সম্রাজ্ঞী পর্ব-০১

0
181

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_1

“আজ কী কিনতে এসেছেন বণিক?”

কুচকুচে কালো রঙের ঢিলেঢালা গাউন পরিহিতা নারীটি বিনয়ী কন্ঠে শুধাল তার ক্রেতার উদ্দেশ্যে। কালো বর্ণের সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিশাল আবরন ছেয়ে আছে তার মাথা থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত। মুখের ওপর বাঁধানো পাতলা কাপড়ের পর্দাটা নেমে গিয়েছে গলার নিম্নভাগ অব্দি। কালো আবরনের আড়ালে হালকা বাদামি বর্ণের চোখদুটো যেন অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে।

“হৃদয় কিনতে এসেছি কন্যা, দেবে তুমি?”

নারীটির দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো সুদর্শন পুরুষটি। পড়নে তার ঘিয়ে বর্ণের একটি পান্জাবী, কোমরে গাঢ় বাদামি বর্ণের পাগরীটা শক্ত করে বাধা, মাথায় সফেদ বর্ণের টুপি। জাহাজে মাল নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোই তার রোজকার কর্ম। নদীর তীরে জাহাজ ভিড়িয়ে রোজ এই দোকানে আসাটাও যেন তার প্রত্যহের কাজে পরিণত হয়েছে।

“এখানে হৃদয়ের সওদা হয় না জনাব। আপনি অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখতে পারেন।” দক্ষ ব্যবসায়ীর ন্যায় যথাসম্ভব কন্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখে জবাব দিলো বিক্রেতা নারীটি।

“ভেবে দেখো কন্যা। প্রত্যহ তোমার নিকট থেকে একই জবাব শুনতে শুনতে বড় ক্লান্ত আমি।” বিরস স্বরে বলল বণিক।

“আমার এই জবাব আজন্মকাল ধরে চন্দ্র-সূর্যের উপস্থিতির ন্যায় অটুট থাকবে। আশা করি, এখানে অযথা এসে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না।” কোনো প্রকার আবেগি হেলদোল ছাড়াই বলে উঠলো নারীটি।

নিয়মমাফিক সেই একি উত্তর পেয়ে মুচকি হেসে বাজার ত্যাগ করলো বণিক। হাঁটতে শুরু করে নদীর তীরে ভিড়িয়ে রাখা তার বিশালাকার জাহাজটির দিকে। রোজ রোজ এমন জবাব শুনেও আশাহত হতে দেখা যায় না তাকে। গত ছ’মাস যাবত রোজ একই ঘটনা ঘটে আসছে। তাদের সংক্ষিপ্ত কথোপকথন এভাবেই রোজ শেষ হয়ে যায়। সূর্য ডোবে, চন্দ্র ওঠে, পুনরায় চন্দ্র বিলীন হয়ে সূর্য ওঠে সেই সাথে বণিকও নিজ নিয়মে ঠিকই হাজির হয়ে যায় এই দোকানের সামনে।

দোকানে উপস্থিত আরো একটি প্রাণী রোজকার ন্যায় নীরবে পর্যবেক্ষণ করে যায় তাদেরকে, নিঃশব্দে শুনে যায় তাদের কথপোকথন। বণিক দোকান ত্যাগ করতেই সে নারীটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আর কতোদিন এভাবে চলবে জোভিয়া? এই ভরা রূপ-যৌবন কতদিন লুকিয়ে রাখবে তুমি? আমি বলি কী, আব্বাজানের কথা মেনে নিয়ে বিবাহ করে নাও তুমি।”

বাক্যটা যেন খুব একটা পছন্দসই হলো না অপর ব্যাক্তিটির কাছে। শক্ত হয়ে উঠলো তার বাদামি চোখের দৃষ্টি। সে নারাজ স্বরে বলল, “তুমি অন্তত আব্বাজানের ন্যায় কথা বলো না বুবু। যেখানে তুমি একাকী জীবন কাটাচ্ছো সেখানে আমার কথা ভাবে কী করে আব্বাজান?”

