সায়র পর্ব-০৩

0
283

#সায়র
#পর্ব_০৩
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

রাত দশটা। অন্ধকার রুম। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের স্নিগ্ধ জোৎস্না রুমকে হালকা আলোকিত করেছে। বাতাসে জানালার পাতলা পর্দা উড়ে উড়ে জাওভানের মুখ আলতো ছুঁয়ে যাচ্ছে। জাওভানের হাতে সিগারেট, দুই পা আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে একটা চেয়ারে উঠানো। তার চোখদুটো লাল। যেন কত রাত নির্ঘুম সে। তার মাথা ডান পাশে হেলানো। ডানপাশের ছোট্ট টেবিলে কিরণের একটা ছবি রাখা। দুই হাত মাথার কাছে এনে জিভ বের করে ভেঙাচ্ছে, চোখে দুষ্টুমি। ছবিটার সামনেই জেল ক্যান্ডেল জ্বালানো। জাওভানের লাল চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ কিরণের ছবিতে। কয়েক সেকেন্ড বাদে বাদে সিগারেট টানছে সে।

তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে কিরণের সাথে কাটানো সময়গুলো। প্রথম দিন কিরণকে দেখার পর সে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল এক প্রকার। সবকিছুর সাক্ষী উজান। সারাক্ষণ জাওভান কিরণের নাম জপতো। সে শুধু মানতো কিরণ ওর, কিরণকে তার চাইই চাই। উজান তাকে বুঝিয়েছিল কতবার, জাওভান শোনেনি। শেষে ইয়ানার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে কিরণের বাসায় চলে গিয়েছিল সে। কিরণ তার আরও দুইটা ফ্রেন্ডের সাথে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকত। কিরণ ছোটোখাটো একটা কোম্পানীতে জব করত। জাওভান বাসায় গিয়ে সরাসরি কিরণকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিরণ তো অবাকের চরম পর্যায়ে। একদিনের পরিচয়ের ছেলে কিনা সোজা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে! কিরণ সাফসাফ বারণ করে দেয়। আর এতেই যেন রাগটা চড়াও হয় জাওভানের। এমনিতেও সে সামান্য এদিক সেদিক হলে রেগে যায়। আর সেখানে তো তার ভালোবাসার মানুষ মুখের উপর রিজেক্ট করেছে।

সেদিন বাসায় ফিরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছিল। উজান তাকে থামাতে এলে অতিরিক্ত রাগে সে উজানকেও আঘাত করেছিল। সে এতোটাই রেগে গিয়েছিল যে বাড়ির পরিচারিকার গায়েও হাত তুলেছে। তার কর্মকাণ্ডে উজান তাকে কষিয়ে চড় মারে। প্রিয় ভাইয়ের হাতে চড় খেয়ে শান্ত হলেও প্রত্যাখানের আগুন তার বুকে দাউদাউ করে জ্বলছিল।

নির্ঘুম রাত কাটানোর পর পরদিন ভোরেই সে উজানকে সাথে নিয়ে কিরণের বাসায় চলে যায়। কিন্তু গিয়ে কিরণের বাকি ফ্রেন্ডদের কাছে জানতে পারে কিরণ গত রাতেই বাসা ছেড়েছে। জাওভান হুমকি ধামকি দিয়েছিল তার ফ্রেন্ডদের। কিন্তু সত্যি বলতে কেউই জানতো না কিরণ কোথায়। যখন জাওভান রাগের মাথায় তাদের গায়ে হাত তুলতে চায় উজান এসে আটকায় তাকে। জোর করে তাকে বাড়ি নিয়ে যায়।

জাওভান কোথায় কোথায় না খুঁজে কিরণকে? কিন্তু পায় না। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেবদাসের মতো হয়ে যায়। রুমবন্দী করে রাখতো নিজেকে। তার হাতে থাকতো কিরণের কলেজ লাইফের একটি পুরোনো ছবি। ইয়ানাকে সে প্রতিদিন মানসিক পীড়া দিতো কিরণের কোনো ছবি থাকলে দিতে। কিরণ ইয়ানার তেমন কোনো ক্লোজ ফ্রেন্ড না যে তার কাছে কিরণের ছবি থাকবে। একসাথে প্রাইভেট পড়েছিল বিধায় ক্লাসমেট হিসেবে নরমাল জানাশোনা ছিল। কিন্তু জাওভানের প্রতিদিনকার তর্জন গর্জনে সে অনেক খুঁজে ফেয়ারওয়েলের একটা ছবি জাওভানকে দেয়।

