সুখের সন্ধানে পর্ব-১+২

0
1136

#সুখের_সন্ধানে_১

বিয়ের আগে জীবনটাকে ফ্যান্টাসি মনে হতো! সেলিমের মতো ছেলেকে বিয়ে করলে আমার মতো যে কারো কাছেই এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক।
দেড় বছর প্রেম করার পর দুই পরিবারের সম্মতিতেই খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল বাবার এমডির ছেলে সেলিম মালিকের সাথে। তার আভিজাত্য, ঐশ্বর্যতে আমি ছিলাম মুগ্ধ! বলিষ্ঠ আর তেজোদৃপ্ত পুরুষালি সৌন্দর্যে কী এক স্বর্গীয় অনুভূতি হতো আমার মধ্যে অথচ তাকে দেখলে সেই অনুভূতি এখন হাজার চেষ্টা করলেও হয় না!
এমন জীবন তো আমি চাইনি! নিজেকেই নিজের কাছে বড় অপাংক্তেয় মনে হয়। ক্যাডেট পড়ুয়া পনেরো বছরের ছেলে প্রিয়র কাছেও নিজেকে বড় অচেনা মনে হয়!

অভিজাত পরিবারের ছেলের বউ! বলা যায় শাড়ীর মডেলের সাথেই পরিবর্তন করি গাড়ির মডেল। এই তো গত সপ্তাহেই বিক্রয় ডট কমে বিক্রি করেছি বছর খানেক আগের কেনা টয়োটা প্রিয়াসের খুব প্রিয় গাড়িটি। ক’দিন ধরে খুব জিপের নেশা চেপেছে। কিনে ফেললাম হ্যারিয়ারের ব্র্যান্ড নিউ কার। এটাও বা কতদিন মনে ধরে সেটাই দেখার বিষয়! এই প্রিয়াস কারটা নেবার আগে হোন্ডা গ্রেসের নিউ মডেলটাও অনায়সেই অল্পদামে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কোনো কিছুতেই একদম মায়া জন্মায় না আজকাল আর। অনুভূতিগুলি এত ভোতা কেন হয়েছে , কবে হয়েছে নিজেই টের পেলাম না। দামি গাড়ি , শাড়ি এসবের মাঝে সুখ খুঁজতে খুঁজতে এখন নিজেকে বড্ড ক্লান্ত লাগে। সত্যিই আমি ক্লান্ত! বড় ক্লান্ত! শশুর শাশুড়ি আলাদা বাড়িতে থাকেন। শশুরবাড়ীর উটকো ক্যাচালে কোনোদিন ভুগেছি মনে পড়ে না। কোনো কিছুর মধ্যে নাক গলাতে আসে না তারা কেউই। আমার ছেলেটা বিয়ের পরপরই কনসিভ করেছিল। এরপরে আর শত চেষ্টাতেও কনসিভ করলাম না। সেকেন্ড বারের মত আর বাচ্চার মুখও দেখা হলো না। ছেলেটাকে নিয়েই সব আশা ভরসা। প্রিয়র খুব শখ হলো ক্যাডেটে পড়ার! না করতে পারলাম না। একমাত্র ছেলে কোলছাড়া হয়ে যাচ্ছে তাতেও আমি নিরুত্তাপ! সবকিছুতেই এত অনীহা আমার! শেষ কবে রান্নাঘরে চুলাতে রান্না চাপিয়েছি মনে পড়ে না।
পড়বেই বা কি করে? ঘর ভরা এত চাকর বাকর থাকতে আমার রান্নাঘরে ঢুকে রান্না করার কি দরকার? সেলিমও কখনো আবদার করে বলে না “আজ তোমার হাতের রান্না খেতে চাই। ” মাঝেমাঝে শখ করে কিছু রান্না করে সামনে দিয়ে যদি বলি, কেমন হলো দেখতো! আজ তোমার জন্য নিজের হাতে রান্না করেছি। তেমন কোনো রিয়্যাক্ট নেই সেলিমের। বলবে, “কষ্ট করতে কেন গেলে? কুককে কী আর মাস গেলে এমনিতেই বেতন দিব? ” রান্নার কষ্টটাই মাটি। তাই এখন আর ও মুখো হই না।
আমি সমাজসেবায় সময় দিচ্ছি খুব! এতে দু’পয়সা ইনকাম হোক বা না হোক মনের শান্তি কিছুটা হলেও জুটছে। আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই আমার স্বামী সেলিম বা তার পরিবারের!
সেলিম ব্যস্ত মানুষ, সে সারাদিন ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই থাকে। আমার কোন ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া পছন্দ-অপছন্দের মাঝে সে কখনোই নাক গলাতে আসে না। আমার বাবা ছিলেন ওদের কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। সেই সুবাদে ওদের বাসাতে আমার মাঝেমাঝে আসা যাওয়া হতো। কখন যে সেলিমের সাথে আমার মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেল এখনো ভাবলে অবাক লাগে। সেলিমই পাগল ছিল আমার জন্য। আমিও মনে মনে পছন্দ করতাম ওকে কিন্তু বলার সাহস হয়নি কখনো। সেলিম যেদিন আমাকে প্রথম তার পছন্দের কথা জানাল আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আব্বুকে যখন আমি জানিয়েছিলাম আমার পছন্দের কথা সে তো শুনেই ভয়ে একাকার। সেলিম তাকে অভয় দিয়েছিল বলেই সাহস করে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায় আমার শ্বশুর আফাজ মালিকের কাছে।

আব্বুর মত এত ভালো আর বিশ্বস্ত ইমপ্লয়িকে তিনি নিরাশ করেননি । আমার শাশুড়ি মা আমাকে খুব বেশি পছন্দ না করলেও ছেলের যেহেতু পছন্দ তাই তিনি আর অমত করেননি। আমাকে যে খুব বেশি পছন্দ তিনি তখনো করতেন না এবং এখনও করে না এটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। কিন্তু এ নিয়ে কখনোই তার সাথে কোন ধরনের কথা বলিনি ।মাঝে মাঝে কিছুটা হীনমন্যতায় ভুগি ।

