সুখের পাখি পর্ব-০৯

0
603

#সুখের_পাখি


তনুর পড়াশোনা গোল্লায় গেছে। বইখাতা টেবিলে ছড়িয়ে রেখে তনু সন্ধ্যা থেকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বালিশে মুখ গুঁজে কতক্ষণ কাঁদল। এ কান্না কারণ ছাড়াই। তার মন খারাপের নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই আজ। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ফুলির ডাকে ঘুম ভাঙল। ফুলি তনুর গা ধাক্কা দিয়ে ডাকছে।

–‘তনু! ও তনু। এই সন্ধ্যা রাইতে কেউ ঘুমায়! মাইয়ার কাণ্ড দেখো। টেবিলে বই খুলে রেখে সে পড়ে পড়ে ঘুমাইতেছে।’

ফুলির গলা শুনে মনে হলো সে মহা বিরক্ত। তনু কাঁচা ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

–‘কী হয়েছে ফুপি আপা!’

–‘কী হইব? কিছু না। বই খুইলা রাইখা ঘুমাইতাছো তুমি।’

তনু ভেবেছিল বাড়িতে কী না কী ঘটে গেছে। অথচ ঘটেনি কচুও। ফুলি আপা এমনি এমনি তার ঘুম ভাঙালো।
রাতে তনু খাবার টেবিলে গিয়ে বড়সড় একটা ধাক্কা খেল। আজ ইহান খাবার টেবিলে খেতে এসেছে! তনুর আগেই সে টেবিলে বসে আছে। ইহান রাতে বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে থাকে। দিনে তনু স্কুলে থাকে, ফলে ইহানের সাথে বসে খেতে হয় না তাকে। হলেও খুব কম সময়। শুধু ছুটির দিনগুলো। তনুর আজ ইহানের সামনে যেতে এতো লজ্জা করছে কেন? হয়েছে কী তার? মনে মনে তনু নিজেকে ধমকালো। সাবিনা ওকে দেখে বলল,

–‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় বোস। আজ তোর পছন্দের চিংড়ির চচ্চড়ি আর বেগুন ভর্তা করেছি।’

তনু ইহানের দিকে না তাকিয়ে চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসলো। তনুর উপস্থিতিতে ইহানের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সে নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। মা, ফুলির সাথে গল্প করছে। ভুলেও তনুর দিকে তাকাচ্ছে না। সাবিনা সবাইকে একটা খুশির খবর জানালো। ইহানের বাবা বাড়ি ফিরছেন। আজ সন্ধ্যায় কথা হয়েছে। বলেছে দু’তিন দিনের মধ্যেই চলে আসবে। খবরটা সবার জন্য খুশির হলেও ইহানের জন্য না। বাবা বাড়িতে থাকলে তার সাথে কোনো না কোন বিষয় নিয়ে বাবার লাগবেই। ঝগড়া করতে ভালো লাগে না তার।
ফুপু আম্মার মুখে কথাটা শুনে তনু চট করে একবার ইহানকে দেখল। আর তখনই চোখাচোখি হয়ে গেল। তনু তাড়াতাড়ি করে চোখ নামিয়ে নিল। স্বামী ফিরে আসবে ফুপু আম্মা কত খুশি। অথচ বাবার আসার খবর শুনে ইহান ভাই খুশি না। বাকি সময়টা ইহান চুপচাপ খেলো। তনু চোরা চোখে ভাতের সাথে ইহানকেও গিলে খেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তনু মনে মনে বলল,

