সায়েবা আসক্তি পর্ব-২০+২১

0
551

#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২০

সাহেরা বেগম সায়েবার সাথে কথা বলছেন না।এ বাড়িতে আসার পর থেকে এক কথায় গুম হয়ে আছে।সায়েবা অবশ্য কয়েকবার মায়ের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। শোয়েব মা আর বোনের নিরব যুদ্ধ একমনে দেখে চলেছে।যদি ও খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না সে।মা যদি একবার জানতে পারে বিসিএস ক্যাডারের খবর ফারহানের কাছে সে পাচার করেছে তাহলে তার পিঠ বাচাবে কে সে চিন্তায় কয়েক রাত ধরে ঘুম হচ্ছে না। তার মা তো তার পিঠের ছাল তুলে নিবে!শোয়েব ভয়ে ভয়ে একবার সাহেরা বেগমের দিকে তাকালো। তিনি গম্ভীর মুখে নিজের কাজ করছেন।শোয়েবের মুখটা কাদো কাদো হয়ে গেলো। মনে মনে বললো, বোন আর দুলাভাইয়ের মিল করাতে গিয়ে না জানি ফোটার আগেই আমার জীবনের কলি ঝরে যায়! এখনো কোন মেয়ে ও পটাতে পারি নাই,বিয়ে করে বাচ্চার বাপ হওয়া ও বাকি!মেয়েদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ও বুঝি হলো না! এগুলো হয়তো আমার না হওয়া গার্লফ্রেন্ড গুলোর অভিশাপ!

— আর কতক্ষন এভাবে মুখ গোমড়া করে বসে থাকবে?একটু পরে তো চলেই যাবো। এখন তো একটু কথা বলো!

সায়েবার অসহায় গলায় বলা কথা গুলো শুনে সাহেরা বেগমের কোন ভাবাবেগ হলো না। সে নিজের মনে কাজ করতে করতে বললো,

— বড় হয়েছো,বিয়ে ও হয়ে গেছে।বাবার বাড়ি আসবে যাবে।নিজের মতো করে থাকবে।আমাকে আর দরকার পরবে কেন?

সায়েবা মলিন চোখে মায়ের অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই অভিমানের বরফ কবে গলবে আল্লাহ জানেন।

🌸

আদিবের গালে বরফ ধরে বসে আছে ফারহানা বেগম। ফায়জার হাতে ভালোই উত্তম মধ্যম খেয়েছে সে।ফারহানা বেগম কয়েক দফা ঝেড়েছে সবাই কে।একেক জন ডাক্তার, বিজনেসম্যান হয়েও বাচ্চাদের মতো ঝগড়া মারামারি করছে।এই দিন দেখার জন্যই বেচে আছে সে।ভাগ্য ভালো সায়েবা বাসায় নেই।নাহলে কি এক লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরতে হতো!

— তোমাদের আমার আর কিছুই বলার নেই।তোমাদের থেকে পাচ বছরের বাচ্চা ও ভালো মেনার্স জানে।আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমাদের কান্ডজ্ঞান দেখে!

ফায়জা এখনো রেগে আদিবের দিকে তাকিয়ে আছে। সুযোগ পেলে আরো কয়েক ঘা লাগিয়ে দিবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আদিব সবার চোখের আড়ালে ঠোঁট উঁচু করে চুমু দেখাতেই ফায়জা আবার তেড়ে গেলো আদিবের দিকে। ফারহানা বেগম ধমকে তাকে ওখানেই থামিয়ে দিলো। চোখ রাঙিয়ে বললো,

— আরেকবার ওর গায়ে হাত তুললে কালকের মধ্যে দুটোর বিয়ে দিয়ে দিবো। তখন যত পারো চুলোচুলি করো।এখন থেমে যাও।

ফরহাদ ও বোনের হাতে কয়েক ঘা সোফায় টান টান হয়ে শুয়ে আছে। ফরহাদের পায়ের দিকে ফায়জা বসে রাগে ফুসছে।ফরহাদ পা ফায়জার কোলে তুলে দিয়ে বললো,

