শ্রাবণ ধারা পর্ব-০৬

0
646

#শ্রাবণ_ধারা
//পর্ব_৬//
#সাদিয়া

গলা পরিষ্কার করে আনোয়ার শেখ বলে,
—আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্রাবণ আর ধারার সম্পর্কের ইতি টানতে।

—একটা বার ভেবে দেখলে হয় না।বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে..

শ্রাবণের বাবার কথায় ভ্রু কুঁচকে আসে আনোয়ার শেখের,
—আপনিও তো একজন মেয়ের বাবা।আপনার মেয়ের সাথে যদি কেউ এমন করতো আপনি কি করতেন? সারাজীবন থাকতে দিতেন নিজের মেয়েকে তার সাথে?সবুর করুন আমরা পুলিশে যাইনি। শান্তিতে সব শেষ করতে চাইছি।পুলিশে গেলে কারোরই মন-সম্মান কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

শ্রাবণের বাবা আর কিছু বললেন না।

—আমি কালকেই আমার উকিল বন্ধুর সাথে কথা বলে সব ঠিক করবো।আর সামনের মাসেই ধারাকে ওর খালার কাছে জার্মান পাঠিয়ে দেবো।আমি আমার মেয়ের জীবনে আর কোনো ঝামেলা চাই না।
অতঃপর শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—তোমাকে একটা কথা বলছি শ্রাবণ তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে।তুমি একজন ভবিষ্যৎ ডাক্তার। এইসব কিছু বাদ দিয়ে নিজের পড়ায় ফোকাস কর।নিজের জীবনটা হেলায় ফেলায় কাটিয়ো না।আর হ্যাঁ ধারার কথা ভুলে যাও।ভুলে যাও ধারা নামের কেউ কোনো দিন তোমার জীবনে এসেছিলো।সব ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবনটাকে শুরু কর।আর ধারার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাও।আমি তোমার ছায়াও দেখতে চাই না আমার মেয়ের জীবনে।
শেষ কথাটা বেশ শক্ত ভাবেই বললেন আনোয়ার শেখ।
শ্রাবণ কিছু বললো না।তার বলার মতো কিছুই নেই।

একমাস পর🍁
দেখতে দেখতে এক মাস চলে গেলো।এই এক মাসে ধারা কলেজ যায় নি।বাড়িতেই থেকেছে।বাড়িতে থাকলেও আবির ছাড়া কারো সাথে সে ভালোভাবে কথা বলে নি।বাবা-মায়ের উপর অভিমানের পাহাড়টা যে তার বিশাল বড়।
কালকে ধারার ফ্লাইট।চলছে শেষ মূহুর্তের প্রস্তুতি। ধারা আর আবির মিলে প্যাকিং করছে।
—ধারা এখানে পিঠা আছে এগুলো এভাবেই দশ থেকে বারো দিন ভালো থাকবে।ঢুকিয়ে রাখ ব্যাগে।

ধারা কোনো কথা না বলে চুপচাপ মায়ের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।ধারার নিরবতা তার বাবা-মা কে অনেক পীড়া দেয়।একটা মাত্র মেয়ে তাদের অনেক আদরের।সে যদি বাবা মায়ের সাথে কথা না বলে তাহলে তাদের তো কষ্ট হবেই!
এতে ধারার বাবা-মায়ের অপরাধবোধ বেড়ে যায়।কম অত্যাচার তো করেননি মেয়েটার উপর।মেয়েটা তাদের পায়ে পড়ে কেঁদেছে পর্যন্ত কিন্তু তারা ধারার কান্না শুনেনি।ধারার চোখের জল দেখেও আমলে নেয়নি।মেয়েটাকে এমনভাবে মেরেছেন রাস্তার কুকুরকেও মনে হয়না কেউ এভাবে মারে।তারা ধারার সাথে যা করেছে তার পর ধারার এমন ব্যাবহারই তো তাদের প্রাপ্য!বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি প্রস্থান করেন।

সব প্যাকিং শেষ করে ধারা আর আবির বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়।আবির কপালের ঘাম মুছে ধারাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—উফফ! এই ধারা এক গ্লাস লেবু পানি খাওয়া আমাকে।

ধারা চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে,
—লেবু পানি কেন?