–‘ইহান ভাই গো! কী জাদু করলেন আপনি আমাকে! আপনার সবকিছুই আমার কাছে এতো ভালো লাগে কেন? আপনার হাঁটাচলা। আপনার কথা বলা। আপনার খাওয়া। এইযে আপনি এখন মুরগির ঠ্যাংটা খাচ্ছেন, আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে আপনার হাত থেকে ঠ্যাংটা কেড়ে নিয়ে ওটা আমি খেয়ে ফেলি। কিন্তু দুঃখের কথা দেখুন। আমি মুরগী একদম খেতে পারি না। গন্ধ শুনলেই বমি আসে। কিন্তু আপনি কত তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। আমাদের কোনো কিছুতেই মিল নেই কেন ইহান ভাই? আপনার বাবার সাথে আপনার রাগারাগি। আমার বাবাই আমার দুনিয়া। আপনি কতো মমতাময়ী একজন মা পেয়েছেন। আমি অভাগী মায়ের মুখটাও মনে নেই। আপনি কতো বড়লোক। আর আমি আপনাদের দয়ায় আছি। আপনি ভালো গান করেন। আমার গলা শুনলে মানুষ দৌড়ে পালাবে। আপনি পড়াশোনায়ও কত ভালো। আমি ফেল্টুস ছাত্রী। অংকে বত্রিশ পাই। আপনার সাথে আমার কিছুরই মিল নেই। না একটা দিকে অবশ্য মিল আছে। আপনিও আমার মতো ফর্সা সুন্দরী। ছেলেরা এতো ফর্সা কেন হয় ইহান ভাই? আপনি এতো সুন্দর কেন? আপনি কালো হলে কি আপনাকে নিয়ে আমার এতো ভয় থাকতো? থাকতো না। তখন কোন মেয়ে আপনাকে পাত্তা দিত না। কিন্তু এখন, এখন তো মেয়েরা প্রথম দেখাতেই আপনার জন্য পাগল হয়ে যাবে। যেমন আমি হয়েছি। আপনাদের বাড়িতে এসে প্রথম দিনই ওই খালি গায়ের ছেলেটাকে দেখে আমি মরেছি।’

তনুর কান্না পাচ্ছে। গলার কাছে ভাত দলা পাকিয়ে উঠছে। বিষম খেল তনু। কাশতে কাশতে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। সাবিনা ব্যস্ত হয়ে উঠে এসে তনুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ফুলি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।

–‘ও তনু কী হইলো তোমার? ও তনু…

তনুর বাবা কী করবেন ভেবে পাচ্ছে না। একটা মানুষও কাজের না৷ কেউ যে তনুকে পানি খাওয়াবে সেটা করছে না। বরং অকাজ করে যাচ্ছে। ইহানের রাগ হলো। সে পানির গ্লাস নিয়ে নিজে তনুকে পানি খাইয়ে দিল। ফুলিকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।

–‘আহ ফুলি! চুপ না করলে তোর চাকরি নট। একটা কথা যেন না শুনি।’

চাকরি যাওয়ার ভয়ে ফুলি চুপ করে গেল। ইহান তার মা’কে রাগ দেখিয়ে বলল,

–‘ওকে পানি না খাইয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে গলার খাবার ছুটে যাবে? অত অস্থির কেন তুমি মা?’

মা’কে বকাবকি শেষ করে সে তনুকেও কড়া করে ধমক দিল।

–‘আর তুমি কি ছোট বাচ্চা? ভাত গলায় বাজে কীভাবে? আস্তে আস্তে খেতে পারো না। লাঠি নিয়ে কেউ তোমাকে তাড়া করছে? তাহলে অত তাড়াহুড়ো কিসের? ‘

সাবিনা করুণ মুখ করে বলল,

–‘মেয়েটাকে আবার বকছিস কেন?’

–‘বকা খাওয়ার কাজ করলে বকবো না! ও কি দুই তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে?’

–‘বুঝতে পারেনি। থাক আর বকাবকি করিস না।’

ইহান কাউকে বুঝাতে পারছে না কেন রেগে যাচ্ছে সে। এই মেয়ে এতটা বেখেয়ালি কেন? তাকে দেখতে দেখতে গলায় খাবার আটকে মরে গেলে হবে?
এখন যদি সিরিয়াস কিছু হয়ে যেত। ইহান শুধু রাগটাই দেখাতে পারছে। তনুকে নিয়ে তার টেনশন কেউ দেখছে না।
তনু ঘরে এসে আরেক দফা কেঁদে নিল।

