সায়র পর্ব-৬+৭

0
234

#সায়র
#পর্ব_০৬
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কিরণ এক পা পিছু হটল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ল অজ্ঞাত মানবটির দিকে। খানিকটা রাগ রাগ গলায় বলল,

‘আমি আপনার নাম জানতে চাইনি। আপনাকে তো এর আগে কখনো দেখিনি, আর এখানেই বা কি করছেন?’

আহযান হালকা হাসল।

‘দেখেননি তো কি হয়েছে? এখন দেখে নিন। ভালো করে দেখে নিন। কোন পার্টটা দেখতে পছন্দ করবেন?’

বলেই পকেটে হাত পুরে সটান হয়ে দাঁড়াল। কিরণ রাগী চোখে তাকায়, ‘ফাইজলামি করার জায়গা পান না মিয়া? জুতার বারি চিনেন? খেয়েছেন কখনো? না খেলে আসেন, খাওয়ায় দেই। বেয়াদব, ফালতু, অসভ্য!’

আহযান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। চোখ বড় হয়ে গেল তার। অবাক করা কন্ঠেই বলল,

‘বাপরে, আপনি মারাত্মক জানি। কিন্তু এতটা মারাত্মক তা তো জানতাম না! বাই দ্যা ওয়ে, রাগবেন না মিস প্লিজ। আমি জাস্ট মজা করছিলাম।’

‘মজা করারও একটা লিমিট থাকে। আমি কিংবা আপনি কেউ কাউকে চিনি না তাহলে এই ধরনের লেইম মজা করার মানে টা কি?’

কিরণ উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। গলার স্বর বাড়ছিল। আহযান হাত দুটো সামনে এনে শান্ত করার ভঙ্গিতে বলল,

‘ওকে ওকে মিস। শান্ত হোন। এই দেখুন কানে ধরছি। তাও প্লিজ চিৎকার করবেন না। কেউ দেখতে পেলে খারাপ ভাববে।’

আহযান কানে ধরল। জাওভান শুনতে পেলে কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে দেবে তা মাথায় আসতেই কিরণ শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। বড় বড় শ্বাস ফেলল। এই রাগই না জানি একদিন তার সর্বনাশের মূল হয়! কিছুতেই সে রাগ কমাতে পারে না।

কিরণ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,

‘ওয়েল। ভালোয় ভালোয় জবাব দিন এবার, হু আর ইউ?’

‘কানটা ছাড়ি?’

‘না।’ কিরণের কড়া জবাব।

হতাশ নিঃশ্বাস আড়াল করল আহযান, ‘আচ্ছা, সমস্যা নেই। আমার এভাবে থাকতেই ভালো লাগছে।’

‘মেইন টপিকে আসুন।’ কিরণ ধমকে উঠল।

আহযান ভীত দৃষ্টিতে তাকানোর ভান করে বলে,

‘আমি আসলে উজান ভাইয়ের জুনিয়র। উনিই এখানে আমাকে ইনভাইট করেছিলেন। উনি আমার কাউন্সিলর।’

‘তো পার্টিতে না থেকে এখানে কি করছেন?’

‘এইখানে…মানে.. এমনিই একটু হাঁটছিলাম আরকি। উজান ভাইয়ের পেইন্টিং দেখছিলাম।’

তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে সামান্য আঁতকে ওঠা গলায় বলল,

‘ও মাই গড। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আমাকে তো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।’

বাহিরের দিকে তাকিয়ে কিরণেরও যেন হুশ ফিরল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ওপাশের ফেইরি লাইটের আলো হালকা ভাবে বোঝা যাচ্ছে। ক্ষীণ আওয়াজে মিউজিক শোনা যাচ্ছে।

‘মিস, আমি তাহলে গেলাম।’ বলেই আহযান পা বাড়াল।

‘শুনুন।’

আহযান দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছু ফিরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। কিরণ শীতল কন্ঠে বলে,

‘আমার সাথে একটু ওয়াশরুমে যাবেন প্লিজ?’

আহযান কিরণের চোখেমুখে ভয় দেখতে পায়। মনে হয় কোনো ব্যাপারে খুব ভয় পেয়েছে। তবুও সে দুষ্টু হেসে বলে,

‘ওয়াশরুমে? একসাথে?’

আহযানের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কিরণ ধমকে তড়িঘড়ি করে বলে,

‘আমি বোঝাতে চেয়েছি আপনি একটু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন।’

‘বাব্বাহ! এতক্ষণ যে আমাকে ভয় দেখাল সে কিনা ওয়াশরুমে একা যেতে ভয় পায়? আর কত কি দেখব দুনিয়ায়!’

কিরণ চোখ পাকালে আহযান বলে, ‘ভয় দেখানোর কি আছে? যাচ্ছি তো।’

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তারা পার্টির জায়গায় পৌঁছানোর আগে কিরণ দাঁড়িয়ে যায়।

‘দাঁড়ালেন কেন? আবার ওয়াশরুমে যাবেন?’

কিরণ কিছুটা কঠিন গলায় বলে, ‘আমি যাওয়ার পাঁচ মিনিট পর আপনি আসবেন। দুজনকে একসাথে দেখলে সমস্যা।’

‘আমরা কাপল হিসেবেই নাহয় জয়েন করি।’

‘আমার পায়ে কিন্তু হিল আছে।’

‘জাস্ট কিডিং, জাস্ট কিডিং। প্লিজ, আপনি যান।’

আহযান কুর্ণিশ করার ভঙ্গিমা করল। কিরণ চলে গেলে আহযান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেল‌ল।

কিরণের ভালো লাগছে না একদম। কেমন যেন অস্থির লাগছে। তার কেন যেন মনে হলো তাকে তখন যে ফলো করছিল সে আহযান নামের ঐ ছেলেটা। কিন্তু আহযান কেন ফলো করবে? সে তো তাকে এই প্রথম দেখল। নাকি আহযান না? নাকি আহযানই? নাকি কেউই ফলো করছিল না? শুধুই ভ্রম ছিল? কিরণের মাথা ব্যথা করতে লাগল। তার ভালো লাগছে না কিছু। বাড়িতে গিয়ে লম্বা একটা ঘুম দেওয়া দরকার। গলা থেকে ওড়নাটা ছাড়িয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলো। চুপ খোঁপা করল।