সেলিমের কাজিনরা যখন তাদের মতো হাই সোসাইটির মেয়েদেরকে বিয়ে করে তখন আমার শাশুড়ির মুখ দেখে কিছুটা হতাশ মনে হয়। আমি বুঝি আমাকে মেনে নিতে হয়তো এখনো তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করি। সেলিমের ছোট ভাই বোন দুটোও আমাকে খুব বেশি সম্মান করে না, তবে অসম্মান করে এটাও বলব না। আমার ছোট দেবর সাহিল বিয়ে করেছে তিন বছর আগে। দেবরের বউ মালিহাকে একদম চোখে হারায় সবাই। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেতাম তবে এখন আর পাই না। ওদের সাথে আমার খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে যদি একটু আধটু দেখা হয় জাস্ট হাই হ্যালো টাইপের কথাবার্তা ছাড়া আর কথা থাকে না আমাদের।
বছরে দু’দিন শ্বশুরের বাড়ীতে আমার যাওয়া হয়। দুই ইদে খুব ঘটা করে অনুষ্ঠান করা হয় আমার শ্বশুর বাড়িতে। আমি সেখানে মেহমানের মত যাই । খেয়ে দেয়ে ফুর্তি করে চলে আসি। অন্য মেহমানদের থেকে আমি নিজেকে আলাদা করতে পারি না। আমার শ্বাশুড়ির কাছে ওদের আর আমার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই হয়তো।
এ নিয়ে মাঝে মাঝে সেলিমের কাছে খুব আফসোস করে বললে সেলিম সেটাকে পাত্তা দেয় না। সে থাকে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত, আমার কথা শোনার সময় কোথায় তার? আমার কষ্টগুলো সে হয়তো বোঝে না? বিশাল বড় ডুপ্লেক্স বাড়িতে সারাদিন একাকিত্বের যন্ত্রনা আমাকে কুরে কুরে মারে।
আমার শাশুড়ি তার বাসাতে আমাকে একজন মেহমানের অতিরিক্ত কখনো ভেবেছে বলে আমার মনে পড়ে না। আমার এখানে আসেও খুব ফর্মাল ভাবে। জাস্ট মেহমানের মত আসে, খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণ থেকে চলে যান। লিভিং রুম থেকে কখনো আমার বেডরুমে আসার কথা সে চিন্তাও করেন না।
মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই এ আবার কেমন সম্পর্ক? বউ শাশুড়ি সম্পর্কে এতটা নিরুত্তাপ ভাব কোন বউয়ের পক্ষেই মেনে নেওয়া সহজ হবে না।
সেলিমের কাছে নালিশ টা কী করব মাঝেমাঝে সেটাই ভেবে পাই না। আমার শাশুড়ি তো আমার কোন কিছুতে দোষ ধরেন না বা আমার কোন কিছু নিয়ে অভিযোগও করেন না। ইদ হোক আর পহেলা বৈশাখ হোক কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে গিফট পাঠাতেও তার ভুল হয় না। আমিও সময়মতো তাকে গিফট পাঠিয়ে আমার দায়িত্ব পালন করছি।
আমার শশুড় শাশুড়ি থাকে ধানমন্ডিতে বিশাল বড় আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়িতে। আমারও ডুপ্লেক্স বাড়ি, আমি থাকি উত্তরাতে। আমারটা তাদের মত অত বড় আর আলিশান না হলেও যতটুকু সেটাই আমার কাছে রাজপ্রাসাদতুল্য।
আব্বুর বাসা মিরপুরে। ছয় শতক জমির উপর পুরানো আমলের একটা তিনতলা বাড়ি। এটাই আব্বুর রেখে যাওয়া একমাত্র সম্পদ। আব্বু মারা গেছেন আমার বিয়ের বছর খানেক পরে স্ট্রোক করে। আম্মু মারা গেছেন গত বছর । ভাইয়া ভাবি আর তার তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়িটাতে থাকেন। নিজে দোতালায় থাকেন, নিচতলা আর তিন তলা ভাড়া দেওয়া। আমার ছোট বোন চম্পা ,ওর সাথে কথা হয় না প্রায় দুই বছর। চম্পার বিয়ে হয়েছে পুরান ঢাকাতে। শশুর শাশুড়ি ননদ দেবর সবাই একসাথেই থাকে। যৌথ পরিবারের বড় বউ চম্পা। দায়িত্বের অভাব নেই তার।
কী সামান্য একটা বিষয় নিয়ে ওর সাথে আমার কথা বলা বন্ধ । বড় মামার মেয়ের বিয়েতে আমাদের আত্মীয় স্বজনেরা যখন আমার শ্বশুরবাড়ির অর্থ-বিত্ত নিয়ে খুব প্রশংসা করছিলেন তখন এটাকে সহজভাবে নিতে পারেনি চম্পা। নিজেকে বড় করতে যেয়ে আমাকে খুব বেশিই ছোট করে ফেলল সবার সামনে। ছোটবেলা থেকেই ওর বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম। কখন কার সামনে কী বলতে হয় আর না হয় হুশ থাকে না। আর রেগে গেলে তো কথাই নেই। সবার সামনে বলে ফেলল, ” এত বড়লোক ঘরে বিয়ে হলে কি হবে? মনে শান্তি আছে? মনের শান্তি বড় শান্তি! আমার ওর মতো অর্থ সম্পদের পাহাড় না থাকলেও শান্তির অভাব নেই। ওর শ্বশুর বাড়িতে ওকে তো কেউ দু’আনার দাম দেয় না। এদিকে আমাকে সবাই মাথায় করে রাখে। এমন অর্থ কড়ি থাকা আর না থাকা একই কথা।”
কথাটা ও হয়তো ওভাবে বলতে চায়নি। কিন্তু ও কখনই ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলতে পারেনা। যা বলে সোজাসুজি মুখের উপর বলে ফেলে। তাতে কেউ কষ্ট পেলো কি না পেল সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই। সেদিন ওর কথায় আমিও প্রচন্ড কষ্ট পেলাম ।আমাদের আত্মীয় স্বজনের সামনে এভাবে আমাকে ছোট না করলেও পারত। অনুষ্ঠানের শেষে বাসায় ফিরে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছিল সেদিন চম্পার সাথে আমার। আম্মু তখন বেঁচে ছিলেন। আম্মুও প্রচুর চেষ্টা করেছেন থামানোর কিন্তু পারেননি। আম্মু আমাদের ছেড়ে চলে যান ।অনেক কিছুই বদলে গেছে কিন্তু আমাদের দু’বোনের সম্পর্ক এখনো সেই আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ।দুজনের সাথে দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আমি কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম ওর সাথে কথা বলার কিন্তু হয়তো আন্তরিকতা ছিল না সেই চাওয়ায় তাই ওর সাথে সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে পারিনি। আম্মু চলে যাবার পরে ভাইয়ার বাসাতেও সব কিছু আর আগের মতো নেই। ভাবির মা আব্বা আমাদের বাড়িতেই থাকেন ভাইয়াদের সাথে। একাকীত্ব কাটাতে সেখানে গেলেও সেই চেনা ঘর দোর আর মানুষগুলিকে কেমন যেন বড় অপরিচিত মনে হয়। আম্মু মারা যাবার পর মাঝে মাঝে যেয়েই আম্মুর রুমে দরজা বন্ধ করে আম্মু আব্বুর খাটে শুয়ে তাদের শরীরের ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করতাম। এখন সেই রুমে ভাবির আব্বা মা থাকেন। আমি গেলে গেস্ট রুমে জায়গা হয় আমার। নিজেকে একদমই মানাতে পারি না সেই বাড়িতে যে বাড়ির আলো ছায়াতে বড় হয়েছি আমরা তিন ভাই বোন। তাই ধীরে ধীরে চেনা পথও আজ বড্ড অচেনা।

