সম্পর্কের বন্ধন পর্ব-০৩

0
5008

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

৩.
শ্যামল রেগে গেলো। তার দিকে তেড়ে যেতেই নির্মলা বেগম থামিয়ে দিলেন। অগত্যা রাগ দেখিয়ে ইমনের খাবারগুলো কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলো। ওকেও খাবার দিবে না সে। দেখবে কি করে আজ না খেয়ে থাকে। তেজ দেখাচ্ছে তার সাথে, সেও দেখবে। তাকেও খাবার না দেওয়ার কঠিন ফরমায়েশ দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। রক্তিম চোখে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ইমন। নির্মলা বেগম বুঝে গিয়েছেন তার ছেলে রেগে গিয়েছে। এখন নিশ্চই ভাংঙ্গাচুরা করবে। তিনি নুহা কে ইশারায় নিয়ে আসতে বলে ছেলেকে এ কথা সে কথা বলো মনোযোগ ভ্রষ্ট করতে চাইলেন। ইমন চোখের পলক ফেলেছে না। ইতোমধ্যে চোখে পানি জমে গিয়েছে। রাগে কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। মা কে ঝাটকা মেরে সরিয়ে কাচের কাপ ঠাস করে মেঝেতে ফেললো। দ্বিতীয়বার অন্য কিছু ফেলার পূর্বেই “মিউ মিউ” আওয়াজ করে ডাকতে ডাকতে রুমে প্রবেশ করলো বার্বিডল। বার্বিডল বিড়ালের নাম। এ বিড়াল ছাড়া থাকতে পারে না ইমন। এর বিশেষ কারণ রয়েছে। বিড়াল টি ইমন ভক্ত। ইমনের যেমন বিড়ালের প্রতি টান ঠিক তার উল্টো শ্যামল। বিড়ালে তার এল্যার্জি, বিড়াল তার আশেপাশে গেলেই সে অনবরত হাঁচি দিতে থাকে। আর এ বিড়াল টি তার চরম শত্রু। এর আগেও একবার ওকে মেরে ফেলার জন্য বের করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো, তখন বার্বিডলকে না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো ইমন। কোনো ধরনের ঔষধ নিতে চায় নি,কোনো কিছুতেই শান্ত থাকতো না। তারপর উল্টোমুখে সে বিড়ালের খোঁজে গিয়েছিলো শ্যামল। ভাগ্যবশত বিড়াল টি জীবিত ছিলো। আর এ বিড়ালের সাথে বোধ হয় শ্যামলের শত্রুতা রয়েছে,কারণ বিড়ালটি তার একদম কাছে ঘেঁষে না, তাকে স্পর্শ করতে আসলেই আঁচড় দিতে যায়। আজও তাকে আঁচড় দিতে চেষ্টা করেছিলো সেজন্যই ওকে স্টোর রুমে আটকে রাখা হয়েছিলো।
খাবার প্লেট আর বিড়ালটিকে রেখে বেরিয়ে যায় নুহা। কারণ এখন তাকে শ্যামলকে সামলাতে হবে। কোনোমতেই শ্যামলকে জানতে দেওয়া যাবে না তার আদেশ অমান্য করা হয়েছে। নির্মলা বেগম প্লেট হাতে নিলেন খাইয়ে দেওয়ার জন্য, তখনই তাকে সাফ না করে দেয় ইমন। সঙ্গে এ ও বলে দেয় যে নির্মলা বেগম থাকলে সে খাবে না। অনেকবার চেষ্টা করে ক্ষান্ত হয়ে চলে গেলেন তিনি। নির্মলা চলে যেতেই প্লেট নিয়ে চুপিচুপি পা ফেলে বেরিয়ে যায় ইমন। উদ্দেশ্য রিপাকে যেখানে আটক রাখা হয়েছে সেখানে যাওয়ার। বিনা আওয়াজে খুবই সন্তর্পণে দরজা ধীরে ধীরে খুলে ফেললো সে। চুপিচুপি রুমে ডুকে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।তার পেছন পেছন বার্বিডল ও প্রবেশ করেছে।

রিপা ওয়ালে হেলান দিয়ে কাঁদছে। সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলস্বরুপ, শরীর টা নেতিয়ে পড়েছে। তার মাথায় এক প্রশ্ন চলছে তাকে এভাবে আটকে রাখার কারণ কি? তখনই
কক্ষে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকালো সে। মুহূর্তেই রুমে অচেনা পুরুষকে দেখে নড়েবড়ে যায়। হাতে প্লেট নিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে আছে ইমন। রিপা বললো,

‘আপনি? আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আমি বলেছি না খাবো না?’

