সুখের সন্ধানে পর্ব-১৪+১৫

0
293

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১৪

নিজের স্ত্রী চোখের সামনে আরেকজন পুরুষের সাথে ঢলাঢলি করবে এটা কোনো পুরুষের পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব নয় এটা আমি ভালো করেই জানি। সেলিম যে সিদ্ধার্থের আর আমার ব্যাপারটা কোনোভাবেই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি এটা আমার খুব ভালো করে বোঝা হয়ে গেছে তার কথাবার্তা শুনেই। এটাই মোক্ষম সময় তার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবার। আমি তো চেয়েছিই এমনটা হোক।
সকালবেলা কোনো কথাবার্তা না বলেই অফিসের জন্য বেরিয়ে গেছে সে। এমনিতেই খুব বেশি কথাবার্তা হয় না ইদানিং। হেলেনের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান চলছে হয়ত তার মনে মনে। তাই এই দুঃখের সময় বউয়ের সাথে আলতু ফালতু খোশগল্প করে গার্লফ্রেণ্ড হারানোর কষ্টটাকে কিছুতেই সে ঘুচতে দিতে চায় না। আহারে বেচারা! গার্লফ্রেণ্ড এমনে তারে ধোঁকা দিলো! ছিঃ, ছিঃ! একটু রহম হইল না দিলে।

কথাগুলি মনে করে খানিকক্ষণ মুখ টিপে হাসলাম। এতবড় বিজনেস ম্যাগনেট, অথচ একদিকে গার্লফ্রেন্ড ধোঁকা দিয়ে অন্যের হাত ধরেছে অন্যদিকে ঘরের বউও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বেচারা তলারটা খেতে যেয়ে গাছেরটাই হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আহারে!
আমার এত হাসি পাচ্ছে সেলিমের মুখখানা মনে করে।
নাস্তা খেয়ে এসে মাত্র রুমে বসেছি অমনি টুম্পার ফোন।

– কি রে! কেমন আছিস?

– এই তো! আলহামদুলিল্লাহ্‌ !

– মিথিলা আর মেহরাব কী করে? ঘুম থেকে উঠেছে?

– মিথিলা উঠে গেছে। মেহরাব এখনো ঘুমায়।

– কী ব্যাপার সকাল সকাল আপার কথা মনে পড়ল যে?

– মাত্র দুলাভাই ফোন দিয়েছিল।

– হুম, বুঝতে পেরেছি। কোনো নালিশ করল কী ?

– নালিশ করা ছাড়া দুলাভাই আমাকে ফোন করবে কোন দুঃখে ! এমনিতে কোনোদিন শালির কথা মনে পড়ে নাকি তার? তোর সাথে ক্যাচাল লাগলেই আমাকে মনে পড়ে।

– নে তাও তো পড়ে। শুকরিয়া কর! হা হা ! এখন বল, কী নালিশ করল আমার নামে?

– কী আর বলব! তোর অভিযোগের খাতা এবার পাতার পর পাতা বললেও শেষ হবে না।

– তাইলে যতটুকু বলা যায় ততটুকুই বল।

– তুই নাকি কাকে খাসীর রেজালা , চিংড়ীর মালাইকারী রান্না করে আদর করে করে খাওয়াস? কাকে নাকি রোমান্টিক গান শোনাস?

– আর কী কী বলেছে বলতে থাক। উত্তর না হয় পরে দেই।

– আরো কত কী ! তুই নাকি আজকাল সারাদিন গুণগুণ করে গাইতে থাকিস? কাকে নাকি ধরে নিয়ে এসে সারারাত প্রেমের গান শোনাস? তোর মনে নাকি বসন্তের হাওয়া বইছে? ঘটনা সত্যি কি না তাই বল?
আমাকে তো কিছুই জানালি না। তাহলে হাওয়া খেতে আমিও না হয় আসতাম।

– সব অভিযোগ শোনার পর না হয় বলি।

– আরে না। তাড়তাড়ি কাহিনী বল। আমার এত এত অভিযোগ মনে নেই। যে কটা মনে আছে বললাম। ঘটনার আদ্যোপান্ত বলবি। দুলাভাই তো চরম দুশ্চিন্তায় আছে তোকে নিয়ে।

– তাই নাকি! আরে ঘটনা শুনবি পরে । আগে বল আমাকে নিয়ে আর কী বলল?