কিরণ এসে দেখল পুলের পাশে ছেলের দলেরা ওয়াইনের বোতল নিয়ে গানের তালে তালে নাচছে, কয়েকজন পুলে নেমে ফুর্তি করছে। আর মেয়ের দলেরা দোলনার কাছে কিংবা চেয়ারে বসে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। আবার কিছু কাপল আলাদা বসে প্রেমালাপে মত্ত।

উজান কোণার টেবিলে বসা, সামনে হরেক রকমের কেক। তার একহাতে মোবাইল, আরেকহাতে চিজ কেক। ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের দিকে খুব মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে। উজান যখন ভ্রু কিঞ্চিৎ করে তখন সে আনমনে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। ধারালো চোয়াল উঁচু হয়ে থাকে। আর সেই মুখভঙ্গি করে যখন তাকায় মনে হয় যেন তীক্ষ্ণ সুচালো তীরের ফলা ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। কিরণ এদিক ওদিক তাকিয়ে জাওভানকে খুঁজল। জাওভানের কাছে ক্ষমা চাওয়া দরকার। শুধু শুধু মারল তাকে, ইয়ানার রাগ জাওভানের উপর ঝাড়ার কারণে কিছুটা অনুতপ্ত হলো কিরণ। তাকে না পেয়ে উজানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,

‘জুভ কোথায়?’

উজানের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। সে মোবাইল থেকে চোখ উঠিয়ে তাকায়। তাকানোর সাথে সাথে কিরণের বুক কেঁপে উঠল ঐ তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মুখে পড়ে। কিরণ চোখ সরিয়ে ফেলল দ্রুত। মনে হলো, উজান তার ভেতরটা পড়ে নিয়েছে এক নিমেষেই।

উজান কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘জানি না।’

‘নাকে মলম লাগিয়ে দিয়েছো?’

‘না।’

‘তোমাকে বলেছিলাম উজান।’

‘আমি তোমার চাকর নই।’

কিরণ আশ্চর্যান্বিত হলো। সামান্য মলম লাগানোর সাথে চাকরের কি সম্পর্ক? বলল,

‘চাকরের কথা উঠছে কেন? ভাই হিসেবেও তো মলমটা লাগিয়ে দিতে পারতে।’

‘আমার ভাই এতটাও উইক নয় যে সামান্য একটা মেয়ের হাতের আঘাতে আহত হবে।’

কিরণ একহাত কোমড়ে আরেক হাত কপালে রাখল। চোখ বন্ধ করে কপাল ম্যাসাজ করল, গভীর শ্বাস নিয়ে উঠতি রাগকে দমন করল। উজান তাকে ছোট করে কথা বলার সুযোগ কখনো মিস করে না। সবসময় তাকে ছোট করবেই। না করলে যেন উজানের পেটের ভাত হজম হয় না। এই যে, মাত্র এই কথাটায় সে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলো যে কিরণ সামান্য একটা মেয়ে। কিরণ উজানের দিকে ঝুঁকল কিছুটা। দাঁতে দাঁত চেপে হেসে বলল,

‘এই সামান্য মেয়েটার জন্যই কিন্তু তোমার ভাই পাগল উজি। আর এই সামান্য মেয়েটাকেই তুমি অনুরোধ করেছিলে তোমার ভাইয়ের সাথে থেকে যাওয়ার জন্য। আমি যদি না করতাম তাহলে বোধহয় পায়েও পড়তে দ্বিধাবোধ করতে না, তাই না মি. উজান?’

উজান শান্ত অথচ ক্রুর চোখে তাকায় কিরণের দিকে। এক মিনিট দুজনেই দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চকিতেই সে কিরণের একহাত টেনে চেয়ারে বসিয়ে নিজে কিরণের উপর ঝুঁকে আসে। কিরণের গলা চেপে ধরে চেয়ারের মাথার সাথে। একহাঁটু দিয়ে কিরণের হাঁটু চেপে ধরে। এক হাতে কিরণের হাত দুটো চেয়ারের পেছনে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। ফলে কিরণ সম্পূর্ণ বন্দী হয়ে পড়ে উজানের কাছে।

কিরণ চমকে গেল। এক সেকেন্ডে কি থেকে কি হয়ে গেল তার বুঝে উঠতে সময় লাগল। শান্ত উজান হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠবে তা সে কোনোদিন আশা করেনি। যেন অন্য এক উজানকে দেখছে সে। সামান্য একটা কথায় উজান এতটা রিয়েক্ট করবে কিরণ ভাবতেই পারেনি।

উজান কিরণের একদম মুখের কাছে এসে পড়েছে। কিরণের গলা চেপে ধরেছে শক্ত করে। ফেইরী লাইটের সোনালী বেগুনী আলো খেলা করছে উজানের সারা মুখে। চোয়াল শক্ত, চোখমুখ সেই আগের মতো স্বাভাবিক হলেও কিরণের কাছে মনে হলো, উজান তার দিকে ক্ষুব্ধ রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে ক্রোধ। কিরণ চোখ বন্ধ করে ফেলল। উজানের এমন দৃষ্টির সাথে সে অপরিচিত। উজান এত রাগলো কেন? এই কথাটা কি তার আত্মসম্মানে বেশি আঘাত দিয়ে ফেলেছে?

