সুখের সন্ধানে পর্ব-২০

0
250

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২০

সেলিম হুট করে প্রিয়র বিয়ের কথা ভাবছে শুনে প্রিয়র মেজাজ গরম হয়ে গেল। আমাকে সেলিম যেটা জিজ্ঞেস করতে বলেছে আমিও সেটা জানতেই ওর কাছে এসেছিলাম। একটু ঘুরিয়ে পেচিয়ে ওর কাছে জানতে চাইলাম রিনির সাথে ওর রিলেশানটা আসলে শুধুই কী বন্ধুত্ব নাকি এর চেয়ে বেশি কিছু! এটুকু জিজ্ঞেস করাতেই প্রিয় আসল ঘটনা টের পেয়ে যায়। আমিও আর না পেঁচিয়ে জানালাম ওর আব্বুর সিদ্ধান্তের কথা। প্রিয় সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে এখনো পর্যন্ত বিয়ের কথা ভাবছে না। আর রিনিকে তো একদমই না। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ও রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আমিও আর আটকালাম না। আমিও চাই না এখনি একটা দায়িত্বের বোঝা ওর কাঁধে চাপিয়ে দিতে। এতটুকুন ছেলে ! ও এখনি কী প্রস্তুত এসব বিয়েশাদীর প্যারা মাথায় নিতে। কিন্তু সেলিমকে বোঝায় কে? যাই হোক আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে সেটা পালন করেছি । সেলিম বাসায় এলে জানিয়ে দিব প্রিয়র মতামত।

মিথিলার ক্লাস শুরু হয়েছে কিছুদিন হলো। কয়েকদিন সাথে করে নিয়ে গিয়েছি আমি। কিন্তু এভাবে প্রতিদিন তো সম্ভব না। আমার নানান ধরণের কাজ থাকে। তাছাড়া আমার শাশুড়ি একা থাকেন। আর উনার কথাবার্তা শুনে মনে হলো উনি এভাবে মিথিলাকে প্রতিদিন নিয়ে যাওয়াটা ভালো চোখেও দেখছেন না। মিথিলাও খুব নিষেধ করছে। ও বারবার বলছে ও নাকি একাই ম্যানেজ করতে পারবে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে। ঢাকা শহরের যে অবস্থা! প্রতিদিন নিউজ চ্যানেল আর নিউজ পেপারে যেসব নিউজ দেখি আর পড়ি তাতে এ শহরে একটা মেয়ের একা চলাফেরা কতটা নিরাপদ সেটাই ভেবে পাই না। মিথিলা অন্য মেয়েদের মতো চালাক চতুর হলেও চিন্তা কিছুটা কম হতো। সেই ছোটবেলা থেকেই মায়ের আঁচল ধরে ধরে এ পর্যন্ত এসেছে। এ জন্যই বেশি চিন্তা। কিন্তু এভাবে তো চলা যাবে না। ওকে এই পৃথিবীর হাবভাব জানতে হবে , বুঝতে হবে। না হলে মেয়েদের যে পদে পদে বিপদ ওৎ পেতে আছে এটা কী করে বুঝবে ও! এত বড় জীবন ! কতদিন এমন সাপোর্ট নিয়ে চলবে সে ? অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম ওর সাথে আর আমি যাব না। তবে আমার গাড়ির ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি ওকে সময়মতো ভার্সিটিতে দিয়ে আসতে আবার নিয়ে আসতে।

