সম্রাজ্ঞী পর্ব-১২+১৩

0
98

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_12

রন্ধনশালার মেঝেতে মোড়া পেতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে হাফসা। কিছুটা দূরে কাঠের ছোট্ট আয়না ধরে সাজগোজে মত্ত ফাইজা। আজকাল বড্ড বেশিই সাজগোজ করতে শুরু করেছে সে। রাত-দুপুরেও তার সাজগোজ থেমে নেই। চোখ-মুখ কুচকে তাকালো হাফসা। বিরক্তির শ্বাস ফেলল ফস করে। মাজেদা বানু ছুটিতে আছে। রন্ধনশালার দায়িত্ব এসে পড়েছে হাফসার উপর। অথচ এই মেয়েটার কর্মকাণ্ডে সে বড্ড বিরক্ত হয়ে পড়ছে। তার এই বিশ বছরের কর্মজীবনে এরকম উড়নচন্ডী মেয়ে আর একটাও দেখেনি সে। কাজ-কর্ম সব ফেলে দেখো কেমন সাজগোজ করছে। মেয়েটা এমনিতেই অতিরিক্ত সুন্দরী, উঠতি বয়স- তার এতো সাজগোজের কী প্রয়োজন মাথায় আসে না হাফসার। সাজতে বসলে যেন দিন-দুনিয়া সব ভুলে যায় সে। মাজেদা বানুর মতো সাতির মহিলাকেও আজকাল গোনায় ধরছে না সে। যখন যা ইচ্ছা তা করে বেড়াচ্ছে। এমন সময় সে আয়না রেখে নিজের লম্বা গাউন দুলিয়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। চমকাল হাফসা। উত্তেজিত হয়ে খানিক উচ্চস্বরে বলল, “এই মেয়ে, কোথায় যাচ্ছ রাতবিরেতে?”

ঘুরে তাকালো ফাইজা। মিহি কন্ঠে বলল, “মহল ছাড়া আর কোথায়? একটু হেঁটে আসি। সবসময় এখানে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছি আমি।”

“এভাবে রাতবিরেতে মহলে ঘোরাঘুরি করার কোনো প্রয়োজন নেই। শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে।”

তার গম্ভীর স্বরকে যেন পাত্তাই দিলো না ফাইজা। হাসতে হাসতে বলল, “রাতবিরেতেই তো ঘোরাঘুরির আসল মজা। তুমি এসব বুঝবে না। ঘুমাও তুমি। আমি গেলাম।”

কথাটা বলেই ততক্ষণাৎ সে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। দরজাটাও ভিড়িয়ে যাবার প্রয়োজন মনে করলো না। ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো হাফসা। মেয়েটাকে নিয়ে ব্ড্ড ভয় হয় তার। আজকাল মহলে যা সব কান্ড-কারখানা শুরু হয়েছে। দু’দিন পরপর খুন হচ্ছে অথচ অপরাধীর কোনো সূত্রই মিলছে না। বেগমের মৃত্যু, বড় সুলতানার নিষ্ঠুরতা, মাজেদা বানুর অত্যাচার, সুলতানের বেদনা- কালবৈশাখী ঝড় যেন পূর্ণ বেগে ধেয়ে আসছে মহলের দিকে। তার স্বামী-সন্তান কেউ নেই। তাই হয়তো তার অবুঝ মন কম বয়সী ফাইজাকে আপন ভেবে নিয়েছে। কিন্তু মেয়েটার আজকাল এসব আজব কর্মকাণ্ডে সে ভীষণ চিন্তিত। তার জীবনের চল্লিশটা বসন্ত পেরিয়ে গেছে কিন্তু এতো চিন্তা সে আগে কখনোই করেনি। এসব সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতে কখন যে তার চোখদুটো লেগে এলো সে বোধহয় টেরও পেলো না।

রামান সাম্রাজ্যের বিশাল মহলখানায় লুকিয়ে আছে অগণিত রহস্য। যার হিসেব রাখা দায়। তেমনি একটা রহস্য হলো মহলের নিচের মাটি খোঁদাই করে বানানো অন্ধকার কাল-কুঠুরি। বারতি কোনো বিশেষত্ব নেই তার। সামন্য একটি ছোট্ট লোহার কারাগার। আলো পৌঁছায় না সেখানে, চারপাশ বিদঘুটে অন্ধকার। তবে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে অজানা বহু রহস্য যার সন্ধান জানেন না স্বয়ং সুলতান। এই কাল-কুঠুরি তৈরি করা হয়েছিল তার পিতা সুলতান শাহজিলের শাসনকালে। সে এই গুপ্ত কুঠুরি বানিয়েছিলের বিশেষ এক কয়েদির জন্য। পরে অবশ্য তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। মুক্ত নয়, মুক্তির স্বাদ দিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। যার সন্ধান সে ব্যতীত শুধু তার স্ত্রী ওয়াসিফা সুলতানই জানেন। এই রহস্য সে নিজের মধ্যে ধারন করছে আজ দশটা বছর। এই কাল-কুঠুরির পরিচর্যার জন্য গোপনে সৈনিক নিযুক্ত করা আছে। যারা সকলেই সুলতান শাহজিলের লোক। কাল-কুঠুরির সমস্ত ব্যবস্থাপনা খুবই গোপনে করা হয়। সুলতান শাহজিল-এর শাসনকাল ফুরিয়ে গেলেও সে এই কাল-কুঠুরির দায়িত্ব হস্তান্তর করেনি বর্তমান সুলতানের নিকট। কাল-কুঠুরিতে আটকে রাখা বর্তমান কয়েদিকে সে সকলের আড়ালেই রাখতে চান,এই দুনিয়ার সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে। সুলতান শাহজাইন যেন এই কুঠুরির খোঁজ না পায় তার জন্যেও বহু প্রচেষ্টা চালাতে হয় তাকে। কাল-কুঠুরির বর্তমান কয়েদি কোনোভাবে সুলতানের সম্মুখে আসলেই শেষ হবে তাদের সমস্ত শ্রম। এই কয়েদি যে সুলতান শাহজাইনের ভীষণ প্রিয় কেউ!

রাত যখন গভীর, সমস্ত প্রাণী ঘুমে আচ্ছন্ন, প্রকৃতি নিস্তব্ধ, চারপাশ সুনসান- ঠিক সেই সময় জেগে উঠলো কাল-কুঠুরির কয়েদি। হাত-পায়ে তার শক্ত লোহার শেকল পড়ানো। বেড়ি পড়ানো হয়েছে গলায়। সারাদিনে একবারই মাত্র তাকে খাবার দেওয়া হয়। তবে তা পর্যাপ্ত পরিমাণে। যা দিয়ে তার একটা দিন ভালোভাবেই কেটে যায়। এখন সময় কত তার হিসেব নেই তার নিকট। ধীরে ধীরে চোখ মেলল সে। কাতর চোখে তাকালো আশেপাশে। দিনেও যেমন আঁধার, রাতেও তেমন আঁধার। একটা ছোট্ট লন্ঠন পর্যন্ত নেই সেখানে। টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো সে। পারলো না। শেকলের ভারে বসে পড়লো। তার উস্ক-শুষ্ক চুল, লাল টকটকে চোখ যেন ভয় ধরাতে পারে যে-কোনো সাধারন মানুষের মনে। তার ফর্সা মুখশ্রীতে ময়লা জমে বড্ড অসৌন্দর্য প্রকাশ করছে। আকস্মাৎ শেকলসহ নড়ে উঠলো সে। ভয়ঙ্কর চোখে তাকালো করাগারের দ্বারের দিকে। গর্জে উঠলো চাঁপা স্বরে। ভয়ঙ্কর! সে শব্দ খুবই ভয়ঙ্কর।

