সায়র পর্ব-০১

0
642

#সায়র
#সূচনা_পর্ব
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

কুয়াশাচ্ছন্ন মধ্যরাত। নিস্তব্ধ রাস্তায় কুয়াশার চাদর ছিন্ন করে উজানের কালো রঙের ফেরারীটি এগিয়ে চলছে তার গন্তব্যে। গাড়ির বাতি নেভানো। প্লেলিস্টে চলছে Blue Christmas গানটি।

I’ll have a blue Christmas without you
I’ll be so blue just thinking about you
Decorations of red on a green Christmas tree
Won’t be the same dear, if you’re not here with me…

উজানের চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ পিচঢালা রাস্তায়। আচমকা গাড়ির সামনে একজন রমণীর অবয়ব সামনে আসতেই সজোরে ব্রেক কষলো উজান। মেয়েটি গাড়িটিকে সাইড দিয়ে ফুটপাতে যেতে চাইলেও পারে না। হাঁটার ভঙ্গি এলোমেলো, যেন এক্ষুনি পড়ে যাবে। উজান বিরক্ত বোধ করলেও মুখভঙ্গি নিষ্প্রাণ রাখল। এখানে গাড়ি চলাচল খুবই কম। তাই গাড়িতে বসে সবটাই স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল সে, কিন্তু সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি।

নিয়নের কুয়াশাচ্ছন্ন মৃদু হলদে আলো যখন মেয়েটির হাতের কাছে এসে পড়ল, তার গায়ের শীতের কোট দেখেই উজানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সহজেই ঠাহর করে নিল মেয়েটি কে হতে পারে। সে ধীর পায়ে নামল গাড়ি থেকে। সে এগিয়ে যেতে লাগল উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকা মেয়েটার দিকে। শীতের সূক্ষ্ম সূচের কাঁটা তার ভারী সোয়েটার ভেদ করে কাষ্ঠ দেহে পৌঁছাতে পারল না, প্রতিটি নিঃশ্বাস ধোঁয়া হয়ে তার মোটা ফ্রেমের চশমা ঘোলা করে দিল।

একহাত বাড়িয়ে মেয়েটির বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরালো উজান। তৎক্ষণাৎ ঘুরতে পারল না মেয়েটি। শক্তিহীন হাতে উজানের হাত সরাতে গিয়েই পিছনে ফিরল সে। মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জ্বলজ্বল করা চোখের উজানকে দেখে যেন সে আশার আলো খুঁজে পেল। দুর্বল পায়ে উজানের দিকে এক পা বাড়ালো। চোখ বুজে আসছে তার, জড়ানো কন্ঠে বলল,

‘তু…তুমি এসেছো উজি। আমাকে আমার বাসায় পৌঁছে দাও। আ..আর প্লিজ জাওভানকে কিছু বলো না…ও যাতে জানতে না পারে আমি এখানে এসে…’

আর বলতে পারল না সে। জিহ্বা যেন ভারী হয়ে আসছে। চোখ লাল। উজান বুঝে ফেলল তাকে নেশা জাতীয় কিছু খাওয়ানো হয়েছে। সে হাত না ছেড়েই মেয়েটিকে নিয়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। গাড়িতে উঠার সাথে সাথেই মেয়েটি গড়গড় করে বমি করে দিল। পছন্দের ফেরারীকে নোংরা করায় উজান কিছুটা বিরক্তিকর সুরেই বলল,

‘নট ইন মাই কার কিরণ।’

এই বলে দৃঢ় মুঠিতে কিরণের কোটের গলা টেনে বের করে দিলো আবার। সাইডে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,

‘ইউ ক্যান স্টার্ট নাউ।’

আধো মাতাল কিরণের উজানের কথায় কান নেই। কিছুক্ষন অপেক্ষার পরও কিরণ যখন বমি করল না তখন উজান তাকে আবারও গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে দিলো।

উজান কিরণের বাসায় না গিয়ে তার নিজের বাসায় চলে এলো। অবশ্য এটা তার একা না। বাড়ির আরেকজন অংশীদার আছে। ঠিক মেইন গেটের পাশেই সিমেন্টের উঁচু একটি স্তম্ভে আলাদা করে নেমপ্লেট লাগানো – ‘সায়র’।

