শ্রাবণ ধারা-২ পর্ব-২+৩

0
640

#শ্রাবণ_ধারা-২
#পর্ব-২_৩
#সাদিয়া

নিজের কেবিনে বসে আছে ধারা। ডাক্তার হিসেবে আজ তার প্রথম দিন। এর আগে জার্মানে এক বছর প্র্যাকটিস করেছে কিন্তু ওই ভাবে নিজের কেবিনে বসে তার পেশেন্ট দেখা হয় নি। আজকে তার জন্য বিশাল বড় একটা দিন। ধারার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। সেই সাথে তার একটু মনটাও খারাপ। করণ তার এমন আনন্দের দিনে তার পরিবার তার পাশে নেই। নেই বললে ভুল হবে! কারণ ধারা নিজেই চায় না তার পরিবার তার সাথে থাকুক। আর তাই তো তার দেশে আসার কথা আবির ছাড়া কেউ জানে না। এই আট বছরে তার পরিবারের সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখেনি সে। বাবা-মা তার সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে সে যত্ন করে এড়িয়ে গেছে। পরিবারের সাথে তার দূরত্বটা অনেক। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধারা।
—মিস ধারা আসবো?

—জ্বী আসুন।

অনুমতি নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে শ্রাবণ আর ডা.সৈকত।

—মিস ধারা উনি হচ্ছেন ডা.সৈকত। আজ থেকে উনি আপনাকে গাইড করবেন। আপনার যে কোনো সমস্যা আপনি উনার সাথে আলোচনা করতে পারেন।

ধারা শ্রাবণের ব্যাবহারে অবাক হলো। কারণ শ্রাবণ তার সাথে একজন অপরিচিতের মতো আচরণ করছে। ধারা এর মানে বুঝতে পারলো না।
—থাক ভালোই হয়েছে। এটা আমাদের কাজের জায়গা এখানে পার্সোনাল প্রবলেম গুলো না টানাই বেটার।

—মিস ধারা আমি কি বলেছি আপনি শুনেছেন?

—জ্..জ্বী শুনেছি।

—আপনি কি তোতলা?
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে প্রশ্নটা ধারার দিকে ছুড়ে দিলো শ্রাবণ। ধারা ভ্রু কুঁচকালো। ধারা বুঝতে পারছে না সে তোতলা কেন হতে যাবে।

—আমি কেন তোতলা হতে যাবো?

—সেটা তো আমার থেকে ভালো আপনি জানবেন। যে পরিমান তোতলান আপনি পেশেন্টদের সাথে কিভাবে ডিল করবেন? আপনাকে তো সার্টিফিকেট দেওয়াই উচিত হয় নি। যত্তসব।
এতটুকু বলেই শ্রাবণ হনহন করে কেবিন থেকে চলে গেলো। ধারা শ্রাবণের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

—ওর কথায় কিছু মনে করো না ধারা।

ধারা এবার ডা.সৈকতের দিকে তাকালো।
—তোমায় তুমি করে বললাম কিছু মনে করো না। তুমি আমার বয়সে ছোটই হবে আর তুমি তো আমার ছোট বোনের মতোই! আর তাছাড়া তোমার বড় ভাই আবির আমার বন্ধু। আমরা এক সাথে স্কুল পাশ করেছি।

ধারা কিছু বললো না। সে তো শ্রাবণের এহেম ব্যাবহারের মানে খুঁজছে।

—আচ্ছা ধারা আমি যাই। আমার আবার এক ঘন্টায় একটা ওটি আছে। তুমি পেশেন্ট দেখো।
কয়েক কদম গিয়ে পেছন ফিরে ডা.সৈকত ধারাকে বলে,
—তুমি কি সার্জারিটা এ্যাটেন্ট করতে চাও ধারা?

ডা.সৈকতের প্রস্তাবে খুশি হলো ধারা। এটা তার জন্য বিশাল বড় সুযোগ। নিজের কর্ম জীবনকর প্রথম দিন-ই সার্জারির অফার পাওয়া কোনো ছোট কথা নয়!