– কী আর বলবে? সে তার সামাজিক স্টাটাস নিয়ে খুব টেন্সড। তাছাড়া প্রিয় জানলে ওর মনের অবস্থা কী হবে এটা বলে খুব হা হুতোশ করল। এই বয়সে তোকে নাকি ভীমরতিতে পেয়েছে।

– ও মা ! তাই নাকি? সে যখন ওই হেলেন না খেলেনের সাথে ফস্টিনস্টি করে বেরিয়েছে সেটা তবে তার স্টাটাসে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি? তখন প্রিয়র কথা মাথায় আসেনি? ভীমরতিতে আমাকে পাইছে? খাচ্চর ব্যাটা!

– আরে কাহিনী কী তাই বল এখন? দুলাভাইরে এমন শকড ক্যামনে দিলি?

– বলছি শোন! মোটামুটি লম্বা চওড়া কাহিনী। হাতে সময় আছে তো?

– আছে বল, বল! মেহরাব ওঠা পর্যন্ত ফ্রীই আছি।

– আচ্ছা, তবে শোন!

আমার কাছে সব কাহিনী শুনে টুম্পাও হাসতে হাসতে শেষ!

– তোর মাথায় এসব ছয় নাম্বার নয় নাম্বার কুবুদ্ধি কই দিয়ে আসে আপা , বলতো?

– আরে এগুলি এমনিই চলে আসে। পরিস্থিতিতে পড়লে এমনি এমনিই চলে আসে। ওই যে বলে না ঠ্যালার নাম বাবাজি! তোর দুলাভাই এবার সামলাক। ওর প্রেমের মজা এবার বেরুচ্ছে।

– দেখিস আবার। লেবু বেশি চিপলে তেতো হয়ে যায় জানিস তো! ভালো করতে যেয়ে আবার খারাপ করে ফেলিস না যেন।

– আরে নাহ! তেমন কিছুই হবে না। তেতো হলে চিনি মেশানোর বুদ্ধিটাও আমার জানা আছে। এতদিন ধরে চুপচাপ সব সহ্য করাটাই আমার ভুল হয়েছে। এবার নিজের অধিকারের জন্য লড়ব। ওকে বুঝিয়ে দিবো আমিও দুর্বল নই।

– আচ্ছা, আচ্ছা ! তবে প্রেসার আবার একটু কম দিস! বেচারা দুলাভাই নইলে স্ট্রোক করবে। হা হা।

– তা মন্দ বলিসনি। গতকাল ওর মুখ যে কী পরিমাণ পাংশু বর্ণের হয়েছিল। তুই না দেখলে বুঝতে পারবি না। একা একা কাউকে বলতেও পারছি না, আবার হাসতেও পারছি না। কী যে ডিসগাস্টিং অবস্থা!

– আচ্ছা, আপা। রাখি তাইলে। মেহরাব উঠে গেল । ওকে নাস্তা খাওয়ানো যে প্যারা। আল্লাহ হাফেজ।

– আল্লাহ হাফেজ।

টুম্পার সাথে কথা বলে আরো মজা পেলাম। এটা সেলিমের বেশ পুরানো অভ্যাস। বিয়ের আগেও যখনই আমার সাথে ওর কোনো কারণে ঝগড়া লাগত , কথা বন্ধ হয়ে যেত । অমনি সে টুম্পার কাছে ফোন দিয়ে আমার নামে দুনিয়ার অভিযোগ জানাত। টুম্পার কাছে আমার দোষ শুনতে শুনতে আমারই মাথা হ্যাং হয়ে যেত। বিয়ের পরেও টুম্পার কাছে নালিশ পাঠাত। আর খুব বেশি সিরিয়াস কিছু হলে ভাইয়ার কাছেও নালিশ করা ছিল তার আরেকটা বদ অভ্যাস। কত বার বলেছি আমার সাথে কোনোকিছু হলে আমার সাথে ডিল করবে। কথায় কথায় ভাইয়ার কাছে নালিশ করার অভ্যাসটা বদলাও। আমি তো কখনো তোমার নালিশ নিয়ে তোমার মা বাবার কাছে যাই না। তবে তুমি কেন? টুম্পার কাছে নালিশ করে সেটাতে কিছু মনে করতাম না। কিন্তু ভাইয়ার কাছে নালিশ করাটা আমার একদমই পছন্দ না। কতবার যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে এ জন্য।

ভাইয়ার কথা মনে পড়তেই মনে হলো হায় , হায় ! ভাইয়ার কাছে যদি সেলিম আগের মতই এবার উল্টাপাল্টা কিছু নালিশ করে তবে মান ইজ্জত আর থাকবে না কিছুই। আমি দ্রুত ভাইয়ার কাছে ফোন দিলাম। একবার রিং বাজতেই ভাইয়া ফোন ধরল।

– আসসালামু আলাইকুম , ভাইয়া। কেমন আছ?