মেইন গেইট দিয়ে উজানের ফেরারী ভিতরে ঢুকতে গিয়ে থেমে গেল গেটের মধ্যিখানে একজন লম্বা সুপুরুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। জাওভান; ‘সায়রের’ আরেকজন মালিক। জাওভান তার জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যেন তাদের ফেরারই অপেক্ষা করছিল।

দ্রুত পায়ে হেঁটে গাড়ির ফ্রন্ট ডোর ওপেন করল জাওভান। টালমাতাল কিরণকে দেখে খুব বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো। তার রাগ দমন করা দরকার এই মুহুর্তে। কিরণকে কোলে নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই কিরণ দ্বিতীয়বারের মতো পরপর দুবার বমি করল। এবার তার জামাকাপড় সহ উজানের গাড়ির অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়ে গেল। উজান ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকাল। এখন যদি এটা মাঝ রাস্তা হতো সে অবশ্যই কিরণকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতো। কিরণ ভাগ্য ভালো সে বাসায় এসে গেছে। ঘৃণা লাগল না শুধু আরেকজনের, জাওভানের। সে হাত বাড়িয়ে কিরণকে কোলে তুলে নিলো। বমি তার জ্যাকেটেও লেগে গেল। সেদিকে খেয়াল নেই তার। তার চোখে রাগের পরিবর্তে এখন উৎকণ্ঠা।

ঘরে এসে জাওভান কিরণকে নিজের রুমে নিয়ে আসে। এর মধ্যে কিরণ আরো একবার বমি করে ফেলেছে। জাওভান দেরি না করেই কিরণের কোট খুলে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে। ততক্ষণে উজান দরজার কাছে চলে এসেছে, সে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

‘কি করতে যাচ্ছিস তুই?’

জাওভান অস্থির গলায় বলে,
‘কিরণ তো বমি করে সব ভরিয়েছে। শার্ট না খুললে তো গায়ে লেগে যাবে। কিরণ এসব কত ঘৃণা করে জানিস!’

এই বলে সে আবারও বোতামে হাত দেয়। উজান আবার আটকায়। ধীর কন্ঠে বলে,

‘তোদের বিয়ে হয়নি জুভ। এখন যদি তুই ওর অজ্ঞান অবস্থাতে চেঞ্জ করে দিস তাহলে ও কি ভাবতে পারে?’

জাওভান বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাল।

উজান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। বলল, ‘আচ্ছা, তোর কাজ তুই কর।’

জাওভান কিরণের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। কিরণের মুখটা ফ্যাকাশে, একটু বাদে বাদে হাত পা নাড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলছে। উজান রুমের বাইরে যাওয়ার আগেই জাওভান ডাক দেয়।

‘তাহলে ওকে ধর, আমি পরিষ্কার করে দেই অন্তত।’

‘শোয়া অবস্থাতে করিয়ে দে।’

‘দেখছিস না কেমন নাচছে! পুরো গা ভরাবে আবার। ধর।’

কিরণকে নিয়ে জাওভান সামনে এগোলে উজান দূরে সরে যায়। চোখেমুখে ঘৃণার ছাপ, যেন এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য বস্তুটি তার চোখের সামনে। বিরক্তিকর আওয়াজ করে বলল,

‘আমি ধরতে পারব না ওকে।’

রাগী চোখে তাকায় জাওভান, ‘ধরলে প্রবলেমটা কি?’

‘আমার ভালো লাগে না।’

‘তোর শালা কোনো মেয়েকেই জীবনে ভালো লাগে না।’

উজান চলে যেতে লাগল, জাওভান পেছন থেকে ডাকল,

‘কিছু একটা ব্যবস্থা তো কর!’

উজানের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। জাওভান কি করবে ভেবে পেল না। কিরণকে সোজা করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল, আর ভাবতে লাগল কি করা যায়।

কিরণের দিকে তাকিয়ে ছিল সে একধ্যানে, কিরণের আধবোজা চোখে তাকিয়ে ভাবার মধ্যেই সে হুট করে কিরণের কপালে চুমু খায়। রিলেশনে তাদের এই প্রথম চুমু, এর আগে শুধু হাত ধরা আর আলতো জড়িয়ে ধরা হয়েছে। সে কি ঠোঁটে একবার চুমু খাবে? আলতো করে? নাহ!

