সায়র পর্ব-০৯

0
238

#সায়র
#পর্ব_০৯
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কিরণ গায়ের শাল ভালো মতো জড়িয়ে দ্বিতীয় তলার করিডোরে হাঁটছিল। ভাবছে একটু আগের ঘটনা। জাওভানকে উপরে উপরে ক্ষমা করলেও মনের গহীনে সে একজন ঘৃণার পাত্র ও ক্ষমার অযোগ্য হিসেবেই থাকবে। জাওভান একটা দুমুখো সাপ। এই ভালো রূপ তো এই খারাপ। একে বিয়ে করে শান্তিতে থাকবে কীভাবে সে? কিন্তু বিয়ে না করে উপায় কি? কোনোভাবে যদি জাওভানের মনের কিরণের জন্য বরাদ্দকৃত অনুভূতিগুলো ধূলিসাৎ করে দিতে পারত তাহলে হয়তো ছাড়া পেত। সমস্যা তো এখানেই, জাওভান একটা জিনিসের জন্য পাগল হলে তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়বে না। আর তা-ই কিরণের জন্য মরণফাঁদ।

কিরণ এসব ভাবছিল আর হাঁটছিল। ঠিক তখন কারো সাথে আচমকা ধাক্কা লাগে। কিরণ পড়ে যেতে নিলে দেয়াল ধরে সামলায়। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পাশে ফিরতেই দেখে ইয়ানা। ইয়ানা দাঁত মুখ খিঁচে কিরণকে দেখছে। কিরণ বুঝতে পারল যে ইয়ানা ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু সে এখন কোনো মারামারিতে যেতে চাচ্ছে না বলে ইয়ানাকে এড়িয়ে চলে যেতে নিচ্ছিল। এক পা বাড়াতেই ইয়ানার কন্ঠ শুনতে পায় সে,

‘স্লাট একটা।’

কিরণ থমকায়। চোখ উল্টিয়ে পেছন ফিরে বলে,

‘সেয়িং বাই দ্য স্লাট হারসেল্ফ। হুহ!’

বলেই ঠোঁট বাকায় কিরণ। সে ফিরে এবার হাঁটা শুরু করে। ইয়ানা দাঁত কটমট করে। চোখ মুখ বিকৃত হয়ে আছে রাগে। হিসহিস করে কিরণকে উদ্দেশ্য করে আবার বলে,

‘তুই একটা কু’ত্তার বাচ্চা।’

‘আর তুই শুয়োরের।’

পেছনে না তাকিয়েই হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয় কিরণ। তারপর করিডোরের অপর প্রান্তে অদৃশ্য হয়ে যায় সে। ইয়ানা পারে না মাথার চুল ছিঁড়তে। সে ভেবেছিল একটা হাতাহাতি লাগবে কিরণের সাথে। তার বড় বড় নখ দিয়ে আঁচড়ে খামচে দেবে কিরণকে। এতে জাওভান তাকে মেরেও ফেলুক না কেন। কিন্তু কিরণ নিজেই তো তাকে ইগনোর করে চলে গেল। ধ্যাত! ইয়ানা শূন্যে লাথি মারে।

কিছু একটা পড়ার আওয়াজে কিরণের পা থামে। উজানের আর্ট রুম থেকে আওয়াজটা আসছে। সে এগিয়ে গেল দ্রুত। দরজাটা হালকা ভেজানো ছিল। সে পুরোটা খুলতেই বিস্মিত হলো। এতটাই বিস্মিত হলো যে তার হাত আপনাআপনি তার মুখে চলে গেছে। চারিদিকে কলো রঙ ছিটানো, তার মাঝে ক্যানভাসগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। ভাস্কর্য টুকরো টুকরো হয়ে সারাঘর ছড়িয়ে। যাচ্ছেতাই অবস্থা রুমটার। রুমের মাঝখানে উজান। সে ক্যানভাস উঠাচ্ছে। আর আহযান মাটির দলা গুলো একত্রিত করছে।

কিরণ ভেতরে ঢুকে সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল,

‘রুমের অবস্থা এমন কেন উজান?’