ছোট বোনের কথাতে খুব একটা বিচলিত হতে দেখা যায় না জারনাবকে। এটা তার বোনের রোজকার ভাষণ, নতুন কিছু নয়। ছোট বোনটাকে বিবাহে রাজি করাতে রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ছুটেছে তার তবুও সে নারাজ। নিজের সফেদ হিজাবটা আরেকটু টেনে নেয় কপালের সামনে। কালো ঢিলেঢালা গাউনের উপরে বিশাল আকারের সফেদ হিজাব পরিধান করেছে সে। চুলগুলো যেন দেখা না যেতে পারে তাই সেটা টেনে রাখা হয়েছে কপালের অর্ধভাগ অব্দি। শুধুমাত্র মুখমণ্ডলটা দৃশ্যমান রয়েছে। এটাই সাম্রাজ্যের সকলের জন্য নির্ধারিত পোশাক, যা যেকোনো নারীর পুরো শরীর ঢেকে রাখতে সক্ষম। তবে জোভিয়ার পোশাক-পরিচ্ছদ সকলের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। সে নিজের মুখমণ্ডলের উপর সবসময় পাতলা পর্দা টেনে রাখে। এতে করে তার চেহারাটুকুও দৃশ্যমান হয় না অন্যদের নিকট। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোনো এক কাঠ ফাটা দুপুরে নদীর পানিতে মুখ পরিষ্কার করার জন্য মুখের উপর টাঙানো পর্দাটা সরাতেই সে নজরে পড়ে যায় এই বণিকের। তারপর থেকে সে নদীতে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে।

ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে মৃদুস্বরে ধমকে উঠতে চাইল জারনাব, “অবুঝের মত কথা বলোনা জোভিয়া। তোমার বয়স চব্বিশ পেরিয়েছে আর কতো? সঠিক সময়েই তো আমার বিবাহ হয়েছিল কিন্তু,,,,,,,,,,,,,,,” কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই গলা শক্ত করে থেমে গেল জারনাব। কন্ঠনালী আটকে গিয়ে যেন ভীষণরকম বিরোধীতা করছে। বাক্যগুলো উচ্চারণ করার খুব একটা ইচ্ছাও নেই তার।

সে তার এই ছোট্ট পরিবারেই বাকি জীবনটা কাটাতে চায়। এই দোকানটা তার আব্বাজানের তবে সে এখন এতোটাই অসুস্থ যে তার পক্ষে এটার দেখাশোনা করা একেবারেই সম্ভব নয়। তাদের কোনো ভাই না থাকায় দু’বোনই কাঁধে তুলে নিয়েছে এই দায়িত্ব। দোকানটাই তো তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র সম্বল। তার ভাবনার মাঝেই জোভিয়া বলল, “কেন অতীতকে এতো প্রাধান্য দিচ্ছো বুবু? স্বামীহারা নারী কি আর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না বুবু? এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা তো নেই, তবে কেন? তোমার পুরো জীবনটা এখনো পড়ে আছে। আব্বাজান তোমাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত।”

“আমাদের সুলতানকে দেখেছো জোভিয়া? একজন সুলতানের উপর আদৌ কোনো নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ ঘটে? বরং একজন সুলতানের জীবনে অকাধিক বেগম আগমনের রীতি চলে আসছে বহুকাল ধরে। তবুও দেখো, সে কতোটা নির্জীব এ ব্যাপারে। বেগমের মৃত্যুর দু’বছর পরে এসেও নতুন করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে নারাজ সে। তোমার কি মনে হয় তার কারন শুধুমাত্র শেহজাদি ‘তোহফা’?”

তাদের কথপোকথনের মাঝেই দোকানে প্রবেশ করে একজন প্রবীণ। তার হাতে একটি ঘুণ ধরা কাঠের লাঠি, যেটা এখন তার দাঁড়িয়ে থাকার একমাত্র অবলম্বন। লাঠি ভর দিয়েও দাঁড়ানো কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে তার জন্য। বার্ধক্য যেন তাকে আষ্টে পিষ্টে জাপটে ধরেছে। সে অপেক্ষাকৃত উচ্চাস্বরে ডাকতে থাকে, “জারনাব, জোভিয়া, আমার আম্মাজানগুলো কী করছে? নিশ্চয়ই আব্বাজানকে খুব বকা দেওয়া হচ্ছে?”