সেলিম পড়ে থাকে তাদের বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। আমার সাথে রাতে খাবার টেবিলে যা টুকটাক কথাবার্তা হয়! সারাদিন ফোন করেও পাই না তাকে। তাই আজকাল ফোন করাই বন্ধ করে দিয়েছি। সেদিন সেলিমকে বললাম ,আমি শাশুড়ির আম্মার কাছে যেয়ে কিছুদিন থাকতে চাই। একা একা এভাবে থাকতে ভালো লাগে না। সেলিম জানাল তার মা হয়তো এটা পছন্দ করবে না। তাই সেখানেও না যাওয়াটাই ভালো। এটা শুনে খুব মন খারাপ হলো। জিজ্ঞেস করলাম, আমার সাথে সবাই কেন এমন ব্যবহার করে ? আমার কী সেখানে যাবার অধিকার নেই? তাদের মাঝে কেন আমাকে আপন করে নিতে পারে না?
সেলিমের উত্তর শুনে ভীষণ অবাক হই।

– তোমার শ্বশুর ,শাশুড়ি, দেবর , ননদ সবাই আলাদা থাকে। তোমার তো খুশি হওয়ার কথা। অন্যান্য বউরা তো এটাই চায়। তুমি কি সেটা চাও না?

– আমি অন্যদের থেকে আলাদা হতে চাই। আমি সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে চাই সেলিম। এই নিঃসঙ্গ জীবন আমি চাই না। তুমি থাকো তোমার কাজ নিয়ে আর আমি সারাদিন এভাবে কী করে থাকি বলতো! আমার তো মনে হয় তারা এত বছরেও আমাকে তাদের পরিবারের একজন বলে মেনে নিতে পারেন নি।

– হ্যাঁ! সত্যি কথা এটা । আমি পছন্দ করি বলেই তারা আমার পছন্দকে প্রাধান্য দিতেই ছেলের বউ হিসেবে তোমাকে মেনে নিয়েছেন। আচ্ছা, তোমার সমস্যা কোথায় ? তুমি আলাদা থাকছ এত বড় বাড়িতে । চাকর বাকর বাড়ি ভরা । তোমার শ্বশুর শাশুড়ি কেউই কখনো এসে তোমাকে কোন কিছু এ সংসারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন না। তারা তাদের জগত নিয়ে খুশি , তুমি তোমার জগৎ নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করো।

– সেলিম, সত্যি কথা বলবে ? তারা কেন আমাকে এত বছরেও মেনে নিতে পারছে না ? মেনে যদি নাই নিবে তাহলে তখন বিয়েতে কেন সম্মতি দিয়েছিলেন?

– বললাম তো !বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল কারন আমি তোমাকে পছন্দ করি তাই। আমার পছন্দকে তারা না করতে পারেনি!

– তাদের ছেলের বউ হিসেবেই যখন ঘরে এনেছে তবে আমাকে প্রাপ্য সম্মানটুকু কেন দিবে না? কী দোষ আমার? আমি কেন বিয়ের এত বছর পরেও তাদের কাছ থেকে আমার প্রাপ্য ভালোবাসাটুকু পাবো না? আমি কি কখনো তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করি নাকি অসম্মান করি? তোমার ভাইয়ের বউকে তো খুব আদর করে তারা।

– তুমি তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করো না এটা ঠিক। শুনতেই যখন চাইছ তখন শোনো! তোমার অন্যায় হচ্ছে তোমাদের স্ট্যাটাস আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে যায় না। এজন্যই তুমি সবার থেকে দূরে। মালিহার সাথে নিজেকে কেন কম্পেয়ার করো? আর বিয়ের এতগুলি বছর পর এসব কথা আমার শুনতে ভালো লাগে না একদম।

– তোমার থেকেও কী তবে এজন্য এমন দূরে রাখছ আমাকে?

