সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব-৩০+৩১

0
436

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩০]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রত্যয় প্রিয়মের থেকে পলকের কথা শুনে দ্রুত পায়ে কেবিনের দিকে গেল। রনিত তখনও থম মেরে বসে ছিল।
প্রত্যয় কেবিনে ঢুকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডক্টরের দিকে তাকাল। ডক্টরের চোখের ভাষা বুঝে প্রত্যয় চুপ হয়ে গেল। রনিত ছলছল আকুতি ভরা চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কারন ওর শেষ ভরসাটুকু প্রত্যয়ের একটা প্রত্যুত্তর। প্রত্যয় নিজ চেক করে ‘না’ বোধক মাথা নাড়াল। যার অর্থ আর নেই। রনিতের শেষ আশাটুকু একনিমিষেই নিভে গেল। সে মেঝেতে বসে দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।

তুয়া চাঁদ পলকের খবরটা শুনে হসপিটালে ছুটে এসেছে। কালকে রাতে পলকের সঙ্গে ওদের কথা হয়েছে। আর আজকে পলক আর নেই। তুয়া যেন এটা মানতেই পারছেনা।
একটুপরে, হসপিটাল থেকে পলককে রনিতের বাসায় আনা হলো। পলক লাল শাড়ি পরে এই বাসায় প্রবেশ করেছিল। আর আজ সাদা কাফনে চিরতরে গৃহত্যাগ করবে। এটাই যেন বাস্তবতার নিষ্ঠুর এক নিয়ম। প্রত্যয় হসপিটালের কাজ সেরে সবাই নিয়ে রনিতদের বাসায় আসল। পলকের মা বাবা উঠানে বসে শব্দ করে কাঁদছেন। এতদিন যারা পলককে কটু কথা শুনাত। আজ তারাও ওর চিরবিদায়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে।

পলককে গোসল করিয়ে কাফন পড়ানো হয়েছে। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওর অন্ধকার কবরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। পলককের নামটা বাতিল করে লাশ নামে নামকরণ হচ্ছে। শরীর থেকে প্রাণ যেতেই লাশ নামে সবাই ডাকা শুরু করেছে। লাশ দাফন হবে কখন? লাশকে গোসল করানো হয়েছে? লাশ কয়টার সময় মারা গেছে? আশে পাশের মানুষজন ফিসফিস করে এসব আলোচনা করছে। রনিত ধীর পায়ে হেঁটে পলকের কাছে গিয়ে বসল। একদৃষ্টিতে পলককের দিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,” তুমি যাও, আমিও খুব শীঘ্রই আসব। হাশরের ময়দানে আমাদের আবার দেখা হবে।”

রনিতের কথাটা শুনে উপস্থিত সবার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। রনিতের কথাটা বুঝিয়ে দিল, পলকের প্রতি তার ভালবাসা। কথাটা বলে রনিত মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। ইশার নামাজের পূর্বে পলকের দাফন কার্য সম্পূর্ণ করা হলো। কবরস্থান থেকে সবাই ধীরে ধীরে স্থান ত্যাগ করল। শুধু রনিত পলকের কবরের থেকে একদূরে বসে রইল। ওদের আড়াই মাসের মৃত বাচ্চাটা দেখে রনিতের বুকটা ফেঁটে যাচ্ছিল। বাবুটা ধীরে ধীরে বড় হতো। ওকে আদুরে সুরে বাবা বলে ডাকত, নানান আবদার করত। কিন্তু সবটাই অপরিপূর্ণ স্বপ্ন হিসেবে রয়ে গেল। শুধু পলক নয় ওদের বাচ্চাটাও ওকে ফাঁকি দিল। রনিত মাথা নিচু করে বিরবির করে বলল,”আল্লাহ! আল্লাহ গো, আমি পাপী বলেই কি আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে? আমার দুই টা প্রিয় মানুষের সঙ্গে আমাকে কেন নিলেনা?”

রনিতের থেকে বেশ কিছুটা দূরে প্রত্যয় আর তুয়া দাঁড়িয়ে আছে। তুয়া প্রত্যয়ের বাহুতে মাথা রেখে নিরবে কাঁদছে। আজকে রনিত পলকের জায়গায় ওরা দু’জন থাকতে পারত। তুয়ার জেদ মানলে হয়তো তুয়ার পরিণতিও এমন হতে পারত। মূলত একারনেই প্রত্যয় তুয়ার আবেগকে সাপোর্ট করেনি। তুয়ার কথাতে কষ্ট পেলেও ভুল পদক্ষেপ নিতে দেয়নি। অপরিপক্ব বয়সে বিয়ে আর গর্ভধারণ দু’টো এক নয়। বিয়েটা সামলে নিলেও অপরিপক্ব বয়সে গর্ভধারণ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তার সঠিক উদাহরণ পলক।

