সম্রাজ্ঞী পর্ব-৬+৭

0
102

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_6

বিকেলের মৃদু বাতাসে যেন রমজানের তীব্র সুগন্ধি মিশে রয়েছে! গরমের উষ্ণতা পেয়ে গাছপালাগুলো সেজে উঠেছে নতুন উদ্যমে। সামান্যতম বাতাসে হেলে পড়ছে নতুন গজিয়ে ওঠা পাতাগুলো। বারান্দার এক পাশে স্বল্প কিছু জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে রান্নার ঘর। এই বিকেলে ভ্যাপসা গরমের মাঝে উনুন ধরিয়েছে জারনাব। শেষ বেলায় এসে ঘেমে নেয়ে একাকার হতে হচ্ছে। সে কাঠের লাকড়ি ধরিয়ে দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে পাতিলের দিকে তাকালো। পাতিল ভর্তি পানি টগবগিয়ে ফুটছে। মোটা কাপড় দিয়ে ধরে পাতিলটা নামিয়ে নিলো সে। পাত্র ভরে পানি নিয়ে ছুটলো আব্বাজানের ঘরের দিকে। আব্বার পায়ের ক্ষতটা রোজ নিয়ম করে গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে সেখানে ওষুধ লাগাতে হয়। দু’বছর হয়ে গেছে এই ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে অথচ এখনো যেন তাজা লাগে। হাঁটুর ঠিক নিচে বিশাল এক গর্ত। যেন মোটা কিছু খুব শক্তি সহকারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে। দু’বছর পূর্বে কোনো এক দুর্ঘটনায় এই ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তবে আব্বাজান সবসময় এই বিষয়টি এড়িয়েই চলেন। তাই আর কখনো জোর দিয়ে জানতে চাওয়া হয়নি ক্ষতের কারন। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল জোভিয়া আর আব্বাজান কোনো জরুরি আলাপে ব্যস্ত। জরুরি এজন্যই কারন তাদের মুখভঙ্গি খুব গুরুতর। গলার স্বর অত্যন্ত ধীর। এতটাই ধীর যে দরজা পর্যন্ত সে কথা এসে পৌছাচ্ছে না। আরোও অবাক করা বিষয় হলো তাকে দেখতেই তারা দু’জন কথা বলা বন্ধ করে দিল। একেবারে নীরব রইল কিছুক্ষণ। সে ভ্রু কুচকে তাকাতেই জোভিয়া এগিয়ে এলো হাসিমুখে। পানির পাত্রটা নিয়ে বিছানার একপাশে রাখতে রাখতে বলল, “এভাবে চেয়ে আছো কেন? তোমার বিবাহের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে না যে এমন সন্দেহপ্রবন দৃষ্টি নিক্ষেপ করছো।”

হুট করে বিবাহের কথা তোলাতে চটলো জারনাব। হনহন করে আব্বাজানের পাশে গিয়ে বসে বলল, “অবশ্যই সন্দেহ করবো। আমি একটু সরেছি কী আর দু’জন ফিসফিসানি শুরু করে দিয়েছো। কেন রে? আমি কি তোমাদের শত্রু?”

আচমকা তার পাশে সেঁটে বসলো জোভিয়া। তার মুখের দিকে এগিয়ে এসে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “তাহলে প্রমাণ দাও তুমি আমাদের শত্রু নও?”

চমকাল জারনাব। আমতা আমতা করে বলল, “এএসসব কোন ধরনের কথা? আআমি কেন তোমাদের শত্রু হতে যাবো? কীসের প্রমাণ?”

কিঞ্চিত হাসলো জোভিয়া। নরম কাপড় গরম পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে আব্বাজানের পায়ের কাছে বসে পরিষ্কার করতে থাকলো তার ক্ষতস্থান। কাজের ফাঁকে জারনাবের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “সেটাই তো। তুমি যে আমাদের শত্রু নও তার প্রমাণ দাও।”

এবার বোধহয় ক্ষেপলো জারনাব। রাগান্বিত স্বরে বলল, “এখন আমাকে কি-না প্রমাণ দিতে হবে! ঠিক আছে, বলো তবে কী প্রমাণ?”

চট করে ঘুরে বসলো জোভিয়া। ভ্রু কুচকে বলল, “সত্যিই দেবে তো প্রমাণ?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, দেবো।” রাগান্বিত স্বর জারনাবের।

“তাহলে দোকানে যাবার অনুমতি দাও প্রমাণ হিসেবে।”

অতিশয় রাগান্বিত হলো জারনাব। মেয়েটা কি অনুভব করতে পারছে নিজের বিপদ! তবুও সকাল থেকে একই বায়না করে চলেছে। যায় হয়ে যাক না কেন সে কিছুতেই দোকান খুলতে দেবে না। জিদানের মতো মানুষের তারা পেরে উঠবে না। আগত ঝড় কিছুদিন স্থগিত থাক। এতে যদি জিদানের রাগ কিছুটা কমে। এ সময় গৃহ ছেড়ে বেরোনো খুবই বিপজ্জনক। বিশেষ করে দোকান খোলা তো যাবেই না। সব ভাবনা ফেলে সে হনহনিয়ে ত্যাগ করলো এই কামরা। নিজ কামরায় গিয়ে জানালার কপাট খুলে দিয়ে চেয়ে রইল অদূরে। জানালা দিয়ে মৃদু বাতাস এসে নাড়িয়ে দিচ্ছে তার হিজাবের বারতি অংশ। তাদের গৃহের আশেপাশে স্বল্প দূরত্বের মাঝে কোনো বাড়ি না থাকায় চারপাশটা বেশ নির্জন। জানালার বাইরে যতদূর দৃষ্টি পৌঁছায় শুধুই শূন্য উদ্যান। উদ্যানের কোনা কোনা দিয়ে বাহারি রকম গাছগাছালি দিয়ে ঠাসা। সুলতান শাহজাইনের উদ্যেগে পুরো সাম্রাজ্যের খালি জায়গাগুলোতে বিভিন্ন রকম গাছপালা এনে লাগানো হয়েছে। সে অবশ্য শুনেছে এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বিরাট রকম প্রকৃতি প্রেমি ছিলেন। তাই এই সাম্রাজ্যে পরিবেশ বান্ধব কোনো কিছুতেই কোনো বাঁধা নেই। তার মনের একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিল বেগমকে একবার স্বচক্ষে দেখার। তবে আফসোস! তার সে ইচ্ছা আর পুরণ হয়নি। বেগমের মৃত্যুর সংবাদে সে খানিক দুঃখ পেয়েছিল বটে!

