সায়র পর্ব-০৫

0
270

#সায়র
#পর্ব_০৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কিরণের দিনকাল আনন্দেই কাটছে। জাওভান গত শুক্রবার নিউইয়র্ক গিয়েছে, এক সপ্তাহ হয়েছে, আর এক দুইদিন পরই চলে আসবে বলেছিল। এই কয়দিন জাওভানকে না জানিয়ে সে ময়মনসিংহে তার গ্রামের বাড়িতে বেশ জমিয়ে দিন কাটাচ্ছে। পরিবার বলতে তার মা আর ছোট ভাই আছে। বহুদিন পর পরিবারের সাথে থাকতে পেরে তার আনন্দের সীমা নেই। সে মীরাকেও সাথে নিয়ে এসেছিল। আজ তার যাওয়ার দিন। কখন না কখন জাওভান এসে পড়ে, আর তাকে যদি না পায় তাহলে বড় কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।

বাসে বসে জানালার পাশে একধ্যানে কিছু ভাবছিল কিরণ। বাহিরে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার কারণে। সকালের ঘন কুয়াশার আবরণে সমস্ত কিছু ঢেকে গেছে। তার কোলে কিউট একটা বিড়ালছানা। কিরণের বিড়াল খুব পছন্দ। বিড়ালটাকে রাস্তায় পেয়ে উঠিয়ে এনেছে সে। জ্যাকেট দিয়ে বিড়ালটিকে আড়াল করে রেখেছে শীতের হাত থেকে। বিড়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে বিড়ালটিকে ওম দিচ্ছে। এত কিউট! একদম গুলুমুলু। কিরণ বিড়ালটির মাথায় কয়েকটা আলতো চুমু খেলো।

মীরা তার পাশে বসে মোবাইল দেখছিল। তখন মীরার ফোন বাজল, দেখল জাওভান। মীরা কিছুটা অবাক হলো, জাওভান কিরণকে কল না করে তাকে কল করছে কেন? তারপর দৃষ্টিপাত করল কিরণের হাতের কাছে থাকা মোবাইলটাকে। সেখানে নোটিফিকেশনে জাওভানের দেয়া ৪৫ মিসকল। কিরণের ফোন সাইলেন্ট করা। এদিকে মীরার ফোনেও কল করছে জাওভান। সে ধরল না, ধরলে তো বুঝে ফেলবে তারা বাসে, তখন ঝড় যাবে কিরণের উপর। মীরা হাত দিয়ে ধাক্কা দিল কিরণকে।

‘কি হয়েছে?’

‘মোবাইল দেখ ছাগী।’

বিরক্ত নিয়ে মোবাইল দেখল কিরণ। মোবাইল দেখতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। জাওভানের এতগুলো কল! সে দ্রুত কলব্যাক করতে নিলো। থামিয়ে দিলো মীরা।

‘গাধীর বাচ্চা গাধী। কল ধরিস না। ধরলে বুঝে ফেলবে তুই যে বাহিরে, আর আজ অফিসও বন্ধ, যদি বলে তুই কোথায় তখন কি বলবি?’

‘আসলেই তো! থ্যাংকস রে।’
কিরণ যেন বড় বাঁচা বেঁচে গেল। এক্ষুনি তো একটা অঘটন ঘটাতে যাচ্ছিল। শিট!

‘তাড়াতাড়ি মেসেজ কর। শালা তো আমার মোবাইলে বারবার কল দিচ্ছে।’ মীরার তাড়া কন্ঠ।

কিরণ মেসেজ অপশনে গিয়ে তাড়াতাড়ি জাওভানকে মেসেজ করল।

‘আজব, কল দিচ্ছ কেন? দেখছো না ধরছি না।’

তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই এলো জাওভানের,’কল ধরছো না কেন? কল ধর তাড়াতাড়ি।’

জাওভানের মেসেজে রাগের অস্তিত্ব টের পেলো কিরণ। কিন্তু কিরণ উল্টো এমনভাবে মেসেজ করল যেন সে নিজেই রেগে আছে,

‘আরে কচুর মাথা। মোবাইলের স্পিকারে কি যেন সমস্যা হয়েছে, কোনো কথা শুনা যায় না, বলাও যায় না। তাই ধরছি না।’

‘তাই বলে যখন কল দিয়েছি তখন কেন মেসেজ করলে না? এত দেরি কেন লাগল?’

‘ঘুমাচ্ছিলাম। ফোন সাইলেন্ট ছিল।’

‘ফোন সাইলেন্ট কেন করেছিলে?’

‘মনে নেই কেন করেছিলাম। হয়তো ভুলে।’

‘নাকি আমি কল দিলে তুমি বিরক্ত হও বলে?’

কিরণ ‘ঠিক তাই’ লিখে তারপর কেটে দিলো আবার। নিজেকে সংযত করল আপাতত কোনো ঝগড়া না করার। কিন্তু জাওভানকে এত কৈফিয়ৎ সে দিতে পারবে না। খুব বিরক্ত লাগে জাওভানের এই সাধারণ ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটাকে। তাই এই কথাবার্তার ইতি টানতে সে একটু লুতুপুতু লেখা লিখল,

‘কি যা তা বলছো! তোমার কল পেলেই তো আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হই জাওভান। ভালোবাসার মানুষের ডাকে কেউ বিরক্ত হয় বুঝি? আমার ভালোবাসার মানুষ তো ওয়ান অ্যান্ড অনলি তুমি, আমার জাওভান ওরফে আমার জান।’ তারপর কয়েকটা কিসিং ইমোজি।

মেসেজটা লিখতে গিয়ে কিরণ হেসে দিলো। মীরাও ফিক করে হেসে দিলো। যেন এর চেয়ে ফানি জিনিস তারা আর কোথাও দেখেনি। মীরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল কিরণের উপর।

ওপাশ থেকে কয়েক মুহুর্ত কোনো মেসেজ আসেনি। তাই কিরণ হাসি থামিয়ে লিখল,

‘সোনা, আমার আরো ঘুম পেয়েছে। একটু ঘুমাবো। পরে কথা বলি, প্লিজ লাভ?’

তাও কোনো রিপ্লাই আসলো না, কিন্তু সীন হলো ঠিকই। কিরণ জানে জাওভান মেসেজের দিকে এখন চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। কারণ জাওভান কিরণকে এর আগে কোনোদিন এত রোমান্টিক আলাপ করতে দেখেনি। তাই বোধহয় বেচারা শক খেয়েছে। কিরণ আবার লিখল,

‘আপাতত বাই। আমি নেট অফ করে দিচ্ছি, এখন কল দিও না। বাই।’

তারপর সে মেসেনজার ক্লোজ করে দিলো। মীরা তখনো হাসছে। কিরণ মুচকি হেসে জানালার বাহিরে তাকাল। এখনও কুয়াশা কাটেনি। দশটা তো বাজে প্রায়। শীত লাগছে বেশ। কিরণ জানালা টেনে দিলো।

আচমকা মীরা প্রশ্ন করল,

‘তুই কি জাওভান ভাইয়াকে সত্যি ভালোবাসিস?’

কিরণ মীরার দিকে ফিরল। মীরার মুখের হাসি উধাও হয়ে ভর করছে সিরিয়াসনেস। কিরণ হালকা হেসে বলল,

‘তোর কি মনে হয়? ভালোবাসি ও কে?’