আজ মিথিলাকে নিয়ে বিকেলে বংশালে ওদের বাসায় এসেছি। মেহরাবের জন্য মনটা কেমন করছিল খুব। আমাদেরকে দেখে মেহরাবের খুশি দেখে কে! আপনজনকে কাছে পেয়ে যেন বন্দী পাখি খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছে। মেহরাবকে দেখে বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। ছেলেটার এখন বাড়ন্ত বয়স। কেমন ডগমগিয়ে উঠেছিল ক’মাস আগেই। অথচ এখন দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটার বয়স তেরো থেকে দশে নেমে এসেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। নাকমুখ কেমন শুকনা শুকনা। আমার কান্না পেল ওর অবস্থা দেখে। আমি মিথিলার ছোটো মা পারুলকে ডাকলাম। আমাদের জন্য নাস্তা পানি রেডি করে আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত সে। উনি কাজে ব্যস্ত দেখে আমি মিথিলাকে পাঠালাম কিচেনে। মিথিলা দায়িত্ব নিয়ে পারুলকে পাঠিয়ে দিলো।

– পারুল, বসো না! খাওয়া দাওয়া সে তো বাসাতেও হয়। এলাম একটু গল্পসল্প করি। এত ব্যস্ত হয়ো না ,প্লিজ!

– না, না, আপা! কী যে বলেন! তাই বলে কি খালি মুখে গল্প হবে? আসেনই তো না! কতদিন পরে আসলেন!

– খুব ব্যস্ত থাকি জানোই তো!

আমার কথাবার্তার মধ্যে দেখলাম পারুলের ছেলে সাদমান বাহির থেকে এসে বাসার ভেতরে ঢুকল। আমার সাথে সালাম বিনিময় করে ছেলেটা ভেতরে চলে গেল। মেহরাব আমার পাশেই বসা ছিল। আমি মেহরাবের চোখের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম ওর সাথে সাদমানের খানিকটা দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। মেহরাবের চেহারা সাথে সাথে কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত মনে হলো। ব্যাপারটা দেখে আমি যেটা বুঝলাম যে মেহরাবকে হয়ত সাদমানকে বেশ তোয়াজ করে চলতে হয়। ভেবে খুব মায়া হলো! হায়রে নিয়তি! নিজের বাড়িতে পরবাসী হয়ে থাকতে হচ্ছে বাচ্চাটাকে। আহারে! সবই সেই আগের মতো আছে শুধুমাত্র মা না থাকায় সবই আজ অচেনা ওর কাছে। বুকের মাঝে দুমড়েমুচড়ে আসছে আমার। সাদমানকে দেখতে কত প্রাণোচ্ছল লাগছে আর আমার বাচ্চাটা যেন ঝিমুচ্ছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়ে ফেললাম মুহূর্তেই। জানি আমার বাসাতে ঝামেলা হবে। হোক! আমি ছাড়া ওদের আর আছেই বা কে? আছে আমার বড় ভাই। কিন্তু সে তো তার নিজের ঝামেলা নিয়েই মহাব্যস্ত! সেই যে টুম্পাকে কবরে শুইয়ে গেল আর এ মুখো হয়েছে কি না জানিনা। কীভাবে পারে আমি বুঝি না। একই রক্ত আমার শরীরেও বইছে। আমি যদি মিথিলা আর মেহরাবের কষ্টে কষ্ট পাই তবে সে কেন পায় না? ও বাড়িতে মেহরাবকে রাখার জন্য আমি চাইলে জোর করতে পারতাম। ও বাড়ির অর্ধেক ভাগ আমাদের দু’বোনের। কিন্তু আমার ভাবির ভাব দেখলে মনে হয় আমরা জ্ঞাতিগুষ্ঠির কোনোরকম কেউ। আমাকে খানিকটা তোয়াজ করে চলে কারণ জানে আমি তাদের মুখাপেক্ষী না। কিন্তু টুম্পাকে সারাজীবনই একটু বাঁকা চোখে দেখেছে। সবসময় ভয়ে ছিল কখন না আবার টুম্পা ভাগের জন্য হাত পাতে। অথচ আমার বোনটা কোনোদিনই ওদের কাছে কিছু আশা করে যায়নি। বরং আমিই সেলিমের সাথে আলাদা হয়ে চলে আসতে চেয়েছিলাম বাবার বাড়িতে। নিজের ভাগের জন্য দাবিও করেছিলাম। ভাইয়া রাজী হয়েছিল তবে কৌশল করে আমার শ্বশুড়কে সময়মতো সবকিছু জানিয়ে তখনের মতো বেঁচে গিয়েছিল । এজন্য অবশ্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ! বড় ভাইয়ের মতো আমার সংসার বাঁচানোর জন্য যা করা দরকার তাই করেছিল। না হলে হয়ত আমার এখন সেলিমের সংসারে থাকা হতো না। অবশ্য এখানেও হয়ত ভাইয়া নিজের স্বার্থই দেখেছিল। আমার চতুর ভাই আর ভাবি সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাবে ভেবে বিষয়টা এমনভাবে কৌশলে হ্যান্ডেল করেছে যে সাপও মরেছে আর লাঠিও ভাঙেনি।
কিন্তু আমি আমার অধিকার ছাড়ব না। কারণ বাবার সম্পত্তি আমার বা আমার সন্তান প্রিয়র না লাগলেও টুম্পার বাচ্চাদুটির খুব প্রয়োজন। আমাকে ছাড়া সেখান থেকে কিছু বের করা সম্ভব হবে না ওদের পক্ষে । তাই আমি ইশারা ইঙ্গিতে অলরেডি ভাইয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছি আমার ভাগ আমি ছাড়ছি না। ভাইয়া তাতে আমাকে ভালোবাসুক আর না বাসুক কিচ্ছু যায় আসে না। ক’দিন আগে মেহরাবকে রাখার ব্যাপারে কথা বলেছিলাম । ভাইয়ার উত্তর শুনে অবাক হয়ে গিয়েছি