তর্জনী দিয়ে একবার চোখ, নাক, গাল, ঠোঁট স্পর্শ করে কিরণের। তার হাত কেমন কাঁপছে। কিরণকে যেন সে নতুন করে আবিষ্কার করে প্রতিনিয়ত। কিরণ তো জানে না, জাওভান যতবার কিরণের হাত ধরে, ওর চোখে তাকায় ততবার জাওভানের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। ভালোলাগার প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় হৃদয়ের আঙিনায়। কিরণ আসার পর তার জীবন বদলেছে, ভালোবাসতে শিখিয়েছে। সে চায় না কিরণ অন্য কাউকে তার মতো ভালোবাসুক, মিশুক, আগলে রাখুক। সে চায় এই মেয়েটি সারাজীবন শুধু তাকেই ভালোবাসবে, অন্য কাউকে না। তাই তো প্রথম থেকেই জোর করে মেয়েটিকে বেঁধে রেখেছে। যেন কিরণ তাকে ছেড়ে কখনো না যায়। আর যদি যায়, সেদিন হবে কিরণের জীবনের শেষ দিন।

তার ভাবনার মাঝেই উজান একটা মেয়ে নিয়ে ভেতরে ঢুকে বলে,

‘জাওভান, বের হ। ইয়ানাকে নিয়ে এসেছি, ও চেঞ্জ করে দিবে কিরণকে।’

জাওভানের ঘোর কাটে, ‘থ্যাংকস।’

উজান নির্বিকারই রইল। বের হওয়ার সময় জাওভান তার টিশার্ট ও ট্রাউজার ইয়ানার দিকে ছুঁড়ে মেরে ইয়ানাকে আঙুল তুলে শাসাল,

‘ইয়ানা, আমার টিশার্ট আর ট্রাউজার পরিয়ে দিবি। আর আমার কিরণের গায়ে যাতে একটা আঁচড়ও না লাগে, তোর রাক্ষসী নখ সামলিয়ে রাখবি।’

ইয়ানা চোখ উল্টিয়ে মুখটাকে বিকৃত ভঙ্গি করল। তাচ্ছিল্য গলায় বলল,

‘বুঝলাম।’

ড্রয়িং রুম বড় হলেও আসবাবপত্র খুব কম। ঘরের সাজ প্রাচীন যুগের একটা ভাব এনে যেয়। গ্রে রঙের ছোট ছোট লতার কারুকাজের এক সেট সোফা। তার পাশে একটি লম্বা ল্যাম্পসেড। মাঝারি সাইজের একটা ফিনিক্স পাখি দুহাত মেলে ছোটো হলদে একটা বাতিকে আকড়ে ধরে আছে। এটা বানিয়েছিল উজান। উজানের আর্ট করা ডিজাইনের হলেও জাওভানের যথেষ্ট অপছন্দ, তার মতে ড্রয়িংরুমটা অন্তত মডার্ন হওয়া চাই। সিম্পল জিনিস এনেও তো অ্যাস্থেটিক একটা ভাব আনা যায়। কিন্তু উজান যেহেতু বানিয়েছে, সেটা তো আর না করা যায় না। দুপাশের দেয়ালে বড় দুইটি বিমূর্ত ফুলের ফটোফ্রেম। ছোট একটি ক্যাবিনেট যার উপর হারিকেনের মতো ও বাটির মতো দেখতে দুটি শোপিস। আর মেঝেতে বড় একটি কার্পেট। এখান থেকে রান্নাঘর সোজাসুজি দেখা যায়।

জাওভান আর উজান বের হয়ে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসল। জাওভান সোফায় হেলান দিয়ে বসে মুখে হাত মালিশ করতে থাকে। উজান জাওভানকে একবার দেখে নিল। জাওভান বলে,

‘কার কাজ এসব?’, কন্ঠ তার শীতল।

‘সাদমান।’

জাওভান কিছু বলল না আর। জানালার লম্বা পর্দার দিকে তাকিয়ে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গভীর ভাবনায় ডুবল। উজান একহাতে চশমা ঠিক করে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলে,

‘যা ভাবছিস তা ভুলেও করতে যাবি না।’

জাওভান যেন তেড়ে উঠল,

‘হোয়াট দ্য হেল ম্যান! আমি ঐ কু’ত্তার বাচ্চাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেব না। আমার কিরণের দিকে নজর দিয়েছে ও।’

উজান শান্ত গলায় বলল,

‘জুভ, তোর চরিত্রের এই দিকটা কিরণের অপছন্দ তুই ভালো করে জানিস।’

জাওভান ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

‘যেটাই হোক। ওকে আমি দেখে নেব।’

‘এর আগেরবারের কথা মনে আছে? এরকম একটা কান্ডের জন্য কিরণ কিন্তু তোর সাথে এক সপ্তাহ কথা বলেনি।’

জাওভান রেগে উঠে দাঁড়াল। গ্লাসটা একধাক্কায় ফেলে দিয়ে বলল,

‘রিডিকিউলাস!’

