সায়েবা আসক্তি পর্ব-১২+১৩

0
529

#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_১২

ফারহানা বেগমের রুমের সামনে অস্থির হয়ে পায়চারী করছে সানোয়ার সাহেব। সে কখন থেকে ডেকে চলছে ফারহানা বেগম কে অথচ তার কোন হেলদোল নেই। মনে সাহস সঞ্চার করে ফারহানা বেগমের দরজায় কড়া নাড়তেই ফারহানা বেগম হুংকার দিয়ে বলেন,

— আমার রুমের সামনে থেকে যাও সানোয়ার।তোমার কোন কথাই আমি শুনতে চাই না। তোমার জন্য আজ আমাকে চরম ভাবে অপমানিত হতে হয়েছে। তা আমি কখনোই ভুলবো না। তুমি নিজের হাতে নিজের ছেলের জীবন দুর্বিশহ করে দিলে।বাবা হয়ে কি করে পারলে এমনটা করতে?আমার ভাবতেই অবাক লাগছে!

ফারহানা বেগমের কথা শুনে সানোয়ার সাহেব অসহায় চোখে স্ত্রীর রুমের দরজার দিকে তাকালো। নমনীয় গলায় বললো,

— আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে।কিন্তু আমি কি করতাম বলো?একমাত্র বোন আমার।বাবা মা মারা যাওয়ার পরে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি।বোনের কান্না মাখা আবদার ফেলতে পারিনি। লিজা ফারহান কে ভালোবাসে।আমি ভেবেছিলাম ওদের বিয়ে হলে ওরা দুজনেই সুখী হবে। ফারহান অন্য কাওকে ভালোবাসে এটা আমি ঘুনাক্ষরে ও টের পাইনি। যখন জানতে পারলাম ফারহান অন্য কাওকে বিয়ে করতে চায় আমি ওদের বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লিজা পাগলামি শুরু করলো। সুইসাইড করার ভয় দেখিয়ে আমাকে দমিয়ে দিলো।আমার কোন কথা না শুনেই এ বাড়িতে চলে এলো। আসার আগে হুমকি দিয়ে এসেছে।যদি এ বিয়ে না হয় তাহলে সে সুইসাইড করবে।

সানোয়ার সাহেবের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো ফারহানা বেগম। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে স্বামীর মুখোমুখি দাড়ালো। কঠিন চোখে সানোয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ভাগনির ভালোবাসা টা তোমার কাছে মোক্ষ সানোয়ার!আর আমার ছেলে?তার ভালোবাসার,ভালো থাকার কোন মূল্য নেই!কেমন বাবা তুমি? তুমি ও কিন্তু আমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলে।তাহলে আজ ছেলের বেলায় এতো বৈষম্য কেন?তুমি তোমার বিয়ে করা স্ত্রী, যার সাথে তুমি ত্রিশ বছর সংসার করেছো তার সাথে সামান্য একটা দেয়ালের দূরত্ব মেনে নিতে পারছো না!তাহলে আমার ছেলে কিভাবে তার ভালোবাসার এই দীর্ঘ বিচ্ছেদ মেনে নিবে?লিজার জেদ মেনেত না নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করতে পারতে।আমরা সবাই মিলে একটা সমাধান ঠিক বেড় করে নিতাম।অন্তত ছেলের কাধে ভরসার হাত তো দিতে পারতে।কিন্তু তুমি কি করলে!নিজের জেদি ভাগনির আবদার মেনে নিয়ে আমার ছেলেকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিলে।তোমার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করি নি সানোয়ার। ফরহাদ, ফারহান আমার কলিজার একটা অংশ। তুমি আজ সেখানে আঘাত করেছো সানোয়ার।আমি আমার ছেলে কে সামলে নেবো।তোমার বোন আর ভাগনির তরফ থেকে যদি আর কোন অশান্তি আমার বাসায় আসে তাহলে সেদিন তুমি আমার অন্য এক রুপ দেখবে। কথাটা মাথায় রেখ।

সানোয়ার সাহেব অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে ফারহানা বেগমের দিকে। এ জন্যই বলে,বউয়ের সাথে পাঙা নিতে নেই।তার ভাতে ও মারবে,পানিতে ও মারবে।

🌸

বাসায় এসে এক কোনায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সায়েবা। তার মা একটু বেশিই শান্ত হয়ে আছে। এমন ব্যবহার করছে যেন কিছুই হয়নি। এদিকে চিন্তায় চিন্তায় তার অবস্থা নাজেহাল। রান্নাঘরে একমনে রান্না করে চলেছে সাহেরা বেগম। মাঝে মাঝে আড় চোখে মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে। সায়েবা গুটিশুটি মেরে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সায়েবা কে কাছে ডাকলো সে।

— ফারহান কে ভালোবাসিস?

