সুখের সন্ধানে পর্ব-১৯

0
281

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১৯

গত আট বছরে জীবনের অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। সেদিন যে মানুষটির অনুরোধে আমি এই বাড়িতে এসেছিলাম সেই মানুষটি অচেনা দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। যাবার আগে আমার কাছে চাওয়া তার শেষ ইচ্ছাটি আমি অপুর্ন রাখতে পারিনি। সেলিম আর আমি এখন একসাথেই থাকি। ক’বছর নির্বাসিত থেকে অবশেষে সংসারী হয়েছে সে। অবশ্য সেলিম তার আচরণের জন্য খুবই দুঃখিত। এরপরে আর কখনোই সেলিমকে অবিশ্বাস করতে হয়নি আমার। ইচ্ছে করেই হেলেনকে ফোন দিয়ে ঢাকায় ডেকেছিলাম। সেলিমের জীবনে ফেরবার অনুরোধও করেছিলাম। সে সেলিমের কাছে ভিড়বার চেষ্টা করেছিল কি না আমার অজানা। জানার ইচ্ছাও হয়নি। শ্বশুর শাশুড়ির সাথে বেশ ভালো একটা সময়ই কেটেছে এত বছর। আমার শাশুড়ির চোখে এখন মোটামুটি একটা ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি এটুকুই আমার এত বছরের বড় প্রাপ্তি।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে দুলতে যে সম্পর্কটা একদিন ছিন্ন হবার ছিল সেই সম্পর্কটি শুধুমাত্র আমার শ্বশুরের জন্য আজও টিকে আছে।
আমরা এখন আমার শ্বশুরের উত্তরার বাড়িতে থাকি। আমাদের আগের বাড়িতে মালিহা আর সজল ওদের দুই মেয়েকে নিয়ে থাকছে। ভাগ্যের চাকা কখন কোনদিকে ঘুরবে কেউই জানি না। একসময় যেখানে ছিল আমার সংসার সেখানে ওরা থাকে। আব্বা মারা যাবার পর আম্মার অনুরোধে মালিহা ওর বাবার বাসা ছেড়ে চলে এসেছে। যে বাড়িতে মালিহার থাকার কথা ছিল সেখানে আমি থাকছি আমার স্বামী সন্তান নিয়ে। এ বাড়িতে থাকার জন্য এক সময় আমার মনটা খুব হাহাকার করত। কিন্তু তখন আমার স্থান ছিল এ বাড়ির ড্রয়িং রুম আর ডাইনিং টেবিলে সীমাবদ্ধ। মালিহা খুব গর্বের সাথে এত বড় বাড়িতে মাথা উঁচিয়ে আমার সামনে যখন ঘুরে বেড়াত তখন খুব কষ্ট হতো। কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি এ বাড়িতে আমার একরাত থাকবার মতো সুযোগ আসবে জীবনে। আমার শাশুড়ির চোখে এমন অবস্থান তৈরি করাটা কল্পনাতীত ছিল আমার জন্য। আল্লাহ হয়ত যা করেছে আমার ভালোর জন্যই করেছে। এই বিরহে পুড়ে সেলিমও কিছুটা শুধরেছে। তবে অহংবোধ আজও কমেনি। সেটা মনে হয় ওর রক্তে মিশে আছে।

প্রিয় এমবিএ করছে। দেখতে শুনতে তার বাবাকেও ছাড়িয়ে গেছে। পড়াশুনার পাশাপাশি সেলিমের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যও দেখছে আজকাল। আগে আমিও বেশ একটিভ ছিলাম বিজনেসে। কিন্তু আব্বা মারা যাবার পর থেকে আগের মতো এখন আর অফিসে রেগুলার যাওয়া হয় না। সপ্তাহে দু’একদিন যাই। আব্বাকে হারিয়ে আম্মা বেশ ভেঙ্গে পড়েছেন। তাই তাকে একা রাখতে মন চায় না। সিলভি ওর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিদেশেই সেটল । আব্বা মারা গেলে এসে গিয়েছে । এরপর আর আসেনি। সজল মাঝেমাঝে আসলেও মালিহা খুব বেশি আসে না এদিকে। সম্পত্তি নিয়ে আব্বার করে যাওয়া উইলের রেশ এখনো কাটেনি। সজল সেলিমের সাথে বিজনেস দেখাশুনা করে। সজল সেলিমের বেশ আজ্ঞাবহ। কিন্তু আসল সমস্যা হচ্ছে মালিহা আর ওর পরিবার। সজল ভালো থাকতে চাইলেও হয়তো ওদের জন্য বেশিদিন ভালো থাকতে পারবে না।

