সম্মোহনী সেই মেয়েটি পর্ব-১২+১৩+১৪

0
482

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃরাদিয়াহ_রাফা_রুহি

অনিলা হসপিটালের ভেতর প্রায় দৌঁড়ে ঢুকলো।এখন রাত সারে এগারো টা ছুই ছুই।হসপিটালে ঢুকেই রিসিপশনের দিকে গিয়ে তার বাবার নাম জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়ে ভেতরে গেলো।গিয়েই দেখলো ওর বুবু আর মা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।অনিলা কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে গেলো ওর বুবু মায়ের কাছে।এটুকু পথ যেনো শেষ হতে চাচ্ছে না,
পা চলছে না কিন্তু এক হাতে স্ট্রুয়ার্টের খাঁচা আর আরেক হাতে ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে এলো।মা বুবুর মুখের দিকে চোখ যেতেই বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো।কোনো রকম খাচা ব্যাগ রেখেই ভাঙা গলায় ডেকে উঠলো,

“বুবু!”

অতি পরিচিত কন্ঠে মাথা উপর করে তুললো মায়াবী আর মিসেস মনিরা।অনিলা কে দেখেই মায়াবী আর ওর মা জড়িয়ে ধরে কান্না ভেঙে পরলো।মিসেস মনিরা এর মধ্যেই দুইবার অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন।অতি শোকে কাতর হয়ে গেছেন তিনি।মায়াবী কে মিসেস মনিরা অনিলার কাছে তার বাবার খবর টা দিতে না করেছিলো কিন্তু মায়াবী অনিলা কে না জানিয়ে থাকতে পারে নি।বাবার এতো বড় একটা আঘাতের কথা কিভাবে না জানিয়ে থাকতো সে।অনিলা মা বোন কিভাবে সামলাবে ভেবে পেলো না।ভেতর টা হুহু করে উঠলো তার।স্ট্রুয়ার্ট ও যেনো কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে।অনিলা হাহুতাশ করে জিজ্ঞেস করলো,

“মা বাবার কি হয়েছে?”বাবা কি করে অসুস্থ হলো বলো মা।কালই বাবা সুস্থ ছিলো আমাকে দেখতে গেছিলো আর এখন কিনা বাবা হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে।

মিসেস মনিরার কান্নার আওয়াজ বেড়ে গেলো মেয়ের প্রশ্ন শুনে।তিনি কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিতে পারলেন না।মায়াবী করুন চোখে তাকালো অনিলার পানে।তখন মায়াবী অনিলাকে ফোন করে বলে ওর বাবা কে হসপিটাল ভর্তি করা হয়েছে।কিন্তু কেন ওর বাবা কে হসপিটালে এনেছে তা বলে নি শুধু হসপিটালের ঠিকানা টা দিয়েছে।মায়াবী চোখের পানি মুছে ভাঙা গলায় বলে উঠলো,

“আমি বলছি বোন।”

“হ্যাঁ বলো বুবু বাবার কি হয়েছে?”উত্তরের আশায় অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো অনিলা তার বুবুর পানে।

মায়াবীর বড্ড কষ্ট হচ্ছে তা সত্তেও বোনকে বলতে উদ্যত হলো।দম নিয়ে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো,”বাবার বুকের ডান দিকে গুলি লেগেছে বোন!”

বাবার গুলি লেগেছে শুনেই অনিলার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।আঁতকে উঠে সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো।অনিলা ওর বুবুর দিকে রোষানল দৃষ্টিতে তাকিয়ে অবসন্ন কন্ঠে বলে,” এসব তুমি কি বলছো বুবু?”পাগল হয়ে গেছো তুমি তোমার জন্য মানে।”

রক্তলাল চোখে তাকালো মায়াবী অনিলার দিকে।মিসেস মনিরা নির্বাক নিরর্থক ভাবে স্থীর চিত্তে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন।মায়াবী মাকে দেখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।চোখের কোণের অশ্রু টুকু গড়িয়ে পরলো চোখ থেকে।সে ভেজা কন্ঠে বললো,

হুম আমি ঠিকই বলছি বোন।আমার চোখের সামনে হয়েছে সব টা।আর আমি কিছুই করতে পারিনি।আমার জন্যই বাবার আজ এই অবস্থা।আমি বাবাকে বলছিলাম আজকে না যেতে কিন্তু বাবা শুনেনি।তারপর এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমি জোর করেই বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম।কিন্তু পথিমধ্যে আসার সময় যে আমাদের জন্য এরকম ভয়ংকর একটা বিপদ অপেক্ষা করছে সেটা তো জানতাম না।সেই মুহুর্তের কথা ভাবতেই শরীর কেঁপে উঠছে আমার।কি ভয়ংকর সেই দৃশ্য।বলেই মায়াবী কান্নায় ভেঙে পরলো।ধপ করে বসে পরলো একটা চেয়ারে।তার পর দম নিয়ে আবার বলে,