এই একটা ছবির সাথে জাওভান কত কথা বলে। পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিল সে। উজান এই সামান্য একটা মেয়ের জন্য নিজের ভাইয়ের এই অবস্থা সহ্য করতে পারত না। খোঁজ নিয়ে জেনেছে কিরণ একটা লো ক্লাসের মেয়ে। এই নীচু শ্রেনীর মেয়ের জন্য জাওভানের মতো হাই সোসাইটির একটা ছেলের কাতরতা মেনে নেওয়া তার পক্ষে ছিল অসম্ভব। এই কিরণের জন্য জাওভান উজানের সাথে বড্ড খারাপ আচরণও করেছিল। চোখের সামনে তার ভাইটা কেমন অন্যরকম একটা মানুষ হয়ে যাচ্ছিল। মৃত্যুর মুখে পড়ে যাচ্ছিল। জোর করে দিনে দু এক লোকমা ভাত খাওয়াতে পারত।

ঠিক তার তিন চারদিন পর জাওভান যখন মদ্যপানে ব্যস্ত ছিল তখন কলিংবেল বেজে ওঠে। তার হাতে ছিল কিরণের ছবি। পরপর সাত আটবার কলিংবেল বাজতে থাকলে প্রচণ্ড বিরক্ত হয় জাওভান। সে কিরণের দিকে ভালো করে মনোযোগ দিতে পারছিল না। পরে টালমাটাল পায়ে হেঁটে সে দরজার দিকে এগোয়। ঘরে কোনো মেইড নেই। মুখ খিচিয়ে কয়েকটা গালি লাগায় পরিচারিকাদের। দরজা খুলে উজানকে দেখে আরও বিরক্ত হয় সে। কারণ উজানের কাছে ঘরের চাবি থাকে, তাহলে এভাবে তাকে ডিস্টার্ব করার মানে কি! সে দরজা থেকে সরে এসে তার নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। ঠিক তখনি একটা নরম হাত তার হাতকে আকড়ে ধরে। ভ্রু কুঁচকে জাওভান পিছন ফিরে। হাত ধরা মানুষটিকে দেখে জাওভান চমকে উঠে। সে স্বপ্ন দেখছে না তো! সত্যি কি সে স্বপ্ন দেখছে? নাকি এটা বাস্তব? কিরণ তার হাত ধরে আছে! কিরণ! তার ভালোবাসার মানুষ! তার প্রতিটি রাতের ঘুম কেড়ে নেয়া অপ্সরী!

কিরণকে দেখে সে একমুহুর্তের জন্য পাথর বনে গিয়েছিল। হৃদয় অস্বাভাবিকভাবে থমকে গিয়েছিল। সে দুহাতের আজলায় কিরণের মুখ তুলে ধরে।

‘কিরণ! এটা তুমি কিরণ? এটা সত্যি তুমি?’ জাওভানের কাঁপা কাঁপা কন্ঠ।

কিরণ মাথা নাড়ায়।

‘এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে কত খুঁজেছি জানো?’

কিরণ জবাব দেয় না।

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি কিরণ। তুমি কেন আমাকে ঐদিন রিজেক্ট করেছিলে? তোমার জন্য দেখো আজ আমার বেহাল দশা। আমি তোমাকে চাই কিরণ, তু..তুমি শুধু আমার। শুধুই আমার। তুমি আমাকে ভালোবাসো তো?’ জাওভানের কথাবার্তা এলোমেলো, কিরণকে দেখে সে কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে কিচ্ছু মাথায় আসছিল না তার।

‘বলো না তুমি আমাকে ভালোবাসো?’ কাতর দুর্বল গলা জাওভানের।

এবার মুখ খুললো কিরণ, ‘ভালোবাসি।’

ব্যস, এই একটা শব্দই ছিল জাওভানের মুখে হাসি ফোটানোর। সে জড়িয়ে ধরে কিরণকে, শক্ত করে।

‘ভালোবাসো, তুমি আমাকে ভালোবাসো… ‘
জপতে থাকে জাওভান।

অথচ সে খেয়াল করলো না ভালোবাসি বলার সময় কিরণের রোবট গলা, তার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। আর না খেয়াল করল আদৌ কিরণ মন থেকে বলেছিল কিনা, নাকি তাকে দিয়ে বলানো হয়েছিল। বোধ করি জাওভান তার সারা জীবনেও তা খেয়াল করবে না….

