#সায়র
#পর্ব_১০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
উজান বসে আছে বারান্দায়। আজ সূর্য উঠেনি। সফেদ কুয়াশার কুণ্ডলী মাকড়সার জালের মতো বিছিয়ে আছে ধরণী জুড়ে। দুপুরে তারা সায়মন বীচ রিসোর্টে উঠেছে। সবার জন্য আলাদা রুম বরাদ্দ শুধু আয়াত আর কিরণের জন্য একটি। দুপুরের লাঞ্চ করে উজান সোজা তার রুমে চলে এসেছে। বিকেলে তাদের হাঁটতে বের হওয়ার কথা থাকলেও জাওভানের অসুস্থতায় কেউই যেতে পারেনি।
উজান চেয়ারে বসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে আছে। যদিও কুয়াশার বিচরণে দূরের সমুদ্রের কিছুই দেখা যায় না। হাতে তার সিগারেট। সে কখনোই এসব সিগারেট খায়নি। ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় স্কুল কলেজে কোনো ফ্রেন্ড বানাতে পারেনি। বিকেলে মাঠে ছেলেরা খেললেও সে যায়নি। তার এসব ভালো লাগে না। একা থাকতে ভাল্লাগে। সকালে উঠে স্কুল যাওয়া, ফিরে এসে আর্ট নিয়ে বসা এই ছিল তার দিনকার রুটিন। তবে জাওভান ছিলো সকলের মধ্যমণি। স্কুল কলেজের প্রতিটা মেয়ে ছেলের সাথে তার ভাব ছিল। কোনো খেলা তাকে ছাড়া ভাবা যেত না। সারাদিন সে ঘরের বাহিরে থাকত। সন্ধ্যা হলে ভাইয়ের কাছে আসতো। তখন উজানও ফ্রি থাকত। সেসময় দুইভাই মিলে গল্প, লং ড্রাইভ, ঘোরাঘুরি করত। ছোটোবেলায় উজানের একমাত্র বন্ধু বলতে জাওভানই ছিল এবং আছে।
জাওভানের হাজারো ফ্রেন্ড থাকলেও সে কাউকেই নিজের প্রায়োরিটির লিস্টে রাখেনি। চলার মতো করে চলেছে। শুধুমাত্র স্বল্পভাষী, ইন্ট্রোভার্ট উজানকেই নিজের বেস্টফ্রেন্ড বানিয়েছে। তার নানা ধরনের ফ্রেন্ড থাকায় ভালো খারাপ সব অভ্যাসই রপ্ত করেছে সে। এসব সিগারেট মদ নতুন কিছু না। কিন্তু উজানের কাছে নতুন। প্রথম মদ খেয়েছিল উচ্চমাধ্যমিকে থাকতে। কৌতুহল থেকেই। তবে সিগারেট সে ছুঁবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। তার এই প্রতিজ্ঞার কথা জেনে জাওভান ইচ্ছে করে ছলে বলে কৌশলে উজানকে সিগারেটও খায়িয়ে ছেড়েছে। একটান দেয়ার পর উজানের দমে সয় না। সে ফেলে দেয়। ওটাই প্রথম আর শেষ ছিল। এরপর আর ভুলেও সে এসব ধরেনি।
আজ লাগেজ নামানোর সময় জাওভানের লাগেজের কোণায় এই সিগারেটের বাক্স পেয়েছে। ট্রিজার্স অ্যালুমিনিয়াম গোল্ড। সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ সিগারেট। সিগারেট অবশিষ্ট ছিল একটা। তার মানে জাওভান এখনো লুকিয়ে সিগারেট খায়! অথচ সে কিরণকে প্রমিস করেছিল সিগারেট ছুঁয়েও দেখবে না। কিরণ সবচাইতে ঘৃণা করে এই সিগারেট খাওয়াকে।
উজান সিগারেট ধরিয়ে হাতে ধরে বসে রইল। মুখে নিলো না। আগুনের হল্কাগুলো কীভাবে সিগারেটের কাগজ ধীর গতিতে পুড়িয়ে অদৃশ্য করে দেয় সেটাই মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সে।
মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে দরজায় কড়া নাড়া শব্দে। দৃষ্টি ফেরায় উজান। হাত থেকে সিগারেট না ফেলেই দরজার দিকে এগোয়। দরজা ভেজানোই ছিল। তবে বাহিরের মানুষটি ভদ্রতাস্বরূপ নক করল। দরজা খুলে দেখে কিরণ দাড়িয়ে আছে। কিরণের পেছনে আরেকটা মেয়েও উঁকি দিচ্ছে। উজান চিনতে পেরেছে মেয়েটাকে। কিরণের বাড়িওয়ালার মেয়ে নাকি। নামটা ভুলে গিয়েছে সে। মনে রাখার চেষ্টাই বা করেছে কবে? তার জীবনে এসব গুরুত্বহীন জিনিসের প্রতি অনীহা ছাড়া আর কিছুই কাজ করে না।
‘তুমি যে ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনলে ঐ প্যাকেটটা কি তোমার কাছে?’ কিরণের তড়িঘড়ি প্রশ্ন।
‘হুম।’
‘ওটা তাড়াতাড়ি দাও। জুভের জ্বর বেড়েছে।’
উজান দ্রুত পায়ে লাগেজ থেকে ঔষধের প্যাকেট বের করল। হাতের সিগারেট অ্যাশ ট্রেতে রাখল। দৃশ্যটা দৃষ্টিগোচর হলো না কিরণ কিংবা আয়াতের। কিরণ কিছুটা নাক ছিটকালো। উজান যে সিগারেট খায় সে সেটা জানতো না। উজানকে সে পিওর ভেবেছিল। তার পেছনে আয়াতের চোখও বড় বড় হয়ে গেল।
উজান প্যাকেট হাতে কিরণের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। একটা কথাও বলল না। কিরণ অবাক না হলেও আয়াত যারপরনাই অবাক হলো। উজান বড় বড় পা ফেলে চলে গেছে। কিরণ আর আয়াত জুভের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো। আয়াত তার ডাগর ডাগর চোখ গোল গোল করে বলে,
‘এটা কি হলো? আমাদেরকে না দেখার ভান করে নিজেই প্যাকেট নিয়ে চলে গেল? এত বড় অপমানস! কিরণ, এই লোকটা তারমানে তোমাকে এভাবেই সবসময় ইগনোর করে?’