“আজ বাবা আর আমি ব্যাংকে গেছিলেন টাকা তুলতে আমার বিয়ের জন্য।আর আসার পথে কয়েকজন লোক আমাদের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পরে।আর বাবা গাড়ি থামিয়ে গাড়ির কাচ নামিয়ে দেই।কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই বাবাকে আর গাড়ি আঁটকে ফেলে।রাত হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা কম ছিলো তুলনায় ।যে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে ছিলো হইতো।আর সেই সুযোগে তিন চারজন লোক বাবার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে আর বাবার বুকের কাছে বন্দুক ঠেকিয়ে ভয় দেখাই যাতে না চেঁচায়।আমি ভয়ে ডুকরে কেদে উঠতেই একজন ছিচকে লোক আমাকে বাজে ভাবে দেখতে থাকেন।আর এগিয়ে আসেন আমার দিকে।আর বলে চেঁচালেই গুলি করে দেবে ওরা।সব টাকা পয়সা গুলো নিতে চাই ওই লোক গুলো।বাবা দিতে চাই না কিছুতেই।এদিকে একটা লোক আমাকে বার বার বাজে ভাবে স্পর্শ করতে থাকে।আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকি।বাবা ওঁদের কে বাধা দিতে চাইলেই এক পর্যায়ে বাবার সঙ্গে ওই লোক গুলো ধস্তাধস্তি জবরদস্তি করতে থাকে।একজন লোক টাকা নিতে চাইলেও পারে না।ধস্তাধস্তি করতেই গুলি বেরিয়ে বাবার বুকে লাগে আর বন্দুকের আওয়াজ আর আমার চেচানো শুনে লোকজন জড়ো হয়।আর লোক জড়ো হতে দেখেই ওই লোক গুলোকে ধরার আগেই দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।মুখে মাস্ক থাকাই কারোর মুখ দেখা যায়নি।

অনিলা সব টা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। মানুষ টাকার জন্য একটা মানুষের জীবন নিতেও একটা বার ভাবে না।হাই আল্লাহ এটা কি হয়ে গেলো তার পরিবার এর সাথে।অনিলা বিদ্ধস্ত হয়ে বসে পরলো মাটিতে।বজ্রপাতের ন্যায় বিকট ভাবে তার কর্নকুহরে বাবার গায়ে গুলি লাগার কথা টা বাজতে লাগলো।মায়াবী এগিয়ে গিয়ে বোনকে তুলে ধরলো।দাঁড় করিয়ে দুই কাধে হাত রাখলো।মায়াবী চোখের জল মুছে আবার বললো,

ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যে লোকজন আসতে আসতে ততক্ষণে বাবার গুলি লেগে অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়।গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পরছিলো।আমি এগিয়ে গিয়ে বাবাকে ধরি।আমার কোলে তুলে ধরি।বাবার গোঙ্গানোর শব্দ হচ্ছিলো পরক্ষনেই বাবার মাথা আমার কোলে লুটিয়ে পরে।সেই সময় পুলিশ কেস ভেবে কেউ এগিয়ে আসছিলো না।বাবা কে হসপিটালে আনবো কিন্তু আমি তো গাড়িও চালাতে পারি না।সেই সময় একটা ছেলে ভীর ঠেলে এগিয়ে আসেন আমাদের দিকে।আমি চিৎকার কাদছিলাম আর সাহায্য চাইছিলাম কেউ আসেনি এগিয়ে।সেই ছেলেটা ছাড়া।আর উনিই পুলিশ কে খবর দিয়েছেন আর বাবাকে হসপিটাল এনেছেন।এদিকে মা ফোন করেই যাচ্ছে সমানে।মা আমার গলা শুনেই বুঝে যায় কিছু একটা হয়েছে। বাধ্য হয় মাকে জানাতে সব টা।তারপর হাসান কাকা মাকে নিয়ে আসেন।আমি মাকে সামলানোর আপ্রান চেষ্টা করছিলাম আমি কিন্তু পারছিলাম না।

সব টা শুনে অনিলা অস্থির হয়ে গেলো।মাথাটা ঘুরছে যেনো।শরীর যেনো অসাড় হয়ে আসছে।মন মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে এক্ষুনি সে পরে যাবে ঠিক সেই মুহুর্তে একটা শক্ত বলিষ্ঠ হাত এসে ওর কমোড় পেচিয়ে ধরলো।ততক্ষণে অনিলার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে।অনিলাকে দেখেই জুনইদ যেনো স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না।সে অস্ফুটে বলে উঠলো,

“মিস সুনামি কি হয়েছে তোমার?”

মায়াবী আড়ষ্ট হয়ে চেচিয়ে বোন বলে ডেকে উঠলো।মায়াবী চমকে উঠে ব্যস্ত হয়ে পরলো অনিলাকে নিয়ে।এদিকে মিসেস মনিরার ও অবস্থা বেগতিক।নিজের ছোট মেয়েকে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে তিনি আরও ভেঙে পরলেন।

মায়াবী তাকিয়ে দেখলো সেই ছেলেটা যে তার বাবাকে হসপিটালে এনেছেন।ছেলেটার নাম টা যে কি এতো কিছুর মধ্যে জানা হয়নি।উনি না থাকলে হইতো আজকে তার বাবাকে বাঁচানোই যেতো না।মায়াবীর অস্থিরতা বেড়ে গেলো সে চেচিয়ে উঠলো নার্স নার্স বলে।নার্স এগিয়ে আসলেন সাথে সাথে।ছেলেটা অনিলাকে নিয়ে গিয়ে হসপিটালের একটা বেডে শুইয়ে দিলো।পিছনে মায়াবী আর মিসেস মনিরাও গেলেন।

একজন নার্স বলে উঠলো,আপনারা সরে দাড়ান একটু আমি দেখছি।আমাকে দেখতে দিন উনাকে।নার্স অনিলার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছেন।

মায়াবীর চোখ পরলো সেই ছেলেটার দিকে।ওর কেন যেনো মনে হচ্ছে ছেলেটা যেনো তার বোনকে চেনে।এতটা অস্থিরতা কেন ছেলেটার চোখে মুখে।চিন্তার ভাজ স্পষ্ট ছেলেটার মুখে।ছটফট করছে কেমন যেনো।আর উনি তখন অনি কে কি একটা অদ্ভুত নামে ডাকলেন।

এদিকে জুনইদ অনিলাকে দেখেই অবাকে আশ্চর্য হয়ে গেছে।সে ভাবছে অনিলা এখানে কি করছে।সে একটু আগেই ডক্টর এর বলা একটা ইনজেকশন আনতে গেছিলো ভদ্রলোক টার জন্য।আর এসেই দেখে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে পরে যাচ্ছে।কোনো কিছু না ভেবে ছুটে এসে ধরে ফেলে কোনো রকমে এক হাত দিয়ে।কিন্তু মেয়েটা যে অনিলা সে পেছন থেকে দেখতে পায়নি।আর যখন দেখলো ওর বক্ষস্থল যেনো ভারী হয়ে গেলো।আর সাথে একরাশ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।

আপনি কি চেনেন আমার বোনকে।

জুনইদ মায়াবীর কন্ঠে সম্বিত ফিরে পেয়ে বলে উঠলো,

“অনিলা আপনার বোন?”.

