সুখের সন্ধানে পর্ব-৩+৪

0
497

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩
সিদ্ধার্থের সাথে নীরার এত ঢলাঢলি আমি কেন যেন মেনেই নিতে পারছিলাম না । যদিও ওদের হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সিদ্ধার্থের সাথে নীরার সম্পর্ক কোন পর্যায়ের হতে পারে। রাতে হোটেলে ফিরে এ ব্যাপারে আমি নীরার সাথে কথা বলার জন্য ওর রুমে গেলাম। আমি যে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেইনি এটা নীরা বুঝতে পারার পরেও কোনো কিছুই মনে করছে না। সে তার মতোই চলছে। এটা দেখে আমার আরো রাগে গা জ্বলছে।
আমি রুমে যেতেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নীরা আমার মনের কথা বুঝতে পারল।

– আমি জানি তুই কী জিজ্ঞেস করতে এসেছিস? সিদ্ধার্থের ব্যাপারে কথা বলবি তো! তোকে শুধু এটুকুই বলব যে সিদ্ধার্থ আমার খুব ভালো বন্ধু!

– ভালো বন্ধু? এ কেমন ভালো বন্ধু?
তুই ম্যারিড। এত বড় বড় দুটো বাচ্চা আছে। তা স্বত্তেও এসব করছিস?

– এই যে আমাদের সমাজের নিয়ম! বড় বড় বাচ্চা আছে, ম্যারিড! তার মানে জীবনটাকে সারা জীবন এই ছকে বাঁধা নিয়মের মধ্যেই আমাকে চালাতে হবে তাই তো? সে জীবন ভালো লাগুক আর না লাগুক। জোর করে আমি কোন কিছু করতেই পছন্দ করি না। আমাদের সমাজ কী বলবে বা তোর মত ফ্রেন্ডরা কী বলবি আই ডোন্ট কেয়ার! ম্যারিড বলে কী জীবনে শখ আহ্লাদ নেই আমার?
জীবনটা ক্ষণিকের। ক’দিন বাদেই মরে যাব। তাই যতটুকু এঞ্জয় করা যায় ততটুকুই লাভ। বাচ্চা জন্ম দেয়া দরকার তাই দিয়েছি। তাই বলে কি আমি বুড়ি হয়ে গেছি? আমার চাওয়া-পাওয়ার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমি একজন স্বাধীন মানুষ। একজন অ্যাডাল্ট মানুষ। আমি বুঝি আমার জন্য কী ভালো, আর কী ভালো না।

– প্লিজ! এসব কী বলছিস? তুই নাহিদ ভাইকে ঠকাচ্ছিস! একবারও উনার কথা ভেবেছিস? আর আমাদের কী এখন সেই বয়স আছে? আমরা আজ বাদে কাল মা থেকে শাশুড়ি হব। এখন এসব আমাদের সাথে মানায় না।

– দেখ, তোকে সাথে এনেছি তোর একাকিত্বের কষ্ট দেখে। একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে। তুই তোর মত এঞ্জয় কর আমাকে আমার মত থাকতে দে। তোর মত মেন্টালিটি হলে আমাকেও এভাবেই কষ্ট পেতে হতো সারাজীবন। আমি লাইফটাকে ফুললি এঞ্জয় করতে চাই। আর প্লিজ, এসব কথা আবার দেশে যেয়ে জনে জনে বলে বেড়াস না। অবশ্য তাতে খুব
বেশি প্রবলেম হবে না আমার।
আর কোন কথা না থাকলে তুই এখন যেতে পারিস। সারাদিন আজকে অনেক জার্নি হয়েছে তার উপর ঘোরাঘুরি হয়েছে খুব। তোকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে ঘুমিয়ে পড় যেয়ে।

– আমাকে তাড়াতে চাচ্ছিস মনে হয়?

– কিছুক্ষণ বাদেই সিদ্ধার্থ আসছে। আজ এখানেই থাকবে। আজই কেন যে ক’দিন আছি সিদ্ধার্থ আমার সাথেই থাকবে। এটা নতুন নয়। সিদ্ধার্থকে আমি সেই ছোট থেকেই পছন্দ করি। ও আমার দুই ক্লাস জুনিয়র ছিল। তাই তখন সাহস করে আসলে আগে ওকে কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। সেই ভালোলাগা থেকেই মূলত ওর সাথে আমার রিলেশনটা শুরু।

নীরার কথা শুনে আমার গায়ের মধ্যে ঘিনঘিন করে উঠল। ও নির্লজ্জ জানতাম কিন্তু এতটা জানতাম না। ওর সাথে আসাটাই বুঝি ভুল হয়ে গেছে।

– নীরা, তুই কি মানুষ? নাহিদ ভাই কী কোনো অংশে এই সিদ্ধার্থের থেকে কম কিছু?

– দেখতে শুনতে ভালো হলেই সে ভালো হয় না। তোর নাহিদ ভাই তো একটা নপুংসক। বউয়ের চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা উনার যে কোনোকালেই হবে না সে আমি ফার্স্ট নাইটেই টের পেয়েছি। আচ্ছা, বাদ দে! এসব লেকচার দেয়া বন্ধ কর আর নিজের জীবনটাকে এঞ্জয় করতে শেখ৷ এই সতীসাধ্বী থেকে কোনো লাভ নেই। সারাজীবন আনলিমিটেড পেইন সহ্য করার কোনো মানে হয় না। মুক্ত বিহঙ্গের মত ডানা মেলে একটু নীল আকাশে বেরিয়েই দেখ তখন বুঝবি জীবনের আসল মানে! এভাবে ধুকে ধুকে আর কতো বাঁচবি?

– আমরা বাচ্চা নই, নীরা। তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। তোর এসব কুকীর্তির কথা কারো কাছে আমি বলতে যাব না । আমাকে উল্টাপাল্টা জ্ঞান না দিয়ে নিজের শোধরানোর চেষ্টা কর। আমি আবারো বলছি, তুই নাহিদ ভাইয়ের মত এমন একজন ভালো মানুষকে এভাবে ঠকাস না। সে তোকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। তোকে ভালোবাসা বলেই হয়তো যেখানে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়। আর তুই এভাবে তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবি?