আব্বাজানের কন্ঠ পেয়ে দৌড়ে আসে দু’বোন। হাসিমুখে সমস্বরে বলল, “আস-সালামু আলাইকুম আব্বাজান।”

“ওয়া আলাইকুমুস-সালাম। তোমরা গৃহে গিয়ে আহার করে নাও। আমি দোকান দেখাশোনা করছি সে সময়টুকু।”

“আপনি গৃহে চলুন আব্বাজান। আপনার শরীর ভালো নেই তাছাড়া দোকান এটুকু সময় বন্ধ থাকলে খুব বেশি লোকসান হবে না।” বলল জোভিয়া। জারনাব ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো তাতে।

মেয়েদের কথায় মুচকি হাসল আব্দুর রহমান। তাকে দু’দিক দিয়ে আগলে ধরেছে জারনাব ও জোভিয়া। কতটা সুশ্রী এবং সুশীল তার কন্যারা অথচ সে এমনই এক ব্যর্থ পিতা যে কন্যাদের মাথার উপর বোঝা হয়ে থাকতে হচ্ছে। একটাই আফসোস তাদের একটা গতি করে দিয়ে মরতে পারছে না সে। তবে উপরওয়ালার উপর তার পূর্ণ ভরসা, সেই কোনো ব্যবস্থা ঠিকই করে দেবে। জারনাবের পঁচিশ বছর চলছে তবুও সে বিবাহের নাম নিচ্ছে না। অন্যদিকে ছোট কন্যা জোভিয়ার বয়সও চব্বিশ পেরিয়েছে, এখনো সে বিবাহের কথা শুনতে নারাজ। অবশ্য বড় কন্যা জারনাবের জীবনে বিবাহিতার তকমা একবার লেগেছিল বটে…………..

আব্বাজানকে আনমনে ভাবতে দেখে নিরাশ হলো জোভিয়া। সে ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে আব্বাজান তাদেরকে নিয়েই চিন্তিত। বুবুকে ইশারা করতেই সে বুঝে যায় কী করতে হবে। মুহুর্তেই ডেকে উঠলো জারনাব, “আব্বাজান, চলুন। পেটে তো ইঁদুর বৈঠক বসিয়ে দিয়েছে।”

অমনি ব্যস্ত হয়ে পড়ে পড়লেন আব্দুর রহমান। লাঠি ভর দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আগাতে আগাতে বললেন, “হ্যাঁ আম্মাজান, চলো। অনেক সময় না খেয়ে আছো তোমরা।”

নদীর তীর দিয়ে হেঁটে চলেছে তারা। আর কিছুটা এগোলেই তাদের গৃহ, বাজার পেরোতে যতটুকু দেরি আর কী। বিশাল ‘শাহ’ নদীর তীর বেয়ে তৈরি হয়েছে এই বাজার। বাজারটির নাম ‘নূর’ বাজার। বাজারটির নাম যতটা সুন্দর, ঠিক ততটাই সুন্দর বাজারের তৈরি হওয়া প্রত্যেকটা দোকান। নদীর তীরে বেশ খানিকটা জায়গা জুরে বিস্তৃত এই বাজার। ছোটো-ছোটো দোকানগুলোর উপরে সযত্নে টাঙানো হয়েছে ভিন্ন-ভিন্ন রঙের ছাউনি। পুরুষ দোকানির পাশাপাশি মেয়ে দোকানিরাও নিজেদের কর্মে কোনো সমঝোতা করতে রাজি নয়। তাদের মার্জিত পোশাক, বিনয়ী আচরন সমস্ত ক্রেতাদের হৃদয় কেড়েছে।

‘শাহ’ নদীর ইতিকথাও নেহাতই কম নয়। পার্শ সাম্রাজ্যের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধের পর এই নদী হাসিল করেছিল সাবেক সুলতান ‘শাহজিল শাহ’। তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে নদীটির অথচ হাজার সৈনিকের রক্তে রঞ্জিত এই নদী। তুচ্ছ সেই সৈনিকদের কথা কেইবা মনে রাখবে? ‘রামান’ সাম্রাজ্যের প্রতিটি প্রাণী হয়তো সাক্ষী দেবে এই নদী জয়ের কৃতিত্ব শুধুই সুলতানের। সৈনিকগুলো অচিরেই বিলীন হয়েছে এই নদীর বুকে। তাদের অস্তিত্ব শুধু মানুষের গল্প আর আপনজনদের দীর্ঘশ্বাসেই সীমাবদ্ধ।

