সায়র পর্ব-০২

0
358

#সায়র
#পর্ব_০২
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে জাওভান এবং উজান গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদেরকে পিক করতে ইয়ানা আসবে। ইয়ানা হচ্ছে জাওভানের দূরসম্পর্কের কাজিন, নিউইয়র্কেই থাকত। তিন বছর হয়েছে ইয়ানার পরিবার পার্মানেন্টলি নিউইয়র্ক ছেড়েছে। জাওভান আর উজানের আসার খবর শুনেই সে জাওভানদের পিক করার কথা জানায়। কিন্তু গত আধঘন্টাতেও ইয়ানার টিকিটারও খোঁজ পাওয়া যায়নি। জাওভানের মাথা গরম হয়ে গিয়েছে। অকথ্য ভাষায় কিছু গালিগালাজ ইয়ানার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলো। বিরক্তিতে তার মুখ তেতো হয়ে গেছে। রাস্তায় কয়েকটা লাথিও মারল সে। আর অপরদিকে উজান ফাঁকা বেঞ্চিতে হাত ভাঁজ করে বসে আছে। তার চোখ বন্ধ। এর মধ্যে বাতাস বইতে শুরু করেছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। গুরুম গুরুম করে ডাকছে। যেকোনো সময় ঝুপ করে বৃষ্টি নামতে পারে।

বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে নিউইয়র্ক গিয়েছিল তারা। থাকার কথা ছিল আরো একমাস। কিন্তু উজানের এক্সিবিশনের ডেট পড়ে যায় যার ফলে তাদের তাড়াতাড়ি ব্যাক করতে হয়। কারণ উজানের আর্টের ফাইনাল টাচ বাকি।

শেষে কোনো দিকদিশা না পেয়ে জাওভান ঠিক করল ক্যাব নিয়েই বাড়ি যাবে। ক্যাব অলরেডি ঠিক করেও ফেলেছিল, সেই সময় ইয়ানার গাড়ি এসে থামল তাদের সামনে। সবার আগে গিয়ে জাওভান গাড়িতে একটা লাথি মারল। হাতে থাকা কোকাকোলার ক্যান ইয়ানার দিকে ছুঁড়ে মারল, ভাগ্যিস ইয়ানা সরে গিয়েছিল। জাওভান দাঁত কটমট করে বলে,

‘এত তাড়াতাড়ি আসলি কিজন্য? আরও দেরি করে আসতি। আমরা তো এখানে থাকার সব বন্দোবস্ত করেই ফেলেছিলাম।’

ইয়ানা অপ্রস্তুত হেসে জাওভানকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে, আহ্লাদী সুরে বলে,

‘জাওভানননন! আর বলিস না, এত জ্যাম ছিল না রাস্তায় যে আসতে চেয়েও পারিনি।’

তখন গাড়ির ভেতর থেকে একটা মেয়েলী গলার অওয়াজ শোনা গেল, ‘তুই যে পার্লারে সাজতে গিয়ে টাইম ওয়েস্ট করলি সেটা বলিস না ক্যান?’

ইয়ানা থতমত খেয়ে গেল। পাশ কাটাতে জাওভানের গাল টেনে বলল, ‘আমার জুভটা খুব অপেক্ষা করেছে তাই না? আহারে!’

ঝটকা মেরে ইয়ানাকে সরিয়ে দিলো জাওভান। হিলের কারণে পড়েই যাচ্ছিল ইয়ানা, গাড়ি ধরে সামলাল নিজেকে। জাওভান আগুন গরম চোখে তাকিয়ে আঙুল তুলে শাসাল,

‘তোকে আমি বারবার সাবধান করেছি এই ধরনের ন্যাকামি আমার সামনে করবি না, একদিন এমন এক থাপ্পড় মারব যে তোর গাল ঝুলে যাবে। স্লাট একটা।’

শেষ লাইনটা অবশ্য জাওভান বিড়বিড় করে বলেছিল যার কারণে ইয়ানা শুনতে পায়নি।

উজান গাড়ির ফ্রন্ট সিটে একবার তাকাল। জানালার কাঁচ উঠানো যার কারণে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না। ইয়ানাকে বলল,

