সম্রাজ্ঞী পর্ব-৮+৯

0
110

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_8

“ওঠো এলি। সেহেরির সময় হয়ে গেছে। এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমানো তুমি কার কাছ থেকে শিখেছো বলোতো? তার গর্দান আগে নেব আমি। কী হলো? শুনতে পাচ্ছ না সৈনিকদের ঘোষণা? আরেহ বাবা! একজন সুলতান তোমাকে ডাকছে অথচ তুমি পাত্তাই দিচ্ছ না। এক্ষুনি আজান দিয়ে দেবে কিন্তু।”

সুলতান হাজারবার ডেকেও বিন্দুমাত্র নড়াতে পারলো না বেগমকে। এদিকে সেহেরির সময় বয়ে যাচ্ছে। বাইরে সৈনিকরা একনাগাড়ে সময়ের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। মহলের সকলে উঠে পড়েছে অথচ বেগম কি-না এখনো ঘুমাচ্ছে! এই মেয়ের ঘুম আর কবে কমবে তার জানা নেই। সে কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে বেগমের হাত ধরে টান দিতেই তার হাতটা নিজের কাছে টেনে নিলেন বেগম। ঘুম ঘুম কন্ঠে বিরক্ত স্বরে বললেন, “উঁহু! সুলতান, রাতবিরেতে কেন বিরক্ত করছেন আমাকে? আমি ঘুমাতে চাই। আরো অনেক ঘুমাতে চাই। আপনিও আমার সাথে ঘুমিয়ে পড়ুন।”

চোখদুটো বড়বড় করে তাকালেন সুলতান। নিজে ঘুমাবে আবার তাকেও ঘুমাতে বলছে! সে কাকে দিয়েছে রানির পাট! নড়েচড়ে বসলেন সুলতান। সে বুঝে গিয়েছে এভাবে হবে না। টেনে ধরা হাতটা আর সরালেন না তিনি। উল্টো সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন বেগমের পাশে। কয়েক মুহুর্ত পরেই বিকট শব্দ তুলে নাক ডাকতে শুরু করলেন তিনি। এতেই যেন কাজ হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ ধরফরিয়ে উঠে বসলেন বেগম। এদিক-ওদিক চেয়ে বিচলিত কন্ঠে বললেন, “কে? কে? কোথায় ডাকাত পড়লো? পাহাড় ধসে পড়লো মনে হলো।”

আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে চোখ-মুখ কুচকে তাকালো সুলতানের দিকে। সুলতান শাহজাইন এখনো চোখদুটো বন্ধ করে মিটমিটিয়ে হাসছেন। চটলেন বেগম। বুঝলো কোথাও কিছু হয়নি। এসব সুলতানের কারসাজি তার ঘুম ভাঙানোর জন্যে। সে হতাশ হয়ে শরীরের উপর থেকে চাদরখানা ফেলে দিয়ে হাই তুলতে তুলতে বললেন, “ঘুম ভাঙানোর কী বিশ্রি পদ্ধতি আপনার! ছিহ! একজন সুলতানের মনোভাব এতো নিম্নমানের কীভাবে হতে পারে?”

এবার হাসতে হাসতে উঠে বসলেন সুলতান। বেগমের নাকটা টেনে দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, “বেগম অলস হলে সুলতানকে কতো পরিক্ষাই না দিতে হয়। এ তো অতি সামান্য! তুমি সুযোগ দিলে আরো বিশ্রি পদ্ধতি দেখাতে পারি আমি। দেখাব?”

চট করে পালঙ্ক ছেড়ে নেমে দাঁড়ালেন এলিজা সুলতান। হনহনিয়ে দ্বারের দিকে এগোতে এগোতে আবার পিছু ফিরে তাকালেন। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, “বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য আর আপনি কি-না এখানে বসে বসে এসব বিশ্রি পদ্ধতি অনুশীলন করছেন!”

তার দিকে হাঁ করে তাকালেন সুলতান। যার ঘুম ভাঙাতে গিয়ে সে পায়ের ঘাম মাথায় টেনে তুলল সেই কি-না তার দাম দিলো না। এসব অনাচারও তার সাম্রাজ্যে হচ্ছে আজকাল! বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দ্বারের দিকে এগোলেন তিনি। ততক্ষণে কামরা ত্যাগ করেছেন এলিজা সুলতান। শব্দ করে ভিড়িয়ে দিয়ে গেছেন দ্বারের কপাট। সুলতান বেরিয়ে এলেন নিজের কামরা ছেড়ে। কিন্তু আশ্চর্য! আশেপাশে কোথাও বেগম নেই! চারপাশে কোনো সৈনিক নেই, সেবক-সেবিকাদের দেখা নেই! ব্যপারখানা ঠাহর করতে পারলেন না তিনি। মহল এমন ফাঁকা কেন? সবাই হুট করে কোথায় গেল? একটু আগেও তো সকলের কথাবার্তার শব্দ শ্রবণগোচর হচ্ছিল। এক মুহুর্তে সবাই কোথায় গায়েব হয়ে গেল? এদিক-ওদিক খুঁজেও কোথাও বেগমের দেখা মিলল না। মুহুর্তেই যেন জনমাবনহীন হয়ে পড়েছে এই সুবিশাল মহলখানা। সে খানিক উচ্চস্বরে বেগমকে ডাকলেন কয়েকবার তবে কোনো সাড়া পেলেন না। সে বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে বললেন, “মাহতাব, দেখো তো মহলের সবাই কি ঘুমিয়ে আছে নাকি এখনো?”