একাধিক ঘোড়ার খুড়ের শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হলো তার। সচকিত হয়ে অদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেল সাত থেকে আটটা ঘোড়া পিঠ বোঝাই সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে আসছে তাদের গৃহের দিকে। ঘোড়ার আরোহীদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে আর বুঝতে বাকি রইল না তারা সুলতানের সেবক। প্রত্যেকের কোমরের পাশ দিয়ে ঝোলানো রয়েছে বিশাল তরবারি। মহল থেকে আসছে তারা। কিন্তু কেন? সে ভ্রু কুঞ্চিত করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সেদিকে। ঘোড়াগুলো তাদের গৃহের পাশে আসতেই ব্যস্ত হাতে জানালার কপাট এঁটে দিল সে। ঘুরে দাঁড়ালো দ্বারের দিকে।

দ্রুত বারান্দার সামনে আসতেই দেখতে পেল জোভিয়া ইতিমধ্যে বেরিয়ে এসেছে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে শব্দটা। সে গলা খাকারি দিয়ে বলল, “মহল থেকে কয়েকজন সেবক আসছে আমাদের গৃহের দিকে।”

তারই মতো অবাক হলো জোভিয়া। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে শুধাল, “কিন্তু কেন? তাদের আবার কী কাজ গরিবের গৃহে? শান্তিতে দু’দন্ড থাকতে দেবে না নাকি? আজব! ঘোড়ার খুড়ের শব্দে কান-মাথা তো গেল একেবারে।”

তার কথাতে বিরক্ত হলো জারনাব। চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকালো বোনের দিকে এই মেয়ের শুধু বাজে কথা সবসময়। কোথায় মহল থেকে সেবকগন আসছে দেখে উত্তেজিত হবে তা না বিরক্ত হচ্ছে এই মহামানবী! সে কর্কশ কন্ঠে কিছু বলার পূর্বেই আচমকা জোভিয়া বলে উঠলো, “সুলতানের পক্ষ থেকে রোজার বাজার দিচ্ছে বোধহয় সবাইকে।”

“আন্দাজে!” ঠোঁট উল্টে বলল জারনাব।

কপাল কুচকে তাকালো জোভিয়া। হনহনিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে করতে উচ্চস্বরে বলল, “আন্দাজে না। দেখে নিও তুমি।”

ততক্ষণে ঘোড়ার খুড়ের শব্দ থেমে গিয়েছে তাদের গৃহের সামনে এসে। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ উচ্চাস্বরে ডেকে উঠলো, “গৃহে কেউ আছেন? আমরা সুলতানের তরফ থেকে এসেছি।”

হিজাব ঠিকঠাক করে দ্রুত ফটকের দিকে এগিয়ে গেল জারনাব। কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়িয়েছে তারা। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মুখের ঘাম পরিষ্কার করছেন অতিরিক্ত বস্ত্র দিয়ে। ঘেমে ভিজে গেছে তাদের বস্ত্র। পাংশুটে চেহারা। গরমের মাত্রা অতিরিক্ত যার কারনে সবাইকেই বেশ ক্লান্ত লাগছে। তাকে দেখতেই একজন সেবক মাঝারি আকারের একটা ঝুড়ি হাতে এগিয়ে এলো তার দিকে। ঝুড়িখানার উপরে সুন্দর সোনালি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ক্লান্ত স্বরে বলল, “আস-সালামু আলাইকুম। মহামান্য সুলতান রোজার সামগ্রী পাঠিয়েছেন তার প্রজাদের জন্য। দয়া করে গ্রহণ করুন।”

চমকাল জারনাব। তারমানে জোভিয়ার কথাই সঠিক। সে কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে ঝুড়িখানা ধরে বলল, “ওয়া আলাইকুম-সালাম। ধন্যবাদ আপনাদের। সুলতানকে অবশ্যই রমজান মোবারক জানাবেন আমাদের তরফ থেকে।”

“অবশ্যই।”

“আপনাদের দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। গরিবের গৃহ থেকে কি একটু পানি পান করবেন?” শুধাল জারনাব।

এবার অন্যান্য সেবকগুলোও এগিয়ে এলো। তাদের মধ্য হতে একজন শুকনো গলায় বলল, “সত্যিই বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। একটু পানি যদি পেতাম তাহলে গলাটা ঠান্ডা হতো।”

“কেন নয়? অনুগ্রহ করে একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুনি পানি নিয়ে আসছি।” সে ঝুড়ি হাতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো বাড়ির ভেতরে। ঝুড়িখানা বড্ড ভারি। এটা নিয়ে বেশি জোরে হাঁটতেও পারছে না সে। কোনোমতে বারান্দায় পৌঁছে ঝুড়িখানা রেখে দৌড়ে গেল রান্নার ঘরের দিকে। তাড়াহুড়ো করে কলসি সমেত কোমরে তুলে নিলো সে। পানির পাত্রটা কলসির উপর উপুড় করে নিয়ে পুনরায় ছুটলো ফটকের দিকে। ফটকের সামনে কলসিটা রাখতেই আর কিছু করতে হলো না তার। সেবকগন নিজ থেকেই পাত্র নিয়ে পানি ভরে ভরে খেতে শুরু করলো। একে একে সকলের তেষ্টা মিটে গেলে তবেই থামলো তারা। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে পানির পাত্রটা কলসির উপর রাখতে রাখতে বলল, “শান্তি পেলাম। পানিটুকু বড্ড প্রয়োজন ছিল। ধন্যবাদ আপনাকে।”