কিরণ ফিরে যায় তার আগের বাসায়। তবে তাকে বেশির ভাগ সময়ই থাকতে হয়েছিল জাওভানের ফ্ল্যাটে। জাওভান তো এমনিতেই সবসময় উজানের ফ্ল্যাটে থাকত তাই তারটা খালি থাকত। কিরণ আসার পর সে রাতের ঘুম ছাড়া পুরোটা সময়ই কিরণের সাথে থাকত। হাজারো কথা বলতো কিরণের সাথে। কিরণ মূর্তির মতো শুধু চুপচাপ শুনত। কিছু বলত না।

ধীরে ধীরে কিরণও জাওভানের সাথে একটু আধটু কথা বলতো। প্রথম প্রথম জাওভান কিরণের সব কথাই মেনে নিতো। কিন্তু ধীরে ধীরে সে তার পছন্দ অপছন্দ চাপিয়ে দিতে লাগলো কিরণের উপর। কিরণ কি করবে না করবে সব ডিসাইড করে দিতো জাওভান। এসব কিরণ মেনে নিতে পারতো না। এই নিয়ে তাদের কথা কাটাকাটি হতো। কিরণ রাগ বেশিক্ষণ দমন করে রাখতে পারতো না, তার কথায় কথায় হাত চালানের অভ্যেস ছোট থেকেই। এই সূত্র ধরে জাওভানকে সে মারতোও। জাওভান মুখ বুজে সহ্য করে নিতো বেশিরভাগ সময়, কিন্ত মাঝে মাঝে কিরণের কর্মকাণ্ডগুলো লিমিটলেস হয়ে গেলে সেও মারতো। তবে সে আস্তে আস্তে পিঠে, হাতে বা পায়ে মারতো, আর কিরণ মারতো দানবের।

কিরণ যখন খেত না জাওভান তখন ধমকাতো, আর কিরণ রেগে গিয়ে জাওভানকে ঘুষি, লাথি মারত। তার জন্য অবশ্য জাওভানের হাতের থাপ্পড়ও খেতে হয়েছিল কিরণকে। তাও কিরণ থামতো না, থামতো না জাওভানও। পরে উজানকেই তাদের থামাতে হয়েছে, এখনও জাওভান আর কিরণের মধ্যে ঝগড়া উজানকেই মেটাতে হয়।

কিরণ একবার একরাত বাসায় ফিরেনি। জাওভান খোঁজ নিয়ে কিরণকে পায় না, সে ভাবে কিরণ পালিয়েছে। পরদিন বিকেলে উজান ধরে নিয়ে আসে তার গ্রামের বাড়ি থেকে। আসলে কিরণ জাওভানকে না বলেই গিয়েছিল কারণ জাওভানকে জানালে সে কখনোই যেতে দিতো না। কিরণকে যখন ধরে আনে তখন কিরণ দেখে, যেই রুমে তাকে রাখা হতো, সেই রুমের প্রতিটা আসবাবপত্র চূর্ণ বিচূর্ণ। আর রুমের মাঝখানে বসে ছিল জাওভান। তার টিশার্ট গলার কাছ দিয়ে ছেঁড়া, মাথার চুল উশকো খুশকো। মুখ রক্তিম। চোখ দুটো রক্তের মতো টকটকে লাল, বিড়বিড় করছিল কিছু একটা। কিরণকে দেখা মাত্র সে হিংস্র সিংহের মতো ঝাপিয়ে পড়েছিল। শক্ত চড় দিয়ে গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছিল কিরণকে, কিরণ বাঁচার জন্য কত মিনতি করছিল, কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারেনি, উজানের দিকে মিনতি ভরা দৃষ্টিতে চেয়েছিল। উজান ছিল আবেগশূন্য, তার চোখমুখ স্বাভাবিক, যেন কিরণকে এখন মারাটাই এই মুহুর্তের কাজ।

