সম্রাজ্ঞী পর্ব-২+৩

0
143

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_2

বন্দিশালার পরিবেশ নিখুঁতভাবে নিজের নীরবতা ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে সেই নীরবতা ছাপিয়ে চাবুকের শপাৎ শপাৎ শব্দ আতঙ্ক ধরাচ্ছে উপস্থিত প্রতিটি প্রাণীর হৃদয়ে। সেই সাথে কারোর ব্যথা মিশ্রিত আত্নচিৎকারে কেঁপে উঠছে সমস্ত রক্ষীবাহিনী। বন্দিশালার দ্বার আটকে তার সামনে দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে আজমাইন মাহতাব। হাতের তলোয়ারটা চকচক করে নিজের ক্ষমতার বর্ণনা দিয়ে চলেছে। এতোটাই চকচক করছে যেন এখনি আলো বিচ্ছুরিত হবে তা দিয়ে। আজমাইন মাহতাব সটান দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। উদ্দেশ্য সুলতানের কর্মে কেউ কোনওরূপ ব্যাঘাত ঘটাতে চেষ্টা করলে তার ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দেওয়া। সুলতানের একনিষ্ঠ সেবক সে তাই এ ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই তার নিকট।

রক্ষীগুলো বারকয়েক উঁকিঝুঁকি দেওয়ার চেষ্ট করলেও আজমাইন মাহতাবের ভয়ে সেমুখো হওয়ার সাহস জোগাতে পারলো না। বন্দিশালায় লাগানো একঝাঁক মোমবাতি টিমটিমিয়ে জ্বলছে। তারাও যেন প্রচন্ড ভীত হয়ে পড়েছে সুলতানের আক্রোশে। কারাগারের মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে একজন মাঝ বয়সী পুরুষ। ঠিক মাঝ বয়সী নয় তবে তার কাতর চেহারা, পাংশুটে মুখশ্রী, বড়বড় এলোমেলো চুল, ময়লাযুক্ত নখ আর চোখের নিচে জমে থাকা কালি যেন তার বয়সের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। তার শরীরের অগনিত ক্ষতস্থান থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্তের স্রোত। ঘা সৃষ্টি হয়েছে কিছু কিছু স্থানে। অবিরত চাবুকের আঘাত সহ্য করতে না পেরে লুটিয়ে পড়েছে সে। আঘাত সহ্য করার মতো বিন্দুমাত্র শক্তি বুঝি অবশিষ্ট নেই তার শরীরে।

সম্মুখেই চাবুক হাতে অগ্নি দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছেন সুলতান। সহস্রবার আঘাত করে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ঘামের বিন্দু চুইয়ে পড়ছে তার সুন্দর মুখশ্রী বেয়ে। চোখদুটো থেকে যেন আগুনের শিখা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এই সুলতানের হৃদয়ে কোনো মায়া নেই, দয়া নেই সে এক কঠিন অগ্নিকুন্ডের ন্যায়। উদারপন্থী সুলতানের এমন ভয়ঙ্কর রূপ খুব কম মানুষই দেখেছে। চাবুকটা হাতের সাথে ভালোমতো পেঁচিয়ে রাখা যেন তা ছুটে গিয়ে তার কর্মের মাঝে কোনোওরূপ বিঘ্ন না ঘটে। রাগে হিসহিসিয়ে ওঠে সে। আচমকা পড়ে থাকা লোকটার চিবুক চেপে ধরে শূন্যে উঠিয়ে আনলো নিজের বলিষ্ঠ হাতে। ভয়ঙ্কর কন্ঠে বলল, “তার নাম না বললে এখানেই কেটে যাবে তোর দুর্বিষহ জীবন।”

লোকটা কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই রক্ত গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে। সে করুন দৃষ্টিতে চেয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল, “আর নাম বললে আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো আগুনের উপর কয়লার ন্যায় ফুটবে। সে শেষ করে দেবে আমার প্রিয়জনদের। কঠিন নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হতে হবে আমার বৃদ্ধ বাবা-মাকে। আমায় ক্ষমা করুন মহামান্য। আপনার এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে।”

সেই একি উত্তর! রোজকার ন্যায় সুলতান আবারো নরম স্বরে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “কোনো ক্ষতি হবে না কারোর। সবাইকে বাঁচাবো আমি। তুই শুধু নামটা বল একবার।”

“সম্ভব নয়, আমার জীবনের চেয়েও অধিক মূল্যবান সেই নাম।” মাথা নুইয়ে জবাব দিলো আঘাতপ্রাপ্ত লোকটা।

অতিরিক্ত রাগে ফুলে উঠলো সুলতানের শিরা উপশিরাগুলি। আচমকা হিতাহিত বোধশূন্য হয়ে তাকে টেনে তুলে ছুড়ে ফেলল দেয়ালের উপর। লোকটা ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে সেভাবেই পড়ে রইল মাটি আঁকড়ে। রাগ কমলো না সুলতানের। বড়বড় নিশ্বাস ফেলে হিংস্র স্বরে বলল, “অকালে মরবি তুই আমার হাতেই। আবারো সময় দিচ্ছি তোকে, পুনরায় ভেবে নে।”

চাবুক ফেলে বড়বড় পা ফেলে বেরিয়ে আসলো সে। দৃষ্টি সামনে রেখে কঠোর স্বরে বলল, “একে ওষুধ-পথ্য খাইয়ে দ্রুত সুস্থ করে তোলো। তৈরি করো নতুন আরেকটি কালরাত্রির জন্য।”

রক্ষীরা সকলে একত্রে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে সম্মান জানালো। কারাগারের দিকে আরেকবার শক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সুলতান। অতঃপর ক্লান্ত দেহে অগ্রসর হলো নিজের কামরার দিকে। বন্দিশালার দ্বার বন্ধের আদেশ দিয়ে তার পেছনে ছুটলো আজমাইন মাহতাব। মাঝপথে বার্তাবাহক এসে সুলতানের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিতেই পথ আটকে দাঁড়ালো সে। রাগে গর্জে উঠে বলল, “এখন সুলতানের বিশ্রামের সময়। সে সম্পর্কে কি অবগত নও তুমি? অবগত না হলে তোমার মতো অকর্মণ্যের কোনো প্রয়োজন নেই এই সাম্রাজ্যে। অসময়ে তাকে বিরক্ত করার অপরাধে তোমার গর্দান নিতেও দ্বিধাবোধ করবো না আমি।”

শুকিয়ে আসলো বার্তাবাহকের মুখশ্রী। জরুরি না হলে এ সময় সে কখনোই আসতো না। সে অনুরোধের স্বরে কিছু বলার পূর্বেই থামিয়ে দেয় সুলতান। নরম স্বরে বলল, “আহ মাহতাব, সে নিশ্চয়ই কোনো জরুরি বার্তা নিয়ে এসেছে।”

বার্তাবাহকের দিকে চেয়ে বলল, “বলো তুমি কী বলবে?”

“উত্তরীয় সাম্রাজ্য থেকে বার্তা এসেছে মহামান্য। বেগম এলিজা সুলতানের পিতা সুলতান ইহসান, মাতা মারজিয়া সুলতান এবং তার ছোট বোন শেহজাদি মাইরা আগামীকাল এই প্রাসাদে আসছেন বলে জানিয়েছেন। হয়তো তারা কিছুদিন এখানে অবস্থান করবেন।”

মুহূর্তেই যেন হৃদয়ের দহন বেড়ে দ্বিগুণ হলো সুলতানের। সবাই আসছে অথচ তার বেগম আর ফিরে আসবে না কোনোদিন! অন্তরের ব্যথায় তালা লাগিয়ে নিজের মুখভঙ্গির কঠোরতা বজায় রেখেই ব্যস্ত স্বরে বলল, “তাদের জন্য কামরা প্রস্তুত করতে বলো। আর হ্যাঁ, তাদের আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে।”

বাক্য সম্পূর্ণ করে দ্রুত পায়ে নিজের শয়নকক্ষে গিয়ে পৌঁছালো সে। দ্বার বন্ধ করার পূর্ব মুহুর্তে আজমাইন মাহতাবকে উদ্দেশ্য করে বলল, “জেগে থাকার প্রয়োজন নেই তোমার। দ্বারের বাইরে পর্যাপ্ত পাহাড়াদার রয়েছে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”

সাথে সাথে মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালো আজমাইন মাহতাব। সুলতানের কামরার দ্বার বন্ধ হলে নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয় সে। যাওয়ার পূর্বে আরো একবার পাহাড়াদারদের কঠিন স্বরে দিয়ে গেল সতর্কবার্তা। পাহাড়াদারগুলো নীরবে শুনে যায় তার হুঁশিয়ারি বার্তা। মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানায় বিনাবাক্যে। আজমাইন মাহতাবের উপর কথা বলার সাধ্যি কার!