বলেই সে এট্যাচ করা মিনি ছাদে চলে গেল। উজান টি টেবিলের নিচ থেকে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে চোখ বুলাতে লাগল। ড্রয়িংরুম পার হয়েই জাওভানের রুম। সেখানে দৃষ্টি পড়তেই দেখল দরজায় বাহু ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে উজানের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে ইয়ানা। দাঁড়ানোর ভঙ্গি আবেদনময়ী। অফ শোল্ডার জামা গলার নিচ পর্যন্ত নেমে আছে, হাঁটু ছেঁড়া জিন্সের জন্য ফর্সা উরু দৃশ্যমান। উজান কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইল ইয়ানার দিকে। ইয়ানার চোখের উপর চোখ পড়তেই ইয়ানা ঠোঁট চোখা করে চুমু ইশারা করল। উজান চোখ ফিরিয়ে আবার ম‌্যাগাজিনে নজর দিল।

উজানের এমন অবিচল রিয়েকশনে ইয়ানা রেগে গেল। উজানের সামনে এসে ম্যাগাজিনটা টান দিয়ে সরিয়ে ফেলল। সোফার দুপাশে হাত রেখে উজানকে বন্দী করে নিল। উজানের দিকে ঝুঁকে আসল, যার ফলে ইয়ানার ক্লিভেজ স্পষ্ট হয়ে উঠল। বলল,

‘তোর সমস্যাটা আসলে কোথায়? সামনে হট একটা মেয়ে দেখেও তোর মধ্যে কোনো ফিলিংস আসলো না! স্ট্রেঞ্জ!’

তারপর উজানের দিকে খানিকটা সন্দেহ ভরা চোখে তাকিয়ে তার কানের কাছে এসে থেমে থেমে বলল,

‘সত্যি বলতো?…তুই কি…ইম্পোটেন্ট?’

এই বলে বাঁকা হাসে ইয়ানা। উজানের দিকে তাকিয়ে তার অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝতে পারল না। বরাবরের মতোই উজানের চোখমুখ শান্ত। সে এবার ইয়ানার কাছে এগিয়ে আসল। খুব কাছে। উজানের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ইয়ানার চোখেমুখে আছড়ে পড়ছে, তার সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠছে উজানের অনাকাঙ্খিত কাছে আসাতে। চোখ বন্ধ করে নিলো সে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে, বুকের ভেতর ঠুকঠুক শব্দে ক্রমাগত হাতুড়ি চলছে। উজান ইয়ানার কাছে এসে জামার দুপাশ ধরে গলা পর্যন্ত টেনে দিলো। তাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। অতঃপর শান্ত কন্ঠেই বলে,

‘আমি ইম্পোটেন্ট নাকি আসল পুরুষ তা তোর মতো সাধুর কাছে প্রমাণ করে লাভ নেই।’

চোখ খুলে ইয়ানা। উজানের জবাবে মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হয় সে। সে তো ভেবেছিল উজান রেগে উঠে এসে ইয়ানাকে চেপে ধরে বলবে, “আমি ইম্পোটেন্ট কি না তোকে প্রমাণ দেখাই চল…”

এটা শুধু ভাবনাই মাত্র। উজানের মতো রসকষহীন ছেলের কাছ থেকে এসব আসা করাও বোকামি।

উজান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে ইয়ানা এসে উজানের কলার চেপে ধরে। উজান যথেষ্ট লম্বা হওয়ায় ইয়ানাকে উঁচু হতে হয়। কলার চেপে ধরে উজানকে ঝুঁকিয়ে আনে। গলায় তেজ ঢেলে বলে,

‘এত এভয়েড করিস কেন আমাকে? এত কিসের ভাব তোর? এত কিসের ইগো? আমাকে তোর ভালো লাগে না কেন? কেন এত ঘৃণা করিস? একবার একটু ভালো করে কেন তাকাস না? আমি কি দেখতে এতটাই খারাপ?’

