শ্রাবণ ধারা-২ পর্ব-০৪

0
613

#শ্রাবণ_ধারা-২
#পর্ব-৪
#সাদিয়া

ধারা নিজের কেবিনে নাজমুলকে দেখে অবাক হয়। সে নাজমুলকে এখানে কল্পনা করেনি। ধারা ভাবছে নাজমুল তার দেশে আসার খবর কিভাবে জানলো?

—কেমন আছো ধারা?

—জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?

—আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তা কবে দেশে আসলে?

—ওই তো তিন দিন হলো।

—জানালে না তো আমাদের?

—আমি কাউকেই জানাই নি ভাইয়া।

—বুঝতে পারছি আমি তোমার অবস্থাটা। তোমার আর কি দোষ বলো। নিজের আপন মানুষগুলো যদি অন্যের কথায় ভুল বোঝে। দূরে সরিয়ে দেয়।
নাজমুলের কথা কটা গায়ে নুনের ছিটার মতো কাজ করলো। ধারার পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে উঠলো। কিন্তু সে তা নাজমুলের সামনে প্রকাশ করলো না। নাজমুল একবার আড়চোখে ধারাকে দেখে নিলো। আসলে সে ধারার ভাবগতি বোঝার চেষ্টা করছে।

—আচ্ছা ধারা তোমার ডিউটি আওয়ার কখন শেষ হবে?

ধারার একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
—অলরেডি বিশ মিনিট ওভার।

—তো বের হচ্ছো কখন?

ডেস্ক থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে ধারা বললো,এইতো এখনই বেরিয়ে যাবো।

—দেট’স গ্রেট! চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

—তার দরকার পরবে না ভাইয়া। আমি ম্যানেজ করে নেবো। তার উপর তিথিকেও পিক করতে হবে।

—সমস্যা নেই ওকেও আমাদের সাথে নিয়ে নেবো। তুমি চলো তো চলো।

ধারা আর না করতে পারলো না। রাজি হয়ে গেলো নাজমুলের সাথে যাওয়ার জন্য। এতে নাজমুল বিশ্বজয়ের হাসি দিলো।

ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙে শ্রাবণের। ফোনের স্ক্রিনে ‘Rasel’ নামটা ঝলঝল করছে। শ্রাবণ ঝটপট ফোনটা তুলে কানে দিলো। ওপাশ থেকে রাসেল কিছু বলতেই শ্রাবণ রেগে ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিলো। রাগে তার কপালের রগগুলো ভেসে উঠেছে চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।

—এই মেয়ের সমস্যাটা কি? এই মেয়ে ঝামেলার কাছে যায় না ঝামেলা এর কাছে আসে আমি বুঝতে পারি না। আমি যত তাকে ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে চাই সে ততই ধেইধেই করে ঝামেলার কাছে চলে যায়।রিডিকিউয়াস।

শ্রাবণ জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলো। অতঃপর সে গাড়ি ঘুরালো। শ্রাবণ যতই নিজেকে শান্ত রাখতে চাইছে ততই
অত যেন তার রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
—কাম ডাউন শ্রাবণ কাম ডাউন। এতো রাগে যাওয়ার মতো কিছু হয় নি। এটা নরমাল বিষয়। এটা নিয়ে এতো প্যানিক করার কিছু হয় নি। আরে ধুর কি প্যানিক করবো না। এটা কি প্যানিক করার মতো বিষয় না? যদি এখন সে ওর কিছু করে দেয়? না না কিসব ভাবছি আমি। মাথাটা গেছে একেবারে।

শ্রাবণ কাউকে একটা ফোন করলো।
—শোনো ওদের ফোলো করো। ওদের প্রত্যেকটা মুভমেন্টের আপডেট আমার চাই।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো।
—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সকল প্রমাণ যোগাড় করতে হবে। সে নিজের চাল চেলে দিয়েছে। আমাকে যা করার খুব দ্রুত করতে হবে।

তিথির ক্লিনিকের সামনে এসে গাড়ি থামায় নাজমুল। তিথি আসছে না বলে ধারা তিথিকে ফোন করে।

—হ্যালো! তিথি কোথায় তুই? আর কতক্ষণ?

—তুই চলে যা ধারা। আজকে আমার দেরি হবে। আসলে ক্লিনিকে আজকে একটু চাপ আছে।

—আচ্ছা ঠিক আছে।

—কি বললো তিথি?

—ওর দেরি হবে। আমাদের চলে যেতে বললো।

ধারার কথা শুনে নাজমুল খুশি হলো। সে খুশি মনে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
—ধারা নদীর পাড়ে যাবে?