অচিরেই আরো একটা বিষাদঘন রাত কেটে গেল। কারোর নীরব কান্না, আহাজারি, কারোর নিখুঁত ষড়যন্ত্রের সাক্ষী হয়ে অন্ধকার ত্যাগ করে দিনের আলো ফুটে উঠলো। আজ দ্বিতীয় রোজা। তবে অনুভূতিটা প্রথম রোজার মতোই। সকালের আবছা শীতল আবহাওয়ায় সকলেই গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। সেহেরি খেয়ে, নামাজ পড়ে ঘুমাতে প্রায় সকালের আলো ফুটেই যায়। তাই ঘুমটা আরো গভীর হয় এ সময়। ঘুমের মাঝেই শরীরের চাদরটা আরো টেনে নিলো জারনাব। ভালো করে জড়িয়ে নিলো শরীরের সাথে। এ সময়টা যতটা শীতল থাকে সারাটা দিন সেরকম শীতল থাকলে তো আর কথাই নেই। তবে সেটা হবার নয়। দিন যত বাড়তে থাকবে শীতলতা তত কমে আসবে। ধীরে ধীরে সূর্যের তাপ প্রখর হবে, উষ্ণ হবে পরিবেশ। খটখট শব্দে ঘুমের গভীরতা কমে এলো জারনাবের। আড়মোড়া ভেঙে ঘুম ঘুম চোখে পাশ ফিরে তাকালো সে। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সবসময়ই তার ঘুম জোভিয়ার আগে ভাঙ্গে। তাই সে রোজই ঘুম ঘুম দৃষ্টিতে আগে নিজের পাশে ঘুমিয়ে থাকা জোভিয়াকে এক নজর দেখে নেয়। কিন্ত আজ নিজের পাশে জোভিয়াকে দেখতে না পেয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসলো সে। ঘরের চারপাশে নজর বুলাতেই কিয়ৎ দূরে দেয়ালের কোনায় নজরে এলো জোভিয়া। তার ব্যক্তিগত সেই কাঠের বাক্সটা খুলে বসেছে সে। তবে জামা-কাপড় ভাজ করছে না। বাক্সটার ভেতরের দিকে উবু হয়ে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা করছে। যার দরুন খটখট আওয়াজটা সৃষ্টি হচ্ছে। ইতিমধ্যে পুরোপুরি ঘুম ছুটে গিয়েছে জারনাবের।বড্ড আশ্চর্য হলো সে। এতো সকালে জোভিয়া উঠে পড়েছে!

শরীর থেকে পাতলা চাদরটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। জোভিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলো সে ছোট্ট হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে বাক্সতে নতুন কাটা মারছে। ভ্রু কুচকাল জারনাব। বাক্স তো ভালোই ছিলো। তবে আমলে নিলো না বিষয়টা। ভাবলো, হয়তো কাটা খুলে গিয়েছিল কিন্তু সে দেখেনি। দ্রুত সে নিজের ব্যক্তিগত বাক্সটার দিকে তাকালো সাবধানী চোখে। এই বাক্সটা তার আবেগ। তার সংসার জীবনের বহু স্মৃতি লুকিয়ে আছে তাতে। যেগুলো সে প্রকাশ করতে চায় না অন্য কারোর নিকট। তাই বাক্সটা বিছানার নিচে সরিয়ে রাখে সবসময়। তবে জোভিয়ার সেসবে ধ্যান নেই। সে তার বাক্সটা দেয়ালের পাশেই রেখে দেয়। আর ভাবলো না সে। পেছন থেকেই জোভিয়ার কাঁধে হাত রাখলো সে। ঘুরে তাকালো জোভিয়া। তাকে দেখে ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে মিস্টি একটা হাসি দিলো। অমনি মনটা ভালো হয়ে গেল জারনাবের। বোনের এই হাসিটাই যে তার সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয়। হাতুড়ি ফেলে উঠে দাঁড়ালো জোভিয়া। মাত্র ঘুম থেকে ওঠার কারনে তৈলাক্ত হয়ে আছে জারনাবের মুখমণ্ডল। আচমকা তেলতেলে কপালটাতে চুমু বসিয়ে দিলো সে। দ্রুত সরে দাঁড়ালো জারনাব। বিরক্ত স্বরে বলল, “আহ! জোভিয়া, পুরো মুখ তেলতেলে হয়ে আছে।”

মনোক্ষুন্ন হলো জোভিয়া। কপাল কুচকে বলল, “ভাব নিয়ে সরে যাচ্ছ কেন? দু-একটা চুমু খেলে রোজা ভাঙবে না।”

“আরেহ বাবা! মুখে তো তেল লেগে আছে।”

“তাতে তোমার কী? চুমু দিয়েছি আমি আর সমস্যা হচ্ছে তোমার। আসলে তুমি আমাকে ভালোই বাসো না।” নারাজ স্বরে বলল জোভিয়া।

জারনাব সন্দিহান গলায় বলল, “মতলব কী? সকাল সকাল হঠাৎ এতো ভালো হয়ে গেলে তুমি! নিশ্চয়ই কোনো ঘোটালা করেছো বা করার ইচ্ছা আছে। কীসের ধান্দা করছো আবার?”

“তোমার কি আমাকে ধান্দাবাজ মনে হয়? তুমি আমাকে এভাবে সবসময় সন্দেহ করো কেন বলোতো?” বিস্মিত কন্ঠে বলল জোভিয়া।

গললো না জারনাব। উল্টো দ্বিগুণ সন্দেহ নিয়ে বলল, “উঁহু! ঘাপলা তো একটা আছেই। না হলে এতো ভালো মানুষ তুমি নও যে নিজ থেকে সই-সকালে উঠে পড়বে। শুনো, আগেই বলে দিচ্ছি উল্টা-পাল্টা কোনো কাজ করো না। এমনিতেই জিদানের গলায় ছুরি ধরে বিপদকে দাওয়াত দিয়ে ঘরে এনেছো।”

অধর বাঁকালো জোভিয়া। মুখ ভেঙচি দিয়ে বলল, “কচু করেছি।”

জারনাব আরো কিছু বলার পূর্বেই সে হনহন করে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আব্বাজানের কামরার সম্মুখে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুকি মেরে দেখে নিলো সে ঘুম থেকে উঠেছে কি-না। আব্বাজানকে খাটের উপর বসে তসবি জপতে দেখে হাসিমুখে কামরায় ঢুকে পড়লো। চোখ তুলে তাকালেন আবদুর রহমান। উজ্জ্বল মুখে বললেন, “আরে আমার ছোট আম্মা যে! আসুন আসুন।”

বিছানায় তার পাশে গিয়ে বসলো জোভিয়া। আবদুর রহমান পুনরায় বললেন, “কী ব্যপার? আজ এতো দ্রুত উঠে পড়েছো? চোখ-মুখ এমন ফোলা ফোলা লাগছে কেন? ঘুম হয়নি?”

উত্তর দিলো না জোভিয়া। কৌশলে এড়িয়ে গেল কথাখানা। ওষুধের থলে নেড়েচেড়ে দেখে রাগান্বিত স্বরে বলল, “আপনি আজ সেহেরিতে ওষুধ খাননি?”

হতাশার তপ্ত শ্বাস ফেললেন আবদুর রহমান। মেয়ের রাগের কারন উপলব্ধি করতে পারলেন তিনি। সেহেরিতে জোভিয়া তাকে ওষুধ বের করে হাতে দিয়ে গিয়েছিল খাওয়ার জন্য। আজান দেওয়ার সময় হয়ে এসেছিল তাই সেই তাড়াহুড়োতে সে আর তার সামনে দাঁড়িয়ে ওষুধ খাইয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু তিনি ওষুধ খাননি। নিজের অতীতের পাপকর্মের কথা চিন্তা করলেই তার নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে যায়। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় যেন দ্রুত এই জীবনের সমাপ্তি ঘটলেই সে এই অনুতপ্ততা থেকে মুক্তি পেত। কিন্তু মেয়ে তো তার কোনো কথা শুনতে নারাজ। মেয়েদের অতিরিক্ত সেবা-যত্নেই হয়তো এখনো জীবিত সে। নয়তো কবেই এই ক্ষত-বিক্ষত পা পচে গিয়ে তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসতো! বাঁচার ক্ষীণ ইচ্ছাটাও বুঝি নেই তার। পূর্বের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলো যে বড্ড পোড়ায় তাকে! শ্বাস নিতে দেয় না স্বাধীনভাবে! নিজ হাতে সম্পাদন করা কর্মগুলোই যেন আজ তার শ্বাসরোধ করছে অদৃশ্যভাবে!