‘কাকে নিয়ে এসেছিস? কন্ঠ তো অচেনা লাগছে।’

ইয়ানা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল,

‘ওল্ড ফ্রেন্ড। রাস্তায় দেখা হয়েছে তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।’

উজান আর কিছু বলল না। ব্যাক সিটে গিয়ে বসে পড়ল। জাওভান তার পাশে বসেই মোবাইল দেখছে। উজান নাকে কেমন একটা উটকো গন্ধ পেল। গন্ধের উৎস খুঁজতে আশেপাশে তাকাতেই চোখে পড়ে সামনের সিটের মেয়েটার হাতে ভদকার বোতল। একটা না, দুটো। নাক কুঁচকে উজান জানালার গ্লাস নামিয়ে দিলো।

গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে জাওভান আদেশ দেয়,

‘সামনে কোনো রেস্টুরেন্ট খোলা পেলে থামা। আই অ্যাম ফাকিং হাংরি।’

সেই রাতের বেলায় ছোটো একটা হোটেল খোলা পাওয়া গিয়েছিল। ততক্ষণে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গিয়েছিল।

উজান আর জাওভান হোটেলে চলে গেল। ইয়ানা গেল না, সে পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে রাম ধমক দিলো,

‘কি দরকার ছিল তোর এত কথা বলার? অসভ্য মেয়ে একটা। তোকে এই মদের বোতল দিয়েছি চুপ থাকার জন্য আর তুই কিনা…! অসহ্য! তোকে গাড়িতে উঠানোটাই আমার ভুল হয়েছে। বের হয়ে যা গাড়ি থেকে। এক্ষুনি!’

মেয়েটি নেমে গেল কোনো কথা না বাড়িয়ে। আর ইয়ানা মেকআপ কিট নিয়ে নিজের মেকআপ ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

জাওভান নিজেই অর্ডার করতে চলে গেল। উজান বসে একটা ছবি হাতে নিয়ে তার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে রইল। সেই সময়ে সে নাকে সেই বিশ্রী গন্ধটা টের পেল, এবং তা তীব্রভাবে। কেউ একজন তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলছে,

‘কাঁদছেন কেন?’

উজান ভ্রু কুঁচকে পাশে ফিরে তাকায়। একটি মেয়ে তার পাশে বসে আছে, তার হাতে সেই বোতলের একটা। উজান বুঝে নিল, ইয়ানার সেই ফ্রেন্ড এই মেয়েটা। সে এক চেয়ার ফাঁকা রেখে আরেক চেয়ারে গিয়ে বসল। মেয়েটি হেসে দিলো। মেয়েটির বুজে আসা চোখদুটো লাল, ঠিক মতো বসে থাকতেও পারছে না, তবুও ভারী জিভ নেড়ে টেনে টেনে বলল,

‘বললেন না তো কাঁদছেন কেন? আপনার জীবনে খুব কষ্ট তাই না? আমার জীবনেও কষ্ট। অনেক কষ্ট।’ শেষের কথাগুলো বলার সময় মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার গলার সুর ছিল অসহায়।

‘এটা খান। কষ্ট কমবে। আমি যখনই এগুলো খাই আমার আর কষ্টের কথা মনে থাকে না। নিন খান আপনি।’

বলে সে ভদকার বোতলটা উজানের দিকে বাড়িয়ে দিলো। উজান ভ্রু কুঞ্চিত রেখেই তাকিয়ে রইল। মেয়টি এমন আবোলতাবোল বকছে কেন? সে কাঁদতে যাবে কোন দুঃখে?

