সুখের পাখি পর্ব-১০

0
599

#সুখের_পাখি

১০
ঘরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তনু হেঁচকি তুলে ফেলল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে মুখে ওড়না চেপে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ কারো কানে যাওয়া যাবে না। ইহান ভাইয়ের মাঝে মাঝে কী হয়? এই কয়দিন তো ভালোই ছিল। কত ভালো করে তার সাথে কথা বলতো। হাসতো, গান শুনাতো। আজ কেন এরকম খারাপ ব্যবহার করলো? উনি এমন করলে তনুর কষ্ট হয়৷ তা কি ইহান ভাই বুঝে না! নাকি বুঝেও আরও বেশি কষ্ট দেয় তাকে?
তনু দরজা লাগিয়ে সেই যে শুলো আর উঠল না। গভীর রাত পর্যন্ত কেঁদেই গেল সে। এতো কষ্ট কেন তার? এই বাড়িতে আসার পরই তার এত কষ্ট। গ্রামে থাকতে মাতব্বরের ছেলে তাকে বিরক্ত করার সময়ও তার এত কষ্ট হয়নি। ইহান ভাই ওই ছেলের মতো তাকে বিরক্ত করে না। বরং তাকে দেখতেই পারে না। তবুও তনুর ইহান ভাইয়ের জন্যই কেন এত মন কাঁদে?
কেঁদে কেঁদে তনুর মাথা ব্যথা করছে। মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে যেন। ঘুমও আসছে না। তনু ভাবল ফুপু আম্মার কাছে ঘুমের ঔষধ আছে। কয়েকটা এনে খেয়ে ফেললেই তার কষ্ট কমতো।

–‘আমি আর কখনও আপনার কাছে যাব না ইহান ভাই। কখনও না। আপনি অনেক খারাপ। আমাকে অনেক কষ্ট দেন। কেন এমন করেন আপনি? আমি কী করেছি? আমি তো আপনার কাছে বেশি কিছু চাই না। আপনি আমার সাথে একটু ভালো করে কথাও বলতে পারেন না! আমাকে কষ্ট দিয়ে আপনি সুখ পান তাই না! আমার সাথে ওরকম বাজে ব্যবহার করতে আপনার ভালো লাগে। আপনি আমার মন একটুও বুঝেন না। আমিই পাগলের মতো একা একা আপনাকে ভালোবেসে যাচ্ছি। আপনি আমাকে ভালোবাসবেন তো দূর আমার ভালোলাগা খারাপ লাগার কথাও ভাবেন না। ফুলি আপা অন্যায় করলেও আপনি তাকে পুরষ্কার দেন। আর আমি কিছু না করেও আপনার কাছে বকা খাই। আপনি আমার জন্যই এত কঠিন কেন বলুন তো?’

তনু কাঁদছে। সত্যিই তার কষ্ট হচ্ছে। তার অবুঝ মন কেন ইহান ভাইয়ের মতো একজন মানুষকে পছন্দ করতে গেল! কেন ভালোবাসলো? জীবনের প্রথম ভালোলাগার মানুষ। সে-ই কিনা তনুর সাথে ওরকম বাজে ব্যবহার করে! ভালোবাসা তার জীবনে এসেছিল কিন্তু এই ভুল মানুষটার জন্য কেন এলো?
মাতব্বরের ছেলে সাত মাস পিছে ঘুরেও তার মন পায়নি। কিন্তু ইহান ভাই কিছুই করল না। তনুই প্রথম দেখাতে ওকে পছন্দ করে ফেলল।
কান্নার বেগে তনুর পিঠ ফোলে ফোলে উঠছে।

–‘আপনি অনেক পাষাণ। আপনার বুকে মন জিনিসটা নেই। এতো কঠিন কেন আপনি? আমি আপনাকে বুঝতে পারি না ইহান ভাই।’