চেঁচামেচি করলো না জোভিয়া। সে জানে আব্বাজানের মনের অবস্থা। মানুষটা নিজ কর্মের জন্য আজ এতোটাই অনুতপ্ত যে পারলে যেন অতীতে ফিরে গিয়ে পাপগুলোকে সুধরে নিতো। কিন্তু তা যে অসম্ভব! কখনোই হবার নয়! ওষুধের থলে রেখে বেরিয়ে এলো সে। বারান্দার পাশে রাখা পানির পাত্রটা নিয়ে এগিয়ে গেল রান্নার ঘরের দিকে। মাঝারি আকারের পাতিলটা ভরে তুলল পানি দিয়ে। অতঃপর চুলায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ। আনমনে লাকরি ঠেলে দিচ্ছে চুলার মধ্যে। ধ্যান যেন তার অন্য কোথাও। কালো ডাগর ডাগর আঁখিজোড়ার উদাসী চাহনি। কিছু একটা ভাবছে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করলো পানি। যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশিই উত্তপ্ত হয়ে গেছে। সেদিকে ধ্যান নেই তার। অনিমেষ চেয়ে আছে আগুনের দিকে। লাকরি ঠেলে দেওয়ার হুঁশ নেই। লাকরি ফুরিয়ে আগুন যখন দাউদাউ করে উপরে উঠতে শুরু করেছে তখনও সে অপলক চোখে সেই দৃশ্য দেখেই চলেছে। এক সময় আগুনের তপ্ত হাওয়া তার শরীরে লাগলো। চমকালো জোভিয়া। দ্রুত হাতে লাকরি ঠেলে ঢুকিয়ে দিলো চুলার ভেতর। তাড়াহুড়ো করে ভুল বসত কোনো আলগা কাপড় বা লুছনি ছাড়াই ধরে বসলো পাতিলটা। অমনি হাত যেন পুড়তে আরম্ভ করলো। বিদুৎ গতিতে এই ঝটকায় আবার হাত সরিয়ে নিলো সে। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলো যন্ত্রণার ধ্বনি। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আশেপাশে চেয়ে ঠান্ডা পানি খুঁজল। পেয়েও গেল। অতি নিকটে পানির কলসির মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিলো। ঠান্ডা পানির স্পর্শে কিছুটা উপশম হচ্ছে তার যন্ত্রণা। ছলছল নয়নে কলসির দিকে চেয়ে থাকলো। তবে নিজের শক্ত মনোভাব এখানেও বজায় রাখলো সে। চোখ থেকে এক ফোটা পানিও যেন না ঝড়তে পারে তার জন্য দৃঢ় প্রচেষ্টা চালিয়ে গেল। সক্ষম হলো অবশেষে। খানিক সময় পরে হাত উঠিয়ে আনলো পানি থেকে। লাল হয়ে আছে আঙ্গুলগুলো। কিছুটা জায়গা ফ্যাকাসে হয়েছে। বোধহয় ফোস্কা পড়বে দ্রুতই। সুন্দর হাতের এই করুন দশাকেও পাত্তা দিলো না সে। পাত্রে পানি ঢেলে অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ ঠান্ডা হতে। জ্বালা করছে আঙ্গুলগুলো। আজ বোধহয় তাকে না কাঁদিয়ে ছাড়বে না। সেও নাছোড়বান্দা। শক্ত মুখে বসে রইল আকাশসম যন্ত্রণা নিয়ে। কিছুক্ষণ পর পানি ঠান্ডা হয়েছে নিশ্চিত হয়ে পাত্র নিয়ে চলল আব্বাজানের কামরায়। আব্দুর রহমান বুঝতে পারলেন মেয়ে এখন তার ক্ষত ধৌত করবে গরম পানি দিয়ে। তাই বিছানার কোনায় এসে পা টা নামিয়ে বসলো সে। জোভিয়া পাত্রটা রেখে পরিষ্কার নরম কাপড় চুবিয়ে নিলো কুসুম গরম পানিতে। পানির সাথে আঙ্গুলের স্পর্শ পেতেই জ্বলে উঠলো তার আঙ্গুল। দাঁতে দাঁত চেপে খিচে বন্ধ করে নিলো চোখদুটো। লক্ষ করলেন আব্দুর রহমান। উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন মেয়ের মুখভঙ্গি দেখে। উত্তেজিত স্বরে বললেন, “কী হয়েছে আম্মা? পানি কি বেশি গরম? তাড়াতাড়ি হাত উঠিয়ে ফেলো পানি থেকে, ফোস্কা পড়ে যাবে।”

কাপড়টা ধরে রেখেই মৃদু হাসলো জোভিয়া। কাপড়টা ভালোভাবে ভিজেছে কি-না দেখতে দেখতে ব্যস্ত স্বরে বলল, “তাড়াতাড়ি লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে তুলে গিট দিয়ে নিন। গরম হলেও হাত ওঠাবো না আমি। ওষুধ দিয়ে গিয়েছিলাম, খেয়েছিলেন আপনি? যেদিন আপনি আমার কথা শুনবেন ঠিক সেদিন আমি আপনার কথা শুনব।”

নিরাশ হলেন আব্দুর রহমান। বুঝলেন মেয়ে তার উপর খুব চটে গেছে। রাগাটাই হয়তো স্বাভাবিক। যার জন্য এত কষ্ট করে অর্থ জোগার করে ওষুধ নিয়ে আসে। কখনো তো বাকিতেও আনতে হয়। সেই মানুষটা ইচ্ছে করে ওষুধ না খেলে যে কেউ রেগে যাবে। কন্যার রাগ সহজে কমার নয় সে কথা তিনি জানেন। তাই চুপচাপ ক্ষতস্থানটা বের করে দিলেন। আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করলো না জোভিয়া। উষ্ণ গরম, ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে লাগলো ক্ষতস্থানটা। ভালো করে পরিষ্কার করে যত্ন করে ওষুধের প্রলেপ লেপে দিলো। নোংরা পানির পাত্রটা হাতে নিয়ে চলে যেতে ধরলো। কিন্তু দরজার সম্মুখে গিয়ে আবার ফিরে তাকালো। রুষ্ট স্বরে বলল, “অনেক হয়েছে আপনার মন-মর্জি, আর নয়।
আপনি এভাবেই নিজেকে অবহেলা করতে থাকলে আমি আর আপনার সামনে আসবো না আব্বাজান। ভুল করেছেন মন থেকে অনুতপ্ত হন। অন্যায় করেছেন। তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, তওবা করুন। তবে এভাবে তিলে তিলে নিজেকে শেষ করার প্রচেষ্টাটা বন্ধ করুন। এতে পাপ বাড়বে বই কমবে না। নিজেকে হত্যা করার কোনো অধিকার আপনার নেই।”

কিছুই বলতে পারলেন না আব্দুর রহমান। শুধু চেয়ে থাকলেন আহত দৃষ্টিতে। সেই দৃষ্টি বোধহয় উপেক্ষা করলো জোভিয়া। হনহন করে বেরিয়ে গেল সে। পানির পাত্র বারান্দায় রেখে চকিতে বসলো এঁটেসুটে। ইতিমধ্যে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে জারনাব। রোজকার মতো পানির পাত্র হাতে উঠোনে ঘুরে ঘুরে গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে সে। এতোটাই মনোযোগ দিয়ে পানি দিচ্ছে যেন একটু বেশি পানি দিয়ে ফেললে জ্বর এসে যাবে গাছগুলোর। জোভিয়া নিজের হাতদুটো মেলে ধরলো চোখের সামনে। ইতিমধ্যে ফোস্কা পড়েছে দুয়েকটা আঙ্গুলে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফোস্কা পড়া আঙ্গুলগুলো খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে নিলো সে। গলা খাকারি দিলো শব্দ করে। ফিরে তাকালো জারনাব। সুন্দর করে হেসে বলল, “আজকের আবহাওয়াটা বেশ শীতল, তাই না?”