তার কথা বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে, শরীরে বেশ জোর নেই। ইমন তার পাশ ঘেঁষে বসে মলিন মুখে বললো,

‘তুমি কাঁদছো কেনো? তোমাকে মেরেছে,না? আমাকেও মারে, ‘ভাইয়া’ না ডাকলে। তুমি ভাইয়া বলে দাও নি কেনো? তাহলে তো আর এত মারতো না। থাক কেঁদো না।’

রিপা যা বলতে উদ্বুত হয়েছিলো তা আর বললো না। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করতে লাগলো। এ ছেলে তো পাগল, অযথা ওর উপর না আবার রাগ দেখিয়ে দেয়। রিপার একটা স্বভাব রয়েছে, সে নিজের রাগ কখনো অন্যের উপর দেখায় না। যার রাগ তার সাথেই মেটায়।

–‘আচ্ছা,আর কেঁদো না। আমি বকে দিবো। এখন খেয়ে নাও।’

—‘আমি খাবো না।’

—‘কেনো?’

—‘কারণ আমার খাওয়া শেষ।’

—‘মিথ্যা কথা, তুমি খাও নি। আমি দেখেছি ভাইয়া তোমার খাবার ফেলে দিয়ে তোমাকে এখানে আটকে রেখেছে। তুমি না খেলে আমি খেয়ে নিবো। মনে রেখো পরে কিন্তু আর পাবে না। ভাইয়া চলে আসবে।’

রিপা নিরুত্তর রইলো। ইমন করুণ সুরে বললো,

—‘ তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ভাইয়া চলে আসবে। আর এসে আমাকে দেখলে আমাকে তো মারবে সাথে তোমাকেও মারবে।’

—‘তোমার ভাই তোমাকে মারে?’

–‘হ্যা,মারে। ভাইয়া খুব পঁচা। জানো, আমাকে না মাঝে মাঝে অন্ধকার ঘরে নিয়ে তেলাপোকা আর ইদুরের সাথে আটকে রাখে। ‘

বলতে বলতে ইমনের চোখ ছলছল করে উঠে।
বিড়ালটি মেউ মেউ ডেকে ইমনের পেছন থেকে বেরিয়ে আসলো। ইমনের গা ঘেষে শান্ত্বনা দিতে লাগলো, যেনো সে বুঝেছে তার মালিক কষ্ট পাচ্ছে। এ অবলা প্রাণীগুলো হয় খুবই প্রভুভক্ত। তাদের একটু আদর দিলেই অন্ধভক্ত হয়ে উঠে। রিপা ফ্যালফ্যাল চোখে বিড়ালের দিকে তাকালো। এ বিড়ালকে সে দেখেছিলো। একদল লোক ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছিলো, ঠিক তখন ই সে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। এত সুন্দর বিড়াল দেখে ও তাদের মারতে দেয় নি। কাঠখড় পোড়ার মতোন অনুরোধ করে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। ভাগ্যের পরিহাসে দ্বিতীয়বার দেখা হয়ে গিয়েছিলো। স্থান টি ছিলো শপিং মলের সিড়ি লিফ্ট। বিড়াল টি সিড়িতে হুট করে দৌড়ে চলে এসেছিলো। এসেই বিপাকে পড়েছিলো, সিড়ি নিচে নামার সাথে সে ও লাফাচ্ছিলো। তখন সে ওকে আবারো বাঁচিয়েছিলো। সে অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে বিড়ালকে ছুঁয়ে দিলো। ইমনকে অবাকের সুরে প্রশ্ন করলো,

‘ এই বিড়ালকে কই পেয়েছেন?’

ইমন অভিমানের সুরে বললো,

‘ওকে বিড়াল বলবে না। ও আমার বার্বিডল।’

রিপা ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে নিলো। কি বললো? বার্বিডল! এটা তো মেয়ে মেয়ে লাগছে। বিড়ালের নাম তো হয়, মিনি,পুষি, ক্যাটি। সে কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,

‘বার্বিডল?এটা আবার কেমন নাম?’

‘ খুব সুন্দর তাই না? জানো এটা আমি রাখি নি। প্রি্,,,’

তার কথার মাঝখানেই রিপা থামিয়ে দিলো। বিড়াল নিয়ে সে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চায় না। তার এখনে জরুরী কথা জানার আছে। রিপা একটু খাবার মুখে তুলে বললো,

‘ তোমাকে আর কেউ মারে? তোমার বউ, বোন,মা উনারা?’