নিজের কামরায় গিয়ে দ্বার আটকে দিলো মাহতাব। তলোয়ারটা পালঙ্কে রাখলো ঠিক তার মাথার কাছেই। কখন কোন দিক থেকে বিপদ এসে হামলে পড়বে জানা নেই। নিঃসঙ্গ এই জীবনে তলোয়ারটাই তার একমাত্র সঙ্গী। এগিয়ে গিয়ে বিশাল জানালার কপাট খুলে দিলো সে। মূহূর্তেই ঠান্ডা হাওয়ায় ভরে উঠলো ঘরটা। এ বাতাস যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায় তার। আবেশে চোখদুটো বন্ধ করে নিলো সে। চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো কারোর আবছা প্রতিচ্ছবি। একজন কিশোরী, হ্যাঁ একজন কিশোরীর প্রতিচ্ছবি। বহূ বর্ষ পূর্বেই যে দাগ কেটেছিল তার হৃদয়ে। সেই প্রথম দেখার অনুভূতি, তার মুচকি হাসির সচ্ছতা যে আজও পোড়ায় তাকে। সেই কিশোরী নিশ্চয়ই এখন তারই মতোন বড় হয়ে গিয়েছে। ভুলে গেছে মাহতাব নামের কাউকে সে চিনতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাহতাব। যে আর কখনো তার হবে না তাকে নিয়ে কেন ভাবছে সে? কপট রাগ দেখিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো। পালঙ্কের পাশের ছোট্ট সিন্দুকটা খুলে বসলো। এই দহন ঘুমাতে দেবে না তাকে। তারচেয়ে বরং যুদ্ধে সম্পর্কিত কিছু প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেখা যাক। পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সঙ্গে নদী নিয়ে দ্বন্দ্ব শেষ হয়েছে সেই কবেই। তাদের সঙ্গে বর্তমানে ব্যবসায়িক সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবুও কেন যেন মন খচখচ করছে তার। মহলের আশেপাশে অনেক নতুন মানুষ দেখা যাচ্ছে আজকাল। তাদের মধ্যে কে কার গুপ্তচর জানা নেই। তাছাড়া মহলে নতুন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কার মনে কী আছে তা নিয়ে সন্দেহ যেন সরছেই না তার মন থেকে।

অপরদিকে দ্বার এঁটে পাগরীটা খুলে পালঙ্কের পাশেই রাখলো সুলতান। চিন্তিত তার মুখখানা। বিগত দুইটা বছর যাবত ঠিক নেই তার সাম্রাজ্য, সচ্ছতা নেই তার মহলে। কেমন যেন গুমোট একটা ভাব বিরাজ করছে চতুর্দিকে। কিছুদিন পূর্বেও মহলের পেছনে একজন রক্ষীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ মিলেছে। এখন পর্যন্ত তার কোনো সূরহা করতে পারেনি তার কর্মচারীবৃন্দ। মহলের কারোর মাঝে নেই পূর্বের ন্যায় ভ্রাতৃত্বসূলভ আচরন। ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। অজানা শত্রু গ্রাস করে নিচ্ছে সবকিছু। আজকাল সবাইকেই সন্দেহ হয় তার। কারোর চোখে চোখ মেলাতে পারছে না সে। তার জীবনের সমস্ত সুখ-শাস্তি হুট করেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তার উপর বেগমের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে ভালো নেই তার হৃদয় কোটর। বেগম কেন ঐ পাহাড়ের চূড়ায় গিয়েছিল সেদিন? সবুজে ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে আগুনের উৎপত্তিই বা কীভাবে হলো? সব ধোঁয়াশা তার নিকট। জ্বলছে সে, দুটো বছর ধরে অজানা অনলে জ্বলছে সে নিয়মিত। সেখানে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতোই উৎপত্তি হলো নতুন শত্রুর। যে কি-না ধীরে ধীরে বিষিয়ে দিচ্ছে তার জীবন। রামান সাম্রাজ্যের বাতাস পর্যন্ত দুষিত করে তুলছে সে। এ চিন্তার বোধহয় আর শেষ নেই।

এখন তার সঙ্গ প্রয়োজন আপনজনের। তাই সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সিন্দুক খুলে ছবিখানা বের করে আনলো সে। রেখে দিলো পালঙ্কের এক পার্শ্বে। অতঃপর বিষাদ আর ক্লান্তিতে ভরা দেহটা এলিয়ে দিলো পালঙ্কে। ছবিটি মুখের সামনে তুলে ধরে আদরের সাথে হাত বুলালো তাতে। নারীটির চোখের দিকে মায়াভরা দৃষ্টি রেখে বলল, “তুমি নির্দয় এলি। এতো দ্রুত তো তোমার চলে যাওয়ার কথা ছিলো না। তুমি কথা রাখোনি এলি, তুমি কথা দিয়ে কথা রাখোনি। আমায় বড় একা করে দিয়েছো তুমি। বৃদ্ধ বয়সে দু’জন একসঙ্গে বসে চন্দ্রবিলাশ করার স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝপথে হাত ছেড়েছো তুমি। ছলনাময়ী প্রেমিকার ন্যায় হৃদয় ভেঙেছো আমার।”

ঝরে পড়া অশ্রু কণাগুলো তার সুন্দর মুখমণ্ডলের মাঝে বড় অসৌন্দর্য প্রকাশ করছে। অতঃপর তা অচিরেই গড়িয়ে পড়ছে পালঙ্কের উপর। ছবির নারীটির কথা বলার ক্ষমতা থাকলে হয়তো এতোক্ষনে সে বলে উঠতো, “আমার সুলতানের সৌন্দর্যে ব্যাঘাত ঘটিও না অশ্রুকণা। তার বেগমের বড় কষ্ট হয় এই অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখে।”

সুলতান পুনরায় বলে উঠলো, “তুমি কি জানো এলি? কাল তোমার সম্পূর্ণ পরিবার আসবে এই মহলে। তুমি কেন আসো না বলোতো? তোমার কি ইচ্ছে হয় না নিজের শেহজাদিকে একবার দু’চোখ ভরে দেখতে? তাকে কোলে তুলে নিতে? তুমি কি দেখতে পাও না তোমার সুলতান ভালো নেই? তোমার শূন্যতায় সে প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। কবে থেকে তুমি এমন নিষ্ঠুর হলে? তুমিতো তোমার সুলতানের একফোঁটা চোখের পানি সহ্য করতে পারতে না। কেঁদেকেটে মহল মাথায় উঠাতে তবে আজ কীভাবে সহ্য করো এই এক সমুদ্র অশ্রুকণা?”

তার এতো কঠিন কথাগুলোও যেন সয়ে নিলো নারীটি। রোজকার ন্যায় উত্তর পাবে না জেনেও শতশত অভিযোগ জমায় সুলতান। সময় পেলেই কামরা আটকে ছবিটির উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয় সমস্ত অভিযোগ।
অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে সে। স্বপ্নেও কি তাকে পীড়া দেবে এই যন্ত্রণা? সেখানে কি সে পাবে তার প্রিয়তমাকে?