‘এই কয়েকদিনে তোর আর ভাইয়ার কথাবার্তায় আমার কাছে মনে হয়েছিল তুই ভাইয়াকে ভালোবাসিস। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে না।’

কিরণ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, ‘ভালোবাসি না তাকে। কখনো পারবো কিনা তাও জানিনা।’

‘তাহলে তুই যে নিজে থেকে প্রতিদিন ভাইয়ার খোঁজ নিস, তার এত কেয়ার করিস, এগুলো কি?’

‘এগুলোকে তোর ভালোবাসা মনে হয়? মায়া বলতেও একটা জিনিস আছে মীরি। জুভের সাথে থাকতে থাকতে ওর প্রতি আমার শুধু মায়া কাজ করে। এটা কি অস্বাভাবিক কিছু? আমরা যদি নরমালি কারো সাথে কয়েকদিন মিশি তার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মায়া কাজ করবে। আর সেখানে জাওভানের সাথে আমার সম্পর্কের আটমাস প্রায়। ও নিজেও প্রতিদিন আমার খোঁজখবর নেয়, কি করেছি না করেছি সব বিষয়ে কেয়ার করে, হ্যাঁ মানছি ওর এসব অতিরিক্ত। কিন্তু ও যদি একদিন এমন না করে তাহলে ব্যাপারটা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগবে এবং আমি জাওভানের এই পাগলামীগুলো মিস করব। কিন্তু তাই বলে কি এটা ভালোবাসা? জাওভানের এসব পাগলামী শুধু অভ্যেসে পরিণত হয়েছে আর এই সবই মায়ার বশে। ভালোবাসলে মনের থেকে যে একটা টান আসে ঐ টানটা আমার জাওভানের জন্য কাজ করে না। আর অনেস্টলি, জাওভান আমার ভালোবাসা ডিজার্ব করে না, শুধুই মায়া ডিজার্ব করে।’

‘তাহলে তুই যে জেলাস হস? ইয়ানাকে জাওভানের পাশে দেখলেও তো তুই জেলাস হস? এই জেলাসিটাও কি মায়া?’

কিরণ একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল,

‘মীরা, শোন। তোর একটা ফ্রেন্ডের সাথে যদি হঠাৎ অন্য একজন এসে ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা করে তখন কিন্তু তোর মধ্যে জেলাসি কাজ করে, তোর মন চায় ঐ ফ্রেন্ডটার সাথে আমি ছাড়া আর কেউ ক্লোজ না হোক। তার মানে কি তুই ঐ ফ্রেন্ডকে ভালোবাসিস? আসলে আমরা চাই কেউ যদি আমাদের দিকে তার একান্ত সব ধ্যান দেয় সেই একই ধ্যানটা যাতে অন্য কেউ না নেয়। এটা জেলাসি, কিন্তু ভালোবাসা না। এর জন্য দোষী কিন্তু ঐ মানুষটাই। সে যদি আমাদেরকে এতটা ইম্পর্টেন্স না দিয়ে সবাইকে সমান ইম্পর্টেন্স দিতো তাহলে এই জেলাসিটা আমাদের মধ্যে কাজ করত না। ঠিক তেমনই জাওভান তার সব ধ্যানজ্ঞান আমাতে দিয়েছে, এখন ইয়ানা যদি এসে ভাগ বসাতে চায় তাতে আমার জেলাস হওয়া নরমাল।’

‘কিন্তু তুই তো জাওভান ভাইয়াকে ভালোইবাসিস না। তাহলে এত জেলাস কেন হস?’

‘ঐ যে বললাম মায়া, সবটাই মায়া।’

‘যেহেতু তোদের মধ্যে ভালোবাসা নেই তারমানে তো একদিন না একদিন তোকে জাওভানকে ছাড়তেই হবে। তখন তুই জেলাস হবি না যদি ভাইয়ার মনে অন্য কেউ আসে।’

কিরণ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,

‘একটা কথা ভুল বললি, ভালোবাসা আছে, তবে তা সম্পূর্ণ জাওভানের তরফ থেকে, আমার তরফ থেকে শুধুই মায়া। আর আমি জানি না কোনোদিন জাওভানকে ছাড়তে পারবো কিনা। সরি, আমি না, জাওভান আমাকে ছাড়তে পারবে কিনা।’

‘তারমানে তুই জাওভানকে ছাড়তে চাস?’

‘বহু আগে থেকেই।’

‘তাহলে সম্পর্কে গেলি কেন? ভালোই তো ছিল তুই যখন পালিয়ে গিয়েছিলি যেদিন জাওভান ভাইয়াকে রিজেক্ট করেছিলি। ফিরে আসলি কেন?’

কিরণ নিশ্চুপ রইল। সে এসব বলতে পারবে না মীরাকে। এমন অনেক কথাই আছে যা সে মীরাকে কেন কাউকেই বলেনি।

কিরণ এবার উদাস কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা এই মায়া দিয়ে কি সংসার করা যায় না? জাওভান তো আমাকে ভালোবাসে, আর ওর জন্য আমার মায়া কাজ করে, তাহলে ভালোবাসা মায়া দিয়ে কি সংসার করা যায় না?’

‘তা তো অবশ্যই যায়। কিন্তু কথা হলো ভাইয়ার ভালোবাসা তো অসুস্থ ভালোবাসা। তোর এই মায়া বিয়ের পর তিক্ততায় রূপ নেবে। তখন জাওভান ভাইয়ার এত কেয়ার, পাগলামী গলায় ফাঁসের মতো লাগবে। এখনি তো তোকে পারমিশন ছাড়া কোথাও যেতে দেয় না, কারো সাথে মিশতে দেয় না, বিয়ের পর তো শিকল দিয়ে আটকিয়ে রাখবে।’

কিরণ কিছু বলল না। সে জানে মীরা ভুল কিছুই বলেনি। জাওভান জীবনে আসার পর তার স্বাধীন জীবন পরাধীন হয়ে গিয়েছে। আর বিয়ে করলে তো তার জীবনই শেষ।

‘ভালোবাসা দিয়ে সংসার করা গেলেও অসুস্থ ভালোবাসা দিয়ে যায় না। তোর মতো চঞ্চল একটা মেয়ের ডানা কেটে দিবে, ইচ্ছে মতো কিছু করতে পারবি না, খাঁচায় বন্দী করবে, অলরেডি করেই ফেলেছে, এখন খালি খাঁচায় তালা মারার পালা।’

কিরণ খুব বড় করে গভীর একটা শ্বাস ছাড়ল। তার মাথা ব্যথা করছে। কি হবে জাওভানকে বিয়ে করলে?

.

.

তারা বাসায় পৌঁছল দুপুর একটায়। কিরণ ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ঢুকল। ড্রয়িংরুমের সামনে দিয়ে তার রুমে যেতেই গম্ভীর পুরুষালী একটা কন্ঠ বলে উঠল,

‘ছুটি কেমন কাটল?’

চমকালো কিরণ। চকিতে তাকাল ডানপাশের নরম গদিতে বসা পুরুষটির দিকে। উজান পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে, তার সরু দৃষ্টি কিরণের উপর। এই কনকনে ঠান্ডায়ও কিরণের মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। উজান এখানে? আর ছুটির ব্যাপারটা উজান কীভাবে জানল? এসব ভেবে কিরণের কপালে দরদর করে ঘাম ঝড়তে লাগলো এই শীতে।

উজান পা নামিয়ে কোটের পকেটে হাত দিয়ে ধীরপায়ে কিরণের নিকট আসলো। একহাত দূরত্ব তাদের মাঝে। হাত বাড়িয়ে কিরণের কপালে জমে থাকা ঘামের ফোঁটা তর্জনীতে নিলো। উজানের গরম হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো কিরণ। উজান আঙুলে থাকা ঘামের ফোঁটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চুটকির মতো করে ছুঁড়ে মারলো ভীতসন্ত্রস্ত কিরণের মুখে। চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নিলো কিরণ। উজান একটু দূরে সরে আসলো। কিরণকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। শান্ত গলায় বলল,

‘শশী লজ, জয়নুল আবেদীন পার্ক, জাদুঘর, সিলভার প্যালেস ঘোরা শেষ? নাকি আরো বাকি আছে?’