— অনেক মেরেছিস বোনু।এবার একটু সেবাযত্ন কর।খুব ব্যাথা করছে।পা টা একটু টিপে দে।

ফায়জা রেগে তাকাতেই ফরহাদের মলিন মুখ দেখে চুপ করে গেলো। যত কিছু হয়ে যাক না কেন,ভাইদের কষ্ট সহ্য করতে পারে না সে।ফারহানের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব ক্লান্ত। কালকে সারাদিন ফারহানের বিয়ের জন্য খাটা খাটনি করে আবার ক
সকাল সকাল অফিসে চলে যেতে হয়েছে।এখন আবার ফুপ্পির জন্য দৌড়ে চলে আসতে হলো। ক্লান্তিতে অবস হয়ে আসছে শরীর। ফায়জা কোন কথা না বলে পা টিপতে শুরু করলো। আদিবের যেন এটা একদম সহ্য হলো না, সে ফারহানা বেগমের কাছে অভিযোগের সুরে বললো,

— দেখলে মনি?মার তো দুজনেই খেয়েছি।দাদাভাই কে তো নামে মাত্র মেরেছে।আর আমাকে!আমাকে সরকারি মাল মনে করে ধুপি ঘাটের কাপড়ের মতো করে ধুয়েছে।এখন ভাইয়ের সেবা করা হচ্ছে। আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি?যদিও আমার পা টিপে দিতে হবে না, হালকা করে একটা চুমু খেলেই হবে।

ফারহানা বেগম কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে চলে গেলেন।এই ছেলেটা সব সময় ফায়জার পেছনে লাগে।এ জন্য মার ও কম খায় না। তবুও একই কাজ করে।

আদিবের কথা শুনে ফায়জা আর ফরহাদ একসাথে বালিশ ছুড়ে মারলো ওর দিকে।

— অসভ্য ছেলে বের হও বাসা থেকে। না হলে বাক যে হাড়গুলো ভালো আছে সে গুলো ও ভেঙে দেবো।

ফায়জার ধমকি জানালা দিয়ে ছুরে মেরে আদিব ওখানের বসে রইলো। ফায়জার দিকে তাকিয়ে দুষ্ট হেসে গান ধরলো,

— তোমার জন্য মরতে পারি ও সুন্দরী তুমি গলার মালা।এই যে দেখো তোমার জন্য আনছি আর্সি কোলা।

— অসহ্য।

ফরহাদ চোখ বুজে পরে রইলো। এখন এদের ঝগড়া দেখার সময় নেই।তার একটু ঘূমানো দরকার।

🌸

রাত নয় টার দিকে ফায়জা আর আদিব সায়েবাদের বাসায় উপস্থিত হলো। সায়েবা তখন টেবিলে খাবার গোছাচ্ছিলো।আদিব আর ফায়জা কে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো। ফায়জা কে হালকা জরিয়ে ধরে কুশল বিনিময় করে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিলো। আদিব কে যদিও বলা লাগে নি। আদিব নিজ দায়িত্বে বসে গেছে।ফায়জার পড়নে কালো বোরকার মতো একটা লম্বা ফ্রক।সাথে হাটু পর্যন্ত লম্বা হিজাব।চেহারা ও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। আদিব যদিও সায়েবার দিকে তাকাচ্ছে না। তবুও সায়েবা নিজেকে আরেকটু ভালো করে ঢেকে নিলো।ফারহানের কড়া হুকুম,বেপর্দায় চলা যাবে না। আর এখন থেকে এমন লম্বা গ্রাউন পরেই থাকতে হবে। বাইরে গেলে ঢিলা ঢালা বোরকা সাথে হাত মোজা পা মোজা ও পড়তে হবে। সে তার বউ কে কাউকে দেখতে দিবে না। কেউ তার বউয়ের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাবে এটা তার সহ্য হবে না। তার বউকে শুধু সে একা দেখবে।মন ভরে দেখবে।মন ভরে গেলে আবার প্রথম থেকে দেখবে।দেখতেই থাকবে।সায়েবা খুব হেসেছিল ফারহানের কথা শুনে। তার সমস্ত আবদার খুশিমনে মেনে নিয়েছে।