‘আমার কোনো কষ্ট নেই আর আমি কাঁদিওনি।’

মেয়েটি ফাঁকা চেয়ারটিতে লাফিয়ে বসল, ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বলল,

‘নাহ, আপনি কাঁদছিলেন। আমি কিন্তু দেখে ফেলেছি। দেখি তো, কাকে দেখে কাঁদছেন।’

চোখের পলকেই উজানের হাত থেকে ছবিটা খপ করে নিয়ে নেয় মেয়েটি। ঠোঁট উল্টিয়ে বল, ‘এই মেয়েটি কে? আর পাশের ছেলেটিই বা কে?’

উজান তড়িৎগতিতে মেয়েটির হাত থেকে টান দিয়ে ছিনিয়ে নেয় ছবিটি। পকেটে রেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটির দিকে।

‘অনুমতি ছাড়া কারো জিনিস নেওয়া ব্যাড ম্যানারস। এই কমন সেন্সটুকুও নেই আপনার?’

মেয়েটি কিছু বলল না। সে শুধু ঘাড় এদিক সেদিক নাড়াতে নাড়াতে উজানকে দেখছিল। ঠিক সেই সময়ে জোরে একটা বাজ পড়ে কারেন্ট চলে গেল। এখানে জেনারেটরের লাইনও নেই। ফলে ওয়েটাররা কতগুলো চার্জ লাইট জ্বালিয়ে দিলো। ততক্ষণে জাওভান খাবার নিয়ে এসে পড়েছে। উজান পাশে তাকিয়ে দেখল সেই পাগল মেয়েটি নেই। শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। জাওভান খাওয়া শুরুর মাঝেই বিদ্যুৎ ঝলকানিতে জানালার কাঁচ গলিয়ে দেখল, বাহিরে একটা মেয়ে দু’হাত ছড়িয়ে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।

জাওভান খাবার রেখেই উঠে পড়ল। ঝড়ো বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে, তার উপর বিকট শব্দে বাজ। মেয়েটার কি সামান্য জ্ঞানটুকুও নেই?

বাইরে বেরিয়ে ছাউনির নিচে থেকেই জাওভান এই মেয়ে এই মেয়ে বলে চিৎকার করে ডাকতে লাগল। বৃষ্টির শব্দে সেই আওয়াজ চাপা পড়ল। জাওভান হোটেল থেকেই একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাক্ষুসে বাতাসে ছাতা উড়ে যাওয়ার যোগাড়। জাওভান মেয়েটার পেছনে এসে এক হাত ধরে টান দিল।

মেয়েটি ঘুরল। সেই মুহুর্তেই বিদ্যুৎ চমকাল। আলোর ঝলকানিতে সামনে দাঁড়ানো চুপচুপে ভেজা মেয়েটাকে দেখে জাওভান এক মুহুর্ত থমকে গেল। আবার চমকালো বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে যতবারই মেয়েটার মুখ ঝিলিক দিয়ে উঠে ততবারই জাওভানের বুকে কেমন তোলপাড় সৃষ্টি হতে লাগল। এই তোলপাড়ে ভেতরটা লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে, যা এই ঝড়ো বৃষ্টির মতো দেখা যাচ্ছে না। জাওভান মেয়েটির ধ্যানে এতটাই পড়ে গিয়েছিল যে তার ছাতা উল্টে বাতাসের বুকে উড়ে গেল। সেকেন্ডেই সেও ভিজে গেল। সেদিকে হুস নেই ভাওভানের। সে তো চেয়ে আছে তার মনে তোলপাড় করে দেওয়া মেয়েটির দিকে। মেয়েটিও আধো আধো চোখে তাকেই দেখছিল…চারপাশ তখন বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে মাতোয়ারা…

সেই ছিল প্রথম দেখা। সেই প্রথম দেখাতেই জাওভানের মন নামক জটিল যন্ত্রটি বাঁধা পড়ে কিরণেতে। তারপর থেকেই কিরণকে নিজের করে রেখেছে সে। তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। তারপর আরও কত কাহিনী করে কিরণকে বন্দী করে রাখতে সফল হয় সে। আজ কিরণ চাইলেও তাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।

.

.