কিরণের ডাকে উজান এক পলক তাকায়। উত্তর না দিয়ে সে আবার পরিষ্কারের কাজে মন দেয়। উজান থেকে আশানুরূপ জবাব না পেয়ে কিরণ আহযানের দিকে চায়। আহযান কাঁধ ঝাঁকায়। মানে সে জানে না। কিরণ এবার ভেতরে ঢুকে নিজেও তাদের সাথে হাত লাগায়।

‘কি অবস্থা রুমটার। ইশ, প্রতিটি আর্ট শেষ।’ স্বগতোক্তি করে কিরণ।

কিরণকে কাজ করতে দেখে উজান হাতে থাকা ক্যানভাসগুলো টেবিলে রাখে। শান্তস্বরে বলে,

‘তোমার এখানে কোনো কাজ নেই কিরণ। তুমি আসতে পারো।’

‘আজব। তোমাদেরকে হেল্প করছি আমি। দেখছো না রুমটার কি হাল। যেন ঘূর্ণিঝড় গেছে। কি এমন হয়েছে বলো তো?’

শীতল কন্ঠে উজান বলে,

‘আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই এমন করেছি। এখন ইচ্ছা হয়েছে তাই পরিষ্কার করছি। তুমি যেতে পারো।’

‘একসাথে করলে তাড়াতাড়ি হবে।’

‘আমরা দুজনই যথেষ্ঠ।’

উজানের এত নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর কিরণকে কিছুটা ভাবাল। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে, যার জন্য রুমটার এই অবস্থা আর উজানও কেমন বিষাদগ্রস্ত হয়ে আছে। উজানের চোখমুখ তার কাছে এমনই লাগছে, বিষণ্ন বিমর্ষ। কাল অবধিও তো সব ঠিক ছিল। আর কে আছে এত বড় দুঃসাহস দেখানোর? এই কথাটা মাথায় আসতেই জাওভানের চেহারাটা কিরণের চোখে ভেসে আসলো। রাইট। জাওভানই আছে যে এই ধরনের কাজ করতে পারে। কিন্তু কেন?

কিরণ কিছুটা থমথম গলায় বলল,

‘এসব ঐ জুভের কাজ নয়তো?’

উজান প্রত্যুত্তরে চুপ থেকে নিজের কাজে মন দিলো। আহযান এমন ভাবে তাকাল যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে কিরণ কীভাবে জানল এসব জাওভানের কাজ! আহযানের মুখাবয়ব দেখে কিরণ বুঝে গেল জাওভানের কাজ এসব। আড়ালে বড় একটা শ্বাস ফেলল সে।

.

.

উজানের বাংলোটার পেছনে নদীর ধারে কিরণ বসেছিল।‌ বিকেলের ঠান্ডা বাতাস কিরণের গায়ে কাঁটা হয়ে বিঁধছে। তার পরনে কোনো সোয়েটারও নেই। কিন্তু সেদিকে খেয়াল না দিয়ে ছোট ছোট কংকরগুলো নদীতে একধ্যানে ছুঁড়ছিল। কিরণ চাইছিল আজকেই চলে যাবে বাসায়। কিন্তু জাওভান বলেছে এখান থেকেই তারা কক্সবাজার যাবে আগামীকাল। তাই আর তার বাসায় যাওয়ার দরকার নেই যেহেতু কিরণ লাগেজ সাথে করেই এনেছে। গতকালই কিরণ ময়মনসিংহ থেকে এসেছে। তার অফিসের ছুটিও শেষ। বসকে কীভাবে ম্যানেজ করবে? এখন আবার ছুটি চাইলে তো দিবেই না উল্টো আরো ধমকাবে। আর জাওভান যদি বসকে ফোন করে তাহলে তো কিরণ নিজেই ফাঁসবে। কিরণ বুঝতে পারছে না কীভাবে ম্যানেজ করবে। মীরাকে বললে সেই গাধী উল্টো আরো তাকে ফাঁসিয়ে দিবে। উজান! ইয়েস, উজানকে দিয়ে বলালেই তো চলে। ও তো সবটা জানেই। ও’কে দিয়ে বসকে হ্যানত্যান তালিবালি বুঝিয়ে ছুটি নেওয়া যাবে। কারণ বস তো উজানের ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত।