কিরণ গলা নাড়িয়ে উজানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না। উজানের নখ ডেবে গেছে তার গলায়। উজান কিরণের হাত মুচড়ে শান্ত গলায় বলল,

‘তোমার মতো দু’টাকার মেয়ের পায়ে পড়ার মতো দুর্ভাগ্য দিন এই উজানের কখনো আসেনি। তোমাকে তো আমি রাস্তার মেয়েও ভাবিনা। ক্লাসলেস বস্তির মেয়ে তুমি। আমার এতটাও ঠেকা পড়েনি যে তোমার কাছে অনুরোধ করবো। তোমাকে তো আমি আদেশ দিয়েছি আদেশ। আমার ভাইয়ের রুচি এতটা খারাপ তা তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়।’

একটু থেমে উজান কিরণের আরো কাছে গেল। কিরণের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ভুলে গিয়েছ আমাদের ডিলের কথা? ডিল অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেলে, অথচ দোষ দিলে আমার। এটা অন্যায় হয়ে গেল না কিরণ?’

কিরণের গলা চেপে ধরায় তার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাও ভাঙা গলায় কিরণ দাঁত কিরমির করে বলল, ‘আপনিই ফাঁসিয়েছেন আমায়, প্রতারক কোথাকার। বিট্রে করেছেন আমার সাথে, একমাসের ডিলে আমাকে সারাজীবন ফাঁসিয়ে দিলেন। আমার জীবন শেষ করেছেন। এর শোধ তো আমি নিবোই। খেলার শুরুটা আপনি করেছেন, শেষটা আমার হাতেই হবে।’ কিরণের চোখে জল, বুকের ভেতরটা হাহাকার আর্তনাদে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

উজান কিরণের কানে তার ঠোঁট লাগিয়ে ধীরস্বরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বাহ! তুমি থেকে আপনিতে চলে গেলে দেখছি। আর কিসের খেলার কথা বলছো? খেলা খেলতে তো তখনই মজা যখন প্রতিদ্বন্দ্বী সমানে সমানে হয়। তুমি তো দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি তোমার জীবন শেষ করিনি, নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছি। তোমার তো আমার নিকট কৃতজ্ঞ থাকার কথা। তা না করে আমার ঘাড়েই দোষ চাপাচ্ছো? এখন তুমি নিজেই তো প্রতারক হয়ে গেলে কিরণ। প্রতারক, থার্ড ক্লাস, নির্লজ্জ, লোভী কিরণ।’

উজান মুখ সরিয়ে এবার কিরণের সামনে আনলো। তার অগ্নিদৃষ্টি সরাসরি কিরণের চোখে নিবদ্ধ। রাগে অপমানে কিরণের চোখ ভিজে গেল। এতটা অপমান তাকে কেউ কখনো করেনি। উজান তাকে প্রথম থেকেই দেখতে পারতো না। তার ধারণা কিরণ তার ভাইয়ের লাইফ নষ্ট করেছে। তাই সুযোগ পেলেই কিরণকে অপমান করে, এমনকি জাওভানের সামনেও। একমাত্র ভাই বলে জাওভান রাগ চেপে সহ্য করে যায়। নাহলে উজানের লাশ আজ নদীতে ভেসে উঠত।

‘তাহলে আপনার ভাইকে কেন বলছেন না আমাকে ছেড়ে দিতে? কেন এখনো আটকে রেখেছেন আপনার ভাইয়ের জন্য?’

কিরণের প্রশ্নে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল উজানের মুখে। তাচ্ছিল্য করে বলল,

‘কম তো চেষ্টা করিনি তোমাকে জুভের লাইফ থেকে সরাতে। জুভ তোমার জন্য কতটা উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল জানো? দিন নেই রাত নেই শুধু তোমার নাম জপত। নাওয়া খাওয়া সব ভুলে তোমাতে বিভোর ছিল। তুমি যেদিন পালিয়ে গিয়েছিলে সেদিন জুভ আমার কাছে কান্না করে তোমাকে ভিক্ষা চেয়েছিল। যেন তোমাকে এনে দেই। একমাত্র জুভ যাতে ভালো থাকে তাই জন্য তোমাকে রাখা। ঐখানে যত মেয়ে দেখছো না? এরাও তোমার থেকে হাই ক্লাসের। ইভেন ইয়ানাও। তুমি তো তাদের নখেরও যোগ্য নও। তোমাকে শুধু প্রয়োজনের জন্যই রেখেছি, জুভের প্রয়োজনে।’

‘উজান ভাই!’

উজান চোখ উঠিয়ে দেখে আহযান। আহযানের চোখে মুখে কৌতুহল। উজান কিরণের গলা আর হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে উঠে আসলো। ফলে কিরণ চেয়ার থেকে উল্টে পড়ে গেল। আহযান এগিয়ে গিয়ে কিরণকে ধরতে নিলেই উজান বাঁধ সাধে।

‘আবর্জনা তোমার গায়ে লাগলে তুমিও নোংরা হয়ে যাবে আহযান। এদিকে এসো।’

উজানের কঠিন আদেশে আহযান দাঁড়িয়ে পড়ে। উজানকে না বলার সাহস তার নেই। তাই সে কিরণের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে উজানের কাছে চলে গে‌ল।

উজান আহযানকে নিয়ে পুলের সাইডে চলে গেল। উজান আর জাওভানের কিছু কিছু কথোপকথন আহযান শুনে নিয়েছে। তার ধারণা উজান কিরণ মেয়েটাকে একদম অপছন্দ করে। উজান যদি কাউকে অপছন্দ করে তবে উজান তার দিকে ফিরেও তাকায় না, রাগ করা তো দুরের কথা। তাহলে কিরণের সাথে এতো রাগ দেখালো কেন? উজানকে সে যত বছর ধরে চিনে, তাতে উজানকে কখনোই এতটা রাগতে দেখা যায়নি। সবসময় শান্তভাবে হ্যান্ডেল করে। আসলে, উজানকে হঠাৎ রেগে যেতে দেখে আহযান নিজেও কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল।

অথচ আহযান জানলো না, তার ঠিক পিছনে আরেকজনও কিরণ আর উজানের ফিসফিসানো কথাগুলো ছাড়া সব কথা শুনে ফেলেছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ আর ক্রোধান্বিত হলেও সে যে কিছুই করতে পারবে না!

আহযান কুন্ঠিত হয়ে বলল, ‘ভাই, একটা পার্সোনাল কথা জিজ্ঞেস করি?’