কিরণ বিস্মিত হলো। উজান কীভাবে জানলো যে সে ময়মনসিংহে গিয়ে এসব জায়গায় ঘুরেছে?

‘অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এই অল্প কয়দিনে তো বেশ ঘুরলে।’ বলে উজান।

কিরণ কন্ঠে বিস্ময় ঢেলে বলল, ‘তুমি কীভাবে জানো এসব?’

উজান কিছু বলল না। কিন্তু কিরণের কেন যেন মনে হলো উজান তার কথার প্রত্যুত্তরে হাসছে।

‘জুভ তো তোমার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলো আমার উপর।’ অনেকক্ষণ পর বলল উজান।

‘তার মানে কি তুমি আমাকে স্টক করেছিলে?’ কিরণের কন্ঠে হালকা রাগ।

‘হাহ! পাগল নাকি! আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই তোমার মতো মেয়ের পেছন পেছন ঘোরা।’ উজানের কন্ঠে তাচ্ছিল্য।

‘ ‘তোমার মতো মেয়ে’ মানে কি বুঝালে?’

উজান তার উত্তর না দিয়ে বলল,

‘এই যে পাখির মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছো জুভের অনুপস্থিতিতে, জুভ কি জানে?’

‘তুমি যদি বলে থাকো তাহলে তো জানবেই।’ কিরণের কাটকাট উত্তর। মনে মনে সে ভয় পেলেও প্রকাশ করল না। ভয় পেতে দেখলে উজান আরো পেয়ে বসবে।

উজান একহাতে চশমা ঠিক করল। কিরণের এবারও কেন যেন মনে হলো উজান হালকা হাসলো। অথচ তার মুখ একদম নির্বিকার। নাকি কিরণ ভুল ভাবছে!

‘চলো।’ এই বলে উজান বেরিয়ে যেতে লাগলো।

‘কোথায়?’ প্রশ্ন করল কিরণ।

‘গেলেই দেখতে পাবে। আর কিছু জামাকাপড় প্যাক করে নিও।’

দীর্ঘ জার্নির পর কিরণের কোথাও যেতে মন চাইছিল না। একটু ঘুমোতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আপাতত উজানের সাথে তর্কে যেতে চাচ্ছে না। যদি রাগের মাথায় জাওভানকে বলে দেয় সব? অগত্যা কিরণ উজানকে অনুসরণ করতে লাগলো।

উজান ড্রাইভিং করছে আর কিরণ তার পাশে বসে বিড়ালের গায়ে হাত বুলাচ্ছে। তাদের মাঝে পিনপতন নীরবতা। প্লে লিস্টে বাজছে লাভ স্টোরি গানটা।

Take my hand
Promise me that everything will be fine
Hold me tight
Next to you, I still dream,
Yes, yes I want to stay,
But I don’t know how to love anymore,
I’ve been too stupid,
Please, stop, stop
How much I regret, no, I didn’t want all this,
I would be rich and
And I’ll offer you all my gold
If you don’t care, I
I, I’ll be waiting for you in the port,
If you ignore me I, will offer you my last breathe of life,

In my love story
In my love story
In my love story
My love story

কিরণের চুল বাতাসে উড়ছে। সে চুলগুলো ঠিক করলো না, উড়তে দিলো। আজ অনেক ক্লান্তি লাগছে তার। গানটি খুব সুন্দর কিন্তু ভাষাটা কেমন অচেনা লাগছে, ইংলিশ না। তাও গানটা হৃদয়ে দাগ কাটার মতো, যেন এক্ষুনি কেঁদে দেবে। উজান জানালা তুলে দিলো।

‘বন্ধ করলে কেন?’

‘ঠান্ডায় বিড়ালটির কষ্ট হচ্ছে।’

কিরণ এতক্ষণে খেয়াল করল যে তার কোলে বিড়াল আছে। আসলে এতো ক্লান্তি লাগছিল শরীর!

‘উজান। তুমি সত্যি জুভকে কিছু বলোনি তো?’ সাবধানে প্রশ্ন করল কিরণ।

‘তোমাদের মাঝে ঝগড়া মেটাতে মেটাতে আমি ক্লান্ত।’ সামনে তাকিয়েই উত্তর দিলো উজান।

প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিরণ। যাক, তার মানে উজান কিছুই বলেনি।

‘আচ্ছা, এই গানটা কোন ভাষার?’

‘ফ্রেঞ্চ।’

‘তুমি বুঝো লিরিক্সগুলো?’

‘না বুঝলে চালিয়েছি কেন?’

উফফ! এই ছেলেটা কি কিরণের সাথে নরমালভাবে একটু কথা বলতে পারে না? এত ত্যাড়া কেন? ফালতু। কিরণ আর কিছু বলল না। চোখ বন্ধ করে গানটা উপভোগ করতে লাগল।

কিরণ অনুভব করল কেউ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে পেছন থেকে। কিরণ পেছনে দাঁড়ানো মানুষটির পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখতে পারছে না মানুষটিকে। তার সামনে গাঢ় নীল সমুদ্র। এখন রাত নেমেছে সমুদ্রে। পূর্ণ চাঁদ তার রূপালী আলোয় আলোকিত করেছে সমুদ্রকে। চারিদিকে জোৎস্না। এত সুন্দর! চোখ জুড়ানো! ঠান্ডা হিমশীতল বাতাস কিরণের পাতলা সাদা গাউন ভেদ করে শরীরে শীতল স্পর্শ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। এত শান্তি! কিরণের কাছে মনে হলো সে সমুদ্রের পানির উপর হাঁটছে। তার ভয় হতে লাগলো। মাথা নাড়িয়ে না না করতে লাগল। তার ভয় লাগে পানিতে নামতে। কিন্তু কোমড় জড়িয়ে আগলে রাখা মানুষটি তাকে আশ্বস্ত করল,

‘আমি আছি কিরণ, তোমার সাথে। সারাজীবনের জন্য। ভয় পেয়ো না, আমি আছি তো। তোমার ভয়গুলোকে জয় করার পথ দেখিয়ে দেবো আমি। শুধু সাহস করে এগিয়ে চলো, তোমার পাশে আছি আমি, ঢাল হয়ে। থাকবো..সবসময়…সারাজীবন …মৃত্যু পর্যন্ত।’

মানুষটির কন্ঠ এতো স্নিগ্ধ হয়ে কিরণের কানে প্রবেশ করল যে কিরণ ভুলে গেল তার পানিতে ভয় আছে। এই স্নিগ্ধ জোৎস্না মেশানো রাতে শ্রুতিমধুর কন্ঠের ব্যক্তিটিকে ঢাল করে শীতল গভীর সায়রে ডুব দিলো কিরণ। তার ভয় নেই, কোনো বাঁধা নেই, আছে শুধু কিরণ, সে এবং গভীর সায়র…

গালে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চোখ খুলল কিরণ। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল! গান শুনতে শুনতে কখন চোখ লেগে এসেছিল সে নিজেও বলতে পারবেনা। কিন্ত সে নড়তে পারছে না কেন? শরীর অবশ লাগছে! খুব কষ্টে চোখ ভালো করে খুলে দেখল জাওভানের চোখের কালো মনি তার দিকে নিবদ্ধ। তাকে দেখছে একধ্যানে। তার চোখেমুখে প্রশান্তির ছোঁয়া।

কিরণ উঠতে গিয়ে বুঝলো জাওভানের কোলে ঘুমোচ্ছিল। ভালো করে চারিদিক খেয়াল করে দেখল এখন তারা এয়ারপোর্ট থেকে বেরোচ্ছে। উজান সামনের সিটে।

‘কেমন আছো সোনা?’ জাওভান বলল, নরম গলায়।

‘ভালো। তোমার কি আজ আসার কথা ছিল?’