ওটিতে যাওয়ার জন্য খুশি মনে তৈরি হচ্ছে ধারা। সে ভীষণ এক্সাইটেড! কিন্তু ধারা এই খুশি বেশিক্ষণের জন্য ছিলো না। তার একমাত্র কারণ হলো শ্রাবণ! ধারা যখন ওটির জন্য তৈরি হচ্ছিল তখন আগমন ঘটে শ্রাবণের। ধারাকে ওটির জামা পরিহিত অবস্থায় দেখে ভ্রু কুঁচকায় শ্রাবণ। অতঃপর ডা.সৈকতকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—মিস ধারা এই পোষাকে কেন সৈকত?

—এখন আমার একটা ওটি আছে। আর ওটাতে ধারা আমাকে এ্যাসিস্ট করবে শ্রাবণ।

—এর আগে কখনো সার্জারী এ্যাটেন্ট করেছেন উনি? মিস ধারা?

ধারা নিচু স্বরে জবাব দেয়,
—না।

—মিস ধারাকে সার্জারী দেখার জন্য নিয়ে যাও সৈকত। আর তোমাকে আজকে এ্যাসিস্ট করবে রাফি। মিস ধারার এ্যাসিস্ট করা দরকার নেই। পরে কোনো গন্ডগোল পাকালে দোষ হবে আমাদের। নাম খারাপ হবে আমাদের হাসপাতালের।
ডা.সৈকতকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে শ্রাবণ।
—দীপ দুই নম্বর ওটিটা বিশ মিনিটে রেডি করো। ইট’স আর্জেন্ট!
আর দাঁড়ালো না শ্রাবণ। ধারা শ্রাবণের যাওয়ার দিকে মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, আমার খুশি তার কোনো কালেই সহ্য হয়নি আর আজীবনেও হবে না।

—ধারা চলো সময় হয়ে গেছে। আর শ্রাবণের কথায় কিছু মনে করো না। শ্রাবণ একটু এরকমই!

ধারা কিছু না বলে সৈকতের পিছন পিছন চলে গেলো।

একঘন্টা পর ডা.সৈকত, ডা.রাফি আর ধারা ওটি থেকে বেরিয়ে আসলো। ডা.রাফি ধারাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—তা মিস ধারা কেমন ছিলো প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা?

ধারা স্মিত হেসে বললো,
—ভালোই ছিলো।

—আরে ধারা মন খারাপ করছো কেন। ছাড়ো তো আগের কথা।

ধারা কিছু না বলে নিজের কেবিনে চলে গেলো।

নিজের কেবিনে এসে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো ধারা। চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলো সে। আজকের সার্জারীটা এতো বেশি ক্রিটিকাল না হলেও এতোটা সহজও ছিলো না। এর আগে ধারার ওইভাবে কোনো সার্জারীতে এ্যাটেন্ট করা হয়নি। আজকের প্রথম দিনটা ভালোই গেলো তার। আরো ভালো যেতো যদি শ্রাবণ না থাকতো।

—ওই লোকের সমস্যা কি আমি বুঝলাম না। কেন করে এমন আমার সাথে? আমার ভালো কেন যে তার সহ্য হয় না। অসহ্যকর লোক একটা। তিথিকে একটা ফোন করি।
ধারা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তিথিকে যেই ফোন করতে যাবে ওমনি তিথির ফোন আসে। ধারা আলতো হেঁসে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিলো।

—চাকরি পেয়ে প্রথম দিনই আমাকে ভুলে গেলি ধারা? মনে রাখিস যখন তোর জীবনে জব ছিলো তখন আমি ছিলাম। জব আসতেই আমাকে ভুলে গেলি! অকৃতজ্ঞ বেইমান মেয়ে। ছলনাময়ী নারী!