উজান ইয়ানার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। যথেষ্ট সুন্দরী ইয়ানা। লম্বাটে মুখ, কাঁধ পর্যন্ত সিল্কি চুল, লিপস্টিক ছাড়াও গোলাপী হয়ে আছে ঠোঁট, ফর্সা গায়ের রঙ, আর ফিগারও আকর্ষণীয়। উজান ইয়ানাকে সরিয়ে দিতে গেলে ইয়ানা আরো শক্ত করে চেপে ধরে। তার চোখে বিন্দু বিন্দু জল, ঠোঁট কাঁপছে, ফিসফিস করে বলছে,

‘আমার দিকে একটু ফিরে তাকা না উজান। একটু ফিরে তাকা…’

বলতে বলতে সে উজানের কাছাকাছি এসে পড়ল। উজানের ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠাধর বসাতে গেলেই উজান ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। ছিটকে দূরে সরে গেল ইয়ানা, রাগে অপমানে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। উজান ঠান্ডা স্বরেই বলল,

‘আগে নিজেকে ঠিক কর। তারপর ভেবে দেখব। আর হ্যাঁ, নিজের ড্রেস আপ ঠিক করে নিস। তোর ড্রেসিং সেন্স যথেষ্ট খারাপ। এটা নিউইয়র্ক না যে তুই এভাবে চলবি।’

উজান চলে যায়। ইয়ানা ধপ করে বসে পড়ে সোফায়। রাগে সে তার মাথার চুল ছিঁড়ছে। উজান কেন তাকে একটু ভালোবাসতে পারে না? কেন দূরে সরিয়ে দেয়? উজান কি ভালোবাসাতে একটুও বিশ্বাস করে না? কেন? ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ইয়ানা। একসময় সেই কান্নার আওয়াজ নিস্তব্ধ ফ্লাটে ছড়িয়ে পড়ল।

সায়র এহসান উজান, জাওভান সায়র; খালাতো ভাই দুজন। উজানের মা উজানকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়, বাবা বিয়ে করে নেয় আরেকটা। শেষে উজানের ঠাঁই হয় একমাত্র খালার কাছে। খালার বিয়ের তিন বছর। বাচ্চা না হওয়ায় উজানকে সে নিজের বাচ্চার মতোই ভালোবাসে, আর উজানের নামকরণটাও তিনি করেছেন। উজানকে কখনোই জানতে দেননি যে তিনি আপন মা নন। উজানের যখন তিন বছর তখন সে শুনে তার একটা ছোট্ট ভাই আসবে। ভাইটির নাম রাখা হয় তার নামের সাথে মিলিয়েই। জাওভান সায়র।

ছোট থেকেই দুই ভাই ছিল এক অপরের প্রাণ। এক ভাই আরেক ভাইকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। জাওভানের পাঁচ বছর বয়সের সময় সবাই চলে যায় নিউইয়র্ক। নানুর কাছে থেকে যায় উজান, নানু তাকে কোলছাড়া করতে চাননি বলেই বাধ্য হয়ে থাকতে হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে উজানকেও নিয়ে যাওয়া হতো নিউইয়র্কে, জাওভানের জন্য।

উজান ইন্টারমিডিয়েটে থাকাকালীন জাওভান এসে পড়ে তার কাছে। বাবা মা কেউ থামাতে পারেনি জাওভানকে। জাওভানের একটাই কথা সে ভাইকে ছাড়া থাকবে না। তারপর থেকে দুজনে নানুর কাছেই ছিল। নানু মারা যাওয়ার পর তাদের বাবা এই বাড়িটি কিনে তাদের দুজনের নামে করে দেয়। ভাগাভাগি করে সব কাজ করতো তবুও কেউ কাউকে ছাড়েনি। সেই যে এসেছে… এখনও পর্যন্ত তারা একসাথে। এখনও দুজন দুজনের প্রাণের চেয়ে প্রিয়। জাওভানের প্রতিটা পদক্ষেপের উজানের দরকার হয়, একে অপরের ডানহাত তারা। পৃথিবীতে যদি জাওভান কাউকে অন্ধবিশ্বাস করে তবে তা হলো, তার ভাই, বেস্টফ্রেন্ড, উজান। উজানের ক্ষেত্রেও একই। সে নিজের ছোটভাইয়ের মতোই জাওভানের সকল কাজে ছায়া হয়ে দাঁড়ায়।

