সাজু ভাই পর্ব-০৮

0
1724

#সাজু ভাই (পর্ব:-০৮)

– সাজু ভাই বললেন, যদি আর কোন মেয়ে লাশ হয় তাহলে রুহিকেও আমি লাশ বানিয়ে দেবো। ভেবেছিলাম বেশি বড় গেইম খেলতে হবে না কিন্তু সেটা ভুল ছিল, আমিও পুরোপুরি তৈরী হয়ে তোর মোকাবিলা করতে চাই।

– ঠিক আছে দেখা যাবে কি করতে পারিস।

লোকটা কল কেটে দিল, সাজু ভাই তখন হাতের মোবাইল রেখে চুপ করে চোখ বন্ধ করলো। হাসান এতক্ষণ ধরে শুনছিল, সেও সাজুর মতো গভীর ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল।

একটু পরে সাজু মোবাইল বের করে মেসেঞ্জারে গিয়ে লম্বা এক মেসেজ লিখলো তারপর পাঠিয়ে দিল গন্তব্যে। হাসান তখন বললোঃ-

– মামলা অনেক পেঁচিয়ে যাচ্ছে সাজু, এখন কিন্তু আমাদের বিপদে পরার সম্ভবনা বেশি।

– সেটা আমিও ভেবেছি হাসান ভাই, কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। মোটামুটি নিশ্চিত হয়েও তেমন কিছু করতে পারি না কারণ প্রমাণ ছাড়া সবকিছুই বিফল। এ পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায় তো কতই স্থান হলো কিন্তু পাকাপোক্ত ভাবে তো কাউকে পাচ্ছি না। আবার যাকে টার্গেট করলাম তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই, তাছাড়া কেউই বিশ্বাস করবে না।

– সত্যি সত্যি যদি আজকে রাতের মধ্যে আরেকটা মেয়ে খুন হয়ে যায় তাহলে কি করবা সাজু?

– আপনি নিশ্চিত থাকুন, আজকে রাতে কেউ খুন হবে না কারণ রুহি আমাদের হাতে।

– সেটা তো আমাদের সন্দেহ, কিন্তু সন্দেহ যদি সত্যি নাহয় তাহলে তো আসল খুনি ঠিকই খুন করে দেবে।

– কিন্তু হাসান ভাই…

– দেখ সাজু, আমার মনে হচ্ছে খুনি আমাদের নিয়ে একটা পরিকল্পনা করেছে। সুক্ষ্ম একটা সন্দেহ তৈরি করেছে যেন আমরা সেই অনুযায়ী চলতি থাকি।

– কিন্তু কি করবো হাসান ভাই? যেকোনো একটা পথ ধরে তো সামনে যেতে হবে, যদি থেমে থাকি তাহলে তো চলবে না।

– ভুল পথে না হেঁটে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কিন্তু অপেক্ষা করা ভালো, নাহলে ভুল পথে যতটুকু হাঁটবো ততটুকু পিছনে আসতে হবে। মনে করো, আমরা খুনির পিছনে পিছনে যাচ্ছি, হঠাৎ করে রাস্তা দুই দিকে চলে গেছে। এখন আমরা যদি তারা যে রাস্তায় গেছে সেদিকে না গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে যাই তাহলে তো বিপদ। যদিও দেরিতে বুঝতে পারবো কিন্তু ততক্ষণে তারা কিন্তু চলে যাবে নাগালের বাইরে।

– কালকে সকালে প্রথম শিকার হওয়া মেয়ে শারমিনের স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমার মনে হয় সেখানে কিছু পথ বের হতে পারে, কারণ তার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করিনি। তাকে সেই প্রথম দিনে এরেস্ট করার পরে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

– ঠিক আছে তাই হবে।

বাতি বন্ধ করে হাসান সাহেব ঘুমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিন্তু সাজু ভাই মাথায় হাত দিয়ে অন্ধকার পর্যবেক্ষণ করছেন। ঘড়িতে যখন রাত তিনটা বাজে, তখনও সাজু ভাই সজাগ ছিল, তারপর সে কখন ঘুমিয়ে গেছে নিজেই জানে না।