স্বল্প পরিসরে ঠোঁটদুটো প্রসারিত করলো জারনাব। সেবকগন ক্লান্ত চেহারায় পুনরায় উঠে বসলো ঘোড়ার উপর। তীব্র গরম সয়ে নিয়ে ঘোড়া তাড়িয়ে ছুটে যায় সাম্রাজ্যের অন্য পাশে। আজকেই রমজানের চাঁদ দেখা যেতে পারে। এমনটাই ধারনা করেছেন মহলের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তাই আজকের মধ্যেই সকলের ঘরে ঘরে রমজানের সামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে। সবাইকে ভালো রাখতে হলে তাদের এটুকু কষ্ট তো সইতেই হবে।

তোহফাকে কোলে করে নিজ কামরার পালঙ্কে বসে আছেন সুলতান শাহজাইন। সম্মুখে স্থির চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে আজমাইন মাহতাব। চাঁদ দেখার প্রস্তুতি চলছে মহলে। তোহফা অস্থির হয়ে উঠেছিল চাঁদ দেখবে বলে তাই সুলতান তাকে নিজের সঙ্গে রেখেছেন। তবে এখানেও সে চুপ নেই। সুলতানের দীঘল কালো খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো ছুয়ে দিচ্ছে নিজের ছোট ছোট হাতে। আবার কখনো দাঁড়িতে টান দিয়ে মাহতাবের দিকে চেয়ে হেসে উঠছে শব্দহীনভাবে। তার ছোট ছোট দাঁতগুলোর নজর কাড়া হাসিতে হাসছে মাহতাবও। এবার যেন সাহস বেড়ে গেল তার। হাত বাড়িয়ে মাহতাবের তলোয়ার ছুঁতে গেলেই তাকে টেনে সরিয়ে নিলেন সুলতান। চোখ রাঙিয়ে বললেন, “আহ! আম্মা, দুষ্টু হয়ে যাচ্ছেন আপনি আপনার আম্মাজানের মতো। মাহতাব চাচ্চু কিন্তু ভীষণ রেগে যাবেন তার তলোয়ারে হাত দিলে।”

আগ্রহী নয়নে চাইল তোহফা। সুলতান পুনরায় বললেন, “তলোয়ার ধরলে মাহতাব চাচ্চু তাকে খুব মারে।”

এবার চোখ-মুখ কুচকে নিল তোহফা। মাহতাবের দিকে চেয়ে আচমকা থাবা মেরে বসলো তার ছোট্ট হাত দিয়ে। ব্যথা লাগেনি তবে হঠাৎ এমন কাজে অবাক হয়েছে বটে মাহতাব। সাথে সুলতানও বেশ চমকেছেন। মাহতাবের দিক চেয়ে হতবাক স্বরে বললেন, “আমার আম্মা তো দেখি এখনি জ্বলে উঠেছে মাহতাব। আর আম্মাজান কি-না ভবিষ্যত সুলতান নিয়ে চিন্তিত!”

শব্দ করে হেসে উঠলো মাহতাব। তোহফাকে কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই হাতে খামচি মেরে দিল সে। এতেই থেমে থাকলো না বরং তেড়ে আসলো তাকে কামড়ে দিতে। দ্রুত তাকে সরিয়ে নিলেন সুলতান। চোখদুটো বড়বড় করে বললেন, “একি! আম্মা, আপনার প্রশংসা করলাম বলে কি আপনি আরো জ্বলে উঠলেন? এমন করতে নেই। মাহতাব চাচ্চু অনেক ভালো। কাউকে মারেন না তিনি।”

কিছুক্ষণ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকলো তোহফা। অতঃপর হুট করে নড়েচড়ে উঠে হাতদুটো বাড়িয়ে দিল মাহতাবের উদ্দেশ্যে। মাহতাব মুচকি হেসে তাকে কোলে তুলে নিল। তার কোলে গিয়ে আদুরেভাবে মাথাটা এলিয়ে দিল তোহফা। আনমনে হাসলেন সুলতান। তার কন্যার চাল-চলন, আচার-ব্যবহার সবকিছুতেই তার আম্মাজানকে খুঁজে পাওয়া যায়। কখনো তেজস্বী, কখনো দুষ্টুমি তো আবার কখনো প্রিয় মানুষের সামনে সরলতার প্রতিক। এ যেন অবিকল এলিজা! রাগটাও মায়ের মতোই পেয়েছে। বেগমের কথা মনে পড়তেই এক অনাকাঙিক্ষত বিষাদ ফুটে উঠলো তার চোখজোড়াতে। কোনো বাক্য বিনিময় না করে নীরব থাকলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর গলা ঝেড়ে মাহতাবের উদ্দেশ্যে বললেন, “মাহতাব, বাইরে গিয়ে দেখে এসো তো প্রস্তুতি কতদূর। সন্ধ্যা তো প্রায় হয়েই এলো।”

তোহফাকে পালঙ্কে বসিয়ে ব্যস্ত হয়ে বাইরের দিকে ছুটলো মাহতাব। দ্বারের বাইরে এসে কড়া দৃষ্টিতে তাকালো পাহাড়ারত সৈনিকদের দিকে। যার অর্থ: সামলে রেখো এই দ্বার। চুল পরিমাণ গাফিলতিও নিতে পারে তোমার গর্দান।”

