সম্পর্কের বন্ধন পর্ব-১১

0
5529

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

১১.
হোসেনআরা বিস্মিত চোখে শাশুড়ির দিকে তাকালেন। রুপসি বানুকে দেখতে খুবই নিষ্পাপ লাগছে। কে বলবে এই মহিলা চামচ চুরি করেছে। রুপসি বানু বউয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে চুপচাপ চলে গেলেন। এভাবে বলা ঠিক হয় নাই। অন্যভাবে বললে হতো। থাক বলে ফেলেছি, তো কি হইছে? আমি কি নিতে চাইছি, শয়তানে জোর করছিলো দেইখা ই না নিছি। রুপসি বানু আপনমনে বিরবির করতে করতে চলে গেলেন। যেতে যেতে ঠাস করে ধাক্কা খেলেন নুহার সাথে। নুহা হড়বড় করে কই যাচ্ছে।

‘ও মা গো, কোমড় শেষ রে। খাড়াও মাইয়া, কই যাইতাছো? বড় ছোট মানো না, ধাক্কাধাক্কি করে ফালাই দাও।’

‘সরি, সরি দাদী। আমি দেখি নি। ‘

‘ রাখো তোমার সারি। সারি কইলে আমার ব্যাথা চইলা যাইবো নি?’

নুহা দাত চেপে তাকিয়ে রইলো। এখন তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না। দ্রুত যেতে হবে নাহলে রিপা আর শ্যামল তার চোখের সামনে থেকে চলে যাবে। সে বিনয়ের সাথে মাথা নত করে রইলো। রুপসি বানু দমলেন না, তিনি বকে যেতে লাগলেন। উপায়ন্তর না দেখে নুহা চুপ করে দৌড় দিলো। রুপসি বানু পেছন থেকে তাকে চেঁচাতে লাগলেন। সেসব কর্নগোচর করলো না সে। দরজার বাহিরে এসে কোথাও রিপা আর শ্যামলের চিহ্ন দেখলো না সে। অনেক্ষণ খুঁজেও কোনো দিশা না দেখে ঘরে ফিরতে হলো তাকে। গোমড়া মুখে নির্মলা বেগমের পাশে বসলো। নির্মলা বেগম রুবেলের সাথে কথা বলছে। ইমন নিপার সাথে ছাদে গিয়েছে। রুবেল কিছু জরুরী কথা বলছিলো নির্মলার সাথে, তখন ইমনের জন্য বলা হয়ে উঠছিলো না। সে কথার মাঝখানে সমস্যা করছিলো তাই নিপাকে ডেকে তার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে রুবেল সাহেব।

-নিস্তব্ধ ছাদে একা একা হাটছে নিপা। এই ভর দুপুরে মানুষের ভীড় হবার ও কথা নয়। মৃদু বাতাসের ফলে ছাদের দড়িতে শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো এদিকে-সেদিকে দুলছে। ইমন বারবংবার সেই কাপড়গুলোর পেছন লুকোচুরি খেলছে। নিপা ব্যস্ত গলায় বলে,

‘ইমন ভাই, দাড়ান। ছাদের রেলিং নেই, আপনি পড়ে যাবেন তো।’

ইমন বোধ হয় শুনলো না। আপনমনে সে হাসছে আর খেলছে। হঠাৎ বেখেয়ালি ভাবে খেলতে যেয়ে পিছলে যায়। সাথে সাথে নিপা ধরে ফেললো। ইমন ভয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো। তাকে সোজা দাড় করিয়ে রাগান্বিত স্বরে বকা শুরু করলো নিপা। বেশ জোর কন্ঠে বলে,

‘আপনি আস্ত একটা পাগল। এতবার বলেছি শুনেন নি। এখন পড়ে মরে তো শান্তি হতেন।’

ইমন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

‘ আমি থাকবো না। সবাই আমাকে শুধু বকে আর মারে। আমি চলে যাবো। সরুন আমি চলে যাবো।’

নিপা শান্ত হলো। বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো। ইমন তো আসলেই পাগল, একদম উচিত হয় নি এভাবে বলা। মনেমনে বেশ অপরাধবোধ করলো। নিপা সুর পাল্টিয়ে মিষ্টি সুরে বলে,

‘ আপনি যদি আমার কথা শুনতেন তাহলে কি বকতাম? আচ্ছা বাদ দেন। বলেন তো, আপনাকে আর কে কে বকে?’