– রুম্পা , তুমি কিসের সাথে কী মেলাও? তুমি এটা তো অস্বীকার করতে পারবে না যে আমাদের সাথে তোমাদের স্ট্যাটাস কোনো দিক দিয়েই যায় না। তাহলে সেটা নিয়ে আবার কেন এত অবুঝের মতো করছ? তুমি আমার স্ত্রী! তোমার সব দায়িত্ব আমার। তোমার কোনো কিছুর অভাব কি আমি রাখছি? চাওয়ার আগেই সবকিছু পেয়ে যাচ্ছ না? কখনও তোমার কোনো কিছুতেই আমি আপত্তি করি না। যখন যেটা চাচ্ছ সেটাই পাচ্ছ। তোমার সাথে কখনো কিছু নিয়ে বিবাদ বা কথা কাটাকাটিই কি করছি আমি? তাহলে অসম্মানটা হয় কী করে? দূরেই বা রাখলাম কোথায়?

সেলিমের কথা শুনে আমি আর কোন উত্তর দিতে পারিনি। দরদর করে বেয়ে পড়া চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছি। ঠিকই তো সেলিমের মত ভালো স্বামী আমি কই পাব? আমার কিছুতেই তার আপত্তি নেই। কোনোদিন কিছু নিয়েই সে প্রশ্ন তোলে না। আমি তো সুখের সাগরে ভাসছি। পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষটা আমি। একই ছাদের নিচে থাকি দু’জন মানুষ । কেউ কারো ভালোমন্দ খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করি না। আজ আমি এটাও ক্লিয়ার হলাম যে সেলিমের পরিবারের মতো সেলিমও আমাকে তার যোগ্য মনে করে না। মাসান্তে সেলিম আমার একাউন্টে ব্যালান্স ট্রান্সফার করেই দায় মুক্ত। এর অতিরিক্ত কিছু লাগলেও সেলিমকে জানানো মাত্র পেয়ে যাই। এত পাওয়ার পরেও নিজেকে কেন সুখী ভাবতে পারি না আমি?

সকালের খাবার টেবিলে সেলিম খুব ব্যস্ত থাকে। কোনোরকম হালকা কিছু খেয়েই বেরিয়ে যায়। আজও একই রকম । খুব তড়িঘড়ি করছে। আমার সাথে সকালে একদমই কথা হয় না এ সময়। চলে যাচ্ছে ঠিক তখন পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম,
“ আমি প্রিয়কে হোস্টেল থেকে নিয়ে আসতে চাই। একা একা আমার একদমই ভালো লাগে না। এসব ক্যাডেট ফ্যাডেট পড়ে কী হবে? ওর বাপ দাদার কী কম আছে যে চাকরি করে খেতে হবে!”

সেলিমের পা যেন আটকে গেল।

“ জীবনটা শুধু অর্থের মাপকাঠিতে মেপেই চলে না। ওর আগ্রহ হয়েছে ও পড়ুক। আর পড়লেই জব করতে হবে এ কথা কেন ভাবছ? আমার ছেলের কোনো স্বপ্ন অপূর্ণ থাকুক আমি চাই না। তখন তো কিছুই বললে না। এখন এসব বলার কোনো অর্থ হয় না। আমি গেলাম।“

তার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে শুধু ভাবছি , আমি তো এমন জীবন চাই নি। যে সেলিমকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম সেই সেলিম আর এখনকার সেলিমের মাঝে বেশ পার্থক্য!
সেলিমের কাছে কিছু চাইলে সাথেসাথেই পেয়ে যাই। কিন্তু সেলিমকে পাই কি? নিজের কাছে নিজে এমন নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছি। সেলিমও হয়তো তার পরিবারের মতই এই সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য হীণমন্যতায় ভুগছে। এত ভালোবাসা, এত ওয়াদা সব তবে মিথ্যে? সেলিম আমাকে প্রতিনিয়ত ঠকাচ্ছে। একসাথে দু’জন শেষ কবে বাইরে গিয়েছি মনে পড়ে না। হ্যা , কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের একসাথে যাওয়া হয়। কিন্তু নিজেদের জন্য একান্ত সময় কাটাবার মত সময় কখনো তার কাছে চেয়ে আমি পাইনা বহু বছর। তাই এখন আর এ সবের আশাই করি না।

চলবে…..

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২

বান্ধবীদের কাছে আমার সমস্যার কথা বলতে গেলে ওদের একটাই কথা, “খবর নিয়ে দেখ তোর জামাই অন্য মেয়ের সাথে টাংকি মারে কি না।” কিন্তু কেন যেন আমার সেটা বিশ্বাস হয় না। সেলিম কাজ পাগল মানুষ। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে ভালোবাসে। তারপরেও সবার কথা শুনতে শুনতে কেন যেন একটু নিজের মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল।নানান ভাবে জানতে চেষ্টা করলাম আসলেই সেলিম অন্য কাউকে পছন্দ করে কি না! কিন্তু তেমন কিছু পেলাম না। তবে ওই যে মনের মধ্যে সন্দেহের বীজ দানা বেঁধেছে তাই কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছি না। সেলিমের অবহেলার কথা মনে পড়লেই মনে হয় সত্যিই সে হয়তো অন্য কোন নারীর প্রেমে আসক্ত।
সত্যিই যদি আসক্ত হয় আমার কিছু করার থাকবে না। সেলিমের আর আমার মাঝে এখন বিশাল তফাৎ। দুইজন যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। বয়সটা তো কম হলো না। তাই এখন আর এসব ভাবতেই পারি না।