– ওয়ালাইকুম আসসালাম। এই তো আছি। তোদের কী খবর? একদমই তো আসিস না। ভুলেই গেছিস নাকি আমাদেরকে?

– কি যে বলো ভাইয়া! তুমিও তো আসো না। শেষ কবে এসেছিলে মনে পড়ে?

– ব্যস্ত মানুষ বুঝিসই তো! তুই আসিস। প্রিয় এসেছিল শুনলাম। ওকে নিয়ে তো আসতে পারতিস।

– ও সিলেটেই ছিল বেশি সময়। ঢাকায় এসে সুযোগ হয়নি থাকার। থাকলে তোমাদের বাসায় নিয়ে আসতাম। ভাবি বাচ্চারা ভালো আছে নিশ্চয়ই ?

– হুম, আছে সবাই আলহামদু্লিল্লাহ। বাসায় আসিস ।

– আচ্ছা, ভাইয়া। রাখছি তবে। আল্লাহ হাফেজ।

– আল্লাহ হাফেজ।

ভাইয়ার সাথে কথা বলে বুঝলাম সেলিমের সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। কথা হলে ভাইয়া এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলত না। ভাইয়ার সাথে আর কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। ভেতরে খুব স্বস্তি অনুভূত হচ্ছে।

আজকাল সেলিম অফিসে খুব জরুরি কাজ না থাকলে বাসায় থাকে। আমি বুঝতে পারছি আমাকে পাহারা দেবার জন্যই বেচারার এই দশা। কারণ সেলিমের নিষেধসত্ত্বেও আমি বেশ কয়েকবার সিদ্ধার্থের সাথে আড্ডা দিতে বাইরে গিয়েছি। এ নিয়ে তুমুল ঝগড়াও হয়েছে দু’জনের মাঝে।
আজ আমি লাঞ্চের পরে ড্রয়িং রুমে বসে মেসেঞ্জারে চ্যাট করছি সিদ্ধার্থের সাথে। সেই সময় সেলিম এসে পাশে বসল। চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম সে আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করতেই এখানে এসে বসেছে।

– তার মানে তুমি আমার কোনো কথাই আমলে নিচ্ছ না?

– কোনটা?

– ন্যাকামো আমার একদম পছন্দ না। বুঝেও না বোঝার ভাণ কেন?

– কী বোঝাচ্ছ ক্লিয়ার করে বলো। আমি তো বাইরে কোথাও যাচ্ছি না। তুমি আমার বাইরে যাওয়াতে রেস্ট্রিকশান দিয়েছ। ওকে ফাইন। আমিও যাচ্ছি না। আর কী চাই তোমার? আর কোনো অন্যায় করে ফেলেছি কি?

– অবশ্যই করেছ। ওই দুই দিনের পরিচিত বন্ধুর সাথে এত কীসের কথা? রাত ভরে দেখি তার সাথে চ্যাট করতে থাকো। আবার দিনের বেলাতেও সুযোগ পেলেই কথা বলছ। এসব কী? কী এমন কথা তার সাথে? একটা মেয়ের সাথেও তো মানুষ এত কথা বলে না। আচ্ছা, এই সিদ্ধার্থের চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে বয়স কম হয়নি? তো এখনো বিয়ে থা কিছু করেনি কেন? এত গল্প যখন দিন রাত করছ তখন এটা নিশ্চয়ই শেয়ার করেছে তোমার সাথে।

– সিদ্ধার্থ বিয়ে করেছিল।

– বউ কোথায় তবে?

– ডিভোর্স হয়ে গেছে।

– সো স্যাড! তো কেন হয়েছে সেটাও নিশ্চয়ই জানো?