শেষে যখন কিরণের জিভ বেরিয়ে আসে, চোখ উল্টিয়ে যায় তখন উজান জাওভানের হাত সরিয়ে দেয়। জাওভানকে তার রুমে নিয়ে যায়। উজান এসে কিরণের কাছে এক হাঁটু মুড়ে বসে শান্ত গলায় বলেছিল,

‘আমার ভাইকে জীবনেও ফুলের টোকা লাগতে দেইনি। যখন যা চেয়েছে তা হাজির করেছি। এখন তোমাকে চায়, সারাজীবনের জন্য। জুভ যা চায় তা মেনে নেও, নাহলে…বুঝতেই তো পারছো।’

সেই রাতে জাওভান অস্থির হয়ে ছুটে আসে কিরণের কাছে। হাত ভর্তি চকলেট আর গোলাপ ফুল নিয়ে। চোখেমুখে অনুতপ্তের ছাপ। কিরণকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তার হাত ধরে নিজের বুকে চেপে ধরেছিল। আর ক্ষমা চেয়েছিল। কিরণের ঘুমে চোখ ভার, সে যতবার ঢলে পড়ত ততবার জাওভান টেনে ঝাঁকাত আর কিরণের ঘুম ছুটে যেত। সেই থেকে কিরণ বুঝেছে, জাওভান আসলে নিজেকে ভালো রাখার জন্য কিরণকে ভালোবেসেছে। কিরণের কিসে খারাপ লাগে, কিসে ভালো লাগে তা জাওভান থোড়াই না কেয়ার করে। আদতে জাওভান যেটাতে খুশি হয়, তার যা ভালো লাগে তা কিরণকে করতে বাধ্য করেছে।

কিরণ আছে জাওভানের সাথে, থাকবে, এবং তা সারাজীবন। কারণ কিরণ তাকে ভালোবাসি বলেছে। – এটা জাওভানের ধারণা।

কিন্তু কিরণের মন কি চায়? আদৌ সে জাওভানকে ভালোবাসতে পেরেছে? নাকি শুধুই ছলনা? যদিওবা ভালোবাসে তাহলে জাওভানের প্রতি এত বিরক্ত কেন সে? আর যদি ছলনাই হয়ে থাকে তাহলে তা কতদিনের? – এসব ধারণা কেন জাওভানের মনে জন্মায় না?

.

.

বাহির থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। জাওভান বিরক্ত হয়। আগের কথা ভাবতে ভাবতে তার ঘুম চলে এসেছিল প্রায়। মোমবাতি নিভে গেছে বহু আগে। এদিক ওদিক ঘাড় কাত করে জাওভান উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে এসে দরজা খুলে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে ছয় সাতটা ছেলেমেয়ে আর উজান ম্যাগাজিন হাতে সোফায় বসা। এরা সবাই কিরণের ফ্রেন্ড।

ফ্রেন্ডদের একজন যার নাম সালেহ, সে বলল,

‘উজান ভাই, কিরণকে একবার ডেকে দিন। ওর ফোন বন্ধ। অফিসেও নেই। আমাদের ধারণা ও এখানে আছে।’

উজান ম্যাগাজিনটা ধীর হাতে টেবিলে রাখল। এক হাতে চোখের চশমা ঠিক করল। তার সব কিছুই আভিজাত্যপূর্ণ। এই যেমন ম্যাগাজিনটা টেবিলে রাখা, চোখে চশমা ঠিক করা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার, কিন্তু উজান যেন এই সাধারণ ব্যাপারটাকে অসাধারণ করে তুলেছে, এর কারণ বোধ হয় তার যেকোনো কিছু করাকেই একটা আর্ট মনে হয়। আর এই আর্টটাও চমৎকারভাবে করতে হয়। তার গায়ে সাদা রঙের টিশার্ট, কালো টাউজার। সালেহর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘কিরণের খবর আপাতত আমার কাছে নেই। কি দরকারে তোমরা এসেছ বলে বিদায় নিতে পারো।’

উজানের কাটখোট্টা জবাবে বন্ধুদলের ভেতর কিঞ্চিৎ অপমানের বাতাস বয়ে গেল। তা বুঝতে না দিয়ে সালেহ বলল,

‘ভাইয়া, সাদমান এক্সিডেন্ট করেছে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে তার।’

উজান প্রশ্ন করল, ‘কীভাবে মারা গিয়েছে?’