“হুম।” ছোট্ট করে জবাব দিলো জোভিয়া।

“ঠিক তোমার মতো।”

জারনাবের কন্ঠে রসিকতার ছোঁয়া। কটমট করে তাকালো জোভিয়া। কপাল কুচকে বলল, “আমি বরাবরই শীতল।”

“সে তো আমার চেয়ে আবরার জাওয়াদ ভালো জানে। বেচারা বণিক! আর মানুষ পেলো না ভালোবাসার জন্য! শেষ কি-না তোমাকে ভালোবেসে বসলো? কী সাহস! অত্যাধিক সাহসিকতার জন্য তাকে তো একটা উপহার দেওয়া প্রয়োজন। কী বলো?”

তার রসিকতা ধরতে পারলো জোভিয়া। তবে রাগলো না সে বরং গালভরা হাসি দিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল, “দুর্দান্ত বুদ্ধি। অবশ্যই উপহার দেওয়া উচিত। কাল ডেকে পাঠিয়ো তাকে। উপহার হিসেবে তোমাকে তুলে দেবো তার হাতে। সেও খুশি, তুমিও খুশি। কী বলো?”

চুপসে গেল জারনাবের মুখশ্রী। পানির পাত্র রেখে বারান্দার দিকে এগোতে এগোতে বলল, “তুমি একটা কাজ করো। ত্যাড়া কথা শেখানোর একটা প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলে নাও। ভালোই অর্থ আসবে।”

আচমকা দৌড়ে এসে তাকে জাপটে ধরলো জোভিয়া। আবদারের সুরে বলল, “চলো না, আজ বাজারে যায়। দোকানের কথা খুব মনে পড়ছে।”

টেনেটুনে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো জারনাব। রাগান্বিত স্বরে বলল, “রোজা থেকে একদম মিথ্যা কথা বলবা না। তোমার কত দোকানের কথা মনে পড়ছে সে কথা কি জানি না আমি? ঘরে অর্থ নেই সেই চিন্তা আমারো আছে। কিন্তু দোকান খুলে এই মুহুর্তে বিপদ বাড়ানোর কোনো ইচ্ছা নেই আমার।”

“দোকান এভাবে দীর্ঘদিন বন্ধ করে রাখলে তো আমরা আমাদের ক্রেতা হারাব। তুমি বুঝতে কেন চাইছো না? ব্যবসা করতে নামলে একটু-আট্ট ঝুঁকি নিতেই হয়।”

বিচলিত কন্ঠ জোভিয়ার। সরু চোখে তাকালো জারনাব। শান্ত গলায় বলল, “আমাকে ব্যবসা শেখাতে এসো না জোভিয়া। এ ক্ষেত্রে হয়তো তোমার থেকে একটু বেশিই জ্ঞান আছে আমার।”

জোভিয়া বুঝলো এভাবে হবে না। আনমনে কিছুক্ষণ ভাবলো। অতঃপর হয়তো জারনাবকে উস্কে দিতেই বলল, “তাহলে বিবাহ করে নাও। যে-কোনো একটা কিছু তো করবে, না কি? তুমি আমার বড়। তোমার বিবাহ না হলে আমিও করতে পারছি না। অন্তত আমার কথা ভেবে এবার বিবাহটা করে নাও। দেখো, হয় ঠিকমতো ব্যবসা করো নয়তো বিবাহ করো।”

আচমকা বিবাহের প্রসঙ্গ উঠতেই জারনাবের মুখে যেন কালবৈশাখীর মেঘ লাগলো। শান্ত মানুষটা হুট করেই কঠিন হয়ে উঠলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো জোভিয়ার দিকে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে। সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে সবসময় নিজের আবেগ নিজের হৃদয়েই চেপে রাখতে। জোভিয়া জেনে-বুঝেই আজ সেখানে আঘাত করেছে। তার পক্ষে বিবাহ করা সম্ভব নয় তা জোভিয়া ভালো মতোই জানে। তার স্বামী, তার ভালোবাসা সম্পর্কে সে পূর্ব থেকেই অবগত। সে শক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে অত্যন্ত কঠিন স্বরে বলে উঠলো, “আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি।”

এমন সময় বাইরের শূন্য উদ্যানের পাশ থেকে ভেসে এলো সৈনিকের উচ্চ কন্ঠ। তবে স্পষ্ট কথাগুলো শোনা যাচ্ছে না। হয়তো তারা গৃহ থেকে একটু বেশিই দূরত্বে অবস্থান করছে। ধীরে ধীরে কন্ঠটা এগিয়ে আসছে তাদের গৃহের দিকে। যতই কাছে আসছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে কথাগুলো। ক্রমেই কন্ঠের তীক্ষ্মতা বাড়ছে। একটু বাদেই বাক্যগুলো স্পষ্টভাবে শ্রবণগোচর হলো। সৈনিক উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলছে, “রামান সাম্রাজ্যের সুলতান মহামান্য সুলতান শাহজাইন শাহ-এর পক্ষ থেকে সকলকে জানানো হচ্ছে ‘রমজান মোবারক’ এবং পবিত্র ইদ-উল-ফিতরের অগ্রিম শুভেচ্ছা।”

কিছুক্ষণ থামলো কন্ঠটা। অতঃপর আবারো বলে উঠলো, “সুখবর, সুখবর, সুখবর। শীঘ্রই মহামান্য সুলতান এবং উত্তরীয় সাম্রাজ্যের সুলতানের ছোট কন্যা ‘শেহজাদি মাইরা’ পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। বিবাহের দিন হিসেবে ইদের দ্বিতীয় দিনকে ধার্য করা হয়েছে। মহলে বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই বিবাহের সমস্ত রীতিনীতি সম্পাদিত হবে। আপনারা সকলেই সেখানে আমন্ত্রিত।”

ধীরে ধীরে কন্ঠটা অন্যদিকে চলে গেল। অবশেষে তবে গুঞ্জন সত্য প্রমাণিত হলো। কান খাড়া করে কথাগুলো শুনলো জোভিয়া। তবে খুব একটা বিচলিত হলো না। সে তো আগেই এই গুঞ্জন শুনতে পেয়েছিল। তাই তার মধ্যে খুব একটা প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা গেল না। সে তো এখন ব্যবসায়িক চিন্তায় মশগুল। এসব আজাইরা জিনিস ভাবার সময় কোথায়? তার মাথায় এই মুহুর্তে শুধু চলছে, দোকান কীভাবে খুলবে। তবে অস্বাভাবিকভাবে জারনাবের মুখভঙ্গির মারাত্মক পরিবর্তন হলো। বিষাদে ছেয়ে গেল তার সুন্দর মুখশ্রী। বাক্যগুলো যেন কাঁটার মতো বিধল তার শরীরে। অনাকাঙিক্ষতভাবে চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠলো কারোর জন্য সীমাহীন ঘৃণা। বাঁকা হাসলো জোভিয়া। বিদ্রুপের স্বরে সে কিছু বলার পূর্বেই গটগট করে কামরায় চলে গেল জারনাব। ধরাম করে আটকে দিলো দরজার কপাট।