আদিব নিজের খাওয়া শেষ করে ড্রয়িং রুমে চলে গেলো শোয়েব কে নিয়ে।তারপর সাহেরা বেগম, ফায়জা আর সায়েবা একসাথে খেতে বসলো। ফায়জা সাহেরা বেগম কে অবশ্য সরি বলেছে। সাহেরা বেগম হাসিমুখে সরি এক্সেপ্ট করেছে।খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ফায়জা যাওয়ার জন্য তাড়া দিলো সায়েবা কে।যাওয়ার কথা শুনে সায়েবার মুখ কালো হয়ে গেলো। তার একদম যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতেই হবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পরলো ওদের সাথে। কাল আবার সকাল সকাল চলে আসা যাবে।যাওয়ার আগে শোয়েব কে কতক্ষণ জরিয়ে ধরে রাখলো।সাহেরা বেগমের চোখ ও ছলছল করে উঠলো। মেয়ের উপর যতই রাগ করে থাকুক না কেন, মেয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছে শুনেই কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। সায়েবা মা কে ও কিছুক্ষণ জরিয়ে ধরে বিদায় নিলো মায়ের কাছ থেকে।

🌸

ফারহানদের বাসায় এসে সবার সাথে হালকা কথা বলে রুমে চলে এলো সায়েবা।ফারহানা বেগম তার ননদের হয়ে ক্ষমা চেয়েছে সায়েবার কাছে।সায়েবা তাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে এসেছে এতে তাদের কোন দোষ নেই।

রুমে আসতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠলো সায়েবার।চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস টেনে ফারহানের গায়ের গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করলো। কাবার্ড থেকে ফারহানের একটা শার্ট নিয়ে কিছুক্ষণ জরিয়ে ধরে রাখলো। এখন ফারহানের শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছে। শার্ট টা জরিয়ে ধরেই শুয়ে পরলো সে।চোখ থেকে কয়েক ফোটা নোনাপানি বেরিয়ে ভিজিয়ে দিলো শার্ট টা। ফারহান প্রেয়সীর চোখের পানি দেখে মন খারাপ করার বদলে তৃপ্তির হাসি হাসলো। চোখ বন্ধ করে সেও তার ধুলোর রানী কে অনুভব করার চেষ্টা করলো। চোখ খুলে সায়েবার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তাকে কল করলো। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই ফারহানের নেশালো গলা শুনে কেপে উঠল সায়েবা।

— মিস মি??

সায়েবা এবার শব্দ করে কান্না করে দিলো। কান্নারত গলায় বললো,

— অনেক।

ফারহান প্রত্যেক ফোটা চোখের পানি গুনে নিলো। সায়েবার কান্নার দমকে লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বললো,

— আমিও।

সায়েবা কোন রকম কান্না থামিয়ে হেচকি তুলতে তুলতে বললো,

— খেয়েছেন?

— হুম।

— কখন উঠলেন?

— অনেকক্ষণ। তুমি খেয়েছো?

— হুম।

— মা কি খুব বেশি রেগে?

— হুম।

— ঠিক হয়ে যাবে।চিন্তা করো না।

— আচ্ছা।

ফারহান চুপ করে সায়েবার দিকে রইলো। সায়েবা ও চুপ করে ফারহানের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে লাগলো।

— সায়েবা,,,

— হুম।

— একবার ভালোবাসি বলবে?

সায়েবা চমকে গেলো। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। তারপর নিজেকে শান্ত করে বললো,

— একবার নয়,অগুনিত বার বলবো। তবে যেদিন আমার সামনে হাজির হবেন সেদিন।

ফারহান মুচকি হাসলো। দুষ্টু গলায় বললো,

— সেদিন শুধু ভালোবাসি বললেই হবে না। এভাবে জরিয়ে ধরে ও রাখতে হবে।

🌸

আদিব ছাদে সিগারেট জ্বালাতেই ফায়জার ফোনে কথা বলতে বলতে আগমন।আদিব কে সিগারেট জালাতে দেখে অবাক হয়ে বললো,

— তুমি সিগারেট জ্বালাচ্ছো???

আদিব ফায়জার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,

— নাহ নিজেকে।

চলবে,,,

#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২১

(অনুমতি ব্যতীত কপি করা নিষেধ)

পাত্র পক্ষের সামনে বসে আছে ফায়জা।পাত্রের মা জহুরি নজরে তাকিয়ে আছে তার দিকে। খুটিয়ে খুটিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে।মহিলার মধ্যে একটা দারোগা দারোগা ভাব আছে।ড্রয়িং রুম জুড়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ। পাত্র নিজেও একজন ডাক্তার। কর্মক্ষেত্রেই তাদের পরিচয়। ফায়জা কে দেখেই মনে ধরে যায় তার।তাই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।

— তা ক’বছর যাবত আপনারা এখানে আছেন?