জাওভান খাটের সাথে মাথা রেখে কিরণকে দেখছিল আর সাত মাস আগে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা কল্পনা করছিল। একহাতে কিরণের একহাত বন্দী। কিরণ চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। পিঠ পর্যন্ত চুলগুলো এলোমেলো ভাবে বালিশে ছড়ানো। সে আরেকটু ঝুঁকে গিয়ে কিরণের কপালে চুমু দিলো। কেন যেন তার খুব ভালো লাগছে! কিরণকে দেখে তার মনে হয় এর চেয়ে সুন্দরী মেয়ে দুনিয়াতে আর হয় না। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের কিরণের মুখে পাতলা দুটি ঠোঁট। চোখে বড় বড় পাপড়ি, টিকোলো নাক। এমন না যে কিরণের শ্যাম বর্ণের মুখে মায়া বা আকর্ষণীয়তা আছে। তবে ঐ মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর চোখ ফেরানো দায়, কেমন যেন চুম্বকের মতো টানে,তখন মনে হয়, কিছু একটা তো আছেই ঐ শ্যামবরণ চেহারায়।

জানালা দিয়ে নরম রোদ চোখের পাতায় খেলা করলে কিরণ নড়েচড়ে উঠে। ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখ পিটপিট করে তাকাল। মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে তার। মাথায় হাত দিয়ে মাথাটা একটু তুলতেই বুঝতে পারল মাথা ভার হয়ে আছে। বহু চেষ্টার পর সে পুরোপুরি চোখ খুলতে সক্ষম হলো। চোখ খুলতেই দেখল জাওভান তার খুব কাছে এসে মনোযোগ সহকারে দেখছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে? জাওভান এখানে আসবে কিভাবে? চোখ কচলে ভালো করে দেখে নিল। জাওভানই তো! চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিরণের। শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসল। জাওভানের ভ্রু কুঁচকে এলো। মাথা সোজা করে নিয়ে খাটে এসে বসল। কিরণের হাত ধরে অস্থির গলায় বলল,

‘কি হয়েছে কিরণ? ভয় পেয়েছ? দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে?’

কিরণ জাওভানকে ঠেলে খাট থেকে নামিয়ে দিল,

‘তুমি আমার রুমে কি করছো? তাও আবার আমার বেডে?’

জাওভান বেড সাইড টেবিল থেকে লেবুর শরবতের গ্লাসটা কিরণের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘আমি তোমার রুমে না বরং তুমি আমার রুমে।’

কিরণ পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখল আসলেই এটা জাওভানের রুম। অবাক কন্ঠে বলে,

‘আমি তোমার রুমে কি করছি?’

‘কাল রাতে যে আমাকে মিথ্যা বলে ফ্রেন্ডদের সাথে ফূর্তি করেছিলে মনে নেই?’

কিরণ গতকাল রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করে। গতকাল ওভারটাইমের নাম করে সে তার ফ্রেন্ড সেতুর বার্থডে তে যায়। এটা জাওভান জানে না। জানলে তাকে আস্ত রাখত না। সেখানে তার নতুন পুরোনো ক্লাসমেট ছিল। তার মধ্যে ছিল সাদমান। এই ছেলেটি তার পেছনের কুকুরের মতো ঘুরত। কিন্তু কিরণ কেন যেন সাদমানকে পাত্তা দিত না।