–‘আপনি এত ভালো কেন ইহান ভাই? আমার জন্য অত ভাবেন আপনি! নিজের হাতে আমাকে পানি খাইয়ে দিলেন। কিন্তু অমন করে বকলেন কেন? আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছে। আপনার উপর মাঝে মাঝে আমার এত রাগ হয়! আবার মন খারাপও হয়। যেমন এখন হচ্ছে। আমি তো জানি আমি যা চাইছি তা কখনও সম্ভব না। কোথায় আপনি! আর কোথায় আমি! আমাদের কোন মিল নেই। কখনও আমাদের মিল হবে এমনটাও আশা করি না। সাধ্যের বেশি চাইতে নেই। এতে শুধু দুঃখই মিলবে। আমি অনেক কিছুই বুঝি। যেমন এটাও বুঝতে পারছি, আপনাকে ভালোবেসে আমি শুধু কষ্টই পাব।’

তনুর দিন গুলো এভাবেই কাটতে থাকে। স্কুলে যায়। বাড়ি ফিরে ইহানের কাছে পড়তে যায়। রাতে ঘরে বসে মন চাইলে পড়ে নয়তো শুয়ে শুয়ে ইহানকে নিয়ে ভাবনার সাগরে ডুব দেয়। পড়ানোর সময় একদিন ইহান তাকে বকে। একদিন ভালো করে বুঝায়। একদিন পড়া বাদ দিয়ে গান শোনায়। ইহানের কাছে পড়ার আগে অংক তনুর জানের দুশমন ছিল। এখন তার কাছে অংক ততটাও কঠিন মনে হয় না। ইহান বুঝালে সহজই মনে হয়। আবার বুইড়া টাকলা ক্লাসে বুঝালে কিচ্ছু বুঝতে পারে না। সব মাথার উপর দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। ইহানের সাথে তার কথাবার্তার সম্পর্ক আগের থেকে অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তনু যে তোতা পাখির মতো চটরপটর কথা বলতে পারে তা দেখে ইহান অবাক।
এই মেয়েকে পড়ানোর সময়টুকু তার কাছে জীবনের ভালো সময় গুলোর মধ্যে জুড়ে যায়। কখন সময় কেটে যায় বলতেই পারে না। ইহান অপেক্ষায় থাকে কখন তনু বাড়ি ফিরবে। কখন ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠবে। তনুর পায়ের শব্দ পেলেই ইহানের বুক ধুকপুক করতে শুরু করে। ইহান বুঝতে পারছে তনুর মায়ায় পড়ে যাচ্ছে সে। এটা ঠিক না জেনেও নিজেকে আটকাতে পারে না। তনু বাচ্চা মেয়ে। এখনও অবুঝ। জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তার। তনু ভুল করতেই পারে। তনুর ভুলকে প্রশ্রয় দিয়ে সে নিজে আরও বড় ভুল করছে। না, এখন থেকে তনুর সাথে কঠিন হতে হবে। এখনই জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে তনু হয়তো ভবিষ্যতে পস্তাতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলো সঠিক সময় নেওয়া উচিত। আবেগের বশে কোন ভুল করে ফেলুক তনু তা ইহান চায় না। মেয়েটা বড্ড অবুঝ।

নিজের ভাবনায় ডুবে ছিল ইহান। তাই আজ সিঁড়িতে তনুর আসার শব্দ পায়নি। চিত হয়ে শুয়ে দুই পা দেয়ালে ঠেস দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে তনুকে নিয়েই ভাবছিল সে। হঠাৎ তনু এসে তার সামনে দাঁড়াল। বিস্মিত চোখে ওকে দেখে বলল,

–‘ইহান ভাই আপনি সিগারেট খান!’

ইহান চমকালো। কিন্তু চেহারায় প্রকাশ করল না। তনু আজকাল না বলেই হুটহাট ঘরে চলে আসে। এটা যেন তার নিজেরই ঘর। যেকোনো সময় আসতে পারবে সে। এই অধিকার অবশ্য একটু একটু করে তনুকে সে-ই দিয়েছে। তাইতো আসার আগে নক করে না তনু। পড়া বাদেও কারণে অকারণে চলে আসে। এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা এমনি বসে থাকে। তার ঘরের জিনিসপত্র ঘাঁটে। গান শোনার জন্য ইহানের কাছে বায়না ধরে। ইহান শান্ত মুখে উঠে বসল। এখনও তার হাতে জলন্ত সিগারেট। নাক দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

–‘আপনিও সব ছেলেদের মতো সিগারেট খান!’

–‘কেন? সব ছেলেদের থেকে আলাদা হওয়ার আমার কি বিশেষ কোন কারণ আছে?’