মায়াবী ভরাট কন্ঠে বললো,

“হ্যাঁ আমার বোন। কিন্তু আপনি ওঁকে চিনলেন কিভাবে।”

জুনইদ ছোট করে জবাব দিলো,

আমার ছোট বোনের ক্লাসম্যাট সেই হিসেবেই আমি চিনি ওঁকে।

মায়াবী আর কিছু বললো না।শুধু ও বলেই ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো।
জুনইদ কিভাবে শান্তনা দেবে ভেবে পেলো না।তার মানে ভদ্রলোক টাই অনিলার বাবা।তখন নিশাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই তার বাবা তাকে ব্যাংকে পাঠায়।ওই ব্যাংক নাকি তার কোনো বন্ধু একটা ফাইল নিয়ে আসবেন।ব্যবসার জন্য ব্যাংক ম্যানেজারের সাইন নিয়ে ফাইল টা ওদেরকে দেবে।ফাইল টা দরকারি হওয়ায় তাকে তখনই আসতেই হয় সেই ব্যাংক।আর ব্যাংক থেকে ফাইল নিয়ে ফেরার সময় রাস্তায় গন্ডগোল দেখে গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে যায়।আর তখনই দেখে একটা মেয়ে অসহায় হয়ে সাহায্য চাইছে বাবাকে বাঁচানোর জন্য কিন্তু কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না।ঘটনা বুঝেই সে সাহস করে এই হসপিটাল নিয়ে আসে।কিন্তু এই ভদ্রলোক যে অনিলার বাবা হবে কে জানতো।

কিছুক্ষন পর অনিলার জ্ঞান ফিরতেই অনিলা অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “বাবা”

জুনইদ অনিলার কন্ঠ এক প্রকার ছুটেই গেলো।অস্থির হয়ে বলে উঠলো, “আর ইউ ওকে মিস সুনামি?”

#চলবে

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ১৩
#লেখিকাঃ রাদিয়াহ রাফা রুহি

নিকষকৃষ্ণ রজনী।শব্দহীন মেদিনী বর্তমানে আঁধারে নিমজ্জিত।চারিপাশে বিরাজমান নীরবতার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ বেয়ারিশ কুকুর ডেকে উঠছে রাস্তায়।ড্রইংরুমে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান।শান্তা বেগম, নিশা, আলতাফ আহমেদ , রমিজ আহমেদ সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছে।ঘড়িতে তখন ১টা বাজতে চলছে।এখনো জুনইদের আসার নাম নেই বাড়িতে।শান্তা বেগম ছেলের চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন।থেকে থেকেই মুখে আঁচল চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছেন।এদিকে জুনইদ কে ফোনের উপর ফোন করেই যাচ্ছে নিশার বাবা, কাকা কিন্তু জুনইদের ফোন সুইচস্টপ বলছে।সবাই চিন্তার জন্য হা-হুতাশ করছে।শান্তা বেগম রেগে ক্ষুব্ধ হয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে রমিজ আহমেদের দিকে তাকালেন,

“আজ আপনার জন্য যদি আমার ছেলের কিছু হয় আমি আপনাকে কোনো দিন ও ক্ষমা করবো না।সব সময় আপনি আমার ছেলেকে বিজনেস এর ব্যাপারে জোর করেছেন ওর পছন্দ না জেনেও।আপনার ব্যবসার কাজে বেরিয়েই আজ এই অবস্থা।এখনো এতো রাত হয়ে গেলো ছেলেটা বাড়ি ফিরছে না।” কথা শেষ করে মুখে হাত চেপে কান্না করে দিলেন।নিশা তার মাকে ধরে সোফায় বসিয়ে শান্ত হতে বললো।রমিজ আহমেদ টু শব্দটিও করলেন না স্ত্রীর কথায়।

আলতাফ আহমেদ বলে উঠলো, আহা ভাবি আপনি শান্ত হোন।ভাইজান কে এখন এসব বলার সময় নয়।তাছাড়া আমরাও এখন চিন্তায় আছি ওঁকে নিয়ে।ওতো এমন ছেলে না যে ফোন বন্ধ করে রাখবে।

রমিজ আহমেদ মুখ থমথমে করে রইলেন।তার ও ভেতর টা হুহু করছে।তার একমাত্র ছেলে জুনইদ।এতো বড় ব্যবসা তিনি আর তার ভাই সামলাতে গিয়ে হাপিয়ে যাচ্ছেন।তাই তার ইচ্ছে তার ব্যবসায় তার ছেলেকে দায়িত্ব দিয়ে নিজের কাধ টা হালকা করবেন।কিন্তু তার মানে তো এটা নয় যে তিনি তার সন্তানের কোনো রকম কোনো ক্ষতি চান।

শান্তার কান্না থামছেই না।নিশা চেয়েও তার মাকে শান্ত রাখতে পারছে না।

হঠাৎই নিশার ফোন টুংটাং ধ্বনি তোলে বেজে উঠলো।আদরের বড় ভাই ফোন করেছে ভেবেই চট করে ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থাপন করলো।নাহ, দেখলো আন-নাম্বার।সবাই হৃষ্টপুষ্ট দৃষ্টিতে তাকালো নিশার দিকে।একটা ক্ষীন আশার প্রদীপ জ্বেলে উঠে সবার চোখ মুখে।

রমিজ আহমেদ চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন,”কে ফোন করেছে নিশা?”জুনইদ নাকি?”