তার বাক্যখানা মহলের চার দেয়ালের মাঝে বিকট শব্দ তুলল। সেবারো কোনো উত্তর আসলো না। অবাক হলেন সুলতান। এরকম তো আগে কখনোই ঘটেনি! এতো বড় মহলের হাজার-হাজার বাসিন্দা এক পলকেই উধাও! সমস্ত আসবাবপত্রগুলো যেন একদম স্থির হয়ে আছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন তিনি। মহলের ভেতরের দিকের গাড় সোনালি রঙটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। গুমট পরিবেশ। সবকিছু এতোটাই ভয়ানক লাগছে যেন সৌন্দর্যমন্ডিত মহলটা তাকে একা পেয়ে গিলে খেতে চাইছে। ইতিমধ্যে এক পা দু’পা করে পেছাতে শুরু করেছেন সুলতান। মহলটা যেন স্থির হয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে তার উপরে হামলে পড়তে। পেছাতে পেছাতে হঠাৎ সে ধাক্কা খেলো সদর দরজার সাথে। চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকালো সে। শক্ত হাতে খুলে দিলেন সদর দরজা। হঠাৎ বাইরের দৃশ্য দেখে চোখদুটো অস্বাভাবিকভাবে বড়বড় করে তাকালেন। প্রশস্ত রাস্তাটার উপর রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর হয়ে পড়ে আছেন বেগম। তার মহা মূল্যবান শাড়ির উপর দিয়ে গেঁথে দেওয়া তলোয়ারটা এখনো মাথা উচিয়ে রয়েছে। তার মাথার সম্রাজ্ঞীর তাজটা খুলে পড়ে আছে পাশেই। তলোয়ারের সাথে লেগে থাকা রক্ত ইতিমধ্যে দলা পাকিয়েছে। বেগম বোধহয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে বেশ কিছুক্ষণ পূর্বেই। সম্মুখেই তার মহলের সৈনিক, সেবক-সেবিকা সকলে দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্র হাতে। সকলের মুখেই পৈশাচিক এক হাসির পরশ। এমন দৃশ্যে আৎকে উঠলেন সুলতান। নিজের প্রান প্রিয় বেগমের লাশটার দিকে চেয়ে গলা ফাটিয়ে গগণবিদারি চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি।

আচমকা ঘুম ভেঙ্গে লাফিয়ে উঠে বসে পড়লেন সুলতান। ঘামছেন তিনি। পুরো শরীর ঘামে ভিজে একাকার। হাতের উল্টো পিঠে কপালের ঘামের বিন্দুগুলো মুছে নিলেন তিনি। বুকের মধ্যে যেন কঠিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে হুট করেই। সে নিজের বুকে হাতটা চেপে ধরে পুরো ঘরে নজর বুলিয়ে উপলব্ধি করতে পারলেন এটা তার স্বপ্ন ছিলো। স্বপ্ন নয় দুঃস্বপ্ন ছিলো, ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। তার শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়েছে ভয়ে-আতঙ্কে। তখনই বাইরে থেকে ভেসে এলো সৈনিকের উচ্চ কন্ঠের ঘোষণা। সৈনিকরা চিৎকার করে সকলকে আহ্বান করছে সেহেরির জন্য। মুহুর্তেই ধপধপ করে উঠলো সকলের কামরার কৃত্রিম আলো। জ্বলে উঠলো মোমবাতিগুলোও। জেগে উঠলো পুরো মহল। সেবক-সেবিকারা ব্যস্ত হয়ে পড়লো খাবার প্রস্তুত করতে। শরীরের উপর থেকে চাদর সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সুলতান। বালিশের পাশে চেয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি না পেয়ে হতাশার শ্বাস ফেললেন তিনি। রোজকার ন্যায় আজ তার পালঙ্কে মাথার পাশে স্থান পাইনি সেই সোনালি কারুকার্যখচিত ফ্রেমটা। খানিক বিচলিত হলো সে। কাল এতো সব ঝুট-ঝামেলার মাঝে সে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানা নেই। বন্দিশালা থেকে সে সোজা যখন আম্মাজানের কামরায় গিয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের উদ্দেশ্যে তখন তার আম্মা খুব স্বাভাবিকভাবেই বলেছিল সে ডাকেনি সৈনিকদের। বরং সৈনিকদেরকে কেউ ভুল তথ্য দিয়েছে। সৈনিকরা যখন হুট করে তার কামরার বাইরে ভীর জমিয়েছিল সে নিজেও বেশ অবাক হয়েছিল। সে ডাকেনি জানতে পেরে বিপদের আশঙ্কা করে তৎক্ষণাৎ সৈনিকরা ছুটে যায় বন্দিশালার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। গুপ্ত সেই ঘাতক তার কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। সব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুলতান। কেউ খুব কঠিন ষড়যন্ত্র এটেছে তার মহল, তার পরিবার, তার সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করতে। দ্রুত সেই শত্রুকে চিহ্নিত করতে না পারলে হয়তো অচিরেই হারিয়ে যাবে তার সাম্রাজ্য!

চিন্তায় চিন্তায় তার মাথাটা ভার হয়ে এসেছে। একটু শান্তি প্রয়োজন তার। সে ব্যস্ত হাতে সিন্দুক খুলে বের করে আনলো সোনালি ফ্রেমটা। বেগমের মুখের ওপর হাত বুলালেন আলতো করে। পুনরায় পালঙ্কে গিয়ে বসলেন ফ্রেমটা হাতে করে। গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “রাগ করেছো এলি? ছোট ছোট বিষয়ে এমন বাচ্চাদের মতো অভিমান করা মানায় না একজন সম্রাজ্ঞীকে।”

কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বললেন, “অভিমান করে কি আমার কাছে ফিরে আসবে তুমি? জানো, ফয়েজ আর নেই। তাকে কি ক্ষমা করেছো তুমি? ফয়েজের ছোট্ট ছেলেটাও এতিম হলো বাবাকে হারিয়ে। তুমি জানো, ছেলেটা বড্ড আদুরে। আচ্ছা, আমাদের তোহফাকেও কি সবাই এতিম বলে আমার আড়ালে?”

তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। ভেসে এলো আজমাইন মাহতাবের কন্ঠস্বর, “উঠুন মহামান্য। সেহেরির সময় হয়ে এসছে।”

উত্তর দিলেন না সুলতান। সযত্নে ছবিখানা সিন্দুকে রেখে তালা লাগিয়ে দিলেন। অতঃপর দ্বার খুলে দিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “উঠে পড়েছো মাহতাব? একটু অপেক্ষা করো আমি পরিষ্কার হয়ে আসছি।”

ভোজনকক্ষের বিশাল টেবিলটাতে বসে সুলতানের জন্য অপেক্ষা করছে সকলে। সেখানে উপস্থিত আছেন ওয়াসিফা সুলতান, শাহজিল সুলতান, শেহজাদি মাইরা, মারজিয়া সুলতান এবং শেহজাদি তানহা। উপস্থিত নেই তোহফা। সে ঘুমাচ্ছে নিজ কামরায়। পাশাপাশি বসেছেন শাহজিল সুলতান, ওয়াসিফা সুলতান এবং মারজিয়া সুলতান। নিজেদের মাঝে টুকটাক কথাবার্তা বলছেন তারা। অন্যদিকে শেহজাদি মাইরা এবং শেহজাদি তানহা একসাথে বসলেও তাদের মধ্যে কোনো কথোপকথন তো দুর দৃষ্টি আদান-প্রদানও হচ্ছে না। তারা নিজেদের মতো করে চুপচাপ বসে আছে। সেবিকারা খাবার গুছিয়ে পরিবেশন করে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। মাজেদা বানু তাদের সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। সে মূলত এসেছে নতুন মেয়েদের তদারকি করতে। যেন খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে কোনো গোলমাল না করে বসে তারা। ফাইজা ও হাফসা মাজেদা বানুর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ফাইজা মাঝে মাঝে আড়চোখে চেয়ে দেখে নিচ্ছে এই কামরার সৌন্দর্য, মানুষগুলোর সাজ-পোশাক। সে নতুন হওয়ার দরুণ এসবের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নয়। সুলতানের খাওয়া শেষ হলে তবেই তারা সকলে খেতে যাবে। এমন সময় বাইরে থেকে ভেসে এলো সৈনিকের উচ্চ কন্ঠ। দ্বারের বাইরের পাহাড়ারত সৈনিক গলা উচিয়ে বলছে, “মহামান্য সুলতান শাহজাইন শাহ।”

চমকাল ফাইজা। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি নিচু করে নিলো সে। মুহুর্তের মাঝেই কামরায় প্রবেশ করলেন সুলতান শাহজাইন। টেবিলের দিকে দু’পা এগিয়ে আবার পিছিয়ে আসলেন তিনি। দৃষ্টি সম্মুখে রেখে গম্ভীর স্বরে বললেন, “ভেতরে এসো মাহতাব।”

বলতে দেরি কিন্তু দৌড়ে ভেতরে আসতে দেরি হলো না মাহতাবের। সে ছুটে এসে সুলতানের পাশে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “বলুন মহামান্য।”

“টেবিলে বসো। সেহেরি খেয়ে নাও।”

“কিন্তু………….”

কথা সম্পূর্ণ করা হলো না তার। সুলতানের অগ্নি দৃষ্টিতে নুইয়ে নিলো নিজের মাথা। নীরবে টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। বর্তমানে সে কোন চেয়ারটাতে বসবে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এগিয়ে এলেন সুলতান। নির্ধারিত স্থানে বসে মাহতাবকে ইশারা করলো নিজের সবচেয়ে কাছের চেয়ারটাতে বসার জন্য। টেবিলে উপস্থিত বাকিদের দিকে একবার তাকালো মাহতাব। তারা অবাক চোখে চেয়ে আছে তার দিকেই। ওয়াসিফা সুলতানের চোখ-মুখ অবশ্য অন্য কথা বলছে। সে যে প্রচন্ড রেগে গেছে পুত্রের এমন কাজে তা বুঝতে বাকি রইল না মাহতাবের। তবুও চুপচাপ বসে পড়লো সুলতানের দেখানো স্থানে। তার পাশের চেয়ারটাতে বসা শেহজাদি তানহা শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। বারকয়েক তপ্ত শ্বাস ছেড়ে অপলক চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। ব্যাপারখানা উপলব্ধি করতে পারলেও তার দিকে একবার চেয়ে দেখলো না মাহতাব। এখন তার দিকে তাকালে বড্ড অস্বস্তিতে পড়ে যাবে সে। তাই না তাকানোটাই উত্তম মনে হলো তার নিকট। সবকিছু বেশ সূক্ষ্মভাবে উপেক্ষা করে গেল শেহজাদি মাইরা। নতুন একটা মানুষ যে যুক্ত হয়েছে তাদের সাথে তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই। ভাবখানা এমন যেন দুনিয়াটা উল্টে যাক তবুও এসবে গুরুত্ব দেবে না। খাবারের দিকে চেয়ে আনমনে কিছু একটা ভেবে চলেছে সে। মারজিয়া সুলতান চুপচাপ দেখে গেল মেয়ের মুখভঙ্গি। সে বুঝে উঠতে পারছে না নিজ কন্যার মনোভাব। তাকে স্বস্তি দিতেই যেন সুলতানের দিকে আড়চোখে তাকালো মাইরা। অতঃপর মুচকি হেসে পুনরায় তাকালো খাবারের দিকে। তবে মুচকি হাসিটা এখনো বিদ্যমান তার ঠোঁটে।

সকলের নীরবতা ভেঙে সুলতান হুকুম দিলেন, “খাওয়া শুরু করো।”

সকলে খাওয়া শুরু করলেও সেদিকে ধ্যান নেই শেহজাদি তানহার। সে তো একদৃষ্টে চেয়ে আছে তার পাশে বসা সুদর্শন পুরুষটির দিকে। পুরুষটির খাওয়ার ভঙ্গিমাও যেন খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করছে সে। হুট করে খাওয়া বন্ধ করে দিলো মাহতাব। এভাবে কেউ চেয়ে থাকলে আর যাই হোক খাওয়া যায় না। সে মাথা উঠিয়ে তাকালো একবার সকলের দিকে। শেহজাদি তানহা ছাড়া সেখানে উপস্থিত সকলেই নিজেদের খাবারে ব্যস্ত। আচমকা কেশে উঠলো মাহতাব। অমনি ভাবনাচ্যুত হলো তানহা। এতোক্ষন সে যেন অন্য জগতে বিরাজ করছিল। নিজেকে সংবরণ করে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো সে।