কিরণ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
‘এই লোকের পাত্তা আমি জীবনে চেয়েছি নাকি যে ইগনোর করবে। এই লোক যাকে ভালো লাগে না তাকে এমনেই ইগনোর করে।’
‘তুমি তো তার ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড। তোমাকে ভালো লাগে না কেন?’
‘ভালো লাগবেই বা কেন? ভাবে তার জানের জিগারের ভাইকে আমি হাত করে নিয়েছি। যত্তসব। বাদ দাও এসব আজাইরা মানুষের কথা।’
আয়াত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘উনি সিগারেটও খায় দেখলে?’
‘দেখলাম তো।’
‘সিগারেটটা দেখেছো, ব্র্যান্ডের সিগারেট। আমার বাপির কাছে দেখেছিলাম। কিন্তু এত এক্সপেন্সিভ যে বাপি দ্বিতীয়বার এটা কেনার কথা ভাবেনি। আর উজান সিগারেট খায় ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল।’
আয়াতের মনটা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেল। সে যদি দেখে তার খুব কাছের বা প্রিয় মানুষ সিগারেট খায় তাহলে তাদের সাথে সে জীবনেও মিশে না। তার বাবার কাছ ঘেঁষতে চাইতো না যতদিন না বাবা সিগারেট ছাড়ে। ক্রাশের সময়ও সেম। ক্রাশ যতই সুন্দর আর হ্যান্ডসাম হোক না কেন, যদি তাদের একটা খারাপ গুণ সে পেয়ে যায় তাহলে তার কাছে ঐ ব্যক্তিটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ মনে হয়। আর ঐ খারাপ গুণটা যদি সিগারেট হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। এটা আসলে তার ভালো দিক নাকি খারাপ দিক সে নিজেও বুঝতে পারে না। এখন চোখের সামনে তার হার্টবিট বাড়ানো ক্রাশকে সিগারেটের সাথে দেখে ক্রাশ নামক বাশ হাওয়ায় উড়ে গেছে। উজানকে দেখে দ্বিতীয়বারের মতো ফিলিংস আসবে কিনা সন্দেহ।
‘কি হলো আপু, মুখটা অমন পাংশুটে হয়ে গেল কেন?’
‘উজান বাদ। লিস্ট থেকে ক্রস করে দিলাম তাকে।’ আয়াত মর্মাহত গলায় বলল। আয়াতের কথার বলার ধরণে কিরণ হেসে ফেলল।
.
.
ধরণীতে সাঁঝ নেমেছে। সমুদ্রের শোঁ শোঁ আওয়াজ রুম থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিরণ রুমে ফোন হাতে শুয়ে আছে। মা আর ভাইয়ের সাথে কথা বলছিল। তার ছোট ভাই সামনে এসএসসি পরীক্ষার্থী। নাম কিয়াদ। তার ভাইয়ের স্বপ্ন পাইলট হবে। দেশে বিদেশে আকাশযান নিয়ে চলবে। ভাইয়ের এই স্বপ্ন দেখাটাকে কিরণ সমর্থন করে। সে কিয়াদের স্বপ্ন অপূর্ণ রাখতে দেবে না।
কিরণ রুমে আলো জ্বালায়নি। বালিশে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। আয়াত এসে জ্বালিয়ে দিলো। হুট করে চোখে আলো পড়ায় কিরণ চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
‘লাইট বন্ধ করো আপু। ভাল্লাগছে না।’
আয়াত এসে কিরণের হাত ধরে টানাটানি করে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,
‘ঘুরতে এসে কার না ভালো লাগে। চলো চলো, সমুদ্র দেখতে যাব।’
‘যাবো না। এই ঠান্ডায় কিসের সমুদ্র! ভালো লাগে না যেতে।’
‘কি যাবে না হুম? তোমার মতো আজিব মেয়ে খুব কম দেখেছি। সমুদ্র নাকি তার ভাল্লাগেনা! আরে মেয়ে, একবার আসোই তো। এই বরফ শীতল পানিতে একবার পা না ভেজালে জীবনটাই অপরিপূর্ণ। আমাদের সাথে আহযানও যাবে।’
কিরণ চোখ খুলল এবার। আয়াতের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।
‘ওহ এবার বুঝলাম কেন এত তাড়া তোমার।’
কিরণের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আয়াত লজ্জা পেল। তা দেখে কিরণ ঠাট্টার হাসি হেসে বলল,
‘তুমি আর ভালো হবে না আপু। যাকে দেখো তাকেই ভাল্লাগে।’
‘একটা গেলে কি হয়েছে? এরকম হাজারটা আসবে যাবে। তবে আহযানও কিন্তু অনেক সুদর্শন।’
‘উজির থেকেও বেশি?’