সুলতান ‘শাহজিল শাহ’ এর সময়কাল ফুরিয়েছে কয়েক বর্ষ পূর্বেই। বর্তমান সুলতান তার একমাত্র পুত্র ‘সুলতান শাহজাইন’। সুলতান ‘শাহজিল শাহ’ যুদ্ধ কলাকৌশলে অধিক পারদর্শী হলেও শাসক হিসেবে ছিলেন খুবই উদাসীন। যার দরুন তার সময়কালে রামান সাম্রাজ্যের তেমন কোনো উন্নয়ন পরিলিক্ষত হয় না। এতোবড় সাম্রাজ্যের শাসক হওয়ায় তার অহংকারও নেহাত-ই কম ছিল না অথচ তার পুত্র ঠিক যেন তার বিপরীত মেরুর। সুলতান হিসেবে তার কোনো তুলনা চলে না। যেমন সুদর্শন তার রূপ তেমন কঠোর তার বিচারকার্য। সাম্রাজ্যের প্রতিটা কোনায় কোনায় তার উন্নয়নের ছোঁয়া। মাত্র ছ’বছরে রামান সাম্রাজ্যের রূপই যেন বদলে গেছে তার পরিচালনায়। তার উদার মানসিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, নির্ভুল শাসনকার্য এবং তীক্ষ্ম বুদ্ধির কারনে আশপাশের সাম্রাজ্যেও তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। সুনামের সাথে সাথে বেড়ে উঠেছে শত্রুর সংখ্যাও। চৌত্রিশ বছর বয়সি এই সুলতান নিজের সবটুকু উজার করে দিয়েছে এই সাম্রাজ্যকে। শুধু পারেনি পুরাতন সেই স্বৈরাচারী নিয়মকানুন ভেঙে তাতে নতুনত্ব আনতে। তার সাম্রাজ্যের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের সাথে যেন মিশে গেছে এসব স্বৈরাচারী নিয়মকানুন। তারা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারছে না এই নিয়ম তাদের উপর কতটা ভারি পড়ে।

তবে এমন নিষ্ঠাবান সুলতান হওয়া স্বত্বেও সুখ নেই তার ব্যক্তিগত জীবনে। প্রিয় বেগমকে হারিয়েছে সে চিরজীবনের জন্য। ছ’বছর পূর্বে সুলতান হয়েই সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় উত্তরীয় সাম্রাজ্যের সুলতানের কন্যা শেহজাদি ‘এলিজার’ সঙ্গে। চার বছরের দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার কোনো ত্রুটি ছিল না তাদের অথচ একটি ঝড়েই যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে তাদের সুখময় বৈবাহিক জীবন। তাদের চার বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। ছোট্ট সেই শেহজাদি মাত্র দু’বছর বয়সেই হারিয়েছে নিজের আম্মাজানকে। আজ থেকে ঠিক দুই বছর পূর্বেই একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে সুলতানের বেগম আর এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। শক্তিশালী একজন পুরুষ হয়েও সেদিন চিৎকার করে কেঁদেছিল সুলতান। তার কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল সমগ্র সাম্রাজ্য। সকলে হতবাক নয়নে দেখেছিল একজন সুলতানের আহাজারি। এর আগে কখনো কেউ এমন আশ্চর্যজনক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে বলে মনে হয়না। ছোট্ট শেহজাদি আম্মাজানকে না পেয়ে হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে কাঁদতে অসাড় হয়েছিল। হাজারটা মুখের ভীরে রোজরোজ নিজের আম্মাজানকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় বুঝে নিয়েছে তার আম্মা আর ফিরবে না। প্রিয়জনের মৃত্যু বুঝি এতোটাই যন্ত্রণাদায়ক হয়? প্রিয় বেগমকে হারিয়ে ক্ষণিকের জন্য সুলতান ভেঙে পড়লেও সাম্রাজ্য রক্ষার্থে পুনরায় শক্ত হাতে হাল ধরতে হয়েছে তাকে। তবুও যেন একটি ত্রুটি রয়েই গিয়েছে। সেটা হলো সম্রাজ্ঞী, হ্যাঁ সম্রাজ্ঞীর, পুরো রাজ্যে এই একটি জিনিসেরই অভাব রয়েছে।
__________________________