উজানের দৃষ্টি আবদ্ধ ছিল পুলের নীল পানির দিকে। তার চোখমুখ এখনো শক্ত। গালের কাটা দাগ জ্বলজ্বল করছে আলোতে। সে কাষ্ঠ কণ্ঠে বলল,

‘আমার ভাইয়ের জীবনটা যে ধ্বংস করবে তাকে আমি ছেড়ে দেব না। সে যেই হোক না কেন। আর কিছু জানতে চাও?’

আহযান দুপাশে না বোধক মাথা নাড়াল। সে সবটুকু বুঝতে না পারলেও কিছুটা বুঝতে পারছে যে কিরণ জাওভানের লাইফে আসাতে উজান খুশি নয়।

উজান বলল, ‘চেঞ্জ দ্যা টপিক। তোমার খবর কি? সামনের সপ্তাহে তোমাকে তো কক্সবাজার যেতে হবে। সবকিছু অ্যারেঞ্জ করেছো?’

‘আপনাকেও যেতে হবে ভাই। আমি এখনো ফ্রেশার। আপনি আমার ইন্সট্রাক্টর হিসেবে থাকবেন। কোথায় কোন আর্ট মানাবে তা আপনি বলে দিবেন, আমি করব। যাবেন তো ভাই?’

‘সময় হলে অবশ্যই যাবো। তোমার প্রথম কাজ কেমন হয়…’

আর কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন জোরে ধাক্কা দিলো উজানকে। যার কারণে উজান পুলে পড়ে গেল। সকলে দ্বিতীয়বারের মতো হতভম্ব হলো। উজান ভিজে গেল সম্পূর্ণ। স্কাই ব্লু টিশার্ট গলিয়ে পুলের হালকা গরম পানিতে তার শরীরের গঠন বোঝা যাচ্ছে। কপালের চুল লেপ্টে চোখের সামনে এসে পড়েছে। উজান হাত দিয়ে মুখ থেকে পানি সরিয়ে তাকালো উপরের দিকে। দেখল কিরণ দাঁড়িয়ে রাগে ফুসছে। তাকে ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় লাগছে। চোখে ক্রোধের আগুন। এই উজান মানুষটার জন্য তার জীবন নষ্ট।

উজানকে পুলে পড়তে দেখে সকলে হেসে উঠল, আহযান নিজেও ঠোঁট চেপে হাসল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জাওভানের রাগী মুখেও একটু হাসির ছোঁয়া লাগল। উজানকে সে কিছু করতে না পারলেও কিরণ তো রাগ ঝেড়েছে। তার ভালোবাসাটা আসলেই মারাত্মক একটা বোম! উজানের সাথে কেউ কখনো বেয়াদবি করার সাহস পায়নি। যাক অবশেষে, একজন তো পেরেছে!

সকলের চোখেমুখে হাসির ফোয়ারা বইলেও দুটো মানব মানবী দুজনের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে। দাউদাউ করে জ্বলা আগুনে পৃথিবী ধ্বংস করে দেওয়ার মতো সেই দৃষ্টি…

.
.
চলবে…

#সায়র
#পর্ব_০৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

উজান শাওয়ারে। চোখ বন্ধ করে বাথটাবে হেলান দিয়ে আছে সে। বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরনার গরম পানি আছড়ে আছড়ে পড়ছে তার সারা মুখে। গালের কাঁটা দাগ বেয়ে পানিগুলো ঘাড় অবধি পৌঁছে মিলিয়ে যাচ্ছে। বাথটাবের একহাত দূরত্বে কাঁচের স্লাইড। এখান থেকে নদী দেখা যায়। তবে কুয়াশার কারণে তা ঢেকে আছে। চারিদিকে কুয়াশার বিচরণে মনে হয় যেন এখন মেঘের দেশে সে ভেসে বেরাচ্ছে।

কিরণের রাগী মুখ তার চোখে ভাসতেই চোখ খুলে উজান। তাকে পানিতে ফেলে দেয়ার আনন্দ, প্রতিশোধ, রাগ সবটা তখন ফেইরী লাইটের আলোতে জ্বলজ্বল করছিল কিরণের সারামুখে। উজান ভেবে পায় না, দু’টাকার একটা মেয়ের বুকের পাটা কতটুকু যে উজানের সাথে লাগতে আসে। যার দয়ায় সে বেঁচে আছে, তার পেটেই লাথি মারছে। কিরণের উচিত ছিল উজানের বশ্যতা স্বীকার করা, উঠতে বললে উঠা, বসতে বললে বসা, কিন্তু কিরণ তো তার সম্পূর্ণ উল্টো। ব্যাপারটা এমন হলো না যে ‘আমার বিড়াল আমাকেই বলে ম্যাও।’ হাহ! এখানে কি তার কোনো ভুল আছে? কিরণের থেকেও বেশি? আছে অবশ্য, তবে সে সেটা তার ইহজনমেও স্বীকার করতে নারাজ, অন্তত কিরণের মতো একটা মেয়ের সামনে। যা-ই করুক না সে, হোক ভুল হোক ঠিক- তার সবই ঠিক, শুধু কিরণ ভুল, শুধুই কিরণ। উজান আবার চোখ বন্ধ করে উষ্ণ পানিতে মাথা ডুবাল, শান্তিতে।

শাওয়ার শেষে নিয়ে নিজের পেইন্টিং রুমে ঢুকতেই কিছু একটা কপালে এসে লাগে। রুম অন্ধকার ছিল। সে গিয়ে সুইচ অন করে দেখল জাওভান তার টুলে বসে আছে। নিচে তাকিয়ে দেখল রঙের কৌটো। জাওভানের চোখমুখ লাল। চোখ দুটো হালকা ভেজাও। উজানকে দেখতে পেয়ে জাওভান ব্যস্ত হয়ে তার কাছে আসলো। কপালে হাত রেখে বলল,

‘ব্যথা লেগেছে ভাই? সরিরে, ভুল করে লেগে গিয়েছে।’

