সুখের পাখি পর্ব-০১

0
1610

#সুখের_পাখি
#জেরিন_আক্তার_নিপা


স্কুলে যাওয়া আসার সময় যে ছেলেটা রোজ তনুকে বিরক্ত করত। আজ সে ফাঁকা রাস্তায় তনুকে একা পেয়ে ওর ওড়না টেনে ধরেছে। আশেপাশে কেউ না থাকায় তনু চিৎকার করে সাহায্য চাইতে পারেনি। অবশ্য মানুষজন থাকলেও তনু চিৎকার করত না। সে সাহায্য চাইলেও সবাই তাকেই দুর্নাম দিত। ছেলেরা যতই অন্যায় করুক, গ্রামের মানুষগুলোর চোখে ছেলেদের কোন অন্যায়ই অন্যায় না৷ ওরা মেয়েদের গায়েই কাদা লাগাতে পারে। ছেলেটা গত সাত মাস ধরে রাস্তাঘাটে তনুকে বিরক্ত করে যাচ্ছে। কুৎসিত কুৎসিত সব কথা বলা থেকে হুটহাট পথ আটকে দাঁড়ানো তো আছেই। আজ তনুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। এতদিন গ্রামের মানুষের ভয়ে চুপ করে থেকেছে সে। চুপ করে থেকেও কী পেয়েছে তনু? তার তো কোন দোষ নেই। তাহলে সে কেন কলঙ্কের ভয়ে চুপ করে থাকবে? অপরাধ তো ওই ছেলে করছে। শাস্তি যদি কারো প্রাপ্য হয়, সেটা এই ছেলের। তনুর না। তনু কোন অন্যায় করছে না। ছেলেটা তনুর ওড়না ধরে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল,

–‘ও তনু, আমার অনু। ও জানপাখি, ময়না, টিয়া আর কতদিন দূরে থাকবা। অনেক তো ঢঙ দেখাইছো। মনের জ্বালা এইবার মিটায়া দিলেই পারো।’

তনুর গা জ্বলে গেল। ঘৃণায় গা রিরি করে উঠল। আজও যদি সে প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকে, তাহলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবে। গ্রামের এই মূর্খ মানুষগুলোর কাটাকাটা কয়েকটা কথার ভয়ে সাতটা মাস ধরে কতকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে। প্রথম প্রথম ছেলেটা শুধু পেছন পেছন যেত আসত। তারপর একটু একটু করে ওর সাহস বাড়তে থাকে। পথ আটকে ওর সাথে কথা বলা। হাত ধরতে চেষ্টা করা। জোর করে তাকে উপহার দিতে চাওয়া। সবই সহ্য করেছে। তনু ভেবে অবাক হচ্ছে এতদিন সে কেন চুপ ছিল! গ্রামের মাতব্বরের ছেলে বলে! গ্রামের সবাই ওর বাবার কথা মত চলে বলে? তনুও ওই লোকটাকে ভয় পেয়েই কি এসব সহ্য করেছে! অগ্নি দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে তনু বলল,

–‘ওড়না ছাড়।’

আজ প্রথম তনুর মুখে কথা শুনে ছেলেটা খুশি হলো। আগের মতই নির্লজ্জ ভাবে হেসে হেসে বলল,

–‘ওমা! বোবার মুখে দেখি কথা ফুটছে! আমার তনু পাখি কথা কইছে! তুমি কথা কইতে পারো? আগে তো জানতাম না। আবার কও তো। তোমার মধুর কন্ঠটা একটু শুনি। কলিজা জুড়াক আমার।’

–‘শুয়োরের বাচ্চা ওড়না ছাড়। নইলে দেখতে পাবি আমি কথা বলার সাথে সাথে আর কী কী করতে পারি।’

সাত মাস পর তনুর মুখ থেকে শুধু কথা না অন্য কিছুও বের হচ্ছে।
ছেলেটার চোখ হিংস্র হয়ে উঠল। মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে ওর। তনুর এই দুঃসাহস সে সহ্য করতে পারল না।

–‘তুই আমার বাপ তুলে গালি দিলি! এত বড় সাহস তোর!’

তনু দ্বিগুণ তেজে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

–‘তোর ওই কুত্তা বাপরে শুধু গালি কেন? ওই বুইড়া শয়তানরে জুতার মালা পরিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া উচিত। একটা কুত্তার বাচ্চাকে জন্ম দিয়ে পথেঘাটে ছেড়ে দিছে। ওই কুত্তার বাচ্চা কী করতেছে না করতেছে তা খোঁজ নেওয়ার সময় নাই।’

–‘তোরে আজ যমে টানছে রে তনু। অনেক কথা বলে ফেলছিস তুই। আজ আমি তোর এমন দশা করমু, জীবনে কাউরে মুখ দেখাইতে পারবি না। গ্রামের লোক তোর উপর ছি ছি করব। আমারে বিয়ে করা ছাড়া কোন উপায় থাকব না তোর।’