কিরণ নিজের প্ল্যানের জন্য নিজেকেই বাহবা দিচ্ছিল। এখন খালি উজান ঘাড়ত্যাড়াকে ম্যানেজ করতে পারলেই হলো। কিরণ উঠে গিয়ে পেছন ফিরবে তার আগেই সে পেছনে থাকা মানুষটার বুকে হোঁচট খেয়ে উল্টে নদীতে পড়ে যেতে নিলো। মানুষটি তড়িৎ গতিতে কিরণের হাত ধরে তাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাল। কিরণ ঝুলে রইল। তার চুলের আগার কিছু অংশ নদীর পানি ছুঁলো। কিরণ মাথা উঠিয়ে তার হাত ধরা মানবটির দিকে তাকিয়ে দেখল উজান। কিরণ কিছুটা চমকালো। উজানের নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। চেহারা সমুদ্রের ন্যায় শান্ত। এই উজানের চোখের ভাষা এতটা কঠিন যে মাঝে মাঝে কিরণ ধরতে পারে না উজানের মনে ঠিক কি চলছে। আবার কখনো কখনো মনে হয় উজানকে সে পড়ছে। কিন্তু এই মুহুর্তের উজানের চোখ মুখের ভাষা ঠাহর করতে পারল না কিরণ। মূলত সে করতে চাইলোই না।

উজান হ্যাঁচকা টানে কিরণকে সোজা দাঁড় করালো। হাত ছাড়ল না। কিরণ নিজেই উজানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। উজানের দৃষ্টি এখনো তার দিকে নিবদ্ধ। কিরণ ভেতরে ভেতরে এতটাই অস্থির অনুভব করল যে ঠিকমতো কিছু বলতেই পারল না। কিন্তু উজানও তো কিছু বলছে না। এভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করার মানে হয় না। তাই সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আরম্ভ করল,

‘থ্যাংকস বাট তুমি এখানে হঠাৎ?’

উজান তার দৃষ্টি সরিয়ে নদীর পানিতে বিদ্ধ করল। স্থির গলায় বলল,

‘জায়গাটা আমার তাই আমি এখানে।’

উজানের এমন কাটকাট উত্তরে কিরণ ভেংচি কাটতে গিয়ে থামল। এখন উজানের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। ও’কে রাগিয়ে দিলে যদি বসের সাথে কথা বলতে না করে দেয়! তাই কিরণ জোর করে মুখে হাসি এঁটে রাখল। দেখল কিছুটা দূরে গাছের গুড়ির কাছে ক্যানভাস আর রংতুলি রাখা।

‘ও তুমি ছবি আঁকছিলে!’ জোর করে হাসল কিরণ।

ঠান্ডা বাতাসে উজানের কপালের ধারের চুলগুলো উড়ছিল। চোখের মোটা ফ্রেমের আবরণের বিপরীতে থাকা গম্ভীর দুটো চোখ তীর্যক দৃষ্টিতে নদীর পানে তাকিয়ে। কিরণ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে যথাসম্ভব সুন্দর গলায় বলল,

‘উজান। একটা সাহায্যের প্রয়োজন ছিল।’

উজান নিরুত্তর।

‘আমি আরকি জুভের সাথে এখন কোনো ঝামেলা করতে চাইছি না। আর বসের থেকে ছুটি নেয়াও সম্ভব না। জুভ যদি বসকে ফোন করে তাহলে আমাদের মাঝে ঝামেলার সৃষ্টি হবে। আই থিংক তুমি বুঝতে পারছ আমি কিসের কথা বলছি।’

কিরণ এবার ধীরস্বরে বলে,

‘তুমি যদি কষ্ট করে একটু বসের সাথে কথা বলতে..মানে ছুটির কথাটা যদি…’

‘বসের নাম্বার দাও।’

কিরণ নিজের দু’কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। সিরিয়াসলি? উজান এত সহজভাবে মেনে নিচ্ছে? মানে সিরিয়াসলি? এটা কি আদৌ পসিবল? কিরণ এই প্রথম কিছু একটা বলল আর উজান কোনো বাক্যব্যয়ে মেনে নিলো? কিরণ ভেবেছিল উজান প্রথমে তাকে হেল্প করতে মানা করবে কিংবা বলবে, “নিজের ঝামেলা নিজে সামলাও। আমি কোনো সামান্য মেয়ের চামচা নই যে তার হয়ে অন্যের কাছে ছুটির জন্য মিনতি করব।” কিন্তু হলো কি? উজান এত সহজে তাকে হেল্প করছে! এটা কোন উজান? এত চেঞ্জ? যাক গে, সেসব পরেও ভাবা যাবে। কিরণ উজানকে নাম্বার দিলো। উজান কল করলো কিরণের বসকে।

‘আপনি কি কিরণের বস বলছেন?’