তুয়া মারা গেলে প্রত্যয় কি করত? তুয়াকে ছাড়া প্রত্যয় থাকতে পারত? প্রত্যয়কে ছাড়া সে বা কিভাবে থাকত? এসব ভাবনা তুয়াকে কষ্টে জর্জরিত করে দিচ্ছে। তুয়া আবারও ভাবছে, ‘ অপরিপক্ব বয়সে অহরহ মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে, বাচ্চা হচ্ছে। তারা তো দিব্যি সুস্থভাবে বেঁচে আছে। পলকের সঙ্গেও এমনটা না হলেও পারত। কিন্তু তা তো হলো না।’ এখানে আবার প্রমান হলো সবার ভাগ্য এক নয়। নিরাপদ পথের যাত্রাকালে সবাই বিনাবিঘ্নে চলে যায়। কিন্তু সহজ সরল মানুষটা সেখানে মুখ থুবকে পরে। আর নয়তো কোনো একটা বিপদের সম্মুখীন হয়। এজন্য কারো ভাগ্যের সঙ্গে কারো ভাগ্যের মিল খুঁজতে নেই। কারন কারো জীবনের পরিসীমা এক নয়। আর এটা তিতা হলেও আরেকটা বাস্তবিক সত্য।

প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখ মুছে শান্ত কন্ঠে বলল,” প্রিয় মানুষটাকে দাফন করার কষ্ট সেই বোঝে, সে করে। উহুম, কেঁদো না দোয়া করো। আল্লাহ যেন রনিতকে ধৈর্য্য ধারণের তৌফিক দান করে।” তুয়া হেঁচকি তুলে কেঁদে বলল,”ভাইয়ার কষ্টটা চোখে দেখা যাচ্ছে না। এমনটা তো না হলেও পারতো?” প্রত্যয় প্রত্যুত্তরে বলল,”এটা হচ্ছে বাস্তবতা নিষ্ঠুর কড়াঘাত। আর এটা আমর সবাই মানতে বাধ্য।”
একটুপরে, প্রত্যয় তুয়া রনিতকে বুঝিয়ে বাসায় নিয়ে গেল। বাসায় ফেরার সময় রনিত বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। ওর মনে হচ্ছিল পলক ওকে ডাকছে। কিন্তু পলকের ডাক শুনতে পেলো না। প্রত্যয় রনিতের বাসায় নিয়ে গিয়ে যতটুকু সম্ভব বুঝাল। রাত এগারোটার দিকে রনিতের খেয়াল রাখতে বলে, প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে বাসার পথে রওনা দিল। দাফনের কাজ শেষ করে প্রিয়মরা চলে গেছে। শুধু প্রত্যয় আর তুয়া ছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রনিতের বাসাটাও আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেল।

গাড়িতে, তুয়া প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে বসে আছে। প্রত্যয় এক হাতে তুয়াকে আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে ড্রাইভ করছে। তুয়াকে নিশ্চুপ দেখে প্রত্যয় তুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,”বাস্তবতা নিয়েই আমাদের জীবন। জন্ম নিলে মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে নিতে হবে। জানো, একটা সময় আমি আমার পেশেন্টের মৃত্যু মানতে পারতাম না। খারাপ লাগত খুব কষ্টও হতো। মনে হতো জাদু করে সবাইকে বাঁচিয়ে দিতে। কিন্তু জন্ম, আর মৃত্যুর জাদুকাঠি তো সৃষ্টিকর্তার হাতে। তাই কষ্ট হলেও মেনে নিতে হতো। ইন্টার্নির সময় প্রথমবার হার্টের অপারেশন করা দেখে, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছিলাম। অথচ, আজকে এই হাত দিয়ে অসংখ্য পেশেন্টের হার্ট অপারেশন করি। এখন হসপিটালে রোজ মৃত্যুর রথ আর আপনজন হারানো আত্মনার্দ শুনি। এখন পেশেন্টের মৃত্যুর আগ মূহুর্তের ছটফটানি দেখেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আজকে সকালেও আমার একটা পেশেন্ট মারা গেল। মারা যাওয়ার সময় আমার হাতের মুঠোয় ওর হাত ছিল। ছেলেটা মারা যাচ্ছে দেখে আয়াতুল কুরসি পড়ে ওকে ফুঁ দিলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। আম্মু একদিন বলেছিল, তুমি ডক্টর হওয়ার আগে একজন মানুষ। যখন কেউ তোমার সামনে মারা যাবে, তখন আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিবা। তাহলে তার মৃত্যুটা সহজ হবে।’ আম্মুর কথাটা শুনে আমি ঠিক তাই করি। আমার এই কাজ দেখে অনেকজন হেসেছে, তবুও কিন্তু আমি আমার কাজ থামায়নি। জানো তুয়া আমার মনে হয়, আজ আমি কারো শেষ সময়ে পাশে থাকলে, আমার মৃত্যুর সময় আমিও কাউকে আমার পাশে পাবো। আর আমরা ডক্টররা কল্পনায় ডুবে নয়। বরং মৃত্যুর মতো কঠিন সত্য দেখে আমাদের দিন কাটে। তবে এর মধ্যেও আরেকটা সত্যি লুকিয়ে আছে, জানো সেটা কি?”