এখন আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের অধ্যায় হলো জীবন থেকে আবার হারিয়ে ফেলেছি আমার একমাত্র বোন টুম্পাকে। আগেরবার তো ওর রাগ ভাঙ্গিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম আমার জীবনে কিন্তু এবার আমি একদমই অপারগ। প্রায়ই রাগ ভাঙ্গাতে ওর দরজায় যেয়ে দাঁড়াই কিন্তু সে একদমই সাড়া দেয় না দরজা খোলাতো থাক দূরের কথা। বুক চিড়ে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে কিন্তু কাউকে দেখাতে পারি না একদমই। এত এত অভিমান আর জিদ ওর। কী দরকার ছিল এত তাড়াতাড়ি তোর চলে যাবার? একবারও মিথিলা আর মেহরাবের কথা ভাবলি না ? নাকি আমাকে পেয়ে নিজের দায়িত্বের কথা ভুলে গেছিস তুই? দুইটা কিডনি ড্যামেজ জানতে পারার পরে মাত্র বছরখানেক ছিল বোনটা আমার। বছর দেড়েক আগে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে টুম্পা। যাওয়ার আগের দিন রাতে আমার সাথে ফোনে কথা বলার সময়েও আমি বুঝিনি সেদিনই ছিল ওর সাথে আমার শেষ কথা। মজার ছলে মিথিলা আর মেহরাবের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিয়ে নিজে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলি। আব্বা মারা যাবার কয়েক মাসের মাথায় বোনকে হারিয়ে মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়ি আমি। এখন কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও যখনই মনে পড়ে তখনই বুকের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। কী যে অসহনীয় যন্ত্রণায় ছেয়ে যায় মনটা! মিথিলা আমার কাছেই থাকছে ক’মাস ধরে। ক’দিন আগেই এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে। ওর মুখের দিকে তাকালে আমি টুম্পাকে খুঁজে পাই যেন! মায়ের মতো শ্যামলা বর্ণের গোলগাল চেহারা আর একহারা গড়নের দেখতে মেয়েটি। কী যে মায়ামাখা ওর কাজলকালো চোখ দুটি! ওকে যখন এ বাড়িতে নিয়ে আসতে চাইলাম আমার শাশুড়ি তেমন আপত্তি না করলেও সেলিম কিছুটা করেছিল । পরে বুঝিয়ে বলার পরে সে রাজি হয়। প্রিয় আর মিথিলা পাশাপাশি থাকবে এ নিয়েই তার আপত্তি । আমি তাকে নিশ্চিত করেছি এমন কিছুই ঘটবে না যা সে ভাবছে। মিথিলা আর প্রিয় ভাইবোন , তাই এর অতিরিক্ত অন্য কোনো সম্পর্কই গড়াবে না ওদের।

মিথিলার বাবা আবার বিয়ে করেছে । সেই মহিলারও একটা ছেলে আছে। মেহরাবের বয়সি হবে। প্রথমে বলেছিল তার ছেলেকে সাথে নিয়ে আসবে না, কিন্তু মাস কয়েক যেতে না যেতেই ছেলে চলে আসে মায়ের কাছে । আর এরপরেই শুরু হয় মূলত উনার আসল চেহারা দেখানো । মেহরাব এখনো পর্যন্ত বাবার কাছেই আছে। এবার সেভেনে পড়ছে। তবে কতদিন বাবার কাছে থাকতে পারবে তার ঠিক নেই। ওর বাবাও যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। কথায় বলে না মা না থাকলে বাপ হয় তালুই। মিথিলার বাবাকে দেখে বারবার ওই কথাটাই মনে পড়ে আমার। আমি চেয়েছিলাম মেহরাবকেও নিয়ে আসব। কিন্তু সাহস করতে পারিনি। তাও ভেবে রেখেছি সেলিমের কাছে বলব। ছেলেটা অনেক মানসিক অত্যাচারের মধ্যে থাকে। মিথিলা মেয়ে বলে কাছে নিয়ে এসেছি। মায়ের গাইড ছাড়া একটা মেয়ে ভুল পথে যাওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই হয়ত মিথিলার বাবাও না করেন নি।