মায়ের প্রশ্নে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো সায়েবা।ফারহান কে সে ভালোবাসে।তবে তার মায়ের থেকে বেশি না।মেয়ের টলমল চোখ দেখে যা বোঝার বুঝে নিলো সাহেরা বেগম।

— আমি বুঝতে পারছি ফারহানের জন্য ভালোবাসা আছে তোর মনে। তবে মা হিসেবে আমি কখনোই এই প্রেম ভালোবাসা মেনে নিবো না। ভালোবাসতে মানা করছি না। তবে সে ভালোবাসা টা হতে হবে পবিত্র। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক হারাম।আমি ছোট বেলা থেকেই তোমাদের ইসলামের মূল্যবোধ শেখাতে চেষ্টা করেছি।আমার শিক্ষায় হয়তো ত্রুটি ছিলো। তাই বড় হতে হতে তা ভুলতে বসেছিস।মা হিসেবে আমার দায়িত্ব তোদের সঠিক পথে চালিত করা।আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবো। ফারহান যদি তোর চাওয়া হয়ে থাকে তাহলে তা আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে চেয়ে নিতে হবে। যদি সে তোর ভাগ্যে থেকে থাকে তাহলে সে তোর হবেই।
রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েও যথেষ্ট স্বাধীনতা পেয়েছিস।আজকে থেকে সেই স্বাধীনতা আর থাকবেনা তোর।পড়াশোনা ছাড়া আর কোন কাজ নেই তোর।
আজকের পর থেকে ফারহানের সাথে কোন যোগাযোগ করবি না।এমনকি ফারহানের সামনে ও যাবিনা।আমি ফারহান কে কথা দিয়েছি সে যদি নিজেকে প্রমাণ করতে পারে তাহলে আমি তার কাছে তোকে বিয়ে দিবো। আমি আমার কথা রাখবো। তার জন্য ফারহান কেও তার কথা রাখতে হবে। এসব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে পপড়াশোনায় মনোযোগ দে।যা,রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।

সায়েবা মায়ের কথায় আর দ্বিরুক্তি করলো না। মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে গেলো। সাহারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিলেন।

🌸

ওই দিনের পর থেকে তিন মাস কেটে গেছে। ফারহানের পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুই দিন হলো। ওইদিনের পর থেকে ফারহান আর সায়েবার সাথে কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নি।রাগী গম্ভীর ছেলেটা হুট করেই কেমন যেন হয়ে গেলো। আগে থেকেই কথা কম বলতো এখন প্রয়জোন ছাড়া রুম থেকেই বেড় হয় না।ফারহানা বেগম অনেক চেষ্টা করেও ফারহান কে আগের মতো করতে পারেন নি।
ছেলের অবস্থা দেখে সানোয়ার সাহেব ও মনে মনে গুমরে মরছে। ফারহান দেশের বাইরে চলে যাবে কয়েক দিনের মধ্যেই।আজকাল সায়েবার শূন্যতা তাকে পাগল করে দিচ্ছে। এতো কাছাকাছি থেকেও নিজের ভালবাসার মানুষ কে না দেখে থাকার যন্ত্রণা ওকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। প্রতি রাতে বারান্দায় চাতক পাখির মতো দাড়িয়ে থাকে একটা বার সায়েবাকে দেখার আসায়।কিন্তু সায়েবা বারান্দায় আসা তো দূর জানালা টাও খোলে না।নিজেকে ফারহানের এখন পাগল মনে হয়। দূরত্ব যখন হবেই তাহলে সেটা শুধু মনের কেন? মানচিত্রে ও হোক।তাতে অন্তত মন কে শান্তনা তো দেয়া যাবে।

এশার নামাজের পরে পড়তে বসেছে সায়েবা।এখন আর আগের মতো ফাকিবাজি করে না।ফারহান কে সে এখনো খুব ভালোবাসে। তবে তা আর প্রকাশ করে না।প্রতিটা মোনাজাতে তার একটাই চাওয়া। আর তা হচ্ছে ফারহান। সায়েবার ভাবনার মাঝেই রুমে প্রবেশ করে শোয়েব। বোনের দিকে তাকিয়ে বিছানায় টান হয়ে শুয়ে পরে।আজকাল সায়েবা আর তার সাথে রাগ দেখায় না।সে পেছনে লাগলেও সায়েবা চুপ করে থাকে। জীবন টা এখন নিরামিষ নিরামিষ লাগে শোয়েবের কাছে।তবে এখন সে সায়েবার সাথে দুষ্টুমি করতে আসে নি। সে সায়েবাকে একটা খবর দিতে এসেছে।