ইমন হড়বড় করে বলে,

‘সবাই। মা, ভাই, নুহাপু। শুধু বার্বিডল কিছু বলে না। জানো সে আমার কথা শুনে।’

‘বার্বিডল? বার্বিডল কে? আর নুহা আপু তো আপনার বউ আপনি আপু কেনো ডাকছেন?’

ইমন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিছুই বুঝতে পারছে না। বউ শব্দ টা বোধ হয় সে এর আগে শুনে নি। ইমন গোলাটে কথাবার্তা বললো। যার আগাগোড়া নিপার বোধগম্য হলো না। কিছুক্ষণবাদে কথার দীর্ঘ ইতি টেনে নিচে নেমে আসলো দুজনে।

বিকালের শেষ দিক। রঙিন আকাশ কালো দেখাচ্ছে। সম্ভবত ঝড়-বৃষ্টি হবে। নির্মলা বেগম তৈরী হয়ে গিয়েছেন যাবার উদ্দেশ্যে। রিপাকে রেখে যাবেন। সপ্তাহ-দশদিন পর নিতে আসবেন। রুবেল সাহেব ভারী খুশি হলেন। বিয়ের পর মেয়েরা বাড়ীতে ফিরলে বোধহয় সবচেয়ে বেশি খুশি বাবারাই হয়। রিপা রুমের কোণে শুয়ে আছে। তার সাথে রুপসি বানু বসে বসে পান চিবুচ্ছেন। রিপার দিকে একপলক তাকিয়ে মুখ ভেংচিয়ে বলেন,

‘এমন ঢং দেখাইয়া শুইয়া আছোস ক্যান? যা যাইয়া শাশুড়িরে বিদায় দিয়া আয়।’

রিপা নিরুত্তর রইলো। রুপসি বানুর একই কথা বারংবার শুনতে শুনতে বিরক্ত হলো। খানিকবাদে মুখ খুললো,বললো,

‘আচ্ছা দাদী, আমি এখানে থাকলে তো তিনি ওই বাড়ীতে থাকবো। আবার নুহা ভাবীও ওখানে থাকবে।’

‘তো?’

‘ আপনি না বলছিলেন, আপনি বিয়ার পর একদিনও দাদাজানরে ছাড়া কোথাও থাকেন নাই এবং থাকতেও দেন নাই। ‘

‘হু। আর আমি অসুস্থ থাকলে ওইদিন আর তারে বাড়ীর বাইরে পা রাখতে দেই নাই। দেখা যেতো আমি অসুস্থ বইলা কোন চিপায় নটিবেটিদের সাথে চইলা যাইতো। ঠিক করছি না,বল?’

‘একদম।’

রুপসি বানু মিষ্টি হাসলেন। রিপা সুর পাল্টিয়ে বলে,

‘ দাদী, শ্যামল না সারাক্ষণ মৌমাছির মতো নুহা ভাবীর পেছনে ঘুরঘুর করে। এখন আমি যদি না থাকি তাহলে কি হইবো বুঝতে পারতাছো?’