– – – – –

এদিকে, জামিল চোরার কথা শুনে চেয়ারম্যান ও তার মেয়ে পারুল দুজনেই থানায় এসে হাজির হলো সন্ধ্যা বেলা। জামিল চোরা সবকিছু আস্তে আস্তে খুলে বললো, সবকিছু শুনে চেয়ারম্যান ও তার মেয়ে পারুল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে।

– পারুল আস্তে করে বললো, সাজু ভাই লোকটা একটা গভীর জলের মাছ। নিজে এতকিছু ঘটিয়ে আমাদের জড়িয়ে দিচ্ছে, কতটা খারাপ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমাদের। খুনি ধরার জন্য আমি খুনিকেই নিজের হাতে রান্না করে দিছি, ইস কি লজ্জা কি লজ্জা।

– চেয়ারম্যান বললো, তুমি সেই কাগজে লেখা সবকিছু বলতে পারবে?

– জামিল চোরা বললো, স্যার আমার কাছে ওই কাগজের আরেকটা কপি আছে। আসলে আমি একবার হারিয়ে ফেলছিলাম, বাস থেকে নেমে চা খেতে গিয়ে রেখে চলে আসছিলাম। তারপর যখন আবারও ফিরে পেলাম তখন সঙ্গে সঙ্গে একটা ফটোকপি করে রেখেছি। আসল কপি দারোগা সাহেবের কাছে দিলাম কিন্তু ফটোকপি আছে আমার সঙ্গে।

দারোগা সাহেব সাজুদের সঙ্গে আলোচনা করে যখন থানায় আসলেন তখনই তাকে ধরে আটক করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কাছে চেয়ারম্যান সবকিছু কল দিয়ে জানিয়েছে তাই তিনি থানায় কল দিয়ে তাকে আটকাতে বলেছেন। দারোগার হাতের মোবাইল কেড়ে নিল এবং সাজু ভাইয়ের খোঁজ বের করতে বললো। দারোগা তখন বুদ্ধি করে বলেছিল যে ” সাজু ভাই ঢাকা গেছে সন্ধ্যা বেলা, কালকে সকালে ফিরবে। ”

অপর দারোগার সঙ্গে চেয়ারম্যান সাহেব আলাপ করে বললো;-

– এখন যদি সাজু ভাই টের পায় তাহলে সকাল বেলা গ্রামের মধ্যে নাও আসতে পারে। তারচেয়ে বরং দারোগাকে আটকে রাখুন এবং সকাল বেলা দারোগাকে দিয়ে কল করিয়ে থানায় আসতে বলবেন।

সিদ্ধান্ত সেটাই বহাল রইল, সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যেন এই খবর কাউকে জানানো না হয়। মোতালেব দারোগা মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছেন, সকাল বেলা তাকে সত্যি সত্যি বাধ্য হয়ে কল দিতে হবে। আর সে কল দিলে সাজু ভাই এবং হাসান সাহেব সঙ্গে সঙ্গে থানায় উপস্থিত হবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা আসলেই তো বিপদ ঘিরে ধরবে, তাহলে কি এভাবেই আসল খুনি পার হয়ে যাবে?

,
,

গভীর রাতে ঘুমানোর জন্য সাজু ভাইয়ের ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হলো, হাসান সাহেব সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাহিরে গিয়ে নাস্তা করে আসলেন। নাস্তা অর্ধেক শেষ করে হোটেলের মধ্যে একটা আলোচনা শুনে দৌড়ে রুমে এলো। রুমের মধ্যে এসেই সাজু ভাইকে ডেকে জাগ্রত করলেন আর বললেনঃ-

– সাজু ভাই রুহির আরেকটা বান্ধবী খুন হয়েছে, বলেছিলাম না খুন হবে? ইসস যদি তখন রাতেই দারোগা সাহেবের সঙ্গে বলতাম তাহলে হয়তো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারতো।

– সাজু ভাই আশ্চর্য হয়ে সদ্য ঘুম থেকে উঠে চোখ ফোলা ফোলা করে তাকিয়ে রইল। তার যেন এই কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যি সত্যি কি আরেকটা খুন হয়েছে?