নিশা অনুদ্দিষ্ট কন্ঠে জবাব দিলো, না বাবা আন-নাম্বার।বলতেই ফোন টা কেটে গেলো।

“ফোন টা তুলো না?জুনইদ ও তো হতে পারে” রমিজ আহমেদ এর কথা শেষ হতেই নিশার ফোন টা আবার বেজে উঠলো। নিশা তারাতাড়ি করে এবার ফোন টা রিসিভ করলো।

“হ্যালো কে বলছেন?”

জুনইদ অকপটে বলে উঠলো,
“নিশা আমি তোর ভাইয়া।”

ভাইয়ের কথা শুনে যেনো জ্বানে পানি এলো।নিশা গলায় তীক্ষ্ণতা টেনে অস্থির কন্ঠে বলে,

“ভাইয়া কোথায় তুমি?আমরা এদিকে চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছি।তুমি এটা কার নাম্বার থেকে ফোন করেছো।কোথায় আছো তুমি।তোমার ফোন কই?”

সবার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।সবাই একটু হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইলো নিশার দিকে।শান্তা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে নিশার দিকে এগিয়ে এলো।

পর পর এতো গুলো প্রশ্ন করাই জুনইদ বুঝলো যে বাড়ির সকলেই তাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে।এতো কিছুর মধ্যে ফোন করার সময় পাইনি সে।বাসায় ফোন দিতে গিয়ে দেখলো তার ফোন টা অফ হয়ে গেছে। হইতো চার্জ ছিলো না।তাই সে মায়াবীর ফোন টা নিয়ে বাড়িতে ফোন করেছে জানিয়ে দিতে যে সে ঠিক আছে।অপাশ থেকে নিশা আবার বলে,

“ভাইয়া কথা বলছো না কেন তুমি?”।তুমি ঠিক আছো তো? কোনো বিপদ হয়নি তো আবার?”

জুনইদ বলে উঠলো, “না না কিছু হয়নি চিন্তা করিস না আমি ঠিক আছি।ফোনে চার্জ ছিলো না তাই অফ আছে এখন।আমি বাড়ি গিয়ে সব টা বলবো।এখন বললেও বুঝবি না।মাকে আর বাড়ির সবাইকে চিন্তা করতে মানা কর।আমি একটা কাজে আটকে গেছি।কাল আমি বাড়ি এসে সব টা বলবো এখন বলার সময় নেই।রাখছি।আর বাবাকে বলিস উনার ফাইল নেওয়া হয়েছে সব ঠিক ঠাক আছে।”

নিশা আর কিছু বলবে তার আগেই জুনইদ কল টা কেটে দিলো।নিশা ওর মা’কে বলে, মা ভাইয়া ঠিক আছে।ও একটা কাজে আটকে গেছে।ওর ফোনের চার্জ ছিলো না বলেই ফোন টা বন্ধ পেয়েছি আমরা।

আমাকে কেন দিলি না।ওর সঙ্গে কথা বলতাম আমি।আচ্ছা করে দিতাম ওকে বকে।এতো বড় হয়ে গেছে আমাকে চিন্তায় না ফেলে তো শান্তি পায় না।বাপ ছেলেতে জীবন টা ভাজা ভাজা করে শেষ করে দিলো একেবারে।শান্তা বেগম কাদতে কাদতে বললেন।

“মা আর কেদো না তো। চিন্তা করো না ভাইয়া ঠিক আছে।”

আলতাফ আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন,”জুনইদ কোথায় আছে এখন সেটা বলে নি?”

“না কাকু কিছু বললো না। শুধু বললো একটা কাজে আটকে গেছে তাই আজ আসতে পারছে না।চিন্তা করতে বারন করলো ও ঠিক আছে।”

“ওর কি এতো কাজ যে এভাবে আমাদের চিন্তার মধ্যে ফেলে দিলো।একবার ফোন করে জানাতে পারলো না।এতোটা দায়িত্বজ্ঞান হীন কেন সে।রমিজ আহমেদ কপট রেগে বলে উঠলেন।”

শান্তা বেগম রমিজ আহমেদ এর দিকে আক্ষেপ ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ড্রয়িংরুমে ত্যাগ করে গটগট করে চলে গেলেন।তিনি বাপ ছেলে দুজনের উপর ই অনেক ক্ষেপে আছেন।রমিজ আহমেদ আহত দৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন নিজের স্ত্রীর যাওয়ার পানে।


জুনইদ জানে আর একটু বেশি কথা বললেই জানতে চাইবে সব টা এক্ষুনি।কিন্তু শুধু শুধু চিন্তা বাড়াতো চাইলো না সে।তাই মায়াবীর ফোন থেকে শুধু এটা জানালো যে ঠিক আছে সে।অনিলার জ্ঞান ফিরেছে।কিন্তু কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি এই পর্যন্ত। অতি শোকে পাথরের মতো বসে আছে।স্ট্রুয়ার্ট ও কোনো রকম আওয়াজ না করে খাচার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে বসে আছে।এতো রাত হয়ে গেছে কারোর চোখের পাতা এক হয়নি।ডক্টর বলেছেন বুকে লাগা গুলি বের করেছেন।আজকের রাত না গেলে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না অনিলার বাবার কন্ডিশন কেমন। জুনইদ এগিয়ে এসে মায়াবীর দিকে ফোন টা এগিয়ে দিলো,

“আপনার ফোন টা আপু!”