রুপসি বানু পান চিবুনো বন্ধ কর দিলেন। কল্পনায় শ্যামল আর নুহা কে একসাথে দাড়িয়ে কাছে এগিয়ে আসতে দেখেই তিনি চোখ বড় বড় করে ফেললেন। ‘নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ ‘ বলে বিরবির করে পানের পিক ফেললেন। হড়বড় করে উঠে বসে ছুট লাগালেন ড্রয়িংরুমে। চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখলেন নুহা, শ্যামলের পাশে দাড়িয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ তার চোখের সামনে কল্পনার দৃশ্য ভেসে উঠলো। এক চিৎকার দিয়ে ওদের দুজনের মাঝখানে দাড়িয়ে পড়লেন। সাথে সাথে ছিটকে সরে পড়লো নুহা আর শ্যামল। দুজনেই ভয়ে বুকে থু থু ছিটাতে লাগলো। উপস্থিত সবাই হতভম্ভ হয়ে গেলো! নির্মলা বেগম প্রশ্ন করলো,

‘কি হয়েছে? কি হয়েছে?’

রুপসি বানু নিজেকে সামলিয়ে বলেন,

‘কিছু না।’

রুবেল বলে,

‘তাহলে এমন চিৎকার দিয়েছো কেনো আম্মা?’

‘ খুশিতে চিক্কুর দিছি। আমি ঠিক করেছি,আমিও যাবো নাতিনের শশুড়বাড়ী। বিয়ার সময় তো সব চৌখে দেখি নাই তাই এখন সব দেখবো।’

রুবেল ব্যস্ত গলায় বলে,

‘আম্মা কি বলতাছো? রিপা তো থেকে যাবে তুমি যেয়ে কি করবা?’

রুপসি বানু বলে,

‘ রিপা থাকবো কে বলছে তোরে? রিপা তোর মতো অবুঝ না। শাশুড়ি অসুস্থ, ভাসুর অসুস্থ, স্বামী অসুস্থ। সে কোন আক্কেলে থাকবো।’

শ্যামল চোখ বড় করে বলে,

‘আমি কখন অসুস্থ হলাম?’

রুপসি বানু তাকে ঝাড়ি দিয়ে বলে,

‘ এখন অসুস্থ! বাগানে যাইয়া রিপা আর শিপারে বলে কইছিলা পেটে গুটুর গুটুর করতাছে। কয়েকবার নাকি বাথরুমে গেছো। সব পাতলা পাতলা যাইতেছে। কিরে শিপা বলে নাই?’

শিপা মাথা নাড়ালো। দাদীর কথার বিপরীতে বলার সাহস নেই। এর পূর্বে দুবার সাহস দেখানোর ফলস্বরপ, ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গিয়েছিলো। তাই এবার আর সাহস করলো না। রিপাকে এদিকে আসতে দেখে শ্যামল সাথে সাথে মাথা দুলিয়ে সমর্থন করলো। এবং পেট চেপে অসুস্থতার ভান করলো। নির্মলা বেগম বেশ লজ্জিত হলেন। ছেলে টা একদম বোকা হয়ে গেছে। শশুড়বাড়ীতে প্রথম এসেই ডায়রিয়া ছুটিয়েছে। এটা কোনো কথা? রুবেল সাহেব ব্যস্ত হয়ে স্যালাইন নিয়ে আসলেন। এক প্যাকেট গুলিয়ে তাকে জোর করে খাইয়ে দিলেন। শ্যামলকে প্রশ্ন করলেন, ‘বাবা বেশি পাতলা নাকি?’ রুপসি বানুর মাথা দুলানো দেখে শ্যামলও মাথা দুলালো। রুবেল সাহেব সাথে সাথে আরেক প্যাকেট খাইয়ে দিলেন। শ্যামল পেট চেপে ধরলো। এবার সত্যি সত্যি পেট ব্যাথা করছে। গলা ভর্তি খাবার। পেট পাক দিয়ে উঠলো। সে তৎক্ষণাৎ ছুট দিলো বাথরুমে। তার সাথে সাথে বাকিরাও যেয়ে বাথরুমের দরজার সামনে দাড়ালো। কয়েক সেকেন্ড বাদেই রুপসি বানু প্রশ্ন করেন, ‘ এবার ঠিকঠাক হয়েছে?’ ভেতর থেকে তখন কোনোরুপ শব্দ আসে না। রুপসি বানু অস্থির হয়ে উঠলেন। বারংবার একই প্রশ্ন করতে লাগলেন। এসব দেখে লজ্জায় ইতোস্ত করতে লাগলেন নির্মলা বেগম। সেদিকে কেউ নজর করলো না। খানিকবাদে বেরিয়ে আসলো শ্যামল। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, মুখের করুণ দশা।

‘জামাই, এবার কেমন হইছে? পাতলা নাকি ঘন?নাকি ডাক্তার নিয়া আইতে হইবে?’