….তার চোখে যেন দেখলাম, আজ দিনটা বড় মেঘলা, বুঝি বৃষ্টি নামবে বললো সে আমায়।
কেনো মেঘ সরেনা রত্তি?
কেনো গল্প হয়না সত্যি?
আমি মত্ত তারই তৈরি দোটানায়। দোটানায়…
বোঝেনা সে বোঝেনা,বোঝেনা…

ইহানের গলা। গান গাইছে সে! মনে সুখ লেগেছে! তনু দুই হাতে কান চেপে ধরল।

–‘আপনার গান আর কখনও শুনবো না আমি। জীবনেও না। একটা গান শুনাতে বলেছিলাম বলে এতো কথা শুনালেন তখন! আর এখন কাকে শুনাতে গাইছেন? বন্ধ করুন। চুপ করুন আপনি। আপনার গলা শুনে আমার রাগ হচ্ছে ইহান ভাই। আপনি আমাকে বোঝেন না। এখন আবার নিজে বোঝেনা সে বোঝেনা গান গাইছেন। আপনাকে আমি বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। দোহাই লাগে গান বন্ধ করুন আপনি।’

তনু কান চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল। ইহানের উপর তার দুনিয়ার সব রাগ এসে ভর করেছে। কিন্তু ইহান! ইহান কি তনুর মনের কথা শুনতে পাচ্ছে? নাকি তনুর কথা ভাবছে?

….যদি একটিবারও পারতো, সব চিন্তা ভুলে আসতে, আমি সব হারাতাম তাকে পেতে হায়…

তনু আর সহ্য করতে না পেরে দরজার দিকে বালিশ ছুড়ে মারল। অন্য একটা বালিশ নিয়ে কান চেপে ধরল। চেঁচিয়ে বলল,

–‘থামবেন আপনি! চুপ করবেন এবার? কাকে পেতে সব হারাতে রাজি আপনি? কে সেই শাঁকচুন্নি যার জন্য আমাকেও পাত্তা দিচ্ছেন না।
থাম তুই শালা। আমাকে কষ্ট দিয়ে তোর মনে রঙ লেগেছে! রঙের পুকুরে ডুব দিচ্ছিস শালা হারামি। তোর কখনও ভালো হবে না। ওই মেয়েটারও না। বিয়ের পরের দিনই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে তোদের। একদিনও সংসার করতে পারবি না। আমার অভিশাপে তোর বউ তোকে বাসরঘরে রেখে অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে যাবে৷ তখন আমার কষ্ট বুঝবি তুই।’

পরের দুইদিন তনু ইহানের কাছে পড়তে গেল না। ফুলি আপাকে দিয়ে বলিয়ে পাঠিয়েছে,

–‘আমার জ্বর ফুলি আপা। তুমি গিয়ে তোমার ভাইজানকে বলে দাও তনু কয়দিন পড়বে না।’

মুখে জ্বর বললেও তনুকে দিব্যি সুস্থ দেখা যাচ্ছে। ফুলি চিন্তিত গলায় বলল,

–‘তোমার জ্বর! আমারে তো বললা না তনু। কই দেখি। দেখি কত জ্বর!’

বলতে বলতে ফুলি তনুর কপালে হাত রাখল।

–‘কই জ্বর! কপাল তো ঠান্ডা। জ্বর আইলে কপাল গরম থাকতো। তোমার জ্বর আসে নাই।’

তনু উদাস গলায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–‘গায়ের জ্বর না গো ফুলি আপা। মনের জ্বর।’

তনুর আগামাথা ছাড়া কথা ফুলির বোধগম্য হচ্ছে না। ভুরু কুঁচকে তনুকে দেখছে ফুলি। এত সুন্দর মেয়েটার মাথায় ছিট আছে। এর ছেলেমেয়ে হলে ওদেরও মাথায় ছিট থাকবে। ওর জামাইটা পড়বে জ্বালায়। মাথায় ছিট ওয়ালা বউ। পোলাপানও মা’র ধারা পাইব।

–‘মনের জ্বর! মনেরও আবার জ্বর হয় নাকি গো!’