কথা ক’টা বলেই ছেলেটা তনুর ওড়না ধরে হেঁচকা টান দেয়৷ তনু টাল সামলাতে পারে না। ছেলেটা ওর দিকে এগিয়ে এলে তনু বুঝতে পারে আজ তাকে সাহস দেখাতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। থাকবে না সে আর এই গ্রামে। বাবাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। তবুও গ্রামের মানুষের কথা ভেবে আজ চুপ করে থাকা যাবে না। তাহলে ক্ষতি তারই হবে। তনু তার ছোট জীবনে কখনও না করা সবচে ভয়ংকর কাজটা আজ করে ফেলল। ছেলেটা যখন তার গায়ে হাত দিবে তনু তখন তার পা ছেলেটার দুই পায়ের মাঝ বরাবর চালিয়ে দিল। ছেলেটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেছে। সাবধান হওয়ার সুযোগ পায়নি সে। এতক্ষণে ছেলেটা গলা ফাটানো চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে । তনু ক্রোধে ফোঁপাচ্ছে। অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে সে। দুই চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। ছেলেটার কাতর চিৎকার ওকে শান্ত করতে পারল না। তনু নিজের পায়ের জুতা খুলল। ছেলেটার কাছে গিয়ে ওর উপর জুতার বাড়ি বর্ষণ করতে লাগল।
ছেলেটা বাবাগো, বাবাগো বলে গোঙাচ্ছে। লাথিটা মনে হয় ঠিক জায়গায় লেগেছে। চোখ উলটে দিচ্ছে হারামিটা।
তনু মাঝে মাঝে পা-ও চালাচ্ছে। তবে লাথিতে তেমন কাজ হচ্ছে না। তনু যখন থামল তখন মনে হয় ছেলেটার হুঁশ নেই। তবুও তনু ক্ষান্ত হলো না। সাত মাসের জমানো রাগ। একদিনে মেটানো যায়? তনু হাঁপাচ্ছে। কপালে ঘাম হচ্ছে। আশেপাশে দেখল সে। পাশের ধান ক্ষেত থেকে কাদা তুলে এনে ছেলেটার পুরো মুখে মাখিয়ে দিল। এটুকু করেও যখন মনে শাস্তি মিলল না, তখন ভয়ংকর একটা কাজ করে বসল। এই ছেলে সুযোগ পেলে আজ তার কী অবস্থা করত সেটা ভেবেই রাগ কমছে না। ও তনুকে হাতে পেলে এত সহজে ছাড়ত? না, তনুর জীবনের সবচে বড় সর্বনাশ আজ হতে পারত। তনু ব্যাগ থেকে জ্যামিতি বের করল। কাটা কম্পাস হাতে নিয়ে ছেলেটার হাতে কিছু লিখতে লাগল। ফোঁটা ফোঁটা রক্তে যখন তনুর হাত লাল হয়ে গেল, তখন তনু ভয় পেল। স্বাভাবিক হয়ে পরিস্থিতিটা ভেবে নিল। আজকের পর এই গ্রাম তার জন্য নিষিদ্ধ। এখানে থাকলে তার এই কাজের জন্য বাবাকেও শাস্তি পেতে হবে। মাতব্বর বুড়ো নিশ্চয় ছেলের এই অবস্থা দেখে তাকে ছেড়ে দিবে না। প্রতিশোধ নিবে। কঠিন প্রতিশোধ। তনু স্কুল ব্যাগ, জুতা ফেলেই বাড়ির দিকে ছুটল। মানুষ জানাজানি হবার আগেই বাবাকে নিয়ে চলে যেতে হবে। ছেলেটার মনে হয় এখন জ্ঞান নেই। জ্ঞান ফিরে সবাইকে জানানোর আগে তনু অনেক দূরে চলে যাবে। তাকে কেউ পাবে না।

তনু দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকেই সামনে বাবাকে দেখতে পেল। ছুটে গিয়ে বাবার বুকে পড়ল সে। বাবা তার এই অবস্থা দেখে হতভম্ব। অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারলেন না তিনি। শেষে মুখ দিয়ে টেনে টেনে কয়েকটা শব্দ বের করলেন।

–‘মা রে, তোর এই অবস্থা কেন? কে করেছে? গায়ে কাদা। হাতে রক্ত লেগে আছে। তোর পায়ের জুতা, স্কুল ব্যাগ কই?’

বাবা একবার তনুর মুখের দিকে দেখল। ফর্সা মুখটায় এখন সূর্য ডোবার কয়েক মুহূর্ত আগের রক্তিম আকাশের ছাপ পড়েছে। ভাবনাটা মনে আসতেই বুকটা কেঁপে উঠল উনার। উদ্বিগ্ন গলায় তিনি আবার বললেন,

–‘কী হয়েছে মা? আমাকে বল।’

হাঁপাতে হাঁপাতে তনু যা বলল তা শুনে, একটু আগে ভাবা সেই ধারণা ভুল প্রমাণ হলে স্বস্তি পেলেন। তবে মনে মনে মেয়ের কথা ভেবে ভয় হতে লাগল।