– এই যে তোদের মত সো কল্ড শাবানা টাইপের মেয়েদের জন্যই আজকাল মেয়েদের কপালে এত দুর্দশা! এসব বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ভালোবাসা এগুলো হচ্ছে ঠুনকো কাচের মতো। এগুলি নিয়ে আই ডোন্ট হ্যাভ এনি হেডেক।

– ঠিকই বলেছিস। এগুলো কাঁচের মতই। যত্ন করে ব্যবহার করলে সারাজীবন পার হয়ে যাবে আরেকটু অযত্ন হলেই ভেঙে খানখান হতে হতে মুহূর্ত সময় লাগবে না । নাহিদ ভাই যখন এগুলো জানবে তখন তুই বুঝবি জীবন কাকে বলে।

– নাহিদ সবই জানে। আমাদের সম্পর্কটা শুধুমাত্র কাগজে-কলমে টিকে আছে। এর কারণ আমাদের ছেলে মেয়ে দুটো। আজকাল অহরহ ছেলেরা বিয়ের পরে এমন এক্সট্রা রিলেশনে জড়িয়ে থাকে। সেগুলো যদি ঘরের বউয়েরা বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে, সংসারের দিকে তাকিয়ে মেনে নিতে পারে তাহলে হাজবেন্ডরা কেন ঘরের সুখ শান্তি বজায় রাখার জন্য ওয়াইফেরটা মানতে পারবে না? নাহিদের কথা বললি না যে ভালো! হ্যাঁ আমি অস্বীকার করবো না। সে মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো। ও আসলেই ভালো। এসব কিছু নিয়ে প্রথমে অনেক ঝামেলা করলেও এখন একদম বুঝে গিয়েছে। এখন সে বোঝে এগুলো নিয়ে ঝামেলা করলে সংসারে শুধু অশান্তিই বাড়বে কোনো সমাধান আর হবে না। আচ্ছা বাদ দে, তুই আমাকে এসব জ্ঞান দেয়া বন্ধ করে নিজের জীবন নিয়ে ভাব। প্লিজ, তোর রুমে যা।

রাগে গজগজ করতে করতে ওর রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
সারারাত আর চোখে এক ফোঁটা ঘুম এলো না। নীরার কথা শুধু ভাবছি মানুষ এমনও হয়? অবশ্য হলে দোষেরই বা কী? এটা ওর জীবন। ওর জীবন নিয়ে ও যা খুশি তাই করতে পারবে। আমি সেখানে বলার কে? সেলিমের সাথে রাতে কথা হলো না। আমি শুধু ভাবছি ওর কি আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না? ওতো আমাকে একটা ফোন দিতে পারে। এখানে আসার পর যে কয়বার ওর সাথে কথা হয়েছে ফোন আমিই দিয়েছি একবারের জন্যও সেলিম মনে করে আমাকে ফোন দেয়নি। তাই রাগ করে আমিও আর ফোন দিলাম না তাকে।
এপাশ-ওপাশ করতে করতে গভীর রাতের দিকে কখন ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পেলাম না।

পরের দিন সকালে দরজায় বারবার নক করার শব্দে ঘুম ভাঙল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা তখন সাড়ে ন’টা। ভাবলাম নীরা হয়তো নক করছে। তড়িঘড়ি করে উঠে দরজা খুললাম।

দরজায় দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থ। তাকে দেখে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমি এখনও স্লিপিং গাউন পরা অবস্থায়ই আছি।

– কি ব্যাপার ভিতরে আসতে বলবেন না?

– না… মানে… মানে! ঠিক আছে, আসুন।

– ভয় পাচ্ছেন কি?

– না, না, তা কেন? আসুন না।

– এখনো ফ্রেশ হবার সুযোগ পাননি মনে হচ্ছে।

– নাহ। মানে কাল রাতে ঘুম আসছিল না। তাই উঠতে একটু লেট হয়ে গেল। আমি ভাবলাম নীরা এসেছে হয়তো। এভাবেই চলে এলাম।

– ঘুম আসছিল না কেন? ভাইয়ার কথা মনে পড়ছিল কি খুব?

– আরে না । তেমন কিছু না। অন্য একটা বিষয় ভাবছিলাম। কিছুটা চিন্তিত ছিলাম তাই ঘুম আসছিল না।

– ঘুম থেকে উঠার পর আপনাকে দারুণ লাগছে এই লুকে। ফ্রেশ ফ্রেশ লুক।

– থ্যাংক ইউ!

– ব্রেকফাস্টের জন্য নিচে যাব তাই আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম। নীরা ফ্রেশ হচ্ছে। ওর সময় লাগবে তাই একা বোর লাগছিল। আমি আবার ঘুম থেকে ওঠার ব্যাপারে টু মাচ পাংচুয়াল। ঘুম ভেঙে যায় খুব তাড়াতাড়ি। হা হা। ফ্রেশ হয়ে নীরাকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে আপনার খোঁজ নিতে আসলাম।

সিদ্ধার্থকে দেখার পর থেকে আমার মনের মধ্যে শুধুশুধু খচখচ করছিল। গতরাতের নীরার কথাগুলি বারবার মনে বাজছে। সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।

– আপনি কি গতরাতে এখানেই ছিলেন? আই মিন নীরার সাথে?

সিদ্ধার্থ কিছুটা যেন হোঁচট খেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না এই প্রশ্ন করাটা কতটা ঠিক হলো। করে যখন ফেলেইছি কিছুই করার নেই । উত্তরের অপেক্ষা করাই এখন যুক্তিযুক্ত।

খানিক্ষণ নিরব থেকে সে বলল, হুম।

– আপনি কি ওকে ভালোবাসেন?

– ইয়ে মানে!