শ্যামল মাথা দুলালো। ডাক্তার লাগবে না। অথচ তার বলা উচিত লাগবে। খুবই শোচনীয় অবস্থা। সুস্থ মানুষকেও যে কেউ অসুস্থ বানিয়ে দেয় তা এখানে না আসলে শ্যামল জানতো না। কোনোরকম এলোমেলো পা ফেলে ড্রয়িংরুমে আসলো। রিপা মুখ চেপে দাড়িয়ে আছে। দমফাটা হাসি আসছে তার। কিন্তু এখন হাসলে চলবে না। কেউ একজন অসুস্থ, আর সেটা নিয়ে হাসাহাসি করলে নিশ্চই সবাই তাকে সন্দেহ করবে। রুবেল সাহেব অনুরোধের সুরে বলে,

‘বেয়াইন সাহেব, বাবাজি না হয় আজ থেকে যাক। এ অবস্থায় বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া টা একদম উচিত হবে না। সুস্থ হয়ে গেলে আমি নাহয় রিপাসহ তাকে দিয়ে আসবো।’

নির্মলা বেগম নিশ্চুপ রইলেন। সে না বলতে পারছে হ্যা আর না বলতে পারছে না। তার দেখা দিয়েছে উভয় শংকট। কীভাবে কি করবেন? শেষে সবার জোরাজুরিতে রাজি হলেন। কিন্তু নুহা মানতে চাইলো না, বহু চেষ্টা করলো রেখে না যেতে। সক্ষম হলো না। নির্মলা বেগম শ্যামলকে রেখে চলে গেলেন। যাবার সময় কঠিন কিছু আদেশ দিয়েছেন। শ্যামল চুপচাপ সব শুনলো। সবাই চলে যাওয়ার পর রুপসি বানু পুরো ঘরের খুঁটিনাটি দেখতে লাগলেন। এমনকি নিচু হয়ে মেঝেতেও চোখ বুলিয়েছেন। সব ঠিকঠাক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

– শ্যামলকে রিপার রুমে শুতে দেওয়া হয়েছে। রাত নয়টা পর্যন্ত তারপাশে বসে রইলেন রুবেল সাহেব আর হোসেনআরা। মাথায় ভীষণ চিন্তা। হঠাৎ মেয়ের জামাই অসুস্থ কীভাবে হয়ে পড়লো? কত পদের খাবার খাইয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। তারা চলে যাবার বেশ সময় পর রুমে আসলো রিপা। এসেই বিছানায় শ্যামলকে না দেখে এদিকওদিক তাকাতে লাগলো । কই গেলো মানুষটা? রিপা অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেই হুট করে তাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলো শ্যামল। আচমকা এমন হওয়ায় ভড়কে যায় রিপা। শ্যামল কোথায় ছিলো? কোন দিক দিয়ে আসলো ভেবে পেলো না সে। শ্যামল সেদিকে তোয়াক্কা না করে অন্যহাতে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর দুহাতের মধ্যে বন্দি করে ফেললো রিপাকে। প্রচন্ড স্পীডে হার্টবিট চলাচল করতে লাগলো রিপার। রিপার কম্পনরোগ দেখে মৃদু হাসলো শ্যামল। দেওয়াল থেকে এক হাত সরিয়ে রিপার উন্মুক্ত কোমড়ে রাখলো।

#চলবে….
®সোনালী আহমেদ