—ইডিয়েট তোর প্যাকিং তো সব আমাকে দিয়েই করিয়েছিস নিজে তো ডমি সেজে দাঁড়িয়ে ছিলিস।তোর এতো প্যাকিং করে আমি ক্লান্ত।এখন আমাকে এক গ্লাস লেবু পানি দিয়ে ধন্য কর।

আবিরকে ভেঙচি দিয়ে ধারা রান্না ঘরে যায়।
.
বিকেল বেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ধারা।তখনই তার ফোনটা বেজে উঠে। আননোন নম্বর দেখে কিছুটা অবাক হয় ধারা।রিসিভ করে সালাম দিতেই অপর পাশ থেকে মহিলা কণ্ঠ ভেসে আসে।কিন্তু ধারা তাকে চিনতে পারলো না।
—ধারা আমি শ্রাবণের আম্মু!

শ্রাবণের মা ধারাকে ফোন করেছে এটা ধারার কল্পনাতীত।
—আন্টি আপনি হঠাৎ আমায় ফোন দিলেন?

শ্রাবণের আম্মু কিছুটা ইতস্তত করে বলেন,
—আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো ধারা।ওইদিন কিছু না জেনেই তোমাকে এতোগুলা কটু কথা শুনিয়েছিলাম। তোমার কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও তোমার গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছিলাম।আমি আমার ছেলের কাজে খুব লজ্জিত ধারা।ও যে এমন কিছু করবে বা করেছে আমরা কোনো দিন ভাবতেও পারি নি।তুমি পারলে আমার ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিয়ো ধারা।

শ্রাবণের মায়ের কথায় হাসি পেলো ধারার।ধারার কেন যেন এখন প্রায় সবার কথা শুনলেই হাসি পায়।সবাই এখন এমন ভাব করে যেন সে তৃতীয় রানী এলিজাবেথ!
—আচ্ছা আন্টি আপনি ঠিক কোন কাজের জন্য শ্রাবণ স্যারকে ক্ষমা করে দিতে বলছেন বলুন তো?সে আমার নামে কেচ্ছা রটিয়েছে সকালের সামনে আমাকে অপমান করেছে, মেহেরবানি করে আমার বেঁচে থাকা কঠিন করে দিয়েছিলো এই করণে আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো?আমি যদি শ্রাবণ স্যারকে ক্ষমা করে দেই না আন্টি তাহলে এটা সমস্ত মেয়ে জাতির অপমান হবে আন্টি। আর আমি তা করতে পারি না।একদম না!আমি মন থেকে কোনো দিন ক্ষমা করতে পারবো না।তাই আমি মিথ্যা মিথ্যা মুখেও বলবো না।আমি এত মহান নই আন্টি যে সব ভুলে গিয়ে সবাইকে ক্ষমা করে দেব।
এতটুকু বলে থামলো ধারা।তার গলা কাঁপছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো,
—কালকে আমার ফ্লাইট আন্টি আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে আমি অতীতকে ভুলে গিয়ে সুন্দর একটা ভবিষ্যতের সূচনা করতে পরি।

—দোয়া করি সুখি হও জীবনে।

বলেই ফোন কেটে দিলেন শ্রাবণের আম্মু।ফোনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এই এক মাসে শ্রাবণের সাথে ধারার কোনো প্রকার যোগাযোগ হয়নি।শ্রাবণ কোথায় আছে কেমন আছে জানে না ধারা।আর সে জানতেও চায় না।আগে ধারা লুকিয়ে শ্রাবণের সকল খোঁজ খবর রাখতো কিন্তু এখন সে শ্রাবণের কথা ভাবতেও চায় না। শ্রাবণ এখন ধারার জীবনের এক বিষাক্ত অতীত।