– হ্যাঁ সাজু, নাস্তা করতে গিয়ে শুনলাম সবাই বলাবলি করছে।

– কি?

– আজকে সকালে ফজরের আজান দেবার পরে মেয়েটার বাবা বাইরে বের হয়েছে আর তখনই খুনি ঘরে ঢুকে খুন করে চলে গেছে। কারণ মেয়ের দাদি দেখেছিল একটা লোক কালো পোশাক পরে উঠোন দিয়ে চলে যাচ্ছে।

– আশ্চর্য লাগলো হাসান ভাই।

– এখানে আশ্চর্যের কি আছে? আমাদের সন্দেহ সঠিক নয় সাজু, আবারও ভাবতে হবে। চলো এই মুহূর্তে দারোগা সাহেবের কাছে গিয়ে কথা বলতে হবে তারপর শারমিনের স্বামীর কাছে যাবো।

সাজু ভাইয়ের মোবাইল বেজে উঠল, নাম্বার দেখে অবাক হয়ে গেল সাজু। গতকাল রাতে যে নাম্বার দিয়ে কল করা হয়েছে সেই নাম্বার দিয়ে কল এসে গেছে। সাজু রিসিভ করলোঃ-

– হাহাহা হাহাহা সাজু ভাই নাকি সাজু আপা?

– মানে?

– যেভাবে নামের পদবি সাজুর সঙ্গে ভাই যুক্ত করছো তাতে মনে হয় বিরাট কিছু, কিন্তু কাজের বেলা তো মেয়ে মেয়ে ভাব তাই বললাম সাজু আপু।

– আজকে রাতে আরেকটা খুন করে দিলি?

– কি করবো সাজু? আমি তো তোকে বলেছিলাম যে আরেকটা মেয়ে খুন হবে, তাই নিজের দেওয়া কথা রক্ষা করেছি। হিহিহি অবাক হচ্ছ?

– হ্যাঁ কিছুটা।

– ঠিক আছে সাজু ভাই, ভালো থেকো।

– তোমার দিন ফুরিয়ে গেছে।

– না সাজু ভাই আমার দিন শুরু হচ্ছে কিন্তু তুমি তোমার দিন ফুরিয়ে গেছে সেটা হিসাব করো। গতকাল রাতে রুহির বান্ধবী খুন হয়েছে এটার চেয়ে আরেকটা বড় খবর আছে।

– মানে কি?

– রুহি এখন আমাদের কাছে হাহাহা।

– কি…? মানে কি?

– রুহির লেখা সেই কাগজের মাধ্যমে তোমাকে মনে হয় আজকেই জেলে যেতে হবে সাজু ভাই। তোমার জন্য বড় আফসোস হচ্ছে।

– তুই রুহিকে কীভাবে খুঁজে পেলি?

– এটাই যে আসল খেলা সাজু ভাই। বায় বায়।

,
,

কল কেটে গেল, সাজু ভাই তাড়াতাড়ি মোবাইলে তানিয়ার নাম্বার বের করলো। তানিয়ার কাছেই তো রুহি ছিল তাহলে তাকে সত্যি সত্যি আবারও নিয়ে গেছে খুনি? আর সেজন্যই মনে হয় বান্ধবী খুন হয়েছে, কারণ রুহিকে পেয়ে গেছে তাই।

৮/১০ বার কল দেবার পরে তানিয়া রিসিভ করে এমন করুণ স্বরে হ্যালো বললো যে সেটা শুনেই সাজু বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়ে গেছে।

– সাজু ভাই বললো, তুমি ঠিক আছো তানিয়া?

– আমাকে ক্ষমা করবেন সাজু ভাই।

– কি হয়েছে গতকাল রাতে? আর তুমি আমাকে রাতে কেন জানাওনি?

– আমি কঠিন অসুস্থ, আমার মাথায় আঘাত করেছে রুহি।

– ওকে আনতে কে গেছিল?

– কেউ আসেনি, বাড়িতে তো অপরিচিত কাউকে প্রবেশ করতে দেবে না। রুহি নিজেই বের হয়ে গেছে বাসা থেকে।

– কিন্তু কীভাবে?