– দেখুন সিদ্ধার্থ সাহেব! আমাদের বয়সটা এমন একটা পর্যায়ে আছে এখানে ভুল করার কোনো গুঞ্জায়েস নেই। আমরা যা কিছু করছি ভেবে চিন্তেই করছি। নীরা আমার খুব ছোটবেলার ফ্রেণ্ড। ও কেমন সেটা আপনিও হয়তো জানেন আমিও জানি। নীরার দু দুটো বাচ্চা আছে। ওর হাজবেন্ড আছে। উনি খুবই ভালো মানুষ। আমাদের বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই । তাই এ বয়সে হয়তো এ ধরণের আচরণ আমাদের শোভা পায় না। আপনি আনম্যারিড হলেও একটা সংসারের ভ্যালু নিশ্চয়ই বুঝবেন। আপনাদের দু’জনের মাঝে আমার কথা বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত জানিনা। নীরার সাথে তো এসব নিয়ে কথাই বলা যায় না। তাই আপনাকে বলছি । প্লিজ , অন্যভাবে নিবেন না। আপনাকে খুব ভালো লেগেছে। বন্ধুর মনে করে কথগুলি বলছি।
কিছুটা পুরো ভাবে কথাগুলো বললাম আমি।

সিদ্ধার্থ যেন আমার কথায় কিছুটা ধাতস্ত হলো। এ ধরণের পরিস্থিতিতে পড়বে সে ভাবতেই পারেনি। চোরের মত মিনমিনে গলায় বলল,

– দেখুন, এই বয়সে যে সম্পর্কে আমরা জড়াই এটা একদম বুঝেশুনেই জড়াই। একদম ঠিক বলেছেন। আপনার কথাগুলি খুব ভালো লাগছে। আপনি যে আপনার বান্ধবীর মত একদমই না সেটা আমি প্রথমবার আপনাকে দেখেই খানিকটা টের পেয়েছি। অসম্ভব বিচক্ষণ আপনি। বন্ধুই যখন ভাবলেন আপনাকে সত্যি বলতে আমার বাঁধা নেই। নীরার স্বভাবতো জানেনই। ও কোনোদিনই ভালোবাসা পাবার মত মেয়ে নয়। আমি অনেক আগে থেকেই ওকে চিনি। সে কোনোদিনই কারো প্রতি লয়্যাল না। হাজবেন্ডের সাথে কী করে হবে বলুন! ওর মতো মেয়ের কপালে কী করে নাহিদ সাহেবের মতো এমন একজন ভালো মানুষ জুটেছে জানিনা। যে তার হাজবেন্ডের সাথে এমন করতে পারে সে অন্য কারো কী করে হবে বলুন।

– তবে আপনি তার সাথে সম্পর্ক কেন রাখছেন?

– তাহলে ঘটনা খুলেই বলি। নীরাকে আমি পছন্দ করতাম বহু আগে। আপনি জানলে অবাক হবেন নীরার সাথে আমার ফিজিক্যাল রিলেশান হয়েছে ও যখন ইন্টারে পড়ে তখনই। আমি তখন মাত্র এসএসসি দিয়েছি। কিশোর বয়স হয়তো তখনো পার করিনি বা পার করছি করছি মাত্র। আমি মামার বাসাতে গিয়েছিলাম কিছুদিন থাকার জন্য। মামা ভাড়া থাকতেন ওদের বাড়ির তিন তলায়। তখন দূর্গা পূজার ছুটি চলছিল আমাদের। ও আমার সাথে প্রায়ই খামারবাড়ি পূজামণ্ডপে যেত। এছাড়া সারাদিনই মামার বাসায় এসে আড্ডা দিত। আমিও যেতাম মাঝেমাঝে ওদের বাসায়। এভাবেই আমাদের মাঝে একটা রিলেশান গড়ে ওঠে। মনে মনে নীরাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করি। একদিন মামা, মামি , কাজিনরা সবাই পূজামণ্ডপে গিয়েছে । আমি বাসায় একা। নীরা আসল তখন। সেদিনই প্রথম ওর সাথে আমার রিলেশান হয়। এরপর থেকে আমার পুরো পৃথিবী জুড়ে নীরা আর নীরা। নীরার কাছাকাছি থাকার জন্য অনেক কায়দা করে বাবা মায়ের সাথে জিদ করে বাংলাদেশে এসে ভর্তি হলাম। এর মাঝে কতবার যে ওর সাথে আমার রিলেশান হয়েছিল ইয়াত্তা নেই। নীরা আমার থেকে বড় হওয়াতে কেউ তেমন কিছু সন্দেহ করত না। এভাবে বছর দুই চলছিল । এর মাঝে নীরা একবার কন্সিভও করে ফেলে। আমাদের ভয়ে তো হাত পা কাপাকাপি অবস্থা। বয়স কম। অতশত বুঝি না। এক বড় ভাইয়ের বুদ্ধিতে ওর এবোরশান করালাম। উনি নীরাদের বাসার চিলেকোঠাতে থাকতেন। ঢাকা ভার্সিটিতে উনি মাস্টার্সে পড়তেন তখন। এবরশনের সময় নীরার কষ্ট দেখে মনে মনে আমি দৃঢ় সংকল্প করে ফেললাম নীরাকেই আমি বিয়ে করব। শুরুর দিকেই টের পেয়ে গিয়েছিলাম বলে এই ব্যাপারটা কেউ আর কিছু বুঝতে পারেনি। বাসায় এটা সেটা বলে নীরা বেঁচে গিয়েছিল । এর কিছুদিন পরে খেয়াল করলাম নীরা আর আগের মত আমার কাছে আসে না। এভয়েড করে চলে। এরপর আমি একদিন হাতেনাতে নীরাকে ধরে ফেললাম সেই বড় ভাইয়ের সাথে উনার চিলেকোঠার রুমে। নীরা অবশ্য আমাকে দেখেনি। কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল সেদিন।
নীরাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলাম না। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বাংলাদেশে আর নয়। এমন মেয়ের জন্য নিজের জীবন বরবাদের কোনো মানে হয় না। দুই মাসের মাঝে আমি সব গুছিয়ে মা বাবার কাছে চলে আসি। ওকে বলে আসি মা বাবাই জোর করছে যাবার জন্য। ওর মধ্যে তেমন দুঃখবোধ হলো মনে হলো না। কারণ ততদিনে বেশ দূরে সরে গেছি আমরা দু’জন। এরপর আর দেখা হয়নি বহু বছর। ও মাঝমাঝে যোগাযোগ করার চেষ্টা করত আমি দায়সারা উত্তর দিতাম। ও আজ অবধি ও জানে না কেন আমাদের মাঝে এমন দুরত্ব হলো। ও মনে করে আমি কিছুই জানি না। আমিও আর বলতে যাইনি। এরপরে বহুবছর কেটে গেল। আমি বিয়ে করেছিলাম । কোনো এক কারণে আমার সংসার টিকল না। বন্ধু যখন ভাবলেন সেই দুঃখের ঘটনা না হয় আরেক দিন বলব।
ফেসবুকের কারসাজিতে যোগাযোগ হলো আবার নীরার সাথে। ততদিনে সে দুই বাচ্চার মা। ভেবেছিলাম ও হয়তো মানুষ হয়েছে এতদিনে। কিন্তু কোথায় কী! মানুষের আজন্ম স্বভাব সে কি আর বদলায়? হাই হ্যালো কথাবার্তা চলছে এমন সময় সে একবার ওর হাজবেন্ড বাচ্চাসহ ঘুরতে এল ইন্ডিয়াতে। ওর হাজবেন্ডের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলো ছোট ভাই বলে।
সেবার আমাদের আরেক বন্ধুর সাথে দেখা করার নাম করে একাই আমার সাথে একদিন বেরুল । আমি দেখলাম ও এখনো সেই আগের মতই আছে। কোনো চেঞ্জ নাই। আমাকে নানান ভাবে কাছে পাবার বাহানা খুঁজছে শুধু। আমি কিছুটা এভয়েড করার চেষ্টা করি প্রথমে। কিন্তু পুরুষ মানুষ তো! তাছাড়া সেই পুরানো কথা বারবার তোলায় আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। ও ওর হাজবেন্ড বাচ্চাকে হোটেলে রেখে আমার সাথে অন্য হোটেলে সময় কাটায়। এই তো ! এভাবেই গেল দু’বছর। সে মাঝেমাঝে ইন্ডিয়াতে যেত ঘোরার নাম করে। আমাদের দেখা হতো। সে আমাকে বারবার বাংলাদেশ যাবার অনুরোধ করলেও আমি যাইনি।