‘জি কিন্তু কে আপনি?’

‘আমি কিরণের… ‘

উজানের কথার মাঝখানে বস বলল, ‘আপনি কি কিরণের বয়ফ্রেন্ড বলছেন?’

উজান একবার কিরণের দিকে তাকাল। কিরণ তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না। ছোট করে উজান উত্তর দিলো,

‘হুম।’

‘জি স্যার বলুন।’

‘কিরণের ছুটির দরকার। এক সপ্তাহের জন্য।’

‘কিন্তু স্যার কিরণের এক সপ্তাহের ছুটি তো শেষ। এখন আবার ছুটি…’

‘সি ইজ সিক।’

‘কি হয়েছে ওর? এনিথিং সিরিয়াস?’

‘নিউমোনিয়া।’

বস দুঃখ পেয়েছে এমনভাবে বলল, ‘সো স্যাড। আচ্ছা স্যার, ও যতদিন ইচ্ছে ছুটি নিক।’

‘ওকে। রাখছি।’

উজান ফোন কেটে দিতেই কিরণ চেঁচিয়ে বলল,

‘আর কোনো ওজুহাত খুজে পাওনি? সরাসরি নিউমোনিয়া?’

উজান আবারও কিরণকে উপেক্ষা করে কোনো উত্তর না দিয়ে ক্যানভাস তুলি নিয়ে গটগট করে চলে গেল। কিরণ দুহাত কোমড়ে রেখে বিরক্তির সুরে বলল,

‘আজব দুনিয়ার আজব মানুষ!’

.
.
চলবে…

#সায়র
#পর্ব_৯ [এক্সট্রা]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

রাতের বেলায় মিনি ছাদের সুইং বেঞ্চে বসে ছিল কিরণ। দৃষ্টি তার তারাভরা আকাশে। ছাদের রেলিংয়ে সোনালী রঙের আলো নৈসর্গিক এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করছিল। জাওভান দু’টো কফি মগ এনে একটা কিরণকে দিল আরেকটা নিয়ে সে কিরণের পাশে বসল। সামনে পাতা চেয়ারে আহযান বসে ছিল। এতক্ষণ তার দৃষ্টি কিরণের উপরে থাকলেও জাওভান আসায় তা সরিয়ে নিলো। একটু পর উজান আসলো। সে এসে আহযানের সামনের চেয়ারটায় বসল। নেভি ব্লু রঙের জ্যাকেট থেকে পাঁচটি টিকিট বের করে টি টেবিলের উপরে রাখল। একটি বাড়তি টিকিট কারণ কিরণ নাকি তার কোনো ফ্রেন্ডকে ইনভাইট করেছে। জাওভান বারণ করতে চেয়েছিল কিন্তু তখনকার ঐ ব্যবহারের কারণে কিরণকে কষ্ট দিয়েছিল বলে আর বারণ করেনি।

উজান চোখের চশমা একহাতে ঠিক করে নিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘কাল সকাল আটটায় ফ্লাইট। কিরণ, তোমার ফ্রেন্ডকে বলবে সাড়ে সাতটার মধ্যে এয়ারপোর্টে থাকবে।’

কিরণ মাথা নাড়িয়ে কফিতে চুমুক দিলো। তখন ইয়ানা আসলো ফোন দেখতে দেখতে। উজানের কথায় সে মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কোথাও যাওয়া হচ্ছে?’

‘কক্সবাজার।’ উত্তর দিলো জাওভান।

‘কখন এসব নিয়ে তোরা প্ল্যান করলি? আমাকে তো কিছুই জানালি না।’

‘প্ল্যান অনেক আগেই করেছি। তোকে জানাইনি কারণ তুই ইম্পর্টেন্ট কেউ না তাই।’ কফি পান করতে করতে জাওভান বলল। তার চোখ বারবারে কিরণের ঠোঁটের দিকে যাচ্ছে। কিরণ এত চমৎকারভাবে ঠোঁট গোল করে কাপে চুমুক দিচ্ছে যে জাওভানের হিংসা হতে লাগল। সে কেন কফি মগটা হলো না?