ছেলের মায়ের প্রশ্নে হচকচিয়ে গেলো সবাই।ফারহানা বেগম হাসি হাসি মুখ করে বললো,

— বাড়ি হওয়ার পর থেকেই আমরা এখানে। আসলে এখান থেকে আমাদের হসপিটাল আর অফিস দুটোই সামনে হয়।তাই এখানে সিফট হওয়া।

পাত্রের মা মুখ কুচকে বললেন,

— আমাদের তো নিজের বাড়ি ঢাকায়।তা আপনারা বাড়ি করার ব্যাপারে কিছু চিন্তা করেন নি? না মানে, কতদিন আর ভাড়া বাসায় থাকবেন?

ড্রয়িং রুমে পিনপতন নীরবতা। সবাই বজ্র চোখে তাকিয়ে আছে পাত্রের মায়ের দিকে। পাত্র নিজেও অপ্রস্তুত চোখ তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। ঠিক সেই মুহুর্তে আদিবের আগমন। ফায়জা কে এভাবে সেজেগুজে বসে থাকতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেছে সে।তবুও কিছু না বলে শান্ত ভাবে গিয়ে বসে পরলো ফরহাদের পাসে।

সবার দিকে নজর বুলিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করলো জাবের (পাত্র)। মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— কি বলছো মা।এই পুরো বাড়ি টাই ওনাদের।প্লিজ তুমি নিজের মুখ একটু বন্ধ রাখো।

ছেলের কথা শুনে চোখ চকচক করে উঠলো তার।এতো বড় বাড়ি! তার মানে টাকা পয়সা ভালোই আছে।এতক্ষণের থমথমে ভাব কেটে গিয়ে মুহুর্তেই আহ্লাদে গদগদ হয়ে গেলো সে।ফায়জার দিকে তাকিয়ে বললো,

— আহা কি সুন্দর মেয়ে।দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মাশআল্লাহ। আমার তো।মেয়ে খুব পছন্দ হয়েছে।

ফায়জা তার মায়ের দিকে করুন চোখে তাকালো। সে এখন কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না। পড়াশোনার জন্য এতো বছর পরিবার ছেড়ে দূরে ছিল। যখন দেশে আসলো তখন ফারহানটা চলে গেলো। এখন যখন ফারহান আসার সময় হয়েছে তখন তার আম্মু তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে।

আদিব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ফায়জার দিকে। তার দৃষ্টি ফায়জা থেকে নড়ছে না।আদিব অনেকদিন আগেই বাবার ব্যাবসা জয়েন করেছে।তাই এদিকে খুব একটা আসা হয়ে উঠে না।কিছুক্ষণ আগে সায়েবা থেকে জানতে পেরেছে ফায়জা কে আজ দেখতে আসছে।তাই সমস্ত কাজ রেখে এখানে ছুটে এসেছে।সানোয়ার সাহেব ও নিজের স্ত্রীর এমন ব্যবহারে বিরক্ত।মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য এতো তাড়া কিসের সে বোঝে না। ফরহাদ এখানে নেই।সে অফিস থেকে আসেনি।মায়ের উপর নিরব রাগ ঝাড়ছে সে।

সায়েবা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে। আদিবের রক্তলাল চোখ দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে উঠছে।ফারহানের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ফারহান ইদানীং খুব একটা সময় দিতে পারছে না তাকে।পড়াশোনায় খুব ব্যাস্ত সে।তার ফাইনাল এক্সাম চলছে। দেখতে দেখতে দেড় বছর কেটে গেছে। চোখের পলকেই যেন সময় চলে যায়।

দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তার মাধ্যমে ঠিক হয় তারা আজ ই ফায়জা কে আংটি পাড়িয়ে যাবে।দুই মাস পরে ফারহান আসলে অনুষ্ঠান করে তুলে দিবে।আদিব এখনো ফায়জার দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়জার দৃষ্টি নিচের দিকে। ফায়জা ছলছল চোখে সানোয়ার সাহেবের দিকে তাকাতেই তার চোখ পরলো আদিবের দিকে। আদিবের লাল চোখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধক করে উঠলো। সানোয়ার সাহেব মেয়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন।