আয়াত কেশে বলল, ‘তা নয়, তবে এখন তো আমার চোখে উজানকে আর ভালো লাগে না। তাই এখন আহযানকেই বেশি সুদর্শন লাগছে।’
‘তো তুমি যাওনা তোমার ঐ সুদর্শনের সাথে। আমাকে ডাকছ কেন?’
বলেই কিরণ বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
কিন্তু আয়াত গোঁ ধরল সে কিরণকে ছাড়া যাবে না। অগত্যা কিরণকে সাধের বিছানাকে বিদায় জানাতে হলো। হুডির উপরে আরো একটা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে বের হলো সে। যাওয়ার আগে জাওভানের রুমে গিয়ে একবার চেক করে আসলো। জাওভানের গায়ে মোটা মোটা দুইটা ব্ল্যাংকেট, সে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। ঘুম পাড়াতেও যত ঝামেলা হয়েছিল। কিরণকে জাওভানের হাত ধরে ঘুমানো অবধি এক ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছে। জাওভানের চোখ মুখ জ্বরের কারণে ফ্যাকাশে হয়ে আছে। নাক কান লাল। আহারে বেচারা!
নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো আহযান। কিন্তু আহযানের সাথে উজানকে দেখেও কিরণ চমকালো। আয়াতকে ফিসফিস করে বলল,
‘এই অহংকারী এখানে কি করে?’
আয়াত ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
‘কি জানি। আহযান তো বলেছিল সাথে আর কেউ যাবে না। এখন আবার এই মালটাকে কেন আনলো কে জানে। থাক, আমরা আমাদের মতো থাকবো।’
‘হুম।’
আয়াত আর কিরণ কাছে আসলে আহযান চওড়া হেসে হাই বলল। উজান তাদের দেখলোও না এমন ভান করে নিজের চশমা ঠিক করে হাঁটতে থাকল। তার পুরুষালী চেহারা ভরা গাম্ভীর্যতা। তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। গাঢ় নীল আকাশে তখন সন্ধ্যাতারারা হীরের টুকরোর মতো ঝিলমিল করছে। হিম বাতাস বয়ে যাচ্ছে সমুদ্র তটে। নির্জন তীরে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। এই সন্ধ্যাতেই যেন রাতের নিস্তব্ধতা ঝুপ করে নেমে এসেছে। সমুদ্রের ক্ষীণ গর্জন আর শীতের ঠান্ডা ভারী নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই।
আয়াত নিজের ভাব বজায় রেখে আহযানের সাথে কথা বলছে। এখনি গদগদ হলে তো তার দাম কমে যাবে। আহযানের কাছে নিশ্চয়ই তার মতো অসম্ভব সুন্দরী মেয়েকে সস্তার মতো উপস্থাপন করবে না।
সমুদ্রের কিছুটা কাছে আসলে কিরণ পা থামায়। আয়াতকে বলে,
‘আমি যাবো না আপু। তোমরা যাও।’
আয়াত কিরণের হাত ধরে টানে, ‘কোনো না নেই। চলো পা ভেজাব।’
‘না আমার মন চায় না। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা যাও না, আমি এখানে অপেক্ষা করব।’
‘পাগল নাকি এই মেয়ে। এখানকার মানুষ ভালো না। একা একা থাকা চলবে না। তুমি চলো তো।’
‘চলুন মিস কিরণ। এমন ঠান্ডায় একটু সাগরের পানিতে পা না ভিজালেই নয়। সমুদ্র দেখেই তো লোভ লাগছে। মনে হয় আমাদেরকে বলছে আমাদের পা ধোয়া জল তাকে দান করতে।’ আহযান মুচকি হেসে বলে।
‘আরে আসো। এত ভয় পাচ্ছ কেন ঠান্ডা পানিকে? তোমার ভয় আজ ভাঙাব চলো।’
উজান সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছে। ফেনা তোলা হিম ঢেউ তার পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। হাত ভাজ করে সে পেছনের বাকি সদস্যদের কান্ড দেখছে। চোখ মুখ সমুদ্রের ন্যায়ই শান্ত।
কিরণ মনে মনে ভয় পাচ্ছে সমুদ্রে যাওয়ার। তার একোয়াফোবিয়া আছে। মানে পানিতে ভয়। ছোটোবেলায় সে একবার পুকুরে ডুবে গিয়েছিল। তাকে নিয়ে হাসপাতালেও দৌড়াদৌড়ি হয়েছে অনেক। সেই থেকে তার পানিতে ভয়। এজন্য সুইমিংপুল কেন, বাথরুমে বাথটাব থাকলেও সে ভয়ে নামে না। এখন সামনে এই বিশাল জলরাশি দেখে ভয়টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সে দূর থেকে দেখতেই ভালোবাসে।
কিরণ কীভাবে না করবে ভাবতে লাগল। যদি সে বলে তার পানিতে ভয় করে তাহলে কি আয়াত আর আহযান হাসবে না? আয়াতকে যতটুকু চিনে সে তো অবশ্যই হাসবে, এ নিয়ে মজা উড়াবে। যার হয় সে-ই বুঝে। আর উজান? সে ও তো বোধহয় হাসবে। প্রকাশ্যে না হোক, মনে মনে তো ঠিকই তাকে নিয়ে হাসবে, হয়তো ভাববে, অতি সাহসী মেয়েটা কিনা পানিতে ভয় পায়! ভুত না, সাপ না, শেষে কিনা পানিকে!! নিজেকে নিয়ে অন্যরা মজা করবে এটা কিছুতেই মানতে পারবে না কিরণ। তাই তার ফোবিয়ার কথা বলল না।
কিরণ চোখমুখে ভয়ের প্রলেপ লাগতে দিলো না। যথাসম্ভব সহজ থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু আয়াত নাছোড়বান্দা। কিরণকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল। এই মুহুর্তে কিরণের ইচ্ছা করল আয়াতের এই সিল্কি চুল সব টেনে ছিঁড়ে ফেলে। এই মেয়েটা সবকিছুতেই একটু বেশি বেশি। নিজের যা ভালো লাগে মনে করে সবারও তা ভাল্লাগবে। অদ্ভুত মেয়ে মানুষ!