তিথির পাগলের প্রলাপ শুনে হাসতে হাসতে ধারার পেটে খিল ধরে গেছে। হাসির জন্য ধারা কথা বলতেও পারছে না।
—ওহে বালিকা এই ছিলো তোমার মনে? তুমি আমার মতো নিরীহ নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ের সাথে এমন কাজ কিভাবে করতে পারলে? বলো কিভাবে পারলে এমনটা করতে? আমার জবাব চাই।

ধারার হাসি বাড়ছে ছাড়া কমছে না।

ধারার কেবিনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সাময় হাসির শব্দে শ্রাবণের পা জোড়া থেমে গেলো। তার হৃদপিণ্ড অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পাম্প করছে। শ্রাবণ কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো। একটু দম নিয়ে সে ধারা কেবিনে উঁকি দিয়ে দেখলো ধারা ফোন কানে দিয়ে খিলখিল করে হাসছে। মূহুর্তেই শ্রাবণের যেন হার্টবিট থেমে গেলো। সে হারিয়ে গেলো কোনো এক মায়াবতী রমণীর হাসির মাঝে। বহুকাল আগে এই হাসির মায়াতেই তো পড়েছিলো সে! শ্রাবণ বুকের বা পাশটায় হাত রাখলো। নিজেকে কোনো রকম সামলে অতন্ত্য গম্ভীর কণ্ঠে ধারাকে ডাক দিলো,
—মিস ধারা!

কারো গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ধারা কান থেকে ফোনটা নামিয়ে দরজার দিকে তাকালো। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটা প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি গম্ভীর আর থমথমে দেখাচ্ছে।

—জ্বী স্যার।

—মনে রাখবেন এটা হাসপাতাল কোনো পাগলাগারদ নয় যে আপনি এভাবে হাসবেন। আর এখানে অনেক ধরনের মানুষ আছে। এদের মধ্যে কেউ যদি আপনার হাসির শব্দ শুনে হার্ট এটাক করে মারা যায় তার দায়ভার কি আপনি নেবেন? তাই ভালোর জন্য বলছি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এটা হাসপাতাল এখানে এভাবে পেত্নীদের মতো করে হাসার কোনো দরকার নেই।

আর দাঁড়ালো না শ্রাবণ। সোজা চলে গেলো নিজের কেবিনে। নিজের কেবিনে গিয়ে এক ঢোকে গ্লাসের পানি শেষ করলো শ্রাবণ।

—বাবারে বাবা এই মেয়ে কি এতবছর পর আমাকে মারার জন্য ফিরে এসেছে নাকি? রিভেঞ্জ নিতে চাইছে আমার থেকে। সে তো জানে তার হাসি আমার দূর্বলতা। তাই তো হাসে এভাবে। না না এ-ই মেয়ের থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। নয়তো প্রলয় হয়ে যাবে।
চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো শ্রাবণ। তার মাথায় এখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আট বছর পর সে নিজের অতীতের মুখোমুখি হয়েছে। এটা যে কোনো শুভ সংবাদ নয় তা শ্রাবণ জানে। এখন যদি আট বছর আগের ঘটা ঘটনা কেউ ঘাটতে যায় তাহলেই বিপদ! ঘোর বিপদ!

—না না না কিছুতেই অতীতকে বর্তমানে আনা যাবে না। অতীত বর্তমানে আসলে সব শেষ হয়ে যাবে। আট বছর আগে তো যেনতেন ভাবে সব আড়াল করেছিলাম। কিন্তু এখন? এখন কিভাবে কি করবো আমি? সে যদি একবার জানতে পারে ধারা ফিরে এসেছে তাহলে সে আবারো ওই নোংরা খেলায় নামবে। কিভাবে কি করবো আমি? উফফ পাগল হয়ে যাবো আমি। কেন ধারা কেন? কেন তুমি দেশে আসতে গেলে? কেন আসলে দেশে? দেশে আসা তোমার উচিত হয়নি। উচিত হয়নি আসা।

—কার আসা উচিত হয়নি শ্রাবণ ডার্লিং?