—না ভাইয়া। আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন।

—আরে চলোই না। তোমার ভালো লাগবে। তোমাকে কেমন যেন ডিস্টার্ভ লাগছে তাই বলছিলাম আরকি।

কিছু একটা ভেবে ধারা রাজি হলো। নাজমুল যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলো। কিছুক্ষণ বাদে গাড়ি একটা নদীর সামনে এনে দাঁড় করালো নাজমুল। ধারা আর নাজমুল দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। ধারা এক মনে নদীর জলের দিকে তাকিয়ে আছে।কতো স্বচ্ছ পানিগুলো। পানিতে তার চেহারাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ধারা নদীর পাড় ঘেঁসে চোখ বন্ধ করে বসলো। সে মূহুর্তটা অনুভব করছে। অপরদিকে নাজমুল ধারার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে এতো বছরের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে ধারাকে দেখে। মেয়েটার মধ্যে এমন কি আছে যা তাকে এতো প্রবলভাবে আকর্ষণ করে? মেয়েটাকে এতো দেখার পরেও তার তৃষ্ণা মেটে না।
—খুব তাড়াতাড়ি তুমি আমার হবে ধারা। তৃতীয় পক্ষ আর আমাদের মাঝে আসবে না। আমি আসতে দেবো না।

আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তারা চলে আসে। ধারাকে তিথিদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে নাজমুল চলে যায়। আজকের দিনের শেষটা নাজমুলের খুব ভালো কেটেছে। আর ভালো যাবেই না কেন? আজকে সে তার প্রেয়সীর সাথে সময় কাটিয়েছে। এটা তো তার কতো বছরের স্বপ্ন ছিলো। সে নিজের প্রেয়সীর সাথে নদীর পাড়ে একান্তে কিছু সময় কাটাবে। আজকে তার চাওয়া কিছুটা পূর্ণ হলো। সে নিজের প্রেয়সীর সাথে একসাথে থাকতে চায়। এক সাথে নিজেদের বার্ধক্য কাটাতে চায়! আর সে নিজের চাওয়া পূরণ করবেই করবে সে যাই হয়ে যাক হোক না কেন।

রাত নয়টায় বাসায় আসে শ্রাবণ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাকে তিন দিনের জন্য সিলেট যেতে হবে। যাওয়ার আগে এখানকার সবকিছু ঠিক করে যেতে হবে।
—এই প্রথমবার এতো ভয় করছে। আমি না থাকা অবস্থায় যদি সে যদি নিজের কাজটা করে দেয় তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে। উফ এখনই কাজ পড়তে হলো। যেতে সাহস পাচ্ছি না আর না গেলেও হচ্ছে না। এই রাসেল কোনো কাজ ঠিকঠাক ভাবে করতে পারে না। ওর প্রতিটা ভুলের জন্য আমাকে ঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু যদি রাসেল না থাকতো তাহলে আমার কি হতো আল্লাহ্ তায়ালা জানে।

এর মধ্যেই শ্রাবণের ফোন বেজে উঠলো। রাসেল ফোন করেছে। শ্রাবণ ফোনটা কানে ধরতেই তার চেহারার রঙ পাল্টে গেলো। তার মুখশ্রীতে বিস্ময় স্পষ্ট!

—কি বলছো রাসেল?

—জ্বী স্যার। একেবারে পাক্কা খবর। কোনো ভেজাল নেই।

—তার মানে বুঝতে পারছো রাসেল? কতোগুলো জীবন সংকটে আছে!

—চিন্তা করবেন না স্যার আমরা সবাইকে বাঁচিয়ে নেব।

—আর ইউ শিউর রাসেল?

—জ..জ্বী স্যার।

—তোতলানো আমার একদম পছন্দের নয় রাসেল এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। সো ডোন্ট ডো দিস।

—সরি স্যার।

—আচ্ছা শুনো উনাকে কোথায় পাওয়া যাবে? মানে এড্রেস জানো?

—একজেক্ট এড্রেস জানি না। তবে প্রাথমিক খবর অনুযায়ী তিনি সিলেটে তার বাবার বাড়িতে আছে।

—দেট’স গুড। আমিও কাল তিন দিনের জন্য সিলেট যাচ্ছি। ওখান থেকে সব কাজ সেরেই আসবো।

—আপনি একা যাবেন স্যার?

—প্রথমে ভেবেছিলাম একা যাবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একা যাওয়াটা ঠিক হবে না।

—আমি আসবো স্যার?

—না তুমি এখানে থেকে সবটা দেখবে। আমি রকিকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি রকিকে ইনফর্ম করে দাও।

—জ্বী স্যার।

ফোনটা কেটে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে গেলো শ্রাবণ।
—একটা মানুষ এতো জঘন্য কিভাবে হতে পারে। এত বড় জঘন্য একটা পরিকল্পনা করতে একবারো বুক কাপঁলো না। সে মানুষ নাকি জানোয়ার।

ক্লান্তিতে একসময় শ্রাবণ ঘুমিয়ে গেলো।

ধারাকে একের পর এক প্রশ্ন করে এক প্রকার অতিষ্ঠ করে তুলেছে তিথি।
—তুই কি দয়া করে একটু চুপ করবি তিথি?