এরপরে আমি চলে এলাম ব্যাংককে। এখানেও সে আসে মাঝেমাঝে। এই তো! বাকি সব তো দেখছেনই।এখন বলুন, আপনার ফ্রেন্ডের ন্যাচার কত খারাপ। এত বছরে কী সে শুধু আমার সাথেই রিলেশান রেখেছে নাকি অন্য কারো সাথেও সে এমন সম্পর্ক রেখেছে? আমাকে না পেলে সে অন্য কারো সাথে থাকবে। এটা আমি নিশ্চিত।
এটা কি ভালোবাসা নাকি অন্যকিছু আপনিই বলেন।

নির্দ্বিধায় আপনাকে অনেক কথা বলে ফেললাম । মাফ করবেন। কেন যেন আপনাকে অন্য সবার থেকে আলাদা মনে হলো তাই অনেক কথা বলে ফেললাম। জানি খুব খারাপ মানুষ ভাবছেন আমাকে। আমি আসলেই খারাপ , খুব খারাপ। সারাজীবন শুধু খারাপ মানুষদের সাথেই ডিল করেছি। ভালো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো। জীবনের শুরুটাই হয়েছে ভুল মানুষের সাথে।

সিদ্ধার্থের কথা শুনে আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। নীরাকে খারাপ ভাবতাম কিন্তু আমি এতটা খারাপ ভাবিনি কখনই। ও যে সেই আগে থেকেই এত খারাপ সিদ্ধার্থ না বললে এটা আমি জানতেই পারতাম না। এ জন্যই হয়তো আম্মু আমাকে সবসময় ওর থেকে দূরে থাকতে বলত। সে হয়তো বুঝতে পারত ওর স্বভাব চরিত্রের ব্যাপারে। এমন একটা মানুষের সাথে আমি এখনো বন্ধুত্ব রেখেছি ভেবেইও লজ্জা পাচ্ছি। সিদ্ধার্থ যতটা অকপটে স্বীকার করল ও নিশ্চয়ই করবে না কোনোদিন। ওর সাথে এতদূর চলে এসেছি ভাবতেই লজ্জা লাগছে। এতটা নীচ চরিত্রের মানুষ হয়!

আমি কোনো কথা বলছি না দেখে সিদ্ধার্থ বলল, আপনাকে একটা অনুরোধ করব রাখবেন?

– জি বলুন। চেষ্টা করব।

– নীরার মত ফ্রেন্ডের থেকে দূরে থাকবেন , প্লিজ। আপনি বেশ ভালো মানুষ। হয়তো ওর সাথে চলতে চলতে কখন পথভ্রষ্ট হবেন নিজেও টের পাবেন না। আমাকে অনেক খারাপ ভাবছেন । ভাবাটাই স্বাভাবিক। তবে আপনার সাথে মাত্র এই দু’দিনের পরিচয়ে আমি বুঝতে পেরেছি আপনি নীরার অন্য ফ্রেন্ডদের মতো নয়। আমার যদি আপনার মতো একজন বন্ধু থাকত যে সৎ পরামর্শ দিবে তবে জীবনটা হয়তো অন্য রকম হতো। অনেক কথাই বলে ফেললাম। ক্ষমা করবেন, প্লিজ। আমি ব্রেকফাস্টের জন্য নিচে যাচ্ছি । এতক্ষণে নীরাও হয়তো রেডি হয়ে গেছে। আপনার অনেক সময় নিয়ে ফেললাম । ভেরি সরি।

সিদ্ধার্থ চলে যাবার পর কেন যেন সিদ্ধার্থের জন্য খুব মায়া হচ্ছিল। কেন জানি না। বারবারই মনে হচ্ছে ওর চাহনিতে কী এক মায়া জড়িয়ে। আবার নিজেকেই নিজে বকা দিচ্ছি ,” সিদ্ধার্থের জন্য মায়া লাগছে কেন? সেও তো সমান অপরাধী নীরার মত। “

কিন্তু তারপরেও কেন জানিনা সিদ্ধার্থকে আমার মন অপরাধী ভাবতেই চাইছে না। এই ক্ষণিকের পরিচয়ে পরিচিত হওয়া মানুষটিকে খুব আপন মনে হচ্ছে, বন্ধু মনে হচ্ছে।

চলবে….