বলছে ঠিকই কিন্তু তার চোখেমুখে কোথাও অনুতপ্তর ছাপ পেল না উজান। উল্টো যেন জাওভান উজানকে মেরে খুবই মহৎ কাজ করে ফেলেছে। উজান ঝাড়ি মেরে জাওভানের হাত সরাল। শীতল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘নাটক কম করবি আমার সামনে।’

প্রত্যুত্তরে জাওভান হাসলো হো হো করে। উজান চারপাশে চোখ বুলাতেই চোখে বিষাদ এসে ভর করল। তার সবগুলো আর্টে কালো রঙ মাখানো। একটা আর্টও বাদ নেই। ছোট্ট একটা টুলের উপর ছিল দুটো হাতের মিলনের ভাস্কর্য। এটা সে স্কাল্পচার ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের নিকট উপস্থাপন করবে বলে বানিয়েছিল। সেটার টুকরো টুকরো ভাঙা অংশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিচে পড়ে আছে। সে কঠিন চোখে জাওভানের দিকে তাকালে জাওভান নিষ্পাপ চোখে তাকায়, বলে,

‘উপস, আমি তো জাস্ট একটু আর্ট শিখতে চেয়েছিলাম তোর মতো। ভাবলাম আর্ট করে তোকে তাক লাগিয়ে দেব, কিন্তু দেখ না, একটুও সুন্দর হলো না।’

বলার পর জাওভান হেসে ফেলে আবার। উজান সবগুলো আর্ট ভালো করে দেখল, কালো রঙের জন্য সবগুলো আর্টের সৌন্দর্য ঢাকা পড়েছে। যেন আর্টে নয়, উজানের মনে জাওভান এই কালো রঙা বিষ ঢেলে দিয়েছে। রাগে, দুঃখে উজানের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। এই সবগুলো আর্ট তার বড় সাধনার। মনের মাধুরী মিশিয়ে এইগুলো সে এঁকেছে। এগুলো সে কখনো প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করেনি। এগুলো একান্ত, যা দেখলে তার মনের সকল খারাপ লাগা কর্পূরের মতো উবে যায়।

উজান আগে গিয়ে ড্রয়ার খুলে একটা ক্যানভাস বের করল। তাতেও কালো রঙ! এবার যেন উজানের দুঃখ আকাশসম হলো। এই ক্যানভাসে তার সবচেয়ে প্রিয় একটি আর্ট ছিল। যেখানে গোলাপ ফুলের গাউনে মোড়ানো একটি মেয়ে বাগানের গোলাপে হাত ছোঁয়াচ্ছে। চুলগুলো কোমড় সমান। তার ঠিক অদূরে, একটি বটগাছের নিচে একটি ছেলে তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। অথচ ছেলে এবং মেয়েটির কারো চেহারাই অঙ্কিত নয়। তাদের চেহারা আঁকতে পারেনি উজান। কেন জানে না! তবে এই আর্টটি যতবারই মনে এসেছে ততবারই ছেলেটির এবং মেয়েটির চেহারা সে অস্পষ্ট দেখেছে। একদম ধোঁয়াশা। তবে সে অনুভূতি খুব গাঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে পারছিল। ছেলেটির চাহনি ছিল গভীর, বহুকাল অন্ধকারে থাকার পর এক টুকরো আলো চোখে পড়লে মানুষ যেমন সেই আলোটির জন্য মরিয়া হয়ে উঠে, তেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল সেই ছেলেটি, মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য। আর মেয়েটি খিলখিল করে হাসছে, চোখে মুখে অন্যরকম উজ্জ্বলতা, প্রাণবন্ত।

তার এই প্রিয় আর্টের উপর জাওভান কালো রঙ দিয়ে মেয়েটির চেহারা বিকৃত করে দিয়েছে। ছেলেটির উপর ক্রস চিহ্ন আঁকা, পেছনের নীল আকাশ লাল রঙ দিয়ে রক্তের মতো ঢেলে দেওয়া হয়েছে। উজান তাকাল জাওভানের দিকে। চোখ রক্তিম তার। জাওভান তা দেখে অবাক আর ভয় পাওয়ার ভান করল,

‘ও মাই গড উজি! এভাবে তাকাবি না প্লিজ। আমি খুব ভয় পাচ্ছি। দেখ আমার হাত পা কাঁপছে।’

বলেই মুখ চেপে হাসল জাওভান। তার হাসি পাগলের মতো।

‘কেন এমন করলি তুই?’ উজানের গলার স্বর কাঁপছিল।

এবার জাওভান হাসি থামিয়ে সেও কঠিন করে ফেলল চোখমুখ। বলল,

‘যেমনটা তুই করেছিস, তেমনটাই ফেরত পেয়েছিস।’

‘তুই জানিস আর্ট আমার কি? কি করে করতে পারলি এটা? যেটার মধ্যে আমি নিজের জীবন খুঁজে পাই সেটাই তুই ধ্বংস করে দিলি? কি এমন ক্ষতি করেছিলাম তোর?’ উজান শান্ত গলাতেই বলল।

‘আরেহ উজি, তুই এখনো রাগছিস না কেন? আমি তো তোর রাগ দেখার জন্য ওয়েট করছি। তখন কিরণ সামান্য একটা কথা বলায় তুই যেমনটা রেগে গেলি! আর এখন আমি তো তোর জীবনের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেললাম, তাও তুই রাগছিস না? স্ট্রেঞ্জ!