কান্তা নামে একজন বান্ধবী আছে। ওর সাথে কয়েকদিন ক্লাবেও গিয়েছি নিয়মিত। হতাশা কাটিয়ে উঠতে আর সময় কাটাতে এসব জায়গার জুড়ি মেলা দায়। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাবে বসে তাস খেলে কাটিয়ে দিচ্ছি আমরা। নতুন নতুন আরও অনেক ফ্রেন্ড সার্কেল হয়ে গেল। সবার মধ্যেই কোন না কোন হতাশা কাজ করছে। তবে আমি মনে হয় সবার থেকে আলাদা। সবার মাঝেই না পাওয়ার কষ্ট। ধীরে ধীরে এদের মাঝে আমিও কেমন যেন মিলিয়ে যেতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই দেখলাম এটা খুবই খারাপ অভ্যাস।আমি আসক্ত হয়ে যাচ্ছি এসবের মাঝে। এখান থেকে এখনই বের হতে না পারলে ভবিষ্যতে হয়তো আরও বেশি নরক যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এসব থেকে বাঁচার জন্য উপায় খুঁজছিলাম।
হঠাৎ মনে হল কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে থেকে বেরিয়ে আসা যায়।

আমার আরেক ফ্রেন্ড নীরা, ও মাঝেমাঝেই দেশের বাইরে যায়। হাজব্যান্ড আর বাচ্চাদের নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ওর বাসা আর ওর মায়ের বাসা একি বিল্ডিংয়ের জাস্ট উপর-নিচে হওয়ায় ও বাচ্চাদের নিয়ে একদম চিন্তা মুক্ত। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ায় সে। তার হাজবেন্ড বলতে বলতে এখন ক্লান্ত। এখন আর কিছুই বলে না। নীরা ছোটবেলা থেকেই ডেয়ারিং স্বভাবের। দেখতে শুনতে মোটামুটি হলেও নিজের স্মার্টনেস দিয়ে যেটুকু ঘাটতি সেটুকু ঢাকার প্রচেষ্টা তার আজীবনের। জীবনে কয়েক ডজন প্রেম করে পরে বিয়ে করেছে মা বাবার পছন্দে। নীরার হাজবেণ্ড খুবই সরল আর ভদ্র। বিয়ের পরেও নীরার শোধরানোর কোনো নাম নেই। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। আদরে আদরে বাদর হলে যা হয়। লাইফটাকে কখনই সিরিয়াসভাবে নেয়নি। যখন যেখানে মনে চায় সেখানেই চলে যায়, রাত করে বাসায় ফিরলেও কারো কাছে জবাবদিহি করতে সে নারাজ। বিয়ের পরপরই ছেলেটা কন্সিভ করে। ছেলেটাকে কোনো রকম পেট থেকে বের করেই সে আবার সেই একই রকম। মায়ের ঘাড়ে বাচ্চার দায়িত্ব দিয়ে সে কর্পোরেট জগতে ঢুকে যায়। কাউকে কেয়ার করার সময় তার নেই। নীরার হাজবেন্ড ছাপোষা ঘরের সন্তান। তার কাছে প্রথম থেকেই নীরার আচরণ দম বন্ধ করার মতো মনে হলেও বাচ্চাটার কথা ভেবে নিজের জীবন কোরবানি দিতে প্রস্তুত হয়। ছেলে জন্মের পরপরই স্থায়ীভাবে মা বাবার সাথে এসে থাকছে নীরা। একসময় তো আসতেই হতো। তার বাবার নিজের বাড়ি মিরপুরে। ছেলের জন্মের ঠিক দেড় বছরের মাথায় ওর মেয়ের জন্ম। বাচ্চাদের নিয়ে তার কোনো আহ্লাদিপনা নেই। ছেলেমেয়ে দুইটার দায় দায়িত্ব বাবা, মা আর হাজবেন্ডের ঘাড়ে চাপিয়ে সে মুক্ত বিহঙ্গ। নীরার হাজবেন্ড এখন ছেলেমেয়ে দুইটার দিকে তাকিয়ে সব মেনে নেয়। নীরার কাছ থেকে সে কী পাবে এটা বোঝা হয়ে গেছে। বাচ্চা দুটিই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তবে নীরার মা বাবা নীরার হাজবেন্ডকে জামাইয়ের থেকে ছেলের চোখেই দেখে বেশি। মেয়ের এমন আচরণে তারাও বিরক্ত। ভেবে ছিল বিয়ের পরে হয়তো নীরা বদলাবে কিন্তু তাদের ভাবনা আর সত্যি হলো না। নীরা নীরার মতোই রয়ে গেল। নীরার হাজবেন্ড নিতান্ত ভালো মানুষ বলে এগুলি সহ্য করে ওকে মেনে নিয়ে এখনো সংসার টিকে আছে। অন্য কোনো পুরুষ হলে কবেই ওকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যেত। শুধুমাত্র বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরার সাথে এখনো সংসার করছে। সবকিছুকে নিজের ভাগ্য বলে সে মেনে নিয়েছে। নীরা যা খুশি করে এ নিয়ে এখন একদমই প্রশ্ন তোলে না সে। নীরাকে ওর হাজবেন্ড বা মা, বাবার কাছে কিছুর জন্যই হাত পাততে হয় না । ও ওর নিজের মতো করেই খরচ করে। ওকে দেখলে মনেই হয় না যে ওর ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে আর মেয়ে ক্লাস এইটে। চলাফেরা এখনও একদম সেই টিনেজদের মতো। ওকে নিয়ে আমরা কত যে হাসাহাসি করি কিন্তু এদিকে ওর কোন খেয়ালই নেই। আড্ডা মাস্তি , ক্লাব সবই চলে দেদারসে।

স্কুল লাইফ থেকে একসাথে পড়াশুনা করেছি আমরা । ওকে সারাজীবন কিছুটা এভয়েড করে চলার চেষ্টা করেছি। আম্মু একদমই পছন্দ করতেন না ওকে। কিন্তু ও মানুষ হিসেবে যেমনই হোক বন্ধু হিসেবে বেশ ভালোই। মাঝখানে বেশ কিছুদিন ওর সাথে খুব বেশি যোগাযোগ না থাকলেও হঠাৎ করে ইদানিং আবার খুব যোগাযোগ বেড়ে গিয়েছে। প্রায়ই আড্ডা হয় , কথা হয়। ক্লাবে যেয়েই মূলত ওর সাথে সম্পর্কটা ভালো হয়েছে আগের থেকেও। আমার কষ্টের কথাগুলি খুব মনোযোগ দিয়ে সে শুনে। ইদানীং আমার খুব ভালো লাগে এজন্য ওকে। কোথাও তো তবু কষ্টের কথা বলতে পারি।