‘আজ সন্ধ্যায়ই ও ড্রিংক করে গাড়ি চালিয়েছিল। রাস্তাতেই আরেকটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্ট করে। একটু আগে আমরা খবর পেয়েছি। খুব জঘন্যভাবে সাদমানের বডি পিষে গেছে।’

উজান এক পলক জাওভানের দিকে তাকাল। জাওভান নির্বিকারভাবে সিগারেট ধরিয়ে ফুঁকছিল।

এবার সেতু এগিয়ে আসলো। তার চোখমুখ ফোলা। দেখে বোঝা যায় কান্না করেছে প্রচুর। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

‘কিরণের খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড ও, তাই কিরণকে তো জানতে হবে। প্লিজ ভাইয়া কিরণকে একটু ডেকে দিন। ও শেষবারের মতো সাদমানকে শেষ দেখা দেখুক।’

এখানে সেতু একটা মিথ্যা কথা বলেছে, সাদমান মোটেও কিরণের ক্লোজ ফ্রেন্ড না। ইভেন কিরণ সাদমানকে বন্ধুদের কাতারেই ফেলে না। জাওভানের কারণে তাকে বন্ধুদের সাথে মিশতে হয়েছে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। সেতুর কথাটা শুনেই দপ করে আগুন জ্বলে উঠল জাওভানের মাথায়। সাদমান কিরণের ক্লোজ ফ্রেন্ড?

হাতের কাছে শোপিস পেয়ে সেটা ছুঁড়ে মারল সেতুর মুখে। শোপিসটা গিয়ে পড়ল সেতুর গলা আর থুতনি বরাবর। আচমকা আক্রমনে সেতু ঘাবড়ে গেল। থুতনিতে ব্যথা অনুভব করা মাত্রই তার কান্নার রেশ বেড়ে গেল। সবাই তাকাল দরজায় দাঁড়িয়ে রাগে গরগর করা জাওভানের দিকে। বন্ধুরা এই জাওভানকে দুচোখে দেখতে পারে না। এই জাওভানের কারণেই কিরণ আর তাদের সাথে আগের মতো মিশতে পারে না। আর তাদের প্রিয় বন্ধু সাদমান কিরণকে পেয়েও হারিয়েছিল এই জাওভানের কারণেই।

জাওভান দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘কিরণ কোত্থাও যাবে না, এক্ষুনি তোরা এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাবি। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। নাহলে সবগুলার লাশ যাবে। অ্যান্ড আই মিন ইট।’

সবাই ভয় পেয়ে গেল। ভয় ভয় মুখ নিয়েই তারা চলে গেল। উজান পকেটে হাত রেখে জাওভানের দিকে তাকালো।

‘শুনতে পেয়েছিস? সাদমান মারা গিয়েছে।’

জাওভানের চোখে রাগ আর বিরক্তি নিয়ে তাকাল, ‘এর থেকেও ইম্পর্টেন্ট হচ্ছে কিরণ কোথায় তা জানা। কে মরেছে না মরেছে সে খবর রেখে আমার লাভ নেই।’

‘জুভ! আমার দিকে তাকা।’ শান্ত স্বরে আদেশ দেয় উজান। জাওভান এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। সে বেরিয়ে যেতে লাগল।

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘কিরণের অফিসে। ওর তো এতক্ষণ অফিসে থাকার কথা না।’

‘আমিও যাচ্ছি। চল।’

কিরণ শপিংমলে এসেছে তার বাড়িওয়ালার মেয়ের সাথে। অফিস থেকে ফেরার পথেই দেখা হয়েছিল, বাড়িওয়ালার মেয়েই কিরণকে জোর করেছিল তার সাথে আসতে। মেয়েটির নাম আয়াত। কিরণের কাছে আয়াতকে ইমা ওয়াটসনের মতো লাগে কিছুটা। আর স্বভাবটাও মিষ্টি।

আয়াতের ফোন নিয়ে কিরণ তার রুমমেট মীরাকে জানিয়ে দিলো যে আজ তার আসতে লেট হবে। তার এক ঘন্টা বাদেই মীরা আবার কল দিলো। আয়াত কিরণকে মোবাইল এগিয়ে দিলো। কিরণ ধরতেই ওপাশ থেকে মীরা বলল,

‘হ্যাঁ রে, কিরণ। তুই কোথায় রে? জাওভান ভাইয়া তো…’

তারপর শুনতে পেল জাওভানের কন্ঠ,

‘কিরণ, তুমি কোথায়? তোমার মোবাইল বন্ধ কেন? তুমি তোমার অফিসে নেই কেন? কোথায় গিয়েছ তুমি? আবার ঐ সাদমানের লাশের কাছে যাওনি তো? কথা বলছো না কেন?’

