সুখের সন্ধানে পর্ব-১০+১১

0
299

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১০
বহুদিন পর সেলিম আর প্রিয়র সাথে ভালো কিছু সময় কাটালাম। মনে হয়েছিল আমি বোধ হয় সেই পুরানো দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছিলাম । শুরুর দিকে এমনই ছিল আমার দিনগুলি। ধীরে ধীরে সেলিম আর আমার মাঝে দুরত্ব বাড়তে থাকে। আমি নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিই। ছেলেটা কাছে থাকলে হয়ত এই নিঃসঙ্গতা কিছুটা হলেও কম হতো। সেলিমের সাথে দুরত্বও এত খারাপ পর্যায়ে পৌঁছাত না।

ঢাকায় পৌঁছেছি গতকাল। প্রিয় আগামীকাল চলে যাবে। মনটা ভীষণ খারাপ আমার। একদিকে সেলিমের টেনশান অন্যদিকে প্রিয় চলে যাবে ভাবতেই পারছি না। সেলিম চাকরিতে না রাখলেও ওই হেলেনের সাথে আবার যোগাযোগ যে করবে সেটা আমি নিশ্চিত। কারণ এই ধরণের মানুষ সহজে শোধরায় না। তবে কাদেরের সাথে কথা বলে যতটুকু বুঝতে পেরেছি। সেলিম হয়ত এই প্রথমই কারো সাথে এ ধরণের রিলেশানে জড়িয়েছে। তাই কিছুটা স্বস্তি। আপাতত এটুকু স্বান্তনা যে আমাকে সেলিম এ ব্যাপারে এখনো ভয় পায়। অবশ্য সে ওপেন কিছু করলেও আমার কোনো শক্তি সামর্থ্য নেই যে তা দিয়ে তাকে ঠেকাতে পারব। সেলিম যে ধরণের পরিবারের ছেলে তাতে এ ধরণের দু’চারটা হেলেনের সাথে সম্পর্ক রাখা তাদের কাছে কিছুই না। এই সোসাইটিতে এটা এক ধরণের বিলাসিতা। অনেকের সাথে মিশেছি এত বছরে। অনেক দেখেছি। সেলিম যদি সত্যিই এটাকে বিলাসিতার পর্যায়ে ভেবে থাকে তবে অপারগ হয়ে হয় সব সহ্য করে আমাকে সংসারে জড় পদার্থের মতো পড়ে থাকতে হবে নয়তো অপমানের যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে সংসার ছাড়তে হবে। কারণ সেলিমের সাথে লড়াই করার মতো শারীরিক বা মানসিক কোনো সাপোর্ট পাবার মতো আমার কোনো রাস্তা নেই। আমার শ্বশুর শাশুড়িকে বলে যে কোনো লাভ হবে না সেটা মালিহার সেদিনের কথায়ই বুঝতে পেরেছি। এই মুহূর্তে আমার কী করা উচিত বুঝতে পারছি না। অনেক ভেবে চিন্তা করেছি এই মুহূর্তে আমার একমাত্র হাতিয়ার , একমাত্র ভরসা আমার সন্তান, আমার প্রিয়। ওকে কাছে রাখাটা খুব বেশি জরুরী। ও কাছে থাকলে আমার আর সেলিমের সম্পর্কও স্বাভাবিক হতে পারে। প্রিয় এখন যথেষ্ঠ বড় হয়েছে । সে এখন অনেক কিছুই বুঝে। ওকে জানাতে হবে সত্যিটা । কাদেরের সাথে কথা বলে যতটা বুঝেছি তাতে আমি নিশ্চিত যে এই হেলেন নামের অশান্তি এত তাড়াতাড়ি সেলিমের পিছু ছাড়বে না।

সেলিম এখনো ফিরেনি। আগামীকাল প্রিয় চলে যাবে । মনটা ভীষণ খারাপ আমার। আমি অনেক ভেবেচিন্তে প্রিয়র রুমে গেলাম। দেখলাম প্রিয় কিছু গোছাগুছিতে ব্যস্ত।

– কী করছ , বাবা। দাও আমি গুছিয়ে দেই।

– না, আম্মু। আমিই করছি। ওখানে তো সবই করতে হয় নিজেকে। আমার অভ্যাস আছে । তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। তুমি বসো। গল্প করি আর গুছিয়ে ফেলি। আবার কবে দেখা হয় কি জানি। আমাকে আবার দাদু আর দিদার সাথে দেখা করতে বের হতে হবে। দিদা ফোন দিয়েছিল উনিই আসতে চেয়েছিল । কিন্তু হঠাৎ করে উনার প্রেসার বেড়ে গেছে নাকি। শরীরটা খারাপ লাগছে তাই আসতে নিষেধ করেছি। আমিই যাচ্ছি দেখা করতে। দাদুও এসে যাবে এর মধ্যে বাসায়। দাদুর সাথেও কথা বলেছি।

– তাই নাকি? আচ্ছা, তবে তোমার সাথে আমিও যাব ওখানে। তোমার দিদাকে দেখে আসি।

– আচ্ছা, তবে তো ভালোই হলো। উনারা তোমাকে দেখলেও খুশি হবেন।

– আমাকে দেখে আর কী খুশি হবে সেটা তো আমিই জানিরে, বাবা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম আমি। যাক ওসব বাদ দাও। তোমাকে আর ক’টা দিন কাছে রাখতে পারলে আমি তোমাকে তোমার টুম্পা মায়ের কাছে নিয়ে যেতাম। ভীষণ খুশি হতো তোমার টুম্পা মা।

– টুম্পা মায়ের সাথে দেখা করার আমারও ভীষণ ইচ্ছা ছিল। যাক নেক্সট বার ইন শা আল্লাহ। টুম্পা মায়ের সাথে রিলেশান ওকে করেছ জেনে খুব ভালো লাগছে।

– হুম। আমারও খুব ভালো লাগছে। আচ্ছা, বাবা। যে কথা বলার জন্য এখানে এসেছি। হাতের কাজটুকু রেখে একটু বসো। কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে তোমাকে। এটা তোমার কাছে বলা ঠিক হচ্ছে কি না জানি না। তবে আমার মনে হয় তু্মি যথেষ্ঠ বড় হয়েছ। কিছু কথা জানা প্রয়োজন তোমার।

– কী হয়েছে আম্মু? এভাবে বলছ কেন? কিছু কী হয়েছে ?

– বাবা, তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তোমার শখ হয়েছে তাই ক্যাডেটে পড়াচ্ছি। আমরাও বাঁধা দেইনি তোমাকে। এ বছর তু্মি সেকেন্ডারি লেভেল শেষ করবে। আমি চাই এরপর থেকে তুমি আমাদের কাছে এসে থাকো। তু্মি এভাবে দূরে থাকো আমরা চাই না। তু্মি কী আমাদের কষ্ট বুঝতে পারছ না? একমাত্র ছেলেকে দূরে রেখে এভাবে থাকাটা কত কষ্টের নিজে বাবা হলে বুঝবে।

– খানিককাল থম মেরে থেকে প্রিয় বলল, আব্বুও কী তাই চায়?

– তোমার আব্বু ব্যস্ত মানুষ। তারও খারাপ লাগে তো অবশ্যই। কিন্তু তার হয়ত কাজকর্মের ব্যস্ততার কারণে খারাপ লাগাটা ততটা অনুভব করে না। কিন্তু আমার কথা কখনো ভেবেছ? আমি কী করে একা একা কাটাই? এভাবে থাকলে পাগল হয়ে যাব আমি।

– কিন্তু আম্মু।

– কোনো কিন্তু না রে ,বাবা। তুমি বাসায় চলে আসো। আরো কিছু সমস্যা আছে। তোমার আসাটা খুব জরুরী।

– কী হয়েছে আম্মু? তোমাকে কেমন যেন লাগছে।

– বাবা, এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ এ বাড়িতে তোমার মায়ের মূল্য কতটুকু! তোমার দাদু দিদার কাছে আমি শুধুমাত্র তোমার মা ছাড়া আর কোনো পরিচয় বহন করি না । সেটা কষ্ট করে মেনে নিলেও তোমার আব্বুর কাছে একই আচরণ মেনে নিতে পারব না।

– কেনো আব্বু কী করেছে?

– তু্মি বড় হয়েছ। হয়ত বুঝবে। তাই বলছি । এসব কথা না জানাই তোমার জন্য ভালো । কিন্তু না বলে পারছি না।

– এত হেজিটেট না করে বলে ফেলো, আম্মু। কী করেছে আব্বু?

– তোমার আব্বু এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ারে জড়িয়ে পড়েছে। আর কিছু জানতে চেও না ,বাবা। আমি যে এসব খবর জানি এটা তোমার আব্বু এখনো জানে না। জানলে আমার সমস্যা আরো বেড়ে যাবে। তাই টেকনিক্যালি হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করছি আমি। আমি চাই আমার এই দুঃসময়ে তু্মিও পাশে থাকো।

– এসব কী বলছ? তুমি শিওর?

– হুম। খুব বেশি চিন্তা করো না। এমনিতেই আমি খুবই কন্সার্ন এসব নিয়ে। তবে তুমি পাশে থাকলে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলবে। তাই বলছি ফাইনাল এক্সাম দিয়ে তু্মি চলে আসো, বাবা।

প্রিয় কী বলবে বুঝতে পারছে না। এমন শকিং নিউজ কোনো ছেলের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব না।

– আস্তে করে বলল, কার সাথে কিছু কি জানো?

– না, তেমন কিছু জানি না। তবে এ ব্যাপারে আমি শিওর। বললাম তো তুমি আর কিছু জানতে চেও না। আমি চাই না তোমার আব্বুর প্রতি তোমার শ্রদ্ধাবোধের এতটুকু কোনো ঘাটতি হোক। তবে এটুকু জেনে রাখো কতটা অসহায় হলে একজন মা তার ছেলের কাছে এমন একটা ব্যাপারে কথা বলতে পারে। তোমার আব্বুর সাথে এসব ব্যাপারে একদমই কথা বলবে না। এমন কি তোমার দাদু দিদার কাছেও না।

– বুঝতে পেরেছি। তিমি চিন্তামুক্ত থাকো। দেখি কি করা যায়।

– তোমার কিছুই করতে হবে না। তুমি শুধু আমার পাশে এসে থাকবে। তুমি পাশে থাকলেই আমার সাহস কয়েক শত গুণ বেড়ে যাবে। আর কেউ তখন পাশে না থাকলেও খুব বেশি খারাপ লাগবে না।

– আগে এক্সাম তো শেষ হতে দাও। দেখি ।

– তবে একটা কথা। তোমাকে যে চলে আসতে আমিই বলেছি এ কথা কারো সাথে শেয়ার করবে না। তাহলে আবার নতুন ঝামেলায় পড়তে হবে আমাকে।

প্রিয়কে নিয়ে আমি যখন ওর দাদুর বাসায় পৌঁছালাম তখন রাত এগারোটা । যেয়েই দেখলাম সত্যিই প্রিয়র দিদার অবস্থা বেশ খারাপ। ডায়াবেটিকস, বিপি সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ডাক্তার এসে চেক আপ করে গেছেন । সুগার লেভেল খুবই বেড়ে গেছে। উনি খুব বেশি অনিয়ম করেন। একে তো খাওয়া দাওয়ার কোনো ডিসিপ্লিন নেই তার উপর মেডিসিনও ঠিকঠাক খায় না। এ বেলা খেলে ও বেলা খায় না। মনে থাকে না নাকি অবহেলা কী জানি। প্রিয়কে পেয়ে যেন অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেলেন। প্রিয় দাদির এমন অবস্থা দেখে খুব ঘাবড়ে গেল। দাদির খুব আদরের ছোটবেলা থেকে। একমাত্র নাতী বলে কথা। তার উপর বংশের বড় নাতী। প্রিয়কে পেয়ে আর কোনো কিছুরই খেয়াল নেই।

– দিদা, কী হাল করেছ নিজের? তুমি নাকি ঠিকঠাক নিজের খেয়াল রাখছ না?

– কী করব রে ভাই। বুড়ি হয়েছি । কিছুই মনে থাকে না।

– তাতে কী ! বাড়িতে আরো মানুষ তো আছে। দাদু আছে ,চাচ্চু, চাচী আছে , ফুপি আছে। তাছাড়া বাড়ি ভর্তি এত সার্ভেন্ট আছে কী করতে?

– যাদের কথা বললি এদের দেখতেই মানুষ লাগে চারজন করে এরা আবার আমার খেয়াল রাখবে কখন? আমার জন্য এদের সময় কই? আর চাকর বাকরের কী এসবের খেয়াল রাখার সময় আছে? আপন মানুষেরই সময় নেই। এরা কী করবে?

– এইটা কোনো কথা ! তাই বলে এমনভাবে অনিয়ম করতে থাকলে বিপদে পড়ে যাবে।

– কী আর করব? একটা নাতবউ এনে দিয়ে যা। আমার পাশে বসে আমার খেয়াল রাখবে সব সময়।

– সময় হলে সেটাও পাবে। আপাতত একটা কাজ করো। ফুপিকে বলো তোমার কয়েকটা কাপড় চোপড় ঝটপট হ্যান্ডব্যাগে দিয়ে দিতে।

– কেন ? আমি কোথাও যাচ্ছি?

– হুম! আমি দাদুর সাথে কথা বলে আসি আগে। তারপর তোমাকে বলছি। তুমি কাপড় প্যাক করাও। কী কী লাগবে ফুপিকে বলো। ফুপি, দিদার ব্যাগটা গুছিয়ে দাও। আমি আসছি এক মিনিট।

আমি বুঝতে পারছি না প্রিয় কী করছে। ও ওর দিদাকে কই নিয়ে যাবে?
আমি ওর দিদার পায়ের কাছে বসে পায়ের আঙ্গুল হালকা করে টেনে দিচ্ছিলাম। টুকটাক কথাবার্তা বলছিলাম উনার সাথে। এর মধ্যে প্রিয় আর ওর দাদু হাজির।

– দিদা, দাদুর থেকে অনুমতি নিয়েছি। তোমাকে ছাড়া থাকতে তার অসুবিধা তো একটু হবে তবে ম্যানেজ করবে।

– আরে ভাই আমি যাচ্ছিটা কই?

– আমার সাথে। মানে আমার সাথে কাল হোস্টেলে যাচ্ছ।

– মানে?

– মানে অতি সোজা। তুমি আমার বাড়িতে যাচ্ছ।

– এটাই তো তোর বাড়ি।

– জানি। আমার আরেকটা বাড়ি আছে সেখানে যাচ্ছ। আম্মু সারাক্ষণ বাসাতে থাকে । তার চাচী আর ফুপির মতো খুব বেশি ব্যস্ততা নেই । তোমার দেখাশোনা করতে পারবে। তোমার যে হাল শুনলাম তাতে প্রপার কেয়ার না হলে বিছানায় পড়তে হবে ক’দিন বাদে বাদেই। তোমার সুগার লেভেল যে পরিমাণ হাই তাতে তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াও কীভাবে ভেবেই অবাক হচ্ছি। তার উপর হার্টেও সমস্যা। তুমি নাকি এক্সারসাইজও করো না। উলটাপালটা খাওয়ার রুটিন। সবই দাদু নালিশ করে দিয়েছে আমাকে। তাই আমার মনে হয় তোমার এই মুহূর্তে আব্বু আম্মুর সাথে থাকা দরকার। এরা দু’জনই আবার তুমুল স্বাস্থ্য সচেতন। আমাদের বাসায় খাবার দাবার খুব হিসেব নিকেশ করে রান্না হয়। জানোই তো তোমার ছেলে কেমন? এই যে খেয়ে খেয়ে গোল আলু হয়েছ এটা আমাদের বাসায় থাকলে আব্বুর চাপে পড়ে দেখবা ক্যামনে কত দ্রুত প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ফিগারে চলে আসো।

– কী যে বলিস রে। অনেক বড় হয়ে গেছে আমার ছোট দাদা ভাই টা। আমাদের ছেড়ে অতদূরে থাকিস কী করে রে ভাই? নারে ভাই। আমার পক্ষে এখান থেকে কোথাও যাওয়া সম্ভব নাহ। আমি ব্যালেন্সডভাবে চলব কথা দিলাম।

– দিদা, আমি যেটা বলেছি করো তো! এ বাড়িতে দাদু ছাড়া এমন কিছু নেই যে সেটা ছেড়ে কিছুদিন অন্যখানে যেয়ে থাকা যাবে না।

– আরে দাদু কিছু বলোতো!

– আচ্ছা, যাও তো। প্রিয় যখন বলছে যাও। কোথাও বেড়াতে তো যাও না। এই সুযোগে না হয় ছেলের বাসাতে বেড়ালে। আর তুমি বললে অফিস শেষে আমিও যেতে পারি। ও বাসাতে কোনোদিন তো সেভাবে যাইনিও । এবার না হয় একটু চেঞ্জ করলাম সিস্টেমের। বড় ছেলে আর ছেলে বউকেও একটু সেবা করার সুযোগ দেই।

– প্লিজ, মা। চলুন না। খুব খুশি হবো। আপনারা গেলে আমার কী যে ভালো লাগবে। আমার তো মা বাবা নেই। আপনারা ক’দিন যেয়ে থাকলে আমি সেই অভাবটা কিছুদিনের জন্য হলেও ভুলতে পারব। আপনাদের ছেলেও ভীষণ খুশি হবে। তাছাড়া প্রিয় যখন চাচ্ছে ওর কথাটা রাখলে ও খুব খুশি হবে। না হলে ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকবে আপনাকে নিয়ে।

আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমার বাসাতে যাবেন, থাকবেন শুনে আমার কী যে খুশি লাগছে। প্রিয় আর ছোট নেই। আমি প্রিয়র উপর ভরসা করে ভুল করিনি। আমার ছেলে সত্যিই বড় হয়েছে।

প্রিয়র পীড়াপীড়িতে আমার শাশুড়ি আর না করতে পারলেন না। আমার জা আর ননদ তো অবাক। উনি যে যেতে রাজী হয়েছেন এটা কারো বিশ্বাসই হচ্ছে না। তবে প্রিয়কে যে উনারা না করতে পারেম না এটা ওরা জানে। আমার শাশুড়ি আগের থেকে কিছুটা সুস্থবোধ করছে । তাই এতটুকু জার্নিতে সে খুব অসুবিধা অনুভব করবেন না। তাছাড়া রাস্তাঘাটও একদম ফ্রি এখন। জ্যাম নেই কোথাও। শ্বশুর বললেন সে আগামীকাল অফিস শেষ করে যাবেন। তার কিছু কাপড় চোপড়ও নিতে বললেন।

নিচে এসে প্রিয় হঠাৎ আমার কানের কাছে চুপিচুপি বলল, খুশি হয়েছ? দিদার সাথে সম্পর্কটা কিছুটা সহজ হবে আশা করছি। আর আব্বুর ব্যাপারটা দেখছি। তুমি আব্বুর কাছাকাছি থেকো। দাদু দিদার সামনে স্বাভাবিক থেকো । দাদুকে কিছুটা আভাস দিয়েছি আব্বুর ব্যাপারে। দাদু কন্সার্ন এটা নিয়ে। তুমি জানলে খুশি হবে দাদু তোমার সাপোর্টে আছে। দাদু সবকিছু জেনে খুব কষ্ট পেয়েছে।

– কী বলছ? এইটুক সময়ের মধ্যে উনার সাথে এসব ব্যাপারেও কথা বলেছ? ছিঃ ছিঃ! উনি কী ভাবছেন আমাকে নিয়ে? আমি এসব কথা তোমাকে জানিয়েছি শুনে উনি আমার ব্যাপারে কী মনে করছেন আল্লাহ জানেন।

– কিছুই মনে করছে না। বরং খুশি হয়েছেন। দাদুর সাথে মন খুলে কথা বলতে পারো। দাদু তোমার আর দিদার সম্পর্ক সহজ করার জন্যই দিদাকে আমাদের বাসাতে পাঠাতে রাজী হয়েছেন। তুমি তোমার বেস্ট ট্রাই করো।

আমার ছেলেটা সত্যিই বড় হয়ে গেছে। ভাবতেই ভালো লাগছে। ও বাসাতেই খাওয়া দাওয়া সেরে রাত দুইটার দিকে বাসায় ফিরলাম। আমার শাশুড়ি কিছুটা ইততস্তবোধ করছে বোঝাই যাচ্ছে। আমি তার সাথে ফ্রী হওয়ার চেষ্টা করছি। আগেই ফোন দিয়ে উনার রুম ঠিক করে ফেলেছি। আমার পাশের রুমেই দোতলায় উনার থাকার ব্যবস্থা হলো। সেলিমকে কিছুই জানায়নি।

আমরা বাসায় পৌঁছাতেই আমাদের সাথে সে তার মাকে দেখে খুব অবাক। পরে প্রিয়র কাছে সব শুনে সেও ভীষণ খুশি । সন্তান যে বয়সেরই হোক সব সন্তানই মায়ের কাছাকাছি থাকতে চায়। তাছাড়া আজ কতটা বছর সেলিম তার মা বাবার থেকে দূরে থাকে। এ বাসায় তার মা বাবা কিছুদিনের জন্য থাকবে শুনে সে তো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে যেন। প্রিয়কে বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছে এমন অসাধ্য সাধন করার জন্য। এর আগে বহুবার সে তার মাকে এ বাড়িতে রাত কাটানোর জন্য বললেও সে থাকেনি। সে জানে তার মা আমাকে পছন্দ করে না। এ জন্যই সে কখনো এ বাড়িতে থাকে না। এজন্য সে সব সময় আমাকে বিয়ে করবার জন্য হীণমন্যতায় ভুগত। মাঝে মাঝে আফসোসও করত। তখন আমার নিজেকে বড় অপরাধী লাগত। যাক আজ আমার ছেলে সেই অসাধ্য সাধন করেছে। সেলিম মায়ের পাশে বসে তার শরীরের খোঁজখবর নিচ্ছে আমি রুমে গেলাম ফ্রেশ হবার জন্য।

হঠাৎ সেলিমের ফোন বেজে উঠল। আমি ফোনটা হাতে নিতেই দেখি হেলেনের নাম ভাসছে। আগে কোনোদিন ওর ফোনে হাত না দিলেও আমি আজ আর কোনো ভয়ডর না পেয়ে ফোন রিসিভ করলাম। আমি কিছু না বলে চুপচাপ থাকলাম।

– হ্যালো সেলিম! কী ভাবলে ? কী করবে? কিছু তো জানালে না। আমি জানার জন্য জেগে বসে আছি। না জানা পর্যন্ত আমি তো ঘুমাতে পারছি না। আমি কী কোনো উপায়েই তোমাদের কোম্পানীতে ব্যাক করতে পারব না? তোমার বউ তো আর জানতে পারবে না। সে তো আর অফিসে আসে না। এভাবে চোরের মত মিট করাটা কোনো সলুউশান না। প্লিজ, কিছু করো।

আমি আর কোনো কথা না বলে কলটা কেটে দিলাম। হারামজাদীর সাথে সেলিম তার মানে ঢাকায় ফিরেই আবার যোগাযোগ করা শুরু করে দিয়েছে। এটাতে অবশ্য আমি আশ্চর্য হইনি। এটা যে করবে আমি নিশ্চিত ছিলাম। মন চাচ্ছে সেলিম আর ওই হেলেন ডাইনীকে একসাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে কতক্ষণ মনের খায়েস মিটিয়ে জুতাপেটা করি।
নাহ! এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে কাজ হবে না। আগে ওই হেলেনকে সরাতে হবে। এবং সেটা সম্ভব একমাত্র যদি হেলেন নিজে থেকে সরে যায়। এছাড়া করারই বা কী আছে। সেলিমকে এরপরে দেখা যাক কী করা যায়!

অনেক ভেবে একটা উপায় বের করেছি । এজন্য টুম্পার সাহায্য লাগবে। আমি টুম্পাকে ফোন করে সব জানালাম। ও শুনে প্রথমে তো খুব হা হুতোশ করেছে । পরে আমি অনেক বুঝিয়ে শান্ত করেছি। কীভাবে কী করতে হবে ওকে বুঝিয়ে দিলাম। একটা চান্স নিয়েই দেখি । দেখা যাক কাজ হয় কি না! না হলে সেকেণ্ড প্লানে যেতে হবে। তবে কিছুতেই ওই হেলেন আর সেলিমকে বুঝতে দেয়া যাবে না যে আমি তাদের সম্পর্কের কথা জানি। আমাকে খুব বেশি স্বাভাবিক থাকতে হবে সেলিমের সাথে। না হলে ওরা সতর্ক হয়ে যাবে।

চলবে…..

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১১
আমার শাশুড়ির ভেতরের জড়তা আমি কিছুতেই কাটাতে পারছি না। উনি সবকিছুতেই কেমন যেন দূরে দূরে থাকতে চায়। আমার সাথে মন খুলে কোনো কথাই বলতে চায় না। আমি যত কাছে যেতে চাই সে আমার থেকে তত দূরে থাকতে চায়। উনি কিছুতেই আমাকে মন থেকে মানতে পারছে না। বিয়ের এতগুলি বছর পরেও শাশুড়ির এমন ব্যবহার মেনে নিতে খুব কষ্ট হয় আমার। ক’দিন বাদে আমি নিজেই শাশুড়ি হব অথচ আজ পর্যন্ত শাশুড়ির কাছে নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকু পেলাম না।
একদিকে সেলিমকে নিয়ে টেনশান অন্যদিকে সকাল বেলা প্রিয় যাবার পর থেকে মনটা ভীষণ খারাপ । সেলিম অফিসে চলে গেছে। তাই শাশুড়ির রুমে এসে বসেছি । উনার কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করছি কিন্তু উনি কেমন করে যেন দায়সারাভাবে উত্তর দিচ্ছেন।
আমি যেচে পড়ে উনার সাথে আগ বাড়িয়ে নানান ধরণের কথা বলছি। উনি শুধু হু হা করেই উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। আমি তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি যে আমি এখান থেকে চলে গেলেই উনি বেশি খুশি হবেন। বুঝতে পারছি কিন্তু তবুও ভাবলাম কিছুক্ষণ উনার পাশে না থাকলে অসৌজন্যতা দেখায়। যদিও আমি জানি উনি একা থাকতেই ভীষণ পছন্দ করেন । তারপরেও আমার কাছে উনাকে একা রাখাটা খুব খারাপ লাগছে। একজন সার্ভেন্টকে সারাক্ষণ তার সাথে থাকার জন্য বললাম। ্টুকটাক কিছু কথাবার্তা সেরে বাইরে বেরুলাম।
এদিকে আরেক টেনশান মাথার মধ্যে।
আজ সকালে সেলিম ফোনে খানিকসময় কথা বলে কথা শেষ করে ফোন আনলক অবস্থায় রেখেই ওয়াশরুমে যায়। আমি সাথে সাথেই তার ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকি। আমি কখনোই সেলিমের ফোন ঘাটাঘাটি করি না। কখনো অবিশ্বাসের চোখে দেখিনি এতদিন। কিন্তু সে সেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তাই বাধ্য হয়েই এই গোয়েন্দাগিরি করছি। লিস্টের শুরুর দিকেই পেয়ে গেলাম হেলেন তাবাসসুম নামের আইডি। মেসেঞ্জারে কী মেসেজ আদান প্রদান হয়েছে সেটা দেখার সময় নেই। সেলিম যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। আমি তড়িঘড়ি করে একটা মেসেজ পাঠালাম সেলিমের আইডি থেকে।

“ আজ ঠিক সাতটার দিকে বনানীর ক্যাফে ইটালিয়ানোতে এসো। জরুরী কথা আছে। আর সারাদিন ফোন বা মেসেজ করো না। আজ সারাদিন বাসাতেই থাকছি। আম্মি এসেছেন আমার বাসায়। তাছাড়া রূম্পা আছে। “

আমি তাড়াতাড়ি করে মেসেজ আবার এ সাইড থেকে রিমুভ করে দিলাম। সাথেসাথে হেলেনের মেসেঞ্জার আইডি ইগনোর করে রাখলাম যাতে ওর মেসেজ সহজে চোখে না পড়ে সেলিমের। হেলেনের ফোন নাম্বার ব্লক লিস্টে রাখলাম।
সেলিম আসার আগেই ফোন রেখে দিলাম। অফিসে যাবার জন্য রওয়ানা হচ্ছিল ঠিক তখন টি টেবিলের উপর ফোনটা দেখে পানি খাওয়ার ভাণ করে ইচ্ছাকৃতভাবে ওর ফোনের উপর জগের সব পানি ঢেলে দিলাম। ফোনটাকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করতে যেয়ে আরেকবার ইচ্ছা করে টেবিলের উপর দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম। এবার এত জোরে ছিটকে যেয়ে ফ্লোরের উপর পড়েছে যে ফোনের ডিসপ্লে পানিতে গোসল করার পরেও যদি ভালো থেকে থাকত এবার আর সেই উপায় নেই। একেবারে নিশ্চিত হলাম যে এই ফোনের অবস্থা চৌদ্দটা বাজা সারা। আজকের জন্য সেলিমকে ফোনের থেকে দূরে রাখতে হবে যে করে হোক। ল্যাপটপ থেকে হয়তো হেলেনের আইডি খোঁজাখুঁজি করতে যাবে না। বাকিটা আল্লাহর উপর ভরসা। কিছুটা রিস্ক তো নিতেই হবে। সেলিম বেশ মেজাজ দেখাল এমন বেখেয়ালি আচরণের জন্য। ফোনটার অবস্থা শোচনীয় খারাপ। কতক্ষণ রাগে গজগজ করে অফিসে চলে গেল। আরেকটা ফোন আছে। কিন্তু সেটাতে শুধুমাত্র অফিসিয়াল কাজ করে সে। এই ফোনটাতেই ফেইসবুক, ইমো। হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জার ইন্সটল করা। কতক্ষণ বকাঝকা হজম করেছি মুখ বন্ধ করে। বার কয়েক সরি বলে তবে মাথা ঠান্ডা করেছি।

খুব চিন্তা হচ্ছে ওই সিম দিয়ে আবার কথা না বলে হেলেনের সাথে। তবে ওই ফোনটা অফিসিয়াল কিছু মেইল চেক করা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগায় না। কিছু দিন আগেই ফোনটা কিনেছে। হাতে গোণা কয়েকটা নাম্বার সেভ করা ওই নাম্বারে। যাক , আল্লাহর উপর ভরসা। কাদের আপাতত সেলিমের পিএসের দায়িত্ব পালন করছে। কাদেরকে বললাম একটু খেয়াল রাখতে। যদিও কাদেরের কিছুই করার নেই।

সন্ধ্যার অপেক্ষা করছি। টুম্পাকে সবকিছু বলে রেখেছি।

ক্যাফে ইটালিয়ানোতে আগে থেকেই বসে আছে টুম্পা। আজ বেশ চড়া মেকআপ নিয়েছে সে । চোখের নিচের কালি ভাব আর বয়সের ছাপ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শিফনের হালকা গোলাপি শাড়ি আর স্লিভলেস ব্লাউজে দারুণ আবেদনময়ী লাগছে তাকে। সে এককাপ কফির অর্ডার দিয়ে বসে আছে। এমন একটা প্লেসে বসেছে যেখান থেকে তাকালেই কে আসছে কে যাচ্ছে সহজেই বোঝা যায়। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। ঠিক সাতটা পনেরোর দিকে হেলেন ভেতরে প্রবেশ করে। টুম্পাকে হেলেনের ছবি দেখানো হয়েছে আগেই। সে দেখেই চিনতে পেরেছে । তার উপর ভিডিও কলে আমিও আছি। ওকে বলেছি পুরোটা সময় ভিডিও অন করে রাখতে। আমি যাতে কী হচ্ছে তা ক্লিয়ার না দেখলেও সব শুনতে পারি। হেলেনের চেহারা ক্লিয়ার বোঝা না গেলেও অবয়ব দেখে আমি শিওর হলাম ওই হেলেন। একদম টুম্পার সামনের টেবিলেই বসেছে হেলেন। বারবার ঘড়ি দেখছে সে। টুম্পাও কারো জন্য অপেক্ষা করছে এমন ভাব করে কফি খাচ্ছে আর অধৈর্যভাবে ঘড়ি দেখছে। টুম্পা অপেক্ষা করছে কখন হেলেনের সাথে ওর চোখে চোখ পড়ে। মিনিট কয়েক পরেই হেলেনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয়। টুম্পা চোখেমুখে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে হেলেনের দিকে এগিয়ে যায়।

– তুমি হেলেন না? অবশ্য মিস্টেকও হতে পারে।

– আপনি?

– আমাকে চিনলে না? আমি তোমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় আপু, যুথী। তুমি ফারিহার ফ্রেন্ড না?

– আপনি ফারিহাকে চিনেন?

– ও মা চিনব না? ওতো আমার খুব ক্লোজ ছিল। তোমার সাথেও আমার পরিচয় হয়েছিল । কিন্তু তুমি হয়ত ভুলে গেছ।

– ওহ! সরি , আপু। হ্যা ফারিহা আমার খুব ক্লোজ ফ্রেণ্ড। বসুন না , প্লিজ!

– থ্যাংক ইউ! কারো জন্য অপেক্ষা করছ মনে হচ্ছে?

– জি না মানে!

– হুম , বুঝতে পেরেছি। বয় ফ্রেণ্ড?

– হুম। আমিও আমার ফিয়ান্সের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ জানিয়ে দিলো কী একটা কাজে ফেসে গেছে । তাই আর আসতে পারছে না আজ।

– ওহ, সো স্যাড!

– তোমার বয়ফ্রেন্ড আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। তোমার সাথে গল্প করি আর কফিটা শেষ করি।

– জি, অবশ্যই। ও অবশ্য এখনি এসে যাবার কথা । কখনো তো দেরী করে না। আমিই আজ দেরী করে ফেললাম।

– ফোন দাও।

– দিয়েছি। বাট কল যাচ্ছে না । কী হয়েছে বুঝতে পারছি না।

– আবার ট্রাই করো। অনেক সময় নেটওয়ার্ক প্রবলেমের কারণে কল যায় না।

টুম্পা এবার ইচ্ছে করেই ওর সামনের সিটটা থেকে সরে যেয়ে পাশের সিটটাতে বসল।

– সামনে একটা ছেলে কেমন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে । তাই এপাশটায় এসে বসলাম। সরি। তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো!

– না ,না! ঠিক আছে, বসুন।

হেলেন ফোন বের করে সেলিমের নাম্বারে কল দিচ্ছে আবারো।

– এটা তো সেলিমের নাম্বার। তুমি পেলে কই? সেলিম তোমার বয়ফ্রেন্ড? ওহ মাই গড! তুমি তো শেষ!

– না , মানে। এসব বলছেন কেনো? আপনি এই নাম্বার চিনেন? আমি তো আমার বসকে কল দিচ্ছিলাম অফিসে যেতে দেরী হবে সেটা জানাতে।

– হেলেন, এই নাম্বার আমার স্মৃতিতে গাঁথা । মৃত্যুর আগদিন পর্যন্ত ভুলব না। তুমি বস নামে সেভ করেছ কারণ সে তোমার বস। তুমি আমাকে বোকা বানাতে পারো না। কারণ এমন সময় আমিও পার করে এসেছি। সে একসময় আমারো বস ছিল। ওহ মাই গড! ঘুরে ফিরে আবার সেই সেলিম!

– আপনি এভাবে বলছেন কেনো ? উনাকে কী করে চিনেন আপনি?

– উনি আমার বস ছিলেন। ছয় মাস ছিলাম উনার অফিসে। আল্লাহর রহমত যে জান নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।

– মানে?

– উনি যে ম্যারিড সেটা তো তুমি জানো , তাই না।

– জি।

– উনার স্বভাবই এমন । সুন্দরী মেয়েদেরকে পিএস হিসেবে রেখে এবিউজ করে। প্রেমের ফাঁদে ফেলে যা খুশি করা ওর অভ্যাস। আমিও সেই ফাঁদে পড়েছিলাম। থ্যাংকস গড যে আমি জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছিলাম।

– মানে? কী হয়েছিল?

– ওর বউ চরম ক্ষ্যাপা আর পাগলাটে। পারে না এমন কিছু নেই। সেলিম আবার ওর বউকে প্রচণ্ড ভয় পায়। তাছাড়া না পেয়েও উপায় নেই। সেলিমের বাবা ওর ভাগের সব সম্পত্তি সেলিমের বাজে স্বভাবের জন্য বউয়ের নামে করে রেখেছে। আমিও এ কথা পরে জেনেছি। সেলিম কাউকে জানায় না এ কথা। আমি অনেক পরে জেনেছিলাম। সেলিমের বউ যদি কোনোভাবে জেনে যায় যে সেলিমের কারো সাথে এফেয়ার চলছে তবে তো আর রক্ষা নেই। তাই সেলিমই নিজে বাঁচতে সত্যি যাতে ফাঁস হয় তাই মেয়েটিকে মেরে ফেলে যাতে তার বউয়ের কানে আর কিছু পৌঁছাতে না পারে। প্রেমিকার চাইতে তো আর সম্পত্তি বড় না , তাই না? ওদের কাছে আমাদের মতো মেয়েদের জীবন তেলাপোকার জীবনের চাইতেও নিকৃষ্ট আর মূল্যহীন । আমার আগে স্নিগ্ধা নামের এক মেয়েকে কার এক্সিডেন্টের নাম দিয়ে মেরে ফেলেছে। এ কথা তো তখন মিডিয়াতেও এসেছিল । তুমি হয়ত জানো না। আমি ছিলাম তার নেক্সট শিকার। আমি সবকিছু জানার পর প্রাণ নিয়ে সরে এসেছি। ছোটোখাটো একটা বুটিকস শপ দিয়েছি। খেয়ে পড়ে ভালোই আছি। সামনের মাসে আমার বিয়ে। আমি স্নিগ্ধার বড় বোনের সাথে নিজে যেয়ে কথা বলেছি। স্নিগ্ধার বড়বোন অনেক চেষ্টা করেছিল সেলিমকে শাস্তি দেবার কিন্তু টাকার কাছে উনাদের হাহাকারের কী দাম?

– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি এসব গল্প আমাকে কেন শোনাচ্ছেন?

– কারণ তুমি জালে ফেঁসে যাচ্ছ তাই। আমি আরেকজন স্নিগ্ধাকে মরতে দিতে চাই না। বড়লোকের ফাঁদে পড়ে এভাবে আর কত অসহায় মেয়ে জান দিবে?

– আমি বিশ্বাস করি না। আপনি অন্য সেলিমের কথা বলছেন।

– আমি পাগল নই ,হেলেন। আচ্ছা, তোমার লাইফ তোমার লায়াবিলিটিস। আমি যা জানি তাই বললাম। দেখ, তোমার সেলিম আসে কি না! বললে তো সে খুব সময় সচেতন । আধঘণ্টা পেরিয়ে গেছে অথচ এখনো খোঁজ নেই। আবার ফোনটাও সুইচ অফ।

– জ্যামে পড়েছে হয়ত। আর ফোনেও হয়ত চার্জ নেই। এমন আগেও হয়েছে।

– ওকে!

টুম্পা উঠে যাবে ঠিক সেই সময় আতঙ্কিত হবার ভাণ করে বাইরের দিকে দুটো লোককে ইঙ্গিত করে বলল, ওই লোক দু’জন আশা করছি তোমার পরিচিত না?
হেলেন খানিকক্ষণ দেখে বলল, না তো! উনারা কারা? আমার দিকে কী ইশারা করছে আর ফাসুরফুসুর করছে?

– তা তো জানি না। অনেক সময় ধরে খেয়াল করছি ওরা আমাদের টেবিল দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলছে । আবার কাকে যেন ফোন করছে।

– আমার মনে হয় তুমি ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছ। আচ্ছা, তোমার কথা কী ওর বউ জানে?

– জানি না। তবে কিছুটা জানতে পারে।

– হুম, হয়েছে। মরেছ এবার। সেলিম তোমাকে এখানে ডেকেছে লোক দিয়ে ধরে অন্ধকার কোথাও নিয়ে গলা কেটে মাটিচাপা দেবার জন্য। এখনো সময় আছে।

– এসব কী বলছেন ? হেলেনের চোখেমুখে কিছুটা শঙ্কার ছাপ।

– ঠিকই বলছি। আজ বেঁচে ফিরবে কি না কে জানে?

– কীসব বলেই যাচ্ছেন? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।

– অন্যায় করোনি আবার? তুমি এখনো বুঝতে পারছ না। তোমার মত হাজারটা হেলেন সেলিমের জীবনে আসে যায়। তুমি না থাকলে তার কিছু এসে যায় না তার। কিন্তু তোমার ওপারের টিকেট যে কেটে ফেলেছে নিশ্চিত থাকো। আজ না পারলে কাল। কিন্তু মিশন সাক্সেস করেই ছাড়বে সে। আমি আগেভাগেই টের পেয়ে এজন্য কেটে পড়েছি। দু’বছর তো ঢাকাতেই থাকিনি। আজ এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারলে ফোন বন্ধ করে ঢাকার বাইরে চলে যাও। বেঁচে থাকলে এমন কত সেলিম পাবে। এই যে দেখ আমার বিয়ে হচ্ছে সেলিমের চেয়েও ভালো অবস্থাসম্পন্ন একজনের সাথে।

– কিন্তু এসব আপনি আমাকে বলছেন কেনো?

– মেয়েটা দেখছি পাগল । আমি তোমাকে চিনি তাই বলছি। তোমাকে খারাপ বুদ্ধি নিশ্চয়ই দিব না। যেভাবে পারো পালাও। এখান থেকে বের হয়ে ওদের সামনে পড়লেই জীবন শেষ এটা আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিলাম।
আমি চলি ভাই। আমার এসব ঝামেলায় যাবার ইচ্ছা নেই। তোমাকে সাবধান করলাম। বিশ্বাস অবিশ্বাস তোমার ব্যাপার।
হেলেনের চোখমুখ দেখে মনে হলো সে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। টুম্পার ডোজে কাজ হয়েছে তবে।

টুম্পা উঠতে যাবে ঠিক তখনই তিনটা মোটাতাজা লোক এসে মোবাইলে হেলেনের ছবি দেখিয়ে বলল, এই মেয়েটাকে দেখেছেন? ওর এখানে থাকার কথা। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের একটা মিটিং হবার কথা ছিল। জরুরী দরকার।

হেলেন পাশেই বসা ছিল। সে ব্যাগ দিয়ে ফেস আড়াল করল। লোক তিনটা একটু সামনের দিকে আগাতেই টুম্পা হেলেনকে একটান দিয়ে তার শরীরের আড়াল দিয়ে ঢেকে নিয়ে বাইরে বেরুল। দরজার কাছে এসে আর পেছনের দিকে না তাকিয়ে টুম্পা তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেল।

সামনেই আমার গাড়ি অপেক্ষা করছিল টুম্পাদের জন্য। গাড়িতে উঠে মিররে তাকিয়ে টুম্পা ড্রাইভারকে বলল, দ্রুত চালাতে। হেলেনও তাকিয়ে দেখল কয়েকজন লোক তাদের অনুসরণ করে এদিকে ছুটে আসছে। হেলেনের ততক্ষণে কলিজা শুকিয়ে অর্ধেক।

– অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আপু।

– আরে কীসের ধন্যবাদ? আমি কি তোমার পর?
তোমার বিপদ এখনো কাটেনি। ওরা তোমার বাসায় পৌঁছে যাবে শিওর থাকো। বাসা কোথায়? পরিবারের সাথে থাকো নাকি একা?