অবশেষে জাবেদ ফায়জার অনামিকায় রিং পরিয়ে দিলো।আদিব নিজের চোখ সরিয়ে নিলো ফায়জার থেকে। ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটিয়ে হাটা দিলো ছাদের দিকে।

🌸

ফরহাদ আর ফারহান দুজনেই মায়ের উপর রেগে আছে। মায়ের এই হুটহাট সিদ্ধান্ত তারা মেনে নিতে পারছে না। ছেলের সম্পর্কে ভালো করে খোজ খবর না নিয়েই এনগেজমেন্ট করে ফেলা হটকারিতা ছাড়া কিছুই নয়।

— তুমি এটা কিভাবে করতে পারলে আম্মু?অন্তত পক্ষে আমার জন্য অপেক্ষা তো করতে পারতে?

— রাগ করো না আব্বু।এখন শুধু এনগেজমেন্ট হয়েছে।তুমি আসলেই বিয়ে হবে। এতো দিনে ওরা নিজেদের মধ্যে সময় কাটাক।চিনুক জানুক। আর জাবের ভালো ছেলে। আমি অনেকদিন ধরে চিনি।আম্মুর উপর একটু ভরসা করে দেখো আব্বু।

রাগে ফারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। ফারহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,

— তুমি তাকে প্রোফেশনালি চেনো আম্মু।ব্যাক্তিগত ভাবে কতটা চেনো?একটা মানুষ কেমন তা তার বাইরের দিক দেখে কখনোই বোঝা যায় না। আর তার একার ভালো দিয়ে কি হবে আম্মু?তার পরিবার কেমন তা ও জানতে হবে। আমার বোন কোন ফেলনা নয়।হাজারের মধ্যে একজন খুজে আনবো তার জন্য। ছেলের সাথে সাথে ছেলের পরিবার ও গুরুত্বপূর্ণ আম্মু।আমার বোন তাদের সাথেই থাকবে।তুমি এ বিষয় নিয়ে আর এগোবে না আম্মু।আমি দেশে এসেই যা করার করবো।

ফারহান রাগ করে কল কেটে দিলো।মায়ের উপর রাগ হচ্ছে খুব।এদিকে ফারহানা বেগম ভাবনায় পড়ে গেলেন।ফারহানের কথা ভুল নয়।এভাবে তাড়াহুড়ো করা উচিত হয়নি।ফায়জার মত না নিয়ে তো একদমই নয়।

ফায়জা সেই যে দরজা বন্ধ করেছে এখনো খোলেনি।ফরহাদ মায়ের উপর চোটপাট করে গিয়ে কয়েকবার দরজা ধাক্কা দিয়েছে।কিন্তু ফায়জা দরজা খোলে নি। সায়েবা শুধু অসহায় চোখে সব কিছু দেখে যাচ্ছে। বাড়ির পরিবেশ গরম। কিছু বলতেও ভয় হচ্ছে। এদিকে রাত ও কম হলো না। টেবিলে খাবার দিয়ে সবাইকে একবার ডেকে এসেছে।কিন্তু কেউই খেতে আসেনি। ফায়জা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সানোয়ার সাহেব আর ফারহানা বেগমের জন্য খাবার নিয়ে গেলো। সানোয়ার সাহেবের প্রেসারের মেডিসেন নিতে হবে। খাবার খাইয়ে তাকে মেডিসিন দিয়ে ফারহানা বেগমের কাছে গেলো সায়েবা।বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছে সে। সায়েবা আস্তে করে মা বলে ডাকতেই চোখ খুললো সে।সায়েবার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,

— খাবার নিয়ে যাও সায়েবা।আমি আর আজ খাবো না।ফায়জার দিকে একটু খেয়াল রেখো। রেগে আছে খুব।

— চিন্তা করবেন না আম্মু।সব ঠিক হয়ে যাবে।

— তোমার ও মনে হয় আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই না?