মায়াবী তাকিয়ে শুকনো একটা হাসি দিলো।
সাথে কিছু টা অবাক ও হলো জুনইদের মুখে আপু ডাক শুনে।সে ফোন টা হাতে নিয়ে বলে,

“আপনার পরিবারের সবাই হইতো চিন্তা করছে আপনার আপনি তো ফিরে গেলেই পারতেন!”

জুনইদ মাথা নিচু করে এবং স্বস্থান দাঁড়িয়ে বলে,

“আমি আপনাদের কে এই অবস্থায় কিভাবে ফেলে যাবো বলুন তো।আমার এখন আপনাদের পাশে থাকাটা জরুরি মনে হয়েছে।আর কোনো কাজ নেই আমার এখন এই মুহুর্তে।তাছাড়া বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি কেউ চিন্তা করবে না এখন আর আমাকে নিয়ে।”

“আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।কৃতজ্ঞতা জানানোর কোনো ভাষায় যে আমার নেই।”আজকে আপনি না থাকলে হইতো বাবাকে হসপিটাল এ আনতেই পারতাম না।আর আমার বাবাকে কথা শেষ করতে পারলো না মায়াবী।গলা ধরে এলো।চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো মুহুর্তেই।”

“ছি ছি আপু কি বলছেন।আমি যদি আপনার ভাই হতাম তাহলে কি আপনি আপনার ভাইকে এভাবে বলতে পারতেন।”

মায়াবী ছলছল চোখে তাকালো জুনইদের দিকে।গলার কাছে কান্নারা দলা পাকিয়ে এলো।মা বোনের দিকে তাকালেই ভেতর টা মড়মড় করে যেনো ভেঙে যাচ্ছে।কি অবস্থা হ’য়েছে ওঁদের।একটা ধাক্কায় সবকিছু এক নিমিষেই শেষ করে দিলো।

জুনইদ এগিয়ে গেলো অনিলার দিকে।অনিলা একমনে কেবিনের বেড বসে দেয়ালের দিকে দৃষ্টি স্থীর রেখেছে।মাঝে মাঝে আবোল তাবোল বকছে।

“বাবা তোমার কিচ্ছু হবে না।কিছুই হতে দেবো না।আমি ওই লোক গুলোকে শাস্তি দেবো যারা তোমার এই অবস্থা করেছে।আরও অনেক রকমের আহাজারি করে আওড়াচ্ছে।”

বাবার শোকে মেয়েটা আধ পাগলি হয়ে গেছে একেবারে।একটা প্রবল ঝড় এসে সব কিছু এভাবে তছনছ করে দেবে কেউ কি ঘুনাক্ষরেও ভেবেছিলো।কাল অব্দি মেয়েটার মুখ জুড়ে ছিলো স্নিগ্ধতা।আর আজকেই সেই মুখ জুড়ে শুধুই বিষন্নতা।জুনইদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“মিস সুনামি?”

জুনইদের গলা শুনে আনমনে তাকিয়ে আবার দেয়ালের দিকে দৃষ্টি স্থীর করলো।জুনইদ সেটা দেখে আবার বলে উঠলো,

“মিস সুনামি তোমার ঘুমের প্রয়োজন।তুমি যদি এভাবে ভেঙে পরো তাহলে আন্টিকে তোমার আপুকে কে সামলাবে বলো তো।”

অনিলা ওইভাবেই তাকিয়ে বললো,”আমি কি করে ঘুমাবো আমার বাবার ওই অবস্থা আর আমি শান্তিতে ঘুমাবো। এটা কি বলছেন আপনি।”

“দেখো আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা।কিন্তু বাস্তবতা মানতে আমরা বাধ্য বলো!’ কপালের লেখন তো আর খন্ডানো যায় না।আমাদের ভাগ্যের উপর তো আর কারোর হাত থাকে না!”

জুনইদের কথায় শান্ত শীতল দৃষ্টিতে তাকালো অনিলা।ছলছল নয়নে ভাঙা গলায় বললো,

“জানেন আমার বাবা না খুব সৎ একজন মানুষ।উনি ব্যাংক অফিসার।সারাজীবন সৎ ভাবেই চলেছেন।অনেকেই বাবাকে ঘুষ দিয়ে বে-আইনি কাজ করাতে চেয়েছে,ভয় দেখিয়েছে,হুমকি দিয়েছে, বাবা অবৈধ কাজ করতে চান নি বলে।কিন্তু বাবা সেসবে ধার ধারে নি।আমার বাবা তো কারোর কোনো ক্ষতি করেন নি তাহলে আমার বাবার আজ এই অবস্থা কেন বলতে পারেন?”

জুনইদ কি বলবে ভেবে পেলো না।লম্বা শ্বাস টেনে শুধু এটা বলে,

আমাদের চলার পথে অনেক বাধা বিপত্তি আসবে।তুমি বার বার হোচট খাবে।কিন্তু তোমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে।ঝড় আসবে সেই ঝড়ে তছনছ করে ভেঙে গুড়িয়ে দেবে তোমাকে কিন্তু তোমাকে নিজেকে আবার গুছিয়ে নিতে হবে নতুনভাবে,নতুনত্ব কিছুর মুখোমুখি হতে হবে।সব বিপদ আপদ কে মাথা পেতে নিয়ে লড়ার নাম ই তো জীবন যুদ্ধ।হাজারও প্রতিকুলতা আসবে তোমাকে প্রতিহত করতে,ভেঙে গুড়িয়ে দিতে কিন্তু আমাদের তো বাস্তবতা মেনে নিয়ে বাচার মতো বাচতেই হবে তাই না।চিন্তা করো না আল্লাহর রহমতে আংকেল ঠিক হয়ে যাবেন।