– হুম , জানি তো! এই যে তুমি যেমন আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছ, অবিশ্বাস করছ , সেও তার বউয়ের সাথে এমনই করত। কোনো অন্যায় না করার পরেও তার বউকে এমন উলটাপালটা সন্দেহ করায় সে ব্যাপারটাকে খুব অপমানজনক মনে করে। করারই কথা। আত্মসম্মানবোধ সবার মাঝেই আছে। এটাকে সিদ্ধার্থের বউ সহজভাবে নিতে পারেনি মোটেও। পরে রাগে , লজ্জায় সিদ্ধার্থকে ছেড়ে চলে যায়। সিদ্ধার্থ পরে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও আর কিছু করার ছিল না। এই তো কাহিনী! আর কিছু কি জানতে মন চায়?

– এসব মানুষের সাথে এমনই হয়। নাহ, আর কিছু জানার নেই। কিন্তু এখন কি সে দ্বিতীয়বার বিয়ে শাদী না করে অন্যের সংসার ভাঙ্গার মিশনে নেমেছে?

– তুমি কি আমাকে নিয়ে সত্যিই খুব ইনসিকিউরিটিতে ভুগছ? প্লিজ, একটু ক্লিয়ার করে বলতো! এই বয়সে আমি এমন কিছু করব বলে কি তোমার মনে হচ্ছে?

– আমি কেন ইনসিকিউরিটিতে ভুগব? তোমার লাইফ তুমি যা খুশি করো।

– এটাই তো শুনতে চাচ্ছিলাম। আমার লাইফ আমি যা খুশি করব। তোমাদের পুরুষ মানুষদের সমস্যা কি জানো? তোমরা নিজেরা যা খুশি করে বেড়াও নো প্রবলেম, বাট ঘরের বউ বাইরে বেরুলেই পায়ে পায়ে দোষ খুঁজে বেড়াও। এই যে তুমি সারাদিন অফিসে যাও। অনেক রাত করে বাসায় ফিরো। কখনো কি তোমাকে নিয়ে উলটাপালটা সন্দেহ করেছি আমি? তোমরা যা খুশি করতে পারবে আর আমরা কিছুই করতে পারব না। এই দুঃখেই সিদ্ধার্থের বউ ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ইস, এমন সাহসী সিদ্ধান্ত যদি সবাই নিতে পারতাম! তবে তোমার মত কিছু পুরুষ মানুষ সোজা হয়ে যেত। যেসব পুরুষ মানুষের বউ চলে যায় সমাজের একাংশ সেই পুরুষের দিকে কোন দৃষ্টিতে তাকায় জানোই তো!

আমি ওকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে সেখান থেকে উঠে এলাম। কারণ ওখানে থাকলে তুমুল কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যাবে সেলিমের সাথে আমার।

পরেরদিন সেলিম অফিসে যাবার পরপরই আমি বেরিয়ে পড়ি। সিদ্ধার্থ আমার জন্য বেনারসী পল্লী এসে অপেক্ষা করছে। সেলিম বাসায় থাকায় আমি বের হতে দেরি করে ফেলেছি। আধাঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম।

দুপুর গড়িয়ে যায় অথচ একটা শাড়িও পছন্দ করতে পারছি না আমরা। যেটা আমার পছন্দ হয় সেটা সিদ্ধার্থের হয় না, আবার সিদ্ধার্থের যেটা পছন্দ হয় আমার সেটা পছন্দ হয় না। বেনারসী পল্লীর এ মাথা ও মাথা চষে অবশেষে মেরুন কালারের একটা কাতান শাড়ি আমাদের মোটামুটি দুজনেরই পছন্দ হলো। আমি আমার গায়ের উপরে জড়িয়ে আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থকে দেখালাম কেমন হলো। সিদ্ধার্থ দেখে পছন্দ করল খুব। এরপরে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে ওড়না কিনলাম। এরপর চলে গেলাম এলিফ্যান্ট রোড। সিদ্ধার্থের শেরওয়ানী কিনতে যেয়েও একই রকম বিপত্তি। বেশ সময় গড়িয়ে গেল । সেখান থেকে একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ কমপ্লিট করে চলে গেলাম বসুন্ধরায়। অর্নামেন্টস কেনা এখনো বাকী!
অর্নামেন্টস কিনতে খুব বেশি দেরী হলো না। একটা দোকান থেকেই সবকিছু নিয়েছি। আমার পরিচিত দোকান। যা যা লাগবে সবই পেয়ে গেলাম এক দোকানে।
এরপরে ঘুরেঘুরে আরো টুকিটাকি অনেক শপিং করলাম। সব কাজ শেষ করতে করতে রাত প্রায় ন’টা বেজে যায়। আমি সিদ্ধার্থকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় পৌঁছাতে রাত প্রায় এগারোটা। বাসায় পৌঁছে দেখি সেলিম ড্রয়িং রুমে বসে আছে। কী যে হবে সেটা আমার পূর্বানুমান করাই আছে। তারপরেও চিৎকার চেঁচামেচির বড় ভয় করে আমার।

আমাকে দেখেই সেলিম এগিয়ে এল। আমার চোখের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমাকে চোখ দিয়েই ভস্ম করে ফেলবে।

– কিছু বলবে?