ভাইয়া আমাকে বলে, “মেহরাব বাবার কাছে থাকছে । অসুবিধার কী আছে? থাকুক ঘরে সৎ মা। সমস্যা কী! ওর বাড়িতে ও থাকবে। নিজে ভালো হলে জগত ভালো। ওকে মানিয়ে চলতে শিখতে বল! যে ছেলে সৎ মায়ের সাথে এডজাস্ট করতে না পারে সে মামির সাথে কী করে করবে? তাই যেখানে আছে সেখানেই থাকতে দে। পৃথিবীটাকে চিনতে দে। এটা সহজভাবে ভাবলে সহজ। কত বাচ্চাই তো সৎ মায়ের সংসারে মানুষ হচ্ছে। আর মেহরাব তো অবুঝ বাচ্চা না। ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নেই। “

ভাইয়াকে কী করে বোঝাই….. হ্যা ,মেহরাব বড় হয়েছে এটা সত্যি। কিন্তু ওর এখন বাড়ন্ত বয়স! ওর এখন পিউবার্টি পিরিয়ড চলছে। এ সময় এক্সট্রা কেয়ারের দরকার। একদিকে মা হারানোর শোক তার উপর বড় বোনটাও ওর থেকে দূরে থাকে। এ সময় ওর আপনজনের সান্নিধ্য প্রয়োজন। যতই নিজের বাবার বাড়ি হোক ! ওর বাবা সে তো সারাদিনই বাসার বাইরে থাকে। তাছাড়া আমি যতদূর জানি মিথিলার বাবা সংসার সন্তান এগুলি নিয়ে বরাবরই উসাসীন! সারাজীবন টুম্পাই সব সামলেছে। সে শুধু পয়সা ইনকাম করেই দায়মুক্ত থাকার চেষ্টা করত। কোনোদিন একটা ছেলেমেয়ে অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গিয়েছে কি না বলতে পারবে না। সব একা হাতে টুমপা সামলেছে। তাই তো টুম্পা মারা যাবার পরপরই সংসার এর বেহাল দশা। ছেলেমেয়েরা খেলো কি না খেলো, বাসায় কী রান্না হবে, ঘরে কী লাগবে কি না লাগবে কোনোদিকেই তার হুশ নেই। এমনিতেই আগে থেকে এওসব ব্যাপারে বেখেয়ালী, আর তার উপর টুম্পাকে হারানোর কষ্ট! পরে এমন অবস্থা দেখে অনেক দেখেশুনে ওর আত্মীয় স্বজনেরা আবার বিয়ে করিয়ে দিয়েছে। প্রথমে মিথিলার বাবা বিয়েতে রাজী ছিল না। পরে সবাই বোঝানো তে রাজী হয়েছে। আমি অবশ্য এই বিয়ের ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলাম। আমার বোনের সংসারে আরেক জনকে আমি কী করে সহ্য করব ভেবেই পাচ্ছিলাম না। তাছাড়া কী হতে পারে ঘরে সৎ মা আসলে সে আমি ভালো করেই জানি। আমার অনুমান একবিন্দুও মিথ্যে যে হয়নি তা মেহরাবের অবস্থা দেখেই টের পাচ্ছি। পারুলের আগের স্বামী ওকে ডিভোর্স দিয়েছে সাদমান যখন বছর সাতেকের তখন। ছেলেটা মায়ের কাছেই থাকে। পারুলের স্বামী তার দ্বিতীয় বউকে নিয়ে সৌদিতে থাকে। টুম্পার চাচাত ননদের কেমন যেন আত্মীয় হয় পারুল। সেই পারুলকে এনে দিয়েছে । কথা ছিল পারুলের ছেলে সাদমান নানা নানির কাছেই থাকবে। মাঝেমাঝে আসবে বেড়াতে মায়ের কাছে। আর পারুল মেহরাব মিথিলাকে নিজের সন্তানের মতো দেখবে।