বিছানা ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করছে জারনাব। বালিশদুটো ঠিক করে রেখে এগিয়ে গেল ঘরের সাথে লাগানো ছোট্ট বারান্দার দিকে। তাদের ছোট্ট এই দালানে সর্বমোট দুটো কামরা রয়েছে। একটাই তাদের আব্বাজান অন্যটায় তারা দু’বোন থাকে। খাওয়া-দাওয়ার জন্য বেছে নেয় আব্বাজানের কামরায় পেতে রাখা ছোট্ট চকিটা। তাদের বাপ-বেটির এই ছোট্ট সংসার বেশ সানন্দেই কেটে যাচ্ছে এই গৃহে। আম্মাজানের মৃত্যুর পর থেকে পাশের ঘরটাতে একাই থাকে তাদের আব্বাজান।

আকাশের বুকে ঠাঁই পেয়েছে একখন্ড সফেদ ফুল। পৃথিবীবাসি তার নাম দিয়েছে ‘চন্দ্র’। এই একফালি শুভ্রতার দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হয় সারাটা দিন।তবে সে শুধু দেখতেই সুন্দর নয় তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে হাজারো মানুষের সুখ-দুঃখের আলাপন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চাঁদের দিকে চেয়ে আছে জোভিয়া। মাঝে মাঝে বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে উঠছে চাঁদের উদ্দেশ্যে। এটা তার নিত্যদিনের কর্ম। চাঁদের সাথে কথা বলতে তার ভীষণ ভালো লাগে।

তার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে জারনাব। বোনের কাঁধে হাত রাখে আলগোছে। জোভিয়া ঘুরে একবার দেখে নেয় তাকে আবার ফিরে তাকায় চাঁদের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জারনাব। চন্দ্রের সান্নিধ্যে দুনিয়াদারি সব ভুলে বসে জোভিয়া। সে চাঁদের দিকে চেয়ে ডেকে ওঠে, “জোভিয়া, ঘুমাবে না?”

চাঁদের থেকে দৃষ্টি সরালো না জোভিয়া। সেভাবে চেয়েই বলল, “তুমি ঘুমিয়ে পড়ো বুবু, আমি একটু পড়ে ঘুমাবো।”

হাল ছাড়লো না জারনাব। বোনের মুখ ধরে আলতো করে ঘুরিয়ে নিলো নিজের দিকে। মায়া মিশ্রিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধাল, “আচ্ছা, আমাকে আজ বলোতো তুমি চাঁদের সাথে কী গল্প করো? আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে তোমাদের কথোপকথন।”

উত্তর দিলো না জোভিয়া। পূর্বের ন্যায় ঘুরে তাকালো চাঁদের দিকে। এ চাঁদ যেন তার নৈকট্য পেতে বড্ড উদগ্রীব! এতো দ্রুত এই চাঁদের সান্নিধ্য থেকে দূরে যাবে না সে। সারাটা দিন অপেক্ষা করতে হয় তার দর্শন পেতে আর এখন কি-না সে তাকে ছেড়ে চলে যাবে! কখনোই না। এখনো যে অনেক গল্প বাকি রয়েছে। অধরা রয়েছে তাদের কথোপকথন। দিনভর জমানো হাজারো কথা চাঁদের জন্য তুলে রেখেছে। উত্তর না নিয়ে সে কেন যাবে? উত্তর দেবে চাঁদ, তার সমস্ত কথার উত্তর দেবে।

বোনকে আনমনে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে হতাশার শ্বাস ছাড়লো জারনাব। কী এমন কথা তার বোনের যে তার সাথে ভাগ করে নিতে পারে না? সেও যেন আজ নাছোড়বান্দা হয়ে উঠেছে। তাকে আজ শুনতেই হবে চাঁদের নৈকট্য কেন এতো প্রিয় তার বোনের? সে জোভিয়ার মাথায় আদুরেভাবে হাত বুলিয়ে পুনরায় শুধাল, “চাঁদ কি উত্তর দিয়েছে আজ? নাকি জ্বালাচ্ছে আমার বোনটাকে?”

“সে অভিমান করেছে বুবু, বড্ড অভিমান করেছে।”
আনমনেই বলল জোভিয়া।

জারনাব উপলব্ধি করে নেয় তার বোনটার বুঝি মন খারাপ। তাই আর বিরক্ত না করে জোভিয়ার মাথায় আলতো চুম্বন করে কামরায় ফিরে গেল সে। বিছানার দিকে এগোতে গিয়ে আবার মনে হলো আব্বাজানের কামরায় গিয়ে একবার তার খবর নিয়ে আসা প্রয়োজন। সে ধীরে ধীরে আব্বাজানের কামরায় প্রবেশ করতেই উঠে বসতে চায় আব্দুর রহমান। দৌড়ে গিয়ে তাকে সামলে নিলো জারনাব। অভিমানী স্বরে বলল, “এমন কেন করেন আব্বাজান? আপনি অসুস্থ, আপনার এভাবে ওঠার কী প্রয়োজন?”

মেয়ের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো আব্দুর রহমান। অতঃপর মেয়ের নারাজ মুখখানার দিকে চেয়ে বলল, “আমার আম্মাজান এসেছে আর আমি শুয়ে থাকবো? তা কী করে হয়?”

“আপনার শরীর ভালো নেই আব্বাজান। এমন করলে কিন্তু আর এ কামরায় আসবো না আমি।” অভিমানী কন্ঠ জারনাবের।

অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আব্দুর রহমান। মেয়ে তার বড্ড মান করেছে। তাই কথা ঘুরিয়ে নিতে সে শুধাল, “আমার ছোট আম্মা কোথায়?”

“আর কোথায়? যেখানে রোজ থাকে। গল্প করতে ব্যস্ত খুব। তাই আর বিরক্ত করলাম না।”

হেসে উঠলেন আব্দুর রহমান। বলল, “চাঁদ বুঝি জ্বালাচ্ছে আমার আম্মাকে। চাঁদ কি জানে না আমার আম্মা তাকে কতো ভালোবাসে?”

বাবার কথায় জারনাব নিজেও মিষ্টি হাসলো। বোনটা তার বড্ড পাগলী। চাঁদের সাথে গল্প না করলে তার ঘুমই আসে না। সমস্ত ভাবনা ছেড়ে আব্বাজানকে বিদায় দিয়ে নিজের কামরায় ফিরে এলো সে। উঁকি দিয়ে জোভিয়াকে আরেকবার দেখে নিয়ে বিছানায় চলে গেল। পাতলা চাদরটা শরীরের ওপর ছড়িয়ে নিয়ে
ডুব দিলো তার জীবনের কঠিনতম বিষন্নতায়। বেশ খানিকটা সময় আনমনে অতীতে বিচরণ করতেই বিষিয়ে উঠলো তার কোমল হৃদয়। ভাবতে চায় না সে অতীত নিয়ে। তবুও কেন যেন অতীত পিছু ছাড়ে না তার। বারংবার মনে করিয়ে দেয় তার সুখময় সেই সংসারের চিত্র। যা তার জীবন থেকে হারিয়েছে কয়েক বর্ষ পূর্বেই। বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।

আরো প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে কামরায় ফিরে আসলো জোভিয়া। বোনের দিকে চেয়ে দেখলো সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই নিঃশব্দে আব্বাজানের কামরায় গিয়ে তাকে একবার দেখে নিয়ে ফিরে আসলো নিজেদের কামরায়। বোনের শরীরে চাদরটা ভালোমতো জড়িয়ে দিয়ে পাশে শুয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়লো।

সকাল সকাল সুলতানের মহলে অতিথি আপ্যায়নের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। সমস্ত সেবক-সেবিকা লেগে পড়েছে নিজ নিজ কর্মে। যথারীতি অতিথিদের জন্য কামরা গুছিয়ে রাখা হয়েছে। রন্ধনশালায় রান্নাবান্নার কাজ চলছে পুরোদমে। নতুন আসা কিছু মেয়েদের দিয়ে রান্না করানো হচ্ছে। তাদের তদারকি করে চলেছে প্রধান রাঁধুনি মাজেদা বানু। কারোর যেন দু’দন্ড বসার কোনো সুযোগ নেই। মেয়েরা ব্যস্ত হাতে রান্না সেরে মাজেদার বানুর সামনে দিচ্ছে। একে একে সমস্ত খাবার পরিক্ষা করে নিচ্ছে সে। যেগুলো খাওয়ার যোগ্য সেগুলো সযত্নে তুলে রেখে বাকিগুলো পাশে সরিয়ে দিচ্ছে। নতুন একটা মেয়ের সামান্যতম ভুলে এক থালা খাবার নষ্ট হয়ে যায়। এতেই তেতে ওঠে মাজেদা বানু। ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, “কাজ করতে না পারলে মহলে এসেছিস কেন?”

