সম্পর্কের মায়াজাল সান্ত্বনা পর্ব

0
2012

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#সান্ত্বনা_পর্ব
#ফারজানা_আফরোজ

রাত তিনটা পাঁচ মিনিটে স্পন্দন জেগে উঠে। এই শীতে তার পুরো শরীর ঘামছে। পাশে শুভ্রতা-কে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভরসা পেয়ে হাতের কাছে থাকা টেবিল থেকে জগ নিয়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে এক নিমিষেই শেষ করলো সবটুকু পানি। কিছুক্ষণ শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে রইলো। পেটের উপর হাত রেখে এলো মেলো চুলে ঘুমিয়ে আছে শুভ্রতা। স্পন্দনের চোখ বার বার ভিজে যাচ্ছে। এই ভয়ানক স্বপ্ন হটাৎ কেন দেখলো সে? বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো স্পন্দন। শুভ্রতা-কে একা রেখে একদম তার বাহিরে যেতে ইচ্ছা করছে না কিন্তু ছটপট মন তার বাবা মায়ের মুখ দেখার জন্য আকুল হয়ে আছে। দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে শুভ্রতার কপালে চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শ্বাস ফেললো। আবারো উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে পা বাড়ালো বাবা মায়ের রুমের দিকে।

দরজার কাছে এসেই আবারো দাঁড়িয়ে রইল স্পন্দন। এত রাতে বাবা মায়ের ঘুম ভাঙাতে একটুও ইচ্ছে করছে না তার কিন্তু যদি এখন সে তার বাবা মাকে দেখতে না পারে তাহলে বাকি রাত সে ছটপট করেই পার করে দিবে। দরজায় টোকা দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় ডাক দিলো……

—” আম্মু, আব্বু দরজাটা খুলবে প্লিজ!”

চার পাঁচ বার ডাকার পর ওপাশ থেকে দরজা খুলার শব্দ আসলো। ঘুম ঘুম চোখে মিসেস সাবিনা বেগম স্পন্দনকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন……

—” কিরে বাবা কি হয়েছে তোর? এত রাতে কেন আসলি কোনো দরকার আছে কি?”

মাকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো স্পন্দন। ছোট্ট বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ছেলের কান্নার শব্দ শুনে মিস্টার আজম ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন……

—” বাবা তুই কি খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?”

বাবার দিকে তাকিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো স্পন্দন। মিসেস সাবিনা বেগম ছেলের কান্না দেখে নিজেও কেঁদে দিলেন। স্পন্দনের মুখ তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন……

—” আরেহ্ বোকা ছেলে দেখো কিভাবে কান্না করছে। স্বপ্ন দেখে কেউ এইভাবে কাঁদে? স্বপ্ন তো বাবা স্বপ্নই হয়।”

স্পন্দন কান্না করছে আর বলছে……

—” খুব ভয়ানক স্বপ্ন ছিল আম্মু। দেখো আমার শরীরের লোম এখনও দাঁড়িয়ে আছে।”

মিসেস সাবিনা বেগম মিস্টার আজমের দিকে তাকালেন। মিস্টার আজম স্পন্দনের মাথায় হাত রেখে বললেন…….

—” তুই বরং এখন গিয়ে নামাজ পড়। দেখবি তোর অশান্ত মন খুব তাড়াতাড়ি শান্ত হয়ে পড়বে। তোর এই অশান্ত মন শান্ত করার এক মাত্র উপায় এইটাই বাবা।”

স্পন্দন চোখের পানি মুছে হেসে বলল…..

—” হুম আব্বু। তোমরা শুয়ে পড়ো। আর শরীরের যত্ন নিও ।”

—” চিন্তা করিস না তো আমরা ঠিক আছি। তোর কি ধারণা আমি আর তোর মা বুড়ো হয়ে গেছি? জানিস এখনও আমি আর তোর মা কোথাও ঘুরতে গেলে সবাই ভাবে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ওহ্ সরি নতুন বউ বর ঘুরতে এসেছে।”

স্পন্দন মিস্টার আজমের কথা শুনে হেসে দিলো। বাবা-মার রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো। দরজা খুলে বিছানায় চোখ ফেলতেই বুক কেঁপে উঠলো তার। শুভ্রতা বিছানায় নেই। দরজা বন্ধ করে ডাকতে লাগলো……

—” শুভ্রতা ,শুভ্রতা কোথায় তুমি? আমাকে রেখে তুমি যেতে পারবে না। বলো কোথায় আছো? দেখো আমার কিন্তু খুব ভয় করছে। শুভ্রতা?”

বাথরুমের দরজা খুলে বের হলো শুভ্রতা। স্পন্দন দৌঁড়ে গিয়ে শুভ্রতা-কে জড়িয়ে ধরে বলল……

—” কোথায় ছিলে তুমি, আমাকে রেখে?”