বার্থডেতে কিরণ উড়ো খবর শুনেছিল যে সাদমান নাকি আজ তাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করবে। এটা শুনে সে দ্রুত চলে আসতে নেয়। সেতু আটকায় তাকে। তার কিছুক্ষণ পর সাদমান এসে কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করলে তার গালে সপাটে এক চড় মেরে দেয় কিরণ। আসলে এই কাজটা সে খুব ভয় নিয়ে করেছিল। জাওভানের ভয়ে। জাওভান জানতে পারলে সাদমানকে জ্যান্ত কবর দিবে। সবার সামনে সাদমান কিরণকে কিছু না বললেও শাসিয়ে যায় যে সে তাকে দেখে নিবে। পরে সেতু কিরণকে ড্রিংকস দেয়। জোরাজুরির পর এক পেগ নেয় কিরণ। নেয়ার পরই তার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। এমন না যে সে এর আগে কখনো ড্রিংকস করেনি। কিন্তু আজকের ড্রিংকসটা খুবই ঝাঁঝাল এবং তীব্র। কেমন মাথা ঘুরছে। সে টের পায় তাকে কেউ একহাতে জড়িয়ে ধরে আছে। আর সেই লোকটি তাকে একের পর এক ড্রিংকস করাচ্ছে। এক পর্যায়ে কিরণ যখন আধো মাতাল তখন সাদমান কিরণকে সকলের চোখের আড়ালে নিয়ে যায়। অথচ তখনো কিরণের সেন্স ছিল। আড়ালে নিয়ে আসার পর ধস্তাধস্তি শুরু করে কিরণের সাথে। কিরণ তখন সেফটিপিন দিয়ে সাদমানকে আঘাত করে তার কাছ থেকে পালিয়ে আসে। রাস্তায় এসেই সম্পূর্ণ টাল হয়ে যায় সে। নিজেকে হাওয়ায় পাখির মতো লাগে। যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছে…তারপর কি হয়?

জাওভান কিরণের মুখের কাছে গ্লাসটা ধরল। কিরণের ভাবনার সুতো কাটে। গ্লাসটা নিতে গেলে জাওভান দেয় না। সে নিজেই খাইয়ে দেয়। খাওয়ার মাঝে জাওভান বলে,

‘সেতুর বার্থডেতে যাবে, আমাকে বললেই পারতে। আমি নিয়ে যেতাম। শুধু শুধু মিথ্যা বলে গিয়ে নিজেকে বিপদের মুখে ফেলার দরকারটা কি ছিল?’

জাওভানের শীতল কন্ঠের কথা শুনে কিরণ বিষম খায়। নাকে মুখে শরবত উঠে যায়। জাওভান পিঠে হালকা চাপড় দিতে দিতে বলে,

‘ধীরে সোনা ধীরে। এত ভয় পাওয়ার কি আছে? কুল মাই লাভ।’

জাওভান গ্লাস হাতে উঠে আসে। দরজার কাছে গেলে কিরণ বলে,

‘আমার মিটিং আছে। এখনি আমাকে অফিস যেতে হবে।’

‘অফিসে যাওয়া লাগবে না আজ। তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু উজি গিয়ে নিয়ে আসবে।’

উজান তার বয়সে বড় হলেও জাওভান উজানকে নাম ধরে ডাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

‘আজকে যেতেই হবে অফিসে। এর আগেও অনেকবার বাদ পড়েছে।’

‘তাহলে উজানকে বলে দিও কি কি আনতে হবে।’

‘আমার একটু বাসায়ও যেতে হবে।’

‘কথা কানে যায়নি তোমার।’

কিরণ উশখুশ করতে করতে বলল,

‘আরে, কিছু ফাইল আছে ওগুলো উজান খুঁজে পাবে না। আমাকেই যেতে হবে। প্লিজ।’

জাওভান একটু সময় চুপ থেকে বলল,

‘আচ্ছা। গিয়ে চেঞ্জ করে নাও। ক্লজেটে তোমার জন্য ড্রেস রাখা আছে।’

জাওভান বেরিয়ে এসে উজানের ফ্লাটে গেল। উজানের রুমে তাকে খুঁজে পেল না। রুমের ভেতর যেই রুমটা আছে ওটার দরজায় গিয়ে জাওভান নক করল। ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসলো না। জাওভান আরো দুবার উজান বলে ডাকল। তখন ভেতর থেকে গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসল,

‘কাম ইন।’