সমুদ্রের যত নিকটে যেতে লাগল কিরণের চোখমুখ ভয়ে নীল হতে থাকল। বুকের ধুকধুকানি বাড়তে লাগল। তার মনে হলো হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে। শান্ত সমুদ্রকে তার কাছে অশান্ত মনে হলো। এই সমুদ্র যেন মুখিয়ে আছে কখন কিরণ আসবে আর কখন তার নীল পানিতে গোগ্রাসে গিলে নেবে কিরণের অস্তিত্বকে। এখন এই সায়রকে কিরণের কাছে যম ছাড়া কিছুই মনে হলো না।
আয়াতের পা পানিতে ভিজে গেছে। পানি যতটা ঠান্ডা ভেবেছিল ততটা না। সয়ে যাওয়ার মতো ঠান্ডা। কিরণকে আর এক কদম আনতে পারলেই পানিতে ভিজে যাবে। কিরণের হাত ধরে সে হ্যাঁচকা টান দিতে গিয়ে অনুভব করল কিরণের অপর হাত কেউ ধরে আছে। পেছন ফিরে দেখল সে।
কিরণ তার ডান হাতে আরেকটা হাতের ছোঁয়া পেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। দেখে জাওভান দাঁড়িয়ে আছে, তার হাত শক্ত করে ধরে। আয়াত কিরণের হাত ছেড়ে দেয়।
জাওভানের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বড় বড় শ্বাস ফেলছে সে। জ্বরের কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। তার পা নড়বড়ে কিছুটা। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না। এলোমেলো চুল আর ফোলা ফোলা লাল চোখ।
ঘুম থেকে উঠে কিরণকে কাছে পায় না সে। পাগলের মতো হয়ে যায়। ঘোরে বুঝতে পারে না কিরণ কোথায়। তার মনে হয় কিরণ তার থেকে দূরে কোথাও চলে গিয়েছে। কিরণকে অনেকবার চেঁচিয়ে ডাকে। তার চিৎকারে হোটেল বয় চলে আসে। সে ছেলেটার কলার ধরে চিৎকার করতে করতে বলে, ‘আমার কিরণ কোথায় বল, আমার কিরণকে কোথায় লুকিয়েছিস?’ এমন আবোলতাবোল অনেক কথা বলে। যারা অন্যদের দেখেছে তারা বলেছে যে বাকিদেরকে সমুদ্রের তীরে যেতে দেখেছে।
তা শোনামাত্রই জাওভান এলোমেলো পায়ে দৌড়ে যায়। আয়াত নামের মেয়েটা কিরণের হাত ধরে পানিতে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তার মাথায় রাগ চেপে বসে। তার মনে হয় সবাই মিলে কিরণকে পানিতে নিয়ে মেরে ফেলবে। তার কিরণকে তার থেকে দূরে সরিয়ে ফেলবে। কথাটি মাথায় আসতে দ্রুত যায় কিরণের কাছে।
উজান জাওভানকে দেখে বিচলিত হয়। এমন জ্বর গায়ে উঠে এসেছে কেন সে! উজান এগিয়ে আসে জাওভানের কাছে। জাওভান আয়াতের দিকে তাকিয়ে হিসহিস করে বলে,
‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমার কিরণকে?’
জাওভানের হঠাৎ রেগে যাওয়ায় আয়াত কিছুটা ভড়কে যায়। আমতা আমতা করতে থাকে সে, ‘আমি..তো, মানে… আমি… ‘
জাওভানের অগ্নিঝড়া দৃষ্টির সামনে আয়াত হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আহযান বলে,
‘ও জাস্ট ও’কে দুষ্টুমি করে পানিতে পা ভেজানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিল।’
জাওভান কিরণের দিকে তাকায়। সে একবার কিরণকে সুইমিং পুলে নামাতে চেয়েছিল, নামাতে পারেনি, পরে কিরণই বলেছিল যে সে পানিতে ভয় পায়। তারপর থেকে ভুলেও জাওভান কিরণকে পানির ধারে কাছে নেয়নি। এমনকি কিরণকে যখন তার ফ্ল্যাটে রাখে, সেখানের ওয়াশরুমের বাথটাবও সরিয়ে ফেলে। কিরণের ভয়ার্ত দৃষ্টি জাওভানের নজরে পড়ে। কিরণকে দেখে জাওভান নরম হয়। তার ভালোবাসাকে এরা জোর করে কিরণের ভয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে! এত সাহস তাদের। জাওভান কিরণকে কাছে টেনে একহাতে জড়িয়ে ধরে। কিরণের পা তখন নিস্তেজ। তার এত নিকটে সমুদ্র যে শ্বাস উঠে যাচ্ছে। জাওভান কিরণের গাল ধরে কোমল কন্ঠে বলে,
‘ভয় পেও না সোনা। তোমার সমুদ্র নামতে হবে না। তোমার যেটা করতে ভালো লাগে না সেটা করা লাগবে না। তাও অন্যদের জোরাজুরিতে।’ শেষ কথাটা বলে সে আয়াতের দিকে রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে মারল। তারপর আবার কিরণের দিকে তাকিয়ে নরম হয়ে বলে,
‘চলো জান।’
জাওভান কিরণকে জড়িয়ে ধরে চলে যেতে নেয়। উজান এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিল। কিরণের ভয় পাওয়াটা তার চোখেও পড়েছিল। কিন্তু সে চেয়েছিল কিরণ আসলে কত সাহসী তা দেখতে। তাদেরকে যেতে দেখে উজান প্রশ্ন করে,
‘এমন ভয় পেলে তো দুনিয়া চলে না। ভয় কাটাতে জানতে হয়।’
জাওভান ঘাড় পেছনে ফিরিয়ে উত্তর দেয়,
‘আমার কিরণ যেটাতে ভয় পায় তা কিরণের পায়েও মাড়াতে দেব না। কিরণকে কখনো ওর ভয় ছুঁতে পারবে না আমি থাকতে।’
জাওভান ধীর পায়ে কিরণকে নিয়ে চলে যায়।
.