— আপু।

— শুনছি বল।

— ফারহান ভাইয়া আজ আমেরিকা চলে গেছে।

শোয়েবের কথা শুনে থমকে গেলো সায়েবা। মস্তিস্কে গিয়ে আঘাত করলো কথাটা।কানের কাছে শুধু একটা কথাই বেজে যাচ্ছে, ফারহান ভাইয়া আমেরিকা চলে গেছে। সায়েবা নির্বাক চোখে তাকালো শোয়েবের দিকে। শোয়েব বোনের দৃষ্টি দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। তারা সবাই জানতো ফারহান আজ চলে যাবে।গতকাল বিকেলে ফারহান সাহেরা বেগমের সাথে দেখা করতে এসেছিলো। সাহারা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সায়েবার সাথে একবার দেখা করার কথা বলতেই সাহেরা বেগম সরাসরি নাকচ করে দেয়। ফারহান অনেকবার রিকোয়েস্ট করেও কোন লাভ হয়নি।শোয়েব মায়ের কান্ডে নির্বাক হয়ে ছিল। ফারহান চলে যেতেই সাহেরা বেগম শোয়েব কে কড়া গলায় নিষেধ করে সায়েবা কে এসব জানাতে।তবে কেন জানি আজ শোয়েব চুপ করে থাকতে পারলো না। কিছুক্ষণ আগে জানালে হয়তো দেখা হয়ে যেতো প্রেমিক যুগলের।শোয়েবের এখন খুব আফসোস হচ্ছে। আরেকটু আগে বললেই কি হতো!

চলবে।

#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_১৩

ফারহান আমেরিকা এসেছে আজ চার দিন হলো।আমেরিকার কেলিফর্নিয়ার ফ্লাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের শহর দেখছে ফারহান।এখানকার আমেরিকান হেরিটেজ ইউনিভার্সিটি তে এডমিশন নিয়েছে ফারহান।ফারহানের সাথে এখানে আরেকজন ছেলে থাকে।ছেলেটা পাকিস্তানি। ফারহান একাই এই ফ্ল্যাটে থাকতো। কিন্তু ফ্লাইটে ইউসুফের সাথে দেখা হওয়ার পর সিদ্ধান্ত বদলেছে ফারহান।ছেলেটার চোখে অন্যরকম মায়া আছে।চেহারার দিকে তাকালেই মনের মধ্যে প্রশান্তি বয়ে যায়। ইউসুফ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার বাবা একজন কাপড় ব্যবসায়ী। স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকা এসেছে।ফ্লাইটে তাদের পরিচয় হওয়ার পর ফারহান তাকে নিজের সাথে থাকার জন্য অফার করে।ইউসুফ প্রথমে রাজি না হলেও ফারহানের জোড়াজুড়ি তে রাজি হতে বাধ্য হয়।ফারহানের ফ্ল্যাট টা মোটামুটি বড় বলা চলে।তিনটা বেডরুম,ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন সহ একটা মিনি টেরেস আছে।ফারহানা বেগমের চাচার ফ্ল্যাট এটা। ফারহান যতদিন এখানে থাকবে ততদিনের জন্য রেন্টে নিয়ে নিয়েছেন ফারহানা বেগম। তবে ফারহান সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে পড়াশোনার খরচ ও নিজে চালাবে।তার জন্য কোন একটা পার টাইম জব নিয়ে নিবে।ফারহানা বেগম আপত্তি করলেও ফারহানের জেদের কাছে তাকে হার মানতে হয়।

(ফারহান আর ইউসুফের কথাবার্তা ইংলিশে হলেও গল্পের সার্থে আমি বাংলায় দিচ্ছি)

— এখানে কি করছো?

হঠাৎ ইউসুফের কথায় ধ্যান ভাঙে ফারহানের।মুচকি হেসে বলে,

— রাতের শহর দেখছি।

— বাড়ির কথা মনে পড়ছে?

— মনে তো পড়ছে।তাদের মিস করলেও কেউ একজনের শূন্যতা হৃদয়ে আঘাত করছে।

ফারহানের কথা শুনে কপাল কুচকে নিলো ইউসুফ। সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো,

— তুমি কার কথা বলছো?

— আমার প্রেয়সীর। যার জন্য আমি আজ সেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছি।

— তুমি কি কারো সাথে রিলেশনশীপে আছো ফারহান?