কারো আওয়াজ পেয়ে শ্রাবণ চোখ তুলে তাকালো। তাকাতেই শ্রাবণ বিরক্ত হলো। যা তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

—কি হলো শ্রাবণ কথা বলছো না কেন?

—তুমি এখানে কেন এসেছো রুশা?

রুশা নামের মেয়েটি শ্রাবণের গলা জরিয়ে ধরে বললো
—কেন আমি আসতে পারি না তোমার কাছে?

—কি করছো রুশা? ছাড়ো। ভুলে যেও না এটা হাসপাতাল।

—তো কি হয়েছে? আমি কি অন্য কাউকে ধরেছি নাকি। আমি তো আমার হবু বরকে ধরেছি।

—স্যার এই ফাই….

আর কিছু বলতে পারলো না ধারা। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীর যেন অসার হয়ে আসছে। ধারা উল্টো পায়ে শ্রাবণের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। আর শ্রাবণ ধারার যাওয়ার দিকে নিশ্চুপ ভাবে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ বুঝতে পারছে না তার কি ধারার পিছন পিছন যাওয়া উচিত কি না! হঠাৎ শ্রাবণের মাথায় একটা প্রশ্ন এলো, “আচ্ছা ধারা কি আমাকে আর রুশাকে এইভাবে দেখে কষ্ট পেয়েছে? কান্না করছে সে? কিন্তু সে কষ্ট কেন পাবে? কান্না কেন পাবে তার? তার তো এতে কোনো ইফেক্ট পড়ার কথা না। তবে আমি কেন তার চোখে জল দেখতে পেলাম? কেন মনে হচ্ছে সে কষ্ট পেলো?”

—দেখলে কেমন বেয়াদব মেয়ে। একে তো নক করে আসেনি তার উপর সরি না বলেই চলে গেলো। ও কে বলোতো?

—ও এখানকার নতুন ডাক্তার। তুমি এখান থেকে যাও রুশা। আমার জরুরি কিছু কাজ আছে।

রুশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শ্রাবণ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। রুশা শ্রাবণের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। পারিবারিক ভাবে রুশা আর শ্রাবণের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তিন বছর আগে থেকেই। এই বিয়েতে শ্রাবণের মত আছে কি না তা জানে না রুশা। শ্রাবণ তাকে পছন্দ করে কি না এটাও জানে না রুশা। তবুও রুশা শ্রাবণকে ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। যাকে বলে অন্তহীন ভালোবাসা!

#চলবে…ইনশাআল্লাহ

#শ্রাবণ_ধারা-২
#পর্ব-৩
#সাদিয়া

পুরো হাসপাতালে শ্রাবণ ধারাকে খুঁজছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। শ্রাবণ বুঝতে পারছে না ধারা কোথায় চলে গেলো। ধারার ডিউটি টাইমও শেষ হয়নি যে সে চলে যাবে। কোথায় আছে ধারা? ধারাকে খুঁজতে খুঁজতে শ্রাবণ ক্লান্ত হয়ে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বাইরে বসে পড়ে। তার শরীর চলছে না আর। সাথে মাথাটাও চিনচিন ব্যাথা করছে। চোখ দুটো বন্ধ করলো শ্রাবণ। তখনই সে শুনতে পেলো পরিচিত এক কণ্ঠস্বর। শ্রাবণ ফট করে চোখ খুলে তাকলো। কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে শ্রাবণ সেদিকে এগিয়ে যায়।

—বাবু তুমি মেডিসিন কেন নিচ্ছে না? মেডিসিন সঠিকভাবে না নিলে তুমি ঠিক হবে কিভাবে বলো তো? আর ঠিক না হলে এই পঁচা জায়গা থেকে বেরুবে কি করে?

—সুস্থ না হলে পঁচা জায়গা থেকে বের হতে পারবো না?