ও আমাকে বলল ওর সাথে কিছুদিন বাইরে থেকে ঘুরে আসলে আমার মন ভালো হবে। নেক্সট মাসে নীরার তিন দিনের ছুটি আছে। সেই সাথে আরো দুদিন ছুটি বাড়িয়েছে। সে ব্যাঙ্ককে যেতে চায়। ওর হাজব্যান্ড বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এ বেশ বড় পোস্টে জব করে । তাই ওর টিকেট পাওয়াটা খুব সহজ। বেশিরভাগই ফ্রী টিকেটে ঘোরাঘুরি করে। এজন্যই দেশের বাইরে যাওয়াটা ওর জন্য খুব সহজ। আমিও ওর প্রস্তাব লুফে নেই। কিছুদিনের জন্য হলেও মনটাকে ভালো করে আসা যাবে।

আমি ব্যাংককে যেতে চাই এ কথা শুনে সেলিম কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না সে হ্যাঁ বলবে নাকি না বলবে!
আমার আগ্রহ বোঝার জন্য হয়তো সে খানিকটা অপেক্ষা করছিল উত্তর দেবার জন্য।
কোনও উত্তর দিচ্ছে না দেখে আমি আবার বললাম,

– কি ব্যাপার কিছু বলছ না যে?

– এত দূরে যাবে তাও একা একা । তুমি সামলাতে পারবে?

– কেন পারব না? আমি তো কোনো বাচ্চা নই! তাছাড়া নীরা যাচ্ছে তো। আমি একা কোথায়?

– নীরা মানে তোমার ক্লাবের বান্ধবী, তাই না!

– ক্লাবের ঠিক না। ওকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। আগে সম্পর্কটা তত ভালো ছিল না। ক্লাবে যাবার পরে আমাদের সম্পর্কটা মজবুত হয়েছে। ও আর আমি একসাথেই পড়াশুনা করেছি ছোট থেকেই।

– তোমার কি মনে হয় তুমি ম্যানেজ করতে পারবে? যদি পারো, দেন যাও। আই হ্যাভ নো প্রবলেম।

সেলিমের অনুমতি পেয়ে আমার খুশি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কেন যেন আমি খুশি হতে পারছিলাম না। সেলিম তো একবারের জন্য হলেও বলতে পারত “নীরার সাথে তোমার যেতে হবে না, তোমার ব্যাংককে যাবার ইচ্ছে হয়েছে, আমি তোমাকে নিয়ে যাব। ”
নাহ ,সেলিমের কাছে এতটুকু আশা করা খুব বেশি হয়ে গেল।

নীরার সাথে চলে এলাম ব্যাংককে। নীরা আগে ব্যাংকক এলেও আমার জন্য এই প্রথম। থাইল্যান্ড সময় ভোর পাঁচটায় আমরা ব্যাংককের ডনমুয়েং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছাই। সিদ্ধার্থ নামের এক ছেলে এসে আমাদের ওয়েলকাম করল। সিদ্ধার্থের ভাষা শুনে আন্দাজ করার উপায় নেই যে সে পশ্চিমবঙ্গের । কথাবার্তার ধরণ একদম বাংলাদেশীদের মতই। সিদ্ধার্থের কথা আমাকে নীরা আগেই বলেছিল। দেখতে শুনতে খুব হ্যান্ডসাম। বলিউডের হিরোদের মত লুক। তাই বয়সটা ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না। আমাদের থেকে খানিকটা ছোট হবে এটা ঠিকই আন্দাজ করতে পারছি। সহাস্যে কথা বলছে পুরোটা সময় ধরেই। এমন ছেলেকে দেখে যে কোনো কিশোরী এক চান্সে প্রেমে পড়ে যাবে। হৃদয়ে ঝড় তোলার মতই সুদর্শন সে। নীরা ওর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। সিদ্ধার্থের বেড়ে ওঠা বাংলাদেশেই। ওর মামারা নীরাদের বাসাতেই ভাড়া থাকত সেই সুবাদে নীরার সাথে বেশ আগে থেকেই পরিচয় তার।
সিদ্ধার্থ এখানে কী নাকি ব্যবসায় করে। আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে সে চলে গেল। হোটেলে পৌঁছে আমি অবাক। চল্লিশ তলা একটা হোটেলে উঠেছি আমরা।

হোটেলে পাশাপাশি রুম আমাদের। আমি ভেবেছিলাম এক রুমেই থাকব। কিন্তু নীরা বলল, ঘুরতে এসে কিছুটা প্রাইভেসিরও দরকার আছে। দু’জন দু’জনের মতো থাকাটাই বেটার। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। ভেবেছিলাম পুরো সময় ওর সাথে গল্প করে কাটানো যাবে। এখানে এসেও যদি সেই একাই থাকতে হয় তবে আর লাভ কী হলো? কিন্তু যেহেতু নীরা একা থাকতে পছন্দ করে তাই আর কথা বাড়ালাম না।

রুমে এসে মনে হলো সেলিমকে জানানো দরকার আমরা পৌঁছেছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হলো ও এখনো হয়তো ঘুমাচ্ছে তাই আর ফোন না দিয়ে একটা মেসেজ করে রাখলাম।

” সেইফলি রিচড”!