স্পন্দনের বুকে মাথা রেখে শুভ্রতা বলল…..

—” কোথা থেকে আসলাম আমি?”

—” যেখানেই যাবে আমাকে বলে এবং সঙ্গে করে নিয়ে যাবে কেমন?”

—” মরণ। বলি আমি বাথরুমেও তোমাকে পাহারাদার হিসেবে নিয়ে যাবো। অসভ্য বর একটা।”

—” যতই বকা দেও রাগ করবো না। সব সময় আমার কাছে বুকে জড়িয়ে রাখবো তোমাকে। কোথাও যেতে দিবো না।”

—” আমি যেতে চাইলে তো যেতে দিবে। এখন আসো দুইজন একসাথে নফল নামাজ পড়ি। ”

—” ওকে আমি ওযু করে আসছি।”

শুভ্রতা ও স্পন্দন বাকি সময় একসাথে নফল নামাজ আদায় করল। ফজরের নামাজ পড়ে স্পন্দন শুভ্রতা-কে নিয়ে হাঁটতে বের হলো। শুভ্রতার এখন তিনমাস চলছে। পার্কের রাস্তার কাছে আসতেই স্পন্দন শুভ্রতা-কে কোলে তুলে হাঁটা শুরু করলো। শুভ্রতা স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল……

—” রাতে দেখলাম কেমন যেন করছো এখন সকাল হতে না হতেই রোমান্টিক হয়ে গেলে। চাঁদের আব্বু কিভাবে এত মুড চেঞ্জ করতে পারে জানা ছিল না তো আমার?”

স্পন্দন কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলো…….

শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, শিশিরে জড়ানো গাছের পাতা, ভেজা মাটির মেঠো পথ পেরিয়ে শুভ্রতা-কে কোলে নিয়ে হাঁটছে স্পন্দন। কিছুটা সামনে যেতেই চোখ পড়ল শাপলা ও পদ্ম ফুলের জলাশয়। সাদা ও লাল শাপলা তার মাঝে গোলাপী পদ্মফুল। শুভ্রতার চোখ এখন সেই জলাশয়ের দিকেই তাকিয়ে আছে। জলাশয় তো নয় যেন লাল,সাদা ও গোলাপি রঙের মেলা বসেছে পানির উপরে। মৃদু বাতাস আবার দুল খাইয়ে দিচ্ছে পানি ও ফুলকে।

—” আমি কি সব কল্পনা করছি না-কি রিয়েল ভাবে দেখছি না-কি সব অনুভব বা অনুভুতি আমার?”

স্পন্দন এতক্ষণ পর কথা বলল…..

—” আমাদের মন তো অনুভুতির সব থেকে বড় জায়গা। এই মনে হাজারো ধরনের অনুভুতি সৃষ্টি হয়। হাজারো প্রশ্নের মেলা বসে এই মনে। আবারো সেই প্রশ্নের উত্তরও বের হয়। মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেলে মনের ভিতর আনচান করে। তাই চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে অনুভুতি গুলো মনের ভিতর ধারণ করো।”

—” হুম।”

সামনে যেতেই চোখ পড়ল সবুজ গালিচার মাঝে ছোট্ট দোলনার । দোলনায় লতাপাতা জড়িয়ে আছে । চোখ ধাঁধানো সুন্দর এক অনুভুতি।

শীতের স্নিগ্ধ সকাল, শিশিরে ভিজে থাকা সবুজ ঘাস, পাতায়-পাতায় শিশিরের ঝুলে থাকা শেষ বিন্দু, পাখিদের কলরব, ছোট্ট জলাশয়, ফুটে থাকা গোলাপি পদ্ম , লাল ও সাদা শাপলা, লতাপাতায় মুড়ানো দোলনা। শুভ্রতা ও স্পন্দন সেই দৃশ্য তাকিয়ে দেখছে আর নতুন আলোর পথের অপেক্ষা করছে। যে আলোতে অন্ধকারের কোনো ঠাঁই থাকবে না। যে আলোতে অন্ধকারের ছায়া নেমে আসলেই আলোর কারণে সেই ছায়া স্থায়ী হতে পারবে না নিমিষেই সব ছায়া মুছে যাবে আর আলোয় পরিণীত হবে।

#সমাপ্ত………….

(সম্পর্কের মায়াজাল শেষ পর্ব পড়ে সবাই খুব কান্না করেছেন। অনেকে রিকুয়েস্ট তাদের কষ্টটা কমানোর জন্য। তারা কেউ মানতে পারছে না শুভ্রতা ও স্পন্দনের কষ্টের মুহূর্ত। তাই সবার মন রক্ষা করার জন্য সান্ত্বনা নামক একটি পর্ব দিলাম। এই পর্ব কিন্তু গল্পের কোনো অংশ না। এইটা জাস্ট সান্ত্বনা পর্ব।)