.
চলবে…
#সায়র
#পর্ব_১১
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
কক্সবাজারে আসার এক সপ্তাহ হলেও তাদের ঘোরাঘুরি খুব কমই হয়েছে। ইনানি বীচ, হিমছড়ি, আর সেন্ট মার্টিন এই তিন জায়গাতেই মাত্র ঘোরা হয়েছে। জাওভানের জ্বর সেরে গেছে। সে নিজে কিরণ আর আয়াতকে ঘুরিয়ে এনেছে। আয়াত কেন যাবে তার আর কিরণের সাথে এ নিয়েও ঝগড়াঝাঁটি কম হয়নি তাদের। পরক্ষণে অবশ্য উজানই বলেছে ঘুরিয়ে আনতে যেহেতু সে আর আহযান বিজি থাকবে, আর এছাড়া কেউই নেই। উজান আর আহযানের স্কাল্পচার নিয়ে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। আহযান কাজে নতুন হলেও খুবই দক্ষতার সাথে কাজ করেছে। উজান শুধুমাত্র মেন্টর ছিল। আহযানের এই কাজ চার লক্ষ টাকার। উজানের কাছে টাকার পরিমাণ কম মনে হলেও সদ্য কাজে যোগ দেওয়া আহযানের কাছে এটাই ছিল অনেক বেশি। মেইন হলরুমের ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং শুধু করেছে সে। ভিজিটরদের জন্য আই-সুদিং দৃশ্য, আর কম্ফোর্টজোন তৈরি করা কম কষ্টের নয়। এই কাজ কখনোই এক সপ্তাহে শেষ হওয়ার কথা না। তারা এখানে আসার আরো চার পাঁচ মাস আগেই স্কাল্পচার সহ ভারী ভারী জিনিস বানিয়েই নিয়ে এসেছে। এখানে খালি জায়গামতো বসানোর জন্যই আসা।
উজান আর আহযানের কাজের জন্য ঘুরতে না পারলেও বাকি তিনজন ঠিকই ঘুরেছে। তবে জাওভান কিরণের সাথে ঘুরাঘুরি একদমই এনজয় করতে পারেনি আয়াত মেয়েটার জন্য। যদিও আয়াত সারাটাক্ষণ জাওভানের ভয়ে খুব কম কথা বলেছে আর কিরণের সাথে ভয়ে ভয়ে কথা বলেছে। একবার ইনানি বীচে হাঁটার সময় সে কিরণের হাত পেঁচিয়ে ধরে হেঁটেছিল। এতে কিরণের কোনো সমস্যা না হলেও জাওভানের বুকে আগুন জ্বলছিল ভেতর ভেতর। যখন রিসোর্টে ফিরে আয়াত কিরণকে ছাড়াই পুলের সামনে দাঁড়িয়েছে, তখন জাওভান আয়াতকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। আশেপাশের সব মানুষ এটাকে মজা ভাবলেও সে এত অপমানিত হয়েছিল বলার বাইরে। আবার তাকে ধাক্কা মারার পর জাওভান পানি আর হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে এতবার হাত ধুয়েছিল যে বোতল শেষ হয়ে গিয়েছিল। যেন সে হাত দিয়ে খুব নোংরা কিছু ছুঁয়েছে। আয়াতকে শাসিয়েছেও, যদি সে কিরণকে কিছু বলে তাহলে আরো খারাপ অবস্থা করবে তার। সেই ভয়েই পুরো জার্নিতে আয়াত কিরণের কাছে যেতেও দু’বার ভাবে।
আজ তাদের ফেরার পালা। বাসের শেষের আগের সিটগুলোয় তারা বসেছে। আহযান আর আয়াত এক সারিতে সিটে, জাওভান আর কিরণ আরেক সারিতে, আর তার সামনের সিটে উজান বসে আছে। রাতের কুয়াশা বাসের ভেতর আসছে বিধায় জাওভান জানালাটা অফ করে দিলো। কিরণ জানালার পাশে বসে ছিল। সে ইচ্ছে করে জানালা খোলা রেখেছে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস নাকমুখ দিয়ে ভেতরটা শীতল করে তুলছিল জাওভানের জানালা বন্ধ করায় সে বিরক্ত চোখে তাকায়। আবার খুলতে নিলে জাওভান কিরণের দুহাত ধরে তার কোলে নেয়।
‘ঠান্ডা লাগবে তোমার।’ কোমল স্বরে শুধায় জাওভান। কিরণ কিছু না বলে হাত সরিয়ে নিজের পকেটে পুরে। জাওভান ব্যাগ থেকে আরো একটা সোয়েটার বের করে কিরণের গায়ে দেয়। কিরণের কাছে খুব গরম লাগছিল। কিন্তু জাওভান তার তোয়াক্কাই করছে না। একটু পরপর ফ্ল্যাক্স থেকে গরম কফি দেয়, আবার এটা খাও ওটা খাও, এভাবে বসো, ওভাবে হাত নেও, এসব বলে বলে মাথা খাচ্ছিল কিরণের। কিরণ ভাবে, জাওভান যদি সত্যিকারের তার ভালোবাসার মানুষ হতো তাহলে সে এই কেয়ারে কখনোই বিরক্ত হতো না বরং এসব না করলেই বিরক্ত হতো। আফসোস, জাওভানের জন্য সেই ভালোবাসা কিরণের মনে জন্মায়নি।