—তুই আমাকে সবটা বল আমি চুপ করে যাবো।

—কি বলবো?

—তুই নাজমুল ভাইয়ের সাথে কি করছিলি? আর তোর আসতে দেরি হলো কেন?

—বললাম তো আমরা নদীর পাড়ে গেছিলাম তাই দেরি হয়েছে।

—তুই ভুলে গেছিস ধারা আট বছর আগে নাজমুল ভাইয়ের জন্য কতোবড় সমস্যা হয়েছিলো?

—নাজমুল ভাইয়ের জন্য নয় তিথি। সবটাই হয়েছিলো শ্রাবণ স্যারের জন্য। এখানে তো আমি নাজমুল ভাইয়ের কোনো দোষ দেখছি না।

তিথি কিছু বলতে যাবে তার আগেই ধারা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে যায়। তিথি ধারার দিকে তাকিয়ে কিয়ৎক্ষণ কিছু একটা ভেবে সেও শুয়ে যায়।

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নেয় শ্রাবণ। রকিকে একটা ফোন করে সে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে রাসেলকে এখানকার সকল কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যায়।
গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে শ্রাবণ। রকি ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকে শ্রাবণকে দেখছে।

—আমাকে না দেখে রাস্তার দিকে দেখো রকি। আমি এতো তাড়াতাড়ি আল্লাহ্ পেয়ারা হতে চাই না।

—আচ্ছা স্যার আমরা হঠাৎ সিলেট কেন যাচ্ছি?

—আমরা না তুমি যাচ্ছো হঠাৎ করে। আমার তো আগে থেকেই ওইখানে কাজ ছিলো।

—আমার কি কাজ স্যার?

—একজন মহিলাকে খুঁজতে হবে।

—মহিলা? স্যার আপনি বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছেন?

—রকি!

—সরি স্যার।
দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা হলো না।

সকাল আটটায় ধারা হাসপাতালের জন্য বাসা থেকে বের হয়। তিথির ক্লিনিকে কাজ থাকায় সে আরো আগে চলে গেছে। ধারাকে আজ একা যেতে হবে। বাসার নিচে আসতেই ধারা দেখতে পায় নাজমুল গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধারাকে আসতে দেখে সে ধারার দিকে এগিয়ে যায়।
—গুড মর্নিং ধারা।

—গুড মর্নিং ভাইয়া।

নাজমুল মুখ বাঁকালো। ভাইয়া শব্দটা নাজমুলের মনে হলো না খুব একটা পছন্দ হয়েছে। নিজের বিরক্তি এক পাশে রেখে মিষ্টি হেঁসে ধারাকে বললো,
—হাসপাতালে যাচ্ছো ধারা?

—জ্বী ভাইয়া।

—চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

—তার দরকার হবে না। আমি চলে যেতে পারবো।

—আরে চলো না ধারা। তুমি যদি না যাও তবে আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাবো ধারা।
অগত্যা ধারা নাজমুলের সাথে যেতে রাজি হলো। নাজমুল ধারারকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো নিজের কাজে।

ধারা নিজের কেবিনে বসে পেশেন্ট দেখছে। শ্রাবণ নেই তাই রুগীর চাপ পড়েছে। হাসপাতালে একজন ডাক্তার না থাকলে তার চাপ পরে পুরো ডিপার্টমেন্টের ডাক্তারের উপর। ধারা বসে বসে ভাবছে হঠাৎ কি এমন কাজ পড়লো শ্রাবণের যে আর্জেন্ট সিলেট যেতে হলো। কালকেও তাকে কেমন চিন্তিত লাগছিলো।

—কেন ভাবছি আমি তার কথা? কেন ভাবছি? তার কথা ভাবার জন্য তো তার বউ রয়েছে তাহলে আমি কেন তার কথা ভাবছি। কিন্তু উনি কি নিয়ে এতো চিন্তিত ছিলেন?

—ডা.ধারা?

—জ্বী ডা.রাফি?

—ডা.সৈকত আপনাকে একটা সার্জারীর জন্য ডাকছে।

—জ্বী আমি আসছি।

ডা.রাফির পিছন পিছন ধারাও ডা.সৈকতের কেবিনের কাছে গেলো।

সিলেটে এসে আগে হোটেলে যায় শ্রাবণ। রুম বুক করে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নেয় সে। খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় রকিকেও নিয়ে যায় সাথে করে। রকি চলে যায় নিজের গোয়েন্দাগিরি করতে আর শ্রাবণ যায় ডাক্তারি করতে!

#চলবে….ইনশাআল্লাহ