চলবে………

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_13

সেদিনের পর কেটে গেছে সাতাশটি দিন। একে একে রোজা ফুরিয়ে আজই হয়তো রমজানের শেষ। শুধুই চাঁদ ওঠার অপেক্ষা। ইদ যত ঘনিয়ে এসেছে গরমের তীব্রতা তত বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার আর বৃষ্টির দেখা নেই। বরাবরের মতোই আকাশ নিজের হালকা নীল রং-টা ধরে রেখেছে। অতিরিক্ত গরমে রোজা থেকে মুসলমানদের অবস্থা কাহিল। তবে আল্লাহর ভালোবাসার নিকট এ কষ্ট বুঝি খুবই তুচ্ছ। আল্লাহর দেওয়া অগণিত রহমতের মাঝে এই সামান্য কষ্ট যেন চোখ বন্ধ করেই সয়ে নেওয়া যায়। তীব্র গরমে সারাদিন রোজা থেকে দিন শেষে আজানের ধ্বনি শুনে শুকনো গলায় এক পাত্র পানি পান করে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলার প্রশান্তিকে বর্ণনা করা দায়। রমজানকে বিদায় দিয়ে বেহিসেবি আনন্দ নিয়ে আসছে ইদ-উল-ফিতর।
নূর বাজারের প্রতিটি দোকানে আজ উপচে পড়া ভিড়। অবশ্য ইদের আগে এমন ভিড় খুবই স্বাভাবিক। সাধারণত ইদ উপলক্ষে মানুষ বেশি বেশি কেনাকাটা করে থাকে নিজের খুশিকে দ্বিগুণ করতে। আজ রাতেই চাঁদ ওঠার সম্ভাবনা চরম। তাই সেই অনুপাতে কেনাকাটার সময় আর বেশি নেই। দোকানিরা কূল হারাচ্ছে ক্রেতা সামলাতে। রীতিমতো মাথায় ঘাম পায়ে ফেলতে হচ্ছে তাদের। পোশাক ঘামে ভিজে চুপচুপে অথচ মুখের হাসি বজায় রেখে কী নিদারুণভাবে ক্রেতাদেরকে সন্তুষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা। তাদের এই আন্তরিকতার কারনেই হয়তো নূর বাজার আজ এই অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে। জোভিয়া, জারনাব দুই বোন সমানতালে ক্রেতা সামলাচ্ছে। আজ আর কারোর দু’দন্ড বসে থাকার জো নেই। সামান্য মুদি দোকান তাদের, আছে কিছু ফলমূলও। তবুও ক্রেতার যেন শেষ নেই। অন্য সময়ের মতোন জারনাব আজ মাদুরে বসে কাটাতে পারছে না। ক্রেতা সামলাতে হচ্ছে জোভিয়ার সঙ্গে। কপালের ঘাম গড়িয়ে পড়ে হিজাবের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাদের ধ্যান দেওয়ার সময় কই? বেশ কয়েকদিন তাদের দোকান বন্ধ থাকার কারনে তাদের দোকানের নিয়মিত ক্রেতারা কেনাকাটা করতে পারেনি। তারাও আজ এসে ভিড় জমিয়েছে। এমন সময় একজন ক্রেতা এসে রুটি বানানোর ময়দা চাইল। জোভিয়া দ্রুত ব্যস্ত হয়ে পড়লো সেদিকে। ময়দার থলে ক্রেতার হাতে তুলে দিয়ে কটমট করে তাকালো জারনাবের দিকে। তার জন্যই এসব হয়েছে এতোগুলো দিন দোকান বন্ধ রেখে রেখে ইদের আগের দিন কি-না দোকান খুলেছে! তাকে জানে মা’রার জন্য?

ভাবান্তর ঘটলো না জারনাবের মাঝে। সে চুপচাপ ক্রেতা সামলাচ্ছে। টু শব্দটা পর্যন্ত করছে না। যেন মুখ থেকে দুটো শব্দ বের করলেই তার দাম কমে যাবে। অধর বাঁকালো জোভিয়া। সেদিনের পর থেকেই তার সঙ্গে কোনো কথা বলছে না জারনাব। এক কামরায় থেকেও সারাক্ষণ নিশ্চুপ থাকে সে। আব্বাজানের যত্নেও আজকাল গাফিলতি করছে সে। সব জোভিয়াকেই করতে হয়। সে অবশ্য প্রতিদিন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায় কিন্তু প্রতিবারই নিরাশ হতে হয়। জারনাব সেই যে দ্বিতীয় রোজায় মুখে কুলুপ এঁটেছে আর খোলাখুলি নেই। যথাসম্ভব জোভিয়াকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে সমসময়। বিচলিত হয় না জোভিয়া। বিবাহের কথা তোলাতে যে তার এমন কঠিন প্রতিক্রিয়ার সম্মুখে পড়তে হবে তা সে আগেই জানতো।

“এতো কী ভাবছো মেয়ে?”

আচমকা চেনা কন্ঠে ধ্যান ভঙ্গ হলো জোভিয়ার। সম্মুখের ব্যক্তিটাকে দেখতেই যথারীতি কপাল কুচকাল। তবে কন্ঠের মাধুর্যতা ধরে রাখলো দৃঢ়ভাবে। সাবলীল ভঙ্গিতে বলল, “জি জনাব, কী লাগবে বলুন?”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মৃদুস্বরে হাসলো বণিক। জোভিয়ার তীক্ষ্ম চাহনিতে ভুললো মস্তিষ্কে সাজিয়ে রাখা বাক্যগুলো। উদ্দেশ্যেহীনভাবে আশেপাশে চাইতেই নজরে এলো জারনাবের হাতের খেজুরের থলে। ফট করে সে বলে উঠলো, “খেজুর, মানে খেজুর নিতে এসেছি।”

“কিন্তু খেজুর তো আপনি রোজার শুরুতেই নিয়েছিলেন। এত দ্রুত শেষ হয়ে গেল?”

থতমত খেল বণিক। নিয়েছিল নাকি? হ্যাঁ, নিয়েছিল তো। সে খেজুর তো এখনো ধরাই রয়েছে। একলা মানুষ এত খাওয়ার সময় আছে না কি? করুন হলো তার মুখভঙ্গি। এই মেয়েটা আজ হঠাৎ এতো প্রশ্ন করছে কেন? সে কি জানে না তার এখানে আসার কারন? কেনাকাটা তো শুধু একটা বাহানা মাত্র। জোরালো কন্ঠে বলল, “না মানে, শেষ হয়ে গেছে। তাই তো নিতে এসেছি।”

“ঠিক আছে, বুবু ওনাকে এক থলে খেজুর দাও তো।”

জারনাবের উদ্দেশ্যে বলল জোভিয়া। অতঃপর বণিকের দিকে চেয়ে বলল, “ও পাশটাতে এগিয়ে যান। বুবু দিয়ে দেবে। আমি আজ ময়দা, চাল, ডাল- এসবের দায়িত্ব নিয়েছি। ফলমূলের দিকটা বুবুই সামলাচ্ছে।”

আচমকা এহেন কথাতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো বণিক। জারনাবের দিকে চেয়ে সরল ভঙ্গিমায় হাসলো। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো জারনাব। খানিক স্তম্ভিত হলো বোধহয়। আজও লোকটা চলে এসেছে! তারমানে এতোগুলো দিন সে ঠিকই এখানে এসে দোকান খোলার অপেক্ষা করতো! এতো ধৈর্য লোকটা পায় কোথায়?