– এত রাত অবধি কই ছিলে? আমি বাসায় এসে শুনলাম তুমি সেই সকালে বেরিয়েছ। এতটা সময় কী করেছ আমি কী জানতে পারি?

– অবশ্যই পারো। সিদ্ধার্থের সাথে ছিলাম।

– সিদ্ধার্থ, সিদ্ধার্থ! আ’ম ফেড আপ। কতবার তোমাকে বোঝাব এসব আমার পছন্দ না। কী করতে চাচ্ছ তুমি? আমি কী তোমার প্লান সম্পর্কে কিছু জানতে পারি?

– কী প্লান জানতে চাও ? আমার তো কোনো প্লান নেই।

– ভেবে বলছো তো!

– অফ কোর্স!

– ওহ রিয়্যালি? প্লিজ, চেক ইওর ফোন । আই থিংক তুমি সিদ্ধার্থে এতটা মত্ত ছিলে যে এখন পর্যন্ত ফোন চেক করার সময় হয়নি।

আমি ব্যাগ থেকে আমার ফোনটা বের করে দেখি আমার হোয়াটস অ্যাপে কয়েকটি ছবি এসেছে সেলিমের নাম্বার থেকে।
আমি ছবিগুলি দেখে চোখ ছানাবড়া। আমি শাড়ির শপে বসে শাড়িটা গায়ে পেচিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে যে ট্রায়াল দিচ্ছিলাম সেটার ছবি। এলিফ্যান্ট রোডে শেরওয়ানী কিনছি সেই ছবি, বসুন্ধরার জুয়েলারি শপের ছবি, আমরা লাঞ্চ করছি সেই ছবি, আরো কত কত ছবি। প্রায় বিশটার মত ছবি। আমি তো অবাক !

– এসব ছবি কই পেলে তুমি?

– অবাক হয়ে গেলে খুব বেশি?

– খুব বেশি না। আমার পেছনে যে স্পাই লাগিয়েছ সেটা আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার।

– তবে কী খুব সাবধান হয়ে যেতে?

– জানি না, তবে ভেবে দেখতাম কী করতাম তখন!

আমার এমন ঠাস ঠাস উত্তর শুনে সেলিমের রাগে হাত পা কাঁপছে। আমি ভয়ে আছি থাপ্পড় টাপ্পড় বসিয়ে না দেয় আমাকে। এই বয়সে তবে মান ইজ্জত আর থাকবে না। তাও অনেক সাহস করে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

– আর কিছু কী বলবে?

– এই ছবির কোনো ব্যাখ্যা দিবে কী?

– নো , আ’ম নট ইন্টারেস্টেড। আমি খুব ক্লান্ত । রুমে যেতে চাই।

সেলিম একদম নিশ্চুপ! আমি চলে যাব তখন সেলিম খুব ঠান্ডা মেজাজে বলল,

– আগামীকাল সকালে প্রিয় আসছে। নাউ হি’জ নট আ কিডস। আই থিংক তার সবকিছু জানা প্রয়োজন। তুমি চলে যেতে চাইলে আমি বাঁধা দিব না। কিন্তু তোমার প্রতি আমার কিছু দায়বদ্ধতার জায়গা আছে। আমাদের সন্তানের কাছে সব কিছু ক্লিয়ার করে তারপরে তুমি তোমার পথ দেখতে পারো। আমার কোনোকিছু বলার থাকবে না আর। আমি বাড়ি ভর্তি সার্ভেন্টের সামনে আর কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাই না। আশা করছি ছেলের কাছে দেবার মতো যথেষ্ঠ উত্তর তোমার কাছে আছে।

আমি সেলিমের কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে খানিকক্ষণ ছলছল চোখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে রুমে চলে গেলাম।

সেলিম রুমে আসেনি। ড্রয়িং রুমে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। আমি কয়েকবার উঁকি মেরে দেখলাম কী করে। খুব ভয় হচ্ছে সেলিমকে।

সারারাত আর ঘুম হলো না। সকালে আমাকে নিয়ে সেলিম সালিশ বসাবে। সেখানে আমি আসামী আর সে বাদী। আর জাজ আমাদের একমাত্র ছেলে প্রিয়। কী লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি হবে ভেবেই হাত পা অবশ হয়ে আসছে।

চলবে….