তুয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে ‘না’ বোধক মাথা নাড়াল। প্রত্যয় মুচকি হেসে একহাত দিয়ে তুয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,”ডক্টরদের মন অনেক শক্ত হয়। তারপরেও প্রিয় মানুষটার ক্ষেত্রে তারাও খুব দূর্বল। কথাটা শুনে তুয়া নিজেকে আর আঁটকাতে পারল না। প্রত্যয়ের শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। প্রত্যয় কিছু বলল না শুধু দেখে গেল। সে বুঝল, পলকের মৃত্যু আর রনিতের ভালবাসা দেখে তুয়ার মনে দাগ কেটেছে।

এদিকে, ইচ্ছের আম্মু এ খবর শুনে কান্নাকাটি করছে। ওরা সিলেট পৌঁছোনোর পরে তুয়া থেকে খবরটা শুনল। কিন্তু এতরাতে আর আসতে পারল না।

প্রায় তেরো দিনপর, রনিত ওর অফিসে গেল। কিছুদিন আগে রনিতকে বাইরের দেশে যাওয়ার অফার করা হয়েছিল। কিন্তু পলকের জন্য সে না করেছিল। এই গুমোট পরিবেশ থেকে বের হতে, রনিত বাইরের দেশের যাওয়ার কথাটা জানাল। যদিও অফিস কতৃপক্ষ রনিতের জায়গায় অন্য কারো নাম দিয়েছিল। কিন্তু রনিতের ব্যাপারটা বিশেষ বিবেচনায় ভেবে ওকে সুযোগ দেওয়া হলো। সে যদি এভাবে নিজেকে সামলে নিতে পারে। তাহলে ক্ষতি কি? রনিত অফিস থেকে বের হয়ে, পলকের কবর জিয়ারত করে ওখানে বসে রইল। সে বাড়ির কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলেনা। নিজের মতো চলে, কখন যায়? কখন আসে? কেউ বুঝতেও পারেনা। চারদিন পর রনিত চাকরিসূত্রে জার্মানিতে চলে গেল। আর যাওয়ার আগে ওর বাবাকে ওদের ফ্ল্যাটের জিনিস গুলো এনে, ফ্ল্যাট টা ছেড়ে দিতে বলল। সে চাইলে কাজটা নিজে করতে পারত। কিন্তু পলকছাড়া ওর ফ্ল্যাটে ঢোকার সাহস ওর হয়ে উঠল না।

ব্যস্ত জীবনে যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। চাঁদ আর তুয়া নিজেদের পড়াশোনায় মনে দিয়েছে। এখন ওরা সবাই বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে থাকে। প্রিয়ম দু’টো প্রোগ্রামে সফল হয়েছে। এখন সে আগের তুলনায় গানের অনেক অফারও পাচ্ছে। চাঁদ আর প্রিয়মের সম্পর্কটা আগের তুলনায় একটু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু প্রিয়মের থাপ্পড়ের কোনো পরিবর্তন আসেনি। চাঁদ উল্টা পাল্টা কিছু করলে বা বললে থাপ্পড় খায়। দুইদিন আগে, ইচ্ছের সাথে প্রত্যয়ের অনেক কথা হয়েছে। সিলেটে গিয়ে ইচ্ছে থাকতে চাচ্ছিল না খুব কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু তিনদিনের বেলায় খেলার সাথী পেয়ে মানিয়ে নিয়েছে। তুয়ার আব্বু আম্মু প্রত্যয়দের বাসায় থেকে দুইবার বেড়াতে গিয়ে ছিলেন। উনারা এখন তুরাগের বিয়ের চিন্তা করছেন। তুরাগ আজকাল কেমন হয়ে গেছে। কিছু বললে রেগে যায় অযথা চেঁচামেচি করে। বিয়ের কথা তুললে এড়িয়ে যায়।