‘আরে, আস্তে, কয়টা প্রশ্নের জবাব দেব? আমি আমার আপুর সাথে একটু শপিংয়ে এসেছি… ওয়েট, সাদমান কি? আবার বলুন তো, বুঝলাম না কি বললেন?’

কিরণের সে কথার উত্তর না দিয়ে জাওভান বলল,

‘ঠিকানা বলো আমাকে তাড়াতাড়ি।’

কিরণ ঠিকানা বলল। তার আধঘন্টা বাদেই জাওভান আর উজান পৌঁছে গেল। ফিফথ ফ্লোরে গিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিরণকে খুঁজতে লাগল। দেখল, দূরে কিরণ হাত নাড়াচ্ছে তাদের দেখে। কিরণকে দেখেই জাওভানের মনে যেন শান্তির শীতল বাতাস বয়ে গেল। প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়ল সে। চোখের দৃষ্টি অস্থির থেকে শান্ত হলো। সে দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে সর্বপ্রথম কিরণেকে জড়িয়ে ধরল। আয়াত আপুর সামনে কিরণ খুবই বিব্রতবোধ করল। আয়াত মুচকি হেসে অন্যদিকে ফিরল। কিরণ জাওভানকে ফিসফিস করে বলল,

‘এটা পাবলিক প্লেস জাওভান। ছাড়ো।’

জাওভান ছাড়ল না। যতক্ষণ না তার মন শান্ত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সে ধরেই রাখল। কিছুক্ষন পরই ছেড়ে দিলো।

‘মোবাইল বন্ধ কেন তোমার?’

‘চার্জ ছিল না।’

‘আর এখানে কার সাথে এসেছ তুমি? আমাকে একবার জানাতে পারলে না?’

‘আমার এক আপুর সাথে। বাড়িওয়ালা আন্টির মেয়ে।’

তারপর সে আয়াত আপুকে ডেকে বলল,

‘এই যে, আমার আপু, আয়াত।’

আয়াতের নজর তখন জাওভানের মুখ থেকে বডি, বডি থেকে মুখে ঘোরাফেরা করছিল। মনে মনে সে কিরণের ভাগ্যের উপর কিছুটা কি ঈর্ষান্বিত হলো? এতো সুন্দর একটা মানুষ কিরণকে পছন্দ করল? আয়াত হ্যালো বলে হাত বাড়াল। জাওভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল আয়াতকে। আয়াতের হাত বাড়ানো দেখে সে হাত না দিয়ে মুখে মুখে হ্যালো বলল। খানিকটা অপমানিত হলো আয়াত। তবুও মুখে হাসি ধরে রাখল। কিরণ নিজেও অপমান বোধ করল জাওভানের আচরণে। মানুষ এমন করে? সে পরিস্থিতি সামলাতে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘আর আয়াত আপু, মিট মাই বয়ফ্রেন্ড। জাওভান।’

জাওভান একহাতে কিরণের বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। গম্ভীর গলায় বলল,

‘উড বি।’

কিরণ ইতস্ততঃ করতে লাগল। মিনমিন করে বলল, ‘ঐ আর কি।’

তারপর উজানকে দেখিয়ে বলল, ‘আর আপু, ও উজান। জুভের বড় ভাই।’

জাওভান খানিকটা সরে দাঁড়াতেই উজানকে দেখা গেল। আর উজানকে দেখতেই আয়াত যেন আরেকটা বড়সড় একটা ক্রাশ খেল। ওহ গড! এই হ্যান্ডসামটা কিরণের উডবির ভাই? আজকে এত হ্যান্ডসামের সাথে দেখা হচ্ছে কেন? আজ কি হ্যান্ডসাম ডে? এভাবে তাকিয়ে থাকলে নিজেকে ছ্যাঁচড়া মনে হতে পারে ভেবে আয়াত মুখে হাসি ফুটিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,

‘হ্যালো।’