— নাহ।আমি তাকে ভালোবাসি।তবে আমাদের মধ্যে প্রেমের কোন সম্পর্ক নেই। আমি যেমন তাকে ভালোবাসি সেও তেমন আমাকে ভালোবাসে।কিন্তু হাতে হাত ধরে প্রেমটা আমাদের ঠিক করা হয়নি কোনদিন। (ম্লান হেসে)

— আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকল প্রকার হারাম থেকে বিরত রাখুন।আমিন।

ইউসুফের কথা শুনে ফারহান তার দিকে অবাক চোখে তাকালো। কন্ঠে অ আবাকতার রেশ এনে বললো,

— আমি তোমার কথা বুঝতে পারিনি ইউসুফ।

বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক আল্লাহ তায়ালা হারাম করেছেন। এটাকে জিনাহ বলে।আল্লাহ তায়ালা বলেন,

‘তোমরা জিনার কাছেও যেও না।কারণ সেটা অশালীন কাজ আর তার পরিণাম খারাপ’
(সুরা বনী ইসরাঈলঃ৩২)

আমরা যখন কোন মেয়ের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি তখন আমাদের মধ্যে তাকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগে।এটাকে চোখের জিনা আর মনের জিনাহ বলে।যখন কেউ তার প্রেমিকাকে ছুয়ে দেয় তখন হাতের জিনাহ হয়।যখন কেউ তার উদ্দেশ্য গমন করে তখন পায়ের জিনাহ হয়।আর একেবারে শেষের ধাপ হচ্ছে শারিরীক সম্পর্ক। তাই আমাদের দৃষ্টি আর কলব কে সামলে রাখতে হবে।জিনাহ্ র শাস্তি ভয়ংকর। জেনাহকারী ইহকাল ও পরকাল দুই জায়গায় ই এই শাস্তি ভোগ করবে।

— আমি তো সায়েবাকে ভালোবাসি।এতে কি আমার জেনাহ হবে?

— ভালোবাসা টাকে পবিত্র রাখো।তবে মার চাওয়া যদি নেক হয় তাহলে তুমি তাকে অবশ্যই পাবে।ভালবাসা গুনাহ না।নিজের সব চাওয়া পাওয়া আল্লাহর নামে করে দাও।তা পুরন করার দ্বায়িত্ব আল্লাহর। এখন নামাজ পড়ে নাও। এশার নামাজের ওয়াক্ত শেষ হতে চললো। (মুচকি হেসে)

ইউসুফের কথা শুনে সময় চেক করলো ফারহান।১১ঃ৩৪ বাজে।তাড়াতাড়ি রুমে চলে গেলো সে।ফারহান আগে থেকেই পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। ওজু করে এসে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলো সে।আজ থেকে প্রেমটা না হয় রবের সাথেই হোক।ভালোবেসে পরম করুনাময় কে মানিয়ে নাহয় সায়েবা কে চেয়ে নিবে।

🌸

আজকাল সায়েবা অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে। কারো সাথে খুব একটা কথা বলতে দেখা যায় না। বন্ধু মহলের সাথে দেখা করাও কমিয়ে দিয়েছে।ফারহানের চলে যাওয়ার কথা শুনে ভিতরে ভিতরে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে।সাহেরা বেগম মেয়ের চুপচাপ হয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত। পড়াশোনা বাদে নামাজ আর কোরআন নিয়েই পড়ে থাকে।শোয়েবের সাথেও ঝগড়া করে না।বাড়িটা যেন একেবারে নিরব হয়ে গেছে।

ফারহানের চলে যাওয়ার কথা শুনে ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছে সায়েবা।তবে তাকে দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। একেই বুঝি বলে প্রণয় বিরহ!বুকের ভিতর এক অসহ্য যন্ত্রণা সারাক্ষণ দম বন্ধ করে দেয়।কান্না করার ও উপায় নেই। মা দেখলে আর রক্ষে নেই। ফারহানের শূন্যতা যেন জেকে ধরেছে সায়েবাকে।নিজের কোন কিছুতে ধ্যান নেই তার।এইযে আজ তিন দিন হলো সে চুল আচরায় না!চুল গুলো জট পাকিয়ে যা তা অবস্থা। এই অবস্থায় ফারহান তাকে দেখলে তুলে আছাড় মারতো।অথচ বেখেয়ালি সায়েবা তার খেয়ালে ডুবেই জটাধারী রুপ ধারণ করেছে!এখন আর কোন কিছুতেই মন বসে না।জোর করে নিজেকে বইয়ের সামনে বসিয়ে রাখতে হয়। বাবা মায়ের স্বপ্ন পুরন করতে হবে যে।অথচ তার মন টা আরেকজন নিয়ে বসে আছে। কি সর্বনাশী ব্যাপার স্যাপার!