সুলতানের মহলের বিশালাকার একটি কক্ষে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। মজবুত কাঠের টেবিলটাতে সুলতানের পরিবারের সকলেই উপস্থিত রয়েছে। সুলতান শাহজাইন এর পিতা শাহজিল সুলতান, মাতা ওয়াসিফা সুলতান, একমাত্র ছোট বোন শেহজাদি তানহা এবং ছোট্ট কন্যা শেহজাদি তোহফা। টেবিলের শেষ দুই প্রান্তে ফাঁকা রয়েছে দু’টি রাজকীয় চেয়ার। যার মধ্যে একটি সুলতানের জন্য নির্ধারিত অন্যটি তার বেগমের জন্য। গত দুইটি বছর ধরেই তার মধ্যে একটি চেয়ার খালিই পড়ে থাকে। তার মালকিন যে হারিয়ে গিয়েছে বহুদূরে। খাবার সামনে করে সকলে অপেক্ষা করছে সুলতানের জন্য। শেহজাদি তোহফা তার ছোট ছোট হাতগুলো দিয়ে নিজের হিজাব টেনেটুনে ঠিক করছে যেন খাবারের মাঝে তা কোনোভাবে সরে না যায়। চার বছর বয়সী শিশুটিও কত নিখুঁত সতর্কতা অবলম্বন করে নিজের হিজাবের ব্যপারে তা কল্পনারও বাইরে। বরাবরের মতোই সকলে নিশ্চুপ রয়েছে। খাবার সময় কথা বলার অনুমতি নেই এই মহলে। শুধুমাত্র সুলতানই এই নিয়মের বাইরে রয়েছে। সকলের নিস্তব্ধতা আরো বাড়িয়ে দিয়ে দ্বাররক্ষী গলা ছেড়ে বলে ওঠে, “মহামান্য সুলতান শাহজাইন শাহ।”

তৎক্ষণাৎ কক্ষে প্রবেশ করে সুলতান। তার সাথে থাকা সহকারীরা দরজার বাইরেই অবস্থান করে। সকলের খাবার পরিবেশন করে দাসীগুলোও মাথা নিচু করে ত্যাগ করে সেই কক্ষ। খাবারের সময় বাইরের কেউ থাকুক তা পছন্দ নয় সুলতানের।

নিজের জন্য নির্ধারিত চেয়ারটাতে নিঃশব্দে বসে পড়ে সুলতান শাহজাইন। টেবিলের অপর প্রান্তের ফাঁকা চেয়ারটার দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। শান্ত দৃষ্টিতে সকলের দিকে চেয়ে একবার দেখে নিয়ে তার সবচেয়ে কাছের চেয়ারটায় বসে থাকা ছোট্ট তোহফার দিকে দৃষ্টিপাত করল। সে তার ছোট ছোট হাতগুলো বাড়িয়ে খাবার ছোঁয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। মুচকি হেসে তাকে কোলে তুলে নিলো সুলতান। এতবড় সাম্রাজ্যে এই একজনই আছে যে কি-না কিছু না করেও সুলতানের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম।

সুলতান তার ছোট ছোট আঙ্গুলগুলো হাতের মুঠোয় পুরে ক্ষীণ স্বরে ডাকল, “আম্মা?”

মাথা উঠিয়ে ড্যাবড্যাব করে তার মুখের পানে তাকালো শেহজাদি তোহফা। দু’হাত বাড়িয়ে তার দাঁড়িগুলো টেনে দিয়ে শব্দহীনভাবে হেসে উঠল সে। মেয়ের হাসিতে মৃদু হাসলেন সুলতান। বেগম থাকাকালীন তোহফার মুখ থেকে তবুও হাসি-কান্নার স্বল্প শব্দ শ্রবণগোচর হতো। পরে ধীরে ধীরে সে কিছুটা বড় হলো কিন্তু হারিয়ে গেল তার কন্ঠ, তার শব্দ। দূর দূরান্তের অনেক কবিরাজ, বৈদ্য দেখানোর পরেও ফিরে আসেনি তার গলার আওয়াজ। শেষে একপ্রকার বাধ্য হয়েই হাল ছাড়তে হয়েছে তাকে। কন্যার এই শব্দহীন হাসিতেও অসীম সুখ খুঁজে পান তিনি।