‘না। আমাকে আর কেউ মারতে পারে না। নুহা তো আমাকে দেখলে ভয় পায়। শিলা আপু সারাদিন ফোন কানে নিয়ে থাকে আর আম্মা সারাক্ষণ আমাকে আদর করে। মারে না, কিন্তু বউ কে? আমাদের ঘরে তো আর কেউ নেই। ‘

‘ওহ আচ্ছা, তাহলে আমার ভুল হয়েছে। তা নুহা তোমাদের কে হয়? ‘

কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে রিপা। তার ধারণা কিছু গন্ডগোল আছে। ইমনের বোকা বোকা কথায় সে বেশ কিছুই জানতে পারছে। ওকে ওর মতোই হ্যান্ডেল করতে হবে। ইমন খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,

–‘ নুহা , নেহাখালামনির আম্মু। আমাদের যে নেহামনি আছে না উনার। জানো নেহাখালামনি এত বড় হয়েও নুহাকে আম্মু ডাকে। হি হি হি, কি লজ্জা।’

বলেই খিলখিল করে হাসলো ইমন। রিপা বুঝে ফেললো নুহা তাদের হয়তো খালাতো বোন। রিপা তার কথার ফুলঝুরি চালু রাখলো। কথায় কথায় জেনে ফেললো, প্রতি রাতে নুহা আর শ্যামল একসাথে থাকে। এটুকু শুনতেই তার গা ঘিনঘিন করে উঠলো। সে যা দেখেছে তার কিছুই ভুল নয়। তাদের কথার মধ্যেই রুমে এসে উপস্থিত হন নির্মলা বেগম। ইমন আর রিপাকে একসাথে দেখেই সে থতমত খেয়ে যান। কঠিন আদেশের সুরে ছেলেকে শাসিয়ে বললেন,

‘তুই এখানে এসেছিস কেনো? তোকে না নিষেধ দিয়েছিলাম?’

ইমন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো। রিপা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

‘ কেনো, আমি সব জেনে যাবো বলে?’

‘এই মেয়ে তুমি বেশি কথা বলো? ‘

‘এখনো কিছু বলেছি কই? আর আমাকে এখানে আটকে রাখার কারণ কি? কেনো আটকে রেখেছেন? আমি যেতে চাই, যেতে দিন। আপনার ছেলের পরকীয়ার সকল ডিটেইলস জানা হয়ে গিয়েছি আমার।’

‘ এই, এই মেয়ে। কি “পরকীয়া” “পরকীয়া” লাগিয়ে রেখেছো? আমি ওর বউ। স্বামী, স্ত্রীর কিসের পরকীয়া? একটা থাপ্পর দিবো। ‘

কথাটা বলে চেঁচিয়ে ভেতরে আসলো নুহা। রাগে ঠোঁট কাপছে। তখন শ্যামলের ভয়ে কিছু বলতে পারে নি। এখন সব ঝাল মিটিয়ে নিবে। কৌশলে শ্যামলকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে এসেছে সে।
রিপা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। নুহার কন্ঠে তেজ শুনা যাচ্ছে। তার আওয়াজ বলে দিচ্ছে সে যা বলছে তার সব ঠিক। বেতালের মতো রিপা প্রশ্ন করলো,

—‘ তাহলে আমি কে?’

নির্মলা বেগম নির্লিপ্ত গলায় বললেন,

—‘ তুমি তার ভাবী। অর্থাৎ ইমনের বউ।’

—‘মানে? কি বলছেন ? ক্লিয়ারলি বলেন।’

–‘ ফুফুআম্মার কথার অর্থ হলো, তোমাকে ইমনের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন কারণ নিশ্চই জানতে চাইবে, তার জন্য বলে রাখি তোমার বাবা ইমনের সাথে তোমাকে বিয়ে দিবে না তাই এ চাল চেলেছি আমরা। যাই হোক শুনো, ভালো কথা মনে পড়েছে, এখন ফটাফট তোমার বাবাকে ফোন দিয়ে বলো তুমি ঠিক আছো,কদিন যেনো তিনি তোমাকে ডিস্টার্ব না করে। না বলতে চাইলে সমস্যা নেই, তোমার সুন্দর শরীরের সুন্দর ভিডিও সবার কাছে পৌঁছে দিবো। ‘

নুহার কথা শুনে রিপা তব্দা খেয়ে যায়। মাথায় যেনো বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। মুখ বিশাল বড় হা করে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। সবটুকু হজম করা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। ধাক্কাগুলোর বেগের গতি খুবই ভারী পড়লো তার উপর। নিজেকে কেমন আউলা-ঝাউলা লাগছে।

চলবে!
®সোনালী আহমেদ