সকাল দশটার দিকে আমরা বের হলাম ব্যাংকক শহর ঘোরার উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ‘দ্যা রয়্যাল গ্র্যান্ড প্যালেস’! গেটে পৌঁছাতেই দেখি সিদ্ধার্থ আছে সেখানে। বুঝতে পারলাম আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। থাই রাজার বাসভবন এই গ্র্যান্ড প্যালেস। খুব সুন্দর জায়গা। প্রসাদের মাথা থেকে সোনা যেন গলে গলে পড়ছে। আমাদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে সিদ্ধার্থ! নীরাকে কিছুই দেখাতে বা বলতে হচ্ছে না। একাই আগে আগে হাঁটছে আর সবকিছু খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে। সিদ্ধার্থ মূলত আমাকেই সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে।
প্রথম কিছুটা অস্বাভাবিক লাগলেও সিদ্ধার্থের বন্ধুসুলভ ব্যবহারে আমি স্বাভাবিক হয়ে যাই দ্রুত।

– আপনি শাড়ি পরতে খুব ভালোবাসেন মনে হচ্ছে?

এ ধরণের প্রশ্নের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তাই কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে উত্তর দিলাম,

– না… মানে… হ্যা…আমার প্রিয় পোশাকই বলা চলে। কেন বলুন তো!

– আপনার ফ্রেন্ড তো জিন্স আর টি শার্ট পরেছে, তাই বললাম। ঘুরতে আসলে সবাই বেশিরভাগই এ ধরণের কমফোর্টেবল ড্রেস পরে কিন্তু আপনি ব্যতিক্রম তাই বললাম।

– না…. মানে…. আমি ওসবে অভ্যস্ত নই। তাছাড়া ও ধরণের পোশাক আমাকে মানাবেও না। নীরার জন্য ঠিক আছে। ও এখনো বেশ পার্ফেক্ট আছে।

– কে বলেছে আপনাকে মানাবে না? আপনি যথেষ্ঠ পার্ফেক্ট। এত সুন্দর মেদহীন টল ফিগার! যে ড্রেসই পরবেন মানিয়ে যাবে। আমার চোখে তো আপনি আপনার ফ্রেন্ডের থেকেও পার্ফেক্ট! তবে সত্যি কথা বলতে শাড়িতেই আপনাকে বেশি মানাচ্ছে মনে হচ্ছে। দূর থেকে আপনার ফিগার আর চেহারার গড়ণ দেখলে যে কেউ সুস্মিতা সেন ভেবে অবাক হবে! এয়ারপোর্টে তো আমার ভাবনায় প্রথমে হোঁচট দিয়েছিলেন আপনি। আমি সুস্মিতা সেনই ভেবেছিলাম দূর থেকে দেখে।

সিদ্ধার্থের কথা শুনে আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। কিন্তু এই লজ্জার মাঝেও যেন কী এক ভালো লাগা কাজ করছে। ব্যাপারটা অনুধাবন করে আমি খুব অবাক হলাম। সিদ্ধার্থের কথায় আমি রাগ না করে বরং কেমন হাসি হাসি মুখে তার কথাটি রিসিভ করছি।
সেলিম এমন করে কবে আমাকে দেখেছে মনে পড়ে না। কখনও আমি কী ড্রেস পরলাম , না পরলাম, আমাকে কেমন লাগছে এগুলি নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। প্রথমে খুব আশা করতাম ওর একটা কমপ্লিমেন্টের কিন্তু এখন আর ওসব মাথাতেই আসে না।

সেখানে ঘুরতে ঘুরতে বেশ বেলা হয়ে গেল এরপর আশেপাশের আরো কয়েকটা বৌদ্ধমন্দির রয়েছে সেগুলো বেশ নান্দনিক এবং দার্শনিক সেখানেও নিয়ে গেল আমাদের সিদ্ধার্থ। সন্ধ্যার দিকে চলে যাই শপিংমলে। আমাদেরকে মলে রেখে সিদ্ধার্থ চলে গেল। বেশ কিছু কেনাকাটা করলাম আমি আর নীরা।

রাতের নিয়ন আলোয় ব্যাংকক শহর এক ভয়ানক মায়াবী শহর। আকাশ ছোঁয়া হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে নিচের পৃথিবীকে এক অদ্ভুত সুন্দর রূপে দেখছি। গভীর রাতে হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে ভাবছি এ এক আজব শহর। সবাই শুধু ছুটছেই। গভীর রাতে গতি যদিও কিছুটা স্লথ আর শান্ত। চারপাশে তাকিয়ে ভাবছি আর কতগুলি উঁচু উঁচু বিল্ডিং হলে এর পাশে বয়ে চলা চাও ফ্রায়া নদীর জল শেষ হবে?
সেলিম কে খুব মিস করছি। এখন যদি সেও আমার পাশে থাকত! দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাত ধরে উপভোগ করতাম রাতের এই নৈসর্গিক আর মায়াবী সৌন্দর্য।
সারাদিনে মাত্র একবার কথা হয়েছে সেলিমের সাথে তাও মাত্র দু’মিনিটের মত। এরপরে সেলিমও আর ফোন দেয়নি আমিও আর দেই নি।
আপনা আপনিই চোখ জোড়া ভিজে আসছে। এই সুউচ্চ ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে ভাবছি চারদিকে এত এত মানুষ । অথচ আমার জন্য ভাববার মত একজন মানুষও কী নেই। ছেলেটাকে খুব মনে পড়ছে। আসার কথা ওকে বলে আসিনি। ওর কষ্ট লাগবে তাই। আমিও আজকাল খুব পাষণ্ড হয়ে যাচ্ছি। নিজের এত পরিবর্তন কখন হলো ভাবতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। আমাদের ডিনারের আয়োজন আজ ছাদেই। ডিনার শেষে বেশ রাতে রুমে আসলাম। রুমে এসে নিজে থেকে সেলিমকে ফোন দিলাম। দু’বার রিং বাজতেই সে রিসিভ করল।

– হুম, কেমন লাগছে ব্যাংকক শহর?