বাস থামে বিরতির জন্য। উজানরা ছাড়া বাসের মানুষ নেমে যায় সব। জাওভানও নেমে যায় কিরণের জন্য কিছু কিনে আনতে। কিরণ বারণ করেছিল, তার কাছে অলরেডি অনেক খাবার আছে, কিন্তু জাওভান আরো নিয়ে আসতে গেছে। এই ফাঁকে কিরণ জানালা খুলে রাতের আকাশ দেখে নিলো। আকাশে বড় চাঁদ, তাকে সঙ্গ দিতে যোগ দিয়েছে হাজারো তারা। মিটিমিটি জ্বলছে।
কিরণের মনোযোগ ছোটায় জাওভানের ভাইব্রেট করা ফোন। কিরণের হাতেই দিয়ে গিয়েছিল মোবাইলটা। কিরণ দেখে এমনিই নোটিফিকেশন। সে মোবাইল রাখতে গিয়েও রাখে না, আকাশের ছবি তুলবে বলে। জাওভানের ফোনের ক্যামেরা ভালো। কিরণ মোবাইলের লক জানে। কিরণের নাম দিয়েই সেভ করা। তার ছবি জাওভানের লকস্ক্রিন, হোমস্ক্রিন জুড়ে। সবগুলাই ক্যান্ডিড ছবি। এই যেমন হোম স্ক্রিনে কিরণের সদ্য ঘুম থেকে ওঠার ছবি।
আহযান আর আয়াত গল্প করছিল। তারা দুজনে খুব ফ্রি হয়ে গেছে এই কয়দিনে। নাম্বার আদান প্রদান করাও শেষ। আয়াত বুঝে ফেলেছে আহযান তার প্রতি দুর্বল। এই একটা জিনিস সে খুব ভালো বুঝতে পারে। ভেবেছিল ক্রাশ খাওয়া অবধিই সীমাবদ্ধ রাখবে কিংবা আহযানকে তার পেছনে ঘোরা চ্যাংড়া ছেলেদের কাতারে ফেলে রেখে দিবে। কিন্তু সুদর্শন হওয়ার পাশাপাশি আহযানে চমৎকার আচরণ সেই সুযোগ দেয়নি। আয়াত নিজ মনে ভেবে দেখেছে, এমন ছেলেকে সুযোগ দেওয়াই যায়।
উজান হাতের উপর ভর দিয়ে তাতে গাল ঠেকিয়ে বসেছিল। তার কিছুদিন বিশ্রামের প্রয়োজন। সবার থেকে। সে ভেবেছে কয়েকদিনের জন্য বাংলোতে একা কাটিয়ে দিবে।
তাদের নিজ নিজ চিন্তা কর্মে হঠাৎ করে ব্যাঘাত ঘটায় এক নারী কন্ঠের লাস্যময়ী শীৎকার। আওয়াজ এত লাউডে ছিল যে আয়াত, আহযান দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের সারিতে তাকায়। এমনকি উজান পর্যন্তও তার পেছনের সীটে ঘাড় ঘুরাল।
‘আমি না আমি না, আমার না এটা, আমার দোষ নেই…’ কিরণ প্যানিক হয়ে এলোমেলো বকতে থাকে। তার হাত কাঁপছে লজ্জায়। সে দ্রুত মোবাইলের এক্সিট বাটনে ক্লিক করছে কিন্তু ব্যাক যেন হচ্ছেই না। উল্টো চাপ লেগে সাউন্ড আরো বেড়ে গেল। তখন বাসে শুধু তারা চারজনই ছিল।
প্রয়োজনের সময় টিভির রিমোট যেমন কাজ করছিল না ঠিক তেমন এখন মোবাইলটাও কাজ করছে না, এমনটাই মনে হচ্ছিল কিরণের। মোবাইলের স্ক্রিনে অশ্রাব্য কিছু শব্দ পালাক্রমে বেড়ে যাচ্ছিল। কিরণ শেষমেষ না পেরে মোবাইল অফ করে দ্রুত হাত থেকে ছিটকে সীটে ফেলে দেয়। তখনো সবাই অবাক দৃষ্টিতে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিরণের কান লাল হয়ে গিয়েছিল। আয়াতের ফর্সা মুখটাও লাল। সে তড়িঘড়ি করে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে মোবাইলে মনোযোগ দেয়। আহযান হালকা কেশে দ্রুত বাস থেকে নেমে যায়।
উজান এমন দৃষ্টিতে তাকাল কিরণের দিকে যে মনে হয় কিরণ কাউকে খুন করে এসেছে। তার চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠছিল। সে মুখ ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকালো।
‘এটা আ..আমার মোবাইল না।’ কিরণের কম্পিত ক্ষীণ কন্ঠস্বর। তার কন্ঠ এতটাই আস্তে শোনা যাচ্ছিল যে কিরণ নিজেও শুনতে পেল না সে কি বলল।
তখন জাওভানের ফোনে হাতের চাপ লেগে মোবাইলের নিচে তিন দাগের বাটনে গিয়ে কোনো একটা অ্যাপ অন হয়েই এসব শুরু। এটা জাওভানের মোবাইল। কিরণের হাত পা ঠোঁট কাঁপছিল লজ্জায়। সে এইমুহুর্তে এত বড় লজ্জার শিকার হলো যে পারলো না বাসের জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে দৌড়ে চলে যায় কোথাও। ছিঃ কী ভাবলো সবাই? উজান তাকে তো এমনেই খারাপ মেয়ে বলে, এখন এই কাহিনীর পর তো আরো খারাপ চোখে দেখবে। আহযান কি ভাবল? আর আয়াত? সে কি তাকে বাজে মেয়ে বলে আখ্যায়িত করবে না?