– রাত দেড়টার দিকে হঠাৎ করে কিছু ভাঙ্গার শব্দ শুনে আমি রুহির রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে সে শব্দ করছিল, আমি বারবার ডাকার পরে হঠাৎ করে দরজা খুলে দিল। কিন্তু আমি যখনই প্রবেশ করলাম ঠিক তখনই আমার মাথায় আঘাত করে রুহি।

– কি দিয়ে আঘাত করেছে?

– খাটের তোষকের নিচে যে কাঠের চালনা সেই চালনা ভেঙ্গে কাঠ বানিয়েছে। আর সেটা দিয়ে আঘাত করেছে আমাকে, আমি তখন অজ্ঞান হয়ে গেলাম৷ রুহি তখন দরজা খুলে সরাসরি নিচে গিয়ে দারোয়ানকে গেইট খুলতে বলে। কিন্তু সেই সময় দারোয়ান তাকে বের হতে দেবে না, তখন রুহি বললো আমি নাকি খুব অসুস্থ এবং ফ্লোরে পরে মাথা কেটে গেছে। বাসায় স্যাভলন নেই বলে সে বাইরে যাচ্ছে, দারোয়ান তখন গেইট খুলে দিয়েছে। কিন্তু রাতে আর রুহি ফিরে আসেনি বলে দারোয়ান সন্দেহ করেছে এবং আমার ফ্ল্যাটে এসে দরজা খোলা দেখে অবাক হয়ে গেল।

– বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমিতো আমাকে জানাতে পারতে তানিয়া।

– আসলে জ্ঞান ফেরার পর থেকে আশেপাশে অনেক মানুষ ছিল তাই কল করিনি। এখন আমি বাথরুমে বসে কথা বলছি কারণ ফ্ল্যাটে অনেক মানুষ আছে।

– ঠিক আছে তুমি থাকো আমি দেখছি।

কল কেটে দিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেল সাজু ভাই, সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। তার পরিকল্পনা সবকিছুই খুনি ভেস্তে দিয়েছে, তাকে হার মানিয়ে দিচ্ছে খুনি। সাজু ভাই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে তৈরি হচ্ছে এবং হাসান সাহেব কে বললোঃ-হাসান ভাই তৈরি হন আমরা থানায় গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি দারোগা সাহেবের সঙ্গে দেখা করি।

বের হবার মুহূর্তে দারোগা সাহেবের নাম্বার দিয়ে কল এসেছে। সাজু রিসিভ করে বললোঃ- স্যার আপনার কাছেই আসতেছি আপনি বরং অপেক্ষা করুন।

দারোগা সাহেবকে কিছু বলতে সুযোগ না দিয়ে ওরা রিক্সা নিয়ে থানায় চলে গেল। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করেই সাজু ভাই ও হাসান সাহেব অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

– চেয়ারম্যান সাহেব বললো, এসো সাজু ভাই তাড়াতাড়ি এসো। তোমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছি আর তোমরা মাত্র আসলে?

– একটা পুলিশ বললো, কালকে রাতে আপনারা কোথায় ছিলেন?

– বাসায়, কেন?

– ওমা তাই নাকি? তাহলে মোতালেব দারোগা যে বললো তোমরা নাকি ঢাকা গেছো? তারমানে মিথ্যা বলেছে?

– পারুল বললো, মিথ্যা বলবে না কেন? দারোগা সাহেব তো জানতেন যে আজকে রাতে আরেকটা খুন হবে। তাই তিনি আগে থেকে সবাইকে বলে দিয়েছে যে এরা ঢাকা গেছে। যাতে করে সবাই প্রশ্ন করলেও এরা বলবে ” আমরা তো ঢাকা ছিলাম, দারোগা সাহেব সাক্ষী আছে। ”

– সাজু ভাই বললেন, মানে কি?

– ভোরবেলা রুহির বান্ধবী ঝুমুরকে খুন করেছেন আপনি, চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে।

– সাজু ভাই বললেন, রাতে টেনশনে ঘুমাতে পারি নাই তাই চোখ ফুলে গেছে।

– চেয়ারম্যান বললো, কুত্তা…বা… খুন করে রাত জেগেছে আবার বলে ঘুমাতে পারি নাই।

.
চলবে…?
লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)