নতুন হওয়ায় মেয়েটা এমনিতেই ভয়ে ছিল তার উপর এমন ধমকে চুপসে গেল সে। তার নাম ফাইজা। বয়স সতেরো কী আঠারো হবে হয়তো। এই অল্প বয়সেই পেটের তাগিদে তাকে আসতে হয়েছে এই মহলে। ফাইজা মাথা নিচু করে বলল, “আসলে আমি আজ একটু অসুস্থ বোধ করছি। ভুল হয়ে গেছে, আর কখনো হবে না এমন।”

তেড়ে আসলো মাজেদা বানু। মেয়েটার চোয়াল চেপে ধরে বলল, “এসব অসুস্থতার বাহানা বহুত দেখেছি আমি। চুপচাপ কাজ কর নাহলে উপযুক্ত শাস্তি পাবি তুই।”

ভয়ে এবার কেঁদে ফেললো মেয়েটা। মাজেদা বানুর সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, “আমায় ক্ষমা করুন। আমি সত্যিই বাহানা করছি না।”

সপাটে এক থাপ্পড় মেরে বসলো মাজেদা বানু। রাগান্বিত স্বরে বলল, “এতো বড় স্পর্ধা তোর? আমার মুখে মুখে তর্ক করছিস?”

এতোকিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ রন্ধনশালার বাকি প্রাণীগুলো কী নিখুঁতভাবে অভিনয় করে গেল। যেন কোনোকিছুই তাদের দৃষ্টিগোচর বা শ্রবণগোচর হয়নি। তারা তাদের মতো নিত্য কর্মে ব্যস্ত। এমন সময় সেবকদের প্রধান আবু হানিফ এসে তাড়া দিয়ে বললো, “কৈ গো মাজেদা, তাড়াতাড়ি করো। মেহমান তো এসে পড়লো বলে। তোমার জন্য গর্দান দিতে হবে নাকি আজ?”

ব্যস্ত হয়ে পড়ে মাজেদা বানু, “না না, এইতো হয়ে এসেছে। এখনি সবকিছু তৈরি করে পাঠাচ্ছি।”

আবু হানিফের চোখ পড়লো ক্রন্দনরত মেয়েটার উপর। সে মাজেদা বানুর উদ্দেশ্যে শুধাল, “কি মাজেদা? কাঁদে কেন? মেরেছো নাকি?”

“কী করবো বলুন? নতুন মেয়েগুলো শাস্তি না পেলে কাজে মনই দিতে চায় না।” আক্ষেপ করে বলল মাজেদা বানু।

“আর মেরো না। বুঝতেই পারছো, বেগমের পিতা-মাতা আসছেন। কোনোরূপ ঝৈ-ঝামেলা হলে আমাদের গর্দান নিয়ে নেবেন সুলতান।”

তার সাথে কথোপকথন জমিয়ে কিছুক্ষনের জন্য রন্ধনশালা ছেড়ে বেরিয়ে গেল মাজেদা বানু। অমনি ফাইজার দিকে দৌড়ে আসলো একজন মধ্যবয়সী মহিলা। সে এখানকার পুরাতন রাঁধুনি। তার নাম হাফসা। ফাইজাকে পরম আদরে আগলে নিয়ে বলল, “কাঁদিস না। তোর কাঁন্না দেখার কেউ নেই এখানে। এখানে সব মাজেদা বানুর নিয়মে চলে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই শাস্তি দেয় সে।”

ফাইজা ভেজা গলায় বলল, “কিন্তু কেউ কি প্রতিবাদ করে না তার?”

“করতো। একজন ছিল যাকে জমের মতো ভয় পেত এসব পাপিষ্ঠারা। আমাদের সুলতানের বেগম এলিজা সুলতান। তিনি থাকাকালীন আমাদের কোনো অন্যায়ের সম্মুখীন হতে হয়নি বরং সেও আমাদের সাথে রন্ধনশালায় সময় কাটাতো, গল্পগুজব করতো। তখন মাজেদা বানুর এতো গরম ছিল না। বেগমের মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয়েছে তার এসব অত্যাচার। সামান্য ভুলেই শাস্তি দিয়ে বসেন তিনি। মহলের অন্যদের আর সময় কোথায় আমাদের দুঃখ-কষ্ট দেখার?”

চোখ-মুখ মুছে উঠে দাঁড়ায় ফাইজা। কৌতূহলী নয়নে শুধাল, “আচ্ছা, বেগম বুঝি খুব সুন্দরী ছিলেন? তাই তো সুলতান তার জন্য এতো পাগল।”

“সুন্দরী তো ছিলোই সে। তবে তার ব্যবহারও ছিল অমায়িক। তার হৃদয়ে ছিটেফোঁটা অহংকার পর্যন্ত ছিল না অন্যদের মতো। সুলতান তার চেহারায় নয়, উদারতা এবং সকলকে আগলে রাখার দক্ষতায় গলেছিল। কমবয়সী একজন সম্রাজ্ঞীর এমন দক্ষতায় গলেছিল সকলেই। সে কতোটা নিখুঁতভাবে আগলে রাখতো আমাদের তা ভুলবার নয়। আমরা কি আর জানতাম এতো তাড়াতাড়ি মৃত্যুবরণ করবে সে? তার মৃত্যুর দিন সুলতানের সে কি আহাজারি, তোকে বলে বোঝাতে পারবো না।”

হটাৎ মাজেদা বানুর আসার শব্দ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে কাজে লেগে পড়লো তারা। মাজেদা বানু এসে শোর ফেলে দিলো। সকলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল, “কাজে মন দাও মেয়েরা। সময় অপচয় সুলতানের পছন্দ নয়। ইতিমধ্যে মেহমান পৌঁছে গেছে মহলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবারের জন্য ডাক পরবে।”

ওয়াসিফা সুলতানের কামরায় অবস্থান করছেন মারজিয়া সুলতান এবং শেহজাদি মাইরা। ওয়াসিফা সুলতান ও মারজিয়া সুলতান নানান বিষয় আলোচনায় মশগুল। পাশেই মাথা নিচু করে বসে আছে শেহজাদি মাইরা। তার নীল সুতোর কারুকার্য করা সফেদ গাউনের উপর দামী, মূল্যবান পাথরের কারুকার্য করা। রূপে তার জুড়ি মেলা ভার। আড়চোখে তার দিকে তাকালো ওয়াসিফা সুলতান। এলিজার তুলনায় কোনো অংশে কম নয় এই কন্যা বরং দু’জনের রূপ যেন সমান পাল্লায় পড়ে। তাইতো পুত্রের জন্য সে বেছে নিয়েছে এই কন্যাকে। হুট করে সে মাইরার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “একি! ভবিষ্যত সুলতানার মাথা নিচু কেন? মাথা উঁচু করে চলবে তবেই তো একজন নিখুঁত সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠতে পারবে।”

মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন মারজিয়া সুলতান।
অতঃপর চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো, “কিন্তু সুলতান শাহজাইন কি সম্মতি দেবে এই বিবাহে? সত্যি বলতে আমি বড্ড চিন্তিত। ক্ষণিক সঙ্কাও রয়েছে এ ব্যাপারে।”

গম্ভীর হয়ে উঠলেন ওয়াসিফা সুলতান। শান্ত স্বরে বললেন, “সম্মতি না দেওয়ার কিছু দেখছি না আমি। তাছাড়া তোহফা তো আম্মাকে হারিয়ে নিজের খালামণিকেই পাবে আম্মাজানের রূপে। শাহজাইন নিশ্চয়ই নিজ কন্যার দিকটাও বিবেচনায় রাখবে। তাছাড়া ভবিষ্যত সুলতানও তো প্রয়োজন। কন্যা তো আর সাম্রাজ্য সামলাতে পারবে না তার উপর সে কথা বলতে পারে না। এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায় না। পুত্রবধূ প্রয়োজন আমার আর সাম্রাজ্যের প্রয়োজন নবাগত সুলতান এবং সম্রাজ্ঞী।”

মাইরার দিকে চেয়ে বলল, “উত্তরাধিকার চায় এই মহল। পারবে না তুমি একটা পুত্র উপহার দিতে?”

আরো খানিক মাথা নুইয়ে নিলো মাইরা। সুলতান শাহজাইন একইসাথে সুদর্শন এবং তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী। তাকে বিবাহ করতে কোনো মেয়েই আপত্তি করবে না বরং তার সফেদ মুখের মাঝে খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। তার পাগরীর মাঝে লুকায়িত চুলগুলো আবেগ লেপে যায় প্রতিটি নারীর হৃদয়ে। তবে সবকিছুর মাঝেও কঠিন বাক্য একটাই। এই পুরুষ তার বড় বোনের স্বামী! বোনের কন্যার পিতা সে!