সেই তখন থেকে চোরা দৃষ্টিতে সুলতানের দিকে চেয়ে আছে ফাইজা। এমন সুদর্শন, সুঠাম দেহী পুরুষ সে আগে কখনোই দেখেনি। মহলে আসার আগে সে অনেক গল্প শুনেছে সুলতানের সৌন্দর্যের। তাই আজ তাকে স্বচক্ষে দেখার উত্তেজনাটা একটু বেশিই। সুলতানের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, চোখের ঘন কালো পাপড়ি যেন তার সৌন্দর্যকে পৌঁছেছে চরম শেখরে। তার মহা মূল্যবান সোনালি পাগড়ি, রাজকীয় সফেদ পোশাক আর গুরুগম্ভীর অঙ্গভঙ্গি কাঁপন ধরাতে সক্ষম প্রতিটি নারীর হৃদয়ে। এই চেহারার দিকে চেয়ে যেন নিমেষেই হাজার বর্ষ পার করে দেওয়া যায়। এতোটাই নিখুঁত এই চেহারা। তাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকাল হাফসা। মাজেদা বানু কিছুক্ষণ পরপর ঘুরে ঘুরে দেখে নিচ্ছে তাদের অথচ ফাইজার সেদিকে কোনো হুঁশ নেই। বিরক্ত হলো হাফসা। লুকিয়ে কনুই দিয়ে গুঁতো মারলো ফাইজাকে। হকচকিয়ে উঠলো ফাইজা। দৃষ্টি সরিয়ে হাফসার দিকে তাকালো। লাজুক হেসে ফিসফিসিয়ে বলল, “বাঁচালে। আরেকটু হলেই শাস্তি পেতে হতো। এমন হৃদয় জ্বালানো রূপ সুলতানের! চোখ সরানো দায়!”

“নিজেকে সংবরণ করো মেয়ে। ভুলে যেও না নিজের স্থান। এই সৌন্দর্য দূর থেকে দেখো তবে কাছে গিয়ে তা ছোঁয়ার চেষ্টা করো না। ভস্ম হয়ে যাবে।” কাট কাট গলায় বলে দিলো হাফসা।

তবে তার কথাগুলো ফাইজার কর্ণ গহ্বরে পৌঁছালো বলে মনে হলো না। সে পুনরায় আড়চোখে ফিরে তাকালো সুলতানের দিকে। মুখের হাসিটা বজায় রেখেই বলল, “সৌন্দর্যের তারিফ করতে আবার কার্পণ্য করি না আমি।”
__________,__________,___________

সকাল হয়েছে বেশ খানিকটা সময়। চারদিকে সূর্যের তীক্ষ্ম রশ্মির উত্তাপ। যেহেতু রমজান মাস তাই সবাই সেহেরি খেয়ে নামাজ আদায় করে একবারে ঘুমিয়েছে। রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই দেখে আজ একটু দেরি করেই উঠেছে জারনাব। কিন্তু জোভিয়া এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার ঘুম বরাবরই একটু বেশি। কিন্তু রোজা থেকে এতো ঘুমানো মোটেই উচিত নয়। তাই জোভিয়ার শিয়রে গিয়ে বসলো জারনাব। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকে উঠলো, “ওঠো জোভিয়া। আর কতো ঘুমাবে? রোজা থেকে এত ঘুমাতে নেই। দেখি ওঠো তো। উঠে বসো দেখবে ঘুম ছুটে গেছে।”

“আহ বুবু! ঘুমাতে দাও তো। মাত্রই চোখ লেগে এসেছে। একটু পরে উঠবো।” জোভিয়ার বিরক্তভরা কন্ঠস্বর।

শুনলো না জারনাব। সে জানে একে এখন ঘুমাতে দিলে একটু পরে সে মোটেই উঠবে না। উল্টো নানান তালবাহানা করবে। তাই হুট করে জোভিয়াকে ধরে টেনে উঠিয়ে বসিয়ে দেয় সে। আচমকা এমন হওয়ায় হকচকিয়ে উঠলো জোভিয়া। চোখ বড়বড় তাকালো বোনের দিকে। পাত্তা দিলো না জারনাব। জোভিয়ার হাত ধরে টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে গেল। দরজা পেরিয়ে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এসো।”

নড়লো না জোভিয়া। উল্টো ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ধপ করে বসে পড়লো দরজার চৌকাঠের উপর। পুনরায় চোখদুটো বন্ধ করে নিলো সে। তেড়ে আসলো জারনাব। বিরক্ত স্বরে বলল, “আরে আরে! আবার ওখানে বসেছো কেন? যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এসো। অন্তত চকিতে তো উঠে বসো। হুট করে নোংরা জায়গায় বসে পড়লে। আক্কেল-জ্ঞান আর কবে হবে তোমার?”

আমলে নিলো না জোভিয়া। সেভাবেই বসে রইল চোখদুটো বন্ধ করে। হতাশার শ্বাস ফেলল জারনাব। পানির পাত্রটা হাতে করে এগিয়ে গেল উঠোনের দিকে। গাছগুলোতে পানি দিতে দিতে আবারো ফিরে তাকালো জোভিয়ার দিকে। কিন্তু নাহ! এখনো ওঠেনি সে। চৌকাঠে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। যার দরুন তার ঠোঁটদুটো হালকা ফাঁকা হয়ে আছে। তবে মিষ্টি লাগছে দেখতে। মৃদু হাসলো জারনাব। হঠাৎ ফটকের ওপার থেকে কেউ গলা খাকারি দিলো। উচ্চস্বরে বলল, “বাড়িতে কেউ আছেন?”

পুরুষের কন্ঠ! তাও এই সকালে! চমকে উঠলো জারনাব। হকচকিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লো জোভিয়া নিজেও। তাদের গৃহে এই সময় কোনো পুরুষ তো আসার কথা নয়। তাদের না তো কোনো আত্মীয় আছে আর না তো কোনো পরিচিত মানুষ আছে। দোকানের জন্য যাওবা দু’য়েকজনের সাথে পরিচয় হয়েছে তবে তারা সকলেই নারী দোকানি। বোনের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকালো জারনাব। জিজ্ঞাসু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল, “জিদান নয়তো?”