প্রথম প্রথম মাস দু’য়েক বেশ ভালোই ছিল। আমি ভেবেছিলাম আমার অনুমান হয়ত ভুল। আমিও কিছুটা চিন্তামুক্ত ছিলাম । কিন্তু ধীরে ধীরে সে তার আসল চেহারা দেখানো শুরু করে, বাধ্য হয়ে মিথিলাকে নিয়ে গেলাম আমার কাছে। ওদের বাবা রাজী হতে চায়নি। পরে অনেক বুঝিয়ে রাজী করিয়েছি। আসাদ টুম্পা মারা যাবার পর থেকে কিছুটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়। কথাবার্তা কেমন মাঝেমাঝে উলটাপালটা হয়ে যায়। মাঝেমাঝে হঠাৎ করে অকারণে প্রচুর রেগে যায়।আবার বেশ ভালো , স্বাভাবিক।
টুম্পার শ্বশুর মারা গেছে কয়েক বছর আগে। শাশুড়ি বেঁচে আছে কিন্তু বিছানায়। ছোটো ছেলের সাথে তিনতলাতে থাকেন। উনি সুস্থ থাকলে হয়ত ওদের এত বেহাল দশা নাও হতে পারত। যেমনই হোক নাতী নাতনীর উপর কাউকে খবরদারী করার সাহস দিত না।

মিথিলা ট্রেতে করে চা আর কিছু নাস্তা নিয়ে এসে আমাদের পাশে বসল। আমি মিথিলা আর মেহরাবকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে পারুলকে আস্তে করে বললাম , পারুল , জানো তো এই সংসারটা আমার বোনের। এই সংসারের কোণায় কোণায় আমি ওর হাতের স্পর্শ দেখতে পাই।

– জি আপা। এটা তো সত্যি কথা। সবকিছু আমি এসে একদম রেডিমেড পেয়েছি। উনার কথা ভাবলে খুব কষ্ট লাগে। মানুষের ভাগ্যে কার কী আছে কে জানে?