তখনই বণিক আমতা আমতা স্বরে বলে উঠলো, “না থাক। তাহলে বরং……. ওহ হ্যাঁ, তাহলে বরং ময়দা দিয়ে দাও কিছুটা। দু’দিন চলার মতো। ইদের দিন তো মনে হয় বন্ধ থাকবে বাজার। আবার ইদের পরদিন আসবো।”

হতাশার শ্বাস ফেলল জোভিয়া। লোকটা আর শুধরালো না! বারবার ফিরিয়ে দিতে দিতে এখন আর তার ধৈর্যে কুলায় না! তাই ভাবছে যা হচ্ছে হতে থাক। যথাসময়ে সে নিজে থেকেই দুরত্ব মেপে নেবে। জল্পনা-কল্পনার ইতি টেনে কিছুটা ময়দা ভরে নিলো থলেতে। এগিয়ে দিলো বণিকের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে থলেটা নিয়েই দ্রুত অর্থ চুকিয়ে দিলো বণিক। ততক্ষণাৎ জোভিয়া শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “আপনার কেনাকাটা শেষ?”

“হুম?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল বণিক।

“আপনার কেনাকাটা শেষ হয়ে গেলে আপনি আসতে পারেন। আজ দোকানে ভিড় বেশি দেখতেই পাচ্ছেন। এখন নিশ্চয়ই দোকান ত্যাগ করার জন্য আপনার নিকট বার্তাবাহক প্রেরণ করতে হবে না?”

চমকাল বণিক। সে কি দিনদিন ছ্যাঁচ’ড়া হয়ে যাচ্ছে? এতোটাই ছ্যাঁ’চড়া যে তাকে দোকান থেকে তাড়াতে হলে বার্তাবাহক প্রেরণ করতে হচ্ছে! বিস্মিত তার নয়ন জোড়া। নিজ ভাবনাকেই শাসিয়ে উঠলো হঠাৎ। ছ্যাঁ’চড়া হলে হয়েছে, তাতে সমস্যা কোথায়? চু’রি তো আর করেনি। প্রেমে পড়ে কত প্রেমিক নিজের গর্দান পর্যন্ত দিয়েছে, সে তো সামান্য বিরক্তির কারণ হয়েছে মাত্র! ছ্যাঁ’চড়া ভাবলে ভাবুক। এতে তো আর তার মান চলে যাচ্ছে না! নিজ মনকে শান্তনা দিয়ে সে পুনরায় দৃষ্টিপাত করলো জোভিয়ার পর্দায় ঢাকা মুখটার দিকে। শেষবারের মতো এক নজর দেখে নিয়ে অধর প্রসারিত করে বেরিয়ে পড়লো দোকান থেকে। থলে হাতে আনমনে চললো নদীর পাড় ঘেষে ভেড়ানো জাহাজটার দিকে। ঘুরেফিরে গন্তব্য যে তার এই দোকানটাই হবে তা হলফ করে বলা যায়। জোভিয়াও নিজের মতো করে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খানিক বিরক্ত সে। অন্যদিকে নজর হটানোর সময় নেই, তার মধ্যে লোকটা এসে কতোটা সময় লোকসান করে দিলো।

“অসহনীয় লোক একটা!”

সে বিড়বিড় করে বললো কথাটা। শুনতে পেয়ে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো জারনাব। লোকটার এতো ভালোবাসা জোভিয়া পায়ে মারাচ্ছে, এটা যেন তার সহ্য হলো না। ভালোবাসার হেরফের তার কোনোদিনই পছন্দনীয় ছিলো না। লোকটা এসেছে পর্যন্ত সমস্ত ক্রেতা জারনাব একা হাতে সামলেছে তাহলে লোকসানটা কখন হলো? এই মেয়েটার কথাবার্তার লাগাম তো কখনো ছিলোই না, এখন আবার যুক্ত হয়েছে তার অনিয়ন্ত্রিত রাগ। আড়চোখে তাকে দেখে নিলো জোভিয়া। অতঃপর গলা ঝেড়ে আফসোসের সহিত বলে উঠলো, “আজকাল মানুষের আবার যখন তখন রাগ হয়ে যায়। বাবাহ! কী গরম! মানুষের মেজাজের থেকে অবশ্য কম।”

অতিশয় বিরক্ত হলো জারনাব। কথাটা যে তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জোভিয়া নিশ্চয়ই চাইছে সে রেগে যাক আর রেগে গিয়ে ভুল বসত কথা বলে বসুক। কিন্তু তার মোটেও ইচ্ছে নেই কথা বলার। তাই সে দোকান রেখে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। পেছনে একবারের জন্যও না তাকিয়ে হারিয়ে গেল ভিড়ের মাঝে। এহেন কর্মে আহাম্মক বনে গেল জোভিয়া। এই উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে তাকে একা দোকানে রেখে চলে গেল! হতাশার তপ্ত শ্বাস ফেলারও সময় পেল না সে। ক্রেতাদের সামলাতে এবার তার অবস্থা বেহাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এলো জারনাব। তবে দোকানে ঢুকল না। বাইরে থেকেই উঁচু কন্ঠে বলল, “আমার একটা জরুরি কাজ আছে। দোকানে আর আসতে পারবো না। বেশি সমস্যা হলে যেন নিজের ঘাম না ঝরিয়ে দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। মানুষ তো আবার খাটতে পারে বেশি। আজ যতটুকু বেচাকেনা হয়েছে তাতেই চলবে। শুধু শুধু ঘাম ঝরানোর প্রয়োজন নেই।”

কটমট করে তাকালো জোভিয়া। নিজে ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে চলে যাচ্ছে আবার তাকেও দোকান বন্ধ করে দেওয়ার উপদেশ দিচ্ছে! ফাঁকিবাজ কোথাকার! সে কিছুতেই দোকান বন্ধ করবে না এতো দ্রুত। যত কষ্ট হবে হোক। একটা দিনই তো। সে ঠিক সয়ে নেবে। তাও বুবুর কথা শুনবে না। মুখ ঘুরিয়ে রইল সে। তার মুখভঙ্গির অর্থ বুঝে নিলো জারনাব। বিড়বিড়িয়ে বলল, “ঘাড়ত্যাড়া।”

ইদ উপলক্ষে মহলকে সাজানো হচ্ছে নতুন রূপে। মহলের বাইরের দিকের সফেদ রং-টা খানিক ফ্যাকাসে হয়ে সময় পেল না তার পূর্বেই শুরু হয়েছে সেখানে নতুন করে রঙের প্রলেপ লাগানো। প্রধান ফটকের উপর চলছে ঘষামাজা। যেকোনো মূল্যে ইদের পূর্বেই ঝকঝকে করতে হবে মহলকে। এই উদ্যোগ কি শুধুই ইদের জন্য না কি এই চকচকে-ঝকঝকে করার আসল উদ্দেশ্য সুলতানের বিবাহ? জানা নেই কারোর। এসব কাজে সুলতানের কখনোই কোনো ভূমিকা ছিলো না। মহলের সৌন্দর্য রক্ষায় সবসময় উদ্গ্রীব হয়ে থাকতো এলিজা সুলতান। তার অবর্তমানে এসবকিছুর দেখাশোনা ওয়াসিফা সুলতান নিজেই করে থাকেন। তবে আজ তার টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকাল থেকেই সে কামরা আটকে বসে আছে। তাই দায়িত্ব এসে পড়েছে আজমাইন মাহতাবের ঘাড়ে। তার নির্দেশনা অনুযায়ীই সমস্ত কাজ হচ্ছে। একটু তাড়াহুড়োই করছে সে। সুলতান একা আছেন। হুট করে যদি তার প্রয়োজন পড়ে যায়? এই চিন্তাতেই ডুবে আছে মাহতাব। তলোয়ার হাতে পায়চারি করছে প্রধান ফটকের ভেতরে। কখনো আবার কপালে আঙ্গুল ডলছে চিন্তিত ভঙ্গিমায়। বারকয়েক বিরক্ত হয়ে বলে উঠছে, “কী ব্যাপার? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাজ করছো না কি তোমরা? তাড়াতাড়ি করো। কতো কাজ আমার আর আমি কি-না এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই ঘষামাজা দেখছি!”

