সঞ্চারিণী পর্ব-১৫

0
449

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

১৫.
তৌকির উল্লাহ টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু এই নিয়ে ছ’টা বের করে কপাল মুছলেন।শেষেরটা হাতে নিয়ে মেধাকে ডাকলেন শাওনের পাশে এসে বসতে।
মেধা এক পা এক পা করে এসে হাজির হয়েছে।কোনো মতে চেয়ার টেনে বসেও পড়েছে সে।তৌকির উল্লাহ বললেন,’তো বলো শাওন তুমি রশ্নিকে কিরকম দেখো?মানে তাকে কি একজন মৃত ব্যাক্তি মনে হয় নাকি স্বাভাবিক মানুষ?সাদা সাদা,অথবা অতিমাত্রায় কালো।হলদে ভাব ইত্যাদি।যেটা দেখতে অস্বাভাবিক মনে হয় আর কি।’

-‘একদমই না।তাকে আমি আগের রশ্নির মতনই দেখি।কোনো খুঁত নেই তাতে’

মেধা ঢোক গিলে বললো,’অবজেকশান মাই লর্ড থুক্কু শাওন স্যারের ডাক্তার!আমার একটা কথা আছে,আমি তো উনার ভূতুড়ে প্রেমিকাকে দেখি না।শুধু সে যা যা করে সেগুলো দেখি।কলম ধরলে শূন্যের উপর কলম দেখি।তার হাত তো দেখিনা’

তৌকিরউল্লাহ নড়েচড়ে বসলেন।কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন এটা কেন হয়।
শাওন ও চিন্তায় পড়লো।রশ্নি কি করে না করে সেসব মেধা দেখে কিন্তু রশ্নিকেই সে দেখেনা।অনেক কঠিন হয়ে গেলো প্যাঁচটা।তৌকির উল্লাহ রহস্যর সমাধান করতে পারলেন না।প্রতিউত্তরে বললেন তিনি একজন ডাক্তার।সিআইডি নন।ঔষুধ লিখে দিলেন।কড়া ডোজের।শুধু ঘুমাতে হবে তার প্রথম শর্ত।শাওন মনে মনে অনেক হাসলো।সে সারাদিন কাজ করে ঘুমানের সময়টুকু বের করতে পারেনা আর এই ডাক্তার বলে কিনা কাজ ফেলে ঘুমাতে।এমন করলে তার চাকরিটা করবে কে?
মেধা বেরিয়ে দেখলো শাওন রশ্নির সাথে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে।দৃশ্যটা ওর মাথার উপর দিয়ে গেলো।কিছুই বুঝলোনা সে।
-‘এই ছেলেটা কি পাগল?তাহলে তো ঔষুধে কাজ হবার কথা না।এই যা দুপুর হয়ে গেলো!আমাকে তো রেডি হতে হবে’

মেধা ছুটে গেলো অফিসের দিকে।সেখানে এসে দেখলো সামিয়া ফিটফাট। একেবারে তন্নির ডুপ্লিকেট সেজে বসে আছে সে।মেধার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে এমনটা দেখে।সে চেয়েছিলো তন্নি সাজবে, তা আর হলো কই।
-‘এখন শেষ রক্ষা হলেই হয়।কিন্তু সামিয়ার উপর এত বড় দায়িত্ব মোটেও মানাচ্ছেনা।ওর জন্য আজকে প্রাণহানি ঘটে যেতে পারে।শাওন স্যার আমাকে পছন্দ করেননা বলে ওর মতন দূর্বল একজনকে দায়িত্বটা দিলো।এটা করে উনি নিজেরই ক্ষতি ডেকে এনেছেন।’

শাওন আজ অফিসে এসেছে বিকেলে।আসতেই মিডিয়ার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে তাকে।তারা সবাই স্বচক্ষে দেখতে চান তন্নি কি কি বলে সব কিছুর উত্তরে।
শাওন রাজি হলো।ডাকা হলো তন্নির সাজে সামিয়াকে।পরনে সাদা থ্রি পিস।লম্বা চুল।হাঁটু অবধি।মাথায় বড় ঘোমটা টানানো।হাতে এক ডজন চুড়ি।
সেখানে সামনে বিশ ত্রিশ জন সাংবাদিক বসে আছেন।শাওন একটা সোফায় আর তার সামনের সোফায় সামিয়া বসেছে তন্নি সেজে।শাওন বার তাকাচ্ছে ওর দিকে।কেন যেন সামিয়া মনে হচ্ছেনা।অনেকটা মেধার মতন লাগছে নাকটা একেবারে বলে দিচ্ছে এটা মেধা।
কিন্তু সে হবে কেন।সামিয়া তো হাল ছেড়ে দেবার মতন মেয়ে না।আর মেধা এত সাহস করবেনা।
নুহাশ ইশারা করলে প্রশ্ন করার জন্য।ইশারা করেই সে চলে গেলো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে।কে আসলো আর কে গেলো দেখতে হবে।
শাওন ঘুরে বসে বললো,’আপনি আশার বান্ধুবী?’

-‘জ্বী’

-‘আপনার আর আশার বন্ধুত্ব্ব কত দিনের?’

-‘পনেরো বছর’

-‘তাহলে তো খুব ভালো করে চেনেন।কখনও কি এখানে আসা হয়েছিলো?আই মিন আশার বাসায়।’

-‘না’

-‘ আশার বিয়েতেও আসেননি?মানে বৌভাত তো ছেলেদের বাসায় হয়’

-‘না আসিনি’

আজকে শাওনদের টিমের সবার পোশাক সাদা ছিলো।এমনকি তন্নি সেজে যে বসে আছে সেও সাদা পোশাকে।
দূর থেকে সাদা পোশাকে একজন এগিয়ে আসছে শাওনের দিকে।হাত পকেটে ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করতে যাচ্ছে।
তন্নি সেজে আজ সামিয়া নয় বরং মেধা এসেছে।সামিয়াকে ওয়াশরুমে আটকে সঠিক সময়ে সাজ বদলে এসে পড়েছে।
সে দেখে ফেললো সাদা পোশাকের একজন হনহনিয়ে ভীড়ের মাঝ থেকে ঠিক এদিকেই আসছে।মেধা তার কোমড়ে হাত দিলো গান বের করবে বলে ঠিক সেসময়ে লোকটা অতর্কিত ভাবে শুট করে বসলো।একেবারে শাওনের দিকে।
শাওন ছিঁটকে সরে গেলো সোফা থেকে।হাতের পাশ দিয়ে গুলি লেগেছে তার।মেধা উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার পা বরাবর শুট করে দিলো ততক্ষণে।হইচই লেগে গেছে সেখানে।সব সাংবাদিক ছোটাছুটি করছে।মেধা মাথা থেকে লম্বা নকল চুল খুলে ফেলে শাওনের কাছে এসে নিচে বসে বললো,’স্যার আপনি ঠিক আছেন?’

-‘তুমি!!তোমাকে এখানে আসতে মানা করছিলাম না আমি?’

শাওন ব্যাথায় হাত নাড়াচ্ছে অনবরত।রায়হান ছুটে এসে ওকে সোফায় উঠিয়ে বসালো।মেধা সামনে তাকিয়ে আরও পাঁচ ছয়জনকে দেখতে পেলো যারা এদিকেই আসছে।সব সেট করে তারা আজ হামলা করতে এসেছে বোঝাই যাচ্ছে।তাদের টার্গেট সব অফিসারকে আজ শেষ করে দেওয়া।
মেধাকে বাদে বাকি সবার উপর এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষন শুরু করে দিয়েছে তারা।শাওন আর রায়হান গান বের করে পিলারের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।আশ্চর্য হয়ে গেছে শাওন।কারণ লোকগুলো বাকি সবাইকে শুট করলেও মেধাকে ভুলেও শুট করছেনা।মেধা গান ধরে এক এক করে গুলি করে যাচ্ছে তাও কেউ পাল্টা ওকে শুট করতে আসছেনা।শাওন তার হাতের গান নামিয়ে মেধার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।মেধা সবাইকে শুট করে তারপর থামলো।তার মনে পড়ে গেলো কেউ তাকে শুট করেনি অথচ বাকিদের করেছে এটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ফিরে শাওনের দিকে তাকালো সে।শাওন এভাবে তাকিয়ে আছে দেখে ওখান থেকে সরে গেলো মেধা।শাওনের হাত ধরে রায়হান ঐ জায়গা থেকে সরিয়ে আনলো। ডাক্তার নার্স মিলে শাওনকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।শাওন আর হাত নাড়ছেনা।তার মাথায় ঘুরছে কেন ওরা মেধাকে রেখে বাকিদের শুট করলো।নিতুকেও শুট করেছে।তাহলে মেধার সঙ্গে তাদের কিসের মিত্রতা??’