– সেটাই। তোমার স্বামী কতটা অগোছালো সে তো এতদিনে বুঝতেই পারছ। ওই মানুষটিকে টুম্পা ম্যানেজ করে চলেছে। আসাদের খামখেয়ালীপনার কারণে কত ভালো একটা জব করত সেটা চলে গেছে। পরে যখন হতাশ হয়ে কোনোকিছু নাকেচোখে দেখছিল না। তখন আমার বোনটা ওর ভরি ভরি গহনা সব বিক্রি করে দিয়ে এই ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ওই যে চেয়ার কাভারগুলি দেখছ না। ওগুলি মারা যাবার ঠিক দু’মাস আগেই আমার সাথে নিউমার্কেট যেয়ে নিজে পছন্দ করে কিনেছিল। পার্পল কালার ওর ভীষণ পছন্দের ছিল। এই যে দেখো, পর্দা, সোফার কাভার সব পার্পল কালারের। এর সাথে ম্যাচিং করে কেনার জন্য অসুস্থ শরীর নিয়ে এ দোকান সে দোকান হণ্য হয়ে ঘুরেছে। আমি কত বকেছি সেদিন । কিন্তু কে শোনে কার কথা ! ওর সবকিছু পার্পলই চাই। টিপটপ থাকতে খুব পছন্দ করত। সেটা তো ওর সংসার দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ।
কথাগুলি বলতে বলতে আমার গলাটা বুজে আসছে। টিস্যু নিয়ে চোখদুটি মুছলাম।

– আপা, প্লিজ ! এভাবে বলবেন না। শুধুই কষ্টই পাবেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন। সেই দোয়াই করি সবসময়।

– দেখো, ও কিন্তু সবই রেখে গেছে । কিছুই নেয়নি। আসাদের বিজনেসও মাশাআল্লাহ বেশ ভালোই চলছে। অভাব অনটন , অভিযোগের পর্ব শেষ! এখন সুখের সময় ও নেই। আল্লাহর মর্জির উপর আমাদের আর করারও কিছু নেই। সবকিছু থাকার পরেও আজ ওর বাচ্চাদুটির কিছুই নেই। মিথিলা আমার কাছে থাকছে। তোমার কী মনে হয় ও সেখানে আভিজাত্য আর জৌলুসের মাঝে খুব আরামে আছে? আভিজাত্য আর জৌলুস কখনোই মানসিক শান্তি এনে দিতে পারে না সেটা তো জানোই।

– পারুল নিশ্চুপ!

– তবুও বলব এখানের থেকে মেয়েটা ভালো পরিবেশে আছে। ওখানে অন্ততপক্ষে ওকে কারো হুকুমের গোলাম হয়ে রান্নাঘর আর গৃহস্থালি নিয়ে পড়ে থাকতে হয় না।

– আপা, এসব কী বলছেন? এমন অভিযোগ আপনি দিতে পারেন না। ওরা মাকে হারিয়েছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কীসব বলেছে আপনি সেসব বিশ্বাস করেছেন?

– পারুল, অভিযোগ কেউ আমাকে করেনি। আমি চোখের দেখাকে অবিশ্বাস করি কী করে বলো তো? আচ্ছা , বাদ দাও ওসব পুরানো কথা। মেহরাবের কথায় আসি। আমি চাইলে কিন্তু মেহরাবকেও নিয়ে যেতে পারতাম । নেইনি কারণ মেহরাবও যদি চলে যেত মিথিলার সাথে তবে এটা ওদের বাবার জন্য মেনে নেওয়া খুব কষ্টের হতো! টুম্পাকে হারিয়ে ও এমনিতে বিপর্যস্ত । মিথিলা চলে যাচ্ছে আবার ওর সবচেয়ে আদরের মেহরাবও যদি সেদিন চলে যেত তবে ও ঘরে ঢুকে যখন দেখত ওর কোনো আপনজনই আর ওর কাছে নেই তাহলে ও আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত।

– এসব কী বলছেন? মেহরাবকে কেন নিবেন। আমার ছেলেকে আমি দেখছি। ওর কোনো সমস্যাই নেই এখানে। মিথিলাকেও আমি দিতাম না। দিয়েছি কারণ নইলে সবাই আমাকে বলতেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। কিন্তু মেহরাবকে আমি কোথাও নিতে দিতাম না তখনো । আর এখনো দিব না।