– খুব মায়াবী।

– দেখো মায়ার টানে যেন আবার থেকে না যাও।

– থাকলে কী খুব খারাপ কিছু হবে?

– থাকতে চাইলে তোমার স্বাধীনতায় তো হস্তক্ষেপ করতে পারি না। তবে দেশে যে একজন স্বামী আর একটা ছেলে রেখে গেছ সেটা একটু মাথায় রাখলেই চলবে। আসা না আসা তোমার ব্যাপার। কিছুটা ঠাট্টার সাথেই বলল , সেলিম।

এরপর এই টুকিটাকি দু’চারটা কথাবার্তা বলে ফোন রাখলাম। ঘুমই আসছে না। ফোন হাতে নিয়ে ফেইসবুকে ঘাটাঘাটি করছি। নোটিফিকেশানে দেখলাম একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছে। ওপেন করতেই দেখলাম সিদ্ধার্থ! একটু এদিক সেদিক ভেবেই এক্সেপ্ট করে ফেললাম।
সাথে সাথেই মেসেঞ্জারে টুং করে উঠল। মেসেঞ্জার ওপেন করতেই দেখলাম তার মেসেজ।

– চিনতে পেরেছেন তবে! ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করার জন্য ধন্যবাদ।

– চিনবো না কেন? কিছুক্ষণ আগে তো আপনার সাথে থেকে এলাম। এতটা ভুলোমন এখনো হয়নি।

– হা হা। কেমন শপিং হলো আজ?

– হুম , খুব ভালো। কী করছেন? এত রাতে ঘুমান নি?

– নাহ! আপনিও তো ঘুমান নি।

– আমি না হয় হাজবেন্ড আর ছেলের কথা ভাবছি । আপনিও কী বউ বাচ্চাকে ভাবছেন?

– হা হা! সাত পাঁকে না ঘুরতেই বউ বাচ্চা কই পাবো? কেউ রেডিমেড দিলে অবশ্য মন্দ হতো না।

– এসব জিনিস রেডিমেড পাওয়া যায় না। আচ্ছা, আমার আইডি লিংক কই পেলেন?

– আপনার ফ্রেন্ডের থেকে। ওর সাথে মাত্র কথা বলে আপনার আইডি লিংক পেলাম। ভুল হয়ে গেল কি?

– না না, ঠিক আছে।

– কাল কখন রওয়ানা হবেন পাতায়ার উদ্দেশ্যে?

– এই তো ! নীরা বলল, দুপুরের দিকে। আপনি যাবেন নাকি আমাদের সাথে?

– ইচ্ছে তো আছে যদি সুন্দরীদের আপত্তি না থাকে।

– কী যে বলেন! সুন্দরী আবার কে?

– নিজেকে বুঝি আয়নায় বহু বছর দেখেন নি!

– হা হা! আপনি যা বলেন না। আচ্ছা, আমাদের সাথে গেলে আপনার ব্যবসায়ের ক্ষতি হবে না?

– সারাবছরই তো বিজনেস করি। আপনাদের জন্য না হয় দু’চারদিন বন্ধ থাকবে । অসুবিধা কি! সব সময় টাকার পেছনে ছুটলেই কী চলবে? মাঝেমাঝে এমন সুন্দরীদের জন্য জীবনের কিছু মুহূর্ত যদি আলাদা করে কাটানো যায় সেটা স্মৃতির পাতায় আলাদা একটা জায়গা হয়ে থাকবে। নীরার কোনো আপত্তি নেই। আপনি যদি কোনো ধরণের হেজিটেট ফিল করেন দেন আমি যাব না। আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।

– আরে না! হেজিটেট ফিল করার কী আছে? আপনি থাকলে বরং আমাদের জন্য ভালোই হয়। আমার জন্য বিশেষ করে। আমার জন্য একদমই অচেনা পরিবেশ। সাথে আপনি থাকলে কিছুটা সাহস পাব। কাল তবে দেখা হবে।

– কালও কী শাড়ি পরেই যাবেন?

– হুম। আমি শাড়িতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তবে বীচে অবশ্যই শাড়ি পরছি না। হা হা।

– গ্রেট! আমিও আপনাকে শাড়ি পরাই দেখতে চাচ্ছিলাম। চারপাশের সবার থেকে আপনাকে আলাদা লাগুক আমিও সেটাই চাই।

– কেন বলুন তো!

– জানি না। কিছু কেনর উত্তর হয় না। তবে শুধু এটুকু বলব , সেই এয়ারপোর্টে প্রথম দেখা আপনাকে কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছি না। এত মায়াবী চেহারা। অপূর্ব!
যদি কিছু বেশি বলে ফেলি ক্ষমা করবেন। তবে সুন্দরকে সুন্দর বলার অপরাধে যে শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিতে রাজি আছি।

– হা হা! আপনি হলেন কথার জাদুকর। আপনার সাথে কথায় পারা আমার সাধ্য নয়। আচ্ছা, কাল তবে দেখা হবে। আজ রাখছি। ভালো থাকবেন।

– আপনিও!

সিদ্ধার্থের সাথে কথা শেষ করে আমি অবাক হলাম । সিদ্ধার্থ আমাকে এমন কিছু কথা বলেছে যেগুলি ওর বলা উচিত হয়নি। অথচ আমি অনায়সে সেগুলি শুনে গেলাম আর তাকে বাহবা দিয়েই গেলাম। আমার অবচেতন মন কি তবে এমন কিছুই আশা করছিল সিদ্ধার্থের কাছ থেকে? খুব বেশিই অবাক হলাম নিজের এমন পরিবর্তনে।

পরদিন সকাল বেলা মাদাম তুসো মিউজিয়াম আর সি লাইফে খানিক সময় কাটিয়ে দুপুরের দিকে তিনজনে ট্রেনে রওয়ানা হলাম পাতায়ার উদ্দ্যেশ্যে।
বিকেল পাঁচটার দিকে আমরা পাতায়া এসে পৌঁছলাম।

চলবে…