স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-০১

0
2757

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[সূচনা পর্ব]
লেখিকাঃ #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

নিজের ১৮ তম জন্মদিনে আমার প্রেমিককে ফ্রেন্ডের স্বামী হিসেবে উপহার পাবো তা কল্পনাতেও আসেনি আমার। সকাল হতেই আমার ফ্রেন্ড অর্পি ফোন দিয়ে বললো আমার জন্য স্পেশাল বার্থডে গিফট আছে! তারপর ফোনে একটা ঠিকানা ম্যাসেজ করে সেখানে আসতে বলে। স্বাভাবিক ভাবে সেখানে যেতেই খেয়াল করি আমার ২ বছরের ভালোবাসা অহন অর্পির পাশে দাড়ানো বর সেজে! পুরো বাড়িটাও ছিলো বিয়েরই সাজে।

আমাকে দেখে অর্পি দৌড়ে এসে বললো,,,

‘ দোস্ত তোর বার্থডে গিফট! তুই না আমার বিয়ে নিয়ে এক্সাইটেড ছিলি?আজ আমার বিয়ে!অহনের সাথে। ‘

অর্পি জানতো না অহনের কথা। তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো এটা কেও জানতো না।
অর্পির কথায় মলিন দৃষ্টি নিয়ে অহনের দিকে তাকাতেই খেয়াল করি তার চোখে পানি! রাগ হলো অহনের ওপর। সাথে কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ভেতরটা! ইচ্ছে করছিলো অহনকে দুটো থাপ্পড় মেরে জিজ্ঞেস করতে কেনো আমায় ধোঁকা দিলো?দোষ কি ছিলো আমার?

বিয়ের কার্য শেষ হতে আমি অহনের সাথে একান্ত কথা বলার সময় পাই। সে তখন ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত ছিলো। আশেপাশে তেমন কেও ছিলোনা। আমি ওর সামনে গিয়ে থাপ্পড় মেরে দেই! কেঁদে দিয়ে জিজ্ঞেস করি,,,

‘ আমায় ধোঁকা কেনো দিলে অহন?দোষ কি ছিলো আমার?’

অহন আমার কথায় তেতে উঠলো এক প্রকার! ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,,,

‘ ধোঁকা? ধোঁকা তো আমি না তুই দিয়েছিস। তোর যে এতো ভয়ংকর একজন প্রেমিক ছিলো তা আগে বলিসনি কেনো?মরতে মরতে বেঁচেছি আমি! অর্পি বিয়ে না করলে এতক্ষণ হয়তো তোর ঐ সাইকো প্রেমিক আমাকে কবরে পাঠিয়ে দিতো। ‘

অহনের কথায় বাকরুদ্ধ আমি! কি বলছে এসব?আমার প্রেমিক? পরক্ষনে স্বাভাবিক হয়ে নেই। নিশ্চিত নিজের দোষ ঢাকতে উল্টো পাল্টা কথা সাজাচ্ছে!

আমি উঁচু গলায় বলি,,,,

‘ একদম নিজের দোষ ঢাকতে মিথ্যা বলবেনা অহন!আমি জানি তুমি নিজের দোষ ঢাকতে এসব বানিয়ে বলছো। ‘

আমার কথা শুনে অহন প্রতিত্তুর করতে যাবে তখনই ওর ফোনে টুং করে ম্যাসেজ আসার শব্দ হয়!ফোন স্ক্রিনে তাকাতেই অহনের মুখ ভয়ে ছেপে যায়। ও নিজের ফোনটা আমার দিকে দেখিয়ে বলে,,,

‘ দেখ, আমি মিথ্যা বলছি?তাহলে এসব থ্রেট কে দিচ্ছে? ঐ রাতে আমায় কিডন্যাপ করে জোর করেছে অর্পিকে বিয়ে করতে আর তোর সাথে সম্পর্ক শেষ করতো। সেদিন কম মার খাইনি আমি। ‘