মহল থেকে মহলের প্রধান ফটকের সুদীর্ঘ দূরত্ব। মাঝখানের জায়গাটা নেহাত কম নয়। মূল্যবান পাথর খচিত রাজকীয় প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রশস্ত এক রাস্তা পেরিয়ে তবেই বিশালাকৃতির সুউচ্চ সফেদ রঙা মহল। প্রধান ফটক থেকে শুরু করে মহল পর্যন্ত সবসময় নিযুক্ত থাকে অগনিত সৈনিক। তবে আজ সে স্থান শূন্য। মহলের প্রধান দ্বারে দু’জন বলিষ্ঠদেহি সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্র হাতে। অন্যদিকে প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন সৈনিক। বাকিরা সকলে চাঁদ দেখার জন্য ছুটি পেয়েছে স্বল্প সময়ের জন্য। চাঁদ উঠতেই আবার তাদের ফিরতে হবে নিজ স্থানে। মহলে অজ্ঞাত ব্যক্তির প্রবেশের জন্য এটাই বোধহয় মোক্ষম সুযোগ। মাহতাব মহলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেখছে সকলের প্রস্তুতি। সুবিশাল একটি সোনার থালা পানি দিয়ে পূর্ণ করছে মাজেদা বানু। তাকে ঘিরে নতুন-পুরাতন সেবিকা মেয়েগুলোর সমাগম। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে আজমাইন মাহতাব। সব ঠিকঠাক দেখে সুলতানের কামরায় ফিরতে নিয়ে আবার কী ভেবে বাইরে এলো এক পাক। সৈনিকরা নিজ নিজ স্থানে অটল আছে দেখে পুনরায় পা বাড়ালো মহলে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে। হুট করে মস্তিষ্ক যেন কোনো সূক্ষ্ম বার্তা দিয়ে গেল। সচকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সে। হ্যাঁ, একজন অজ্ঞাত নারী প্রধান ফটকের ভেতরে অবস্থান করছে। যে কি-না হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে বাগানের দিকে। অজ্ঞাত এ কারনেই কারন তার পোশাক-পরিচ্ছদ মহলের বাসিন্দা বা সেবিকাদের মতো নয়। বোরখা-হিজাবের আড়ালে তার চেহারাখানি দৃষ্টিগোচর হলো না। তার উপর সে পেছনের দিকে থাকায় আন্দাজ করতে পারলো না নারীটির বয়স।

সামান্য এগিয়ে গলা খাঁড়া করে চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো মাহতাব, “এই মেয়ে, কে তুমি? দাঁড়াও বলছি ওখানেই।”

মুহুর্তেই থমকে দাঁড়ালো নারীটি। দু’দন্ড থেমে থেকে হুট করে দৌড়ে ছুটে গেল বাগানের দিকে। আচমকা এমন করায় হকচকিয়ে গেল মাহাতাব। সন্দেহ হলো তার।দৌড়ে তার পিছু নিতেই পেছন থেকে সেবকের আতঙ্কিত কন্ঠের চিৎকার শুনতে পেল, “খুন হয়েছে, খুন হয়েছে, মহলে খুন হয়েছে।”

চকিতে ফিরে তাকালো সে। আবার খুন! তাহলে কি এই নারীটিই সেই অজ্ঞাত খুনি! অজানা শত্রু! হন্তদন্ত হয়ে বাগানের দিকে ছুটে গিয়েও আর কোথাও পেল না নারীটিকে। শূন্য, বাগান একেবারে শূন্য। মৃদু হাওয়ায় দুলছে রজনীগন্ধার গাছগুলো। তীব্র সুগন্ধ ছড়িয়ে ঢেকে দিচ্ছে কারোর অস্তিত্ব।

চলবে……….

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_7

মহলের ভেতরে ঠিক মধ্যখানে গোলাকার ফাঁকা স্থান। উপরে বিশাল এক ঝাড়বাতি ঝুলছে দুলে দুলে। তার সাথে ঝুলছে শ’খানেক মোমবাতি। চতুর্দিকে হাজারো মূল্যবান আসবাবপত্র। ফাঁকা স্থানটা যেন মহলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছে! তবে বর্তমানে স্থানটা আর ফাঁকা নেই। ভরে উঠেছে সৈনিক, সেবক-সেবিকা আর মহলের বাসিন্দাদের সমাগমে। মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে তার উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে একটি লা’শ। লা’শটার বুকের উপর ক্ষতের ন্যায় একটি গর্ত। ক্ষতস্থানটা পরিপূর্ণ শুকনো রক্তে। কেউ বন্দিশালার ভেতরে ঢুকে খন্জর ঢুকিয়েছে তার বুকে। লাশ! হ্যাঁ, বর্তমানে তার পরিচয় শুধুই লাশ। জীবিত থাকাকালীন সে সুলতানের সৈনিক ছিল। তবে মৃ’ত্যুর দু’বছর পূর্ব থেকে তার পরিচয় ছিল একজন আসামি হিসেবে। বন্দিশালার একজন বন্দি হিসেবে। তাকে ঘিরেই সকলের জটলা। তবে শোক প্রকাশ করছে না কেউই। করবেই বা কেন? সে যে অপরাধী। বেগমের হ’ত্যায় অতঃপ্রতভাবে যুক্ত ছিল সে। বেগমকে মহল থেকে ডেকে নিয়ে ঐ দূর পাহাড় পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল সে নিজেই। বেগমের মৃ’ত্যুর পর বেশ কয়েকজনের সাক্ষীতে তাকে আটক করা হয়। বন্দিশালায় নিয়ে কঠিন অত্যাচারের পর সে নিজের অপরাধ স্বীকার করে তবে আজও পর্যন্ত সে বলেনি অপরাধের কারন বা উদ্দেশ্য। যেহেতু বেগমের মৃ’ত্যুতে তার কোনো লাভ-লোকসান ছিল না তাই ধারনা করা হয় যে সে অন্যকারোর কথাতে বা হুমকিতে পরে এসব করেছিল। রোজ রোজ বন্দিশালায় সব রকম অত্যা’চার সহ্য করার পরেও সে বলেনি উক্ত ব্যক্তির নাম। সুলতান তাকে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দিয়েও উগলাতে পারেনি সেই নাম। তাই তাকে মৃ’ত্যুদন্ড না দিয়ে দেওয়া হয়েছিল রোজ রোজ অজস্র চাবুকের আঘাতের সাজা। চাবুকের কঠিন আঘাত সইতে না পেরে সে আহত হতো, লুটিয়ে পড়তো মাটিতে, অসাড় হতো তার শরীর তবুও সে বলেনি সেই নাম। তার কীসের এতো ভয়? আজ সেই অপরাধীর মৃত্যু হয়েছে যে কি-না বেগমের মৃত্যুর একমাত্র সাক্ষী ছিল। শেষ আশাটাও আজ নিভে গেল! তবে কি কখনোই জানা যাবে না বেগমের মৃত্যুর রহস্য?