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন ওয়াসিফা সুলতান। সম্মুখেই কাতর মুখে বসে আছেন সুলতান শাহজিল। তাদের দু’জনের মুখেই ভয়ের ছাপ। দৃষ্টি চঞ্চল। ওয়াসিফা সুলতান ভয়ে হাঁসফাঁস করলেও সুলতান শাহজিল নীরব। যে-কোনো পরিস্থিতিতে তার শান্ত মনোভাব বজায় থাকে। কিন্তু শেষ রোজায় এসে এমন হয়রানি যেন আর সহ্য হচ্ছে না। সকাল থেকে কাল-কুঠুরির কয়েদি গায়েব। বোকা সৈনিক সকালে খাবার দিয়ে আসার সময় তালা লাগাতে গাফিলতি করেছিল। যেখানে বড় বড় তিনটা বিশাল আকারের তালা লাগিয়েও তাকে আটকে রাখা দায় সেখানে তাড়াহুড়ো করে মাত্র একটা মাঝারি আকারের তালা ঝুলিয়ে চলে এসেছে সৈনিক। সুযোগ পেয়েছে সে। অমনি তালা ভেঙে পালিয়েছে। ভীত সৈনিক কাঁচুমাচু করে কয়েদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মহলের চারদিক। সে পালিয়ে গেলে নিঃসন্দেহে তার গর্দান যাবে। এতোগুলো দিন কাল-কুঠুরিতে বন্দি থাকার পরেও যে কারোর শরীরে তালা ভাঙার মতো এমন অসীম শক্তি থাকতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাদে সৈনিক মাথা নিচু করে হাজির হয় তাঁদের কামরায়। তাকে দেখতেই অগ্নি দৃষ্টিতে চাইল ওয়াসিফা সুলতান। উঠে দাঁড়িয়ে আগ্রহী কন্ঠে শুধাল, “পাওয়া গেছে?”

আরো কিছুটা কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ালো সৈনিক। নত স্বরে বলল, “জি না, সুলতানা। মহলের আশেপাশে সব জায়গায় খুঁজে এসেছি। কোথাও নেই সে।”

রাগে হিতাহিতবোধশূন্য হলো ওয়াসিফা সুলতান। চাঁপা স্বরে গর্জে উঠে বলল, “নেই মানে? গায়েব হয়ে গেছে? হুট করে অদৃশ্য হয়ে গেছে? সে শাহজাইন পর্যন্ত পৌঁছে গেলে তারপর খুঁজে পাবি? তোর অলসতা আর গাফিলতির জন্য সে পালাতে পেরেছে।”

ভয়ে কেঁপে উঠলো সৈনিক। এবার তাকে বাঁধা দিলো সুলতান শাহজিল। শান্ত কন্ঠে ধমকে উঠে বলল, “আহ! ওয়াসিফা, থামো। এভাবে চিল্লাচিল্লি করে কোনো সমাধান হবে না।”

রাগ ঠান্ডা হলো না ওয়াসিফা সুলতানের। তবে থেমে গেল সে। আর একটা কথাও বললেন না। সুলতান শাহজিল বিচক্ষণ ব্যক্তির ন্যায় ধীর কন্ঠে বলল, “তুমি যাও সৈনিক। মহলের ভেতরে আগে ভালো করে খুঁজে দেখো কোথাও লুকিয়ে আছে না কি। এতো পাহাড়া পেরিয়ে বাইরে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম। সকলে তাকে দেখলেই চিনে ফেলবে। আর চিনলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে মহলে হৈ-চৈ পড়ে যেত। তারমানে এখনো কেউ দেখেনি তাকে। দ্রুত যাও তুমি। সময় নষ্ট করো না।”

সারা মাস রোজা থেকে শেষ বেলায় এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছে শেহজাদি তানহা। ইদের আগের দিন জ্বরে ভুগছে সে। সকাল থেকেই শয্যাশায়ী হয়েছে। উঠে বসার মতো শক্তিও নেই তার শরীরে। রোজা থাকার কারনে ওষুধ খেতেও পারছেন না। তার খাস সেবিকা আনাবিয়ার সাহায্যে মাথায় পানি নিয়েছে, শরীর মুছেছে। এখন বিছানায় শুয়ে ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে। মোটা চাদর শরীরে জড়িয়েও যেন শীত কমছে না তার। সুলতান বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেছে তাকে। এসেছিল শেহজাদি মাইরাও। তবে আসেনি তার পিতা-মাতা। মেয়ের অসুস্থতাতেও তারা একবারের জন্য উঁকি দিতেও আসেনি এই কামরায়। এমন নয় যে তারা অবগত নন। তারা সবটাই জানে তবুও আসেনি। সেবা করার ভার সঁপে দিয়েছে সেবিকাদের উপর। এতেই যেন তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। আচমকা চোখদুটো ছলছল করে উঠলো তানহার। ব্যথিত হলো তার মনের আঙিনা। পিতা-মাতার ভালোবাসা কি এমনই হয়?

তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল আজমাইন মাহতাব। তার কোলে ছোট্ট তোহফা ছটফট করছে নিচে নামার জন্য। হাত-পা ছুড়ছে দিক্বিদিক। তাদেরকে এক পলক দেখতেই চাদরের নিচে মুখ লুকিয়ে নিলো তানহা। অবাক হলো মাহতাব। ধীরে-সুস্থে তোহফাকে নিচে নামিয়ে দিলো সে। আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না তোহফা। ছুট লাগালো পালঙ্কের দিকে। ফুফুজানের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙুলগুলোর উপর ভর দিয়ে সামান্য উঁচু হলো সে। ছোট ছোট হাতদুটো বাড়িয়ে দিলো চাদরের দিকে। অমনি চাদর টেনে গলা পর্যন্ত নামিয়ে নিলো তানহা। মুখটা বের করেই তোহফার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো। নিষ্প্রাণ সে হাসি। চোখের পানি আগেই মুছে ফেলেছে সে চাদরের সাথে। তোহফার ছোট্ট ছোট্ট হাতের মধ্যে বেশ মায়াময় লাগছে তার মুখটা। তার দিকে অপলক চেয়ে মিষ্টি করে হাসলো তোহফা। কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে তাকে নিজের দিকে টেনে নিলো তানহা। কপালে আলতো করে শুষ্ক অধর ছোঁয়ালো। অনিমেষ চেয়ে তাদের ভালোবাসাময় মুহুর্তগুলো পর্যবেক্ষণ করে গেল মাহতাব। চলে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই তার মধ্যে। তোহফার হিজাবটা টেনে ঠিক করে দিলো তানহা। সারাদিন পর স্বস্তির শ্বাস নিতে পারছে সে। প্রশান্তি যেন অন্তর জুড়িয়ে দিলো। সময়টাকে বোধহয় এখানেই থামিয়ে দিলে সমস্ত অসুখ ভালো হয়ে যেতো তার। তোহফাকে পেরিয়ে এবার দৃষ্টিপাত করলো মাহতাবের দিকে। সে কী মায়া তার নয়ন জোড়ায়! ভড়কে গেল মাহতাব। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আমতা আমতা করে বললো, “আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন শেহজাদি। বাচ্চাটা আপনাকে ছাড়া থাকতে পারছে না।”

বাক্যটা বোধহয় পছন্দসই হলো না তানহার। নিমেষেই গায়েব হলো তার চোখের সকল মায়া। অনাকাঙিক্ষত ক্রোধ জায়গা করে নিলো সেখানে। আজও তার কথা ভাবলো না সৈনিক প্রধান! শুধুমাত্র তোহফার জন্যই তার সুস্থতা কামনা করলো! শক্ত দৃষ্টিতে পুরো কামরায় নজর বোলাতেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো আনাবিয়া। ব্যস্ত কন্ঠে শুধাল, “আপনার কিছু লাগবে শেহজাদি?”