– হা হা! তুমি দেয়া না দেয়ার কে? হাউ ফানি! হ্যা, এটা সত্য জন্ম না দিয়েও মা হওয়া যায়। কিন্তু সেটা হওয়ার যোগ্য তুমি অন্ততপক্ষে না।

– এবার কিন্তু বেশি বলে ফেললেন, আপা। আপনি মিথিলার বড় খালা মানে আমারও বড় বোন। আপনাকে যথেষ্ঠ সম্মানের চোখে দেখি আমি। প্লিজ, এভাবে আমাকে ব্লেম করতে পারেন না।

– ব্লেম করছি কোথায়? তুমি যেটা করছ সেটাই বলছি। মিথ্যে বললে সেটা ব্লেম হতো!

– ভীষণ রেগে যেয়ে পারুল কিছুটা কর্কশস্বরে বলল, কী এমন করেছি আমি?

– মেহরাবের কী অবস্থা দেখছি আমি? ওর কী এমন চেহারা ছিল?

– ওহ! ভাগ্নের চেহারা দেখে আমাকে বিচার করছেন? মা বোনকে রেখে থেকে একদিকে যেমন মানসিক কষ্টে ভুগছে অন্যদিকে আপনার আদরের ভাগ্নে রাত জেগে পাবজি, ফ্রী ফায়ার আরো কীসব গেমস খেলে। ওর জন্য আমার ছেলেটাও গোল্লায় যাচ্ছে। খুব রুটিনে মানুষ করেছি আমার ছেলেকে। এখানে আসার পরে মেহরাবের পাল্লায় পড়ে ছেলেটাও এসবে এডিকটেড হয়ে যাচ্ছে!

– ওহ, তার মানে দাঁড়াল এই যে , তোমার ছেলেকে এডিকটেড করে ফেলছে সেই অপরাধে তুমি ক্রিকেটের স্টাম্প এগিয়ে দিয়ে বাবার হাতে ছেলেকে বেধড়ক পিটান খাওয়াবে! বাহ!

– সব খবর আসার সাথে চালান করে দিয়েছে? ফোন তো গতরাতেই নিয়ে নিয়েছে ওর বাবা। আপনিই তো সব নষ্টের গোড়া। এতটুক ছেলের হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দিয়েছেন।

– দিয়েছি আমাদের সাথে যাতে যোগাযোগ করতে পারে তাই। আর এই বয়সের ছেলেপুলে একটু এসব গেমস টেমস খেলে। হ্যা, এটা ভুল বলোনি যে এই বয়সে ফোন দিয়ে একটু বাড়াবাড়িই করেছি। কিন্তু বাধ্য হয়েই দিয়েছি। তোমার ফোনে কথা বলতে চাইলে তুমি ওকে ফোন দিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকো। ও ভয়েই কথাই বলতে পারে না। আর ওর বাবা তো ফিরে কখন না কখন ঠিক ঠিকানা নেই। টুম্পার ফোনটাও মিথিলা নিয়েছে।

– আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে কী অসুবিধা? আসল কথা বলেন আমার নামে নালিশ পৌঁছানোর জন্যই ভাগ্নেকে ফোন কিনে দিয়েছেন। যাতে আমার অবর্তমানে আমাকে নিয়ে মনগড়া যা খুশি তাই বলতে পারে।

– তেমনটা ভাবলে দোষের কিছু ভাবব না আমি। আমি তো তোমার কাছে বাচ্চাটাকে রেখে নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে পারি না। তুমি সুযোগ পেলেই ওর নামে আসাদের কানে বিষ ঢালতে থাকো। এটা অবশ্য তোমার দোষ না। এটা অবশ্য বেশিরভাগ সৎ মায়ের বৈশিষ্ট্য! তা তোমার ছেলেকেও ভাড়া করে এনেছ আমার বাচ্চাটার গায়ে হাত তোলার জন্য?