“আরে না। ঐ বেয়াদব, অভদ্রটা আসলে নিশ্চয়ই এভাবে কথা বলবে না। গুন্ডাগিরি করতে করতে এতোক্ষনে গৃহে ঢুকে পড়তো। অন্য কেউ এসেছে। দাঁড়াও আমি দেখছি।” বলতে বলতে দৌড়ে ঘর থেকে পর্দাটা এনে মুখের উপর বেঁধে নিলো জোভিয়া।

সে ফটকের দিকে এগোতে নিলেই তার হাত টেনে ধরলো জারনাব। ইশারায় সেদিকে যেতে নিষেধ করলো তাকে। আতঙ্কিত তার দৃষ্টি। অজানা কোনো কারনে সে সামান্যতেই ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু এসব ভয়-ভীতি খুব একটা কাবু করতে পারে না জোভিয়াকে। সে টেনে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। অতঃপর হনহনিয়ে এগিয়ে গেল ফটকের দিকে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল জারনাব। আগ্রহী নয়নে চেয়ে থাকলো ফটকের দিকে। ফটকের সামনে গিয়ে ব্যক্তিটিকে দেখেই মুখটা আপনা আপনি হাঁ হয়ে গেল জোভিয়ার। হতবাক স্বরে বলল, “আপনি!”

অমনি এক দমকা হাওয়ায় সরিয়ে দিলো তার মুখের উপরের পর্দাটা। আকস্মাৎ বাতাসে নড়ে উঠলো কৃষ্ণচূড়ার ডাল-পালা। লাল ফুলগুলো ঝরে পরতে শুরু করেছে তাদের উপর। মুহুর্তেই স্থানটা ভরে উঠলো কৃষ্ণচূড়া ফুলে। লাল রঙে সাজলো ভূমি।

চলবে………

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_9

“দেখেছো তুমি? প্রকৃতিও আমাদের একত্রিত করতে চাইছে। অথচ তুমি একাই শুধু দূরত্ব খোঁজো। কেন মেয়ে? এত বাহানা কীসের?”

মুখের পর্দাটা ঠিকঠাক করে কটমট করে তাকালো জোভিয়া। কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো পায়ের কাছ থেকে কুড়িয়ে নিলো হাত ভোরে। অতঃপর আলগোছে সেগুলো ফটকের ভেতরে ছুড়ে ফেলল। তার কর্মকাণ্ডের আগা-মাথা কিছুই উপলব্ধি করতে পারলো না বণিক। সে ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। হুট করে মুচকি হেসে বলে উঠলো, “প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে চাইছ?”

আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো জোভিয়া। উচ্চস্বরে বলল, “কেন আমাকে বিরক্ত করছেন এভাবে? পস্তাবেন আপনি। দ্রুতই নিজের কর্মের কারনে পস্তাবেন।”

তার কঠিন বাক্যগুলো হেসেই উড়িয়ে দিলো বণিক। নিজের দু’হাতে ধরে থাকা বড় বড় থলেদুটো এগিয়ে দিয়ে পুনরায় বলল, “রোজার বাজার দিতে এসেছি, তোমাকে বিরক্ত করতে নয়। দোকান খুলছো না যে? কাল সারাদিন তো বন্ধ ছিলো দোকান।”

“আমার দোকান, আমার মর্জি। আপনাকে কেন বলতে যাব? তাছাড়া আপনাকে কেইবা বলেছে রোজার বাজর আনতে? এসব নিয়ে বিদেয় হন তো আপনি। সুলতান যেগুলো পাঠিয়েছে ওগুলো দিয়েই দিব্যি চলে যাবে আমাদের।”

তার কথার প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো বণিক। কোমরে বেধে রাখা পাগড়িটা খুলে আজ মাথায় পেঁচিয়েছে সে। টুপিটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। কাল সকাল থেকে সে নূর বাজারের আশেপাশে চরকির মতো ঘুরঘুর করেছে। কিন্তু দোকান আর খুললো না কেউ। সন্ধ্যা নামলে যখন আলো ফুরিয়ে আসতে শুরু করলো তখন সে হতাশ হয়ে ফিরে যায় জাহাজে। আজও সকাল থেকে দোকান খোলার আশায় প্রহর গুনছিল অথচ কালকের মতো আজও দোকানটা বন্ধ রইল এতটা সময়। তাই সকল চিন্তা ঝেড়ে ফেলে রোজার বাজার নিয়ে চলে এসেছে খোঁজ-খবর নিতে। অথচ দেখো, মেয়েটা কেমন দুর্ব্যবহার করছে! তাকে যেন সহ্যই করতে পারে না! দু-চারটে কথাও বলতে চায় না ঠিক করে! সে কি জানে? তাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে ঠিকানা খুঁজে পেতে। এতেও যেন বিন্দুমাত্র আক্ষেপ প্রকাশ পেল না তার ভঙ্গিমায়। সে বাজারের থলেগুলো নিচে রাখতে রাখতে বলল, “যখন-তখন এভাবে আগুনের ন্যায় জ্বলে ওঠো কেন? নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা কি অন্যায়? জোর তো করছি না তোমায়। অপেক্ষা করবো আমি। আজন্মকাল অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।”

এমন কথাতে রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও কেন যেন রাগলো না জোভিয়া। বরং হতাশার শ্বাস ফেলল সে। এই মানুষটা তার শত্রু নয় আবার বন্ধুও নয়। তবুও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য হয় সে। মানুষটা তার কতোটা ভালো চাই সে সম্পর্কেও অবগত সে। কিন্তু তার ভালোবাসা এতো ঠুনকো নয় যে সামান্য ঝড়েই দিক হারাবে। সে গম্ভীর স্বরে বলল, “আপনি এভাবে বারবার নানান ছুতোয় আমার সামনে আসবেন না আবরার। আপনি যা চান তা কখনোই আমি দিতে পারবো না। এ অসম্ভব। আপনার চাওয়া সারাজীবন অপূর্ণ রয়ে যাবে। তাই এটাই ভালো হবে যে আমার থেকে কম করে হলেও শ’মাইল দূরত্ব বজায় রাখতে শিখুন। অপমান হজম করতে করতে কি বদহজম হয় না আপনার?”