বড় হওয়ার পর দুজনে কোনো না কোনোভাবে বুঝে যায় যে তারা আপন ভাই নয়, তবে তা তাদের সম্পর্কে কখনো প্রভাব ফেলেনি। মাঝে মধ্যে কখনো বাবা মায়ের জন্য দুয়েকমাস থেকে আসে তাদের সাথে। আবার মাঝে মাঝে বাবা মা এসে থেকে যায়।

তাদের বাড়িটা ফ্লাট টাইপের। দুই ইউনিট। একটা জাওভানের আরেকটা উজানের। ফ্লাট আলাদা হলেও তাদের খাওয়া দাওয়া ঘুম সব একসাথে। প্রথম দিকে উজান শিল্পী ছিল, তার ছোটো থেকেই আঁকাআঁকি পছন্দ। মনের ভেতরের শব্দগুলো সে আর্টের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলত। একেকটা আর্ট যেন জীবন্ত। তারপর একসময় সে এই আর্টগুলোকে হাতে ছোঁয়ার প্রয়োজন অনুভব করে, ধীরে ধীরে ছোট ছোট আর্টগুলোকে মাটি দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি করত। এরজন্য সে আগে থেকেই ট্রেইনিং নিয়েছিল। তারপর প্রফেশনালি সে একটজন ভাস্কর্য শিল্পী হয়ে উঠে। আর্ট ও ভাস্কর্য করাই যেন তার জীবনে একমাত্র স্বপ্ন। এই দুটো তার জান ও প্রাণ। তার বাহারি রকমের ছবিও ভাস্কর্য দেশে বিদে‌শে লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়।

আর জাওভান মায়ের বিজনেসের একাংশ সামলানোর পর নিজ থেকে কিছু করার চেষ্টায় করত। নিউইয়র্কে নিজস্ব ব্র্যান্ডেড শপ তৈরি করে, নাম দেয় ‘সায়র’। ধীরে ধীরে তা বড় হয়ে উঠে, এখানেও সায়রের শাখা আছে। সেটা আপাতত সে দেখছে। আর নিউইয়র্কেরটাও সে আগে দেখত, কিন্তু নিজের জন্য সময় পেত না বলে বিদেশেরটা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে সে এটা দেখাশোনা করছে। দুই ভাই-ই প্রতিষ্ঠিত।

দুইভাই হলেও তাদের দুজনের চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। জাওভান ছটফটে, চঞ্চল, অপরদিকে উজান শান্ত নিরব একজন মানুষ। জাওভানের নাকের ডগায় রাগ থাকে, একটুতেই মাথা ফাটিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা, নিজের প্রিয় জিনিসের প্রতি কাউকে নজর দিতে দেয় না, আগলে রাখে। আর জাওভানের মতে উজানের স্বভাব শান্ত সমুদ্রের মতো, পুরো ঘটনা শুনে তারপর বাছবিচার করে, কখনোই রাগে না বলতে গেলে, তার প্রিয় জিনিস পছন্দটা যে আদৌ কি সেটা জাওভান এখনও জানতে পারেনি, কারণ জাওভান যেটাতেই খুশি হয়েছে উজানও সেটাতেই খুশি হওয়ার চেষ্টা করেছে, কখনো নিজের পছন্দ অপছন্দ কারো উপর চাপিয়ে দেয়নি।

জাওভান সবসময় হ্যাং আউট, পার্টি ড্রিংকস, লংড্রাইভ পছন্দ করে, আর উজান চোখে চশমা এঁটে রং তুলি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে। তবে তারা দুজন কখনো ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে না। দুজনই আজকের দিনটা কিভাবে উপভোগ করবে সেটাই ভাবে। তাদের লক্ষ্য নেই। ভালো থাকা, ভালো রাখা, জীবনকে উপভোগ করা…ব্যস, এটাই জীবন। সেই লক্ষ্যহীন জীবন এলোমেলো করে দিলো এক নারী চরিত্র এসে। জাওভানের সর্বনাশ তখন থেকেই শুরু…

.
.
চলবে…