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১৫

– ছেলের আদালতে মায়ের নামে বিচার বসছে। ব্যাপারটাকে তুমি কি খুব হালকাভাবে দেখছ? এটা যে কত বড় লজ্জার, কতটা ঘৃণার সেটা কি তুমি আন্দাজ করতে পারছ? তোমার নির্লিপ্ত চেহারা দেখে অবশ্য সেটা মনে হচ্ছে না।

– হালকাভাবে কেন দেখব? একদমই হালকাভাবে দেখছি না। তবে এমন দিন আমাকে দেখতে হবে সেটা ভাবি নি কোনোদিন !

– যেমন কর্ম তেমন ফল। এসব কাজ করার আগে তোমার প্রিয়র কথা একবার চিন্তা করা উচিত ছিল।

– আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। আচ্ছা, যাই হোক অন্যায় যদি করে থাকি ছেলের সামনে সেটা ফাঁস হবে। আমি ভয় পাই না।

দু’জন কথা বলছে ঠিক সে সময় প্রিয় এসে রুমে ঢুকল। রুমের মধ্যে বেশ থমথমে পরিবেশ।

– আম্মু, কী এমন হল যে আমাকে এভাবে জরুরী নোটিশে বাসায় নিয়ে আসতে হলো?

– সেটা তোমার আব্বুকে জিজ্ঞেস করো।

– আব্বু, কী হয়েছে এমন?

সেলিম এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসল।

– বলছি। আগে তুমি বসো।
বাবা তুমি এখন যথেষ্ট ম্যাচিউরড হয়েছ। বয়স প্রায় আঠারো ছুই ছুই। তাই অনেক সাহস করে তোমার কাছে কথাগুলো বলতে চাচ্ছি।
আমার কেন যেন খুব মনে হচ্ছিল তোমাকে ব্যাপারগুলি জানানো দরকার। বাবা হয়ে ছেলের কাছে এগুলো বলাটা খুবই দৃষ্টিকটু মনে হলেও পরে আমার মনে হল কথাটা তোমাকে না জানালেই বরং তোমার সাথে অন্যায় করা হবে কারণ এর সাথে তোমার নজীবন জড়িত।

– আব্বু, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

– না, মানে! ব্যাপারটা আসলে কিভাবে বলব! ভেবেছিলাম তোমার কাছে বলাটা আমার জন্য সহজ হবে। অনেক কথা গুছিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু এখন তো দেখছি এটা বলা খুবই কঠিন আমার জন্য।

– আব্বু, কি হয়েছে বলবে তো!

– না, মানে! ব্যাপারটা আসলে তোমার আম্মুর ব্যাপারে!

-কি করেছে আম্মু?

– সি ইজ ইন লাভ!

– সো?

– তোমার আম্মু একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। সে তাকে বিয়ে করতে চায়।

– আর ইউ সিরিয়াস, আব্বু?

– আমি জানি কথাটি তোমার জন্য মোটেই সুখকর নয়। কোন সন্তানের জন্যই নয়। তুমি কষ্ট পাবে আমি জানি। জেনে-বুঝেই আমি তোমাকে ডেকেছি। যাতে কষ্টটাকে মেনে নেওয়া শিখতে পারো।

আমি বাপ বেটার আলাপ-আলোচনা শুনছি আর মনে মনে হাসছি।

– তোমার মা ব্যাংককে যেয়ে কোন এক হিন্দু লোকের সাথে রিলেশনে জড়িয়েছে। সেই লোক এখন বাংলাদেশে। বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশে আছে। তার সাথে তোমার মায়ের নিয়মিত আড্ডা দেওয়া, ঘোরাফেরা এমনকি বাসা পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। যাই হোক মানুষের বন্ধু থাকতেই পারে তা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি ঘটেছে যেটা দেখে সেটাই তোমাকে আমি দেখাবো। তুমি এই ছবিগুলো দেখো।

সেলিম নিজেই তার মোবাইল বের করে একটার পর একটা ছবি প্রিয় কে দেখাচ্ছে। প্রিয় চুপচাপ ছবি দেখা শেষ করল।

প্রিয় কোনো কথা বলছে না দেখে সেলিম তাকে জিজ্ঞেস করল কী কথা বলছ না যে? কী বুঝলে বলো!