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৪
কোথাও ঘুরতে গেলে আগে থেকেই কোনদিন কী পরব কী না পরবো রেডি করে নিয়ে আসি । সেই হিসেবে আজ বেরুবার আগে আমার সালোয়ার কামিজ পরার কথা। কিন্তু সালোয়ার কামিজ পরতে যেয়েও আবার কী মনে করে লাল জামদানী শাড়িটা পরলাম। তার সাথে ম্যাচিং করে হালকা গহনা আর মানানসই সাজগোজ। আয়নার দিকে তাকাতেই নিজেকে দেখে নিজেই অভিভূত। অনেকক্ষণ ধরে আয়নাতে নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কতদিন নিজেকে এভাবে দেখা হয় না।

মনে হলো আমি তো এখনো সেই আগের মতই আছি । খুব বেশি কী বুড়ি হয়েছি? নাহ! এই রূপের জাদুতে পাগল হয়েই আমাকে মন সঁপেছিল বিশিষ্ট শিল্পপতির ছেলে সেলিম মালিক। আমাকে একটি মুহূর্ত দেখবার জন্য ছটপট করত। শাড়ি পরতে বলাটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আমাকে তো বলেই দিয়েছিল, “বিয়ের পর তুমি এই সালোয়ার কামিজ টামিজ পরতে পারবে না। আমি তোমাকে শাড়ি পরাই দেখতে চাই সব সময়। “ অথচ এখন কবে শাড়ি পরলাম আর কবে সালোয়ার কামিজ পরলাম দেখার মত সময় হয় না তার। এখন আর বলেও না “চলো কোথাও লং ড্রাইভে যাই। খোলা চুলে তুমি পাশে বসবে আর আমি তোমার কালো চুলের মায়ায় হারিয়ে যাবো দূর প্রান্তরে।”

এখন আর সেই লং ড্রাইভের সহযাত্রী করার আবদার করার সময় হয় না সেলিমের। সম্পর্কও বুঝিও মানুষের বয়সের মতো বুড়িয়ে যায়। আশা প্রত্যাশা সবই একসময় হারিয়ে যায় কোন অজানায়। সেলিমের জন্য মনটা পুড়ে উঠল খুব। এক বুক অভিমান নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করতে যেয়েও রেখে দিলাম। ফোনটা রাখতেই হঠাৎ করে টুং করে শব্দ হলো। দেখি সিদ্ধার্থের মেসেজ। “ আমরা নিচে অপেক্ষা করছি” ।

আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই পুরানো দিনের কথা মনে করতে যেয়ে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিলাম যেন। কিন্তু না । এই জাদুর শহরে আর যতক্ষণ আছি এক মুহূর্তের জন্যও আর ভাবতে চাই না সেই সোনালী অতীত যে অতীত আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে প্রতিনিয়ত পিষ্ট করে মারছে।

সিদ্ধার্থ মেসেজিং করাতে বুঝতে পারছি গতকাল রাতের ব্যাপার নিয়ে নীরা আমার উপর রাগ করেছে তাই আমাকে সে না ডেকেই নিচে চলে গেছে। ও রাগ করেই থাকুক । সিদ্ধার্থের কাছে সবকিছু জানার পর ওর প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে একদম। ভাবতেই বিরক্ত হচ্ছি ওর সাথে আরো দু’টো দিন পাশাপাশি থাকতে হবে বলে।
পরক্ষণেই আমি নিজের আচরণের কথা ভেবে অবাক হচ্ছি। আমি নীরার উপর রাগ করছি ভালো কথা। সেই সমান অপরাধে তো সিদ্ধার্থও দোষী। তবে সিদ্ধার্থকে কেন আমি ঘৃণা করতে পারছি না? আয়নায় শেষ বারের মত আমি নিজেকে আরেকবার দেখে পরিপাটি করে নিলাম। আয়না নিজেকে দেখছি আর ভাবছি আমার অবচেতন মন শুধুমাত্র সিদ্ধার্থ পছন্দ করে বলেই বুঝি শাড়ি পরতে আমাকে তাড়া দিয়েছে। নিজের পছন্দকে তোয়াক্কা না করেই আমি সিদ্ধার্থকে খুশি করতেই হয়তো শাড়ি পরলাম। এই ঠোঁটজোড়া লিপস্টিকের ছোঁয়ায় শেষবারের মতো রাঙিয়ে নিলাম। কপালের টিপটা ঠিক মাঝখানে আছে কি না খুব ভালো করে পরখ করলাম। মনের অলিগলিতে আসলে ঠিক কী চলছে খানিকক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলাম আর মনের এমন পরিবর্তনের কারণ খুঁজছিলাম । আমিও কি তবে নীরার পথেই হাঁটছি ? সিদ্ধার্থের মনোরঞ্জনের জন্য এত সুন্দর করে সাজলাম! কখনো কি এমন করে এখন আর সেলিমের জন্য আমি সাজি? সেলিম আমাকে এখন আর দেখে না এই অজুহাতে শেষ কবে শুধুমাত্র সেলিমের জন্য সেজেছি মনে পড়ছে না। আজ অন্য কারো ভালোলাগাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের পছন্দকে তোয়াক্কা করছি না। এই কি আমি? হ্যাঁ নিজের পছন্দকে তোয়াক্কা না করে একসময় সেলিমের চাওয়া-পাওয়া কে প্রাধান্য দিতাম। কিন্তু সেখানে আমি অন্য কাউকে আজ কী করে ভাবছি?

