সুখের পাখি পর্ব-০২

0
1086

#সুখের_পাখি


ইহান দুই পা উপরের দিকে তুলে গিটার হাতে চিত হয়ে শুয়ে আছে। তার চোখ জোড়া চঞ্চল হয়ে সিলিঙের দিকে ঘোরাঘুরি করছে। দূর! আজ গিটারে মন মতন কোন সুর তুলতে পারছে না। অনেকক্ষণ ধরে টুংটাং করেই যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই আজ ভালো লাগছে না। ইহান খালি গলায়ই গাইতে লাগল,

–‘সুর নাই, সুখ নাই, বউও নাই রে। আমার কিছুই নাই রে…

সাবিনা ছেলের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,

–‘বিয়ে করে নে তাইলেই সব হবে। সুর হবে, সুখ হবে, বউও হবে। বিয়ে না করলে বউ হবে কীভাবে হ্যাঁ?’

ইহান ঘাড় ঘুরিয়ে মা’কে দেখল। মা আজ ছাদে এসেছে? হাঁটু ব্যথা ভালো হয়ে গেল নাকি? মা তো সচারাচর ছাদে আসে না। সাবিনা ঘরে এসে বিছানায় বসতে বসতে বলল,

–‘এভাবে উল্টো হয়ে বাদুড়ের মত ঝুলে আছিস কেন? দেয়াল থেকে পা নামা। পিঠ ব্যথা হয়ে যাবে। সোজা হয়ে শু।’

ইহান পা নামাল না। তবে হাত থেকে গিটার রেখে দিল। পিঠে ভর দিয়ে একটু পিছিয়ে এসে মা’র কোলে মাথা রাখল।

–‘একটা এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম বুঝলে মা। বাদুড়দের মত মানুষও ঝুলে থাকতে পারে কি-না। ধরো মা, মানুষেরও বাদুড়ের মত ঝুলে থাকার ক্ষমতা থাকলে কত ভালো হতো বলো। ফ্যানের সাথে ঝুলে থেকে সিলিঙ পরিষ্কার করে ফেলতাম। রাতের পর রাত উল্টো ঝুলে থেকে গান বানিয়ে ফেলতাম।’

ছেলের কোন উদ্ভট কথাই সাবিনার কাছে উদ্ভট মনে হয় না। ছেলের সব আচরণই তার কাছে স্বাভাবিক। সাবিনা ইহানের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।

–‘তুমিতো ছাদে আসো না মা। আজ কী উপলক্ষে এলে? হাঁটু ব্যথা ভালো হয়ে গেছে?’

এই বাড়িতে ইহানের দু’টো বেডরুম। একটা দোতলায়। একটা এই ছাদের চিলেকোঠায়। দিনের বেশিরভাগ সময় সে চিলেকোঠায়ই থাকে। রাতেও থাকে। মাঝে মাঝে দোতলার বেডরুমে গিয়ে ঘরের চেহারা আকার-আকৃতি মনে করে আসে শুধু।

–‘নিচে গিয়ে দেখ। ফুলি কী কাণ্ড করেছে। তোর মাছের একুরিয়াম নিচে ফেলে ভেঙে ফেলেছে। মাছগুলো ঘর জুড়ে সাঁতার কাটছে। ফুলি সেই নিয়েই কেঁদেকেটে বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। তুই নাকি ওকে বকবি।’

–‘বকব কেন? আজব কথা। একুরিয়াম ভেঙে ফেলেছে বলে বকতে হবে? মাছগুলো না মরলেই হলো। তুমি ওকে বলে দাও, আমি ফুলিকে বকব না। বরং ওর এই অপরাধের জন্য ওকে পুরস্কৃত করব।’

সাবিনা বিরক্তি ভরা চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকান। একে পেটে নিয়ে কোন পাগলা গোটা খেয়েছিলেন তিনি? যার কারণে ছেলের চরিত্রে এমন পাগলামি এলো! ওর চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ তো পাগল না। ওর বাবাও সুস্থ মানুষ। তাহলে ছেলের এরকম হওয়ার পেছনের কারণটা কী?