– আমি কিছুই বুঝলাম না! শুধু বুঝলাম একটা লোক আই মিন আম্মুর বন্ধুর সাথে আম্মু শপিং করছে, খাওয়া দাওয়া করছে এই তো!

– তুমি অনেক ছোট বাবা। তাই এসব বুঝতে পারছ না। কিন্তু যেহেতু এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেক্ষেত্রে তোমার জানা দরকার। এ জন্যই তোমাকে ডাকা।
তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তাই তোমার সবই জানা উচিত।

– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কী বলবে বুঝিয়ে বলো, আব্বু।

– তোমার আম্মু তার নিজের বিয়ের শপিং করছে। সে আমাদেরকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছে। তুমি কি এটা সহজভাবে মেনে নিচ্ছ?

প্রিয় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আম্মু! আব্বু যেটা বলছে সেটা কি সত্যি?

– বাবা, তোমার আব্বুকে বল তার একটা কমনসেন্স থাকা দরকার ছিল । আমি একজনের বিবাহিতা স্ত্রী হয়ে অন্য জনকে কি করে বিয়ে করি? তোমার বাবার সাথে তো আমার এখন পর্যন্ত ডিভোর্স হয়নি! আর একটা ডিভোর্সের প্রসেস শেষ হতে কতদিন লাগে সেটা নিশ্চয়ই তোমার আব্বু জানে!

– হোয়াট ডু ইউ মিন? তুমি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছো?

– সেটা কখন বললাম?

– আলাদাভাবে কেন বলতে হবে? তোমার কথা দিয়ে বুঝিয়েই তো দিলে।

– তুমিই তো বললে আমি নাকি সিদ্ধার্থকে বিয়ে করছি। আমি তো একবারের জন্যও এমন কথা বলি নি। আসল কথা হচ্ছে যে যেমন, সে অন্যকেও নিজের মতো করেই ভাবে!

– হোয়াট? আমি আবার কী করলাম?

– প্রিয়, তোমার আব্বুকে মনে করিয়ে দিতে হয় তবে।
তাকে জিজ্ঞেস করো তার পি এস হেলেনের সাথে অফিসিয়াল সম্পর্কের বাইরে আর কী সম্পর্ক তার? তোমার চতুর বাপ মনে করেছে আমি কিছুই জানি না। আমি সবই জানি, সব খবর আমি রাখি।
হঠাৎ করে হেলেনের গায়েব হয়ে যাবার পেছনের কাহিনীও কিন্তু আমি সব জানি। আমি কী তবে মুখ খুলব?

হেলেনের নাম শুনে সেলিম এবার নড়েচড়ে বসল খানিকটা। অবাকই হলো বলা যায়।

– এসব কী বলছ? নিজের অন্যায় ঢাকতে আমাকেই উল্টো ব্লেম করছ?

– সত্যি বলছি, সেলিম । তুমি কী এখন ছেলের সামনে আমাকে ডিটেইলস বলতে বলছ? তবে তুমি অনুমতি দিলে প্রিয়র কাছে আমি সবকিছু জানাতে চাই।

– রূম্পা! চিৎকার করে উঠলো সেলিম।

– চিৎকার করছ কেন? তোমরা পুরুষ মানুষ বলে যা খুশি করে বেড়াতে পারবে। আমরা কিছু করলেই দোষ! তোমরা হাজার অন্যায় করেও পার পেয়ে যাবে। আর আমাদের জন্য জেল জরিমানা!
আগে নিজেকে শোধরাও তারপর না হয় অন্যকে জ্ঞান দিতে এসো। আমাদের মেয়েদের একফোঁটা অন্যায় দেখলে সহ্য করতে কষ্ট হয়। তাহলে ভেবে দেখো দিনের পর দিন আমরা কী করে সহ্য করি? তুমি চাইলেই হেলেনের ব্যাপারটা অস্বীকার করতে পারো। আমি কিছুই বলব না। আমার বলা না বলায় কিছুই পরিবর্তন হবে না। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করো তুমি কী একবারের জন্যও আমার কথা, প্রিয়র কথা, সমাজের কথা, ধর্মের কথা ভেবেছিলে এসব কুকর্ম করার আগে?