“না তো। কখনোই বদহজম হয় না আমার। জানো তো, আমার পেট আবার অনেক শক্তিশালী। সহজে হার মানে না। কিন্তু তোমার মুখে আমার নামটা কিন্তু খুবই শ্রুতিমধুর শোনাচ্ছে। তা কি খেয়াল করেছো তুমি?”

বিরক্ত হলো জোভিয়া। এই লোক ভালো কথার মানুষ নয়। খারাপ ব্যবহার না করলে এক পাও সে নড়বে না এখান থেকে। রেগে কিছু বলার পূর্বেই বণিক পুনরায় বলে উঠলেন, “রাগলে তোমায় কেমন লাগে? আমাকে একটু দেখাবে? নিশ্চয়ই মারাত্মক তেজস্বী লাগে?”

দু’পা এগিয়ে এলো জোভিয়া। শক্ত গলায় বলল, “আপনি খুবই অসহ্য একজন লোক। একেবারে যা-তা। হাজারবার নিষেধ করার পরেও আমার পিছু ছাড়ছেন না। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি আপনার আফসোসের দিন খুব বেশি দূরে নেই। আপনি আফসোস করবেন, শীঘ্রই আপনি ভুল মানুষকে ভালোবেসে আফসোস করবেন।”

অতঃপর হনহনিয়ে সে চলে গেল ফটকের ভেতরে। তার জটিলতায় ভরা বাক্যগুলো বণিক উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো না বোধহয়। তাইতো সে চিল্লিয়ে বলল, “আরেহ! বাজার না নিয়ে চলে গেলে যে?”

উত্তর আসলো না গৃহ থেকে। ফটকের ভেতরে উঁকি দিতে চেয়েও দিলো না আবরার। এটা বেজায় অভদ্রতা। তাই বাইরের থেকেই পুনরায় চিৎকার করে বলল, “আমি চলে যাচ্ছি। বাজারগুলো রইল এখানেই। নিয়ে যেও। জিনিসগুলো এখানে পড়ে থেকে নষ্ট হলে তার দায়ভার কিন্তু সম্পূর্ণ তোমার। অপচয় করা উচিত নয়।”

থলেগুলো ফটকের সাথে হেলান দিয়ে রেখে পথের দিকে হাঁটতে শুরু করলো সে। মাথার পাগড়িটা খুলে কোমরে বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে গেল নদীর পাড়ে। ধীরে ধীরে রোদ উঠছে। কড়া রোদ। শরীর ঘেমে যাচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে অথচ সে ভ্রুক্ষেপ করলো না তাতে। বরং ঠোঁটদুটো খানিক প্রসারিত করলো জোভিয়া রাগান্বিত কন্ঠস্বর অনুভব করে। অন্যদিকে বারান্দায় চকির উপর বসে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে জোভিয়া। একটা মানুষ ঠিক কতটা অসহনীয় হতে পারে তা এই বণিককে না দেখলে উপলব্ধি করতে পারতো না সে। মুখের ওপর থেকে কালো পর্দাটা খুলে ছুড়ে ফেলল নিচে। হঠাৎ নিজের সামনে কারোর ছায়া দেখে মাথা ওঠাতেই নজরে আসলো জারনাবের হাস্যজ্জল মুখশ্রী। রাগ কমে এলো জোভিয়ার। মৃদু হেসে তার পাশে বসলো জারনাব। জিজ্ঞাসু স্বরে শুধাল, “আবরার জাওয়াদ এসেছিল?”

“হুম।”

“কেন? তোমায় দেখতে?”

চোখ ছোট ছোট করে তাকালো জোভিয়া। বিরক্ত কন্ঠে বলল, “আমায় আবার দেখার কী আছে? রোজার বাজার দিতে এসেছে? খেয়ে কাজ পায় না কি-না।”

“আচ্ছা? শুধু বাজার দিতেই এসেছিল। লোকটা কিন্তু খারাপ না, ভালোই। সবসময় এভাবে দূর দূর না করলেই পারো।”

অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো জোভিয়া। বলতে কী চাইছে তার বুবু? ঐ অসহনীয় লোকটাকে সহ্য করে নিতে বলছে! কিন্তু তা কখনোই সম্ভব নয়। আর কোনো বাক্য বিনিময় না করে সে হনহন করে ঘরে চলে যায়। তার যাওয়ার পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জারনাব। তার মতো কি জোভিয়ার জীবনটাও এভাবে এলোমেলো হয়ে থাকবে? বোনের জীবনটা একটু গুছিয়ে দিতে পারলে খানিক শান্তি পেত সে। তার জীবন এলোমেলো হয়েছে তার ভাগ্যের দোষে কিন্তু জোভিয়া, সে কেন গুছিয়ে নিচ্ছে না নিজের জীবনটাকে? নিজের হারিয়ে ফেলা সংসারের কথা মনে আসতেই পুনরায় বুকের দহন বৃদ্ধি পেল তার। তার স্বামী! তার সংসার! সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছে সে। এতোটাই অভাগী সে! কতোই না সুন্দর ছিল তার ভালোবাসার মানুষের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো। কিন্তু এক নিমেষেই আবার সব শেষ হয়ে গেল! চিরজীবনের জন্য সে খুইয়ে বসেছে নিজের ভালোবাসাকে! চোখের কোনে পানি জমেছে তার অজান্তেই। উপলব্ধি করতে পেরে দ্রুত মুছে নিলো সে। দৃষ্টিভঙ্গি শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল ফটকের দিকে। বাজারগুলো নিয়ে আসা প্রয়োজন। জোভিয়া তো জীবনেও আনবে না তা সে জানে কিন্তু জিনিসগুলো শুধু শুধু সেখানে ফেলে নষ্ট করতেও তার মন সায় দিচ্ছে না। ফটকের বাইরে আসতেই দেখতে পেল দুটো বাজারবর্তি থলে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রাখা। আবরার জাওয়াদ লোকটা এতো ধৈর্য পায় কোথায় তার জানা নেই। জোভিয়ার একটু ধৈর্যের প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন তার থেকে। মেয়েটা অল্পতেই রেগে আগুন হয়ে যায়। সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতে থলেদুটো হাতে নিতেই কানে আসলো কারো বিদ্রুপের কন্ঠ।

“কী সুন্দরী? বাজার করতে গিয়েছিলে নাকি?”