সম্মুখে গম্ভীর মুখে বসে আছেন সুলতান। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন ফয়েজের লাশের দিকে। ফয়েজের বাবা তার সাম্রাজ্যের একজন সাহসী সৈনিক ছিল। তাই ছোট থেকেই ফয়েজের সঙ্গে তার ওঠা-বসা। বেশ নিবিড় সম্পর্ক জন্মেছিল তাদের মাঝে। বড় হয়ে ফয়েজ তার বাবার মতোই একজন সৈনিক হলো। নিষ্ঠার সাথে নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে তার পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল সে। বহুবার সে তার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। কিন্তু শেষমেষ এমন একটা অপরাধের সাথে জড়িয়ে গেল যে তার হাজারটা ভালো কর্ম চাপা পড়ে গেল সেই অপরাধের ভারে! ক্ষমা করা গেল না তাকে। নিক্ষেপ করতে হলো কারাগারে। বেগমের চেয়ে দামী যে আর কিছুই ছিল না তার জীবনে। তাকেই তো কেড়ে নিয়েছে ফয়েজ। তাইতো সে নিজ হাতে বহুবার তাকে আঘাত করেছে মুখ খোলাবার উদ্দেশ্যে। অথচ আফসোস! সে নিজের জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে ভয় পেয়ে চলল যে কি-না তার জীবনটাকে অপরাধে মুড়ে দিয়েছিল! জানা নেই, সে সেচ্ছাই এই অপরাধ করেছিল নাকি বাধ্য হয়ে করেছিল। তবে তাকে ঠকিয়েছে সে। বিশ্বাসে আঘাত করেছে। আচ্ছা, আপন মানুষগুলোই কেন বারবার ঠকিয়ে দেয়? ফয়েজের উপর তার রাগের চেয়ে দুঃখের পরিমাণই বেশি ছিল। আজকে তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, “ওঠ ফয়েজ। দেখ তোর বিশ্বাসঘাতকতা আমাকে কীভাবে ভেঙে দিয়েছে। তোকে দিয়েছে মৃত্যুর মতো নিকৃষ্টতম উপহার। বল না আমার বেগম কী ক্ষতি করেছিল তোর? কেন তুই আমাকে এই যন্ত্রণায় ফেললি? তুই আমাকে নিশ্ব করে দিলি ফয়েজ, আমাকে নিশ্ব করে দিলি।”

তার আত্মচিৎকার নিজের গহীনেই থেকে গেল। বেরিয়ে এলো না কন্ঠ চিরে। আজমাইন মাহতাব চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই। সুলতানের চোখের ভাষা পড়তে আজ অক্ষম হলো সে। এগিয়ে গিয়ে আলাদা পর্দা দিয়ে ঢেকে দিল লাশটা। সাধারণত খু’নের লাশগুলো আগে পরিক্ষা করা হয় তারপর দাফন করা হয়। তাই সে গলা উচিয়ে সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলল, “লাশটা সরাও এখান থেকে। পরিক্ষার জন্য নিয়ে যাও।”

সৈনাকরা এসে লাশটা যেই না ছুঁয়েছে অমনি ভেসে এলো সুলতানের গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর, “গোসল করাও ফয়েজকে। দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করো। খবর দাও তার পিতাকে।”

খু’নের লাশ এভাবে পরিক্ষা ছাড়াই গোসল করাতে বলায় অবাক হলো মাহতাব। তবে বিপরীতে একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না সে। তারই মতো অবাক হয়েছে সৈনিকগুলোও। তারা লাশ ছুঁয়ে হতবাক নয়নে চেয়ে আছে সুলতানের দিকে। লক্ষ করল মাহতাব। কঠিন স্বরে বলল, “কী হলো? শুনতে পাওনি? সুলতান যা বললেন তাই করো। অতি দ্রুত তার পিতার নিকট বার্তা পৌঁছাও।”