🍁
কলেজের ক্যাফেটোরিয়েতে বসে আছে শ্রাবণ।এই এক মাস সে কারো সাথে যোগাযোগ করে নি।নিজেকে সবার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে নিয়েছে সে।এই এক মাস কলেজেও আসে নি।আজকে ধারা চলে যাবে তা সে জানে।ধারাকে একবার দেখতে শ্রাবণের ভীষণ ইচ্ছে করছে।মন বলছে যেতে আর মস্তিষ্ক বলছে না যেতে।এখন চলছে মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধ।
শ্রাবণের জীবনটা অনেক ঘোলাটে।সে বাবা-মার আদর পায়নি কোনো দিন।বাবা-মা সবসময় নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকতেন।তাকে একদম সময় দিতেন না।ছোট বেলা থেকে একা একাই বড় হয়ে উঠা তার।ইন্টারে পড়ার সময় তার মেহরিনের সাথে পরিচয় হয়।সে ছিলো শ্রাবণের জুনিয়র।মেয়েটা বড্ড অদ্ভুত ছিলো।সবসময় শ্রাবণের খেয়াল রাখতো।শ্রাবণ মানা করতো কিন্তু শুনতো না।একদিন হঠাৎ সে শ্রাবণকে প্রোপোজ করে বসে।ততো দিনে শ্রাবণও মেহরিনের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলো।তাই সে বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেছিলো মেহরিনের প্রস্তাবে।সবকিছু ভালোই চলছিলো।শ্রাবণ মেডিক্যালে ভর্তি হলো।আচমকাই মেহরিনের বিয়ে হয়ে গেলো।মেহরিনের বিয়ের খবর শ্রাবণ পেলো বিয়ের সাত দিন পর।শ্রাবণ ভীষণ কেঁদেছিলো সেদিন।ভীষণ বাজে ভাবে ভেঙ্গে পরেছিলো সে।তার এক বছর পর তার ধারার সাথে দেখা হলো।ধারা চেহারা কিছুটা মেহরিনের মতো।ধারাও মেহরিনের মতোই যতটা পারে শ্রাবণের খেয়াল রাখতে চেষ্টা করতো।তখনই শ্রাবণের মাথায় ধারাকে বিয়ে করার ভুত চাপে।নামজুল যখন বলেছিলো সে যেকোনো মূল্যে ধারাকে বিয়ে করতে চায় তখন হুট করেই শ্রাবণ নামজুলকে মিথ্যাটা বলে দেয়।সে এর পরিণতির কথা চিন্তাও করেনি।যদি পরিণতির কথা একবার চিন্তা করলে হয়তো আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে চুমুক দেয় শ্রাবণ।তার হাতে কিছুই নেই এখন।কিচ্ছু করার নেই এখন তার।সবাই এখন তাকে ঘৃণা করে।হয়তো এটাই তার প্রাপ্য ছিলো।মিথ্যা বলা মহা পাপ।আর শ্রাবণ সেই মহাপাপ টাই করেছে।মহাপাপের মহা শাস্তিটাও তো তাকে পেতে হবে।

.

ধারা এয়াপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। ধারাকে সি ওফ করতে সবাই এসেছে। ইমিগ্রেশনে যাওয়ার সময় ধারা এক নজর নিজের পরিবারকে দেখে নিলো।এক সময় যে শ্রাবণের জন্য সে যেতে চায় নি আজ সে শ্রাবণের জন্যই তাকে দেশ ছাড়তে হচ্ছে,পরিবার ছাড়তে হচ্ছে।ধারা জানে না সে যা করছে এটা আদো ঠিক নাকি ভুল তবে ধারা এটা জানে এখানে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে পা বাড়ায় ধারা।সে আর পিছন ঘুরে জীবনকে দেখতে চায় না।অতীতের অপ্রিয় স্মৃতি গুলোকে ভুলে যে সামনে এগিয়ে যেতে চায়।

মানুষের জীবন খুব অদ্ভুত। তার চেয়ে বড় অদ্ভুত হলো ভালোবাসা।মানুষের জীবনে ভালোবাসা কখনো বলে কয়ে আসে না।ভালোবাসা হয়ে যায়।ভালোবাসা কারো জীবনে সুখকর হয়ে আসে আবার কারো জীবনে দুঃখ নিয়ে আসে।ধারার জীবনে ভালোবাসা দুঃখ নিয়েই এসেছিলো।শ্রাবণকে ভালোবেসে ধারা মানসিক যন্ত্রণা আর দুঃখ ছাড়া কিছুই পায়নি।তবুও সে শ্রাবণকে ভালোবাসে।তাদের শ্রাবণ-ধারার কাহিনীতে হয়তো হ্যাপি এন্ডিং লেখা ছিলো না।সবার ভালোবাসা তো আর পূর্বতা পায় না।তাদের শ্রাবণ-ধারার কাহিনীও অপূর্ণই থাক।

সিজন-০১ সমাপ্ত।