উজান পকেটে দুই হাত পুরেছিল। আয়াতের হ্যালো বলা শুনে সে শুধু মাথা নাড়াল। কয়েক সেকেন্ড হাত হাওয়াতেই ভাসিয়ে রাখল আয়াত। সে এবার সত্যি সত্যি অনেক অপমানিত হয়েছে। সারা শরীর অপমানে কাঁপতে লাগে তার। আজকে হ্যান্ডসাম ডে না হয়ে নিশ্চয়ই তার জন্য অপমান ডে! কিরণের নিজেরও কেমন ছোট ছোট লাগল। এমন ব্যবহার করার দরকারটা কি ছিল? এই দুই ভাই কারো সাথে একটু সহজভাবেও মিশে না। সমাজে কীভাবে চলতে হয় জাওভান আর উজানের মতো বুড়ো ধামড়াগুলো জানে না? অসহ্য!

কিরণ আয়াতকে সহজ করার জন্য হাত ধরে টেনে আনল, বলল,

‘আপু, চলো না। তোমার না কি কি যেন কিনতে হবে।’

আয়াতের এবার মনে পড়ল, ‘ও হ্যাঁ, চলো।’

তারা দুজন পেছনে ঘুরলে জাওভান বলে,

‘ওয়েট, কতক্ষণ লাগবে তোমার লাভ?’

উত্তরটা দিলো আয়াত, ‘বেশিক্ষণ লাগবে না জুভ ভাইয়া।’

জাওভান মুহুর্তেই আয়াতের দিকে রাগী চোখে তাকাল। আয়াত থতমত খেয়ে গেল। এভাবে তাকানোর কি আছে? সে কি ভুল কিছু বলল?

জাওভান চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘কল মি জাওভান ভাইয়া অর জাওভান। জুভ নামটা শুধু কিরণ আর আমার ভাইয়ের জন্য বরাদ্দ। যার তার কাছ থেকে জুভ ডাক আমি পছন্দ করি না। গট ইট?’

আয়াতের মুখ ঝুলে গেল অপমানে। আজকের দিনটাতে কি তার কপালে শুধু অপমানই লেখা ছিল? এই দুই ভাইয়ের কাছে এত হেনস্তা হচ্ছে কেন সে?

জাওভান কিরণকে নিয়ে জামা কাপড়ের সাইডে চলে গেল। উজান এক পলক আয়াতের দিকে তাকিয়ে চোখের চশমা ঠিক করে কিরণদের সাথেই গেল। আয়াত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আয়াত তার প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পাশাপাশি ওদের দিকে তাকাচ্ছে। একবার জাওভানের দিকে তাকালে তার চোখ আটকে যায়, আরেকবার উজানের দিকে। একজনের দিকে তাকালে চোখ আরেকজনের দিকে টানে।

আয়াত ভালো করে দুই ভাইকে পরখ করতে লাগল। জাওভান আর উজান দুজনেই উচ্চতায় সমান। ইয়া লম্বা। কিরণ তাদের কাঁধ থেকে একটু নিচে পড়বে বোধহয়। জাওভানের চোখে মুখে এক ধরনের চঞ্চলতা বিরাজমান। উজ্জ্বল শ্যামলা দুজনেই। জাওভানের পুরুষালী চেহারায় চাপ দাঁড়ি, চুল গুলো কপালে ফেলে রাখা। ঠোঁট দুটো কিছুটা বাদামী।

আর উজানের চেহারা কেমন গভীর শান্ত আর গম্ভীর, অথচ চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তাকালে কেমন বুক কাঁপে, মনে হয় যেন এক তাকানোতেই সে সবার ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারবে, মিথ্যে বললেও। চুলগুলো সামনে কপালে এসে পড়েছে, চোখে মোটা ফ্রেমের চার কোণা চশমা। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। গালে একটা কাটা দাগ, যার কারণে চেহারাটা আরো বেশি ম্যানলিনেস লাগে।

উজানকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে আয়াত মুগ্ধতার সাগরে ভেসে যাচ্ছিল। সেই সাগর থেকে তাকে উদ্ধার করল ফোনকল। দেখল মীরা আবার ফোন করেছে। সে কেটে দিলো। বাসায় গিয়ে নাহয় কথা বলা যাবে। এখন এই দুটো সুদর্শন পুরুষকে মন ভরে দেখা যাক! বিশেষ করে, গালে কাটা দাগওয়ালা অহংকারী পুরুষটাকে!

.
.
চলবে…