অনিলার আর সহ্যশক্তি নেই এই কষ্ট কে উপেক্ষা করার।জাপ্টে ধরলো সে জুনইদকে।একটা ভরসার জায়গা পেতে।একটা কান্নার জায়গা পেতে, যেখানে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে নিজের কষ্ট লাঘব করতে পারবে।হুহু করে কান্নায় ভেঙে পরলো সে।জুনইদ অনিলাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

মায়াবী ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো।নার্সকে বলে সে তার মাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।আর এই কেবিনে এসেই জুনইদের শেষ কথা শুনতে পেয়েছে।তার বোন কে সে এমন ভাবে সামলাচ্ছে যেনো সে তার অতিব প্রিয় কেউ।এভাবেও কি কাউকে আগলানো যায় কোনো অনুভূতি ছাড়া।কোনো ভালোবাসা ছাড়া।এটাই কি তবে ভালোবাসার আরেক রুপ!”

#চলবে

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ১৪
#লেখিকাঃ রাদিয়াহ রাফা রুহি

“আপনি আমার হবু স্ত্রী মায়া।কিছুদিন পর আমাদের বিয়ে হবে আর এতো কিছু হয়ে গেছে আমাকে একটা বার জানান নি পর্যন্ত।কেন মায়া?”প্রশ্নবোধক নয়নে তাকায় ফাহাদ মায়াবীর দিকে।

মায়াবী দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলে, “কি করে জানাতাম আপনাকে।পরিস্থিতি তখন অন্য রকম ছিলো।এতো কিছুর মধ্যে আপনাদেরকে জানানোর কথা মাথাতেই আসে নি।

ফাহাদ রোষানল দৃষ্টিতে তাকালো মায়াবীর দিকে,” জানাতেন,যদি মনে রাখার মতো কেউ হতাম তাহলে জানাতেন।জানাতেন, যদি আপনি আমাকে নিজের কেউ মনে করতেন।এখনো বোধহয় আপন কেউ হয়ে উঠতে পারিনি।আমি যদি এতোটুকুও আপনাদের উপকারে আসতে পারতাম তাহলে অন্তত একটু শান্তি পেতাম।আজ আপনার বাসায় না গেলে তাহলে হইতো জানতেই পারতাম না এসব কিছু।এটা একেবারেই আশা করি নি আপনার থেকে মায়া।”

মায়াবী নত মুখে তাকিয়ে রইলো।কিছুই বলার নেই তার।সত্যিই এতো কিছুর মধ্যে সে ভুলেই গেছিলো জানাতে।ফাহাদও তো ফোন করে নি তাকে।উনি যদি ফোন করতেন তাহলে কি ধরতো না সে।সে কেন ফোন করেনি।একটা চাপা অভিমান উপদ্রুত হলো তার মনে।মায়াবীকে মাথা নত করে থাকতে দেখে ফাহাদ আবার বলে উঠলো,

“আমি জানি মায়া আমার একবার ফোন করা উচিত ছিলো আপনাকে।কিন্তু আমি কাল এতো টাই ব্যস্ত ছিলাম যে ফোন হাতের নাগালে নিতে পারিনি পর্যন্ত।রাতে ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো।ঘুমিয়ে গেছিলাম বাড়ি ফিরেই।আমি ভাবলাম এক নজর দেখে আসবো সকালে গিয়ে আপনাকে।আর সকালে উঠেই অফিসে যাওয়ার আগে আপনার বাসায় যায়।সেখানে যেতেই দারোয়ান কাকা বললেন সব টা।আর আপনাকে ফোন করেই জানলাম বাকিটা।”

“বুবু এমনিতেই অপরাধ বোধে ভুগছে ফাহাদ ভাই।বুবু ভাবছে আজ বাবার এই অবস্থার জন্য বুবুই দায়ী।কিন্তু সত্যি তো এটাই যে এটা আমার বাবার ভাগ্যে ছিলো।সত্যিই কাল পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো না যে জানানোর কথা মাথায় আসবে।প্লিজ আবার সব টা মনে করিয়ে দিয়ে সেটার পুনরাবৃত্তি করবেন না!”

মেয়েলি কন্ঠ পেয়ে ফাহাদ তাকালো কন্ঠের অধিকারীনির দিকে।দেখলো অনিলা।অনিলাকে সে এই প্রথম বার সামনাসামনি দেখলো।এর আগে ছবি দেখেছে শুধু।আর ফাহাদকেও ছবি তে দেখেছে অনিলা।দেখেই চিনতে পেরেছে অনিলা ফাহাদ কে।

“অনিলা তুমি!ঠিক বললাম?”