শাওনকে রেখে রায়হান,সাজিদ,মিলন আবারও আগের জায়গায় এসেছে সব দেখতে।সবাইকে মেধা হাতে আর পায়ে গুলি করেছে।মেধা এখন অফিসের দোতলায় এসেছে তন্নির সাজটা বদলাতে।গলা থেকে সিলভারের লকেটটা খুলে নিজের চুলগুলোকে পিঠে ছেড়ে দিলো সে।মেকআপ বক্স থেকে মেকআপ রিমোভাল ওয়াইপস্ নিতে গিয়েই দেখলো ঐ টিস্যুতে লেখা আছে,’আমার গোল্ডের ডিম পাড়া হাঁসকে কি করে মারার নির্দেশ দিই?আমার পক্ষে তা একেবারেই সম্ভব না’

মেধা টিস্যুটা ছুঁড়ে মারতে গিয়ে শাওনকে দেখতে পেলো দরজার কাছে।হাতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে এসেছে।
শাওন ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ফেললো।মেধা বেশ ভালো মতন বুঝে গেছে শাওন এখানে কেন এসেছে।ও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শাওন তেড়ে এসে বললো,’আমি জানতে চাই ওরা তোমাকে বাদ দিয়ে বাকি সবার উপর কেন আক্রমণ করেছে?তোমাকে একবারের জন্যও গুলি করেনি কেন?অথচ তুমি তাদের শুট করেছো তাও তারা ভুলবশতও তোমার দিকে গুলি ছোড়েনি।এর মানে বোঝাও আমাকে’

মেধা দাঁত কেলিয়ে টেবিলের দঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’যদি বলি আমিও খুনির দলের একজন সদস্য।’

শাওন মেধার যে হাতটা এতদিন প্লাস্টারে বাঁধা ছিল সেটা চেপে ধরে বললো,’আমি মজা করার মুডে নেই মিস মেধা’

মেধা চোখ মুখ খিঁচিয়ে নড়ে উঠলো।তন্নি সাজতে গিয়ে ডাক্তারের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে তাকে প্লাস্টার খুলতে হয়েছিলো যাতে কেউ চিনতে না পারে।ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠেছে সে।শাওন খুব শক্ত করে ধরেছে ওর হাতটা।
শেষে ব্যাথার সঙ্গে না পেরে হেসে দিয়ে মেধা বললো,’আপনার যেটা মনে হয় আমি ঠিক সেটা।’

-‘শোনো!!কথা ঘুরাবেনা।আমাকে সোজা উত্তর দাও।একজন অফিসার হয়ে আমাকে বাধ্য করবা না তোমাকে আরও টর্চার করতে।তুমি আসামি নও যে আমি এখন তোমাকে টর্চার করে সত্যিটা বের করবো’

-‘প্রশ্নর উত্তর আমার জানা নেই।ওরা কেউই মারা যায়নি।আপনি চাইলে তাদের জিজ্ঞেস করতে পারেন।অবশ্য আমিও জিজ্ঞেস করবো আমি তাদের এত প্রিয় কেন’

-‘জিজ্ঞেস তো করবোই।ওসব পরে হবে।কিন্তু মাথায় একটা কথা ঢুকাতে পারছিনা কিছুতেই।
যে মেয়ে হাতে গান নিয়ে থরথর করে কাঁপছিল কদিন আগে। সে মেয়েটা কিনা আজ দুহাতে শুট করে সবাইকে সেভ করেছে একা দাঁড়িয়ে থেকে?আমি চোখের পলক ফেলতে পারছিলাম না।তাছাড়া সামিয়াকে ওয়াশরুমে আটকে তুমি নিজে এসেছো পরিস্থিতি সামাল দিতে।মানে তোমার বিশ্বাস ছিল তুমি একা হাতে সব করতে পারবে।তাহলে সেদিন ভীতু হবার নাটক কেন?শুধু সেদিননা।তুমি প্রথমদিন থেকেই একই নাটক করে এসেছো।
তুমি কি আসলেই ভীতু নাকি অন্য কিছু আছে এর পেছনে?
তখন যে দ্রুত গতির কাজ করা একটা মেয়েকে দেখলাম সে কি আদৌ মেধা ছিল নাকি অন্য কেউ?আচ্ছা! তোমার মধ্যে এত রহস্য কেন?’

মেধা মুখ এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বললো,’ঐ রহস্যটাকে আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে’

চলবে♥
Afnan Lara