দ্রুততার সাথে লাশ সরিয়ে ফেলা হলো। উঠে দাড়ালেন সুলতান। নজর বুলালো চারদিকে। ওয়াসিফা সুলতান, মারজিয়া সুলতান, শেহজাদি মাইরা। সুলতান ইহসান নিজ সাম্রাজ্যে ফিরে গিয়েছেন সেদিনের আলোচনার পরেই। বাকি সকলেই এখানে উপস্থিত আছে। এমনকি উদাসী সুলতান শাহজিল নিজেও। ফয়েজের পিতা তার সৈনিক হওয়ার দরুণ ফয়েজের উপর স্বল্প হলেও মায়া রয়েছে তার। তবে সেখানে উপস্থিত নেই শেহজাদি তানহা। সে নিজ কামরায় খিল এঁটেছে তোহফাকে সাথে নিয়ে। অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছে সে তোহফাকে এসব থেকে দূরে রাখতে চায়। তাই তাকে নিয়ে সরে পড়েছে সে। অথচ তার দৃষ্টির মাঝে ছিল না সামান্যতম শোকের ছায়া! এটা আজ নতুন নয়। কখনোই কারোর মৃত্যুতে শোকাহত হতে দেখা যায় না তাকে। এমনকি নিজের ভাইয়ের স্ত্রীর মৃত্যুর দিনেও তার দৃষ্টিতে ছিল না কোনো শোক, দুঃখ। সে ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং অনড়। সেদিন শুধু সে তোহফাকে কোলে তুলে অবাক হয়ে দেখে গিয়েছিল তার ভাইয়ের আহাজারি। সুলতানের যখন স্ত্রীর শোকে পাগলপ্রায় অবস্থা তখনও সে নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে শুধু দেখে গিয়েছিল সবকিছু। এ পর্যন্ত কারোর মৃত্যুই পরিবর্তন করতে পারেনি তার ভঙ্গিমা।

সকলে যখন ফয়েজকে শেষ গোসল করাতে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহুর্তে শোকের পাহাড় ভারী করে মহলে প্রবেশ করলো ফয়েজের পিতা ফুয়াদ হোসেন। ষাটোর্ধ মানুষটার মনোবল এখনো যেন পূর্বের ন্যায় শক্তিশালী। চোখদুটো পানিতে টলমল করছে অথচ তা গড়িয়ে মাটিতে পড়তে দিচ্ছে না সে। সবাইকে পেরিয়ে সুলতানের নিকট এগিয়ে এলো সে। কাতর দৃষ্টিতে তাকালো সুলতানের দিকে। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন সুলতান। এই চোখের হাহাকার সে সহ্য করতে পারবে না হয়তো। যেই মানুষটা তার সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে নিজের পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছে তার পুত্রের এমন বেহাল দশা তারই বন্দিশালা থেকে হয়েছে। এই গ্লানি মুছতে পারবে না সে। লোকটা বোধহয় পাথর রেখেছে নিজের বুকে। নাহলে কি আর একমাত্র পুত্রের এমন নির্মম মৃত্যুতে কেউ এভাবে শক্ত থাকতে পারে!
কয়েক মুহুর্ত পরেই ফয়েজের লাশ এনে শুইয়ে দেওয়া হলো খাটিয়ার উপর। কাফনের কাপড়ে আবৃত তার ক্ষতবিক্ষত দেহখানা। খাটিয়ার পাশে বসে পড়লেন ফুয়াদ হোসেন। আচমকা খাটিয়া ধরে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন লোকটা। সুলতানের দিকে চেয়ে করুন স্বরে বললেন, “আমার ফয়েজ এতোটা খারাপ ছিল না কখনোই। সে তো সুলতানের জন্য নিজের প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিল। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে আমার সরল-সহজ পুত্র।”

কিছুক্ষণ থামলেন তিনি। শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে দিলেন পুত্রের মুখটাতে। কালেমা পড়লেন তার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ে। অতঃপর আতঙ্কিত দৃষ্টিতে সুলতানের দিকে চেয়ে শুধালেন, “আমার ফয়েজকে কি আসামির কাতারে কবর দেওয়া হবে?”

বাক্যটা যেন ঝনঝন করে শব্দ তুলল মহলের চার দেয়ালে। কাঁপছে মানুষটার চোয়াল। দুনিয়ার সমস্ত শক্তি যেন সে এই এক বাক্যে খরচ করে ফেলেছে। মহল থেকে খানিকটা দুরে পাশাপাশি দুটো কবরস্থান। একটাতে মর্যাদার সঙ্গে সৈনিকের দাফন করা হয় অন্যটাতে আসামিদের দাফন করা হয়। ফয়েজ নামের ব্যক্তিটা এক সময় সাহসী একজন সৈনিক থাকলেও শেষ সময়ে এসে সে অপরাধীর খেতাব কুড়িয়েছিল। উপস্থিত প্রতিটি মানুষ আগ্রহী নয়নে চাইল সুলতানের দিকে। সকলের দৃষ্টি যেন উপেক্ষা করে গেলেন সুলতান। শক্ত কন্ঠে বললেন, “সৈনিকদের কাতারে দাফন করা হবে তাকে। একটা অপরাধ কখনোই তার সারাজীবনের সৎ কর্ম ধুয়ে দিতে পারে না।”

পুত্রের মৃতদেহ সামনে নিয়েও মানুষটা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো সুলতানের দিকে। এমন সময় হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সেখানে উপস্থিত হলেন একজন পৌঢ়া। ছুটে আসলেন খাটিয়ার কাছে। খাটিয়ার কাঠের মধ্য দিয়ে হাত গলিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “ফয়েজ, আমার বাচ্চা, আমার বাজান, আমার বাজানরে ওরা মে’রে ফেললো! মিথ্যা অপরাধের আসামি করে বন্দি করেও শান্তি মিটল না তোদের। জা’লিমের দল, আল্লাহ বিচার করবে তোদের। আমার কোল খালি করে দিলি। আমার বুকের মানিকরে মে’রে ফেললি। আমার বাজান কতোই না কষ্ট পেয়েছে। ঐ খন্জর আমার বুকে ঢোকালি না কেন তোরা?”

দূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছেন একজন অল্প বয়সী নারী। অচেনা হলেও কারোর বুঝতে বাকি রইল না যে সে ফয়েজের স্ত্রী, তার অর্ধাঙ্গী। ফুয়াদ হোসেন খাটিয়ার কাছ থেকে টেনে তুললেন নিজের স্ত্রীকে। পুত্রের শোকে কী বলতে কী বলবেন সেই ভয়ে টেনে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন তাকে। পুত্রের লাশের কাছ থেকে তার আম্মাকে সরানো কি এতোই সহজ? কখনোই না। দুনিয়ার সমস্ত শক্তি ভর করলো যেন তার উপর। স্বামীর হাত ছাড়িয়ে সে পুনরায় দৌড়ে এলো খাটিয়ার কাছে। হাউমাউ করে কেঁদে ভারী করে তুললেন আকাশ-বাতাস। ফুয়াদ হোসেন পুনরায় টেনে তুললেন তাকে। টেনে-হিঁচড়ে সরিয়ে নিলেন খাটিয়ার পাশ থেকে। জোর করে হলেও তাকে সরাতে হবে এখান থেকে। দাফনের সময় এগিয়ে আসছে। প্রধান দ্বার পেরোনোর আগে কান্না ভেজা কন্ঠে পুনরায় চিৎকার করে উঠলেন নারীটি। সুলতানের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন, “আমার বাজানকে বন্দি করে রেখে ছল করে হ’ত্যা করলি। আমি অভিশাপ দিলাম তোকে। আমার মতো তুইও সন্তানহারা হবি। কাঁদবি নিজের সন্তানের লাশ বুকে নিয়ে।”

আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকালেন সুলতান। চেয়ে থাকলেন তার যাওয়ার পথে। ভীত হয়ে পড়লেন তিনি। একজন আপনজনের শূন্যতাই তো এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। সেই যন্ত্রণাই তো এখনো তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এ যে একজন মায়ের অভিশাপ! তার দোয়া কি ফিরিয়ে দেবে সৃষ্টিকর্তা? তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো তোহফার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি। তৎক্ষণাৎ নিজের ভেতরে সূক্ষ্ম ব্যথার উপস্থিতি টের পেল সে। মাহতাব রাগান্বিত হয়ে মহিলাটির দিকে এগিয়ে যেতে নিলে হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দেন সুলতান। স্থির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো মাহতাব। সে অবাক হয় সুলতানের ধৈর্যশক্তি দেখে!

সৈনিকরা এগিয়ে গেল খাটিয়ার কাছে। কাফনের কাপড় দিয়ে মুখটা ঢেকে দিয়ে খাটিয়া কাঁধে তুলে নিতে চাইল। অথচ হুট করে তারা থেমে গেল প্রধান দ্বারে ছোট্ট ছোট্ট দুটো পায়ের উপস্থিতি পেয়ে। খাটিয়া ছেড়ে কাতর হয়ে উঠে দাঁড়ালো তারা। ছোট্ট ছোট্ট সেই পায়ের অধিকারী দৌড়ে এলো খাটিয়ার কাছে। তার শরীরে ধূসর বর্ণের ফতুয়া আর সবুজ রঙা পাজামা। মাথায় সফেদ রঙা টুপি। সাত বছরের ছোট্ট ফাইয়াজ তার ছোট হাতদুটো গলিয়ে দিলো খাটিয়ার ভেতরে। কাফন টেনে খুলতে না পেরে অসহায় চোখে তাকালো সৈনিকদের দিকে। ভাঙা গলায় বলল, “কাপড়টা খুলে দাও না চাচ্চু। তোমরা জানো তো আমি অনেকদিন আব্বাজানকে দেখি না। আম্মা বলেছিল এবার ইদে আব্বাজানের সাথে দেখা করাতে নিয়ে আসবে। কিন্তু আজ সবাই বলছে আব্বাজানকে নাকি তোমরা মাটির নিচে রেখে আসবে? আমি তো আর আমার আব্বাজানকে দেখতে পাবো না তাই আজ মক্তবে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছি। জানো, ফাঁকি দিলে হুজুর খুব মারে। আমি তবুও কাঁদব না বিশ্বাস করো। শুধু এই কাপড়টা একটু সরিয়ে দাও মুখের উপর থেকে। আমি কথা বলবো আব্বাজানের সাথে।”

এবার বুঝি সকলের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। তৎক্ষণাৎ দেয়ালের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন সুলতান। শুনতে চায় না সে এই বেদনাদায়ক বাক্য। দেখতে চায় না ছোট্ট ফাইয়াজের এতিম হবার দৃশ্য। একজন সৈনিক কাঁপা কাঁপা হাতে কাপড়টা সরিয়ে দিল মুখের ওপর থেকে। অমনি লাশের মুখের উপর ঝুঁকে পড়লো ফাইয়াজ। হাত বাড়িয়ে গালটা ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে আজ এতো সুন্দর লাগছে কেন আব্বাজান? জানো তুমি, বাইরে খুব গরম। তোমার খুব কষ্ট হবে তাই না মাটির নিচে থাকতে? তুমি একদম চিন্তা করো না আমি রোজ তোমায় দেখতে যাবো। আমি আল্লাহর কাছে বলে দিয়েছি তোমাকে যারা ব্যথা দিয়েছে তাদের সবাইকে ব্যথা দিতে।”

এতোটুকু বলে থামলো সে। তার চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। দু’হাতে চোখ মুছে সে পুনরায় কান্না ভেজা কন্ঠে শুধাল, “আমার সাথ ইদ করবে না তুমি আব্বাজান?”