তারপর পা দিয়ে একটা চেয়ার উজানের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,

‘বসে কথা বলি চল।’

উজান ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো চেয়ারটা। জাওভান দরজা আটকে দিতে দিতে বলল,

‘কুল ব্রো, কিরণ ঘুমোচ্ছে। তোর চিৎকার চেঁচামেচিতে আমার জানটার ঘুম ভেঙে যাবে।’

জাওভান নিজেই চেয়ারে বসলো। বলল,

‘আজ তোর ঠিক কি হয়েছিল রে উজি! তোর যে এত রাগ তা তো জানতাম না? ইদানীং কি হয়েছে তোর বলতো? রাগ এত বেড়েছে কেন? আগে তো এমন ছিলি না।’

‘আগে তো তুইও এমন ছিলি না।’

জাওভান দুহাত মাথার পেছনে নিয়ে হেলান দিলো। বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আজ কিন্তু তুই বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিস উজি। কিরণকে তুই একদমই দেখতে পারিস না, দ্যাটস ফাইন। ওকে তুই বাজে বাজে কথাও বলেছিস, মুখ বুজে সহ্য করে নিলাম একমাত্র ভাই বলে। কিন্তু কিরণকে আঘাত করার সাহস পেলি কোত্থেকে? তোর নখের দাগ বসে গিয়েছে ওর গলায়। ইউ নো, কিরণের গায়ে একটা আঁচড় লাগলে আমি কতটা ডেসপারেট হয়ে যাই! কেউ ওর দিকে হাত বাড়ালে তাকে জ্যান্ত রাখি না, তেমন তুইও বাড়িয়েছিস। তোকে তো আর আঘাত করতে পারি না বল। আমার জানের জিগারের বেস্টফ্রেন্ড তুই। তাই তোর আর্টগুলোতেই নাহয় নিজের ক্ষোভ মিটিয়ে নিলাম।’

বলেই জাওভান ঘাড় কাত করে তাকায় উজানের দিকে। মুখে তার পৈশাচিক হাসি।

উজানের আসলে কি করা উচিৎ সেটা সে নিজেও ভাবতে পারছে না। জাওভান, যে কিনা তার পেইন্টিং রুমে তার পারমিশন ছাড়া ঢুকতো না আজ সে-ই তার সন্তানসম আর্টগুলোকে নষ্ট করেছে। উজানের তখন না রেগে উপায় ছিল না। কিরণ কি বলেছিল? সে নাকি কিরণকে অনুরোধ করেছে! এমনকি কিরণের পা পর্যন্তও ধরতো! সিরিয়াসলি! কিরণ নিজেকে ভেবেছেটা কি? তার ভাইয়ের সাথে প্রেম করে বলে তারও মাথায় চড়ে বসবে? এটা সে কিছুতেই মানতে পারছিল না। আর সেই সময় কিরণের জন্য জাওভানের করা সমস্ত অপরাধগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। যেগুলো তার রাগকে বাড়িয়ে দিয়েছিল মুহুর্তেই। তার রাগ কন্ট্রোল করার ক্ষমতা চমৎকার! কিন্তু যেখানে কিরণের জন্য জাওভান বাবা মায়ের সাথে একমাস কথা বলেনি সেই বিষয়টা একদম মেনে নিতে পারেনি উজান। জাওভানকে শতবার বুঝিয়েছিল। সেই পাগল বুঝেনি। তাও উজান চুপচাপ কিরণকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে আজ কিরণের হেয় করে বলা কথাগুলোতে উজানের পুরোনো রাগ সাপের ফণা তুলে ফুঁসে উঠেছিল। তাইতো সে রাগের মাথায় কি কি করে ফেলেছিল! দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো উজান। আজ এমনটা না করলে তার আর্টগুলো বেঁচে যেত। জাওভানের করা এই কান্ড ছিল তার ভাবনাতীত। তার এই কাজে উজানের ভেতরে ঠিক কতটা কষ্টের জোয়ার বইছে সেটা সে কাউকেই বোঝাতে পারবে না।

জাওভান বলল, ‘আমি এখন তোর সাথে কোনো ঝামেলা করতে চাই না। শুধু চাই তুই গিয়ে কিরণকে সরি বলবি। ব্যস শেষ।’

‘বলবো না।’ উজানের দৃঢ় জবাব।

জাওভান বিরক্তির আওয়াজ তুলল।

‘এত ইগো প্রবলেম কেন তোর? ভুলটা আজ তোর বেশি ছিল উজি। তুই কিরণকে রাস্তার মেয়ে, ক্লাসলেস, বস্তির মেয়ে বলেছিস। হার্টও করেছিস। সেই হিসেবে কিরণ তোকে তেমন কিছুই বলেনি। তাই ও’কে গিয়ে সরি বলবি।’

উজান চুপ করে রইল। তার চুপ থাকায় জাওভান বুঝে নিলো উজান কিছুতেই সরি বলবে না। জুভ ওয়ার্নিং দিলো এবার,

‘তুই যদি কিরণকে সরি না বলিস তাহলে তোর সাথে আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ।’

উজান বাহিরে স্বাভাবিক থাকলেও তার ভেতরটা বিদ্যুতের মতো চমকে উঠল। সাতাশ বছর ধরে যেই ছেলে কিনা তাকে ছাড়া একমুহুর্তও দূরে থাকতো না সেই ছেলেটা দুদিনের মেয়ের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইছে! উজানের বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হলো যে এটা তার জুভ। জাওভান যা বলে তাই করে, যেমনটা বাবা মায়ের সাথে করেছিল। তার মানে এখন সত্যি সত্যি তার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিবে! কিন্তু সে তার ভাইকে ছাড়া থাকবে কি করে? নিজের খুশির কথা না ভেবে যে কিনা সারাটাজীবন ভাইয়ের খুশির কথা ভেবেছে, তার কথা অনুযায়ী সব করেছে, সেই ভাই চলে গেলে তার কি হবে! এই পৃথিবীতে একমাত্র আপন বলতে জুভই আছে তার। আর এই দুর্বলতার সুযোগ জুভ কাজে লাগাচ্ছে!

‘তুই এর আগেও মম ড্যাডের সাথে এমন করেছিলি।’

‘করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তারা কিরণকে যদি সহজে মেনে নিতো তাহলে এমনটা হতো না। কিরণকে তারা অপমান করেছে।’

‘আর মম-ড্যাড যে কষ্ট পেয়েছ তা কিছু না? দুদিনের মেয়েই সব?’