জাওভান তার উত্তর না দিয়ে কিরণের দিকে তাকিয়ে রইল। কিরণের ঘুমঘুম কন্ঠ কি আবেশী! আর তার ঘুমঘুম চেহারা কোমল, স্নিগ্ধ। ইচ্ছে করছে এই মেয়েটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে। এত সুন্দর কেন মেয়েটা? জাওভান কিরণের গালে কপালে গভীর চুমু দিলো।

কিরণ কারেন্টের শক খেল যেন। এখান থেকে আয়নায় সরাসরি উজানকে দেখা যায়। লজ্জা নেই জাওভানের?

‘ছাড়ো।’ ফিসফিস করে বলল কিরণ।

কিন্তু জাওভান তো ছাড়লোই না বরং কিরণের হাতে চুমু দিতে লাগলো। প্রত্যেকটা চুমুর আওয়াজ পর্যন্ত হচ্ছে। কিরণের কান গরম হয়ে গেল রাগে, লজ্জায়। জাওভানটা আসলেই বেশরম। তার লজ্জা না থাকলেও কিরণের আছে। কিরণ জাওভানের চুল খুব জোরে টেনে ধরে তাকে ছাড়িয়ে সিটে বসে পড়ে। জাওভান আবার এগিয়ে আসতে নিলে কিরণ জুতা খুলে হাতে নেয়। জাওভানকে চোখ রাঙিয়ে শাসায়। জাওভান ঠোঁট কামড়ে হাসে।

কিরণের মনটা ফুরফুরে লাগছে ঐ স্বপ্নটার কারণে। এমন স্নিগ্ধতায় মাখানো স্বপ্ন প্রতিদিন কেন দেখে না সে? একসময় গাড়ি থামে। উজানের পাশের সিটে উঠে বসে ইয়ানা। ভ্রু কুঁচকে এলো কিরণের। ইয়ানা হঠাৎ? আবারো গাড়ি চলতে শুরু করে। এই রাস্তা তো তাদের বাসার রাস্তা না। তাহলে কোথায় যাচ্ছে তারা?

কিরণ প্রশ্ন করল এবার, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘তোমার শ্বশুরবাড়ি।’ বলল জাওভান।

কিরণ চোখ রাঙালো, ‘সত্যি করে বলো কোথায় যাচ্ছি?’

‘গেলেই দেখতে পাবে।’ উত্তর দিলো উজান।

জাওভান বলল, ‘ব্রো বলেছে আমাকে কি একটা সারপ্রাইজ দিবে। সেখানেই যাচ্ছি।’

কিরণ অবাক হয়ে বলল, ‘তো তোমার সারপ্রাইজ দেখতে আমি কেন যাচ্ছি?’

জাওভান কিছুটা রাগী গলায় বলল, ‘কারণ আমি মানেই তুমি, তুমি মানেই আমি।’

জাওভানের আদিখ্যেতায় ভেঙচি কাটে কিরণ।

অতঃপর তারা এসেই পড়ল। গাড়ি থেকে নেমে চমকে যায় কিরণ। তার মুখ দিয়ে আপনাআপনি বের হয়, ‘ওয়াও!’

.
.
চলবে…

#সায়র
#পর্ব_০৫ [এক্সট্রা]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

পড়ন্ত বিকেল। শীতের মিষ্টি রোদ গাছের ফাঁক গলিয়ে তিমিরে ঢাকা রাস্তাটিকে আলোকিত করছে। যেখানেই চোখ যায় খালি গাছ আর গাছ। রাস্তার একদম শেষ মাথাটা অন্যান্য দিকগুলোর চেয়ে যেন আরো বেশি আলোকিত। একটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা গেল খুব বড় একটা জায়গার মধ্যিখান দখল করে সগর্বে দাড়িয়ে আছে একটি বাংলো। কিরণ সামনে অবস্থিত আলিশান বাংলোটা দেখে হা করে তাকিয়ে আছে। ছোট ছোট কংকর বিছানো পথ পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজা। দরজাটা কারুকার্যখচিত। পুরো বাড়িটার রং অফ হোয়াইট। বাড়িটার চারপাশে ঘিরে আছে জঙ্গল। একদম নির্জন একটা এলাকা। পেছনে বহমান নদী। তারপর দূরদূরান্ত পর্যন্ত যেখানেই চোখ যায় সেখানেই বড় বড় সবুজ পাহাড়। এই বাড়িতে আসার পথটিও জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। এক কিলোমিটারের মধ্যে আরো কোনো বাড়ি আছে কিনা সন্দেহ। কিরণ বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। এই চমৎকার বাড়িটি উজান কিনেছে? এ যেন স্বপ্নের প্রাসাদ। কিরণের মনে হলো তার যদি উজানের মতো এত টাকা থাকত তাহলে সে উজানের আগেই এই বাড়িটা কিনে ফেলত। একদম তার মনের মতো।

কিরণ কন্ঠে বিস্ময় ঢেলে বলল,

‘মাই গড। এটা তোমার সারপ্রাইজ? উজির পছন্দ যে এতো সুন্দর তা তো আগে জানতাম না!’

জাওভান কিরণকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল,

‘দেখতে হবে না কার ভাই?’

উজান গাড়ি থেকে তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বের করে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। তার পিছু পিছু হাঁটছে ইয়ানা। সে মাথা ৩৬০° অ্যাঙ্গেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাংলোটাকে দেখছে।

জাওভান কিরণের হাত ধরে নিয়ে হেঁটে উজানের পাশে গেল। বলল,

‘আমি কি তোর পর হয়ে গিয়েছি উজি?’

উজান হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দেয়, ‘কেন?’

‘তাহলে তুই একা একা বাংলো কিনে ফেললি আমাকে একবারও জানালি না কেন? আমি ভাগ বসাতে আসবো দেখে?’

উজান ঠোঁট মৃদু প্রসারিত করে বলল, ‘এটা একটা সারপ্রাইজ। আমি চেয়েছিলাম সব ঠিক করেই তোকে বাড়িটা দেখাই। আর আমার সবকিছুই তো তোর।’

জাওভান তৃপ্তি ভরা দৃষ্টিতে উজান ও তার বাড়ির দিকে তাকাল। উজানকে দেখে কিরণের মনে হচ্ছে উজানও হাসছে। কিন্তু কি আশ্চর্য! উজানের চেহারায় হাসির ছাপ পর্যন্তও নেই। তবুও… মনে হয় উজান মৃদু হাসছে!