কীভাবে নিজেকে সে দোষী প্রমাণ করবে? সবাই তো ভাবছে এটা কিরণের মোবাইল। কিরণ মুখ গোল করে শ্বাস ছাড়ল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। জাওভানের মোবাইল হাতে নিয়ে আয়াতকে জোরে জোরে বলে,
‘আপু এটা আমার মোবাইল না বিশ্বাস করো। আমার মোবাইলে তো চার্জ নেই, তুমি তো জানো।’
আয়াতের কানে ইয়ারফোন থাকায় সে বোধহয় শুনলো না। কিরণ এবার সামনের সীটে বসা উজানের মুখের কাছে ধরে ফোন। কৈফিয়তের গলায় বলে,
‘এটা তোমার ভাইয়ের ফোন। এগুলা তোমার ভাই দেখে বুঝলে। আমি এত খারাপ মেয়ে না।’
একটু থেমে বলে,
‘ছিঃ! নিজের ভাই এসব দেখে বেড়ায় সে খেয়াল রাখো না, কেমন ভাই তুমি? ভাইয়ের খবর রাখো না। ভালো করে দেখে নেও তোমার ভাইয়ের ফোন। আর কি কি যে দেখে আল্লাহ জানে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিহ!!’ কিরণ এমনভাবে কথাটা বলল যেন দোষটা জাওভান আর উজানের।
উজান কিরণকে খেয়ালই করেনি এমনভাবে বাহিরে তাকিয়ে রইল। কিরণ নিজের সীটে বসল। বলে তো দিলো সে, তবে লজ্জাটা তার কাটছেই না। চোখ বন্ধ করে, মাথা নাড়িয়ে বারবার ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল। পারল না।
এবার সবাই ফিরে এলো বাসে। আহযান এসে আয়াতের পাশে বসে নিজেও ফোন নিয়ে ব্যস্ত হলো। মূলত তাদের কারো লজ্জাই তখন কাটেনি এমন ঘটনার পর। জাওভান এসে কিরণের পাশে বসল। তার হাতে হরেক রকমের জাংক ফুড। মনে হয় দোকান কিনে নিয়ে আসছে।
বাস চলতে আরম্ভ করেছে। জাওভান খেয়াল করল কিরণের মুখ গোমড়া। সে কিরণের সাথে একদম ঘেঁষে বসল। কিরণের নাকে টোকা দিয়ে বলল,
‘কী হয়েছে সোনা? মুখ কালো হয়ে আছে কেন? খাবার কম হয়েছে?’
কিরণ জাওভানের দিকে ফিরে দাঁত খিচিয়ে বিড়বিড় করে অকথ্য একটা গালি দিলো। বিড়বিড় করে বললেও জুভ বুঝতে পারল কিরণ তাকে কি গালি দিয়েছে। সে কিরণের এক হাত ধরতে চাইল। কিরণ ঝটকা মেরে সরালো। জাওভান বুঝতে পারল না তার দোষটা কোথায়।
‘জান এমন করছো কেন আমার সাথে? বলবে তো কী করেছি আমি?’
জাওভান এমনভাবে বলল যে কিরণের মনে হলো তার থেকে নিষ্পাপ এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। আহারে, ফিডার খাওয়া ল্যাদা বাচ্চা।
একটু আগে কিরণ জুভের মোবাইল খুলে হিস্ট্রি চেক করেছে। যা দেখল তাতে তার সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। বাজে বাজে ভিডিও দিয়ে জুভের হিস্ট্রি ভর্তি। শেষ সময় দেখাচ্ছে গতকাল রাতের। তারমানে জুভ প্রতিদিন এসব দেখে, আবার এমন ভান করে যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।
কিরণ মোবাইলটা নিয়ে জাওভানের মুখ বরাবর ছুঁড়ে মারল। জুভ ক্যাচ করে মোবাইলটা।
‘ছিঃ! আমার তো আপনার পাশে বসতেই ঘিন লাগছে, খাটাশ লোক।’ এই বলে কিরণ মুখ ফেরায়।
জাওভান ফোনটা খুলেও বুঝতে পারে না। সে নিজ মনে ভাবে সে আসলেই কী করেছে। তার মোবাইল কী দোষ করেছে?
‘কী হয়েছে মোবাইলে?’