শেহজাদি তোহফা খাবারের দিকে হাত বাড়াতেই তা আলগোছে সরিয়ে নিলো সুলতান। নিজের হাতে খাবার তুলে ধরল তার ছোট্ট কন্যার মুখের কাছে। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে তাকে খাইয়ে, মুখ পরিষ্কার করে দিলো সে। অতঃপর তাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজের খাওয়া শুরু করল। এতোক্ষন টেবিলে উপস্থিত সবকটি প্রাণী অপেক্ষা করছিল এই সময়ের। সুলতান খাওয়া শুরু করতেই তারাও খাওয়া শুরু করলো।

খাবার শেষ করে সুলতান উঠে কক্ষের বাইরে যাওয়ার পরে সকলে যার যার মতো উঠে দাঁড়ায়। সকলে বেরিয়ে গেলেও থেকে যায় শেহজাদি তানহা ও ছোট্ট তোহফা। একজন দাসী এসে শেহজাদি তোহফাকে কোলে করে নিতে চাইলে বাঁধ সাধে শেহজাদি তানহা। গুরুগম্ভীর স্বরে বলল, “তোহফা আমার সঙ্গে যাবে। তুমি বাইরে গিয়ে দেখে এসো সৈনিক প্রধান কোথায় আছেন বর্তমানে।”

“কিন্তু সে তো সবসময় সুলতানের সঙ্গেই থাকেন।” হুট করে বলে বসলো দাসি।

শেহজাদি তানহা চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সে ছুটে যায় বাইরের দিকে। ইতিমধ্যে অন্যান্য দাসিরাও দ্বারের সম্মুখে ভিড় জমিয়েছে খাবারের স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের উদ্দেশ্যে।

সমস্ত দায়-দায়িত্ব শেষে নিজের কক্ষে বিশ্রামের জন্য এসেছে সুলতান। কক্ষের বাইরে যথারীতি দাঁড়িয়ে আছে সেবকগণ। সৈনিক প্রধান ‘আজমাইন মাহতাব’ সুলতানের সুরক্ষায় বর্তমানে তার প্রধান সহকারী হিসেবে নিযুক্ত আছেন। সে কক্ষের দ্বার টেনে দিয়ে দ্বারের বাইরে তলোয়ার হাতে সটান দাঁড়িয়ে থাকে। তার মতো সাহসী যোদ্ধা এই সাম্রাজ্যে হয়তো আর দুটো নেই। তার বীরত্বের পরিচয় মিলেছে বহুবার। সে যেন সুলতানের সম্মুখে কোনো সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের ন্যায়। সুলতানের প্রতিটি বিপদে সে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় সবার আগে।

রোজকার ন্যায় এই কক্ষের দ্বার বন্ধ থাকবে কিছু সময়ের জন্য। এতে বিচলিত হতে দেখা যায় না কাউকে। কিছুক্ষন পরে আপনা-আপনি খুলে যাবে এই দ্বার, সে ব্যাপারে বাইরে উপস্থিত প্রতিটি মানুষই জ্ঞাত। এ সময়টুকু সুলতান সম্পূর্ণ একাকী, নিজের মতো করে কাটান। এই সময়ে তাকে ডাকাডাকি করার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