মিথিলা পড়াশুনায় বেশ ভালো। ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য হরদম উঠে পড়ে লেগেছে। একটা কোচিং এ ভর্তি করে দিয়েছি। আমিই সাথে করে নিয়ে যাই যেদিন ক্লাস থাকে। পড়াশোনার দিকেও খেয়াল রাখছি। প্রথম দিকে প্রিয় আর মিথিলার মাঝে কিছুটা দুরত্ব থাকলেও এখন একটু স্বাভাবিক। মিথিলা কথাবার্তা কিছু বললেও প্রিয় খুব বেশি কথা আগায় না। প্রিয় কোনোরকম দায়সারা ধরণের উত্তর দিয়ে চলে যায়। আসলে ছোট থেকে ওরা দূরে দূরে থাকায় ওদের মাঝের সম্পর্কটা স্বাভাবিক না। নাকি প্রিয়ও ওর বাবার মতোই মিথিলাকে এখানে নিয়ে আসাটা ভালো চোখে দেখছে না বুঝতে পারছি না। ছেলেটা যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান হলেও যতই দিন যাচ্ছে ততই দাদী আর বাবার মতো নাক উঁচু স্বভাবের হচ্ছে। যাই হোক কিছুটা হলেও তো রক্ত তো কথা বলবেই । প্রিয়র এমন ব্যবহারে মিথিলা হয়ত কষ্ট পায় কিন্তু কখনো প্রকাশ করে না। এই যেমন গত সপ্তাহে আমি কিছুটা অসুস্থ বোধ করায় প্রিয়কে বললাম যাওয়ার পথে মিথিলাকে ক্লাসে নামিয়ে দিতে । কিন্তু প্রিয় যেন ব্যাপারটা শুনেও না শোনার ভাণ করে বেরিয়ে গেল। ব্যাপারটা মিথিলার সামনেই ঘটেছে । মেয়েটা হয়ত খুব লজ্জা পেয়েছে। আমি নিজেও লজ্জা পেয়েছি প্রিয়র এমন ব্যবহারে ।
আমার শাশুড়ির সাথে মিথিলার এখন মোটামুটি ভালোই সম্পর্ক। আমি কিছু না বললেও মিথিলা নিজে থেকেই কোনো কাজবাজ না থাকলেই যেয়ে উনার পাশে বসে। মাঝেমাঝে জোর করেই উনার চুলে তেল লাগিয়ে দেয়, মাথাটা ম্যাসাজ করে দেয়, পায়ে বাতের ব্যাথাটা বাড়লে সরিষার তেল বা বাম মালিশ করে দেয়া ওর রেগুলার রুটিনে পরিণত হয়েছে। উনার পাশে বসে দীর্ঘক্ষণ গল্প করে মিথিলা। উনার সাথে মিথিলার সম্পর্কের এই উন্নতি দেখে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি আমি। মিথিলা খুব বেশি সেলিমের সামনে যায় না। সেলিমকেও কখনো দেখি না মিথিলার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করতে। আমিও আগ বাড়িয়ে বলতে যাই না কিছু। সে যেহেতু মিথিলার এ বাড়িতে থাকাটা স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না তাই আমারও ইচ্ছে হয় না জোর করে ব্যাপারটা স্বাভাবিক করার। থাকুক সে তার মতো । অন্ততপক্ষে মিথিলার থাকা নিয়ে ঝমেলা করছে না এটাই শান্তি। মেয়েটাকে চেষ্টা করি ব্যাপারটা বুঝতে না দেবার কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় ও সবই হয়ত বুঝতে পারে। তাই তো সেলিমের সামনে পারতপক্ষে কখনো আসতে দেখি না। এত বড় বাড়িতে ও সারাদিন ওর নিজের রুমেই বই খাতার মধ্যে বন্দি থাকে। সেলিম যখন না থাকে তখন একটু বের হয়। মাঝেমাঝে আমার বেডরুমে আর আম্মার রুমে যাওয়াই ওর সীমানার মধ্যে পড়ে।

বাসায় কোনো পার্টি শার্টি হলেও পড়াশোনার অজুহাতে ও রুমেই থাকে। দিন দশেক আগে প্রিয়র ফ্রেন্ড সার্কলের একটা গেট টু গেদার ছিল । ওদের মাঝে কয়েকজন মেয়েও ছিল। কতবার বললাম মিথিলাকে বেরিয়ে ওদের সাথে জয়েন হতে কিন্তু ও একদমই শুনল না। প্রিয়কে বললাম ওকে ডাকতে কিন্তু প্রিয়র কথা “ ও এখানে এসে কী করবে? এটা আমার ফ্রেন্ডদের পার্টি। এখানে এসে ও এঞ্জয় করার পরিবর্তে বোর ফিল করবে। “ বুঝলাম প্রিয়র আগ্রহ নেই ওকে ডাকার। তাই আর জোর করলাম না।