শেহজাদি তানহা একটি প্রয়োজনে আম্মার কামরায় এসেছিল তবে এসে হুট করে এসব শুনে হনহনিয়ে চলে গেল সে। তার আম্মাজান একজন সুলতানা হয়ে কীভাবে এমন মনসিকতা রাখতে পারে? আম্মা সবসময় কন্যার তুলনায় পুত্রকে অধিক মূল্যায়ন করেছেন। এতে তার কোনো আপত্তি ছিল না। তা বলে জোর করে ভাইকে আবার বিবাহ দিয়ে উত্তরাধিকার আনতে হবে? আর তোহফা? ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুটাকে সে কীভাবে তুচ্ছ করে দেখতে পারে? নিজের আম্মার সিদ্ধান্তে অত্যন্ত হতাশ সে। আশঙ্কায় পড়েছে সে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়েও। সেই মানব, যার নিকট এখন পর্যন্ত নিজের ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেনি সে। তাকে নিয়ে আশঙ্কা! ফিচেল হাসলো সে। মানুষটা বুঝি কখনোই তার হবে না। নিজের হৃদয়ে স্থান দেবে না মহলের কোনো বাসিন্দাকে।

চলবে,,,,,

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_3

মানুষে গমগম করছে ‘নূর’ বাজার। দোকানিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ক্রেতাদের মন রক্ষার্থে। জারনাব ধীরে ধীরে দোকানের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখছে আর জোভিয়া ক্রেতা সামলাচ্ছে। জারনাব সবসময় জোভিয়াকেই এগিয়ে দেয় ক্রেতাদের সামলাতে। সে খুব কম কথা বলতেই অভ্যস্ত অন্যদিকে জোভিয়া কথাবার্তায় বেশ পটু। তাই এদিকটা তাকেই দেখতে হয়। কিছুক্ষণ বিরতি পেয়ে নিচে পেরে রাখা মাদুরটাই পা ভেঙে বসে পড়লো জোভিয়া। জারনাবের উদ্দেশ্যে শুধাল, “ঈদ আসতে আর কতদিন আছে বুবু?”

নরম কাপড় দিয়ে খেজুরের বয়ামটা পরিষ্কার করছিলো জারনাব। হটাৎ বোনের কথাতে ভ্রু কুচকে তাকালো সে। তার বোন প্রতিবছরই ইদের জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। প্রতি ইদে সুলতানের মহলের অতিথি হয় তারা। শুধু তারা বললে ভুল হবে। রামান সাম্রাজ্যের প্রতিটা মানুষ ইদের দিন মহলের অতিথি হয়। প্রতি ইদে বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে সুলতানের পক্ষ থেকে সবাইকে ভোজন করানো হয়। বয়ামটা রেখে বোনের পাশে মাদুরে বসলো সে। বোনের উদ্দেশ্যে দুটো খেজুর এগিয়ে দিয়ে বলল, “বেশি দেরি নেই আসতে। শীঘ্রই আসবে ইদ-উল-ফিতর। এইতো রমজান মাস এলো বলে। দু’য়েকদিনের মধ্যেই রোজা শুরু হবে।”

“এবার বুঝি দেরি করছে আসতে।” মন ভার করে বলল জোভিয়া। বড় বোনের নিকট থেকে মায়ের ন্যায় স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে সেও বুঝি আল্লাদি হয়ে উঠছে। অন্যদিকে জারনাব, সে পৃথিবীর সবার সম্মুখে গম্ভীর এবং স্বল্পভাষী অথচ ছোট বোনের নিকট সে এক মমতার প্রতিক। বয়সের পার্থক্যটা ভীষণ কম তবুও কী নিদারুণভাবে সে মমতায় আগলে রাখে বোনটাকে। স্বামীর মৃত্যুর পর এমনভাবে নিজেকে আবৃত করে নিয়েছে যেন একটা মাছিও গলতে না পারে তার এপারে। অসাধারণ সুন্দর তার ব্যক্তিত্ব।

জোভিয়া, সে যেন রহস্যের মায়াজাল। যেই জাল ছেদ করতে কারো পুরো জীবনই বুঝি লেগে যাবে। কঠোর এবং স্পষ্টভাষী সে কিন্তু বোনের নিকট যেন গলে মোম হয়ে যায়। বাইরের কারোর সঙ্গে কথা বলতে সে খুব একটা পছন্দ করে না তবে ক্রেতাদের সাথে তার আচরন অত্যন্ত ব্যবসায়িক। জারনাব পুনরায় কিছু বলবে এমন সময় নিজের নিয়মমাফিক সেখানে হাজির হয়ে যায় বণিক। দোকানের বাইরে থেকে খানিক উচ্চস্বরে আওয়াজ দিয়ে বলল, “কেউ আছেন?”

মুখের ওপরের পর্দাটা ভালোমতো ঠিকঠাক করে উঠে দাঁড়ালো জোভিয়া। বিনয়ী কন্ঠে বলল, “জী বলুন, কী লাগবে?”

“আস-সালামু আ’লাইকুম।” তৎক্ষণাৎ সালাম প্রদান করলো বণিক।

“ওয়া আ’লাইকুমুস-সালাম।”

সোজা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জোভিয়া। তার দিকে চেয়ে বণিক মুচকি হেসে বলল, “খেজুর নিতে এলাম। রোজা তো এলো বলে।”

চুপচাপ ছোট বড় কিছু খেজুরের প্যাকেট এনে তার সামনে রাখলো জোভিয়া। অগোছালোভাবে দুটো প্যাকেট তুলে নিলো বণিক। মূল্য চুকিয়ে দেওয়ার পরেও একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল সে। মায়ার দৃষ্টিতে চাইল জোভিয়ার দিকে। ভারি অস্বস্তি বোধ করলো জোভিয়া। নিজের শক্ত দৃষ্টি খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে নিলো সে। কেননা এটা রোজকার রুটিন, আজ নতুন নয়। আর ক্রেতার সঙ্গে দুর্ব্যবহার এই বাজারের নিয়ম বহির্ভূত। সে গলা খাকারি দিয়ে বলল, “আপনার আর কিছু প্রয়োজন আছে কি?”

ধ্যান ভাঙলো বণিকের। হকচকিয়ে উঠলো সে। ব্যস্ত স্বরে বলল, “আমি যা কিনতে এসেছি তা কি দেবে তুমি? বড় কঠিন পাথরে তৈরি তোমার হৃদয়।”

হয়তো খানিকটা রাগান্বিত হলো জোভিয়া। তবে কন্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখেই বলল, “আপনি বোধহয় আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন জনাব।”

মুচকি হাসলো বণিক। মনেমনে কিছু একটা আওড়ে নিয়ে বলল, “তুমি আমায় আবরার বলে সম্বোধন করতে পারো অথবা জাওয়াদ। আমার নাম আবরার জাওয়াদ। বারবার তোমার মুখে এই জনাব শব্দটা ঠিক শোভা পাচ্ছে না।”

“ধন্যবাদ, তবে ক্রেতার নাম ধরে ডাকা নূর বাজারের নিয়ম বহির্ভূত। আমি অত্যন্ত দুঃখিত।” পুনরায় বলল জোভিয়া।

মুচকি হাসি এখনো বজায় রয়েছে বণিকের ঠোঁট জোড়ায়। সে খানিক রসিকতার স্বরে বলল, “আর কতো এভাবে কাঠপুতলির ন্যায় আচরন করবে কন্যা? বেরিয়ে আসো এই নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করে। চলো দু’জন হারিয়ে যাই কোনো দূর সাগরে।”

“আপনার প্রয়োজন শেষ হয়ে থাকলে আপনি আসতে পারেন। অযথা ভীর জমিয়ে অন্যান্য ক্রেতাদের বিরক্তির বা অসুবিধার কারন হবেন না আশা করি।”

মুখের ওপর এভাবে নাকচ করে দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলার পরেও মোটেও বিরক্ত বা রাগান্বিত হতে দেখা যায় না বণিককে। বরং তার ঠোঁটের অপূর্ব হাসিটুকু এখনো অক্ষত। সে দোকান ছেড়ে যেতে যেতে গলা উচিয়ে বলল, “ভেবে দেখো কন্যা। এমন নির্মম হইয়ো না এই আশিকের প্রতি। আবার আসবো আমি, অপেক্ষা করবো অনন্তকাল।”