কক্ষের বিশাল বিশাল আসবাবপত্রের মধ্যে মাথা নিচু করে বসে আছে এক কারুকার্য খচিত সিন্দুক। মাথা থেকে নরম কাপড়ের তৈরি অধিক মূল্যবান পাগরীটা খুলে রাখলো সুলতান। চাবি গলিয়ে সিন্দুক খুলে তার মধ্য থেকে বের করে আনলো একটি ছবির ফ্রেম। সামান্য একটি ছবির ফ্রেম তার নিকট এতোটাই মূল্য বহন করে যে সুলতান সেটাকে যত্ন করে সিন্দুকে লুকিয়ে রেখেছে এবং তা সকলের থেকে লুকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। ফ্রেমটিতে হিজাব পরিহিতা একজন হাস্যজ্জ্বল নারীর ছবি ফুটে উঠেছে। কী চমৎকার তার দুই নয়ন! মাথায় তার সম্রাজ্ঞীর তাজ। পরম আদরে ছবিটিতে হাত বুলালো সুলতান। এই ছবিটি তারই অঙ্কন করা। তার হাজারটা গুণাবলীর মাঝে এটাও একটি। বেগমের অলক্ষ্যে অনেক যত্ন করে এই ছবিটি অঙ্কন করেছিল সে। সময়ের স্বল্পতা এবং দায়িত্বের ভারে অনেকগুলো দিনে একটু একটু করে সম্পূর্ণ করেছিল এই ছবিটি। ভেবেছিল বেগমকে হটাৎ একদিন চমকে দেবে এটা দেখিয়ে। তবে সে কি আর জানতো, তার বেগম আরো বড় চমক রেখে দিয়েছে তার জন্য!

ছবিটিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই শক্তিশালী পুরুষটির দু’চোখ ভিজে উঠলো নোনা জলে। রাশভারি সুলতান নিজের বাহ্যিক আস্তরণ ভেঙে উদাস চোখে চেয়ে দেখে ছবিতে থাকা নারীটিকে। আচমকা ছবিটি সজোরে নিজের বক্ষে চেপে ধরে অস্পষ্ট স্বরে বলল, “কেন এমন হলো এলি? কেন আমাকে এই কঠিন যন্ত্রণায় ফেললে তুমি? তুমি কি জানো, একজন সুলতানের হৃদয় ভাঙার শাস্তি কতোটা কঠোর হয়?”

দু’চোখ বেয়ে গরিয়ে পড়া অশ্রু কণা মোছার প্রয়োজন মনে করলো না সে। সারাটাদিন এই অশ্রু কণাগুলোকে বয়ে বেড়াতে বেড়াতে বড্ড ক্লান্ত সে! পুনরায় ছবিটির দিকে চেয়ে ভাঙা গলায় বলল, “ছোট্ট শেহজাদিকে দুনিয়াতে এনে শখ করে তার নাম দিয়েছিলে তোহফা, যার অর্থ ‘উপহার’। মুচকি হেসে বলেছিলে এটা আমার দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার তোমার নিকট। আমার উপহার আমাকেই ফিরিয়ে দিয়ে কেন চলে গেলে তুমি? জানো, সে কিছুটা বড় হয়েছে, ছোট ছোট পায়ে চলতে শিখেছে। তার মুখে আব্বুজান ডাক শুনতে না পেয়েও দুঃখি নই আমি বরং এটা ভেবেই চিন্তিত যে, সে যদি হুট করে কোনোদিন বলে বসে, আমার আম্মাজান কোথায়? সেদিন কী উত্তর দেবো আমি বলতে পারো? কেন এই কঠিন পরীক্ষায় ফেললে আমাকে?”

রোজকার ন্যায় আজও কোনো উত্তর আসলো না তার প্রশ্নের। তার দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে যেন ছবিতে থাকা নারীটি। ছবিটির কথা বলার ক্ষমতা থাকলে হয়তো সে বহু আগেই সুলতানের কথার জবাব দিতো। কিন্তু ছবিটি যে নির্জীব, তার ক্ষমতা কোথায় সুলতানের কষ্ট লাঘব করার!

ধীরে সুস্থে ছবিতে আলতো চুম্বন করে সেটা পুনরায় সিন্দুকে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দিলো সুলতান। এই ছবিটির মূল্য তার নিকট আকাশসম। দু’চোখ মুছে নিজের মুখভঙ্গি পূর্বের ন্যায় কঠোর করে তোলে সে। পাগরীটা পুনরায় পড়ে নিয়ে দ্বার খুলে দিতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে আজমাইন মাহতাব। ইতিমধ্যে বন্দিশালার দিকে হাঁটতে শুরু করেছে সুলতান। তার সথে সাথে পা মেলাচ্ছে আজমাইন মাহতাব। সকলের চোখে সুলতানের এই কষ্ট ধরা না দিলেও সে ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে সুলতান ভালো নেই। চোখে-মুখে বিষন্নতা ফুটিয়ে শুধাল, “কেন রোজ রোজ নিজের কষ্টে নতুন করে প্রাণ ঢেলে তা তাজা করে তোলেন মহামান্য?”

শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো সুলতান। সুলতানের উদ্দেশ্যে এমন প্রশ্ন করার দুঃসাহস একমাত্র আজমাইন মাহতাবই দেখাতে পারে। সুলতান মুচকি হেসে বলল, “তুমি আমার বন্ধুর ন্যায় মাহতাব। তোমার কাছে বলতে দ্বিধা নেই, তাছাড়া তোমার থেকে নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখতে বারংবার-ই ব্যর্থ আমি। শোনো তবে, এই কষ্টের মাঝেও অসীম সুখ খুঁজে পাই আমি যা অন্য কোথাও পাই না।”

বরাবরের মতোই নিরাশ হতে হয় আজমাইন মাহতাবকে। ত্রিশ বছরের টগবগে যুবক সে অথচ সুলতানের নৈকট্য ছাড়া সবই যেন মূল্যহীন তার নিকট। যার ফলস্বরূপ সুলতানের নিকট সবসময়ই সে অধিক বিশ্বস্ত এবং ভরসার মানুষ। সুলতান পুনরায় বলে ওঠেন, “আজও ভোজনকক্ষে পাইনি তোমায় মাহতাব। এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারন কি জানাবে তুমি?”

মস্তক নুইয়ে নেয় আজমাইন মাহতাব। ক্ষীণ স্বরে বলল, “আমি সামান্য কর্মচারী হয়ে সেখানে কীভাবে থাকতে পারি মহামান্য? আপনি বললেও অন্যরা তা ভালো দৃষ্টিতে দেখবে না ”

কঠোর হয় সুলতানের দৃষ্টি। শক্ত কন্ঠে বললেন, “আমার মহলে কোথায় কী ঘটবে সেই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই অন্যদের নেওয়ার অধিকার নেই? আশা করি, আমার কথাটা রাখবে তুমি।”

আজমাইন মাহতাব উত্তর দেওয়ার মতো কোনো শব্দ সে খুঁজে পায় না নিজের শব্দভাণ্ডারে। কথা বদলাতেই হয়তো নিচু স্বরে বলল, “আপনি অনুমতি দিলে আমি কিছু বলতে চাই?”

পা থেমে যায় সুলতানের। সে খানিক অবাক কন্ঠে শুধাল, “তোমার আবার আমার নিকট অনুমতির প্রয়োজন পড়লো কবে থেকে মাহতাব? নির্দ্বিধায় বলতে পারো তুমি।”

“মহলে আপনার জন্য নতুন বেগম আনার আলোচনা চলছে। গুপ্তভাবে খবর পেয়েছি আমি।”

শক্ত হয়ে উঠলো সুলতানের মুখভঙ্গি। বন্দিশালার সম্মুখে সটান দাঁড়িয়ে রূঢ় কন্ঠে বলল, “তা কখনোই সম্ভব নয় মাহতাব। আম্মা-আব্বাকে এ কথা জানিয়ে দিও। এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা চাই না আমি।”

তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে টু শব্দটাও করলো না আজমাইন মাহতাব। যেন সে জানতো এমনই উত্তর আসবে। বন্দিশালার রক্ষীর দিকে ইশারা করতেই সে নীরবে বন্দিশালার দ্বার খুলে দিলো। কারাগারের সামনে ঝোলানো চাবুকটা হাতে নিয়ে নীরবে প্রবেশ করল সুলতান। মেঝেতে জড়সড় হয়ে মাটি আকড়ে শুয়ে আছে কেউ। তার শরীরের অধিকাংশ স্থানে আঘাতের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। দ্বার খোলার শব্দ পেয়ে সে মাথা উঠিয়ে তাকালো সুলতানের দিকে। সুলতানের হাতের বিশাল চাবুকও তাকে সামান্যতম বিচলিত করতে পারলো না বোধহয়। যেন সে আগে থেকেই জ্ঞাত যে এখন কী ঘটবে তার সাথে।

চলবে……….