দিনরাত মেয়েটা খাটছে একটা ভালো ফলাফলের প্রত্যাশায়। আমিও মনেপ্রাণে দোয়া করছি ওর জন্য। মিথিলার মুখের দিকে তাকালে আমি যেন টুম্পাকেই খুঁজে পাই। মাঝেমাঝে তন্ময় হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। খুব ঠাণ্ডা মেজাজের হয়েছে। খুব চিন্তাভাবনা করে কথা বলে । এদিক থেকে সে মায়ের থেকে কিছুটা আলাদা। যে ঘরের বউ হবে আমি নিশ্চিত পুরো ঘরে আলো ছড়াবে নিঃসন্দেহে । জানিনা কার ভাগ্যে আছে এই লক্ষী মেয়েটা? শুধু ভালো কিছু আশা করছি। মেয়েটার একটা ভালো ভবিষ্যৎ আশা করছি।

অবশেষে মিথিলার মনের আশা পুরণ হয়েছে । ফিন্যান্সে চান্স পেয়েছে ঢাকা ভার্সিটিতে। খবরটা অবশ্য আজ প্রিয়ই নিয়ে এসেছে। কেন জানিনা আমার আনন্দে চোখ ভিজে এল। সন্তানের সাফল্যের খুশিতে মা বাবা খুব বেশি আবেগী হয়ে পড়ে। আমিই বা তার বিকল্প কেন হব? আমার শাশুড়িও বেশ খুশি হয়েছে মনে হলো। যদিও মুখে উনি কখনোই উনার আবেগ প্রকাশ করে না। তবে এতবছরে যতটুকু চিনেছি তাতে মনে হলো উনিও মিথিলার খুশির শরিক।

রাতে খাবার টেবিলে সবাই খাচ্ছে। আমি পাশে বসে সার্ভ করছি। বসে আছি এদের খাওয়া শেষ হলে মিথিলার সাথেই আমি ডিনার করব।

– আম্মু, তুমি বসতে পারো তো আমাদের সাথে!

– না , বাবা! মিথিলা তবে একা রয়ে যাবে। আমি ওর সাথে খাব।

– মিথিলাকে ডাকো। ও পরে খায় কেন প্রতিদিন? একসাথে বসলেই তো পারে!

প্রিয়র মুখে এ কথা শুনে আমি ভীষণ খুশি। কখনোই এভাবে মিথিলাকে একসাথে বসার ব্যাপারে বলেনি প্রিয় বা ওর বাবা। সেলিমের মুখের দিকে তাকালাম প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য। কিন্তু তেমন কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলাম না। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে হয়ত ছেলের কথায় সে অখুশি হয়নি বা খুশিও হয়নি। আমি দ্রুত মেইডকে পাঠালাম ওকে ডিনারের জন্য ডেকে আনতে। মিনিট দুই তিনের মাঝেই মিথিলা এসে পড়ে। আমি ইশারায় বসতে বললাম । প্রিয়র পাশের চেয়ারটা ফাঁকা আছে। মিথিলা টেবিলে সবাইকে একসাথে দেখে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বুঝতে পারছি। আমি ওর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে ইশারায় আবারো বসতে বললে ও আস্তে চুপ করে ভয় ভয় চোখে চেয়ারে বসল। আমি ওর দিকে প্লেট এগিয়ে দিলাম । মিথিলা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে টুকটাক কথাবার্তা বলে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছি।

– কি রে , মিথিলা! এবার তো ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট হয়ে গেলি। এখন আর পায় কে? দেখবি বিশাল ভাব এসে যাবে শরীরে! হা হা!

– এসব কী বলছ ,ভাইয়া! মনে হচ্ছে দেশের প্রাইম মিনিস্টার হয়ে গেছি।

– আরে এমনই তো ভাবে সবাই। আমাদের কয়েক ফ্রেন্ড তো চান্স পেয়ে এমন বিহেভই করেছিল। তাই মনে হলো তুইও হয়ত বদলে যাবি।

– তোমার কি তাই মনে হয়?

– মনে তো হচ্ছে না। কিন্তু মানুষের মন তো ! তাই বলা যায় না। আচ্ছা, তুই প্রতিদিন লেটে খেতে আসিস কেন? কী এত পড়িস? আম্মু প্রতিদিন তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে কত রাত করে খাবার খায়। রাতের খাবার যত তাড়াতাড়ি খাওয়া যাবে ততই হেলথের জন্য ভালো। বুঝেছিস!