বাক্য সম্পূর্ণ করে সে চলে যায় নিজের জাহাজের দিকে। আর কতোবার হৃদয়ের অনুভূতি ব্যক্ত করলে এই কন্যার হৃদয় গলবে? প্রণয়হীন এই জীবন কবে পাবে তার প্রণয়িনীর স্বাদ? নারীদের নরম মন বোধহয় বড্ড কঠিন প্রতিচ্ছবি এঁকে দেয় প্রত্যেক প্রেমিক হৃদয়ে! ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সে জাহাজে উঠে হারিয়ে যায় নদীর বুকে। নূর বাজারে টাঙানো শত শত রঙিন ছাউনিগুলোও যেন হলফ করে বলতে পারে কাল সে আবার ফিরে আসবে। আবার আসবে এই দোকানের সম্মুখে। ব্যক্ত করবে নিজের হৃদয়ের কথন। সেই একই জবাব পেয়ে সে আবার হারিয়ে যাবে নদীর বুকে।

সে চলে যেতেই মাদুর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জারনাব। ইতিমধ্যে বিরক্তিতে তার চোখ-মুখ কুচকে গেছে। জোভিয়া বিরক্ত হয় কি-না তা তার জানা নেই। তবে সে খুবই বিরক্ত এই আবরার জাওয়াদের উপর। সে এক আতঙ্কের ন্যায় রোজ রোজ হাজির হয়ে যায়। সেই সময়টুকু জারনাব মাদুরে বসেই কাটায়। মাঝে মাঝে তার মনের কোনে প্রশ্ন উঁকি দেয় ; লোকটার কি লাজ-লজ্জা বলতে কিছু নেই? রোজ একই উত্তর সে হজম করে নেয় কতো সাবলীলভাবে! তবে লোকটা সুদর্শন বটে। তার বোনের হৃদয় গলাতে তাকে আরো কাঠখড় পোড়াতে হবে। বেচারার ধৈর্য্য আছে বটে!

হুট করেই বাজারময় চিৎকার-চেঁচামেচি খানিক বৃদ্ধি পেল। দোকানিদের আতঙ্কিত স্বর শ্রবণগোচর হতেই ভ্রু কুচকাল জারনাব। ঠাহর করতে পারলো কী ঘটতে চলেছে। তখনই দূর থেকে নজরে আসলো পাঁচজন পুরুষ। তারা একসঙ্গে এগিয়ে আসছে তাদের দোকানের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জারনাব। জোভিয়ার উদ্দেশ্যে বলল, “আবার চাঁদা তুলতে এসে পড়েছে। এই জিদানের জন্য একটু বেঁচে-কিনে খেয়েও শান্তি নেই। প্রত্যেক সপ্তায় দলবল নিয়ে হাজির হয়ে যায় সকাল করে। খুবই অভদ্র একজন ব্যক্তি এই জিদান।”

কথা সম্পূর্ণ করার পরেও জোভিয়ার কোনো সাড়াশব্দ
পেল না সে। দ্রুত তার দিকে তাকাতেই হতবাক হতে বাধ্য হলো। জোভিয়া মাদুরে বসে ছিলো মুখের পর্দা উঠিয়ে। প্রচন্ড গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার হতে হচ্ছে তাদের। তবে এখন আর স্বাভাবিক নেই জোভিয়া। অতিরিক্ত রাগের ফলে শক্ত হয়ে উঠেছে তার মুখভঙ্গি। হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে সে। তার কাঁধে হাত রাখলো জারনাব। হতবাক নয়নে শুধাল, “তুমি আবার এমন রেগে যাচ্ছো কেন? দেখো, এই দোকানটাই আমাদের উপার্জনের একমাত্র উপায়। আমি চাই না এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক। সামান্য অর্থের জন্য ঝামেলা করে নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাছাড়া জিদান প্রভাবশালী। তার পিতা মহলের উচ্চ পর্যায়ের কর্মচারী। তার সঙ্গে পেরে উঠব না আমরা উল্টো হারাতে হবে এই দোকানটা।”

শুনলো না যেন জোভিয়া। জিদান তার দলবল নিয়ে তাদের দোকানের সম্মুখে আসতেই শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল সে। খপ করে তার হাত চেপে ধরলো জারনাব। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো, “বসে থাকো। আমি সামলাচ্ছি।”

এমন সময় বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে ডেকে উঠলো জিদান, “কী গো? দুই সুন্দরী, সামনে আসবে না নাকি? তোমাদের সৌন্দর্য দেখে এবারের চাঁদাটা মাফও করে দিতে পারি। সামনে এসো, সামনে এসো। নাহলে আমাকে আবার ভেতরে আসতে হবে।”

মাদুর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জারনাব। সালাম প্রদান করে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, “এ সপ্তাহে খুব একটা বেঁচা-কেনা হয়নি ভাইয়া। যতটুকু হয়েছে আব্বাজানের ওষুধ কেনার পর সংসার চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। দয়া করে একটু সময় দিন। সামনের সপ্তাহে পুরোটা একবারে দিয়ে দেবো কথা দিলাম।”

জারনাবের আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে শয়তানি হাসলো জিদান। অতঃপর বিশ্রি ভঙ্গিমা করে বলল, “তা আবার হয় নাকি সুন্দরী? গতরখানা তো ভালোই বানিয়েছো। এদিকে বিবাহও করছো না দু’বোন। ব্যবসা নিশ্চয়ই ভালোই জমছে রাতের বেলা। তা আমাকেও তো একটু সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো। চাঁদা মওকুফের সাথে বকসিসও পাবে।”

ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠলো জারনাবের। এতো নোংরা মানসিকতা কারোর থাকতে পারে তা জানা ছিলো না জারনাবের। লজ্জায়, ঘেন্নায় কুকড়ে যাচ্ছে সে। জঘন্য রকম নোংরা কথাগুলো বলেও দাঁত বের করে হাসছে জিদান। সাথে তাল মেলাচ্ছে তার দলবল। ইতিমধ্যে ভিজে উঠেছে জারনাবের নয়ন জোড়া। টলমল দৃষ্টি লুকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সে কথাগুলো হজম করে নিলেও হুট করে উঠে দাঁড়ালো জোভিয়া। পর্দার আড়ালে তার হালকা বাদামি চোখদুটো অগ্নি শিখার ন্যায় জ্বলে উঠেছে। আচমকা কেউ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সে সর্বশক্তি দিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো জিদানের গাল বরাবর। থাপ্পড়টা এতোটাই জোড়ালো ছিলো যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যেতে ধরলো জিদান। ধরে ফেলল তার সাথের ছেলেগুলো। অগ্নি দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো জিদান। ভয়ে থরথর করে কাঁপাকাপি শুরু হয়ে গেছে জারনাবের। জিদান হিংস্র হয়ে জোভিয়ার দিকে তেড়ে যেতে নিলে তাকে চেপে ধরে তার সাথের ছেলেগুলো। শোরগোলের লক্ষণ পেয়ে এতক্ষণে ভীর জমে গেছে দোকানের সামনে। ছেলেগুলো জিদানকে সামলে নিয়ে স্বল্প স্বরে বলল, “ভরা বাজারে কিছু করলে গর্দান নিয়ে নেবেন সুলতান। চারপাশে দেখুন কত লোকজন জড়ো হয়ে গেছে।”

জিদান চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখলো ঘটনা সত্যিই। এখানে কিছু করা যাবে না। তবে হার মানলো না সে। সামান্য এক নারীর কাছে হার মানার পুরুষ নয় সে! যেই নারীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছে এতদিন। তাদের একজনের কাছে হারবে সে! কক্ষনো না। ভরা বাজারে এমন অপমান তাকে হিংস্র করে তুলেছে কয়েকগুণ। সে আক্রোশভরা দৃষ্টিতে চেয়ে হুমকির স্বরে বলল, “হাজার মানুষের সাথে শুয়ে শুয়ে খুব গরম হয়েছে তোর শরীরে? জিদানের গায়ে হাত তুলিস? তোর শরীরের সমস্ত তেজ আমি গুড়িয়ে দেবো খুব তাড়াতাড়ি। তোদের দুটোকে যদি আমার পালঙ্কে না নিতে পারি তবে আমিও এক বাপের ব্যাটা নয়।”

কথাখানা বলেই সে দলবল নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় বাজার থেকে। ধীরে ধীরে কমে আসলো মানুষের জটলা। দোকানিরা নিজের দোকান ফেলে ছুটে এসেছিলো তাই আবার হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো নিজেদের দোকানের দিকে। একই স্থানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে ফুঁসছে জোভিয়া। রাগ হলো জারনাবের। ভেজা কন্ঠে কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “তোমাকে কে বলেছিল এতো বাড়াবাড়ি করতে? বসে থাকতে বলেছিলাম না তোমায়?”

রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হলো জোভিয়া। কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলল, “সবসময় কেন মুখ বন্ধ করে সহ্য করো এসব? কোথায় এতো সাহস পায় ঐ লোক? কিছু না বলাতে দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ওর অভদ্রতা। বাড়াবাড়ির দেখেছো কী? যেই মুখে ও নোংরা শব্দগুলো উচ্চারণ করেছে সেই মুখ সেলাই করে দিলেও শান্তি পেতাম না আমি।”

“বাস্তবতা বড় কঠিন জোভিয়া। মুখ থাকলেই সবকিছু বলতে নেই তেমনি হাত থাকলেই তা যার-তার উপর ওঠাতে নেই। হাত তোলার আগে অবশ্যই প্রতিপক্ষের শক্তি বিবেচনা করা উচিত। যেই প্রতিবাদ অন্যায় রোধ করার বদলে অপরাধীকে ক্ষেপিয়ে তোলে তাকে আরো বড় অপরাধ করার জন্য সেই প্রতিবাদের কি খুব প্রয়োজন জোভিয়া? তোমার উঠিত নিজের অনিয়ন্ত্রিত রাগকে দমন করা।”

তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে রাগশূন্য হলো জোভিয়ার। শান্ত স্বরে বলল, “দমন করবো কিন্তু দাফন নয় বুবু। যতবার জিদানের মতো মানুষের সম্মুখীন হব ততবার এই রাগ নতুন করে জন্ম নেবে। রাস্তার কুকুরের জন্য হয়তো দুইটা ধমকই যথেষ্ট তবে মানুষের মাঝে মিশে থাকা কুকুররা মুখের কথার মূল্য দিতে জানে না। ভদ্রতার খোলস ছেড়ে এদের জন্য হাজারবার অভদ্র হতেও প্রস্তুত আমি।”

নিশ্চুপ থাকলো জারনাব। সে যেন গভীরভাবে আভাস পাচ্ছে অনাগত কোনো ঝড়ের! যা দ্রুতই ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে শোরগোল বাধানোর মেয়ে সে নয়। তাই এই মুহুর্তে কঠিন নীরবতাকেই বেছে নিলো সে।

নীরবতার ইতি টেনে পাশের দোকানির তিন বছরের বাচ্চাটা হটাৎ কেঁদে উঠলো। সব ভুলে তৎক্ষণাৎ সেখানে দৌড়ে গেল জোভিয়া। দোকানে প্রবেশ করে মাদুরে বসে থাকা ছোট্ট ইনায়া ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেলো না সে। একি! দোকান যে শূন্য! শাহিদা আপা বাচ্চা রেখে কোথায় গেছে? বাচ্চাটা মাদুরে বসে বসে হাত-পা ছুড়ে কেঁদে চলেছে। দ্রুততার সাথে কোলে তুলে নিলো সে। কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে হাঁটাহাটি করার পর গিয়ে থামলো বাচ্চাটা। কান্না থামিয়ে জোভিয়াকে আঁকড়ে ধরে পিটপিট করে চেয়ে আছে তার মুখের পানে। মুখের উপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে মুচকি হাসলো জোভিয়া। বাচ্চাটার নাম ইনায়া, সে এই দোকানের মালকিন শাহিদা আপার কন্যা। আপার স্বামী সুলতানের মহলের একজন স্বল্প বেতনভুক্ত সেবক। পানির পাত্র হাতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো শাহিদা। জোভিয়ার কোলে ইনায়াকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, “যাক বাঁচলাম। কখন এলি?”

কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে জোভিয়া বলল, “তোমার কেমন আক্কেল বলোতো আপা? ছোট বাচ্চাটাকে এভাবে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলে?”

“আর বলিস না, পানি ফুরিয়ে গিয়েছিল। ইনায়া ঘুমিয়ে ছিল তাই দ্রুত পানি আনতে গেলাম। তুইতো জানিস কুয়োটা বাজারের একদম শেষ প্রান্তে। দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়েছি আর এসেছি। এর মধ্যে জনাবা উঠে পড়েছেন।” হাঁপাতে হাঁপাতে বলল শাহিদা।

“এরপর থেকে পানির প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে। ঠিক আছে? আমি এনে দেব। তবুও বাচ্চা ছেড়ে এভাবে যেও না কোথাও। ছোট বাচ্চাকে এভাবে একা রেখে যাওয়া মোটেই উচিত হয়নি তোমার।”

“আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। তুই বাচ্চাদের এতো আদর-স্নেহ করিস অথচ বিবাহে রাজি হচ্ছিস না কেন বলতো? বিবাহের পর তোরও সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে। তাকে আদর করবি, তার সাথে সময় কাটাবি, কতো সুন্দর হবে তাই না?” ইনায়াকে নিজের কাছে নিতে নিতে বলল শাহিদা।

আচমকা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল জোভিয়ার মুখখানা। হয়তো বিবাহের প্রসঙ্গ তোলার কারনে অথবা পুরোনো কোনো ক্ষত নতুন করে তাজা হবার কারনে। জোভিয়া গম্ভীর কন্ঠে বলল, “সবার ভাগ্য তো আর এক হয় না আপা। আল্লাহ অবশ্যই উত্তম পরিকল্পনাকারী। তার মর্জিতেই সব হবে।”

কথা সম্পূর্ণ করেই সে ঝড়ের গতিতে ত্যাগ করলো সেই স্থান। ফিরে আসলো নিজেদের দোকানে। আনমনে বসে কিছু একটা ভাবছিল জারনাব। হঠাৎ জোভিয়ার আসার শব্দ পেয়ে মুখ তুলে থাকালো সে। বোনের বিষন্ন মুখ দেখে চমকাল সে। দ্রুত এগিয়ে এসে শুধাল, “কী হয়েছে আমার বোনটার?”

“বুবু, আমি বিবাহ না করলে কি বোঝা হয়ে যাবো তোমাদের নিকট?”

“এসব কী বলছো? তুমি কি জানোনা আমাদের নিকট কতোটা মূল্যবান তুমি? হাজার সুখের কিনারা তুমি আমাদের। এমন কথা আমরা মনেও আনতে পারি না। তুমি এটা কীভাবে বলতে পারলে জোভিয়া?” হতবাক নয়নে চেয়ে উত্তর দিলো জারনাব।

দৌড়ে এসে তাকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো জোভিয়া। ক্ষীণ স্বরে বলল, “সুলতান তো কথা দিয়েছিল সে বাজারের মাঝখানে একটা পানির কল বসিয়ে দেবে। এতে বাজারের সকলেরই সুবিধা হতো। এখনো কেন দিচ্ছে না তাহলে? তুমি জানো, আজ শাহিদা আপা ইনায়াকে একলা ছেড়ে ঐ শেষ প্রান্তে পানি আনতে গিয়েছিল। বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হলে কী হতো বলোতো?”