🌸

ফায়জা দেশে এসেছে আজ একমাস হয়েছে।ফারহান আমেরিকা চলে যাবে শুনে পনেরো দিন আগেই দেশে চলে এসেছে সে।ছোট ভাই চলে গেলে আবার কবে দেশে ফিরবে তার ঠিক নেই।তাই পরিবারে সাথে একসাথে কিছুটা সময় কাটাতে তারাতাড়ি দেশে আসা।দেশে এসে সব কিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলো ফায়জা।তার বাবার মতো নরম মনের মানুষ এমন কিছু করতে পারে তার বিশ্বাস ই হচ্ছে না!ফারহানা বেগম এখনো কথা বলেন না সানোয়ার সাহেবের সাথে।ফায়জা মনে মনে লিজার উপর প্রচন্ড ক্ষেপে আছে।তার বাবার মতো একজন বিচক্ষণ লোক কিভাবে লিজার মতো একটা মেয়েকে ফারহানের জন্য পছন্দ করতে পারে এটা চিন্তা করেই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। বাবার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বাবা মায়ের এই অভিমান ভাঙার ব্যবস্থা করতে হবে। একমাত্র ফারহান ই সব কিছু ঠিক করতে পারবে।

— এতো কি ভাবছিস?

— আব্বু আম্মুর এই মান অভিমানের পালা এবার শেষ হওয়া দরকার ভাইয়া।এগুলো আর নেয়া যাচ্ছে না।

ফায়জার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ফরহাদ।তার কি বাবা মা কে এভাবে দেখতে ভালো লাগে? কতদিন হলো বাবা মায়ের খুনসুটি ভরা ভালোবাসা দেখে না।বাবার মলিন মুখটা দেখলে বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করে। বন্ধুর মতো ছোট ভাইটা কতো দূরে আছে!পুরো বাড়িটা যেন শূন্যতায় ভরে গেছে।

— আম্মু তো কোন কথাই শুনতে চাইছে না। আব্বু কতটা শুকিয়ে গেছে খেয়াল করেছিস?আজকাল রাতেও ঠিক করে ঘুমায় না। আম্মুর রুমের সামনে মাঝরাত পর্যন্ত পায়চারি করতে থাকে।

— ফারহান কে বলতে হবে। একমাত্র ফারহান ই আম্মু কে মানাতে পারবে।এসব আর নেয়া যাচ্ছে না। আম্মু ফারহানের জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে বিপি বাড়িয়ে ফেলেছে।আদরের ছোট ছেলে বলে কথা।আচ্ছা ভাইয়া, আমি চলে যাওয়ার পরেও কি আম্মু এভাবে কেদেছিলো?

— শুনতে চাস না বোন।সহ্য করতে পারবি না।

ফরহাদের দুঃখী দুঃখী চেহারার দিকে তাকিয়ে ফায়েজা আবেগী হয়ে পরলো।আম্মু তার জন্য এতটা মন খারাপ করেছে ভাবতেই চোখ ভরে এলো। কিন্তু মুহুর্তেই মন খারাপ বদলে গেলো ফরহাদের কথা শুনে।

— তুই চলে যাওয়ার পর আম্মু তো হাফ ছেরে বেচেছে।কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে বলে কথা। বন্ধবি দের নিয়ে কিটি পার্টি ও করেছে।তার সে কি আনন্দ!যদিও আম্মু তোকে এসব বলতে নিষেধ করেছে। তবুও বললাম।আমি তো তোকে খুব ভালোবাসি তাই না বল?তোর গা থেকে ডাস্টবিন ডাস্টবিন গন্ধ আসে তাতে কি হয়েছে? আমরা মেনে নিয়েছি তুই আমাদের গন্ধযুক্ত ফায়জা।আমরা তোকে এভাবেই ভালোবাসি।

ফরহাদের কথা শুনে দাত কিড়মিড় করতে করতে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে আছে ফায়জা।ছোট বেলা থেকে এসব ফালতু কথা বলে আসছে তাকে।এতো দামী পারফিউম দেয়ার পরেও নাকি ডাস্টবিন ডাস্টবিন গন্ধ আসে! ফরহাদের দিকে কুশন ছুরে মেরে কয়েকটা ভয়ংকর গালি দিলো সে।বোনের গালি শুনে দাত কেলিয়ে হাসছে ফরহাদ।

চলবে,,