“হ্যাঁ! ” অনিলা ছোট্ট করে জবাব দিলো।

ফাহাদ তার সরু পাতলা জিব দিয়ে নিজের চেরির মতো ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো।মায়াবীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরতে দেখে ফাহাদের কেমন যেনো বক্ষস্থলে যন্ত্রণা অনুভব হলো।এই তো সেদিন এক মাস আগের কথা।মায়াবীকে সে একটা রেস্টুরেন্টে দেখেছিলো প্রথম।তারই ফান্ডের ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের কে নিয়ে খেলা করছিলো।কি প্রানবন্ত লাগছিলো মেয়েটাকে সেদিন।ওর সেই মন কাড়া হাসি আর উচ্ছ্বাস, উচ্ছ্বলতা দেখে এক প্রকার মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো সে।মায়াবী সেখানে প্রায় রোজ ই যেতো।সময় পেলেই গিয়ে খুবই স্নেহের সাথে বাচ্চা গুলো কে খাওয়াতো নিজের হাতে।এরপর ফাহাদ সময় করে তার ফান্ডে যেতো একটাবার মায়াবী কে দেখতে।ফাহাদ ইচ্ছে করেই মায়াবী কে ফলো করে দেখেছিলো আসলে মায়াবী রোজ কি করে।সামনেই একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে প্রত্যেক কে নিজের হাতে খাইয়ে দিতো মায়াবী।আর বিকেলে খেলা করতো বাচ্চাদের সাথে।মায়াবীর এই সব দেখেই মুগ্ধ হয়েছিল ফাহাদ।তাই তো সব রকমের খোজ খবর নিয়ে তার মামা মামিকে দিয়ে সম্বন্ধ পাঠিয়েছিলো।বাবা মায়ের এক্সিডেন্ট এ মৃত্যুর পর বড্ড একা হয়ে গেছিলো সে।এক্সিডেন্ট,রক্ত এসবে ভীষণ ভয় তার।মা বাবার মৃত্যুর পর ছোট বেলা থেকেই সে মামা মামির কাছেই মানুষ হয়।সে মায়াবীর কষ্ট টা উপলব্ধি করতে পেরে আফসোসের স্বরে বললো,

আংকেল এর এই অবস্থা আর আমি এতোটা পরে জানলাম।তাই মাথাটা একটু ডিস্টার্বড হয়ে গেছিলো।যায় হোক আ’ম স্যরি মায়া।আমি সেভাবে কিছুই বলতে চাইনি।আমি আপনাকে হার্ট করার জন্য এসব বলিনি। আমার বোঝা উচিত ছিলো আপনাকে।আমি হইতো একটু বেশিই রিয়েক্ট করে ফেলেছি।আমি সত্যিই দুঃখিত! ”

মায়াবী হাতের উল্টো পিঠ চোখ মুছে বললো, ইটস ওকে ফাহাদ।এখন বাবা ঠিক আছেন।দুই এক সপ্তাহের মধ্যেই বাবাকে হসপিটাল থেকে বাবাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো।

কথা শেষ করেই মায়াবী প্রস্থান করে।ফাহাদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়াবীর যাওয়ার পানে।এরপর ফাহাদ আর মায়াবীর মধ্যে আর কথা হয়নি।মায়াবীর গভীর চোখ দেখে ফাহাদের বুঝতে আর বাকি থাকে না মায়াবীর অভিমান হয়েছে।

অনিলার মন খারাপ হয়েছে ভীষণ।একটু আগেই সে জুনইদকে প্রায় জোর করেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।জুনইদ কিছুতেই যেতে চাইছিলো না।তার জেদের কাছে হার মেনে যেতে বাধ্য হয়েছে।ফাহাদ এখন এখানেই থাকবে।বিকালে আলিফ হোসেন এর জ্ঞান ফিরলে সবাই দেখা করে উনার সাথে।জুনইদ ও এসে দেখা করে গেছে। নিশাও এসেছিলো দেখা করে গেছে অনিলার সাথে।জুনইদ ও বাড়ি গিয়ে সব টা খুলে বলেছে।সব টা স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় চলছে এখন।

এখন আস্তে আস্তে কথা বলতে পারেন আলিফ হোসেন।নার্স,দুই মেয়ে আর মনিরা বেগম সবাই দিন রাত এক করে সেবা যত্ন করছেন আলিফ হোসেন এর।দুই সপ্তাহের মধ্যেই আলিফ হোসেন কে রিলিজ দেওয়া হলে বাড়ি নিয়ে আসে।এর মধ্যে অনিলার ভার্সিটির মুখ দেখাও হয় না।মায়াবীর বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।আলিফ হোসেন পুরো পুরি সুস্থ হয়ে গেলেই বিয়েটা সম্পন্ন হবে।আলিফ হোসেন সুস্থ হলেই বিয়ের ডেট আর এক সপ্তাহ পর দেওয়া হয়েছে। বোনের বিয়ের জন্য অনিলার আর ফেরা হলো না তার ফ্ল্যাট এ।কলেজে প্রায় এক মাস পদার্পণ হয়নি।বাবার অসুস্থতা, বোনের বিয়ে সব কিছুই জানানো হয়েছে ভার্সিটির প্রিন্সিপাল কে।অনিলা রাতে ফোন ঘাটছিলো।হঠাৎ ওর মাথায় একটা দুষ্টু আইডিয়া এলো। এই কদিনে জুনইদ এর সাথে কথা হয়নি বললেই চলে।যেটুকু হয়েছে তার বাবার বিষয় নিয়ে টুকটাক কথা আর কি।

এখন রাত প্রায় দশ টা বাজতে চললো।অনিলা ফেসবুকে গিয়ে আইমান জুনইদ নাম দিয়ে সার্চ করলো।যথারীতি অনেক গুলো আইডি এলো।সব গুলোর ডিপি দেখতে দেখতে একটা তে জুনইদের ছবি দেখতে পেলো।আইডিতে গিয়ে রিকুয়েষ্ট দিলো সে। এবার এক্সেপ্ট করার পালা শুধু।চলুন আইমান জুনইদ আপনাকে একটু বাজিয়ে দেখা যাক।

জুনইদ ও ফেসবুক ঘাটছিলো কিছুই ভালো লাগছিলো না তার।এর মধ্যে খুবই কম কথা হয়েছে অনিলার সাথে।এতে যেনো বক্ষপিঞ্জরে কোথাও একটা শুন্যতা অনুভব হয়েছে তার।এর মধ্যেই একটা নিউ রিকুয়েষ্ট এলো।দেখলো শাপলা কড়ি নামের একটা আইডি।বাহ নাম টা তো বেশ ইন্টারেস্টিং।বেশি কিছু না ভেবে সে এক্সেপ্ট করলো।সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজ এলো,

“হ্যালো জুনইদ ”

“জুনইদ হাই লিখলো।”

জুনইদ ভাবছে নিশ্চয়ই এটা ওর কোনো বন্ধুর কাজ।ওর সঙ্গে ইয়ার্কি করার জন্য এটা করছে।আবার ম্যাসেজ এলো,

“হোয়াট আর ইউ ডুইং?”