এই রুমটা উজানের আর্ট রুম। রুমের এক পাশে অজস্র রং তুলি আর ক্যানভাসে ভরা। দেয়ালে বড় বড় কতগুলো পেইন্টিং ঝুলানো, তার মধ্যে উজানের সবচেয়ে প্রিয়গুলো সাদা কাপড়ে মোড়ানো। আরেকপাশে টেবিলের সাইডে মাটি রাখা, নানা ধরনের স্কাল্পচার সাজিয়ে রাখা আছে টেবিলে। তার মধ্যে একটা ভাস্কর্য তিন ছয় ফুটের মতো, একটা মেয়ে পাতলা ওড়না দিয়ে নিজের সম্ভ্রম ঢেকে অদূরে তাকিয়ে আছে। উজান এখন মেয়েটির চুলের দিকটা তৈরি করছে। এটা বোধ হয় এক্সিবিশনের জন্য।

মূলত উজান এই রুমে কাউকেই প্রবেশ করতে দেয় না। এটা তার একটা ধ্যানের জায়গা। এই রুমে আসলে জগতের সবকিছু ভুলে সে নিজস্ব জগতে প্রবেশ করে। সেই নিজস্ব জগতের কিছু টুকরো টুকরো দৃশ্য চমৎকারভাবে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলে সে। এই জগত তার সবচেয়ে প্রিয় জগত, যেখানে আসলে সে আর নিজের মধ্যে থাকে না, হারিয়ে যায় রঙ তুলির মাঝে।

উজান ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জাওভানকে। জাওভান কখনোই তাকে অযথা বিরক্ত করে না। তাহলে এখন হঠাৎ কি প্রয়োজনে? উজানের কুঁচকানো ভ্রু দেখে জাওভান কোনো ভণিতা না করেই বলল,

‘তুই একটু কিরণকে ড্রপ করে দিয়ে আয়। আমাকে একঘন্টার মাঝেই অফিস যেতে হবে। ইটস আর্জেন্ট।’

উজানের কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে যায়।

‘কিরণ কোনো বাচ্চা মেয়ে না যে একা একা বাসায় যেতে পারবে না। আর সময়টা এখন সকাল, রাত হলে ভিন্ন কথা।’

‘ও আসলেই যেতে পারবে না। এখনো ও ঠিক মতো দাঁড়াতেও পারছে না।’

‘তাহলে ওকে থেকে যেতে বল।’

‘ওর নাকি বাসায় যাওয়া খুব জরুরী।’

‘উবারে কল দে। বাসার দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’

জাওভান রাগ হলো হালকা, ‘অসম্ভব! অচেনা কারো উপর ভরসা করে আমার কিরণকে ছেড়ে দিতে পারি না।’

‘তাহলে সরি। আমি যেতে পারব না।’

‘উজান!’ জাওভানের কন্ঠে রাগ।

উজান শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল জাওভানের দিকে,

‘ঝাঁঝ দেখাস কাকে?’

জাওভান বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। অনুনয় স্বরে বলল,

‘ওকে ভাই, প্লিজ, কিরণকে দিয়ে আয়। রাস্তাঘাটে কি না কি ঘটে যায়, ঠিকঠিকানা নেই। আর কিরণের নেশা এখনো কাটেনি। কোথা থেকে কোথা চলে যাবে আবার, প্লিজ, উজি।’

উজান ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জাওভান আসলেই নাছোড়বান্দা! যেকোনো কাজ তাকে দিয়ে করিয়েই ছাড়বে।

ড্রয়িংরুমে কিরণ বসে আছে। উজানকে আসতে দেখেই দাঁড়াল। উচ্ছল কন্ঠে বলল,

‘হেই উজি! গুড মর্নিং!’

উজান কিরণকে আপাদমস্তক দেখে নিল। হাসিখুশি খুশি কিরণ ফুল ফিটফাট। সে জাওভানের দিকে একবার তাকাল। জাওভান দ্রুত উজানের থেকে সরে গিয়ে কিরণের কাছে এসে দাঁড়াল। উজান ছোট করে বলল,

‘মর্নিং।’

‘ব্রেকফাস্ট ডান?’

‘হ্যাঁ। চলো।’

লিফট থেকে নামার সময় উজান কিরণকে বলল,

‘কিরণ, তোমাকে কি ধরে ধরে নিতে হবে? ইউ অলরাইট?’