ভেতরে গিয়ে দ্বিগুণ অবাক হয় কিরণ। ভেতরটা বিশাল বড়। ড্রয়িংরুমের প্রতিটা আসবাবে শিল্পের ছোঁয়া। দেয়ালে মস্ত বড় একটা পেইন্টিং। পেইন্টিংটা শত রঙের ছোঁয়া দিয়ে একটা মেয়ের মুখের একপাশ আঁকা, মেয়েটির চোখ যেন চেয়ে থেকে কিছু একটা বলছে, এত জীবন্ত! ড্রয়িং রুমের বামসাইড থেকে প্যাঁচানো সিড়ি উঠে গেছে উপরে। লম্বা করিডোর ধরে সারি সারি রুম কতগুলো।

উজান এই বাড়িটি কিনেছে তার নিজের জন্য। কোলাহলমুক্ত পরিবেশে সে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়। চার মাসেই সে বাড়িটির ইনডোর ডিজাইন কমপ্লিট করেছে। এটাতে সে প্রতিদিন এসে পেইন্টিং, ভাস্কর্য তৈরি করবে। বাড়িটি কেনাই হয়েছে তার আর্টের উদ্দেশ্যে। দোতলার নির্দিষ্ট একটি রুমে তার পেইন্টিং ও স্কাল্পচারের সকল সামগ্রী সমগ্র রাখা।

কিরণ আর ইয়ানা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলো। করিডোরের প্রথম সারির রুমের দরজাটা খুলল। আর খুলতেই তাদের দুজনের মুখ হা হয়ে গেল। রুমটিতে কোনো আসবাবপত্র নেই। দেয়ালে, ছাদে আর মেঝেতে রঙের প্রলেপ। দেয়ালে আঁকা 3D নৈসর্গিক দৃশ্য। চমৎকার নীলাভ আকাশের নিচে বয়ে চলা নদী, আর পাশে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, কতগুলো ফুল গাছ বাতাসে দোল খাচ্ছে, দুটো খরগোশ উঁকি দিচ্ছে গাছের মাঝখানে। একটি গাছে ফুলে মোড়ানো দোলনা। যেন স্বর্গীয় দৃশ্য, চোখ জুড়িয়ে যায়। কিরণের মনে হলো সে আসলেই কোনো প্রকৃতিতে এসেছে। স্নিগ্ধ সতেজ বাতাস নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। মেঝেতে ঘাসের মাঝে গোলাপী একধরনের ফুল। যেন সে সত্যিই নরম ঘাসে পা ফেলে আছে। কি সুন্দর! উজানের আর্ট দেখলেই বোঝা যায় তার ভেতরটা কত সুন্দর, চিন্তা ভাবনা কতটা মনোমুগ্ধকর!

পরের রুমটাতে গেল তারা। আর যেতেই দ্বিতীয়বারের চেয়ে বেশি অবাক হলো কিরণ। এখানে সবগুলোই ভাস্কর্য। দুই তিনটি বাচ্চা ছেলে মেয়ে বসে বসে খিলখিল করে হাসছে, তাদের হাতে কালার প্যালেট আর তুলি, একটি মেয়ে দেয়ালে হাতের ছাপ, প্রজাপতি, গাছ, বিভিন্ন কিছু আঁকছে। আর বাকি দুটো ছেলেমেয়ে একে অপরের গায়ে রঙ মাখামাখি করছে। কিরণের মনে হচ্ছে সে বাচ্চাদের হাসি শুনতে পাচ্ছে। সে গিয়ে হাত রাখল, বাচ্চাদেরকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। মনে হয় জীবন্ত তিনটি বাচ্চাকে স্ট্যাচু বানিয়ে দেয়া হয়েছে। উজানকে যতটাই গম্ভীর দেখাক না কেন, এই আর্টটি দেখে কিরণ নিশ্চিত উজানের ভেতর বাচ্চা মনটা এখনো জীবিত।

তারপর পরের রুমটিতে গেল। দরজা খোলা মাত্রই দুজনের চিৎকার দিয়ে উঠল সমস্বরে। জাওভান নিচের তলা দেখছিল, দেয়ালে দেয়ালে চোখ জুড়ানো পেইন্টিং। কিরণের চিৎকার শুনতে পেয়েই তার বুকটা ধ্বক করে উঠল।ইয়ানাও চিৎকার করছে। তার মানে কিরণ আর ইয়ানা মারামারি করছে না তো? কিরণ একদম দেখতে পারে না ইয়ানাকে, তার পক্ষে ইয়ানাকে মারা অস্বাভাবিক কিছু না। ইয়ানা কিরণকে বেশি আঘাত করেনি তো? ওর নখ তো রাক্ষুসে।

জাওভান ছুটে গেল দোতলায়। গিয়ে দেখল কিরণ আর ইয়ানা রুমের দরজার সামনে চোখ বড় করে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের চোখে ভয়। যাক, মারামারি করছে না তারা। কিন্তু কি দেখে এমন ভয় পেয়ে আছে? জাওভান তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতরটা দেখতেই তার ভ্রু কুঁচকে এলো। ভেতরটা অন্ধকার জগতের মতো, হরর ফিল্মে যেমনটা থাকে না? তেমন। রুমের একদয সামনাসামনি দেয়ালে দুটো ভয়ানক রক্তিম চোখ আঁকা। যেন প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার পাশের দেয়ালে ঝিরঝির করা টিভি, মেঝেতে ভাঙ্গা গ্লাস, একটা মেয়ে সামনে চুল এনে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আছে, চোখের দৃষ্টি কাতর, ঠোঁটে গা হিম করা হাসি, পরনের জামা রক্তে লাল। তার হাতে রক্ত মাখা মানুষের মাথা। তা দেখেই কিরণের শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। রক্ত হিম হয়ে আসলো তার। হাত পা কাঁপতে লাগল। কি ভয়ংকর দৃশ্য! তার মাঝেই দুটো হাত তার পেঁচিয়ে ধরল, কিরণ গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠল, তার চিৎকারে ইয়ানা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল।

কিরণ দেখল রক্তাক্ত দুটি হাত তাকে জড়িয়ে ধরে আছে, তার চিৎকার দ্বিগুণ হলো। হাত থেকে ছুটতে চাইল, পারল না। পেশিবহুল হাত দুটো শক্ত করে তার কোমড় জড়িয়ে রাখল।

জাওভান কিরণের কানের কাছে গিয়ে বলল, ‘ভয় পেয়ো না কিরণ। আমি তোমার জাওভান। রিল্যাক্স।’

জাওভান কিরণকে জড়িয়ে ধরেই রুমের সামনে থেকে নিয়ে আসলো। কিরণ কাঁপতে কাঁপতে শরীরের ভর ছেড়ে দিল। জাওভান কিরণকে সামনে ঘুরিয়ে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। কিরণ শান্ত হয়েও জাওভানকে জড়িয়েই ধরে রাখল। মাথার ভেতরে সেই দৃশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে।