চকিতে তাকালো জারনাব। সাঙ্গোপাঙ্গ সমেত জিদানকে এগিয়ে আসতে থেকে ভীত হয়ে পড়লো সে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে পিছিয়ে গেল দু’পা। ধরে থাকা থলেদুটোর ভার যেন মুহুর্তেই বেড়ে দশগুণ হয়েছে। হাত-পা কাঁপছে তার অজানা ভয়ে। তার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো জিদান। কপাল কুচকে বলল, “দু’দিন ধরে দেখছি দোকান বন্ধ। ভয় পেয়েছ?”

“ভভভয় পাবো কেন? এএএমনিই বন্ধ।” ভয় দমিয়ে জোরপূর্বক জবাব দিলো জারনাব।

শব্দ করে হেসে উঠলো জিদান। সাঙ্গোপাঙ্গদের দিকে চেয়েও হাসলো কতক্ষণ। আচমকা হাসি থামিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। তার খুব কাছে এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বলল, “ভয় পাস নাই? বোন খুব সাহস জুগিয়েছে দেখছি। তা কোথায় তোর বোন? গতর বেচতে গেছে নাকি আমার ভয়ে লুকিয়ে আছে ঘরের কোনায়?”

কিছুই বলল না জারনাব বরং আরো খানিক পিছিয়ে গেল। পুনরায় চেঁচিয়ে উঠলো জিদান। খপ করে শক্ত হাতে চেপে ধরলো জারনাবের হিজাবের বাড়তি অংশ। হিং’স্র চোখে চেয়ে বলল, “বল? কোথায় ঐ শা’লি? বোনকে কোন গর্তে লুকিয়েছিস আমার ভয়ে?”

“ওর বোন এখানে। ভুলভাল জায়গায় খুঁজলে হবে?”

চমকাল জারনাব। জোভিয়াকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয় আরো কয়েক ধাপ বাড়লো তার। সে করুন দৃষ্টিতে তাকালো বোনের দিকে। যার অর্থ: কেন এলে তুমি এখানে? এখন তোমাকে কীভাবে লুকাবো আমি?

জারনাবের হিজাব চেপে ধরে রেখেই ফিরে তাকালো জিদান। জোভিয়ার দিকে এগিয়ে এসে কিছু বলবে তার পূর্বেই ভেসে এলো জোভিয়ার শান্ত কন্ঠস্বর।

“বুবুর হিজাব ছাড়।”

তার শান্ত দৃষ্টির মাঝেও যেন আগুনের উজ্জ্বল ফুলকি লুকিয়ে আছে। জিদান লক্ষ করলো সেই দৃষ্টি। তবে ভয় পেল না সে। ভয় পাওয়ার কী আছে? সামান্য মেয়ে মানুষ! তুচ্ছ করেই তাকে দেখলো সে। মনে মনে ভেবে নিলো আজ এই মেয়ের সমস্ত ডেমাগ ভাঙবে সে। ভরা বাজারে তার শরীরে হাত তোলার মূল্য চোকাবে আজ। শুধুমাত্র এই সাম্রাজ্যে গালাগালি সম্পর্কিত কঠিন নিয়মের কারনে নোংরা ভাষায় গালাগালি করতে পারছে না সে। তাই তার রাগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে ভেতরে ভেতরে। আজ তা উগলে দেওয়ার সুযোগ এসেছে। সে আরো শক্ত করলো হাতের মুঠো। জারনাবের হাতের থলেদুটো হাত থেকে পড়ে গেছে বেশ খানিক পূর্বেই। জিদানের শক্ত হাতের টানে কাঁধের উপর থেকে সরে এসেছে হিজাব। ব্যস্ত হাতে হিজাবখানা চেপে ধরলো জোভিয়া। অন্য হাতে জোড়ে সোরে ধাক্কা মারলো জিদানের বুকে। আকস্মাৎ আক্রমণে হিজাব ছেড়ে কয়েকপা পিছিয়ে গেল জিদান। হতবাক নয়নে তাকালো জোভিয়ার দিকে। একটা মেয়ের শরীরে এতো শক্তি। যেন কঠিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সে!

চিৎকার করে উঠলো জোভিয়া, “বেয়াদবি করেছিস তুই আর তোর শরীরে হাত তুলেছি আমি। বুবুকে কেন টানাহ্যাঁচড়া করছিস মাঝখানে?”

নিজের হিজাব আকড়ে ধরে ছলছল নয়নে চাইল জারনাব। তার ইজ্জত তার সম্বল। সেখানে কেউ হাত দিলে সহ্য করা বড় কঠিন হয়ে পড়বে তার জন্য। জোভিয়ার কথাতে জিদান যেন নতুন কোনো সংকেত খুঁজে পেল। জোভিয়ার দিকে চেয়ে কিঞ্চিত বাঁকা হেসে টেনে ধরলো জারনাবের হিজাব। আচমকা ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে ছিটকে পড়লো সে। হিজাব টেনে ধরা তার হাতটা বেয়ে গলগলিয়ে রক্ত ঝড়ছে। সম্মুখেই ছোট্ট একটা ছুড়ি হাতে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জোভিয়া। ছুড়িটা আকারে খানিক ছোট হলেও তা অধিকতর ধারাল। এতক্ষণ এটা কারোর দৃষ্টিগোচর হয়নি। বোধহয় লুকিয়ে রেখছিল জোভিয়া। জিদানের সাঙ্গোপাঙ্গগুলো রেগেমেগে জোভিয়ার দিকে এগিয়ে আসলো তাকে আঘাত করতে। তার পূর্বেই হাওয়ার বেগে জিদানের সামনে এসে দাঁড়াল জোভিয়া। হুট করে সে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে কৌশলে ছুড়িটা ধরে বসলো জিদানের গলায়। জোরালোভাবে ধরার কারনে চেপে ধরা মাত্রই কিঞ্চিত কেটে গেল স্থানটা। ক্ষতটা সামান্য তবে রক্ত পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা। আকস্মাৎ আক্রমণে চোখদুটো বড়বড় করে তাকালো জিদান। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে গেল জারনাব। নিজের বোনের এমন ভয়ঙ্কর রূপ সম্পর্কে অবগত নয় সে! তার দিকে হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে রইল জিদানের সাঙ্গোপাঙ্গগুলোও। সাধারণ এক নারীর এমন রূপ সকলের নিকট আশ্চর্যজনকই বটে!

শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো জোভিয়া। সাঙ্গোপাঙ্গদের উদ্দেশ্য করে কিঞ্চিত ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “সরে দাঁড়া।”

বলা মাত্রই দু’পা পিছিয়ে এলো তারা। যার কারন জিদানের গলায় ধরে রাখা ধারাল ছুড়িটা ধীরে ধীরে দেবে বসছে তার চামড়ার উপর। হেলদোল নেই জোভিয়ার। চারপাশের সমস্ত কোলাহল যেন মুহুর্তেই থেমে গেল। সে পূর্বের মতোই শক্ত হাতে ধরে আছে ছুড়িটা। এখনো ঘোর কাটেনি জিদানের। সে নির্বাক হয়ে দেখে যাচ্ছে জোভিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ। জোভিয়াকে তেজী ভেবেছিল সে। কিন্তু বিন্দুমাত্র ধারনা করতে পারেনি সে এতোটাই ঝাঁঝালো হবে যে তা গলাধঃকরণ দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে! হঠাৎ ধ্যান ফিরতেই সে হ্যাঁচকা টানে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। বিচলিত হলো না জোভিয়া বরং হাতে থাকা ছুড়িটা ছুড়ে মারলো কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে উদ্দেশ্য করে। ছুড়িটা গিয়ে নিখুঁতভাবে গেঁথে বসলো কৃষ্ণচূড়ার ডালের ওপর।

সকলে অবাক হলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। শ্রবণগোচর হলো একাধিক ঘোড়ার খুড়ের শব্দ। চকিতে তাকালো জিদান। সুলতানের সৈন্যবাহিনী আসছে এদিকে। দূর থেকেই তাদের সাজ-পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ছুড়ি ফেলে দেওয়ার কারন উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো সে। কটমট করে তাকালো জোভিয়ার দিকে। অধর জোরা প্রসারিত করলো জোভিয়া। সৈন্যবাহিনীর দিকে নজর দিলো না সে। জারনাবের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে হাসিমুখেই তাকালো জিদানের দিকে। খসখসে গলায় বলল, “আবার দেখা হবে জিদান। বারবার এভাবে প্রাণ নিয়ে ফেরা হবে না কিন্তু। কাউকে না কাউকে নিজের সমাধি খুঁড়তেই হবে। আমার এখনো জীবনে অনেক অসমাপ্ত কাজ রয়েছে। যেগুলো পূর্ণ করা অতিব জরুরী। সমাধিক্ষেত্রটা বোধহয় তোমার জন্যই নির্ধারণ করা রয়েছে।”

ঘোড়ার খুড়ের শব্দ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। সৈনিকরা তাদের খুব কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে বুঝতে পেরে জারনাবের হাত ধরে ফটকের ভেতরে ঢুকে পড়লো জোভিয়া। রেখে গেল অনাকাঙিক্ষত কিছু ভাবনা, কিছু প্রশ্ন আর কিছু অজানা রহস্য। সৈন্যবাহিনীর কারনে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলো জিদানসহ তার সাঙ্গোপাঙ্গ।
_________________________________

মহলের দেয়ালে দেয়ালে সাজ-সাজ রব। সুলতানের বিবাহের আলাপ গোপনে চললেও ধীরে ধীরে মহলকে নতুন করে সাজিয়ে তুলছেন ওয়াসিফা সুলতান। কারন হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ইদ। ইদের জন্য মহলের এই নতুন রূপ। মহলের বাইরের সফেদ রং নতুন করে প্রলেপ লেপে চকচকে করা হয়েছে। বদলানো হয়েছে নানান আসবাবপত্র। বাদ যায়নি বহু পুরনো সৌন্দর্যমন্ডিত ঝাড়বাতিটাও। সবই হচ্ছে ওয়াসিফা সুলতানের কথা মোতাবেক। তাই অন্য কারোর সেখানে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। সেবক-সেবিকারা রোজকার ন্যায় তাদের কর্মে ব্যস্ত। তোহফা আছে তার ফুফুজানের সাথে। শেহজাদি তানহা এক মুহুর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করে না তাকে। মায়ের অভাব খুব সূক্ষ্মভাবে পুরণ করে দেয় সে। তোহফা নিজেও ফুফুজানের কাছে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। খাবার হাতে ঘুরে ঘুরে তোহফাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে তানহা। মহলের ঠিক মাঝ বরাবর গোলাকার স্থানটাতে এসে বসে পড়লো সে। তোহফাকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো। খাবার মুখে তুলে দিতে চাইল নিজ হাতে অথচ ছোট্ট তোহফা মানতে নারাজ। সে সবার সঙ্গেই খাবে। একা একা কেন খাবে? শেহজাদি তানহা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আজ তো সবাই রোজা। রোজা থেকে কিছু খেতে নেই, মা।”

ঠোঁট উল্টালো তোহফা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল তার দিকে। তার না বলা কথাগুলো বোধহয় বুঝে নিলো তানহা। মুচকি হেসে বলল, “আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সারাদিন সমস্ত পাপকার্য এবং খাওয়া থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলা হয়। অর্থাৎ সিয়াম। রমজান মাসে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের জন্য রোজা রাখা ফরজ। তুমিতো এখনো অনেক ছোট। বড় হলে তোমাকেও রোজা রাখতে হবে তখন তুমিও সকলের সাথে না খেয়ে থেকো, কেমন? এখন সুন্দর করে লক্ষী বাচ্চার মতো খেয়ে নাও তো।”

মাইরা ঘুরে ঘুরে দেখছে সবকিছু। মাঝে মাঝে নিজের ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করছে আলতো করে। আচমকা একজন সেবক এসে জানালো সুলতান তাকে ডেকেছেন। অবাক হলো মাইরা। সুলতান ডেকেছেন! হঠাৎ!

চলবে………