– এসব কী বলছেন, আপা? এতক্ষণ আমাকে ব্লেম করেছেন আমি সহ্য করেছি। কিন্তু আমার ছেলের উপর ব্লেম দিলে আমি সহ্য করব না। এবার বুঝতে পেরেছি। আপনার আসল সমস্যা হলো সাদমান। ওকে এখানে দেখেই আপনার শরীর জ্বলছে। আমি মিথিলার বাবার অনুমতি নিয়েই ওকে এখানে রেখেছি। আর তারপরেও যদি বলেন ওকে এখানে রাখা যাবে না। তবে ওকে কালই পাঠিয়ে দিব। তবুও আমার বাচ্চাটাকে এভাবে ব্লেম করবেন না।

– না, না! সেটা কেন করব? তোমার বাচ্চার নাস্তার সময় পাতিলে ভাত ,তরকারী, রুটি সবই থাকে আর মেহরাবের জন্য একদিনও সকালের নাস্তা থাকে না।

– বাহ! এসব নালিশও চলে গেছে কানে? নাস্তা থাকবে কী করে নবাবের পুত্র তো বেলা এগারোটা বাজিয়ে টেবিলে আসে।

– আর স্কুলে যাবার সময়ও যে নাস্তা বা টিফিন কিছু জোটেনা। তার কারণ কী?

– যেদিন স্কুল থাকে সেদিন অত ভোরে আমার পক্ষে ওঠা সম্ভব না। আমার বাতের সমস্যা আছে। ভোরে উঠতে পারি না। আমার ছেলের জন্য কীভাবে হয় এটা বললে বলব, আমার ছেলে এগারোটায় স্কুলে যায়। তাই ওর সমস্যা নেই নাস্তা বা টিফিন পেতে। মেহরাবকে নাস্তা দিতে না পারলেও ওর বাবা টাকা দিতে ভুল করে না কখনোই। প্রতিদিন ঘরের ওই ডিম রুটি না খেয়ে ক্যান্টিনে বরং মন মতো খাওয়াই সে পছন্দ করে। জানিনা আপনার কানে সে কী কী নালিশ ঢেলেছে?

– ও কোনো নালিশই করেনি। আমি এখানে আসার আগ পর্যন্তও কিছুই জানতাম না। তোমাদের বাসায় ঢোকার আগে আমি তিনতলায় গিয়েছিলাম। এসব কথা তোমার অসুস্থ শাশুড়িই কান্না করতে করতে আমাকে বলেছে। উনার এক পা কবরে। উনি নিশ্চয়ই আমাকে মিথ্যে বলবেন না।

– সারাদিন থাকে তো বিছানায় শুয়ে। এসব খবর ক্যামনে পায়? আজাইরা কথাবার্তা।

– পায় । কারণ কি জানো? উনার অন্তর কাঁদে এই এতিম বাচ্চা দুইটার জন্য। নিজে যে অপারগ তারপরেও ওদের ভালোমন্দের , কষ্টের অনুভূতিগুলি উনি ঠিকই টের পায়। তোমাকে চিনতে সবাই ভুল করলেও আমি করিনি সেদিন। তারপরেও এ বাড়িতে ওদের মা হয়ে এলে। ওদের আপন করে ভাববে কত প্রমিজ করলে কিন্তু এখন দেখছি সবই ফেক।

– আপা, আপনি কী আমার সাথে ঝগড়া করতে এসেছেন?

– একদমই না! আমি আমার অভাগা বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তোমার দুর্ভোগ কমিয়ে বরং শান্তি দিতে এসেছি।

– মেহরাব কোথাও যাবে না , আপা!

আসাদের গলা শুনে আমি চমকে উঠলাম। দরজা লক করা ছিল না হয়ত। আসাদ কখন যে এসে দাঁড়িয়েছে , কতটুকুই বা কী শুনেছে কিছুই জানি না।
ওর কণ্ঠের দৃঢ়তা দেখে কিছুটা যেন হোঁচট খেলাম।

চলবে…..