–‘আমি বলতে পারব না। তুই নিজে গিয়ে বলে আয়। আর আমি বললে ফুলি আমার কথা বিশ্বাস করবে না।’

–‘আচ্ছা আমিই তাহলে যাচ্ছি।’

ইহান উঠে দাঁড়াল। যাবার জন্য পা বাড়ালে সাবিনা ধমক দিল।

–‘জামা পরে যা। তোকে কতবার বলেছি, সারাক্ষণ এরকম খালি গায়ে থাকবি না। কী একটা হাফপ্যান্ট পরে সারাদিন ছাদের ঘরে শুয়ে থাকিস।’

ইহান মায়ের কথা শুনে হেসে নীচু হয়ে ঝুঁকে ফ্লোর থেকে টিশার্ট তুলে নিল। ওটা গায়ে দিল না। হাতে নিয়েও কাঁধে রেখে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এখন তার পরনে শুধুমাত্র একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। সেটাও আবার নাভির কত নিচে। যেন খুলে পড়ে যাচ্ছে। বা এক্ষুনি পড়ে যাবে। সিঁড়িতে ইহানের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাবিনা নড়ল না। বসে থেকে ভাবল, তার এই পাগল ছেলে কবে ঠিক হবে?
ইহান মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সাবিনার সাথে উদ্ভট উদ্ভট আচরণ করে। সে জানে তাকে নিয়ে মা’র কত চিন্তা। তাই আরও বেশি বেশি করে। মা’কে খেপানোর জন্যেই করে। নিজের প্রতি মায়ের মনের সন্দেহ আরও প্রগাঢ় করতে চায়। এতেই তার আনন্দ। একদিন সে কটকটা একটা লাল রঙের ফুলপ্যান্ট আর হলুদ রঙের ফুলহাতা শার্ট পরে এসে সাবিনার সামনে দাঁড়াল। হাসি হাসি মুখ করে বলল,

–‘মা আমাকে কেমন লাগছে দেখো তো। ভালো করে দেখে বলো। চট করে কিছু বলে দিও না। আগে দেখো, সময় নিয়ে ভাবো। তারপর আসল সিদ্ধান্ত জানাও।’

সাবিনা উত্তর দেওয়ার আগে ছেলেকে দেখে হতভম্ব। তার হাতে সবজি কাটার ছুরি ছিল। একটুর জন্য ছুরি হাতে চালিয়ে রক্তারক্তি কারবার ঘটিয়ে ফেলত। তবে তার হতভম্ব ভাব মনে মনেই রইল। চেহারায় প্রকাশ পেল না। ইহান এসব আজব জিনিস কোত্থেকে জোগাড় করে এটা উনার সবথেকে বড় প্রশ্ন। তবুও তিনি ছেলের মতোই মিষ্টি হেসে বলল,

–‘ভালোই তো। তা যাচ্ছিস কোথায়?’

ইহানের উৎসাহ বাড়ল। দ্বিগুণ আগ্রহে সে বলতে লাগল,

–‘বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। ছাব্বিশে পা দিচ্ছে। বন্ধুরা সবাই চেপে ধরায় পার্টি দিচ্ছে। নয়তো ও যে পরিমাণ কিপ্টা। জীবনে বন্ধুদের এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়ায়নি। ওর বাড়িতে গেলে হয়তো পানিও সাধবে না।

সাবিনা তখন পুইশাক কাটছিল। সে কাটাকাটিতে মন দিলেই বলল,

–‘খালি পায়ে যাবি নাকি? এই জামা প্যান্টের সাথে মিলিয়ে জুতাও কিনে নিতি।’

ইহান মায়ের এরকম রি-অ্যাকশন মোটেও আশা করেনি। সে কতক্ষণ ওভাবেই মা’র সামনে দাঁড়িয়ে রইল। সাবিনা ওকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। হাতের কাজ শেষ করে সে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

–‘এখনও দাঁড়িয়ে আছিস! যাচ্ছিস না কেন? কখন বের হবি? দেরি হলে তোর বন্ধু আবার রাগ করতে পারে। দেরি করিস না। তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে যা। আর শোন বন্ধুর জন্মদিনে খালি হাতে যাস না। ওর জন্য কোন গিফট টিফট নিয়ে যাস। বেচারার ভালো লাগবে। টাকা আছে তো তোর কাছে?’

