রাবণের।
—ধারা তুমি যাবে না!

শ্রাবণের কথায় হুহা করে হেঁসে উঠে ধারা।যেন সে মিরাক্কেলের কোনো মজাদার দৃশ্য দেখছে।ধারাকে হাসতে দেখে শ্রাবণের ভ্রু কুঁচকে আসে।

—কেন যাবো না আমি?এই খানে থেকে থেকে অপমানিত হবো?যা করি নি তার শাস্তি ভোগ করবো?আমি মানুষ নই?আমার কোনো আত্মসম্মান নেই?নাকি আমাকে এতটুকু অপমান করে আপনার মন ভরেনি?আরো আপমান করতে চান আমাকে?আরো নিচু করতে চান?আপনি অন্যায় করেছেন স্যার।আপনার অন্যায়ের কোনো ক্ষমা নেই।আর কথায় আছে অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সয় দয় দু’জনেই সমান অপরাধী। এমনিতেই আমার অপরাধের শেষ নেই আমি আর অপরাধের ভাগিদার হতে চাই না।

শ্রাবণ নিচু স্বরে বলে,
—আমি তোমাকে ভালোবাসি ধারা।

—ভালোবাসা!কোনটাকে ভালোবাসা বলছেন আপনি স্যার?সবার সামনে আমাকে ছোট করলেন আমাকে অপমান করলেন এই আপনার ভালোবাসা?আরে ভালোবাসলে সম্মান করতে জানতে হয়।সেখানে সম্মান নেই সেখানে কিসের ভালোবাসা?যেই ভালোবাসা সম্মান নেই আমার সেই ভালোবাসা চাই না।চাই না আমার সেই ভালোবাসা।আগে সম্মান করতে শিখুন তার পর ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসবেন।

—আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি ধারা।

—আপনি আদো ভালোবাসা মনে বুঝেন স্যার?ভালোবাসলে প্রথমে তাকে সম্মান দিতে নয়।আপমান করাকে ভালোবাসা বলে না।ভালোবাসলে তাকে আগলে রাখতে হয়।তাকে অত্যাচার আর মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে হয় না।আর আপনি যেটাকে ভালোবাসা বলছেন না স্যার ওটা আসলে ভালোবাসা নয়।এটা আপনার ইমফ্যাচুয়েশন।যা সময়ের সাথে সাথে কেটে যাবে।আচ্ছা বলুন তো আপনি আমাকে কেন ভালোবাসেন?

শ্রাবণ কিয়ৎকাল কিছু একটা ভাবলো।ভেবে উত্তর দিলো,
—কারণ তুমি কিছুটা মেহরিনের মতো দেখতে।

শ্রাবণের কথায় ধারা মুচকি হাসে।
—আপনি আমাকে ভালোবাসেন কারণ আমি মেহরিন আপুর মতো দেখতে!আপনি মেহরিন আপুকে পাননি বলে আমাকে পাওয়ার জন্য এমন একটা জঘন্য কাজ করতেও দু’বার ভাবলেন না।একবারও এটা ভাবলেন না আপনার একটা মিথ্যাতে আমার জীবনে কি ঝড় আসতে পারে। আমি আপনার ভালোবাসা ছিলাম না স্যার।আমি ছিলাম আপনার জেদ। মেহরিন আপুকে পাননি তাই আপনার মাথায় জেদ চেপে বসেছিলো।যেই তার মতো একজনকে দেখলেন এটাকে ভালোবাসার নাম দিয়ে ফেললেন।ভালোবাসা এতো সহজ নয় স্যার।সবাই ভালোবাসতে পারে না।সত্যিকারের প্রেমিক হতে গেলে বুক ভরা সৎ সাহসের দরকার হয়।যা আপনার নেই।

এতটুকুবলেই থামলো ধারা।শ্রাবণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার কিছু বলার নেই।ধারাকে দেখার পর আসলেই তার জেদ বেড়ে গিয়েছিলো।মেহরিনকে না হোক মেহরিনের মতো দেখতে কাউকে নিজের করে পাওয়ার।

ধারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—আমি একা থাকতে চাই।আপনারা আসতে পারেন।

ধরার কথায় সবাই তার রুম ত্যাগ করে আর ধারা রুমের দরজা আটকে দেয়।ধারা শ্রাবণকে ভালোবাসে আজো ভালোবাসে।এতো কিছু হওয়ার পরেও ধারা শ্রাবণকে ঘৃণা করতে পারে না।ধারা আগে শ্রাবণকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতো কিন্তু এখন আর সে শ্রাবণকে পেতে চায় না।যে মেয়েদের সম্মান করতে পারে না তার সাথে কিভাবে থাকবে সে।মেয়েরা সব কিছুতে কম্প্রোমাইজ করতে পারে শুধু নিজের সম্মান ছাড়া। মেয়েদের কাছে তাদের সম্মান অমূল্য!যেখানে সম্মান নেই সেখানে থেকে যাওয়ার কথা চিন্তা করাও আপরাধ!জঘন্য অপরাধ!

.
ড্রয়িং রুমে সবাই এসে বসেছে।সবার দৃষ্টি এখন আনোয়ার শেখের দিকে।সবাই তার সিদ্ধান্ত জানতে উদগ্রীব হয়ে আছে।গলা পরিষ্কার করে আনোয়ার শেখ বলে,
—আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্রাবণ আর ধারার সম্পর্কের ইতি টানতে।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