–‘এসব খাওয়া ভালো না ইহান ভাই।’

–‘আমি জানি। তোমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। আমি তোমার শিক্ষক? নাকি তুমি আমার শিক্ষক?’

–‘আমারও ইচ্ছে ছিল জীবনে একদিন হলেও সিগারেট খাব। আপনার থেকে একটা খাই ইহান ভাই?’

ইহান হতভম্ব। রাগা উচিত এখন তার। তবুও রাগতে পারল না। অবাকই বেশি হলো।

–‘তুমি সিগারেট খাবে?’

–‘হ্যাঁ। ছেলেরা খেতে পারলে মেয়েরা কেন পারবে না? এখন তো ছেলেমেয়ে সমান অধিকার।’

–‘ছেলেরা খালি গায়ে বাইরে যেতে পারে। তুমিও কি ওড়না ছাড়া বাইরে যেতে পারবে? না পারলে ছেলেমেয়ে সমান অধিকার বলতে এসো না আমার সামনে।’

ইহান রেগেই বলল। কিন্তু তনু লজ্জায় মরে গেল। ইহান ভাইটা এতো ঠোঁটকাটা কেন? মুখে যা আসে তা-ই বলে যায়। সামনের মানুষটা যে লজ্জা পাবে তা ভাবে না। ইহান ছোট্ট ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট ফেলে আসে। ঘরে এসেই তনুকে বই বের করতে তাড়া দেয়। তনুর আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। সে বায়না ধরা গলায় বলল,

–‘আজ পড়ব না ইহান ভাই। আজ গান শুনতে ইচ্ছে করছে। একটা গান শোনান না প্লিজ। সুন্দর একটা গান। যেটা শুনে মন ভালো হয়ে যাবে। আমার না আজকাল মনটা ভীষণ খারাপ থাকে। কারণ ছাড়াই কান্না পায়। কাঁদিও খুব। তবুও কষ্ট কম হয় না। কষ্ট কমানোর একটা গান শুনান না। আপনার গান শুনে আমার কষ্ট কমুক।’

তনুর আবদার রাখতে ইচ্ছে করছিল ইহানের। কিন্তু তার হাত পা বাঁধা। তনুকে থামাতে হবে। ওর আর তনুর মাঝে একটা রেখা টানতে হবে। এই রেখার বাইরে কেউ যেতে পারবে না। না তনু এই রেখা পার করে তার দিকে আসবে। না ইহান যাবে। কঠিন গলায় ধমক দিল সে।

–‘আমার কাছে পড়তে আসো না গান শুনতে আসো? পড়ার সময় অন্য কোনো কথা না। আর কোনদিন আমার সামনে এসব কথা বলবে না। আমি তোমার স্যার। তোমার বন্ধু না। ভালো করে পড়তে পারলে আসবে নইলে এসো না। আমার অত শখ লাগেনি তোমাকে পড়ানোর। মাথায় গোবর। আবার পড়া রেখে কত আবদার।’

অপমানে তনুর চোখে পানি চলে এলো। ইহানের সামনেই কেঁদে ফেলল সে। ইহান তনুর চোখে পানি দেখেও গললো না। আরও কঠিন স্বরে বলল,

–‘কান্না বন্ধ। ন্যাকামি পছন্দ করি না আমি। কথার আগে চোখে পানি চলে আসে। চোখে কি নদী ফিট করে রেখেছ! এতো পানি আসে কোত্থেকে?’

তনু ইহানের সামনে আর দাঁড়াল না। ছুটে চলে এলো। ইহান অসহায় মুখে ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–‘তুমি কেন এই ভুল করতে গেলে তনু? কেন এমন ভুল করলে! ভুল মানুষকে ভালোবাসা অনেক কষ্টের তনু। এই কষ্ট আমি তোমাকে দিতে চাই না। তুমি সহ্য করতে পারবে না। এখনও তুমি অনেক ছোট। মাত্র টেন-এ পড়ো। আরও কত জীবন পড়ে আছে তোমার। তুমি একদিন বড় হবে। তখন বুঝতে পারবে আমি তোমার ভালোর জন্যই আজকের এই ব্যবহার করেছি।

চলবে🍂

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা