#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১২
কিছুদিন ধরে নিয়মিত সেলিমের ফোন চেক করা আমার রূটিনে পরিণত হয়েছে। প্রথম কয়েকদিন ডায়াল কলে বেশ কয়েকবার ধরে হেলেনের নাম্বার দেখতাম। কিন্তু এখন আর তেমন দেখছি না। কাদেরের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম সেলিম নাকি কাদেরকেই দায়িত্ব দিয়েছে হেলেনের খোঁজখবর নেবার জন্য। কাদেরকে শিখিয়ে দিলাম কী বলতে হবে সেলিমের কাছে।
কাদের দু”দিন বাদে রিপোর্ট করার কথা। সে সেলিমের কাছে আমার শেখানো বুলিই বলল। কাদের সেলিমকে জানিয়েছে হেলেন অন্য একটা কোম্পানীতে জব পেয়েছে। সে সেলিমের সাথে কোনো রিলেশান রাখতে চায় না আর। ওই কোম্পানীর মালিকের সাথে হেলেনের বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে এই সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। তাই সে আর পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না। আর সেলিম যদি কোনো ঝামেলা করে বা ফোন দেয় তবে সে পুলিশ কেইস করবে।
কাদেরের কাছে এসব কথা শুনে সেলিম কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছে। কাদের তাকে বোঝায় , এসব মেয়েমানুষ এমনই। সকাল বিকাল হাত বদল করা এদের অভ্যাস। যখন যেখানে সুবিধা পায় সেখানে যেয়ে ঘাঁটি দেয়। এসব খারাপ মেয়েদের জন্য কেনো নিজের মান সম্মান নষ্ট করবেন। কাদেরের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ভেতরে ভেতরে যে সে খুব আপসেট সেটা আমি টের পাচ্ছি। ঠিকমতো খাবার দাবার খাচ্ছে না। আমার সাথে একদম দরকার না হলে কোনো কথা হয় না। আগের চেয়েও আরো বেশি চুপসে গিয়েছে সেলিম।
আমার শাশুড়ি সাতদিন থেকে নিজের বাসায় গেছে। আমার সাথে সম্পর্কের খুব বেশি উন্নতি না হলেও আমাদের মাঝের বেশ কিছুটা জড়তা কেটেছে এ ক’দিনে। তাছাড়া আমি উনার দেখাশোনায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। প্রতিবেলা সময়মতো খাবার দেওয়া, খাবারের আগে পরে ওষুধ দেওয়া সব মনে করে আমি নিজ হাতে করেছি। বাসাতে চলে যাওয়ার পরেও প্রতিবেলা উনাকে রুটিন করে ফোন দেওয়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। উনি এতে বিরক্ত হলে হবে। আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি।
সেলিম আগের থেকেও আমার প্রতি আরো বেশি বিরক্ত। কোনোকিছু জিজ্ঞেস করলে খুব বিরক্তির সাথে উত্তর দেয়। আমি বুঝি আমার প্রতি তার এমন ব্যবহারের কারণ। আমার কারণেই হেলেনকে বাধ্য হয়ে সে অফিস থেকে বের করে দিয়েছে। এটা সেলিম হয়ত মেনে নিতে পারছে না কোনোভাবে। আবার বলতেও পারছে না কিছু আমাকে।
সেলিমের আচরণে আমি ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমি যত সেলিমের কাছাকাছি যেতে চাই সে যেন ততটাই ঠিক আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সেলিমের সেলিমের ব্যাপারটা মাথা থেকে অনেক কষ্টে ঝেড়ে ফেলে আমি সেলিমকে কাছে টানতে চাইছি কিন্তু সে ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটছে। হয়তো হেলেনকে তার জীবন থেকে হারানোর কষ্টটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। মুখে বলতে না পারলেও আমি বুঝতে পারছি যে এর জন্য সে সম্পূর্ন দায়ী আমাকেই ভাবছে। তাই আমাকে দেখলেই যেন তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এমন ভাব। আমি কিছু বললেই ফোঁস করে ওঠে। মাঝে মাঝে মন চায় মুখের উপরে বলি। ওই নষ্ট মেয়ে মানুষের জন্য ও আমাকে এভাবে দিনের পর দিন অপমান করছে আমি এটা মেনে নিতে পারছি না কিছুতেই। কিন্তু আমি যে সবকিছু জানি সেলিমের কাছে আমি এটা প্রকাশ করতেও চাচ্ছি না। না পারছি কিছু বলতে না পারছে সহ্য করতে।
যখন খুব বেশি মন খারাপ থাকে আমি তখন শপিং করতে চলে যাই। আজকাল বন্ধুবান্ধবের সাথে খুব বেশি আড্ডা হয় না আমার। ব্যাংককে যেয়ে নীরার কাহিনী জানার পর থেকে কেন যেন ওসবে রুচি উঠে গেছে। মমতাজ আপাও এনজিওর কাজে কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে গেছেন। তাই এই মুহূর্তে সেলিমের থেকে পাওয়া কষ্টটাকে কিছুটা হলেও ভোলার জন্য শপিং করাটাই আমার জন্য বেস্ট সলিউশন। তাছাড়া নিজের জন্য কিছু কেনাকাটাও করা প্রয়োজন ছিল।
ড্রাইভারের পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে আসতে কেন এত দেরি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। দুই হাত ভর্তি শপিং করেছি। গুলশান পিংক সিটির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি গাড়ির। এত এত শপিং করলাম কিন্তু মনটা কিছুতেই অন্য কিছুতে ডাইভার্ট হচ্ছে না ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় ফিরেই আবার সেলিমের মুখোমুখি হব। ওর বিরক্তি ভরা মুখটা দেখব আবার সব কষ্টগুলি তাজা হয়ে উঠবে।
আজ আকাশটা খুব মেঘাচ্ছন্ন। কালো মেঘে ছেয়ে আছে। যেকোন সময় বৃষ্টি নামবে।
আজ মনে হয় আকাশটারও খুব মন খারাপ। আকাশ তো খানিকক্ষণ বৃষ্টি ঝরিয়ে তার মনটাকে হালকা করে নিতে পারবে। কিন্তু আমার মনের আকাশে যে মেঘ জমা আছে তার কী হবে? কত নোনা বৃষ্টি ঝড়ছে দিনেরাতে কিন্তু একফোঁটা কালোমেঘও কেটেছে কিনা সন্দেহ। ঝাপসা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছি এমন সময় কেউ আমার নাম ধরে ডাকায় আমার ঘোর কাটল।
– রুম্পা, আপনি এখানে? হোয়াট আ প্লেজ্যান্ট সারপ্রাইজ!
আমি আমার সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কী করে সম্ভব? ঝাপসা চোখে সানগ্লাসের আড়ালে মনে হলো সবকিছু যেন স্বপ্নের মত। একহাতে সানগ্লাসটা খুলে আরেক হাতে চোখটা কচলে নিলাম। সত্যি দেখছি তো?
– রূম্পা! কথা বলছেন না যে? নাকি সেই ক্ষণিকের দেখা হওয়া মানুষটিকে স্মৃতি থেকে মুছে দিয়েছেন?
– আ… আপনি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না! আপনি বাংলাদেশে?
– এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলবেন? চলুন উপরে যাই। ফুড কোর্টে বসে কথা বলি।
– আমার ড্রাইভার আসছে গাড়ি নিয়ে। ও এসে আমাকে খুঁজবে !
– আসতে নিষেধ করে দিন না। নাকি যেতে চাচ্ছেন না?
– না , না, তা কেন হবে? আচ্ছা অপেক্ষা করুন। এক মিনিট।
আমি যেন ঘোরের মধ্যে আছি। ও যা বলছে আমি শুধু রোবটের মত ডিরেকশান ফলো করছি।
আমি ড্রাইভারকে আবার ব্যাক করে গাড়ি পার্ক করতে বললাম। কেনো জানি না আমি সিদ্ধার্থকে না করতে পারলাম না। একবার ভেবেছিলাম এখান থেকে জাস্ট হাই হ্যালো করেই চলে যাব।
দু’জন দু’কাপ কফি নিয়ে বসে আছি বেশ কিছুক্ষণ। কারো মুখে কথা নেই। আমার বুকের ভেতর যেন কেউ হাতুড়ীপেটা করছে। বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ শব্দ শুনতে পাচ্ছি নিজের কানেই । কখনো কল্পনায়ও ভাবিনি সিদ্ধার্থের সাথে আবার দেখা হবে।
– বাংলাদেশে এলেন কবে?
– এই তো সপ্তাহ ঘুরে যাচ্ছে । পুরো একমাস থাকছি আপনাদের এই যাদুর শহরে।
– বাহ! নীরার অভ্যার্থনায় থাকছেন নিশ্চয়ই?
– উহু! নীরা ছাড়া কী আমার আর কেউ নেই এ দেশে। দেশটা কিন্তু আমারও জানেন তো! আমার নাড়ির টান রয়েছে এ দেশের সাথে। নীরার টানে নয় , নাড়ির টানে এসেছি। আপনার ফ্রেন্ড এখনো জানে না আমি ঢাকাতে এসেছি। আর জানাতেও চাই না।
– কী ব্যাপার ! নীরাকে এভয়েড করে চলছেন মনে হচ্ছে।
– হুম, কেউ একজন যাকে আমি খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে আপন ভেবেছিলাম তার কথা ফেলি কী করে বলুন? চেষ্টা করছি সব ব্যাড হ্যাবিট ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার।
আমি বুঝতে পারছি সিদ্ধার্থ কার কথা বলতে চাচ্ছে। আমিই বলেছিলাম নীরার থেকে দূরে থাকতে। বিয়ে করে সংসারী হতে। সিদ্ধার্থ আমাকে আপন ভেবেছে একথা শুনে আমি লজ্জায় কথা বলতে পারছি না। মাথা নিচু করে কফির মগটা শুধু নাড়াচাড়া করছি।
আমি কোনো কথা বলছি না দেখে সিদ্ধার্থই বলে উঠল, কফি যদি ঠাণ্ডা পানি পানি করে খাবেন তবে কোল্ড কফির অর্ডার দিতাম। নাকি অর্ডার দিব?
– না, না! ঠিক আছে। ্কথা বলতে বলতে খেয়ালই নেই।
– কথা বলছেন কোথায়? সবই তো আমি বলছি। আপনি তো মনে হচ্ছে ফোনের মত মন থেকেও আমাকে ব্লক করে রেখেছেন?
এবার আমার ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। সত্যিই তো আমি তাকে ব্লক করে রেখেছিলাম সব জায়গা থেকে। সামনা সামনি আবার দেখা হবে ভাবিনি। কী বিশ্রী একটা ব্যাপার হলো।
– না। মানে! হয়েছে কী আমি চাইনি আমরা আর এমন সব ব্যাপারে কথা বলি যেগুলি আমাদের চলার পথকে অমসৃণ করে দিবে ।
– বুঝতে পেরেছি। আমাকে আপনার কোনো এক্সপ্লানেশানস দিতে হবে না, প্লিজ। কথা প্রসঙ্গে চলে এল তাই বলে ফেললাম। আমি আপনার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম আমাকে ব্লক করার কারণে। কষ্ট পেয়েছিলাম খুব। পরে বুঝতে পেরেছি। আপনার সাংসারিক জীবনে আমিও কোনো ঝামেলা আনতে চাই না।
– না, না! ঝামেলার কী আছে। আসলে আমি খুব ইমোশনাল। তাই ইমোশানকে আড়াল করার জন্যই এটা করেছি। যদিও ব্যাপারটা কিছুটা বাচ্চাদের মতো শোনাচ্ছে। কিন্তু আশা করছি বুঝতে পারছেন।
– আরে কী শুরু করলেন? আমি তো বলেছিই আমি কিছুই মনে করিনি। ‘
– এখানে এতদিন ধরে থাকবেন, কি ব্যাপার বলুন তো! কোনো নতুন বিজনেস শুরু করছেন নাকি?
– নাহ! বিজনেস চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাগল হতে চাই না। এক জায়গা আছে সেইই ভালো। নিরিবিলি থাকতে চাই। খুব বেশি টাকা পয়সার দরকার নেই আমার।
– ভালো বলেছেন। এখানে উঠেছেন কোথায়?
– শান্তিনগরে, আমার মাসীর বাড়িতে। আচ্ছা, একটা কথা!
– জি, বলুন।
– যে ক’দিন বাংলাদেশে আছি আপনাকে যদি আমি ফোন দেই মাঝেমাঝে সেটা করা কী খুব বেশি অন্যায় হয়ে যাবে ?
– আমি কিছু সময় নিরব থেকে মাথা নাড়িয়ে বললাম, না!
– তাহলে যে ব্লক খুলে দিতে হয়!
– দিয়ে দিব। বাসাতে যেয়ে নিই।
– বাসায় যেয়ে যদি হারিয়ে যান? আপনাকে কী বিশ্বাস?
– হা হা! হারাব না। বিশ্বাস রাখুন।
– আপনাকে আর বিশ্বাস? বাংলাদেশে এসে খুব মিস করছিলাম আপনাকে। মনে মনে শুধু ভেবেছি কখনো এমন হতো হুট করে আপনার সাথে দেখা হয়ে যেত! দেখুন না , ঈশ্বর আমার কথা শুনেছেন। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমার সামনে বসে আছেন!
– আপনার ঈশ্বর আপনার উপর খুবই সদয় মনে হচ্ছে। তবে ব্লক খোলার ব্যাপারে এটুকু বিশ্বাস করতেই হবে আপনাকে। আচ্ছা, রাতে কথা হবে । আজ তবে উঠি। অনেক সময় পেরিয়ে গেল। বাংলাদেশে যখন এসেছেন তখন নিশ্চয়ই দেখা হবে আবার।
আমি তাড়াতাড়ি সিদ্ধার্থের কাছ থেকে বাঁচতে চেয়েছিলাম।
– অবশ্যই। খুব ভালো লাগছে আপনার সাথে দেখা হয়ে।
– আমারও। আচ্ছা, চলুন যাওয়া যাক। আপনার সাথে গাড়ি আছে?
– না, না। উবার ডেকে চলে যাব।
– দরকার হবে না । কোথায় যাবেন চলুন আমি নামিয়ে দিয়ে আসব।
– আপনি কেন ঝামেলা করতে যাবেন?
– বন্ধুর জন্য এটুকু করতেই পারি। আপনি আমাদের মেহমান।
– আপনার যদি দেরি হয়ে যায়?
– আমার বাসায় কোনো তাড়া নেই, চলুন তো!
– বন্ধুই যখন বললেন তাহলে আর প্রবলেম কী? চলুন!
মনটা কেন যেন খুব ফুরফুরা লাগছে আজ আমার। বাসায় এসেই আবার সিদ্ধার্থের সাথে কথা হলো।
সেলিমের সাথে তেমন আর কোনো কথা হয় না। আপাতত সেলিমের দরকার নেই। সিদ্ধার্থকে নিয়ে খুব ব্যস্ত আমি। রাতে সেলিম ফিরে আসলে তেমন কোনো কথাবার্তা আর হলো না আজ। আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সারাক্ষণই গুণগুণ করে গান গাচ্ছি আর নিজের চুল ঠিক করছি। সেলিম সোফার উপর বসে অফিসের কী যেন কাজ করছে। আমি সেলিমকে দেখেও না দেখার ভাণ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিদ্ধার্থের সাথে চ্যাট করেই যাচ্ছি।
গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে কখন যে বেশ উচ্চস্বরে গাইতে শুরু করেছি নিজেও টের পেলাম না।
“তুমি আমার এমনই একজন ,
যারে একজীবনে ভালোবেসে ভরবে না এ মন!
ভালোবাসার সাগর তুমি
ভালোবাসার সাগর তুমি
বুকে অথৈ জল
তবু পিপাসাতে আখি
হয়রে ছলছল, হয়রে ছলছল!
একসময় আমার গাওয়া এই গানটা সেলিম খুব পছন্দ করত। কতবার যে ওকে গেয়ে শুনিয়েছি হিসেব নেই। আজ অনেকদিন পর আবার সেই সুর তুললাম আমার বেসুরো কণ্ঠে!
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি বেশ জোরেসোরেই গান গাইছি। মনের অজান্তে শুরু করলেও এবার ইচ্ছা করেই বেশ ভাব নিয়ে গাইছি আর সিদ্ধার্থের সাথে চ্যাট করেই যাচ্ছি। রাত তখন দেড়টা বাজে। আমি আড় চোখে খেয়াল করলাম সেলিম আমার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। আমি গান শেষ করে খানিকক্ষণ চুপচাপ। তার রিয়্যাকশান দেখার অপেক্ষায় আছি। সেলিম হাতের কাজ শেষ করে বিছানায় এসে বলল, এতদিন পরে গাইলেও খুব বেশি খারাপ হয়নি কিন্তু। মাঝেমাঝে তো গাইতে পারো। এসব জিনিস চর্চা করতে হয়। চর্চা না থাকলে পরে আর ঠিকঠাক গাওয়া যায় না।
সেলিম যে আমার গান মনোযোগ দিয়ে শুনবে এতটা আশা করিনি। খুব ভালো লাগছে সেলিমের মন্তব্য পেয়ে। কিন্তু সেটা আর আমি সেলিমের সামনে প্রকাশ করতে গেলাম না।
উলটো দিকে ঘুরে শুয়ে সেলিমকে বললাম , কতবার এই গান গেয়েছি যে চর্চা না থাকলেও আমি এই গান ভুলবো না। অবশ্য চর্চা তো করাই যায়। তবে শোনানোর জন্য কাউকে পেলে চর্চায় আগ্রহ আসে। দেখা যাক। আবার গাইতে যখন শুরু করেছি । শোনানোর মত শ্রোতাও নিশ্চয়ই পেয়ে যাব।
সেলিম আমার কথার আগামাথা কিছু বুঝল কি না জানি না। সে উলটো ঘুরে শুয়ে আছে। একদম চুপচাপ। ঘুমিয়ে গেছে কি না সজাগ সেটাও জানি না। জানতে মনও চায় না।
পরেরদিন দুপুরে খেয়েদেয়েই বেরিয়েছি সিদ্ধার্থের সাথে ঘুরতে। রাত বারোটার দিকে ফিরলাম আমি। এভাবে বেশ ক’দিন ঘুরছি দু’জন। সিদ্ধার্থের সাথে কাটানো সময়গুলি কীভাবে কেটে যায় একদমই টের পাচ্ছি না। এর মাঝে সিদ্ধার্থকে পরের শুক্রবার আমার বাসায় দাওয়াত দিলাম । সিদ্ধার্থ সেলিমের সাথে দেখা করতে চায়। সেলিমকে সিদ্ধার্থের কথা জানালাম। তাকে বললাম , আমার এক ফ্রেন্ড বাসাতে আসছে। সে ব্যাংককে থাকে। শুক্রবার ডিনারে দাওয়াত দিয়েছি। তুমি বাসাতে থাকবে, প্লিজ।
সেলিম হু হা কিছুই করল না। আমি অবশ্য সেলিমের কাছে আমার ফ্রেণ্ড ছেলে না মেয়ে সেটা কিছু বললাম না। তবে আমার যত সম্ভব মনে হলো সে হয়তো ভেবেছে আমার কোনো মেয়ে ফ্রেণ্ড আসবে। কারণ আজ অবধি আমার কোনো ছেলে বন্ধুকে আমি বাড়িতে আনিনি। তাছাড়া আমার বাসায় আনার মত কোনো ছেলে বন্ধু নেইও। এ কথা সেলিমও ভালো করেই জানে। তবে
আমার চালচলন , আচার আচরণের মাঝে বেশ পরিবর্তন যে এসেছে এটা সেলিম ঠিকই খেয়াল করছে। আমিও চাই সে খেয়াল করুক।
সকাল থেকে আমি খুব ব্যস্ত। মনে হচ্ছে ঘর ভর্তি মেহমান আসছে আমার বাসাতে। সেলিম বাসাতেই। মনে হলো না যে সে কোথাও বের হবে। আমি এটা গোছাই সেটা গোছাই। ঘরের কোণায় কোণায় সাফ করছি। কখনো সার্ভেন্টদের ধমকা ধমকি করছি , কখনো নিজের হাতে করছি, কখনো ওদের দিয়ে করাচ্ছি । ড্রয়িং রুম থেকে শুরু করে বেড রুম পর্যন্ত গুছিয়ে টিপটপ। যদিও আমার ঘরদোর সব সময় টিপটপই থাকে। কিন্তু আজ আরো বেশি চকচক করছে চারদিকে। ড্রয়িং রুমের ফ্লাওয়ার ভাসে তাজা ফুল দিয়ে সাজালাম। বেডরুমেও তাই। সারাঘর জুড়ে রজনীগন্ধা আর গোলাপের তাজা গন্ধে মৌ মৌ করছে।
ঘর সাজানো শেষ করে মনোযোগ দিলাম রান্নাঘরের দিকে। আসবে সেই রাতে অথচ আমাই তোরজোর শুরু করে দিয়েছি এখন থেকেই। সার্ভেন্টরা মনে মনে ভাবছে না জানি কত কত গেস্ট আসছে। আমি ওদের কিছুই বললাম না। যদিও সবসময় বাবুর্চী রান্না করে কিন্তু আজ আমি নিজ হাতেই কয়েকটি ডিশ বানালাম । সিদ্ধার্থের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে এ ক’দিনেই বেশ ওয়াকিবহাল আমি। দুপুরের মধ্যে আমার কাজ শেষ করে বাকি কী কী করতে হবে সার্ভেন্টদের বুঝিয়ে দিয়ে আমি দুপুরের খাওয়া শেষ করে সব জায়গা ঠিকঠাক আছে কি না আবার ভালো করে দেখলাম। সেলিম তার মত করে কখনো টিভি দেখছে , কখনো ফোন ঘাটছে।
সাতটার দিকে সিদ্ধার্থ আসবে। আমি পাঁচটার দিকে বসে গেলাম ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজেকে গুছিয়ে নিতে। সেলিম বিছানায় শুয়ে মাঝেমাঝে আমাকে উঁকি মেরে দেখছে । আমি বেশ মজাই পাচ্ছি । আমি আলমারি থেকে বেছে বেছে প্রায় এক ডজন শাড়ি বের করলাম। একটার পর একটা আয়নার সামনে যেয়ে নিজের শরীরের সাথে মিলিয়ে দেখছি আর বাজেয়াপ্ত করছি।
পরে আধাঘন্টা ধরে সিদ্ধান্ত নিলাম কোন শাড়িটা পরব। হালকা নীল রঙয়ের একটা শাড়ি সিলেক্ট করলাম। সাথে ম্যাচিং করে হালকা অর্নামেন্টস আর হালকা প্রসাধনী। চোখে কাজল পরলাম বেশ গাড় করে। সেলিম আমার চোখে কাজল পরা খুব পছন্দ করত। আর এই শাড়িটাও সেলিমের খুব পছন্দ। বেশ সময় নিয়ে সাজগোজ করছি আর গুণগুণ করে গান গেয়েই যাচ্ছি। সেলিমের দিকে ভ্রুক্ষেপও নেই। সেলিম আমাকে দেখছে কি না নাকি কী ভাবছে সে নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। আমি এখন নিজেকে গোছাতেই খুব ব্যস্ত। প্রথমবারের মত সিদ্ধার্থ আমার বাসায় আসবে বলে কথা! নিজেকে যতটা সম্ভব পরিপাটি করে নিলাম।
সাজগোজ শেষ করে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি।
– কখন সাতটা বাজবে?
– কী ব্যাপার ! মনে হচ্ছে পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে তোমাকে?
রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন সেলিমের এমন কথা শুনে মনে হলো কিছুটা কেঁপে উঠলাম। আমি দাঁড়িয়ে সেলিমের দিকে তাকিয়ে কিছুটা তাকে বোঝার চেষ্টা করলাম। তারপর সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বললাম,
– ব্যাপারটা কিছুটা সে রকমই। খুব স্পেশাল কারো জন্যই সেজেছি। আশা করছি খুব খারাপ লাগছে না আমাকে!
আমি আর সেলিমের মতামতের অপেক্ষা না করে ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে আরেকবার নিজেকে দেখে বাইরের দিকে পা বাড়ালাম।
চলবে….
#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১৩
আমি উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি কখন সিদ্ধার্থ আসবে। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছেই না। সিদ্ধার্থকে আনতে আমি আমার গাড়ি পাঠিয়েছি। বারবার ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি কতদূর পৌঁছাল। সাড়ে সাতটার দিকে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটল। সেলিম ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে। সেই সময় সিদ্ধার্থ বাসায় ঢুকল। সিদ্ধার্থকে দেখে আমি হাসি মুখে এগিয়ে গেলাম। সেলিমের সামনেই সিদ্ধার্থের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। সিদ্ধার্থকে দেখে সেলিম যে বিশাল বড় একটা ধাক্কা খাবে সেটা আমি নিশ্চিত। এবং আমিও সেটা চাই। ওকে এমন ধাক্কা দেবার খুব দরকার এই মুহূর্তে। সে কখনো ভাবেনি আমি কোনো ছেলে বন্ধুকে বাসায় ইনভাইট করতে পারি বা তার জন্য এত আয়োজন আর প্রস্তুতি আমার।
আমি সিদ্ধার্থকে সেলিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে এগিয়ে গেলাম।
– সিদ্ধার্থ, মিট মাই হাজবেন্ড, সেলিম।
– সেলিম, হি ইজ সিদ্ধার্থ । মাই বেস্ট ফ্রেন্ড ফ্রম ব্যাংকক।
সেলিম উঠে দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।
– হাই, নাইস টু মিট ইউ। প্লিজ, হ্যাভ ইওর সিট।
– থ্যাংক ইউ সো মাচ। আ’ম সিদ্ধার্থ ব্যানার্জী। নাইস টু মিট ইউ, ঠু!
– ইটস মাই প্লেজার!
আমি সিদ্ধার্থের পাশে বসে বললাম, এত দেরী করলে কেন? জানো কত অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। ইট’স অলরেডি এইট পি এম।
বাই দ্যা বাই। রাস্তায় কনো সমস্যা হয়নি তো?
– তুমি তো ট্রাফিক জ্যামের কথা জানোই। মাই গড । এত জ্যাম! বাংলাদেশ নাকি পুওর কান্ট্রি বাট ঢাকার রাস্তায় এত গাড়ী কই দিয়ে আসে সেটাই ভেবে পাই না। হা হা!
– আর বলো না। জ্যামের কথা উঠলে আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়।
– তোমার গাড়ি পাঠানোর প্রয়োজন ছিল না। আমি ম্যানেজ করতে পারতাম। তুমি কী যে করো না!
– আমার ড্রাইভার তো অলস বসেই ছিল সারাদিন। সমস্যা কী?
– ইউ লুক সো মাচ প্রিটি এন্ড গর্জিয়াস!
– থ্যাংক ইউ সো মাচ!
– ওয়েলকাম। তোমার বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবে না?
– অফকোর্স! চল যাই।
সিদ্ধার্থ আর আমার চলে যাবার দিকে ক্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে আছে সেলিম। তাকে যেন দেখেও দেখছি না। আমরা আমাদের মতো কথবার্তায় ব্যস্ত। তার দিকে তাকানোর ফুরসৎ নেই। এ ক’দিন ঘোরাঘুরি করতে করতে সিদ্ধার্থের সাথে সম্বোধন কখন যে আপনি থেকে তুমিতে নেমে গিয়েছে নিজেই টের পাইনি। সিদ্ধার্থকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি আর টুকটাক গল্প করছি।
সিদ্ধার্থকে বাসা ঘুরিয়ে দেখিয়ে আমি টেবিল সাজানোর কাজে লেগে গেলাম। সেলিমের সাথে বসে বিজনেস রিলেটেড টুকটাক কথাবার্তা চলছে দু’জনের যেটা সচরাচর দু’জন অপরিচিত পুরুষ মানুষ একসাথে হলে হয়। এরা পার্সোনাল ইনফরমেশানের চাইতে প্রফেশনাল ইনফরমেশান নিয়েই বেশি কৌতূহলী।
খাবার টেবিলের আয়োজন দেখে সিদ্ধার্থের সাথে সাথে আমার স্বামী বেচারারও চোখ ছানাবড়া।
– এত আয়োজন কেন, রূম্পা? আর ইউ ক্রেজি?
– ইয়েস, আ’ম। বিকজ ফার্স্ট টাইম তুমি আমার বাসায় এসেছ। সবই তোমার জন্য।
– আমি এত কিছু কী করে খাব? তুমি তো জানোই আমি ডিনারে খুবই কম খাই।
– আজ কোনো কথা নেই। সব কিছু ট্রাই করতে হবে। এখানের অনেক আইটেম আমি শুধুমাত্র তোমার জন্য নিজের হাতে করেছি। রান্নাঘরে রেগুলার না গেলেও কোনোকিছু রান্না করলে খুব বেশি খারাপ হয় না কিন্তু। টেস্ট করে মার্কস দিবে তুমি।
আমি ইচ্ছে করেই বারবার শুধু তোমার জন্য শব্দটা ব্যবহার করছি । আমি সেলিমকে অনুভব করাতে চাই কাউকে অবজ্ঞা করলে তার কেমন লাগে।
আমি এটা সেটা জোর করে উঠিয়েই যাচ্ছি সিদ্ধার্থের প্লেটে। সে অর্থে সেলিমের দিকে আমার কোনো নজরই নেই। সেলিম নিজের মতো করে নিচ্ছে , খাচ্ছে।
– খাসীর রেজালা আর চিংড়ীর মালাইকারি কিন্তু একদম নিজের হাতে করেছি। এ দুটিই তোমার ফেভারিট । এজন্য কাউকে হাত লাগাতে দেইনি। এটা কিন্তু একদমই স্কিপ করতে পারবে না। খেতেই হবে তোমাকে।
– মাই গড! কত খাব? তুমি তো আজ আমার বারোটা বাজাবে। এটা জানলে তিনদিন আগে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে রাখতাম ।
– করোনি কেন? এজন্য পানিসমেন্টস্বরুপ খাবার বেশিই খেতে হবে।
– শুইধু আমাকেই পেয়েছ পানিসমেন্ট দেবার জন্য ? সেলিম সাহেবের প্লেট একদমই খালি। তাকে কিছু দাও।
– সেলিম সাহেবকে তো প্রতিদিনই পাচ্ছি পানিশমেন্ট দেবার জন্য। কিন্তু তোমাকে রোজ রোজ কোথায় পাই বলো!
– তার মানে তুমি সেলিম সাহেবকে এভাবেই টর্চার চালাও প্রতিদিন? মাই গড! বেচারার লাইফ তো তবে শেষ!
– সেটা সেলিম সাহেবই ভালো জানবেন। জিজ্ঞেস করতে পারো । সামনেই তো বসা আছে।
– কী ব্যাপার ! রূম্পা কি এভাবেই টর্চার করে নাকি, ব্রো?
– সেলিম মৃদু হেসে কোনোরকম মাথা নাড়িয়ে দায় সারা একটা উত্তর দিয়ে শেষ করল।
সেলিমের আচরণ দেখে নিশ্চিত হলাম যে তার ভেতরে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেছে। মনে মনে বলছি, জ্বলে দেখ ব্যাটা হারামজাদা! আমাকে জ্বালিয়ে মারছিস। এবার বুঝবি কত ধানে কত চাল! তুই তো ওই চুন্নি হেলেনের সাথে লুকিয়ে চোরের মতো ফস্টিনস্টি করেছিস , কিন্তু আমি এসব করছি না। আমি তোর সামনেই যা করার করব। আর তুই ভ্যান্দার মতো এভাবেই তাকিয়ে দেখবি। জ্বলে দেখ , লাগেটা কেমন? আমার সাথে বদমায়েশির শাস্তি এটা।
খাওয়া দাওয়া শেষে সেলিম বেডরুমে চলে যাবে কিন্তু সিদ্ধার্থ আটকাল।
– হেই মিস্টার! কই যাচ্ছেন? এমন একটা ভুড়িভোজের পর আপনার মিষ্টি বউয়ের কণ্ঠে একটা গান না হলে চলেই না। প্লিজ, বসুন না। আপনি তো টু মাচ লাকি পার্সন। এমন গুণী আর সুন্দরী একটা বউ পেয়েছেন । দেখেন না, হাউ মাচ আনলাকি আই এম! বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে বাট আজ পর্যন্ত সংসার করতে পারলাম না। পারবই বা কী করে আমার চয়েসের টপলিস্টে থাকা মেয়েটা তো আপনার দখলে।
সিদ্ধার্থের এবারের কথা শুনে সেলিমের চোখ লাল হয়ে গেল। সিদ্ধার্থ খেয়াল না করলেও আমি সবই খেয়াল করছি। অগত্যা অনুরোধের ঢেকি গেলার মতো সেলিম বসল।
বারবার অনুরোধ করার পরেও আমি গান গাচ্ছি না দেখে সিদ্ধার্থ সেলিমকে বলল,
– ব্রো , আপনি বলুন না, প্লিজ! আই থিংক সে আপনি বললে রাজি হবে। আমি ভালো করেই জানি সে চমৎকার গায়।
– সেলিম কিছুটা বিরক্তির সাথেই বলল, ব্যানার্জী সাহেব এত রিকোয়েস্ট করছেন যখন একটা গান শোনাতেই পারো।
আমি সেলিমের অনুমতির অপেক্ষাই করছিলাম। সে একদম চুপচাপ দেখেই এটা করেছি। তার ভেতরের ভাব বোঝার চেষ্টায় ব্যাকুল আমি।
অনেকদিন পিয়ানোতে হাত দেই না। মাঝেমাঝে খালি গলায় গান গাইলেও বাজানো হয় না অনেক কাল । আজ নিজেই পিয়ানোর দিকে এগিয়ে গেলাম। পিয়ানোতে সুর তুললাম । পুরো হলরুমে অন্য রকম একটা পরিবেশ তৈরি হলো।
“ধীরে ধীরে সে মেরি জিন্দেগি মে আনা
ধীরে ধীরেসে দিল কো চুরানা,
তুমসে পেয়ার হামে হে কিত্না জানে জানা
তুমসে মিলকার তুমকো হে বাতানা !
……
সেলিম এবং সিদ্ধার্থ দুজনেই তন্ময় হয়ে গান শুনল। খুব একটা খারাপ গাই না আমি। গান শেষ হওয়ার সাথে সাথে সিদ্ধার্থ তালি বাজানো শুরু করল। সেলিম নিরুত্তাপ তবে গানটা যে এনজয় করেছে সেটা তার মুখ দেখে বুঝতে পারছি।
– ওয়াও, ইউ আর সাচ আ ট্যালেন্টেড গাই! আমেজিং ভয়েস এন্ড সিঙ্গিং স্টাইল। প্লিজ, ওয়ান্স মোর।
– না, না। প্লিজ, আর গাইতে বলো না। অনেকদিন পরে গাইলাম। কেমন না কেমন হয়েছে কে জানে?
– কেমন না কেমন মানে কি? আমি তো তোমাকে বললাম সুপারহিট গেয়েছ। বিশ্বাস না হলে সেলিম সাহেব কে জিজ্ঞেস করো!
– ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর জিজ্ঞেস করতে হবে না কাউকে। গান শোনাচ্ছি। তবে এটাই কিন্তু শেষ, এরপরে আর বলতে পারবে না!
– দ্যাট ডিপেন্ডস অন ইয়োর লিসেনার। হা হা। আগে শুরু তো করো। এবার একটা বাংলা গান গাইবে। এরপরে তোমার কাছে আরো দুটো হিন্দি গান শুনব।
– মাই গড! বল কি? আমি কি কোন সিঙ্গার নাকি?
– গান শোনাতে হলে সিঙ্গার হতে হবে কে বলেছে? সিঙ্গার না হলেও মানুষ গান গাইতে পারে। আর তার প্রমাণ তুমি। সো শুরু করো।
“এ জীবনে যারে চেয়েছি
আজ আমি তারে পেয়েছি,
তুমি আমার সেই তুমি আমার
তোমারে খুঁজে পেয়েছি।
তুমি ছিলে না ছিল না আশা
তোমায় পেয়ে আশা বেঁধেছে বাসা ।
তুমি ছিলেনা ছিল না আশা
তোমায় পেয়ে আশা বেঁধেছে বাসা ,
ফুটালে আমার মুখে সুখের ভাষা।
ও….ও….ও….ও….”
– আহা..হা.. প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। কী চমৎকার গাও তুমি! দারুণ। সেলিম সাহেব, আপনাকে দেখে তো আমার হিংসে হচ্ছে এখন খুব। যেমন সুন্দরী বউ আপনার, তেমন গুণবতী। সামলে রাখবেন। কাল টিপ দিয়ে রাখেন আবার যেন কারো নজরে না পড়ে।
এবার খোশ গল্প করতে-করতে প্রায় রাত বারোটা। সেলিম অবশ্য আরও কিছুক্ষণ আগে ঘুমের বাহানা দিয়ে এখান থেকে চলে গেছে। আমি অবশ্য বুঝতে পেরেছি ঘুমের বাহানা টাহানা কিছু না। আজকে এমন ডোজ দিয়েছি যে ওর রাতে ঘুমই হবে না ।
আমার বিয়ের এ্যালবাম, পারিবারিক অ্যালবামের ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সিদ্ধার্থের দেখাচ্ছি আর একেকটা ছবির পিছনের নানান মজার গল্প বলছি আর হাসছি দু’জন।
সিদ্ধার্থকে বিদায় করে অবশেষে রাত একটার দিকে আমি বেডরুমে গেলাম। সেলিম খুব অস্থির হয়ে রুমের ভেতর পায়চারি করছে। আমার জন্যই যে অপেক্ষা করছি সেটা আমি নিশ্চিত। তার চেহারা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। কারণ সেলিম রেগে গেলে ওর কোন হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা কি থেকে কি বলে নিজেও জানে না।
এত তাড়াতাড়ি যে ডোজ কাজ করা শুরু করবে ভাবিনি।
– এতক্ষণে রুমে আসার সময় হল? বেশ চড়া সুরে বলল সে।
– গেস্ট বিদায় করে তারপরে তো আসব?
– এ ধরনের ম্যানারলেস গেস্ট তুমি কোথায় পাও? যে রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত মানুষের ঘরের বউয়ের সাথে আড্ডা দেয়! শুধু দেখতে শুনতে সুন্দর হলেই স্মার্ট হওয়া যায় না! স্মার্টনেস হয় কথায়, আচরণে।
– নিশ্চয়ই পথে ঘাটে বা বাজারে পাইনি। কোথায় পেয়েছি সেটা তোমাকে জানিয়েছি। আর এক্সকিউজ মি! তুমি তাকে ম্যানারলেস বলতে পারো না। কারো ম্যানার সম্পর্কে আগে জেনে তারপর তাকে নিয়ে মন্তব্য করতে হয়।
– হেয়ালিপনা রাখো। আমার কিছু কথার ক্লিয়ার কাট আনসার দিবে।
– অবশ্যই। বলো কী জানতে চাও?
– সিদ্ধার্থ নামের এই নমুনার সাথে তোমার পরিচয় কি আসলেই ব্যাংককে গিয়ে? মাত্র এই ক’দিন পরিচয়েই এই পর্যায়ে পৌছেছে রিলেশান?
– কেন, তোমার কী কিছু সন্দেহ হয় নাকি? উল্টাপাল্টা কিছু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। ও খুব ভালো মানুষ। আমার একাকীত্ব কাটানোর জন্য কাউকে খুব প্রয়োজন। তোমার তো সময় হয় না আমার জন্য। সেই ভাবে ওর সাথে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠা । এছাড়া আর কিছুই না।
– ওকে ফাইন। তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কী জানে না অন্যের ওয়াইফের সাথে কী করে কথা বলতে হয়। ডিসগাস্টিং আচরণ! তাকে সঠিক ট্রাকে থাকতে বলো। তোমাদের দু’জনের গায়ে পড়া স্বভাব আমার একদমই পছন্দ না। সো বুঝতেই পারছ আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি।
– মোটেই কোনো গায়ে পড়া স্বভাব দেখাচ্ছি না আমরা। উই আর গুড ফ্রেন্ডস। জাস্ট ইট!
– হ্যা, গুড ফ্রেন্ডস এর নমুনা তো দেখতেই পেলাম। আর তোমার বিহেভিয়ারও দেখলাম।
– দেখার মতো এমন কিছুই করিনি।
– ওহ,আই সি! সারাদিনের এত আয়োজন, খুব পরিপাটি লুক নিয়ে নিজেকে তার সামনে প্রেজেন্ট করা, নিজের হাতে রান্নাকরা, জোর করে করে তুলে খাওয়ানো, গাড়ি পাঠানো, পিয়ানোতে সুর তুলে একের পর এক রোমান্টিক গান শোনানো এগুলি কিছুই কি দেখার মতো ছিল না? আমি কি কিছুই বুঝি না ভেবেছ?
– এগুলিকে সমস্যা মনে করা তোমার ব্যক্তিগত বিষয়। আমি তো কোনো সমস্যা দেখছি না।
– আমার জন্য তো কখনো তোমাকে এমন উতলা হতে দেখি না।
– কারণ আমার এমন উতলা হওয়া এখন আর তোমার পছন্দ না। শেষ কবে আমার দিকে ভালো করে তাকিয়েছ মনে করে আমাকে জানিও! আপাতত ঘুমাতে
গেলাম। সারাদিন খুব পরিশ্রম হয়েছে। রেস্ট নিতে চাই। রাত দুপুরে এসব ননসেন্স টপিকে কথা বলতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না। গুড নাইট।
সেলিমের চেহারা দেখার মতো ছিল। আমি ওকে পাশ কাটিয়ে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় চলে গেলাম। সেলিম তখনো সোফায় বসা।
বেচারার ঘুমের যে চৌদ্দটা বাজাতে পেরেছি এটা ভেবেই বহুদিন পরে আমার একটা শান্তির ঘুম হবে।
চলবে….