অহনের ফোন স্ক্রিনে তাকাতেই আমার চক্ষু চড়কগাছে! ম্যাসেজটা দেখে নিজেই কেমন ভয়ে কেঁপে উঠলাম! ম্যাসেজে লিখা ছিলো,,

‘অহন শেখ! দোলার কাছ থেকে দূরে সর, রাইট নাউ!নাহলে তোকে কেটে ১০০ পিস করতে দুবার ভাববো না! ‘

ম্যাসেজটা আমায় নানান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে মন গভীরে! কে এই লোক?এমন মারাত্মক থ্রেট কে দিতে পারে?

আমি কাঁপা কন্ঠে বলি,,,

‘ অহন ট্রাস্ট মি! আমি এই লোককে চিনিনা। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। ‘

অহন কিছু বললো না।ওর মুখ ভয় আর আতংকের ছাপ স্পষ্টত লক্ষমান! আমি কাছে যেতে নিলেই অহন ভীত কন্ঠে বললো,,,,

‘ কাছে আসবেনা দোলা। আমি মরতে চাইনা! ‘

কথাটি বলেই দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে যায় অহন! আমি সেদিকে তাকিয়ে কেঁদে দেই। অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম অহনকে। এভাবে আলাদা হয়ে যেতে হবে আমাদের কল্পনাও করিনি। সব ঐ অপরিচিত লোকটার জন্য! জানিনা কে সে?বাট তাকে সামনে পেলে আমি মেরে ফেলবো। তাকে মেরে জেলে চলে যাবো তাও তাকে খুন করে ফেলবো!

কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে যাই অহনদের বাসা থেকে। দরজা পেরিয়ে সামনে এগোতেই কারো সাথে ধাক্কা লাগে খুব জোরে! আমি পরে যেতে নিলেই কেও আমার কোমর আঁকড়ে ধরে। ভয়ে চোখবন্ধ করেই সামনের ব্যাক্তিটির দুই বাহু খামচে ধরে। ক্ষনিক সময় পার হতেই হুশ আসে আমার। চোখ খুলে সামনে তাকাতে দৃশ্যমান হয় কোনো এক যুবকের চেহারা! সুর্দশন যুবক! শ্বাস আটকে এসে গলায় কথা আটকে যায়।

একদম ফিল্মি স্টাইলে আমার কোমড় আঁকড়ে ধরে আছেন। চোখেমুখে তার শত বিরক্তির আভাস! আমি ছিটকে দূরে চলে আসি। কিছু সময়ের জন্য কান্নাটা দূরে সরে ঘিরে ধরে আমায় একরাশ লজ্জা! পিছু ফিরে চলে যেতে নিলেই কারো গম্ভীর কন্ঠ কানে আসে! কেও যেনো বলছে,,,,

‘ হেই মিস! আপনার ব্লাউজের দুটো ফিতা খুলে গিয়েছে। লাগিয়ে নিন জলদি! ‘

কথাটা কানে ভেসে আসতেই আগের তৈরি হওয়া লজ্জাটা যেনো দ্বিগুণ হয়। কন্ঠস্বরটা পরিচিত মনে হলো। তবে সেসব না ভেবে আমি দরজার পাশে থাকা ঝোপঝাড়ে গিয়ে ফিতাটা লাগানোর চেষ্টা করি। কাজ হয়না! কয়েকবার চেষ্টা করতেই কাজ না হওয়ার ফলে শব্দ করে কেঁদে দেই! এই অবস্থায় বাহিরে গেলে ইজ্জত থাকবেনা আমার। ফোনও সাথে নেই!

কান্না করার মূর্হতে মনে হলো সেই গম্ভীর কন্ঠস্বর আবার ভেসে আসছে। তিনি পুনরায় বলছেন,,,

‘ কাঁদছেন কেনো?কোনো প্রবলেম? হেল্প চাই? ‘

ঝোপের আড়ালে থেকে খেয়াল করি সেই কালো শেরোয়ানি পড়া লোকটা উল্টো ঘুরে আমায় জিজ্ঞেস করছেন। তার মুখ দেখতে পাইনি।কালো মাস্ক দিয়ে আবৃত ছিলো তার মুখ! চোখে কালো কুচকুচে রঙ্গের সানগ্লাস!