ফয়েজের স্ত্রী দৌড়ে এসে বুকে টেনে নিল ছেলেকে। অমনি হাউমাউ করে কেঁদে দিল ফাইয়াজ। মাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “আব্বাজান…… আব্বাজান……।” কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গেল তার। টেনে টেনে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। মহলের প্রতিটা কোনা কোনা এবার পরিপূর্ণ হলো শোকের ছায়াতে। উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তির শক্ত হৃদয় নাড়িয়ে তুলল সাত বছরের ছোট্ট ফাইয়াজের কান্না।

চাঁদ উঠেছে নিজ গগনে। বয়ে এনেছে রমজানের সুঘ্রাণ। অথচ মহলের কারোর মধ্যে কোনো তাড়া নেই চাঁদ দেখার। সমস্ত আয়োজন মাঠে মা’রা গেল। চাঁদ দেখার উত্তেজনা বিলীন হয়ে সেখানে ঠাঁই পেয়েছে গভীর শোক। খাটিয়া নিয়ে যাওয়া হলো নির্দিষ্ট কবরস্থানে। জানাজা পড়িয়ে মাটি দেওয়া হলো সৈনিকদের কাতারে। সকলে একে একে ত্যাগ করলো কবরস্থান। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন ফুয়াদ হোসেন। ভেজা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন পুত্রের কবরের দিকে। কিছুক্ষণ বাদে তাকেও টেনে সরিয়ে নেওয়া হলো। একলা ফয়েজ সকল বাঁধন ছিন্ন করে পড়ে রইল অন্ধকার কবরে।

রাত কত হয়েছে হিসেব নেই। বন্দিশালার পাহাড়ারত সৈনিকরা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সুলতান আজ ভীষণ চটেছেন। গম্ভীর সুলতান দাঁড়িয়ে আছেন বন্দিশালার সম্মুখে। পাশেই নিজ নিয়মমাফিক বিশাল তলোয়ার হাতে সটান দাঁড়িয়ে আছে আজমাইন মাহতাব। ফয়েজকে যেই করাগারে রাখা হতো সেটা আজ শূন্য। সেবকরা সেই সন্ধ্যা থেকে কারাগারের ভেতর প্রমান খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। অথচ মেলেনি একটা সূত্র পর্যন্ত। এ যেন নিখুঁত হত্যা! মাহতাবের চিন্তিত মুখভঙ্গি। এতো কিছুর মাঝে সুলতানকে জানানো হয়নি সেই অজ্ঞাত নারীর ব্যপারে। তার মস্তিষ্ক এটাই মানতে নারাজ যে একজন বহিরাগত নারী বন্দিশালায় ঢুকে আসামির বুকে খন্জর ঢুকিয়েছে। এ যেন অসম্ভবই বটে!

তার ভাবনার মাঝেই ভেসে আসলো সুলতানের গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর, “কোথায় ছিলে তোমরা?”

মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলল সৈনিকগুলো। নত কন্ঠে বলল, “মাফ করবেন মহামান্য। বড় সুলতানা ডেকেছিল আমাদের। শুধু দৌড়ে গিয়েছি আর এসেছি। এর মধ্যে যে কীভাবে কেউ বন্দিশালায় ঢুকে পড়লো জানা নেই। তবে কারাগারের চাবি আমাদের কাছেই ছিল।”

নিজের মায়ের কথা শুনে হতবাক হলো সুলতান। বিস্মিত নয়নে চাইল সৈনিকের দিকে। অতঃপর কন্ঠে একরাশ বিস্ময় মিশিয়ে বলল, “আম্মা! আম্মা ডেকেছিল?”

বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে আছে জোভিয়া। রাতের কালো আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদটা। সেটাই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে। তবে তার এ সময়ের সাজসজ্জা একেবারে ভিন্ন। নীল রঙের একটি শাড়ি পড়েছে সে। চুলগুলো খোলা। দীঘল কালো চুলগুলো তার কোমর ছুঁয়েছে। উল্টোদিকের হাওয়ায় তার শাড়ির আঁচলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কখনো উড়ে উড়ে পেছনে যাচ্ছে আবার কখনো আছড়ে পড়ছে এলোমেলো হয়ে। তবুও চুলগুলো বাঁধার প্রয়োজন মনে করলো না জোভিয়া। থাক না খোলা, তাতে কী? বরং আজ একটু প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়া যাক। যদি সামান্যতম রমজানের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়!

এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো জারনাব। হিজাবের ওপরেও আজ চাদর জড়িয়েছে সে। চাদর টেনে ঢেকে নিয়েছে নিজের মুখখানি। সে ফটক পেরিয়ে উঠোন পর্যন্ত আসতেই জোভিয়াকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। ফিচেল হাসলো জোভিয়া। মিষ্টি কন্ঠে শুধাল, “কোথায় গিয়েছিলে বুবু?”

হুট করে এমন প্রশ্নে থতমত খেল জারনাব। জোরপূর্বক হেসে বারান্দার দিকে এগিয়ে এলো সে। জোভিয়া পুনরায় শুধাল, “কী হলো? বললে না যে?”

রান্নার ঘর থেকে ঢকঢক করে এক পাত্র পানি পান করলো জারনাব। চাদরখানা বারান্দার ছোট্ট চকিটাতে রাখতে রাখতে বলল, “সামনেই গিয়েছিলাম। উদ্যান পেরিয়ে একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। সারাদিন ঘরে বসে বসে ভালো লাগছিল না।”

হাসলো জোভিয়া। ছোট করে বলল, “ওহ।”

জারনাব পুনরায় বলল, “মহলে খুন হয়েছে। শুনেছো কি?”

ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল জোভিয়ার। বিস্মিত নয়নে চেয়ে কাঁটা কাঁটা গলায় শুধাল, “মমমহলে খুন! ককার খুন হয়েছে? তততুমি কীভাবে জানলে?”

“বন্দিশালার মধ্য থেকে একজন আসামির খুন হয়েছে। সেবকরা পুরো সাম্রাজ্যে ঘোষণা দিচ্ছে। আমাদের এ পাশটাতেও আসবে ঘোষণা দিতে।”

চলবে……….