সায়েবা তপ্ত শ্বাস ফেললো। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললো,

— বাবা মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না আম্মু।আপনার দিক থেকে আপনি সঠিক। তবে সময় নিয়ে সবার সাথে আলোচনা করে নিলে ভালো হতো। এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়ায় সবাই মন খারাপ করেছে।আমার কথায় রাগ করবেন না আম্মু।আপনার আপুর সাথে কথা বলা উচিত ছিল। তার মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার অনুমতি ব্যতীত এএনগেজমেন্ট করা বোধহয় ঠিক হলো না। ইসলামে এটা সম্পুর্ন নিষেধ। কুমারী মেয়ের অনুমতি আর বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের মতামত ছাড়া তাদের বিয়ে দেয়া নিষেধ।এতে বান্দর হক নষ্ট হয়।

— আমি রাগ করি নি আম্মু।আমার ভুল হয়েছে।তবে বিয়ে হয়ে যায় নি। আমি এবার ভালো করে খোঁজ নিয়ে তারপর বিয়ে নিয়ে এগোবো।আর ফায়জার মতামত নিয়েই হবে সব কিছু। ওর যদি মত না থাকে তাহলে বিয়ে হবে না।

সায়েবা সন্তুষ্টির হাসি হাসলো। সানোয়ার সাহেব ও খুশি হলেন।এতক্ষণ সে ওদের সব কথা শুনছিলেন।স্ত্রীর উপর এতক্ষণ রেগে থাকলেও এখন আর রাগ টা নেই।সে খুশিমনে শুতে চলে গেলো।

🌸

সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছাদেই আছে আদিব।নিচে নামতে ইচ্ছে করছে না। চোখ গুলো রক্তবর্ন ধারণ করেছে।

পায়ের শব্দ পেয়েও পিছনে ফিরলো না সে।

— এতো রাতে এখানে কি করছো?

ফায়জার উপস্থিতি টের পেয়েও কিছু বললো না আদিব।

— কি হলো? কথা বলছো না কেন?

— ইচ্ছে করছে না।

— নিচে যাও আদিব।অনেক রাত হয়েছে।

— আমাকে নিয়ে না ভাবলেও চলবে আপু।

আদিবের মুখে আপু ডাক শুনে চমকে উঠলো ফায়জা। যেন হৃতপিন্ডের ভিতর কেউ হাজারো সুচ ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফায়জা ছলছল চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে। আদিব একবার ও তার দিকে তাকায় নি। যে ছেলেকে মারধর করে ও আপু বলানো যায় নি সে আজ নিজ ইচ্ছায় আপু বলছে!কয়েক বার ঢোক গিলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো ফায়জা।ভাঙা গলায় বললো,

— হটাৎ আপু ডাকলে যে?

আদিব আকাশের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,

— অনেক আগে থেকেই বলা উচিত ছিল। আমার ই ভুল।আপনাকে আপু না ডাকা টাও ভুল।ঠিক আপনাকে ভালোবাসার মতো।

ফায়জা ফ্রিজ হয়ে গেলো। কাপা কাপা গলায় বললো,

— আদিব!কি বলছো এসব?,আমি তোমার বড়,,,

আদিব ঝড়ের গতিতে ঘুরে ক্ষ্যাপা বাঘের মতো চেপে ধরলো ফায়জা কে। রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বললো,

— মজা করছো আমার সাথে?তুমি জানতে না আমি ভালোবাসি তোমাকে?বলো জানতে না?একটা মেয়ে দূর থেকে ছেলেদের দৃষ্টি দেখেই সব বুঝে ফেলে।আর আমি তো তোমার এতো কাছে ছিলাম সব সময়। সারাক্ষণ তোমার সাথে ছায়ার মতো থেকেছি।তোমাকে ঘিরে হাজার পাগলামি করেছি।এই অবহেলা আমি তোমার তিন বছরের ছোট বলে?আরে একবার আমাকে একটা সুযোগ তো দিয়ে দেখতে!জান দিয়ে হলেও সবাই কে রাজি করাতাম।তুমি আজ আমাকে খুন করেছো।নিরবে আমার হৃদয়ে আঘাত করে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলেছো।ড্রয়িং রুমের প্রতিটি সেকেন্ডে আমার নিশ্বাসের সাথে বিষাক্ত যন্ত্রণা দিয়েছো তুমি।আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না সোনা।খুব পস্তাবে তুমি।

চলবে,,,