–‘হয় গো হয়। শরীরের জ্বরের ঔষধ আছে। কিন্তু মনের জ্বরের ঔষধ নাই। তুমি এতসব বুঝবে না। তুমি শুধু তোমার ভাইজানকে গিয়ে বলো তনুর জ্বর। এর বেশি আর কিছু বলতে হবে না।’

–‘আচ্ছা।’

ফুলি চলে যাচ্ছে। তনু পেছন থেকে ডেকে বলল,

–‘এই শোনো, মনের জ্বরের কথাটা আবার বলতে যেও না। তুমি যা মুখ পাতলা!’

সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ইহান ভেবেছিল তনু এসেছে। হাতের সিগারেট মেঝেতে ফেলে পাপোশ দিয়ে ঢেকে ফেলল। তনু তাকে সিগারেট খেতে দেখলে রাগ করবে। সেদিন ওভাবে তনুকে বকার পর আজ দুই দিন পর তনুর দেখা পাচ্ছে ইহান। মাঝের আটচল্লিশ ঘন্টায় তনুর ছায়াটা পর্যন্ত দেখেনি ইহান। খাবার টেবিলে না। বসার ঘরে টিভির সামনেও না। ইহান একরাত নিজের বেডরুমে ছিল। এই ভেবে যে তনুর দেখা হয়তো পেতে পারে। হুটহাট রাতের বেলাতেও বসার ঘরে চলে গেছে। তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল ও গিয়ে দেখবে তনু সোফায় উপুড় হয়ে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে রিমোট হাতে গান শুনছে। তাকে দেখে চট করে খবরের চ্যানেলে দিয়ে দিবে। না। তেমন কিছুই হলো না। তনু যেন এই বাড়িতেই নেই। পুরো বাড়ি ঘুরেও সে তনুর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারল না। দুইটা দিন ধরে বুকের ভেতর কেমন ব্যথা হচ্ছে তা ইহানও জানে না। দুইদিন পর তাহলে তনুর রাগ ভেঙেছে! ইহানকে দেখা দিতে এসেছে ও। ইহান তার তৃষ্ণার্ত চোখে দরজার দিকে তাকালো। তনু আসছে। দরজার সামনে পায়ের শব্দ পেয়ে তনু দরজায় টুকা দেওয়ার আগেই খুশি খুশি গলায় ইহান বলল,

–‘এসো তনু।’

ইহানের সব ভাবনায় এক চুলা ছাই ফেলে তনুর বদলে ফুলি ঘরে ঢুকল। ফুলিকে দেখে ইহানের মেজাজ সাত আসমানে উঠে গেল। এখন তনুর আসার কথা ছিল। ও না এসে ফুলি এসেছে। ফুলিটার চাকরি এবার সত্যি সত্যিই নট করে দিবে সে।

–‘তনু না ভাইজান। আমি ফুলি। তনু পড়তে আইব না।’

–‘আজও আসবে না! গত দু’দিন আসেনি। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে নাকি ও?’

–‘আরও এক সপ্তাহ মনে হয় আইতে পারব না।’

ইহান বিরক্ত হলো। আবার পাশাপাশি চিন্তিতও হলো।

–‘কেন? কী হয়েছে তনুর?’

–‘তনুর জ্বর। আমারে এই কথা আপনারে জানাইতে পাঠাইল।’

ইহানের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গিয়ে তনুর গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিতে। দুইদিন ধরে জ্বর! ইহান কিছুই জানে না! কেউ তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করল না। আজব পরিবার তার। এমনিতে তো মা দুনিয়ার সব আজাইরা কথা তার কানে তুলতে ভুলে না। আর এই কাজের কথাটা বলতে পারল না। আর তনুর আক্কেল জ্ঞান কেমন? আজ দুইদিন পর নিজে না এসে ফুলিকে পাঠিয়েছে তার অসুস্থতার কথা বলতে! নিজে এলে কি পা ব্যথা হতো? ফাজিল মেয়ে।

–‘আমি যাই ভাইজান।’

ফুলি চলে যাচ্ছিল। ইহান বাঁ হাতে কপাল ডলতে ডলতে বলল,

–‘জ্বর কি খুব বেশি? বিছানা থেকে উঠতে পারছে না?’