ইহান গম্ভীর মুখে চুপচাপ উপরে চলে গেল। সাবিনা ওসব কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাগল ছেলের সাথে পাল্লা দিয়ে তাকেও কম পাগলামি করতে হয় না। ছেলে যদি চলে ডালে ডালে, তাহলে তাকে পাতায় পাতায় চলতে হয়।

–‘পাগল ছেলে! তার কত শখের একুরিয়াম ভেঙে গেছে আর সে বলছে এই অপরাধের জন্য ফুলিকে পুরস্কৃত করবে! আমাকে চমক দেওয়ার জন্য এই ছেলে যে আরও কত কী করবে? বিয়ে দিলে যদি এর পাগলামি কমে। বউ এলেই এই ছেলে ঠিক হবে। বিয়েই এর পাগলামির একমাত্র ঔষধ।’

ইহান সিঁড়িতে চপচপ শব্দ করে নিচে নেমে এলো। নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পেল। কে এসেছে? কতক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজছে কে জানে। মা ছাদে। কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পায়নি। ফুলি শুনলেও এখন দরজা খুলতে আসবে না। যতক্ষণ না ওর কান্নাকাটি শেষ হয় ততক্ষণ সে নড়বেও না। এক জায়গায় একই ভাবে বসে দুই তিন ঘন্টা কাঁদতে পারার রেকর্ড ফুলির আছে। দুই তিন ঘন্টাই চোখ দিয়ে একটানা পানি পড়বে। সাধারণত কিছুক্ষণ কান্না করার পর মানুষের চোখ থেকে আর পানি বের হয় না। কিন্তু ফুলির ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। বাধ্য হয়ে ইহানকেই দরজা খোলার জন্য এগিয়ে আসতে হলো। দরজা খুলে দিয়ে সামনে দাঁড়ানো একজন বয়স্ক লোকের পেছনে ষোলো সতেরো বছরের একটা মেয়েকে দেখতে পেল। এরা কারা ইহান চিনে না। আগে কখনও দেখেনি।
তনু বাবার পেছনে ইতস্তত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলার সাথে সাথে ওর চোখ খালি গায়ের এই ছেলেটার উপর পড়লে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল সে। পেছন থেকে সাবিনার গলা শোনা গেল।

–‘ইহান, ঘরে না গিয়ে দরজার কাছে কী করিস তুই?’

–‘এদিকে আসো তো মা।’

–‘কেন? কে এসেছে?’

–‘আসোই না তুমি।’

সাবিনা এগিয়ে এলো। এসেই ওদের থেকে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। গলার স্বর কয়েক ধাপ চড়ে গেছে ওর।

–‘এ কী কাণ্ড! কাদের তুই দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিস ইহান! তুই তোর মামাকে চিনতে পারিসনি?’

ইহান বয়স্ক লোকটার দিকে তাকাল। এ আবার তার কোন মামা? দুনিয়া জুড়ে যে মা’র লতানো পাতানো কত ভাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আল্লাহ জানেন! মা নানা নানুর একমাত্র মেয়ে। তার কোন মামা, খালা নেই। কিন্তু মা’র পাতানো ভাই বোনের অভাব নেই। ওরকম মামা সংখ্যায় তার কতটা হবে তা হয়তো মা’ও সঠিক বলতে পারবে না। মা তাকে অচেনা এই মামার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার আগে ইহান কেটে পড়ল।

–‘কী আশ্চর্য! আমি তো ভাবতেই পারিনি তোমরা আজ আসছো৷ আমাকে বলে এলে না কেন? কী কাণ্ড! আমি স্টেশনে লোক পাঠিয়ে দিতাম।’

জামাল সাহেব সাবিনার আগ্রহ দেখে হাসলেন। তার এই পাগলী বোন এখনো আগের মতোই আছে। ওর চোখে খুশির ঝিলিক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সাবিনা একটুও বদলায়নি। তনু বাবার শার্ট ধরে চুপ করে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সাবিনার চোখ এবার ওর উপর পড়ল।