জাওভান তার পাশের রুমের দরজাটা খুলে কিরণকে দেখতে বলল। কিরণ ভয়ে ভয়ে তাকাল, না জানি আবার ভয়ংকর কোনো দৃশ্য আছে! কিন্তু চোখ খুলে দেখল বাম পাশের দেয়ালে আঁকা চেরি ব্লসম ট্রি। গাছের নিচে একটি মেয়ে রাঙা মুখ নিয়ে মাথা নিচু করে আছে। পরনে সাদা রঙের গাউন। হাত দুটো দিয়ে গাউন শক্ত করে ধরে রাখা, চোখ দুটো বন্ধ, গাল লাল। তার সামনে কালো শার্ট পরা লম্বা একটি ছেলে। ছেলেটি মেয়েটির গালে দুহাত রেখে কপালে চুমু খাচ্ছে। তাদের উপর চেরি ব্লসম উড়ে উড়ে পড়ছে। আবেগজড়িত রোমান্টিক এই দৃশ্য দেখে কিরণের ভয় সব দৌড়ে পালাল। বিমোহিত হয়ে চেয়ে থাকল সে। জাওভান কিরণের হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ঘুরাল। কিরণের কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে গাল দুটো ধরে উপরে তুলল। কিরণের চোখে মোহ, অন্যরকম দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জাওভানের দিকে। তবে জাওভান ধরতে পারল না এই অন্যরকম দৃষ্টিটা আদৌ তার জন্য কিনা! কিরণ জাওভানকে নিজের থেকে ছাড়াতে গিয়ে টের পেল তার শরীরে এক ফোঁটাও শক্তি নেই। যেন সে স্ট্যাচু হয়ে আছে। জাওভান কিরণের কপালে আলতো ছোঁয়ালো তার ওষ্ঠাধর। কেঁপে উঠল কিরণ, বন্ধ হয়ে গেল চোখ। একদম সামনের আর্ট করা ঐ কাপলের মতো।

দরজা খোলার আওয়াজে চমকে উঠল দুজনেই। দেখল উজান দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে ইয়ানা। জাওভান আর কিরণ খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। কিরণ অপ্রস্তুত হয়ে দূরে সরে দাঁড়াল।

উজান বলল, ‘চিৎকার শুনলাম কার?’

জাওভান কিরণের হাত ধরে নিয়ে বেরোতে বেরোতে বলল,

‘কিরণ আর ইয়ানাই চিৎকার করছিল। ঐ রুমের হরর দৃশ্য দেখে।’

উজান খানিকটা তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘সামান্য একটা আর্ট দেখেই এত ভয়? এর চেয়ে ভয়ংকর দেখলে কি করতে?’

কিরণ অবাক হলো, ‘এটা সামান্য! সামান্যটা এমন হলে ভয়ঙ্করটাকে কি বলবে?’

‘উজি তো সবসময় হরর মুভি দেখে তাই এইটা ওর কাছে এটা সামান্যই। এখন চলো, একটু পর সবাই এসে পড়বে। অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হবে।’

উজানের নতুন বাড়ি কেনার উপলক্ষে জাওভান সন্ধ্যায় ছোটোখাটো পার্টি অ্যারেঞ্জ করেছে। তার সব বন্ধুবান্ধব আর উজানের ওল্ড একাডেমির কিছু ক্লাসমেট আসবে।

কিরণ আর ইয়ানা দোতলার কোণার রুমে চলে গেল। কিরণ অফ হোয়াইট কুর্তির সাথে ব্ল্যাক জিন্স পড়ল। গলায় চিকন ওড়নাটা ইউটিউব দেখে স্টাইল করে বেঁধে নিলো। চোখে আইলাইনার আর ঠোঁটে রেডিশ লিপগ্লস লাগালো। তাকে দেখতে চমৎকার লাগছে, কিরণ নিজেই নিজেকে দেখে মুচকি হাসলো। রেডি হওয়ার পর সে স্লাইডিং ডোর খুলে বারান্দায় গেল। বারান্দায় গ্রিল নেই। বাড়ির পেছনের জঙ্গল, আর একটু দূরেই বয়ে চলছে একটি নদী। নদীর ঠান্ডা বাতাস সরাসরি এসে গায়ে লাগছে। বাড়ির পেছনের দিকটা জঙ্গলের কারণে কিছুটা ভুতুড়েও লাগছে।

বিকেলবেলার বাড়ির পেছনের সুইমিংপুলের কাছে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। একপাশে ব্যুফের মতো করে টেবিল সাজানো। তাতে বিভিন্ন ধরনের কেক, কুকিজ রাখা। আরেকপাশের টেবিলে বিদেশী বিয়ার, ওয়াইন রাখা। চারপাশ ডেকোরেট করা হয়েছে বিভিন্ন শেডের চোখ শীতল করা ফেইরী লাইট দিয়ে। সন্ধ্যা হলেই ফেইরী লাইট জ্বালানো হবে।

বন্ধুদের সংখ্যা কম নয়। পনেরো বিশ জনের মতো হবে। কিরণ তার বন্ধুদেরকেও ইনভাইট করেছিল, কিন্তু তারা সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে আসবে না। কিরণের মন খারাপ হয়ে গেল, তবুও তাদেরকে জোর করল না। কারণ সে জানে পার্টিতে জাওভান আছে বলেই তারা কেউ আসবে না।

উজান আর জাওভানের ড্রেসকোড এক। দুজনেই স্কাই ব্লু শার্ট আর হোয়াইট জিন্স। সিলভার স্টোনের বিগ ডায়ালের ঘড়ি। জাওভানের চঞ্চল মুখে হাসি, আর উজানেল শান্ত মুখে…কি? ওকে দেখে তো কিছুই বোঝা যায় না। তাও, সেই শান্ত চোখ, চেহারা আর বডির জন্য তার মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পার্টির মেয়েদের মনোযোগ একেবেঁকে তাদের দুজনের উপর গিয়েই ঠেকছে।

কিরণ আর ইয়ানা উপস্থিত হলো পার্টি শুরু হবার বিশ মিনিট পর। জুভ তখন ফ্রেন্ডসদের সাথে ড্রিংক করছিল। জাওভান কিরণের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলো। কিরণকে যেন সে প্রতিদিন নতুন রূপে আবিষ্কার করে। এই যে কিরণ কংকর বিছানো পথে হেঁটে আসছে, মনে হয় যেন তার মনের রাস্তায় নরম পায়ে হেঁটে বেরাচ্ছে। এই মন কেমন করা ব্যথা কি শুধু তার একাই হয়? তাকে দেখলে কিরণ এই মন মোহাবিষ্ট হওয়ার রোগে আক্রান্ত হয় না?

কিরণের চোখে চোখ পড়তেই জাওভান মিষ্টি হেসে উঠে দাঁড়াল। বিনিময়ে কিরণও হাসল। জাওভানকে কিরণের কাছে যেতে দেখে সকলের দৃষ্টি কিরণ আর ইয়ানার দিকে গেল। ইয়ানাকে দেখে কেউ কেউ হেসেও উঠল, আড়ালে। কারণ ইয়ানা পরেছে সবুজ রঙের শাড়ি। আঁচল গড়াগড়ি খাচ্ছে ফ্লোরে। এমন পার্টিটে কে শাড়ি পরে? তাও আবার মা মা শাড়ি। তাকে দেখে জাওভানও অট্টহাসি হেসে উঠল। ইয়ানা মুখ ভার করে কিরণকে বলল,

‘আমাকে কি সুন্দর লাগছে না কিরণ? জুভ এরকম হাসছে কেন?’

কিরণ কি বলবে ভেবে পেল না। তখন হঠাৎ ইয়ানা এসে বলল সে শাড়ি পরবে। তাই সে একটা সবুজ শাড়ি এনেছে। কিরণ বারংবার মানা করেছিল এমন পার্টিতে শাড়ি না পরতে, নরমাল একটা ড্রেস পরতে। তাও একটা আকর্ষণীয় শাড়ি হলে মানা যেত, কিন্তু একটা কেমন পুরোনো ডিজাইনের মায়েদের মতো শাড়ি। তবে ইয়ানার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে পরিয়ে দিলো।

কিরণ মুখে মেকি হাসি টেনে বলল,

‘তোকে আগেই বলেছিলাম এসব না পরতে, ওরা হাসছে এমন পার্টিতে এসব পরার জন্য, তবে তোকে খারাপ লাগছে না সত্যি।’

ইয়ানা সন্তুষ্ট হলো না। সে সোজা উজানের কাছে গেল। উজান টেবিলের পাশে চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। হাত বুকের কাছে মোড়ানো। দৃষ্টি ছিল বন্ধুদের হাসিঠাট্টার দিকে। ইয়ানা টেবিলের সাথে ঘেঁষে দাঁড়াল, একদম উজানের সামনে। উজান তাকাল ইয়ানার দিকে। ইয়ানা খানিকটা লজ্জা মুখ করে বলল,

‘কেমন লাগছে উজি?’