‘বাবা মা আমাকে ভালোবাসলে কিরণকে মেনে নিতো। কিরণকে মেনে নেয়নি তারমানে তারা আমাকে ভালোওবাসেনা।’

‘আমিও তো কিরণকে মেনে নেইনি। তারমানে কি আমি তোকে ভালোবাসি না?’

জাওভান এ প্রশ্নের জবাবে চুপ করে গেল। বাবা মায়ের থেকেও উজান তাকে বেশি ভালোবেসেছে এ কথা সে কখনো অস্বীকার করতে পারবে না। তার কোনো কাজ যদি অন্যায়ও হয় তাহলে উজান তাকে প্রথমে বোঝাবে, যখন দেখবে জাওভান অন্যায় করে আনন্দ পাচ্ছে তখন সে আর বাঁধা দেবে না। তার কাছে জাওভানের প্রায়োরিটি সবার আগে।

জাওভানের উত্তর না পেয়ে উজান কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বলল,

‘এখন তো তোর কাছে টাকা আছে, তাই বাবা মাকে মূল্য দিচ্ছিস না। অথচ যখন তুই ছোট ছিলি তারাই কিন্তু কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিল। তোকে ভালোবেসেছিল। তার প্রতিদান হিসেবে তুই তাদের ফোনকল তোলা বন্ধ করে দিলি। মা ফোন করে কত কান্না করে জানিস? তোর সাথে একবার কথা বলার জন্য। তুই তো পাত্তাই দিতি না। সারাক্ষণ কিরণ কিরণ করিস।’

তারপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘এই যে তুই যার জন্য সবার সাথে সম্পর্ক ‌শেষ করছিস, যার নাম হাজারবার নিচ্ছিস, ভালোবাসি ভালোবাসি করছিস, সে কিন্তু তোকে ভালোবাসে না।’

এবার জাওভানের ভ্রু কুঁচকে এলো। বলল,

‘ওকে তোর থেকে বেশি আমি চিনি। ও আমাকে ভালোবাসে কি ভালোবাসে না সেটাও জানি।’

‘তুই ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিস তাই ভাবছিস তোর চারপাশের সবাইও তোকে ভালোবাসে। এটা কিন্তু ভুল। কিরণ তোর একটু কেয়ার করে, তোর সাথে মিশে, মুখে ভালোবাসি বলে তারমানে এই না যে তোকে সে ভালোবাসে। ওর চোখের দিকে ভালো করে একবার তাকিয়েছিস? ওর চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছিস? কিরণ তোকে ভালোবাসে না। যা করে সবটাই মায়ার বশে।’

‘কিরণ যেদিন নিজ মুখে বলবে ও আমাকে ভালোবাসে না সেদিন হবে ওর জীবনের শেষ দিন। আমাকে ভালোবাসি না বললে ওর মুখ থেকে অন্য কারো জন্য ভালোবাসি বলাটা তো আমি মেনে নেব না।’

বিদ্রুপ কন্ঠে উজান বলল, ‘কেমন ভালোবাসা তোর? জোর করে ভালোবাসিয়ে নিবি? আর ভালো না বাসলেই মেরে ফেলবি? কিরণ কি চায় না চায় সেটা তো কখনো বুঝতে চেষ্টা করিস না। সবসময় নিজের পছন্দ অপছন্দ চাপিয়ে দিতে জানিস শুধু।’

জাওভানের ভেতরে ক্রোধের আগুন জ্বলতে লাগল। কিরণ তাকে ভালোবাসে না এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। পরক্ষণেই মনে হলো, কিরণ তো তাকে কখনোই বলেনি যে সে তাকে ভালোবাসেনা। উজান শুধু তাকে রাগানোর জন্য এমনটা বলছে। কারণ উজান তো কিরণকে দেখতে পারে না, তাই কিরণের নামে মিথ্যা বলছে। ভাবতেই আগুনে পানির ছিটা লাগল। সে শান্ত হয়ে বলল,

‘এসব ফাউল কথা বাদ দে এখন। কিরণ ভালোবাসলে কি, না বাসলে কি, ওকে আমার সাথেই থাকতে হবে। এ বিষয়ে আমি আর একটা ওয়ার্ডও বলতে চাই না। তুই কিরণকে সরি বলবি কিনা বল? ব্যস একটা সরিই তো। এই একটা শব্দই কিন্তু সব ঠিক করে দিবে। তোর, আমার সম্পর্ক।’

উজান মনে মনে কিছু ভাবল। জাওভান যখন জানতে পারবে কিরণ তাকে সত্যি ভালোবাসে না তখন জাওভান নিজেকে সামলাতে পারবে না। সেই উজানকেই সামলানো লাগবে। কিন্তু এখন সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলে উজানের কাছে জাওভান আর কখনোই আসবে না। আর সেটা সে চায় না। তাই বলল,

‘ডান।’

উজানের এত সহজে রাজি হওয়ায় জাওভান মনে মনে কিছুটা হাসল। উজানের যতই ইগো থাকুক না কেন, জাওভানের কথা আসলেই সে সব মেনে নেয়। জাওভান হালকা হেসে উজানকে জড়িয়ে ধরে। পিঠে চাপড় দিয়ে বলে,

‘এই নাহলে আমার ভাই!’

তারপর সে গুড নাইট বলে চলে যায় পাশের রুমে। আজ তারা উজানের বাংলোতেই থাকবে। কিরণ নিচের রুমে।

আহযান এসেছিল উজানের সাথে একটু জরুরী বিষয়ে কথা বলতে। সে রুমে যাওয়ার পর দেখল পেইন্টিংগুলোর নষ্ট অবস্থা। একজন আর্টিস্ট হিসেবে সে জানে, কষ্টের করা শ্রম যখন কেউ নিমিষে নষ্ট করে দেয় তখন কতটা খারাপ লাগে! আর এটাও জানে যে এসব জাওভানের কাজ, সে বাহির থেকে তাদের কথাবার্তা শুনেছে। উজানের সবগুলো আর্ট দেখে আহযানের কতটা কষ্ট লাগছে সে নিজেও বলতে পারবে না। তাহলে উজানের মনের অবস্থাটা কেমন হবে?