জুনইদ এবার একটু রেগে গেলো।রিপ্লাই দিলো,

“আপনি কে যে আপনাকে বলতেই হবে আমি কি করছি।”

অনিলা ঠোঁট চেপে হাসলো।তারপর লিখলো,

“এই নাহ আপনি নাহ,!আমি আপনার থেকে দুই বছরের জুনিয়র তাই আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।”

জুনইদ রিপ্লাই দিলো,”এই তুমি আমাকে চেনো নাকি?”

“হুম চিনি তো!”

“কিভাবে? ”

“আপনি যে কলেজ এ পড়েন আমিও সেই কলেজেই পড়ি।অনিলা মুখ টিপে হাসছে আর ম্যাসেজ করছে।”

“আচ্ছা তো তুমি আমার ফেসবুক আইডি কোথা থেকে পেলে?”

“ঢুন্ডেসে সাব কুছ মিল যাতিহে, ইয়ে তো সিরফ ইক আইডি হ্যেই”

“আবার হিন্দি বলা হচ্ছে।”

“কেন আপনি তো হিন্দি বলতে পছন্দ করেন, তাই বললাম আর কি!”

“আমার ব্যাপারে তো দেখছি পিএইচডি করে রেখেছো”

“শুধু পিএইচডি কেন,তার থেকে বড় কিছু করতে হলেও করবো?”

জুনইদ রিপ্লাই করলো,” তো এতো রাতে আমাকে ডিস্টার্ব করার মানে কি শুনি?”

“এই আপনি কি ধরনের মানুষ হ্যাহ,একটা মেয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে আর আপনি কিনা বিরক্ত হচ্ছেন?”

“আমার কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। ওকে বাই!”

অনিলা এবার যেনো হাসি দমিয়ে রাখতে পারছে না।কিছু টা শব্দ করেই হেসে দিলো।হাসি থামিয়ে লিখলো,

“কেন? আপনি কি থার্ড পারসন নাকি?”

“হোয়াট দ্যা হ্যাল!”তুমি দেখবে আমি কি পারসন।আচ্ছা তুমি কোন ইয়ার বলো তো?এতো বেয়াদবি কি করে করতে পারো?”
একটা মেয়ে এই ধরনের বিহেভিয়ার কি করে করতে পারে।মনে হচ্ছে তুমি কোনো মেয়েই নও।তুমি কোনো ছেলে!জুনইদ এটা সেন্ড করেই দু চারটে উল্টো পালটা কথাও লিখে দিলো।”

তারপর ভাবলো এটা যদি ছেলে হয় তাহলে পালটা লোকাল ল্যাঙ্গুয়েজ এ নিশ্চয়ই রিপ্লাই করবে।কিন্তু নাহ কোনো উত্তর এলো না।

অনিলাও আন্দাজ করে চুপ করেই থাকলো।তারপর রিপ্লাই করলো,

“আমি বুঝতে পারিনি স্যরি!”আপনাকে সবার থেকে আলাদা মনে হয়েছিলো তাই কথা বলতে চেয়েছিলাম।

এই ম্যাসেজ টা পেয়ে জুনইদের একটু খারাপ লাগলো।ওর মন টা গলে গেলো।

“আচ্ছা ঠিক আছে।আমার ওইভাবে বলা উচিত হয়নি।কিন্তু তুমিও আর আমাকে নিয়ে ওরকম কিছু ভাববে না।আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।”

অনিলা তার শাপলা কড়ি একাউন্ট থেকে রিপ্লাই করলো,”আচ্ছা তাই! তা কে সে?আপনার জিএফ!আপনার জিএফ আছে বুঝি? কই কোনো দিন তো কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখিনি আপনাকে!”

জুনইদ উত্তর দিলো,

“ছিলো না বলেই যে এখন থাকবে না সেটা তো নয় তাই না” এখন আছে!জিএফ বলতে পারো আবার জীবনসঙ্গী ও বলতে পারো। সব কিছুই এখন সে! ”

জুনইদের জিএফ আছে শুনে অনিলার খারাপ লাগতে শুরু করলো।সে রিপ্লাই দিলো,

“আমি বিশ্বাস করিনা!”

“তো আমি কিভাবে বিশ্বাস করাবো তোমাকে এখন!”

“নাম্বার টা দেন আপনার জিএফ এর!”

“কিন্তু এতো রাতে কল করলে তো রাগ করবে আমার জিএফ! ওর ঘুমের ডিস্টার্ব হোক আমি চাই না।”

“ওকে তাহলে কাল নাম্বার টা দিয়েন।”

অনিলা বাই দিয়ে ফেসবুক থেকে বের হয়ে পরলো।জুনইদের জীবনে কেউ আছে ভেবেই তার চোখ ভিজে উঠলো।তার এতো টা খারাপ কেন লাগছে।অবশ্য এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে।আজ ম্যাসেজ করে জানতে তো পারলো জুনিইদ অন্য একজনের।সে মনে মনে ঠিক করলো জুনইদের জন্য যে তার মনে সুপ্ত অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল তা আস্তে আস্তে মুছে ফেলবে।কিন্তু চাইলেই কি মুছে ফেলতে পারবে সেই অনুভূতি। তার চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো।

#চলবে

আসসালামু আলাইকুম।নামাজ কায়েম করুন!