কিরণ অবাক হলো কিছুটা। উজান তার সাথে এত ভালো ব্যবহার করছে কেন? মনের চিন্তা মনে রেখে মুখে বলল, ‘অফকোর্স আ’ম অলরাইট। কেন বলো তো?’

উজান আড়চোখে জাওভানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘না, কেউ একজন আমাকে বলেছিল তুমি নাকি ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছো না। তোমার নেশা কাটেনি।’

জাওভান কিরণের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে উজানের কথা পাশ কাটাতে কিরণকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগে,

‘দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার, চলো।’

কিরণকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে জাওভান জানালার পাশে হাত রেখে বলে,

‘বাসায় গিয়ে রেডি হয়ে সোজা অফিস চলে যাবে। উজান তোমাকে পৌঁছে দেবে।’

উজান চোখ রাঙায় জাওভানকে। জাওভান চোখে আকুতি করে। চোখ ফিরিয়ে নেয় উজান। সেই সুযোগে জাওভান কিরণের গালে হঠাৎ চুমু দেয়। চমকে উঠে কিরণ গালে হাত দেয়। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে। জাওভান ঠোঁট বাঁকা করে হেসে এক চোখ টিপে বিদায় জানায়।

সকালের মিষ্টি রোদ্দুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাস্তার আনাচেকানাচে। আকাশ রাঙা হয়ে আছে হালকা নীল হলদেটে আভায়। নিবিড় নিস্তব্ধ চারপাশ। কিচিরমিচির শব্দে দুয়েকটা নাম না জানা পাখি উড়ে যায় এদিক সেদিক। রাস্তায় মানুষ কম। আর একটু পরই শুরু হবে যান্ত্রিক শহরের ব্যস্ততা। এই ব্যস্ততার মাঝে সকাল আর রাতের আকাশ দেখলেই মন থেকে কর্পূরের মতো উবে যায় খারাপ লাগা।

বাড়িঘর, গাছপালা পেছনে ফেলে শা শা করে উড়ে যাচ্ছে উজানের মার্সিডিজ বেঞ্চ। বাতাসে উড়ছে কিরণের বাঁধনহারা এলোচুল। সে জানালায় হাত রেখে তার উপর মাথা রেখে চারপাশ দেখছে। কিরণ সবসময় সকালের আর রাতের নিস্তব্ধতা মন দিয়ে উপভোগ করে। তবে আজ আর মনটা সেই নিস্তব্ধতার মাঝে নেই। জাওভানের করা একটু আগের কাজটা তাকে বারংবার ভাবাচ্ছে। ঘিন লাগছে কিরণের, সে গাল অন্য হাতে বারবার ঘষতে লাগল উজানের আড়ালে। জাওভানের সাহস দিনকে দিন বাড়ছে। কি উপায়ে জাওভানকে দূরে সরানো যায়? কম চেষ্টা তো আর করেনি। একবার সফল হতে গিয়েও হলো না একমাত্র উজানের কারণে। কেন যে সেদিন উজানের করা ডিলে সাইন করেছিল? উজান তাকে এভাবে ট্র্যাপে ফেলবে জানলে সে কখনো সাইন করতো না। প্রয়োজনে না খেয়ে মরে যেত। আর সেই কর্মের ফলাফলস্বরূপ আজ জাওভান নামক রাস্কেলটার কাছে সে বন্দী হয়ে গেল।

উফফ!! কিরণ যদি পৃথিবী থেকে একজনকে উধাও করার ক্ষমতা পেত তাহলে সেই একজনটা হবে উজান। একে রাস্তা থেকে সরানো গেলেই জাওভান থেকে মুক্তি পাওয়া কিরণের কাছে বাম হাতের খেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিরণ। তাকে আর কত দিন এই নরকে থাকতে হবে? কবে রেহাই পাবে সে? জাওভানকে যে মেনে নিতে পারছে না। কিরণের মতে জাওভান একটা নোংরা কীট।

.
.
চলবে…