‘তাই বলে জানানো যায় না? কে কে যাচ্ছিস তোরা? ঐখানে তো পাঁচটা টিকিট।’

‘এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। ঐ পাঁচটার মধ্যে তোমার কোনো টিকিট নেই।’

কিরণ ভেঙচি কেটে উত্তর দিলো। ইয়ানার পিত্তি জ্বলে গেল এতে। সে উজানের সামনে গিয়ে বলল,

‘আমি তোর সাথে কথা বলছি উজি। তোরা ঘুরতে যাচ্ছিস আর আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করলি না? এতটাই পর হয়ে গেছি আমি? নাকি আমাকে নিলে টাকা বেশি খরচ হবে বলে বাদ দিয়েছিস?’

‘আমরা আজাইরা মানুষ সাথে নেই না।’ আবারো জবাব দিলো কিরণ।

আহযান মিটিমিটি হাসল। ইয়ানা চোখ বন্ধ করে রাগের ঢোক গিলল। কিরণের দিকে ফিরে তার দিকে তেড়ে এসে বলল,

‘তোর সমস্যাটা কি? তোর সাথে কথা বলছি আমি? আর আজাইরা কাকে বলছিস? আমি ওদের কাজিন। তুই নিজে আজাইরা। বেয়াদব একটা…’

ইয়ানার কথা শেষ হতে দেরি কিন্তু তার গায়ে জাওভান কফি ছুঁড়তে দেরি করল না। হালকা গরম ছিল বিধায় তেমন কিছুই হয়নি। তবে ইয়ানা এমন জোরে চিৎকার করলো যেন তার গায়ে সাপ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তা দেখে আহযান বিড়বিড় করে বলল, ‘ন্যাকা মাইয়া মানুষ।’

জাওভান ধমকে উঠে ইয়ানাকে,

‘মুখ সামলে কথা বলবি। আমার সামনে আমার কিরণের সাথে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস কি করে হয় তোর!’

ইয়ানা রাগে কাঁপতে থাকে। সে উজানের দিকে ফিরতেই দেখে উজান নেই। সে তো সেই কখনই জায়গাটা ত্যাগ করেছে। তার এসব নাটক দেখার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ইয়ানা জাওভানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই জাওভান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

‘তোর ঘ্যানঘ্যান শোনার টাইম নেই। তোকে আমরা কক্সবাজার নেবো না সাথে। সকালে রেডি হয়ে থাকবি, তোকে বাসায় ছেড়ে দেওয়া হবে।’

‘রাস্তার মাঝে ছেড়ে দিলে বেটার হয়।’ কিরণ বাঁকা হেসে বলল। তখন ঝগড়া না করলেও এখন ভালোই লাগছে ইয়ানাকে রাগিয়ে দিতে। ইয়ানার ইচ্ছে করছে কিরণকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। এখন চাইলেও সে কিছু করতে পারবে না জাওভানের জন্য।

জাওভান হেসে বলল,

‘অ্যাজ ইওর উইশ মাই লেডি।’

তারপর ইয়ানার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘যা এখন। উই নিড প্রাইভেট স্পেস।’

ইয়ানা পা আছড়িয়ে আছড়িয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে কিরণকে চোখের ইশারায় বলল, “দেখে নেব।” তা দেখে কিরণ চোখ টিপ দিলো।

জাওভান সামনে বসা আহযানের দিকে তাকিয়ে হুকুমের সুরে বলল,

‘এই যে উজানের স্টুডেন্ট। আপনিও যান এখন।’

আহযানের মোটেই ইচ্ছে করছিল না যেতে। তার এখানে শীত শীত আবহাওয়া ভালো লাগছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে গেল পাছে জাওভান তাকে কলার ধরে উঠিয়ে নেয়। তখন তো কিরণের সামনে মান সম্মান ফুস করে উড়ে যাবে।