“নিয়ে যাও তোহফাকে। ওর ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে। ওষুধগুলো দ্রুত খাইয়ে দাও দ্রুত।”

ভ্রু কুচকাল মাহতাব। তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ঠিকই উপলব্ধি করে নিলো শেহজাদি তাকে উপেক্ষা করছে। কিন্তু তার অন্যায়টা কোথায়? যাকগে, উপেক্ষা করলে করুক। শেহজাদি বলে কথা। ভাব তো একটু থাকবেই।আনাবিয়া এগিয়ে এসে তোহফা কোলে নিতে গেলে তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো তোহফা। আঙুল উঠিয়ে শাঁসালো বোধহয় নীরবভাবে। হতবাক হয়ে পিছিয়ে এলো আনাবিয়া। এবার সফেদ ঝকঝকে দাতঁগুলো বের করে নিঃশব্দে হাসলো তোহফা। অতঃপর দৌড়ে এগিয়ে গেল মাহতাবের কাছে। দু’হাত উচিয়ে ধরতেই তাকে কোলে তুলে নিলো মাহতাব। দ্বারের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েও আবার থামলো সে। পেছন ফিরেই তানহার উদ্দেশ্যে বলল, “চিন্তা করবেন না শেহজাদি। রন্ধনশালার সেবিকাদেরকে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দেবো ছোট শেহজাদিকে। এ বিষয়ে কোনো গাফিলতি হতে দেবো না আমি। আপনি নিজের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখবেন।”

কথাখানা বলেই বেরিয়ে গেল সে। একজন সেবককে ওষুধগুলো আনতে পাঠিয়ে নিজে রন্ধনশালার সম্মুখে গিয়ে গলা উচিয়ে বলল, “কেউ একজন বাইরে আসো। কাজ আছে।”

ইফতারি প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছিলো তারা। হঠাৎ সৈনিক প্রধানের কন্ঠ পেয়ে সচকিত হলো হাফসা। দ্রুত হাতে রুটি বেলতে বেলতে আশেপাশে তাকালো। ফাইজাকে সাজগোজ করতে দেখে কিঞ্চিত রাগান্বিত হলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “ফাইজা, বাইরে গিয়ে শোনো তো সৈনিক প্রধান কী বলছেন।”

কাঠের দর্পণখানা রেখে বিরক্ত চোখে তাকালো ফাইজা। অলস স্বরে বলল, “আমিই কেন?”

“কারন তুমি ছাড়া এখানে সবাই কাজে ব্যস্ত। অকর্মণ্যের ঢেকি শুধু তুমি একাই আছো। দ্রুত যাও। সৈনিক প্রধান আবার খুব রাগি মানুষ।”

বিরক্তিভাব ছেড়ে বিস্মিত নয়নে চাইল ফাইজা। এমন সময় পুনরায় সৈনিক প্রধান ডেকে উঠতেই সব ফেলে হরবরিয়ে দৌড় লাগালো সে। একদম মাহতাবের সামনে গিয়েই থামলো। হুট করে মনে পড়লো সে তো সম্মান প্রদর্শন করেনি সৈনিক প্রধানকে। জিভ কেটে দ্রুত মাথা নুইয়ে নিলো সে। চোখদুটো ছোট ছোট করে চাইল মাহতাব। অবাক কন্ঠে বলল, “আমার সামনে দিয়ে লাফাতে লাফাতে আসলে ভাল্লুকের মত! এখন আবার মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন করছো! এটাকে সম্মান বলে?”

নিজ মনে ফুঁসলে উঠলো ফাইজা। প্রচন্ড রাগ হলো তার। সব বাদ, কিন্তু তাকে ভাল্লুক বললো! কোন দিক থেকে সে ভাল্লুকের মতো দেখতে? সে মাথা নিচু করেও হলফ করে বলতে পারছে এই সৈনিক প্রধানের চোখে সমস্যা আছে, বিরাট সমস্যা। শুধু দেখতেই সুদর্শন, মনটা পাতিলের তলার চেয়েও বেশি কুৎসিত!

সে কিছু বলার পূর্বেই মাহতাব নামিয়ে দিলো তোহফাকে। একজন সেবক ওষুধগুলো এনে দিলো তার হাতে। বিভিন্ন গাছ-গাছালি ও শেকরের গুড়োর সংমিশ্রণ কাঁচের ছোট্ট ছোট্ট শিশিতে ভরে রাখা। আরো কিছুর মিশ্রণ হয়তো আছে তার মধ্যে তবে আন্দাজ করা গেল না সেগুলো কী। ওষুধগুলো সে এগিয়ে দিলো ফাইজার দিকে। কন্ঠের দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল, “ওষুধগুলো পরিমান মতো নিয়ে খাইয়ে দাও শেহজাদিকে।”

অসহায় হলো ফাইজার মুখভঙ্গি। পরিমান মতো! সে কী করে নির্দিষ্ট পরিমাণ বুঝবে? তার দৃষ্টির অর্থ যেন বুঝে নিলো মাহতাব। বিরক্ত হয়ে নিজেই ওষুধ ঢেলে ধরিয়ে দিলো তার হাতে। অমনি হাসি ফুটে উঠলো ফাইজার ঠোঁটে। ততক্ষণাৎ ওষুধটা নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো তোহফার সামনে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে দেখছে তোহফা। ওষুধটা মুখ পর্যন্ত আসতেই হাঁ করলো সে। এগুলো সে রোজ খায়। তাই অভ্যাস আছে। সে এটাও জানে এই ওষুধ তার জবান ফিরিয়ে আনতে খাওয়ানো হয়। ওষুধটা তার মুখের মধ্যে ঢেলে দেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে ভেসে এলো একটি নারী কন্ঠ।

“থামো।”

তাল হারালো ফাইজা। আকস্মাৎ থামতে গিয়ে হাত ফসকে নিচে পড়লো ওষুধ। গড়িয়ে গেল মেঝেতে। হুট করে আঁধার হয়ে এলো উজ্জ্বল মহল। কখন যে আকাশে মেঘ করেছে জানা নেই। জোরালো ঠান্ডা হাওয়া মহলে ঢুকলো জানালাগুলোর পর্দা উড়িয়ে। খুলে গেল প্রধান দ্বার। একটি নারীমূর্তি এসে থামলো সেখানে। মুহুর্তেই রজনীগন্ধার তীব্র সুগন্ধে ভরে উঠলো স্থান। তড়িৎ বেগে ঝড়ো হাওয়া বইছে বাইরে। দুলছে বিশাল ঝাড়বাতি। থমথমে প্রকৃতি। বাইরে কোথাও বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো বোধহয়। সেই সাথে শ্রবণগোচর হলো একটি বজ্রকন্ঠ।

“খবরদার, ঐ বিষ মিশ্রিত ওষুধ আরেকবার খাইয়েছো তো তোমার গর্দান যাবে অকালে।”

চকিতে তাকালো ফাইজা। চোখ জোড়া কপালে তুলে দেখে গেল তীব্র হাওয়ায় উড়তে থাকা মহা মূল্যবান ঘিয়ে রঙা শাড়ির আঁচলটা। শুভ্র রঙা দুর্লভ পাথরের তৈরি তাজটি মাথার উপর জ্বলজ্বল করে চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য প্রকাশ করছে। মারাত্মক এ সৌন্দর্য যেন নয়ন জুড়িয়ে দেয়! মুগ্ধ হতে বাধ্য প্রাণহীন জড়বস্তুগুলোও। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে আঁকড়ে থাকা অলংকারগুলো বুঝি আজ বহুকাল পরে প্রাণ ফিরে পেয়েছে!

চলবে………..