উজান ইয়ানার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে হাত বাড়াল তার কোমড়ের দিকে। জাওভান, কিরণসহ সবাই হা করে তাকিয়ে ছিল। তাদের জানামতে উজান কখনোই কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না, হাত বাড়ানো তো দূরের কথা। মনে মনে কিরণ খুব খুশিই হচ্ছিল। ইয়ানার নজর জুভের দিকেও আছে, আর কিরণ তা একদম চায় না। ইয়ানাকে কারো গলায় ঝুলিয়ে তার কুদৃষ্টি থেকে জাওভানকে বাঁচানোর দোয়া কিরণ বহুদিন ধরে করেছিল।

ইয়ানা চোখ বন্ধ করে নিল। আর কয়েক মুহুর্ত পরই উজানের পুরুষালী হাত তার চিকন কোমড়ে এসে পড়বে ভাবতেই ইয়ানার গা উত্তেজনায় শিরশির করে উঠে। উজান ইয়ানার কোমড়ের কাছ ঘেঁষে টেবিলে থাকা কাপকেক নিয়ে এক কামড় বসাল। বলল,

‘ডিলিশাস।’

সকলে হেসে উঠল শব্দ করে। হাসির শব্দে ইয়ানা চোখ মেলল। দেখল উজান সামনের দিকে তাকিয়ে মজা করে কেক খাচ্ছে। অপমানে থমথম করছে ইয়ানার মুখ। উজানকে কিছু বলবে তার আগেই উজান উঠে গিয়ে সাউন্ড বক্সে গান ছেড়ে দিল।

সকলে মেতে উঠল নাচে। উজান সরে এলো ইয়ানার পাশ থেকে। কিরণের নাচতে ভালো লাগে না তাই সে বসে রইল। জাওভান নাচের অফার করল। তখন কিরণ না চাইতেও হাত বাড়িয়ে দিলো। তারা সকলের থেকে সরে গিয়ে একসাইডে নাচছিল। জাওভান কিরণের কোমড়ে দুহাত রেখে শুধু এদিক ওদিক দুলছে। তবে গানের সাথে নাচ খাপ খাচ্ছিল না তাদের। বোল্ড মিউজিকে রোমান্টিক নাচ নিশ্চয়ই নাচা যায় না!

একজন বন্ধু এসে জাওভানকে টেনে নিয়ে গেল। জাওভান ছাড়িয়ে কিরণের কাছে আসতে নিলে কিরণ চোখের ইশারায় বোঝায় যেতে।

কিরণ এসে উজানের পাশের চেয়ারে বসল। উজান একমনে সকলের নাচ দেখছিল। কিরণের কথায় তার ধ্যান ভাঙলো,

‘ইয়ানা কিন্তু এবার তোমার জন্য সেজেছে।’

উজান তাকায় কিরণের দিকে। কিরণ বলেই চলে,

‘বিকেলে রেডি হওয়ার সময় ইয়ানা শাড়ি নিয়ে এসে বলে ওকে পরিয়ে দিতে। আমি বলেছিলাম পার্টিতে এই ধরনের শাড়ি পরে না। কিন্তু ও কি বলল জানো? ও বলেছে তুমি নাকি ওকে বলেছিলে ঠিক হতে, তোমার পছন্দ মতো তৈরি হতে, তাহলে নাকি তুমি ওকে নিয়ে ভেবে দেখবে। তাই আজ শাড়িটা পরিয়ে দিলাম। দেখেছো, ও তোমায় কত চায়? ওর ইমোশন বোঝার চেষ্টা করো উজি। মেয়েটা তোমাকে সত্যি ভালোবাসে।’

‘হুম।’ উজানের নির্বিকার কন্ঠ।

‘কি হুম? একটু ভালো করে দেখো মেয়েটাকে।’

‘ইয়ানাকে আমি ছোট থেকে চিনি। ও কেমন মেয়ে সেটাও জানি।’

‘একজন কি সবসময় একরকম থাকে উজি? ইয়ানা বদলে গেছে।’

‘জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’ উজানের মৃদু কন্ঠ।

উজান চোখ ফিরিয়ে আবার আগের জায়গায় নিলো। কিরণের এবারো মনে হলো উজান খুব হাসছে। সে এবার সরাসরি বলল,

‘হাসছো কেন?’

‘কোথায় হাসলাম?’ চোখ না ফিরিয়েই বলল উজান।

‘আমার মনে হচ্ছিল তুমি হাসছো।’

‘তুমি আর তোমার মনে করা। দুটোই ফালতু।’

কিরণ ঘুষি দেওয়ার জন্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উঠালো। তারপর নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে হাত নামিয়ে নিলো। কিন্তু উজান সত্যিই হাসছিল। মনে মনে সে বাঁকা হাসছিল। চোখের চশমা ঠিক করে ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে রইল ডান্স ফ্লোরে।

নাচের তালে তালে ইয়ানা বারবার একটা ছেলের গায়ে ঢলে পড়ছিল। দুজনে কোমড়ে জড়াজড়ি করে নাচছে। কিরণে ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল! এ তো গিরিগিটি! একটু আগে উজানকে নিয়ে কত ভালোবাসার কথা বলছিল আর এখন ঢলাঢলি করছে অন্য ছেলের সাথে! আশ্চর্য মেয়ে!

কিরণ বসেই থাকল। কিন্তু ইয়ানার একটা কাজে সে বসে থাকতে পারল না। ইয়ানা নাচতে নাচতে একদম জুভের কাছে চলে গিয়েছে, জাওভানের সে খেয়াল ছিল না, সে চোখ বন্ধ করে নাচছিল। সেই সুযোগে ইয়ানা জুভের একটা হাত নিয়ে নিজের কোমড়ে রাখল। তা দেখেই কিরণ উঠে দাঁড়াল। তার ব্রহ্মতালু রাগে জ্বলছে। চেয়ারে একটা ধাক্কা মেরে সে ডান্স ফ্লোরে চলে গেল।

জাওভানের থেকে ইয়ানাকে ছাড়িয়ে শক্ত করে একটা চড় মারল। তারপর ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো পুলে। নাচ বন্ধ হয়ে গেল সবার, গান বন্ধ হলো। সকলে চমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিরণের অগ্নিমূর্তির দিকে। ইয়ানা পানিতে পড়ে পানি গিলেও ফেলেছে। কতক্ষণ কেশে নিজেকে ঠিক করে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল কিরণের দিকে। কিরণ ভয়ানক, অকথ্য একটা গালি দিল। তারপর বলল,

‘ডাইনির ঘরের ডাইনি। কয়টা লাগে তোর? বিকালে না বললি উজানকে ছাড়া নাকি তুই বাঁচবি না? তাহলে এখন সিয়াম আর জুভের সাথে এত ঘেষাঘেষি কিসের তোর? তোরে এমনে এমনে ডাইনি বলি না। সবার কাছ থেকে বয়ফ্রেন্ড ছিনিয়ে নেস তুই, পুরো ডাইনির মতো।’