– আমার পরিবার রংপুরে। আমি এখানে একা থাকি।

– এক কাজ করো। এখনি রংপুর চলে যাবার ব্যবস্থা করো। পারলে সিমটা ফেলে দাও। যাতে সেলিম তোমাকে আর কল দিতে না পারে।
হেলেন তাড়াতাড়ি সিমটা বের করে ভেঙ্গে দু’টুকরো করে বাইরে ছুড়ে ফেলল।

– কিন্তু আপু, আমার কাছে যে এই মুহূর্তে কোনো হার্ড ক্যাশ নেই।

– সমস্যা নেই । আমার কাছে আছে। তোমাকে পাঁচ হাজার দিয়ে দিচ্ছি। তুমি সুযোগ হলে আমাকে দিয়ে দিও। আমি তোমাকে স্টেশানে নামিয়ে দিয়ে আসব। ভয় নেই। আপাতত বেশ কিছুদিন ঢাকাতেই এসো না। আর একদম ঘাবড়াবে না। তোমার ভাগ্য ভালো । হায়াত আছে। নইলে আমিই বা ওখানে কেন আসব আর তোমার সাথেই বা কেন পরিচয় হবে বলো!

– আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দিবো আপু। সারাজীবন মনে থাকবে আপনার এই সাহায্যের কথা। ঋণী করে ফেললেন।

– ধুর বোকা! তবে একটা কথা মনে রাখবে। এমন বড় লোকের ট্রাপে আর পড়ো না। এরা শুধু ভোগ করতেই জানে। এদের কাছে আমাদের মত মেয়েদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। স্নিগ্ধার করুণ পরিণতির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে শুধু আজ। আর একটু দেরি হলেই তোমার একই হাল হতো আজ। আল্লাহ মেহেরবান।

– আপনাকে সারাজীবন মনে রাখব আপু। আমি কি আপনার একটা কার্ড পেতে পারি?

– আমার কাছে কার্ড নেই । এই পার্সে কার্ড নেই মে বি। সমস্যা নেই । তুমি আমার নাম্বার রাখো।

– আপনার টাকাটা আমি সুযোগ হলেই পাঠিয়ে দিবো আপু।

– আরে বোকা! বড় আপুর পক্ষ থেকে গিফট হিসেবে রেখে দিও। আর হ্যা, নিজের পায়ে দাঁড়াও । শিক্ষিতা মেয়ে তুমি। এভাবে শর্টকাটে বড়লোক হতে যেয়ে জীবনটাকে ঝুঁকির মুখে ফেলো না। সব সেলিমরাই একই রকম। বেকায়দায় পড়লে ভালোবাসা উবে যায় কর্পুরের মতো। আমি সময়মত বুঝেছিলাম বলেই আজ নিজের একটা পরিচয় বানাতে পেরেছি। কোনোদিন সুযোগ হলে আমার বুটিক শপে এসো। মিরপুর স্টেডিয়ামের বিপরীতে আমার শপ।

– অবশ্যই আপু। ভালো থাকবেন।

হেলেনকে নামিয়ে দিয়ে টুম্পা আমাকে কল দিলো।

– আপা, সবই তো শুনলি। হেলেনকে তুমুল সাইজ দিয়েছি। যে ভয় পেয়েছে। মনে হয় না আর দুলাভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করবে।

– আমারও তাই মনে হলো ওর কথার টোন শুনে। তোকে কী বলে যে ধন্যবাদ দিব? এত চমৎকার আর নিখুঁত এক্টিং করলি!

– আরে বাদ দে। ধন্যবাদ কাদের ভাইকে দে। তার পাঠানো চ্যালাপ্যালাগুলি একদম পার্ফেক্ট মাস্তানের এক্টিং করেছে। বেচারি যা ভয় পেয়েছে।

– বেচারি? ওকে তোর বেচারি মনে হয়? বল,ডাইনী!

– আপা, ওরা আসলেই বেচারি। গ্রাম থেকে এসে একা একা থাকে। বর্তমান চাকরী বাকরীর যে বেহাল দশা। ওরা তো টিকে থাকার জন্য , বড়লোক হবার জন্য সিঁড়ি খোঁজে । সেই সুযোগটাকে কাজে লাগায় দুলাভাইয়ের মত পয়সাওয়ালারা। ওদের এক তরফা দোষ দিয়ে কী লাভ?

– এক তরফা দোষ দিচ্ছি কই? আমি জানি এখানে তোর দুলাভাইয়েরই দোষ বেশি। কিন্তু কী করব বল! সংসার টেকাতে হলে ওর সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকাতো আমার ক্ষমতার বাইরে।

– এক হেলেনকে তাড়িয়েছিস। দেখবি আরেক হেলেন এসে নাক গজিয়েছে। তাই এই হেলেনদের পেছনে না ঘুরে নিজেদের সম্পর্ক ঠিক কর। আমার এই কষ্ট নেই রে। জামাল খুব লয়্যাল। এসব দিক দিয়ে অনেক ভালো আছে , আলহামদুলিল্লাহ! দোয়া করিস!

– আলহামদুলিল্লাহ! এভাবেই যেন থাকে। এই কষ্ট সহ্য করার মতো না রে বোন!

– জানি আপা। তুই দুলাভাইয়ের মাঝে সেই আগের মত তোর জন্য মায়া জাগিয়ে তোল। আগে দেখি কত্ত কাহিনী করত তোকে দেখার জন্য। কীসব কাহিনী করে ফ্যামিলির সবাইকে রাজী করিয়ে তোকে বিয়ে করল। আর এখন সব গায়েব ! আজব মানুষ!

– দেখি কী করা যায়। তুই যা করেছিস ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না।

– আরে গাধা। এসব কী বলিস। তোর জন্য করব না তো পর মানুষের জন্য করব। এখন রাখছি। বাসায় ওরা কী করছে আল্লাহ জানে। অনেক রাত হলো। আমি বাসায় পৌঁছেই তোর গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি। ভালো থাকিস। আর বাসায় আসিস। ওহ , শাশুড়ি আম্মার আর তার ছেলের খুব খাতিরদারি করিস কিন্তু। আল্লাহ হাফেজ।

– আল্লাহ হাফেজ।

চলবে….