জাওভান কিরণের গা ঘেঁষে বসলো। কিরণ উঠে যেতে চাইলে জাওভান তার ডান হাত ধরে আবার বসিয়ে দেয়।

‘ঘরে চলো। শীত লাগছে।’

জাওভান তার জ্যাকেট খুলে কিরণের গায়ে পেঁচিয়ে দিয়ে বলে, ‘এবার শীত লাগবে না।’

কিরণ অসহ্যকর শব্দ তুলে। তার ভালো লাগছে না জাওভানের সাথে। জাওভানকে যত এড়িয়ে যেতে চায় জাওভান ততই তার নিকটে আসে। কিরণ কাঠ হয়ে বসে রইল।

‘কি দরকার তাড়াতাড়ি বলো।’

‘বলার জন্য কি বসেছি নাকি! দুজন একটু আলাদা সময় কাটাই, সারাদিনে তো তোমাকে একটু কাছেও পেলাম না।’

কিরণ বিরক্তিকরভাবে চোখ উল্টায়। আজ সারাদিন জাওভান তার পেছন পেছন আঠার মতো লেগে থেকেছে তাও নাকি সে তাকে কাছে পায় না!

কিরণকে চুপ থাকতে দেখে জাওভান কিরণের এক হাত নিয়ে নিজের একহাতে মুষ্টিবদ্ধ করল। একটু এগিয়ে এসে কিরণের চুলের ঘ্রাণ নিলো। কিরণ ঠায় বসে রইল। এখন চুপচাপ বসে থাকলে জাওভানের নাটকও তাড়াতাড়ি শেষ হবে। জুভ কিরণের হাত নাকের কাছে নিয়ে টেনে টেনে ঘ্রাণ নিলো। কিরণের হাতে কি মারাত্মক নেশা জাগানিয়া ঘ্রাণ! জাওভানকে মোহিত করে তুলল। কিরণের হাতে এত সুন্দর ঘ্রাণ না জানি শরীরের ঘ্রাণ কেমন। কথাটি মাথায় আসতেই জাওভানের শরীর জেগে উঠল। সে কিরণের হাতে চুমু দিলো। একটা না দুইটা না, পরপর অনেকবার। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে থাকা কিরণ অতিদ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। হাত সরিয়ে নেওয়ায় জুভ কিরণের দিকে তাকাল। জাওভানকে দেখে কিরণ চমকালো। জাওভানের চোখের ভাষা তার কাছে পানির মতো সহজ। এখন জাওভানের চোখে নেশা দেখছে সে। তার জন্য নেশা। কিরণ জাওভানকে দুহাতে দূরে ঠেলে দিয়ে উঠল। এই মুহুর্তে জাওভান যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে। কিরণ বড় বড় পা ফেলে চলে যেতে লাগল।

জাওভান দৌড়ে এসে কিরণের কোমড় জড়িয়ে ধরল।

কিরণ নিজেকে ছাড়াতে লাগল, ‘জুভ ছাড়ো।’

জাওভান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কিরণের ঘাড়ের কাছে নাক ঘষতে লাগল। জ্যাকেট গলিয়ে কিরণের পেটে হাত দেয়ার চেষ্টা করল। এই শীতল আবহাওয়া, মৃদু লাইটিং জাওভানের কামনাকে আরো জাগিয়ে তুলল। কিরণের গা ঘিনঘিন করতে লাগল। তাদের এই সম্পর্কে জাওভান শুধু কয়েকটা চুমু খেয়েছিল কিরণকে, কপালে কিংবা গালে। তাও কিরণের কিছু বুঝে ওঠার আগেই। এছাড়া সে কখনোই জেনে বুঝে জাওভানকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। কিরণ খুব কষ্ট করে তার পেটের দিকে ধেয়ে আসা জাওভানের হাত ঠেকাল। জাওভানের শক্তির সাথে সে পারছে না।

‘জুভ ছাড়ো।’ কিরণ ছটফট করতে লাগল।

জুভের কানে কিচ্ছু ঢুকল না। তার মাথায় নেশা চড়ে বসেছে। কিরণকে কাছে পাওয়ার নেশা। কিরণের ক্রন্দনরত কন্ঠও তার কাছে নেশার মতো লাগছে।

‘জানোয়ারের বাচ্চা ছাড়।’ কিরণ চেঁচালো আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল। জাওভান কিরণকে দেয়ালে চেপে ধরতে চাইল। সেই সুযোগে কিরণ তার পা দিয়ে জাওভানের পায়ের ভেতর ঢুকিয়ে ল্যাং মারার চেষ্টা করল। এবং সফলো‌ও হলো। পাশে থাকা প্ল্যান্টের টব উঠিয়ে জাওভানের মুখ বরাবর ছুড়ে মারল। জাওভান গাল কেটে গেল। তবুও তার নেশা ছুটল না। সে উঠে গিয়ে কিরণকে ধরবে তার আগে কিরণ গাছে পানি দেয়ার জন্য পাইপ নিয়ে জাওভানের দিকে তাক করল। কিরণ জানে জুভ তার মাইন্ড লস্ট করেছে। জাওভানের মনকে অন্যদিকে কনভার্ট করতে পারলেই তার এই নেশা উধাও হয়ে যাবে। ঠিক তাই হলো, গা কাঁপানো ঠান্ডা পানি জাওভানের গায়ে এসে পড়তেই সে তার হিতাহিত জ্ঞান লাভ করলো। গালের ক্ষতে, সারা শরীরে ঠান্ডা পানি ধারালো অস্ত্রের মতো বিঁধল। কিরণ ততক্ষণ পর্যন্ত পাইপ তাক করেই রাখল যতক্ষণ না জাওভানের কাশি উঠে।

প্রায় আট দশমিনিট পর কিরণ পাইপ নামাল।

‘কেমন বোধ করছো?’

ঠান্ডার কারণে জাওভান কিছু বলতে পারল না। তাছাড়া নদীর ঠান্ডা বাতাসও তার গায়ে চুমু দিয়ে যাচ্ছে। তার শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। দাঁতে দাঁত লেগে এলো। কিরণের একটুও দয়া হলো না। বরং ভালোই লাগল জাওভানকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পেরে।

জাওভানের জ্যাকেটটা কিরণের গায়ে ছিলো। সে সেটা জাওভানের পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে জিহ্বা দিয়ে চুক চুক আওয়াজ তুলে বলল,

‘আহারে, অনেক কষ্ট হচ্ছে?’

তারপর জাওভানের চুল থেকে পানিগুলো ঝড়িয়ে দিতে দিতে বলল,

‘কি করতে যাচ্ছিলে এখন মনে পড়ে? আজকে না ক্ষমা চাইছিলে আর বলেছিলে আমাকে কোনো কিছুতে জোর করবে না? এখন কি হলো?’

জাওভান আবার অনুতপ্ত হলো তার কাজের জন্য। দাঁত ঠকঠকানির মধ্যেই বহু কষ্টে উচ্চারণ করে, ‘সরি কিরণ..’

কিরণ জানতো জাওভান এটাই বলবে। এছাড়া আর কি বলার আছে? একটা ভুল করবে, আবার সরি বলবে, আবার ভুল করবে, এভাবেই চলতে থাকে তার। কিরণ অভ্যস্ত। তাই তো আজ জাওভানের করা কাজে ভয় পায়নি। উল্টো তার কাজকে ভিত্তি করেই পানি ঢালতে পারল।

‘হয়েছে, এখন চলো নিচে, যত্তসব।’

জাওভান রোবটের মতো হাঁটতে লাগে ঠান্ডায়। কিরণ তাকে থামিয়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

‘ওয়েট। আমি আগে যাবো। আর শুনো, তোমার যদি জ্বর আসে উজানকে বলো না যে এসব আমার জন্য হয়েছে। এমনিতেও দোষ তোমার, তবে তোমার দোষ জেনেও তো তোমার প্রাণের ভাই তোমাকে কিছু বলবে না, উল্টো আমায় কথা শোনাবে। তার চেয়ে বরং কিছুই বলার দরকার নেই। কিছু জিজ্ঞেস করলে নিজের জন্য জ্বর হয়েছে বা এমন কিছু একটা বলবে যাতে আমার দিকে আঙুলটা না যায়।’

বলেই কিরণ হেঁটে চলে গেল। জাওভান তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তার কিরণটার সাথে আজকে সে কি করতে যাচ্ছিল! যদি কিছু হয়ে যেত তাহলে তো কিরণ তাকে কোনোদিন ক্ষমা করতো না। কিরণ তার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এটা ভাবলেই তো তার মনে কষ্ট অনুভূত হয়। সে তো শুধু চায় কিরণ তার সাথে প্রতিদিনকার মতো হাসিখুশি ভাবে কথা বলুক। ভালোই হয়েছে কিরণ তার নেশা কাটিয়েছে। থ্যাংকস মাই লাভ।

.

.

পরদিন ইয়ানাকে তার বাড়িতে ড্রপ করে বাকিরা এয়ারপোর্টে চলে যায়। তার আগে উজান ফার্মাসিতে গিয়ে ঔষধ কিনে আনল। জাওভান সারা রাস্তা একের পর এক হাঁচি দিয়েই চলছে। তাল গায়ে মোটা মোটা দুটো জ্যাকেট জড়ানো তার উপর আবার কম্বল পেঁচানো। উজান জাওভানকে নিয়ে এতোই টেন্সড যে হাসপাতালেও পর্যন্ত যেতে চেয়েছিল। জাওভানই বলেছে তার কোনো সমস্যা হবে না, খালি জ্বরের ঔষধ কিনলেই চলবে। ভাইকে নিয়ে উজানের এত আদিখ্যেতা কিরণের অসহ্য লাগল। এই এত আদিখ্যেতা যদি না দেখাত ভাইয়ের জন্য তাহলে কিরণের এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। জাওভান কিরণকে ছাড়া থাকতে পারবেনা বলেই তো কিরণ আজ জুভের কাছে বন্দী। সব দোষ উজান বেয়াদবটার।

এয়ারপোর্টে আগেই বসে ছিল আয়াত। গত রাতে যখন কিরণ আয়াতের সাথে কথা বলছিল তখন কথার প্রসঙ্গে কক্সবাজারের কথা বলেছিল। এটাও বলেছিল যে উজান কিরণকে বলেছে যে সে যেকোনো ফ্রেন্ডকে নিতে পারবে। কিন্তু মীরার কাজ থাকায় সে যাবে না। কিরণের কথা শুনে আয়াত মনে মনে চাইল সে যাবে। জাওভান আর উজানকে প্রথম দেখার পর তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এখন এই সুযোগটা মিস করতে চায় না সে। ইনিয়ে বিনিয়ে কিরণকে বলল সেও নাকি কোথাও ঘুরতে চায় কিন্তু বাবা মা দেয় না। কিরণ বুঝে গেল যে আয়াত আসতে চায়। তাই সে প্রস্তাবটি দিলো।

আয়াত সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। কিরণ তো এও বলে ফেলল, “তুমি উজানকে দেখার জন্য যাবে তাই না?”

আয়াত লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে হ্যাঁ বললেও সে মনে মনে বলে, শুধু উজান না, আড়ালে তোমার বফটাকেও দেখার চান্স মিস করব না।

কিরণ আয়াতকে দেখে হাই দেয়। আয়াত আজ খুব সেজেগুজে এসেছে সে। সাদা সালোয়ার কামিজ, কালো শাল, ম্যাচিং করে মেকাপ। অপ্সরীর মতো লাগছিল তাকে। আয়াত এসে সবার সাথে হায় হ্যালো করল। উজানের দিক থেকে তার চোখ সরছে না। উজানের পরনে ছিল কালো জিন্স আর কালো লম্বা কোট, উজানকে এত হট লাগছিল যে আয়াত বারবার আড়চোখে তাকে দেখছিল। আজ মুখে মুখে সে হাই বলল, ঐদিন যে লজ্জাটা পেয়েছে তা সে আর পেতে চায় না। উজান আজ স্বাভাবিক ব্যবহারই করল। তবে জুভের জ্বরের কারণে সে কারো সাথেই কোনো কথা বলতে পারল না। খালি কিরণের হাত ধরে আছে। আয়াত তৃতীয়বারের মতো আবার ক্রাশ খেয়েছে অচেনা আরেক পুরুষকে দেখে। আহযান। এত সব হ্যান্ডসাম ছেলে কিরণের কেন পরিচিত হতে হলো! তার কেন নয়?

.
.
চলবে…