আমি কাঁদো কন্ঠে বলি,,,

— ব্লাউজের ফিতাটা লাগাতে পারছি না। কাওকে ডেকে দিবেন প্লিজ।

— এখানে কেও নেই! সবাই বিয়ের কাজে ব্যাস্ত! আপনি যদি চান তাহলে আমি হেল্প করতে পারি! ইউ ক্যান ট্রাস্ট অন মি!

ওনার কথা শুনে প্রথম ভয় পেলেও পরে মন কেনো যেনো বাধ্য করলো বিশ্বাস করতে। লোকটা বিশ্বাসযোগ্য নাহলে ঐ সময়ই তিনি আমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করতেন! আমি তাকে বলি আমার হেল্প করতে! লোকটি এক টুকরো কাপড় চোখে বেঁধে ভেতরে ঝোপঝাড় এর আড়ালে আসে! তা দেখে আমার মনে প্রশান্তি জন্মে! লোকটা আসলেই ভালো মনের। পিঠে স্পর্শ ব্যাতীত দক্ষতার সাথে ব্লাউজের ফিতাটা লাগিয়ে দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে যান! আমি সেদিকে তাকিয়ে নিজেও বেড়িয়ে যাই আড়াল থেকে!
_________________________

ঢাকার স্তব্ধ এক সড়ক দিয়ে হাঁটছি! কাঁদতে কাঁদতে চোখে লাগানো কাজল চারিপাশে এটে গেছে। পা দুটো যেনো চলতেই চাইছে না। বারবার থেমে এসে জরোতা তৈরি করছে!

কিছুদূর যেতেই লক্ষ করি কয়েকটা ছেলে গাড়ির ওপর বসে মদ খাচ্ছে! সবাই মাতাল প্রায়! তা দেখে বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। ভয়গুলো হানা দিচ্ছে মনের নিভৃতে! এখান থেকে ফিরে গেলে আজ আমি বাসায় যেতে পারবো না। বাসায় যাওয়ার এই একটাই রাস্তা! নিস্তব্ধ জন মানবহীন! ভাবনার মাঝেই তাদের মধ্য হতে একজন আমায় দেখে নেয়! দেখা মাত্রই বিশ্রি একটা হাসি দিয়ে বাকি দুজন ছেলেকে আমায় দেখিয়ে ইশারায় কিছু বলে। তা দেখে ভয়গুলো যেনো দ্বিগুণ হলো।

আমি কিছু না ভেবে উল্টো পথে হাঁটা ধরি। পিছু ফিরে দেখলাম ঐ তিনটে ছেলে আমার পিছে আসছে, দৌড়ে! আমিও শাড়ীর কুচি ধরে দৌড় দিতে নিলেই পায়ে ইটের টুকরু বেঁধে পড়ে যাই। ছেলে তিনজন এসেই আমার চারপাশে গোল হশে দাঁড়ায়!

তাদের মধ্যে হতে একজন বললো,,,

— মা** কিন্তু জোস!আজকের দিনটা অস্থির যাবে আহান!

দ্বিতীয়জন! আহান বলল,,,

— হ, ঠিক কইছোস! আমার তো এরে দেইখাই মাথা গরম হয়ে গেছে।

এবার তিনজন আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্রি হাসি দেয়। আমি কেঁদে দিয়ে বলি,,,

— ভাইয়া প্লিজ আমায় যেতে দিন!

আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে দেয় তিনজন। একজন আমার পাশে বসে বলল,,,

— ভাইয়া কি? জান নয়তো বাবু বলে ডাকো! ট্রাস্ট মি! খুব সুখ দেবো।

এমন বিশ্রি কথা আর তাদের অসভ্য চাহনি দেখে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। তবে এতে যেনো তাদের খেয়াল নেই। শাড়ীর আঁচলে হাত দিতে যাবে তখনই আহান নামক ব্যাক্তিটির হাতে গুলি লাগে! হতভম্ব আমি আর বাকি দুজন!

আহান ব্যাথায় চিৎকার দিয়ে উঠলো।বাকি দুজন ভয় পেয়ে ভীত কন্ঠে বলল,,,

— ঐ কে রে?কোন শালায় গুলি করলি? সামনে আয় বা*!

এবার আরো দুটো গুলি এসে ঠেকলো বাকি দুজনের হৃদপিণ্ড বরাবর। সাথে সাথে মুখ থুবরে মাটিতে পড়ে যায় তারা দুজন! বাকি একজন ভয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটেছে। চোখের সামনে খুন হওয়া দেখে শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলো বোধহয়!পিছে খেয়াল করে দেখলাম কেও আসছে! হাতে তার গান (বন্দুক)! পুরো কালো আবরণী দিয়ে শরীর ঢাকা! লোকটাকে দেখে ভয় হলো। এবার আমাকে মারবে না তো?

লোকটি কাছে এসে আমার পাশে বসে। তার নিজের মুখ গুজে দেয় আমার গলায়। ছোট ছোট চুমু দিচ্ছে গলায়, কাধে! আকস্মিক কান্ডে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! লোকটি আমার দুহাতে অজস্র চুমু খেয়ে ঠোঁটের দিকে আগাতেই থেমে যায়। ভারী কন্ঠে বলে,,

— আই এ্যাম সরি স্নিগ্ধপরী! তোমায় হালাল ভাবে স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু এতদিন পর তোমায় সামনে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।

আমি আর কিছু শুনতে পেলাম না। শ্বাসকষ্টের কারনে তার বুকেই ঢলে পড়ি! সেন্সলেস হওয়ার আগে তার উতলা হওয়াটা যেনো চোখে এড়ালো না!
__________________________

চরম মাথার যন্ত্রণা নিয়ে চোখ খুলে চারিপাশে বুলাতেই আম্মুকে বসা দেখি! তার মুখে চিন্তার রেশ। আমি বাসায় দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলি। কিন্তু আমায় এখানে আনলো কে?

আম্মুকে জিজ্ঞেস করি,,,

— আম্মু আমি তো রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে এখানে আনলো কে?

— পূর্ব কোলে করে আনলো! তোর শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা দিনদিন বেড়েই চলেছে। আবাড ডাক্তার দেখাতে হবে।

আম্মুর কথায় আমি চরম অবাক! পূর্ব?মানে পূর্ব ভাই? মাই গড! পূর্ব ভাইয়ের নাম শুনলেই শত ভয় ঝেকে ধরে আমায়। তিনি আমার বড় চাচার ছেলে! পূর্ব ভাইকে আমিই একা ভয় পাইনা বাড়ির সবাই মোটামুটি তার রাগী এবং গাম্ভীর্যপূর্ন স্বভাবের কারনে ভয় পায় কথা বলতে।কারন তিনি হুটহাট রেগে গিয়ে নিজের চরম ক্ষতি পর্যন্ত করেন।লোকটা মারাত্মক সুর্দশন হলেও রাগ অত্যান্ত!

আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করি,,

— পূর্ব ভাই তো কানাডা ছিলো। দেশে কি করে?

— আজকেই আসলো। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো সবাইকে। তারই মধ্যে আসার পথে তোকে রাস্তায় অজ্ঞান পেলো তাই কোলে তুলে আনলো।

আমি আম্মুর সাথে আর কথা না বলে পূর্ব ভাইয়ের রুমের দিকে আগাই। ভয় লাগলেও আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই!

পূর্ব ভাইয়ের রুমে যেতেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে…….!

#চলবে,
____________________________