–‘মনের জ্বর বেশি না কম কেমনে কমু ভাইজান। মনের জ্বর কি মাপুন যায়?’

ইহানের কপাল কুঁচকে গেল।

–‘মনের জ্বর আবার কি?’

ফুলি জিভ কামড় দিল। তনু তাকে এই কথা ভাইজানকে বলতে না করেছিল। ফুলি সাথে সাথে কথা ঘুরিয়ে নিল।

–‘মন কইছি নাকি আমি? তনু কইছি। আপনে শুনতে ভুল করছেন। তনুর জ্বর।’

ইহান ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার বের করে ফুলির হাতে দিল।

–‘এই নে জ্বর মাপার যন্ত্র। এটা দিয়ে জ্বর মেপে এক্ষুনি এসে আমাকে জানাবি। বুঝেছিস?’

–‘হ। আইচ্ছা ঠিক আছে।’

ফুলি যখন থার্মোমিটারটা এনে তনুর হাতে দিল, তনু জিনিসটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। ঠোঁট বাকিয়ে বলল,

–‘এটা দিয়ে আমি কী করব ফুলি আপা? তুমি এটা আমাকে দিচ্ছ কেন? আর তোমাকেই বা এটা কে দিল? কোথায় পেলে তুমি এটা?’

ফুলি মহা বিরক্ত। তনুর পড়ার টেবিলে বসে পড়ে বলল,

–‘ভাইজান দিছে। এইটা দিয়া জ্বর মাপে। জ্বর মাপার যন্ত্র। তোমার মনের জ্বর মাইপা আমারে কও। আমি ভাইজানরে গিয়া বলে আসি।’

তনু রাগ সামলাতে পারল না। ওটাকে ছুড়ে ফেলল। ফুলি হায় হায় করে উঠে বলল,

–‘এইডা কী করলা তুমি!’

–‘তোমার ভাইজানের কোন জিনিস আমার লাগবে না। তোমার ভাইজান একটা মিচকা শয়তান। বুইড়া শয়তান। ধলা শয়তান। চেহারায় মানুষ ভেতরে শয়তান। রগে রগে শয়তানি উনার। হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি। পেটে পেটে খবিশি বুদ্ধি। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভেজাল মাল।’

এই ফুলির চাকরি সত্যিই খাবে ইহান। ফুলিটা আজকাল কোন কাজে লাগছে না। কখন বলেছে তনুর জ্বর মেপে তাকে এসে জানিয়ে যেতে। তা তো জানালোই না। তার চা-টাও এখন পর্যন্ত দিয়ে এলো না। কী করে ফুলি?

–‘ফুলি! এই ফুলি! কই মরলি?’

তনুর ঘর থেকে তনুর পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গলা শুনে তো মনে হচ্ছে না তনু অসুস্থ। ইহান এই প্রথম তনুর ঘরের দিকে পা বাড়াল। তনু চেয়ারের উপর এক পা তুলে আরেক পা ঝুলিয়ে বসে গলা ছেড়ে পড়ছে। ইহান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখল। সে যে এসেছে এদিকে তনুর খেয়াল নেই। তনু মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তসবিহ জপার মতো পড়ে যাচ্ছে। ইহান ট্রাউজারের পকেটে হাত রেখে দরজায় হেলান দিয়ে তনুর দিকে চেয়ে রইল। অসুস্থতার কথা তাহলে সম্পূর্ণ ভুয়া! কোনো জ্বর-টর আসেনি তনুর। ইহান মুচকি হাসল। বিড়বিড় করে বলল,

–‘তাহলে মনের জ্বর হয়েছে তোমার!’

চলবে🍂