হঠাৎ কেন যেন মনে হলো আমিও বুঝি নীরার মত। চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই তো শুরু হয় পথ হারানোর সূচনা। সুখের নাগাল পেতে যেয়ে জীবনটাকে কোনো তিক্ত স্বাদ দিতে আমি রাজি নই। আমি আর নিজের ব্রেইনকে আর আগে-পিছে কোন কিছু চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে ঝটপট করে শাড়িটা খুলে ফেললাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছি খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। দেরী হোক তাও নিজের বিবেকের কাছে নিজে এভাবে হেরে যেতে পারব না। আগে থেকে সিলেক্ট করে রাখা সালোয়ার-কামিজটাই পরলাম। খোলা চুলগুলোকে খুব আঁটোসাঁটো করে বেঁধে নিলাম।
কপালের টিপ টা খুলে টিপের পাতায় রেখে দিয়ে খুব হালকা সাজগোজে তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে পড়লাম নীচে যাবার জন্য।

আমাকে দেখে নীরা খানিকটা গাল ফুলিয়ে বলল, এত দেরি করেছিস কেন? মনে হচ্ছে কোন বিয়ে বাড়ির বরযাত্রী যাচ্ছি আমরা। এভাবে যদি রুমে বসে থাকার জন্য আমরা এখানে এসেছি তাহলে টাকা খরচ করে ব্যাংককে আসার দরকার কি ছিল? বাসায় থাকলেই পারতাম।

আমি নীরার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু বললাম ,সরি। আসলেই খুব দেরী করে ফেললাম। তাকে নিয়ে আমার মনের ভেতর কী চলছে আমি একদমই বুঝতে দিলাম না।

আমার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধার্থ হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছে। আমার কেন যেন খুব বুদ্ধিমান মনে হয় লোকটাকে। কিন্তু কেন এটা জানিনা। এমন একজন বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমান মানুষকে নীরার পাশে আমি ঠিক মানতে পারছি না।

তড়িঘড়ি করে ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমরা বের হই। নীরা এটা সেটা বললেও আমি শুধু হু হা করেই উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। নীরা আমার এই থমথমে ভাবটা বুঝতে না পারলেও সিদ্ধার্থ ঠিকই বুঝেছে। নীরা আমার থেকে বেশ সামনে। সিদ্ধার্থ ইচ্ছে করে নীরার থেকে কিছুটা দূরত্ব রাখার জন্য ধীরে ধীরে হাঁটছে।

– আপনি আমার উপর প্রচন্ড রেগে আছেন তাই না?

– না, না । তা কেনো হবে? আপনার ওপর আমি কেন রাগ করব?

– আপনি না বললেও আমি বুঝি। আসলে আমার সম্পর্কে যেসব কথা আপনাকে আমি বলেছি এগুলি জানার পর থেকে আপনি যে আমাকে প্রচন্ড ঘৃণা করবেন এটা আমি জানি । আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলেও তাই করত।
আমি আসলেই ভালো মানুষ না। ভালো মানুষ না বলেই হয়তো সংসারটা টিকল না। একটা ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে দিন পার করছি।

সিদ্ধার্থের কথা আমি কোন জবাব দিচ্ছি না দেখে সে নিজে থেকে আবার বলল,
আজ শাড়ি পরলেন না যে! তবে সালোয়ার কামিজেও কিন্তু আপনাকে দারুন মানায়।

– ধন্যবাদ । প্রতিদিন শাড়ি পড়তে ভালো লাগে না। তাই মাঝে মাঝে ভিন্নতা প্রয়োজন।

– হুম ,এটা ঠিক বলেছেন। মাঝে মাঝে বৈচিত্রেরও প্রয়োজন আছে জীবনটায়। একঘেয়েমি না হলে মাথায় উঠে বসে। কোনোভাবেই নামানো যায় না।

– হুম! তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে একঘেয়েমিই ভালো। সব জায়গা বিচিত্রতা খুঁজতে গেলে জীবনটাকে রঙিন করতে যেয়ে বরং দোজখে পরিণত করা হয়।

– ঠিকই বলেছেন। সব ক্ষেত্রে ভিন্নতা আসলেই অশান্তি ডেকে আনে। আপনাদের তো কাল রাতে ফ্লাইট তাই না?

– জি।

– ক্ষণিকের দেখা এই বন্ধুটির কথা মনে থাকবে নিশ্চয়ই?

– অবশ্যই । আমি আবার সহজে কিছু ভুলি না। অবশ্যই মনে থাকবে আপনার কথা।

– কৃতজ্ঞ হলাম। আমিও ভীষণ মিস করব। সরি, মানে আপনাদেরকে।

– ধন্যবাদ।

ব্যাংককে আমার মনই টিকছে না একদম। জানিনা বাকিটুকু সময় কীভাবে কাটবে? ছেলেটার সাথে কথা বলেছি । ও আসছে আগামী সপ্তাহে। এখনি মন ছুটে যাচ্ছে দেশের জন্য। সেলিমের উপর এক বুক অভিমান জমে আছে। অভিমান জমে জমে পাহাড় হয়ে আছে। এই অভিমানের পাহাড় জানিনা কোনদিন আর কবে বরফের মত গলে গলে সমতল ভূমিতে রূপ নিবে? নাকি আদৌ নিবে না। মানুষটার একবারের জন্যও কি মন চায় না আমার খোঁজখবর নিতে! মেসেঞ্জারে একবার দিনে হাই হ্যালো পর্যন্তই কি আমাদের সম্পর্ক? আমি কেন জানি না সিদ্ধার্থকে দেখলেই কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ছি। যদিও যতটুকু সময় আর আছি তাকে এভয়েড করারই চেষ্টা করছি। মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। আমি বুঝতে পারছি আমার মন প্রচণ্ড খরার পরে এক ফোঁটা শিশির বিন্দুকেও তার খুব আপন ভাবতে চাইছে। মন তো বড় বেয়াড়া । শাসন বারণ সে একদমই মানতে চায় না। কিন্তু তবুও আমাকে মানাতে হবে। আমি এটুকু বুঝতে পারছি সিদ্ধার্থও হয়তো আমার খুব কাছাকাছি আসতে চাইছে। আমি ইশারা দেবার সাথেই সে আরেক ধাপ এগিয়ে আসবে। কিন্তু সেই সুযোগ তাকে একদমই দেয়া যাবে না। নিজের ব্যক্তিস্বত্তাকে বিকিয়ে দেবার কোনো মানে নেই। আমার ভাগ্যই এমন। এই ভাগ্যকেই আমার মেনে নিতে হবে। সুখের সন্ধানে ক্লান্ত হয়ে পথ খুঁজতে খুঁজতে পথহারা হওয়া যাবার মত মেয়ে আমি না। সুখের ঠিকানা কোথাও না কোথাও ঠিকই আছে। আমি হয়তো সঠিক পথটা খুঁজে পাচ্ছি না। আমাকে খুঁজতেই হবে।