আহযান দেখল উজান নির্নিমেষ চেয়ে আছে হাতে ধরা একটি ক্যানভাসের দিকে। আর্টটাতেও কালো রঙ। আহযান বুঝতে পারল না আর্টটা। তবে বুঝল যে পেইন্টিংটা উজানের খুব প্রিয় ছিল। আহযান নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে যায়। এখন উজানের স্বাভাবিক কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।

.

.

সকাল সকাল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে কিরণের ঘুম ভেঙে যায়। আড়মোড়া ভেঙ্গে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থাকে। রাতের বেলায় খুব চমৎকার ঘুম দিয়েছে সে। একরোখা উজানকে শাস্তি দিতে পেরে তার বড্ড আনন্দ হচ্ছিল। রুমে এসে সে নিজেকে নিজেই বাহবা দিচ্ছিল নিজের সাহসিকতার জন্য। তারপর নিজে নিজেই গুনগুনিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

জানালার সাদা পর্দা ভেদ করে সকালের মিষ্টি কুয়াশাচ্ছন্ন রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে। দেয়ালে আর ছাদে আঁকা নীল আকাশ। পেঁজা তুলোর মতো কোমল মেঘ আর তার মধ্যে এক জোড়া পাখি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। যেন কিরণ আকাশের নিচেই শুয়ে ছিল। নিজেকে খুব সতেজ লাগল। উজানের আর্টের প্রশংসা না করে পারা যায় না। উজানের আর্ট দেখলে কেউই বলবে না যে আর্টিস্টটা কত্ত গম্ভীর এবং কঠিন।

কিরণ উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিলো। তৎক্ষণাৎ এক ফালি সোনালী রোদ্দুর হুড়মুড় করে লাফ দিয়ে পড়ল তার রুমে। রুম সোনালী আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল চকিতেই। কিরণ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শীতের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখালো। সামনে ঘন জঙ্গল। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের নরম আলো। গাছের লাল লাল শুকনো পাতা ঝরে আছে সবুজ ঘাসের উপর। মনে হয়, লাল পাতার গালিচা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ছোটোখাটো উঠোনের মাঝখানে আছে বেতের চেয়ার টেবিল। তাতে শোপিস হিসেবে রাখা চায়ের কাপ ভর্তি ট্রে, কেটলি। কিরণ কিছুক্ষণ মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকলো সেদিকে। তার মন না চাইতেও উজানের অভিজাত রুচির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

ঠকঠক ঠকঠক। আবারো কড়া নাড়ার শব্দে কিরণের মুগ্ধতায় ব্যাঘাত ঘটে। ‘চ’ কারান্ত বিরক্তিকর শব্দ তুলে গুটিগুটি পায়ে গেল দরজা খুলতে।

দেখল উজান দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত পুরে। পরনে পার্পল কালার টিশার্ট আর ট্রাউজার। এলোমেলো চুল কপালে ছড়িয়ে আছে। লাল লাল চোখের চারপা‌শ কালো হয়ে আছে কেমন, মনে হয় রাতটা নির্ঘুম কেটেছে উজানে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে জাওভান। জাওভানের মুখটা হাসি হাসি। সে ব্ল্যাক গেঞ্জি উইথ থ্রি কোয়াটার পরে আছে। ভাবটা এমন যেন সে খুশির সংবাদ নিয়ে এসেছে।

কিরণকে দেখেই জাওভান একটা হার্টবিট মিস করল। কিরণের ঘুমঘুম চোখ, ফোলা ফোলা গাল দেখে জাওভানের চোখের দৃষ্টি পাল্টাতে লাগল। সে গিয়ে কিরণের গাল টেনে কপালে চুমু দিলো। পাশে যে তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে, সেটা বোধহয় সেই মুহুর্তের জন্য সে ভুলে গিয়েছে।

‘গুড মর্নিং।’

কিরণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল জাওভানের কান্ডে। অপ্রস্তুত হেসেই বলল, ‘মর্নিং। সকাল সকাল হঠাৎ কি দরকারে?’

‘সরি।’ ভেসে আসে উজানের দিক থেকে।

কিরণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় উজানের দিকে? কি বলল উজান? ঠিকঠাক শুনতে পেল না যেন। নিজের কানকে বিশ্বাস করানোর জন্য সে প্রশ্ন করল,

‘সরি?’

‘সরি।’ উজানের নির্বিকার জবাব।

কিরণের মনে হলো, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য কোনো ঘটনা তার চোখের সামনে এইমাত্র ঘটলো। উজান আর সরি? তাও আবার তাকে? যাকে কিনা গতকাল বাজে বাজে কথা বলেছিল? কিরণের মুখ হা হয়ে গেল সবিস্ময়ে।

উজান তা পাত্তা না দিয়ে বলল,

‘গতকাল তোমার সাথে যেই ব্যবহার করেছিলাম তার জন্য সরি। আমার এমনটা করা উচিৎ হয়নি। আমি মন থেকে অনুতপ্ত। সামনের সপ্তাহে একটা কাজে কক্সবাজার যাবো। সেই হিসেবে তুমি আর জুভও যাবে। তুমি তোমার যেকোনো ফ্রেন্ডকে ইনভাইট করতে পারো। ইটস আ সরি ট্রিট।’

রোবটের মতো কথাগুলো বলে উজান চলে গেল। কিরণ এখনো বিশ্বাসই করতে পারছে না। জাওভান ও’কে ঝাঁকাল।

‘কি হলো? উজান তো সরি বলেছে। সরি এক্সেপ্ট করেছো তো?’

কিরণের হুশ ফিরে। সে সরি এক্সেপ্ট না করলেই বা কি? উজান তো চলেই গিয়েছে। আর এমন যন্ত্রের মতো কথাগুলো বলল যেন সে রিডিং পড়ছিল। সামান্য একটু অনুভূতির লেশমাত্রও ছিল না কথাগুলোতে!

.
.
চলবে…