– বাজে কথার লিমিট থাকে রূম্পা। ছেলের সামনে নিজের দোষ ঢাকতে কীসব উল্টাপাল্টা বলছ?

প্রিয় ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে।
খানিকটা সময় চুপচাপ থেকে সে তার আব্বু আর আমার দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বলল,

আমি কোনোদিন ভাবিনি এমন একটা ব্যাপার নিয়ে তোমাদের সাথে আমার কোনোদিন কথা বলতে হবে! পৃথিবীর কোন সন্তানের যেন এমন দুর্ভাগ্য না হয়।
তোমাদের দুজনের সাথে কথা বলে যেটা বুঝলাম তোমরা একসাথে সুখী নয়। এজন্যই একে অপরকে দোষ দিয়েই যাচ্ছ। আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। অনেক কিছুই বুঝি। মোটামুটি যে জ্ঞান আছে সেই জ্ঞানের ভিত্তিতেই এটুকু বলব, তোমাদের যদি একসাথে থাকতে ভালো না লাগে, একজন আরেকজনকে শ্রদ্ধার সাথে দেখতে না পারো তবে শুধুশুধু তিক্ততা আর না বাড়িয়ে আলাদা হয়ে যাওয়াই উচিত। আমি খুব কষ্ট পাব। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমি মেনে নিতে চেষ্টা করব। তারপরও তোমাদেরকে এই অসুস্থ সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যেতে অনুরোধ করব না। ক্যাডেটে পড়ে এই ক’বছর অনেক কিছু শিখেছি। তোমাদের থেকে দূরে থেকে তোমাদের মূল্যটাও বুঝতে শিখেছি। কিন্তু তোমরা? যাক, সেটা আমার ভাগ্যে নেই হয়ত।
তোমাদের যখন আমার জন্য কোনো ভাবনাই নেই সেখানে কান্নাকাটি করে হাত পা ধরে তোমাদের একসাথে রাখার কোনো মানে নেই।

আমাকে যখন তোমরা জানানোর জন্য ডেকেছই তাই আমি বলব, আম্মু যদি তার বন্ধুকে বিয়ে করে নিজের জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে চায় আমি আপত্তি করব না। আমি তোমাদের সুখী দেখতে চাই।
তআমি নিজেই তোমার বিয়েতে উপস্থিত থাকব। আর আব্বুর জন্যও একই কথা। তুমিও যদি কাউকে এ ঘরে এনে আম্মুর জায়গা দিতে চাও আমি একবারের জন্য বাঁধা দিব না।

শেষের দিকের কথাগুলো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে বলতে প্রিয় সেখান থেকে দ্রুত চলে গেল।

আমি প্রিয়র কষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। খানিকক্ষণ থম মেরে বসে থেকে সেলিমের উদ্দেশ্যে কিছুটা আবেগমিশ্রিত গলায় বললাম,

প্রিয়র কথা তো শুনলেই। আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রিয়কে ডেকে আমাকে চিন্তামুক্ত করলে। আমি নির্ভার হলাম। আমার কাছ থেকে সবকিছু বুঝে নিও। আমার কাছে তোমার যা কিছু আছে আমি সব রেখে যাচ্ছি। যে সংসারে শুধু অপমান আর অপদস্তই হলাম সেখানের কোনো স্মৃতি চিহ্ন আমি আর বয়ে বেড়াতে চাই না।
আমার এত বছরের ভালোবাসা যার কাছে একটা রাস্তার মেয়ের ভালোবাসার থেকে সস্তা সেখানে আর যাই পাওয়া যাক মানসিক সুখ কোনোদিন মিলবে না।
এই আধুনিক যুগে এসেও আমরা নারীরা আজও শৃঙ্খলিত , নিপীড়িত, নির্যাতিত। । অনেকে মুখ খুলে কারো কাছে হয়ত বলতেও পারি না নিজের কষ্টের কথা। প্রতিটি নারী মাত্রই জানে প্রতিনিয়ত কতটা অবহেলা , অসম্মান, অবজ্ঞা আর আত্মসম্মানহীণতার ভেতর দিয়ে দিন পার করতে হয় তাদের।
শুধু পেট ভর্তি খাবার, ভালো পোশাক আর প্রাচুর্যের মাঝেই যদি মানুষের প্রকৃত সুখ মিলত তবে আমি বলতাম আমি সুখী।

চলবে…..