তারপর ইয়ানার মুখ বরাবর থুতু ফেলল। সকলে থম মেরে দাঁড়াল। কেউ বিশ্বাসই করতে পারল না যে সামনের মেয়েটি আসলেই কিরণ। জাওভান নিজেও বিস্মিত।

কিরণ রাগে কাঁপতে কাঁপতে পেছন ফিরে জাওভানকেও নাক বরাবর ঘুষি মারল।

‘তুই নিজেও কি? মেয়েদের সাথে ঢলাঢলি করতে খুব ভালো লাগে তাই না? অসভ্যের বাচ্চা। যেখানে সুন্দরী নারী দেখবে সেখানেই ছুটে যাবে। ইতর বেয়াদব কোথাকার।’

কিরণ ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া ধরল। জাওভান ঘুষি খেয়েও হেসে ফেলল। কিরণ এতটা জ্বেলাস! সে কিরণকে পেছন থেকে ধরলে হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়। আর আঙুল তুলে শাসায় যেন তার পিছু না ধরে। তাও জাওভানের মুখ থেকে হাসি সরছিল না।

কারো বিস্ময়ের অবসান ঘটছিল না। তবে উজান ছিল নিস্পৃহ। যেন সে জানতো এমনটাই হবে। সে আড়ালে বাঁকা হেসে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসল। কিরণ এসে উজানকে বলল,

‘তোমাদের ওয়াশরুমটা কোথায়?’

উজান উঠে দাঁড়ায়, ‘চলো, দেখিয়ে দিই।’

কিরণ হাত দিয়ে থামায়, ‘আমাকে বলো কোথায়। আমি নিজেই যেতে পারব।’

উজানের বাংলোটার সবগুলো বাথরুমের কাজ বাকি ছিল। এছাড়া আরেকটা সিঙ্গেল বাথরুম আছে, সেটার ঠিকানা কিরণকে দিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। জাওভান এসে বলল,

‘আমি নিয়ে যাচ্ছি চলো।’

‘আবার ঘুষি খাওয়ার ইচ্ছা আছে?’ চোখ রাঙায় কিরণ।

জাওভান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে হাসল। কিরণ বলল,

‘অসহ্য একটা।’

‘তোমারই তো।’

‘ঢং। একদম আসবি না। আই রিপিট, একদম আসবি না। নাহলে ভালো হবে না।’ তারপর উজানের উদ্দেশ্যে বলল,

‘তোমার ভাইয়ের নাকে মলম লাগিয়ে দিও।’

কিরণ চলে গেল।

তখন সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে যেন রক্ত ছিটানো। টকটকে লাল। পাখিরা কিচিরমিচির করে নীড়ে ফিরছিল।

বাথরুমটা বাড়ির শেষ মাথায়। বাড়িটির সাইড ঘেষে আরেকটা করিডোর। করিডোরের এক পাশে সারি সারি রুম, আরেক পাশে কাঁচ দিয়ে জানালা ঘেরা। কিরণ হাঁটতে জানালা দিয়ে রক্তিম আকাশ দেখছিল। মাথায় পানি ঢেলে আসা জরুরী। নিজেকে শান্ত করতে হবে। বড় একটা শ্বাস ছাড়ল কিরণ। তবে আজকে তার খুব শান্তি লাগছে প্রতিশোধ নিতে পেরে। এমন একটা দিনের অপেক্ষায় ছিল সে বহুদিন। ইয়ানা তার সাথে খুব খারাপ আচরণ করেছিল যখন কিরণ অসহায় ছিল। খালি হাত তুলাটাই বাকি রেখেছিল। এখন তো কিরণ অসহায় নেই। তাই আজকে জাওভানকে উছিলা করে ইয়ানাকে শান্তিমত একটা চড় মেরেছে। শান্তি লাগছে।

কিরণ এসব ভাবছে তার হাঁটছে। হাঁটা থেমে গেল কিরণের যখন সে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনল। পেছন ফিরল, একটি ছোট ফুলদানী নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিরণ কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো। বাহিরে তো বাতাস নেই, তাহলে এটি কীভাবে পড়ল। সে গিয়ে ঠিক করে টেবিলে রাখল ফুলদানীটি। হাঁটতে লাগল আবার।

হাঁটার মাঝে কিরণের কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ ওর পিছু নিচ্ছে। পেছন ফিরল আবার, কোথায়? কেউ নেই তো। সে আবার হাঁটতে লাগল, আবার মনে হলো কেউ পিছু নিচ্ছে। কিরণ দাঁড়িয়ে পড়ল, মনে হচ্ছে অনুসরণকারীও দাঁড়িয়েছে। কিরণের ভয় হতে লাগল। বাহিরে সাঁঝ নেমে পড়বে এক্ষুনি, অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। এখানে লাইটও নিভানো। ভুতুড়ে লাগছে পরিবেশ। সে দৌড় শুরু করল এবার, এবারও মনে হলো পেছনের ব্যক্তিটিও দৌড়াচ্ছে। আশ্চর্য! রাস্তা শেষ হচ্ছে না কেন? এত দেরি লাগছে কেন ওয়াশরুমে যেতে?

কিরণ সাথেসাথেই দাঁড়িয়ে পেছন ফিরল। কেউ নেই। কিন্তু জানালার পর্দাটি উড়ে থেমে গিয়েছে। যেন কেউ ঐ জায়গাটা অতিক্রম করেছে। কিরণ সাহস সঞ্চয় করে বলল,

‘কে ওখানে? কোন কাপুরুষের বাচ্চা এভাবে পিছু নিচ্ছিস? সাহস থাকলে মুখোমুখি এসে ফাইট কর। ভীতুর ডিম!’

সাড়া আসলো না কোনো, পুরো অন্ধকার করিডোর। কিরণ নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সে পেছন তাকিয়েই উল্টোপায়ে হাঁটতে লাগল, ধীরে ধীরে। হঠাৎ দেয়ালের সাথে পিঠ লেগে গেল। সে পৌঁছে গিয়েছে, অবশেষে। কিরণ শান্তির নিঃশ্বাস ফেলবে তার আগেই তার নিঃশ্বাস মাঝপথে থমকে গেল দেয়ালের আওয়াজ শুনে। দেয়ালটি তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে,

‘হেই মিস বিউটিফুল ধানী লঙ্কা!’

কথাটি কিরণের এতক্ষণের সাহসে পানি ঢেলে দিলো। ভয় করছে তার। দেয়ালের কন্ঠটি একজন পুরুষ কন্ঠের মতো লাগছে। কিরণ তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরল। সে আসলে দেয়ালে না, একজন পুরুষের বুকে পিঠ লেগেছিল।

কিরণ তাকিয়ে দেখল পুরুষটিকে। ছিপছিপে দেহের চমৎকার দেখতে একটি ছেলে। চকলেট কালারের টিশার্ট পরনে। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। ঠোঁটে মৃদু হাসি। এই ছেলেকে আগে কখনো দেখেনি কিরণ। এ কে? এখানে কি করছে?

কিরণ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে, ‘কে আপনি?’

ছেলেটি একহাতে চশমা ঠিক করল। এক পা এগিয়ে এসে খানিকটা ঝুঁকে দাড়ায় কিরণের দিকে। মৃদু হেসে বলে,

‘আমি… আহযান। আহযান খান!’

.
.
চলবে…