“হ্যাঁ তাইতো, তার হয়তো স্মরণে নেই বিষয়টা। আমি বলি কী, তুমি তো কথাবার্তায় বেশ পটু। তুমি একবার মহলে গিয়ে তাদেরকে বিষয়টা স্মরণ করিয়ে দাও।” চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল জারনাব।

তাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো জোভিয়া। পানির পাত্রটা নিয়ে ঢকঢক করে দুই ঢোঁক পানি খেয়ে নিয়ে বলল, “কখনোই না। অন্য কাউকে যেতে বলো। আমি কোথাও যাচ্ছি না। মহলে তো একদমই নয়।”

সুলতানের মহলে অতিথি আপ্যায়নের তোড়জোড় চলছে পুরোদমে। বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে করা হচ্ছে অতিথিদের আপ্যায়ন। চারদিকে সকল সেবক-সেবিকা নিজ নিজ কর্মে এতোটাই ব্যস্ত যেন চোখের পলক ফেলারও সুযোগ নেই তাদের। সুলতান মহলে নেই, সে আজমাইন মাহতাবকে সাথে নিয়ে পার্শ্ব সাম্রাজ্যে গিয়েছে ব্যবসায়িক চুক্তির ব্যপারে আলোচনা করতে। এই সুযোগে মহলের বিশাল বৈঠকখানায় বৈঠক বসিয়েছে ওয়াসিফা সুলতান। সেখানে উপস্থিত আছেন সুলতান শাহজিল, শেহজাদি তানহা, এলিজা সুলতানের পিতা সুলতান ইহসান, মাতা মারজিয়া সুলতান এবং বোন মাইরা সুলতান সাথে রয়েছেন ওয়াসিফা সুলতান নিজেও। ছোট্ট তোহফা বসে আছে ফুফিজানের কোলে। ভাসা ভাসা চোখদুটো দিয়ে সে ঘুরে ঘুরে দেখছে সবাইকে। শেহজাদি তানহা তার ভীষণ পছন্দের একজন মানুষ। বাবার পরে এই একজনের কাছেই সে যথাযথ আদর পায়। হঠাৎ তার চোখ গিয়ে পড়লো নীরবে বসে থাকা মাইরার উপর। কৌতূহলী নয়নে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকলো কতক্ষণ। অতঃপর দূরে বসা সুলতান ইহসানের দিকে চেয়ে শব্দহীন হেসে উঠলো। তার সঙ্গে তার মিলিয়ে হাসলেন সুলতান ইহসান নিজেও।

সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে ওয়াসিফা সুলতান বললেন, “তাহলে আলোচনা শুরু করা যাক?”

সকলের সম্মতি নিয়ে সে বলতে শুরু করে, “আজ এই পারিবারিক বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু হলো সুলতানের বিবাহ। এলিজা সুলতানের মৃত্যুর দু’বছর কেটে গেছে। তাই আমি চাইছি মহলে নতুন বেগম আনতে। তাছাড়া তোহফারও একজন মা প্রয়োজন। অন্যদিকে সাম্রাজ্য তার উত্তরাধিকার চায়। তার উপর আমার একমাত্র নাতনি তোহফা, তার তো জবান নেই। তাই তাকে দিয়ে সাম্রাজ্যের হাল ধরানো কোনোমতেই সম্ভব নয়। তাকে নিয়ে এ আশা করা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। যে কথাই বলতে পারে না সে সাম্রাজ্য সামলাবে কীভাবে? আর পুত্র সন্তান আনতে হলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন বেগমের প্রয়োজন। সর্বদিক বিবেচনা করে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি শাহজাইনের আবার বিবাহ দেওয়া হবে।”

আগ্রহের সাথে বসে থাকা মানুষগুলো মুহুর্তেই খানিক নড়েচড়ে বসলো। বিরক্ত হলো তানহা। সে পূর্বেই আন্দাজ করেছিল বৈঠকের কারন এটাই হবে। সুলতান ইহসান আপত্তি করে বলে উঠলেন, “কিন্তু সে যে তোহফাকে নিজ কন্যার ন্যায় মূল্যায়ন করবে তার নিশ্চয়তা কী? আমার নাতনি তো আর হেলায় বেড়ে উঠতে পারে না। সে আমার কন্যার একমাত্র চিহ্ন। আমি এই প্রস্তাবে কখনোই সম্মতি দিতে পারি না।”

মারজিয়া সুলতান অসন্তুষ্ট চিত্তে চাইল স্বামীর দিকে। তার বোধহয় মোটেও পছন্দ হলো না বাক্যগুলো। ওয়াসিফা সুলতান পুনরায় বলে উঠলেন, “সেই ব্যাপারটা মাথাতে রেখেই আমি প্রস্তাব রাখছি আপনার নিকট। আপনার ছোট কন্যা শেহজাদি মাইরাকে আমি পুত্রবধূ হিসেবে চাইছি। সে নিশ্চয়ই বোনের কন্যাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করবে।”

আচমকা এমন প্রস্তাবে চমকে উঠলেন সুলতান ইহসান।
হুট করে এমন প্রস্তাব আশা করেনি তিনি। নড়েচড়ে বসলো মাইরা। কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে সব যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অসহায় তার মুখভঙ্গি। তানহা দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল তোহফাকে নিয়ে। সন্তুষ্ট হলো বুঝি একজন ব্যক্তি সে হলো মারজিয়া সুলতান। তার যুক্তি হচ্ছে বাইরের মেয়ে বেগম হয়ে আসার চেয়ে ঘরের মেয়ে আসা ভালো। আসলেই কী ভালো? প্রকৃতির এই নিষ্ঠুরতা বুঝি আর শেষ হবে না!
ওয়াসিফা সুলতান পুনরায় বললেন, “মাইরাকে না পেলে অন্য কেউ বেগম হয়ে আসবে এই মহলে। কারোর মৃত্যুতে পুরো একটা সাম্রাজ্য থমকে যেতে পারে না। তোহফার জন্য এটাই ভালো হবে যে সে তার খালামণিকে পাবে আম্মাজান হিসেবে। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।”

সুলতান ইহসান মায়া মিশ্রিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তোহফার দিকে। সে আপাতত তানহার কোলে বসে নিজের হিজাব ধরে টানাটানি করছে। তোহফার মাঝে যেন এলিজাকে খুঁজে পায় সে। তার এলিজাও ছোটবেলায় ঠিক এমন ভাবেই হিজাব টানাটানি করতো সারাক্ষণ। তার নাতনিটা এতো ছোট বয়সে মাতৃহারা হয়েছে। এখন নতুন বেগম আসলে তার উপর বিশাল প্রভাব পড়বে। শাহজাইন প্রচন্ড ভালোবাসে এলিজাকে এতে কোনো সন্দেহ নেই তবুও দিন শেষে সে একজন পুরুষ, একজন সুলতান। তারও নিশ্চয়ই সঙ্গী প্রয়োজন। তার পুরোটা জীবন এখনো পড়ে রয়েছে। আজ হোক কাল হোক কেউ না কেউ আসবেই তার জীবনে। সবকিছু চিন্তাভাবনা করে সে অসহায় ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “আমি রাজি এই প্রস্তাবে। আপনি কথা বলুন শাহজাইনের সঙ্গে।”

খুশি হলেন ওয়াসিফা সুলতান এবং মারজিয়া সুলতান। তারা একত্রে বলে উঠলেন, “আলহামদুলিল্লাহ।”

আলোচনার সমাপ্তি বুঝে উঠে গেলেন সুলতান শাহজিল। অপরদিকে নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে রইল মাইরা। বড় বোনের স্বামীর সঙ্গে বিবাহ! দ্রুতই তার স্বামী হবে সে। নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে হবে তাকে। এ কি আদৌ সম্ভব! জানা নেই তার। কিঞ্চিত বিরক্ত হলো তানহা। কৌতূহলী হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে তোহফা। বিরক্তিভাব যেন হাওয়ায় উবে গেল তানহার। তোহফার ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুলগুলো ছুয়ে দিয়ে মিষ্টি হাসলো সে। ফুফিজানের হাসিতে খুশি হলো বোধহয় তোহফা। নিজের ঠোঁটদুটো খানিক প্রসারিত করলো সে। হুট করে খুব কান্না পেল তানহার। তোহফা যদি কথা বলতে পারতো সে নিশ্চয়ই এখন জানতে চাইত কার বিবাহের আলোচনা চলছে। কী বলত সে তখন? তোমার পিতার বিবাহ? নাকি তোমার আম্মাজানের স্থান তোমার খালামণি পেতে যাচ্ছে এটা বলত। নিষ্ঠুর এই নিয়তি কী খেল খেলছে তাদের নিয়ে! উপরওয়ালা বুঝি এতোটাই নারাজ তাদের প্রতি! তার আম্মাজান বুঝলো না নিজ পুত্রের ভালোবাসা। উত্তরাধিকার পেতে উতলা হয়ে উঠেছে সে। অথচ রামান সাম্রাজ্যের সুলতানের হৃদয়ের স্পন্দনের সাথে মিশে আছে একটিই নাম: এলিজা, এলিজা সুলতান।

চলবে………….