—না সোনা পারবে না। ওই আঙ্কেলগুলো তোমাকে বের হতেই দেবে না। তাই জলদি জলদি মেডিসিন গুলো নাও আর পানি দিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নাও।

—কিন্তু ওগুলো তো মজা না।

—মজা না হলেও খেতে হবে। আচ্ছা তুমি যদি জেদ না করে সবসময় মেডিসিন নাও তাহলে আমি তোমাকে এত্তোগুলো চকলেট দিবো। এখন তিতলি বাবুর কি চকলেট চায়?

বাচ্চাটি জোরে জোরে মাথা ঝাকালো।
—তাহলে তো আগে মেডিসিনগুলো খেতে হবে।

ধারার কথায় তিতলি নামের বাচ্চাটি ওষুধ খেয়ে নিলো। বাচ্চাটির মা ধারার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ হাসি দিলো। তিতলিকে ঘুম পাড়িয়ে ধারা বাইরে বের হতেই দেখতে পেলো ওয়ার্ডের সামনে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণকে দেখেই ধারার তখনকার দৃশ্য মনে পড়ে গেলো। সাথে সাথে তার চোখ ভরে উঠলো তপ্ত অশ্রুতে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই ধারা তা মুছে নিলো। কিন্তু তা শ্রাবণের দৃষ্টিগোচর হয়নি। ধারা শ্রাবণের সাথে কোনো কথা না বলে প্রস্থান করে।
—আমি কেন সবাইকে এতো কষ্ট দি-ই? কেন সবাই আমার জন্য এতো কষ্ট পায়?

.
নিজের কেবিনে ফিরে এসে থেকেই অনবরত চোখ মুছে চলেছে ধারা। সে বুঝতে পারেছেনা তার এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? কেন সে এতো কষ্ট পাচ্ছে? তার তো কষ্ট পাওয়ার কথা না তবে কেন সে কষ্ট পাচ্ছে। কেন তার চোখের জল বাঁধ মানছে না।

—আমি আর কষ্ট পাবো না। পাবো না আর কষ্ট। সে তো নিজের জীবনে খুব ভালো আছে সুখে আছে তাহলে আমি কেন অতীত ধরে বসে আছি? কেন কষ্ট পাচ্ছি তার জন্য। আর কষ্ট পাবো না আমি তার জন্য। তার জন্য আর চোখের জল বিসর্জন দেবো না। অনেক হয়েছে আর না।

ডিউটি আওয়ার শেষ হতেই ধারা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পথে সে ক্লিনিক থেকে তিথিকে পিক করে।

—প্রথম দিন কেমন কাটলো ডা.ধারা?

ধারা নিশ্চুপ।
—কি হলো ধারা কথা বলছিস না কেন? প্রথম দিন কেমন কাটলো।

কিয়ৎকাল নিরবতা পালন করে শান্ত কণ্ঠে ধারা বলে,
—শ্রাবণ স্যার বিয়ে করে নিয়েছে তিথি।
ধারার কথায় তিথি অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। ধারার মুখশ্রী তখনও বেশ শান্ত।
—এ কথা তোকে কে বলেছে ধারা?

—আজকে হাসপাতালে তার বউ এসেছিলো।

—শ্রাবণ ভাই তোকে বলেছে ওটা তার বউ ছিলো?

—বলতে হবে কেন তিথি? আমি কি কোনো বাচ্চা নাকি। একটা মেয়ে তো আর এমনি এমনি তার কোলে উঠে তার গলা জরিয়ে ধরে বসে থাকবে না। তাই না?

—তার মানে তোকে তিনি বলেনি যে ওটা তার বউ ছিলো।
এবার ধারা বিরক্ত হয়।
—না।

তিথি যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

.
রাতে খাবার পর্ব শেষ করে রুমে আসে ধারা আর তিথি। তিথি বিছানা করছে ঘুমাবে বলে। আর ধারা নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।

—এই ধারা কি করছিস?

ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই ধারা জবাব দিলো,
—বাসা খুঁজছি।

—বাসা খুঁজছিস মানে?

—বাসা খুঁজছি মানে বাসা খুঁজছি। এখানে আর কতোদিন থাকবো বল।

—এখানে থাকতে তোর কি সমস্যা ধারা? এমনিতে তো বাসায় আমি আর আম্মুর থাকি। তোর কি এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে ধারা?

—না সমস্যা হবে কেন? এইভাবে এখানে থাকাটা কেমন দেখায় না।

—তুই আমাদের কি মনে করিস ধারা। তুই এখান থেকে গিয়ে কোথায় থাকবি? তোদের বাসায় তো যাবি না। একা থাকবি? এই শহরে একা থাকার মনে বুঝিস তুই? আর তুই চলে যাতে চাইবি আর আমরা তোকে যেতে দেবো। ভাবলি কিভাবে তুই। দেখ এইসব ফাউল চিন্তা ভাবনা ছেড়ে ঘুমাতে আয়। এখান থেকে তোর কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।

পরদিন সকালে যথাসময়ে হাসপাতালে চলে যায় ধারা। হাসপাতালে ঢুকতেই শ্রাবণের মুখোমুখি হয় সে। শ্রাবণকে দেখে একটু অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছে রাতে ঘুম হয়নি তার। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে তার সাথে ফুলেও আছে। ধারা বেশি মাথা না ঘামিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেলো। লাঞ্চ টাইমের আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা পেশেন্ট দেখা হয়ে গেছে তার। লাঞ্চ টাইমে সে হাসপাতালের ক্যাফেটরিয়ায় বসে এক কাপ কফি হাতে। ধারা কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে চর আশপাশটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে। তার দুই টেবিল পরেই শ্রাবণ বসে আছে। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। মনে হচ্ছে কোনো টেনশনে আছে। ধারা ভ্রু কুঁচকায়।

—তুমি আমাকে একথা এখন বলছো ইডিয়েট। তোমাকে আমি মাসে মাসে টাকা কেন দি? উফফ রাসেল তুমি বুঝতে পারছো না সে এখন বসে থাকবে না। আমি তাকে খুব ভালো করে চিনি। বসে থাকবে না সে। সে যে কি কি করতে পারে তার ডেমো সে আট বছর আগে দেখিয়েছে। আমি এখন কি করবো রাসেল। কি করা উচিত আমার?

ওপাশ থেকে কি বলা হয়েছে তা শুনতে না পেলেও শ্রাবণের প্রত্যেকটা কথা ধারা শুনেছে।

—সত্যটা কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় তোমার? তাও এতোগুলো বছর পর? আর আমার কাছে কি প্রমান আছে? আছে কোনো প্রমান? না নেই! এখান আমার কিছু করার নেই। সে কি করবে এটাই শুধু দেখে যেত হবে এখন আমাদের। আর একটা কথা তুমি কিন্তু তার দিকে টুয়েন্টি ফোর সেভেন আওয়ার নজর রাখবে। মনে রাখবে নাজার হাটি তো দূর্ঘটনা ঘাটি!

ফোনটা কেটে শ্রাবণ পকেটে ঢুকিয়ে কফির কাপে চুমুক দিতেই তার কপালে বিরক্তির ভাজ পড়লো। কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। শ্রাবণ আরো একটা কফি অর্ডার করলো।

অপর দিকে ধারা শ্রাবণের বলা কথাগুলো ভাবছে। সে ভাবতে চাইছে না কিন্তু তবুও সে ভাবছে। কি হয়েছিলো আট বছর আগে? আট বছর আগে তো শুধু শ্রাবণ স্যার আমাকে মিথ্যা অপবাদই দিয়েছিলো। আর কি ঘটেছিলো? আর তিনি কার কথা বলছেন? কে কি করবে? তিনি কাকে এতো ভয় পাচ্ছেন? উফফ কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কি হচ্ছে এসব।

কফির সাথে হালকা কিছু খেয়ে ধারা নিজের কেবিনে ফিরে যায়। কেবিনে আসতেই তার পা থেমে যায়। এতোগুলো বছর পর সে এই মানুষগুলোকে দেখছে। আচ্ছা কেমন আছে তারা? ভালো আছে তো তাকে ছাড়া?