মিথিলার সাথে প্রিয়র এত এত কথা শুনে আমি তো অবাক! এই ক’মাসে আজই এত দিলখোলা হয়ে ও মনে মিথিলার সাথে কথা বলছে । তাও ওর দাদী আর বাবার সামনে।

প্রিয়র কথার রেশ ধরেই এবার আম্মাও বলল,

– মিথিলা, ঠিকই বলেছে কিন্তু আমার দাদাভাই! রাতের খাবারটা আগেভাগে খেয়ে নেওয়াই ভালো। পড়াশুনা সে তো যেকোনো সময় করা যায়! এখন থেকে আমাদের সাথেই বসে যাবে। তোমার রূম্পা মায়েরও খাওয়ার জন্য লেট হবে না।

মিথিলাও আমার মতো অবাক বুঝতে পারলাম। সে সেই অবাক ভাবটা লুকিয়ে বলল,

– জি, দাদি। এখন থেকে চেষ্টা করব।

– চেষ্টা না। এটাই করবে। তোমার দাদাকে তো দেখনি! সে ছিল রুলসের ব্যাপারে খুবই স্ট্রিক্ট। সারাদিন যে যেখানেই থাকুক বাসার সবার একসাথে ডিনারে বসতেই হবে।

– আচ্ছা, দাদী। আস্তে করে কোনোরকম করে বলল, মিথিলা।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুলটা বেণী করছিলাম । সেলিমকে দেখলাম ডেল কার্ণেগির একটা বইয়ে নাক গুঁজে আছে। আমিও গুণগুণ করে গান গাইছি আর চুল বাঁধছি ।
হঠাৎ সেলিম আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– বুঝেছ, ভেবেছি এবার প্রিয়র বিয়েটা সেরে ফেলব। সিলভি কবে আসতে পারবে জেনে বিয়ের ব্যাপারে ভাবতে হবে।

– আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, হঠাৎ করে প্রিয়কে বিয়ের কথা ভাবছ?

– ভাবতে তো হবেই । বড় হয়েছে না?

– ওর তো এখনো পড়াশোনাই শেষ হয়নি।

– সো হোয়াট? পড়াশুনা শেষ করার সাথে বিয়ের কী সম্পর্ক? এসব কথা ভাবে মিডল ক্লাসরা। আমার কী কিছুর অভাব ? তাছাড়া প্রিয় নিজেও অনেক প্রপার্টি ওউন করে।

– সেটা ঠিক আছে! কিন্তু তারপরও! ওর ম্যাচুউরিটিরও একটা ব্যাপার আছে।

– হি ইজ এনাফ ম্যাচিউরড! বাই দ্যা ওয়ে, ওর কোনো পছন্দ আছে নাকি কিছু কী জানো?

– আমার তেমন জানা নেই। তবে রিনি ওর ভালো বন্ধু তাই জানি।

– রিনি? মানে মামুন ভাইয়ের মেয়ে?

– হুম!

– নট ব্যাড! মেয়েটা বেশ লক্ষী আছে। তাছাড়া মামুন ভাইয়ের নাম ডাক আছে । লাস্ট ইয়ারে চেম্বারস অব কমার্সের বেশ উচ্চপদে ছিলেন।

– হুম!

– আচ্ছা, এক কাজ করো তো!

– বলো!

– তুমি প্রিয়র সাথে কালই কথা বলো। রিনির ব্যাপারে ক্লিয়ার হও। রিনির ব্যাপারে যদি পজিটিভ হয় তবে আমি ইমিডিয়েট মামুন ভাইয়ের সাথে কথা বলব। পরে সিলভির সাথে কথা বলে একটা ডেট ফিক্সড করে ফেলব।

– এত তড়িঘড়ি করছ কেন?

– তড়িঘড়ি কোথায় দেখলে? আমি তো ধীরেসুস্থেই এগুচ্ছি। জাস্ট প্লান করে রাখলাম। তবে তুমি প্রিয়র সাথে কথা বলতে ভুল করো না। ও তো তোমার সাথে আমার থেকে বেশ ফ্রী! আমাকে সে এসব ব্যাপারে কিছুই বলবে না এটা আমি ভালো করেই জানি।

– আচ্ছা , দেখছি। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ওকে বিয়ের কথা না বললেই মনে হয় ভালো হতো! দায়িত্ব নেবার মতো মানসিকতা মনে হয় না ওর এখনো এসেছে।

– আরে ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে সবই বুঝবে। আর দায়িত্বের কী আছে? এসব মিডল ক্লাস মার্কা কথা বলো না তো একদম ! বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কখন না কখন মারা যাই? নাতি নাতিনীর মুখ দেখে যেতে হবে তো!

– এসব কি বলছ? ইনশা আল্লাহ, তোমার আশা পূর্ণ হবে একদিন।

চলবে….