‘বাজে লোক। জানেনা যেন কী দেখে মোবাইলে!’
দেখার কথা মাথায় আসতেই সে দ্রুত ফোন চেক করল। কিরণ দেখে নিয়েছে যে এসব এডাল্ট ভিডিও দেখে! জাওভান এবার বুঝতে পারল। সে গভীর শ্বাস ছেড়ে কিরণের মুখ জোর করে নিজের দিকে ফেরায়।
‘এই সামান্য ভিডিও দেখি দেখে তুমি এত রেগে আছো? তুমি কি ছোটো বাচ্চা?’
‘এগুলো সামান্য? আপনি আসলে কী বলেন তো? আপনি নিজে জানেন কী দেখছেন?’ কিরণ চোখ বড় করে বলল।
‘হ্যাঁ, প…’
জাওভানের কথা কেটে কিরণ ধমকে উঠে, ‘এই চুপ, লজ্জা নেই আবার বলে যে। খচ্চর লোক।’
‘জান, এখানে খারাপের কী আছে? আমি তো আর আন্ডারএইজ না যে এসব দেখতে পারব না! আ’ম আ গ্রোন অ্যাস ম্যান। অ্যান্ড ইটস আ নরমাল থিং।’
‘এগুলো নরমাল আপনার কাছে? বাহ! ভালোই! দূরে সরে বসেন, ঘিন লাগে আপনার সাথে বসতে। আপনার জন্য মান সম্মান গেছে আমার।’ কিরণ চেপে বসে, তার অসহ্য লাগছে।
তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাসের বয়স্ক একজন লোক বলে উঠল, ‘আহ! এত চিৎকার করো না তো, সমস্যা হয়।’
জাওভান কিরণের কাছে এসে বলল, ‘শুনো লাভ, এগুলো সবাই-ই দেখে, কেউ গোপনে দেখেও অস্বীকার করে। আমি তো আর অস্বীকার করি না। এসব সাধারণ বিষয়। ভবিষ্যতে আমাদের কাজে লাগবে এসব।’
জুভের শেষ কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কিরণ উঠে দাঁড়ায়। আর নাহ! তার মাথা ধরে যাচ্ছে। এত জঘন্য! এত নোংরা! এত লাগাম ছাড়া জুভ! রাগে রি রি করছে তার শরীর। জাওভান বেয়াদবের থেকেও যদি বড় কিছু থাকে তাহলে সেটা। কিরণ জুভকে ধাক্কা মেরে সরালো। একটুর জন্য জুভ পড়ে যায়নি। চলন্ত বাসে কিরণ সীট ধরে দাঁড়িয়ে দেখলো কোথাও খালি আছে কিনা। নেই, সব ভর্তি। জাওভান বারবার অনুরোধ করল কিরণকে, হাত টেনে ধরল। কিরণ তার পায়ের হিল খুলে জাওভানের কনুইতে বারি মারল। সে ধমকে উঠল যদি জাওভান আরেকবার ডিস্টার্ব করে তাহলে চিল্লিয়ে সবাইকে জাগিয়ে তুলে জুতার বারি মারবে।
জাওভান বুঝল যে কিরণের সাথে একটু বেশিই অশোভন কথা বলে ফেলেছে। কিরণ আনকম্ফর্টেবল ফিল করেছে সেটাও বুঝে।
কিরণের নজর গেল উজানের পাশের সীটে। উজানের ব্যাগ সীট জুড়ে আরামে বসে আছে। কিরণ ব্যাগটা নিয়ে নিজের সীটে ছুঁড়ে মেরে উজানের পাশে বসল। উজান চোখ মেলে তাকাল। পাশে ফোঁস ফোঁস করতে থাকা কিরণের দিকে তাকিয়ে পেছনে কাতর জুভের দিকে তাকাল। জাওভান উজানের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বলল,”এসব তো নরমাল উজি। ও এত রিয়েক্ট করছে কেন?” উজান বুঝে নিলো যে তখনকার ঘটনার জন্য এমন অবস্থা।
জাওভান বারবার কিরণকে বিরক্ত করছে দেখে কিরণ জাওভানের দিকে ফিরে শান্ত গলায় বলল,
‘জুভ তুমি যদি আর একবার আমাকে ডিস্টার্ব করেছো তো গায়ের সবগুলা জ্যাকেট খুলে বসে থাকব। কিচ্ছু খাবোও না। তোমার ভালো লাগবে তা?’
জাওভান দু’পাশে মাথা নাড়ালো।
‘তাহলে চুপচাপ বসে থাকো। আমার ঘুম পাচ্ছে।’
জাওভান চায় না কিরণের কোনো কষ্ট হোক। তাই চুপচাপ বসে রইল। সামনের সীটে একহাত বাড়িয়ে কিরণের বাহু ধরে থাকল।
‘হাত ধরেছো কেন? হাত সরাও।’
‘তুমি ঘুমাও সোনা। যদি পড়ে যাও তাই ধরেছি। ডিস্টার্ব করছি না তো।’
কিরণ কিছু না বলে বিড়বিড় করে বলল,
‘এসব বাজে ছেলেই কেন আমার কপালে জুটে? সব ছেলেগুলাই এক, বাইরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট।’
উজান বোধহয় শুনে নিলো কথাটা। সে কিরণের দিকে চেয়ে চোখ ঘুরাল। কিরণ মনে মনে বলল, “আসছে আমার আরেক ভাবওয়ালা। যত্তসব ফালতু।”
.
.
চলবে…
[কোনো ভুলত্রুটি দেখলে ধরিয়ে দিবেন।]