—ধারা!

বাবার ডাকে ধারার শরীরটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু সে কোনো কথা বলে না।

—কথা বলবি না মা?

—কেমন আছো তোমরা?

—আমরা আছি।

—তা এখানে কি মনে করে?

—দেশে আসার পর তো একবারো আমাদের সাথে দেখা করতে আসলি না তাই আমরাই এলাম।

ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

—এখনও আমাদের ক্ষমা করতে পারিসনি তাই না?
মলিন কণ্ঠে কথাটা বলে ধারার বাবা।

—তোমাদের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই বাবা।

—তাহলে ফিরে চল।

—না বাবা এটা সম্ভব নয়। আমি ওই বাড়িতে ফিরতে পারবো না।

—কেন পারবি না? ওটা তো তোর নিজের বাড়ি।

—না মা ওই বাড়িতে আমি যাবো না। অনেক কষ্টে আমি নিজের কালো অতীত থেকে বেরিয়েছি। হয়তো পুরোটা না। তবে আমি ওই বাড়িতে ফিরতে পারবো না। ওই বাড়িতে গেলেই আমার সাথে ঘটা প্রত্যেকটা নির্মম ঘটনা আমার মনে পড়ে যাবে। আর আমি চাই না তা ঘটুক।

ধারার বাবা-মা তাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ধারা নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ়। ব্যার্থ হয়ে ধারার বাবা-মা চলে গেলো।
বাবা-মা চলে যেতেই চেয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে ধারা।
—কেন শ্রাবণ স্যার কেন? কেন এমন করলেন আমার সাথে? কেন এতোবড় শাস্তি দিলেন আমাকে? আপনাকে ভালোবাসার জন্য এমন শাস্তি পাবো জানলে কখনো আপনাকে ভালোবাসতাম না আমি। কখনও না।

ধারার কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধারার কথাগুলো শুনলো শ্রাবণ। ধারার বাবা-মাকে চোখে পানি নিয়ে চলে যেতে দেখে প্রচন্ড রাগ নিয়ে ধারার কেবিনে আসছিলো শ্রাবণ। কিন্তু ঢোকার আগে ধারার কথাগুলো শুনে সে আর ভেতরে ঢুকলো না।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শ্রাবণ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। গাড়ি চালিয়ে শহর থেকে অনেকটা দূরে চলে আসলো সে। একটা খোলা জায়গায় গাড়ি থামালো। গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে শ্রাবণ।
—আমি কেন এতো অভাগা? কেন? ভালোবাসা কি কোনো অপরাধ? কেন আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না? কেন পায় না? আমার কি ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই? কেন সবসময় আমার সাথেই এমন হয়? আমার তো কোনো দোষ ছিলো না তবে কেন আমি আজ সবার চোখে দোষী? আমি যা করেছিলাম সব তো নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে করেছিলাম। তবে কেউ আমাকে কেন বুঝলো না? কেন বুঝলো না?
এক পর্যায়ে শ্রাবণ গাড়িতে ঘুমিয়ে যায়।

আপরদিকে নিজের কেবিনে বসে চোখের জল ফেলছে ধারা। এমন সময় কারো ভরাট কণ্ঠে কানে আসে তার।
—ধারা?

চোখের জল মুছে সামনে তাকাতেই সামনের লোকটিকে দেখে ধারা অবাক হয়। এই সময় তাকে এখানে ধারা কল্পনা করেনি।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ
(শ্রাবণকে কি শাস্তি দেওয়া যায়?)