এই সেলিমকে পাবার জন্যই একসময় মরিয়া ছিলাম। আমার সব বন্ধু বান্ধবীরা বলত সেলিমের বউ হওয়া আমার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। আমি হার মানিনি । সকলের দেয়া এই ভয়টুকুকে জয় করবার জন্য সেলিমকে ভালোবাসা দিয়ে এতটাই ঘিরে রেখেছিলাম যে সেই আমাকে বাকিপথটুকুতে আলো দেখিয়েছে। আমাকে কিছুই করতে হয়নি। সেই দুঃসময়ের মতো দিনগুলিকে যদি আমি জয় করতে পেরেছি তবে এবার আবার আমাকে সেই সেলিমকে জয় করতে হবে। হয়তো পারব ,না হয় পারব না। তাই বলে পথভ্রষ্ট হওয়া যাবে না একদম। নিজেকে , নিজের মনকে যে করেই হোক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এই সার্কেল থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই নীরাদের মত মেয়েদের সাথে থাকলে পা পিছলাতে খুব বেশি সময় লাগবে না হয়তো। নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগেই নিজেকে এদের থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে। না জানি নীরার মত পর্দার আড়ালে একেক জনের আরো কত রূপ আছে। আমি সেই রূপ আর দেখতে চাই না একদম। আমিই এখান থেকে নিরবে সরে আসতে চাই।

প্লেনে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি বেশ কিছুক্ষণ ধরে। মনটা খুব বিষণ্ণ। চোখজোড়া ভেজা। ব্যাংককে এসেছিলাম একটু সুখের তালাশে। কিন্তু ফিরে যাচ্ছি বিষণ্ণমনে। এয়ারপোর্টে রেখে আসা ওই ক্ষণিকের পরিচিত মুখখানা খুব মনে পড়ছিল। সিদ্ধার্থের মায়া ভরা চাহনিটুকু আমি অনেক কষ্টে এভয়েড করতে পেরেছি। সিদ্ধার্থের সামনে তাকে এভয়েড করার বাহানা করলেও আমি জানি কতটা কষ্ট লেগেছিল তাকে শেষবারের মত বিদায় জানাতে। সিদ্ধার্থের ভেতরেও যে কেমন লাগছিল সেও হয়তো আমি খানিকটা টের পেয়েছি। মেয়েদের এই অদ্ভুত ক্ষমতাটুকু সৃষ্টিকর্তা একদম ঠিকঠাক দিয়ে দিতে ভুল করেননি। কে তাকে পছন্দ করে আর কে তাকে এভয়েড করে এতটুকু বোঝার ক্ষমতা তাদের খুব ভালোভাবেই থাকে। সিদ্ধার্থের চোখের ভাষা আমি টের পেয়েছিলাম। তবে তার মাঝে নোংরামি খুঁজে পাইনি একদমই।

আসার আগমুহূর্তে সিদ্ধার্থের বলা কথাগুলি আমার মনে খুব বাজছে।

নীরার অগোচরে বলা তার সেই কথাগুলি আমি ভুলতেই পারছি না একদম।
বিদায় জানানোর মুহূর্তে সিদ্ধার্থকে আমি আবারও বিয়ে করে সংসারী হতে বললে সে আমার খুব কাছাকাছি এসে আস্তে করে বলল, “ প্রথম দেখাতে মানুষের প্রেম হয় সেটা জানতে খুব দেরি করে ফেললাম। সিনেমার এই ডায়লগে শুনতে শুনতে এই বস্তাপচা ডায়লগটা একদমই সস্তা মনে হতো। ভাবতাম প্রেম আবার প্রথম দেখাতে হয় নাকি? দেখতে দেখতে ভালোলাগার অনুভূতি আসবে। তারপরেই না সেই ভালোলাগা থেকে হবে প্রেম, ভালোবাসা। কিন্তু ভাবনাগুলি ভুল প্রমাণ হলো। বুঝতে পারলাম প্রেম আসার যেমন কোনো নির্দিষ্ট সময় , স্থান, কাল আর বয়সের সীমারেখা নেই ঠিক তেমনি কার সাথে প্রেম হবে এটাও একটা অলৌকিক বিষয়। নিজের মনের অজান্তেই ভালোবাসা হয়ে যায়। “

সিদ্ধার্থ আরো কিছু বলতে যাবে তখনই তাকে থামিয়ে দিয়ে আমি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। কথাগুলিকে আর এগুতে দিলাম না আমি। কেন যেন নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিলাম। সেই বিশ্বাসটুকু যাতে একদমই হাত ছাড়া হয়ে না যায় তাই আর সিদ্ধার্থকে একদমই পাত্তা দিলাম না।

চোখের কোণে জমে থাকা নোনাবিন্দুটুকু টিস্যু দিয়ে মুছে ফেললাম। খেয়াল করলাম নীরা একটা ইংলিশ ম্যাগাজিন পড়ায় খুব মনোযোগী। আমি ব্যাগ থেকে আমার ফোনটা বের করে সিদ্ধার্থের নাম্বারটা ব্লকলিস্টে রাখলাম। তখনও নেটওয়ার্ক কাজ করছিল। আমি ফেসবুক , মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপেও তাকে ব্লক করলাম। কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে নীরাকেও সবখান থেকে ব্লক করে দিলাম। আমি চাই না নীরার সাথে আর কোনো ধরণের যোগাযোগ হোক। আর নীরার সাথে যোগাযোগ করলেই সিদ্ধার্থ সম্পর্কে আবার জানার আগ্রহ বেড়ে যাবে।