–‘তনু না তুই? ও বাবা! কত বড় হয়ে গেছে। সেই ছোট্টটি দেখেছিলাম। এখন তো বড় বেটি হয়ে গেছিস। আয় মা আয়। আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি তোর ফুপু আম্মা। ছোট বেলায় তুই আমাকে পুপু আমা ডাকতি। ফুপু আম্মা উচ্চারণ করতে পারতি না। কী কাণ্ড! একদম মায়ের মতো দেখতে হয়েছিস। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক। গায়ের রঙও সবটুকু মা’র থেকে কেড়ে এনেছিস।’

ইহান নিজেই মায়ের পেঁচালে বিরক্ত হচ্ছে। মেয়েটার কী অবস্থা হচ্ছে কে জানে। নিশ্চয় মনে মনে মা’র উপর সে-ও কম বিরক্ত হচ্ছে না। সাবিনা ইহানকে ডেকে ওদের সাথে পরিচয় করানোর আগে ইহান নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। দেখা যাক অত বড় অপরাধ করে ফুলির এখন কী করছে। যেতে যেতে শুধু তনু নামটাই তার কানে এসে বাজল।
সাবিনা ওদের ভেতরে নিয়ে এসেছে।

–‘এবার যেন কোন ক্লাসে পড়িস মা?’

এই প্রথম তনু কথা বলল। ধীর গলায় জবাব দিল।

–‘এবার ক্লাস টেন এ উঠেছি ফুপু আম্মা।’

–‘অহ্ ভালো। মাশাআল্লাহ পড়াশোনায়ও এগিয়ে গেছিস। তা জামাল ভাই, তনুকে নিয়ে আমার এখানে কয়টা দিন থাকবে তো? তোমরা তো আমার এখানেই থেকে গেলে পারো। গ্রামে তো ভালো স্কুল কলেজও নেই। সুযোগ সুবিধাও কম। তনুকে এখানে রেখে কলেজে পড়ালে জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে।’

সাবিনা বাবা মেয়ের থাকার ব্যবস্থা গেস্ট রুমে করে দিলেন। ঘরে এসে তনু গোসল সেরে নিল। যা গরম পড়েছে! খালি পায়ে বাইরে গিয়ে দু’মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে পায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে। তনু হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গা লাগাল। সে কখনও ভেবেছিল, অচেনা অজানা এক মুখে বলা ফুপুর বাড়িতে এসে উঠবে। দরজায় টুকা পড়ল। তনু উঠে বসেছে। সাবিনা বলল,

–‘খেতে আয় মা। খেয়েদেয়ে শুয়ে থাক।’

তনু সাবিনার পেছন পেছন খাবার টেবিলে চলে এলো। বাবাকে ফুপু আম্মা আগেই ডেকে নিয়েছে। তনু বাবার পাশে বসল।
ফুলি এসে গম্ভীর মুখে সাবিনার পাশে দাঁড়াল। সাবিনা ফুলিকে ওদের চিনিয়ে দিল।

–‘তুইও খেতে বসে যা ফুলি।’

–‘খামু না।’

–‘কেন? মন খারাপ? ইহান সত্যি সত্যিই বকেছে নাকি?’

ফুলি এবার কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,

–‘ভাইজান বকে নাই। বকলেও তো মনে শান্তি পাইতাম। উনি আমারে নতুন একটা কচকচা পাঁচশো টেকার নোট ধরাই দিল। এইডা কোন কথা হইল আম্মাজান! আপনিই কন। অপরাধ করলে শাস্তি না দিয়া পুরষ্কার দেয়! এইডা কেমুন কারবার!’

সাবিনা হাসল।

–‘যা তোর ভাইজানকে খেতে আসবে বল গিয়ে।’

–‘গেছিলাম। ভাইজান কইল, উনার খাওয়োন ঘরে দিয়া আসতে।’

–‘আচ্ছা তাহলে দিয়ে আয়।’

ফুলি প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ফুপু আম্মা আর মেয়েটার কথায় এটুকু জানা গেল, ওই থ্রি কোয়ার্টার এর নাম তাহলে ইহান। তনুর কাছে ছেলেটাকে প্রথম দেখাতেই আজব প্রাণী বলে মনে হয়েছে।

চলবে🍃