–‘মাতব্বরের ছেলেকে আমি জন্মের শিক্ষা দিয়ে এসেছি বাবা। ও আর কোনদিন কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাবে না। তুমি বলো, আমি ভালো করিনি বাবা? ওই ছেলে একটা জানোয়ার। বাপের মত কুত্তা।’

মেয়ের মাথায় সমর্থনের হাত রাখলেন তিনি। কিন্তু মুখে বললেন,

–‘কিন্তু মা এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার আগে আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। নইলে ওরা তোকে ছাড়বে না। মাতব্বর তার ছেলের প্রতিশোধ নিবেন।’

–‘চলো আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাই বাবা। এই গ্রাম মানুষ বাস করার উপযোগী না। ওই বুড়ো কুত্তা মাতব্বর গ্রামের বাতাস অনেক আগেই দূষিত করে দিয়েছে।’

–‘তুই ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি কিছু কাপড়চোপড় গুছিয়ে নে। আমি এক্ষুনি আসছি।’

কথাটা বলে বাবা দাঁড়ালেন না। তনু পেছন থেকে ডাকল,

–‘কোথায় যাচ্ছ বাবা?’

যেতে যেতেই তিনি জবাব দিলেন,

–‘তোর মানিক চাচার কাছে।’

তনুর ব্যাগ গোছাতে পাঁচ মিনিট সময়ও মনে হয় লাগল না। বাবার কিছু কাপড়, তার কিছু কাপড়। তার জমানো কিছু টাকা। স্কুলে উপবৃত্তি পেয়ে ওই টাকা দিয়ে একটা স্বর্ণের চেইন বানিয়েছিল। ওটা গলায় পরে নিল। সময়ে টাকার দরকার পড়তে পারে। তখন কাজে লাগবে। মানিক চাচাকে নিয়ে বাবা ফিরে এলেন। ঘরে এসে পরনের শার্টের উপর আরেকটা শার্ট চাপিয়ে তনুকে তাড়া দিলেন।

–‘সব নিয়ে নিয়েছিস তো?’

তনু চোখ ঘুরিয়ে ঘরের সব জিনিসপত্র গুলো দেখে নিল। একটা সংসারে অনেক কিছুই থাকে। সবকিছু কি সাথে নেওয়া সম্ভব?

–‘ব্যাগে যতটুকু জায়গা নিয়েছে।’

–‘আচ্ছা এখন চল মা। মাতব্বরের লোক নাকি দলবল নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে। ওদের হাতে পড়া যাবে না।’

তনু ঘরে তালা দিতে নিলে মানিক চাচা বললেন,

–‘এই তালা ভাঙতে ওদের খুব খাটতে হবে না রে তনু। ওরা তালা ভেঙেও ভেতরে ঢুকতে পারবে। তোরা তো আর কখনো ফিরে আসবি না। ঘরে তালা দিয়েই কী হবে? আর আমি তো এখানে আছিই। তুই কোন চিন্তা করিস না।’

–‘কীভাবে যাব আমরা? ওরা আমাদের দেখে ফেলবে না?’

ওদের গ্রামের যে পথ দিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে গাড়ি ধরতে হয়, সেদিক দিয়ে গেল না ওরা। যাবার সময় তনুর চোখ জ্বালা করতে লাগল। এটা তার গ্রাম। তার জন্মভূমি। জীবনের ষোলটা বসন্ত এখানে কাটিয়েছে ও। গ্রামের রাস্তা, পুকুর, গাছপালা। সবকিছুর সাথেই তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তনুর কাছে এটা ভেবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগল, এখানে তার মা’র কবর। তার স্কুল, স্কুলের বান্ধবীরা। চিরচেনা এই সবুজ গ্রাম ছেড়ে কোন অজানায় পা বাড়াচ্ছে সে? তনু ভেজা গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করল,

–‘আমরা এখন কোথায় যাব বাবা?’

–‘আল্লাহর দুনিয়া অনেক বড় রে মা। কোথাও না কোথাও নিশ্চয় বাবা মেয়ের মাথা গোঁজার জায়গা পেয়ে যাব।’

তনু আর কিছু বলল না। বাবার বুকে মাথা রেখে বাসের জানালা দিয়ে ওর শস্যশ্যামল ছোট্ট গ্রামটাকে শেষ বারের মতো চোখ ভরে দেখে যাচ্ছে। শীতের সকালে এই ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে শিশির বিন্দু গায়ে মাখতে মাখতে আর ছুটতে পারবে না। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে গাছে চড়ে ফল-পাকুড় পেড়ে খেতে পারবে না। গ্রামের ছোটছোট ছেলেমেয়ে গুলোর সাথে মজা করে পুকুরে গোসল করাও হবে না। তার প্রিয় বন্ধুদেরকেও আর কখনও দেখতে পারবে কি-না কে জানে? সে তো এবার ক্লাস টেন-এ উঠেছে। তার পড়াশোনা কি এখানেই শেষ হয়ে যাবে? তনু চোখ বুজল। তার অজান্তে গাল বেয়ে টুপ করে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

চলবে🍁