বাসায় ফিরেছি কিছুক্ষণ আগে। ফিরেই জানতে পারলাম সেলিম সিলেট গেছে কী একটা কাজে। খুব কষ্ট লাগল। কষ্টটাকে চেপে রেখে ফোন দিলাম । সেলিম জানাল তাদের নতুন ফ্যাক্টরির জন্য জমি দেখতে সিলেট গেছে । ফিরবে কখন ঠিক বলতে পারছে না। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। বারবার সিদ্ধার্থের কথা মনে আসছিল । মনটাকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করতে ছেলের সাথে কথা বলতে ওর হোস্টেলে কল দিলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই প্রিয়কে পেলাম। প্রিয়কে জানালাম আমি ব্যাংককে গিয়েছিলাম। তাকে না জানানোর জন্য প্রথমে রাগ করলেও পরে সরি বলতেই সে হেসে দিয়ে আমাকে ক্ষমা করে দিল এমন একটা ভাব নিয়ে বলল, “ আচ্ছা, বুঝেছি, বুঝেছি। এবার বলো আমার জন্য কী কী আনলে? ছেলের জন্য নিয়ে আসা গিফটের লিস্টের কথা শুনে সে ভীষণ খুশি হলো। কথা শেষে প্রিয় জানাল আগামী সপ্তাহের ছুটিটা তাদের বাতিল হয়ে গেছে। পরীক্ষা শেষ হবার আগে কোনো ছুটি নেই । মনটা আবারো খুব খারাপ হয়ে গেল ।
কতকিছু নিয়ে এসেছি কিন্তু প্রিয় এই মুহূর্তে আসবে না। সারা বাড়িতে একা একা ছটফট করছে মন। রাতে সেলিমকে কল দিলাম। কয়েকবার বাজার পর রিসিভ করে খুব বিরক্তির সাথে বলল, “ এত কল দিচ্ছো কেনো? ফ্রী হলে আমিই তো দিতাম । এখানে ফ্যাক্টরির জন্য হিউজ এমাউন্টের জমি নিতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা যে জমিগুলি নিতে চাচ্ছি ফার্মারদের মধ্যে অনেকে সেগুলি নিয়ে বেশ ঝামেলা করছে। এজন্য কিছুটা দেরী হবে ফিরতে । উনাদের সবাইকে রাজি করিয়ে মোটামুটি একটা সেটলমেন্টে এসেই আমি ঢাকায় ব্যাক করব। প্রতিদিন তো আর আসা সম্ভব না সব কাজকর্ম ফেলে। “
সেলিমের এমন ব্যবহার নতুন না তাই খুব বেশি আর কষ্ট পেলাম না।

খুব মনে পড়ছে সিদ্ধার্থের কথা। ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। ওকে জানানোই হয়নি যে আমি সেফলি এসে পৌছেছি। ও হয়তো আমাকে ট্রাই করেছে। কিন্তু আমি ওকে ব্লক করে রেখেছি তাই ও শত চেষ্টা করলেও আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারবে না। একবার মন চাইল ওর ব্লক ক্যান্সেল করি। কিন্তু বিবেকের কাছে হেরে গেলাম আমি।

সারারাত ধরে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি সোশ্যাল ওয়ার্কে আবার একটিভ হব। এসব বন্ধুমহল , ক্লাব , পার্টি আসলে আমার জন্য নয়। ব্যাংকক থেকে শ্বশুর , শাশুড়ির জন্য গিফট এনেছি। ভাবলাম কাল সকালেই যাবো তাদের কাছে। এ সুযোগে ওনাদের সাথে দেখা করাও হয়ে যাবে। মনটা হয়তো তাতে কিছুটা ভাল লাগতে পারে।

ভাবনা মতই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় তেমন জ্যাম না থাকার কারণে আমি খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম। নিজ হাতে শ্বশুরের হাতে গিফট দেবার জন্য সকাল সকাল চলে এলেও তাকে পেলাম না। শাশুড়ি মা আমাকে দেখে খানিকটা অবাক হলেন। এত সকালবেলা আসিনি কখনো।
আমি একাই ব্যাংককে গিয়েছিলাম শুনে বেশ অবাক হলেন। কিন্তু আমার সামনে সেটা প্রকাশ করতে না চাইলেও আমি বুঝতে পেরেছি।

সব কুশলাদি বিনিময়ের পরে তার হাতে বাবার জন্য এবং তার জন্য আনা গিফট দেওয়ার পরে ভেবেছিলাম হয় তো খুব খুশি হবেন এবং অন্তত পক্ষে একটা থ্যাঙ্কস আমি পাব । কিন্তু তেমন কোন ভাব লক্ষন দেখছি না। আমি বারবার প্যাকেট খুলে দেখার অনুরোধ করলেও পড়ে দেখবেন বলে রেখে দিলেন।মেইডকে সেগুলো উপরে রেখে আসতে বললেন। আমার সাথে দু’চারটা কথা বলতে বলতে আরেকজন মেইড কফি আর কিছু হালকা নাশতা নিয়ে এলো। আমাকে সেগুলো খাবার অনুরোধ করে উনি কিছুক্ষণ বসেই কী একটা অজুহাতে উপর চলে গেলেন। আমি একা একা বসে আছি। আশেপাশে আর কাউকে দেখছি না। আমার ননদ আর দেবরের বউ হয়তো এখনো ঘুমাচ্ছে। মনে মনে ভেবেছিলাম আজকে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে নাস্তা করব তাই বাসা থেকে নাস্তা করে আসিনি। অথচ আমার শাশুড়ি একবারের জন্য নাস্তা নাস্তা করার কথা জিজ্ঞেস করলেন না।

নিজেকে নিজের খুব ঘৃনা হচ্ছে আমার।

চলবে…..