তার ঠিক দুইদিন পর, বিকেলের দিকে তুরাগ বাসায় ফিরল। ওর আব্বু আম্মু তখন চা খাচ্ছিলেন। তুরাগ ফোনে কথা বলে রেগে সোফার কুশনটা ছুঁড়ে মেরে বলল,”আম্মু আব্বু দুই দিনের মধ্যে আমি বিয়ে করব, তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করো।” তুরাগের বাবা বললেন,”তাহলে ইলার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।” তুরাগ রাগটা কনট্রোল করে বলল,”ইলা নয়, তোমরা অন্য মেয়ে দেখো। আর দুই দিনের মধ্যে বিয়ে দাও নাহলে আমি বাড়ি ছাড়া হবো। আর ভুলেও ওই মেয়ের নাম মুখে আনবে না।”

চলবে।

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩১]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

ছেলের কথা শুনে তুরাগের আব্বু আম্মু খুব অবাক হলেন। হয়তো ইলা তুরাগের ঝগড়া হয়েছে। রাগ কমলে আবার দু’জনে এক হয়ে যাবে। তাই উনারা আপাতত প্রত্যুত্তর করলেন না। আর রাগের বশে নেওয়া সিদ্ধান্ত সঠিক সমাধান আনে না। পরে ঠান্ডা মাথায় ছেলেকে বুঝাবেন ভেবে উনারা চুপ করে গেলেন। তুরাগ নিজের রুমে গিয়ে স্বজোরে দরজা আটঁকে দিল। ওর মন চাচ্ছে সবকিছু চূর্ণ বিচূর্ন করতে। জীবনটা এতো কঠিন কেন? কেনই বা জীবনে এতো বাঁধা বিপত্তি আসে? তুরাগ ওর মাথার চুল খামছে ধরে এসব ভাবছে। একটুপরে, ওর ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। তুরাগ ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল তুয়ার কল। সে নিজেকে কোনো মতে সামলে নিল। কারন যত যাই হোক! তুরাগ কখনও তুয়ার উপর রাগ দেখাতে পারে না।

তুরাগ কল টা রিসিভ করে শান্ত কন্ঠে বলল,” আম্মু তোকে কিছু বলেছে, তাই না? বোনু আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। আর আমি জানি তোরা আমার পাশে থাকবি?” কথাটা শুনে তুয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,”ভাইয়া, রাগের বশে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে আফসোস করবে না তো?” তুরাগ অকপটে উত্তর দিল, “ভুলেও না। আর শোন সহজ সরল একটা মেয়ের সন্ধান কর।”

এমন কথা শুনে তুয়া চট করে বলল,”ভাইয়া, তিন্নি আপু কিন্তু পাত্রী হিসেবে মন্দ না।” তুরাগ ওর নিচের ঠোঁট কামড়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,”আব্বু আম্মুকে আজকেই কথা বলতে বল। ওরা রাজি থাকলে কালকেই বিয়ে সম্পূর্ণ করব।” তুয়া বুদ্ধি খাঁটিয়ে তুরাগের সমস্যার কথা জানতে চাইল। তুরাগ বোনের কাছে ওর সমস্যার কথা জানাল। সবটা শুনে ”তুমি যা বলবে তাই হবে ”বলে তুয়া কল কাটল। যদিও ইলাকে তুয়ার কখনই পছন্দ ছিল না। কারন ইলা কারো সঙ্গে মিশতে চাইত না। ফোন দিলেও এড়িয়ে যেতো। তুরাগ কষ্ট পাবে ভেবে তুয়াও কিছু বলত না। তুয়া চেয়েছিল ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে ভাবী নয়, বরং একটা বন্ধু পেতে। আর ইলা কখনই ওর বন্ধু হতে পারত না। তবে তিন্নি সাদামাটা সহজ সরল একটা মেয়ে। তুয়াদের দেশের বাড়ি সৌন্দর্যপুর। ওদের বাড়ির দুই বাড়ি পর তিন্নিদের বাড়ি। তিন্নি তুরাগকে আগে থেকে পছন্দ করে। কিন্তু মুখ ফুটে কখনও বলতে পারেনি। কারন সে অকারণে তুরাগকে ভয় পায়। তবে হাব ভাব দেখে বোঝা যায়, তিন্নি তুরাগকে পছন্দ করে।

তুয়া ফোনে ওর আব্বু আম্মুকে সবটা জানিয়ে দিল। এবং ওর আব্বু তিন্নির আব্বুর সঙ্গে কথা বললেন। তিন্নিরা অর্থের দিক থেকে খুব একটা সচল নয়। তবে মানুষ হিসেবে ওরা যথেষ্ট ভালো মানুষ। দুই পরিবারের চেনা জানা অনেক দিনের। তাই উনারাও এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। দুই দিন পর, প্রত্যয়দের বাসার সবাই এবং নিকট আত্মীয়দের উপস্থিতিতে তুরাগ তিন্নির বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। তিন্নিদের টিনের চালা দেওয়া বড় উঠান ওয়ালা বাড়ি। এসব দেখে
প্রত্যয়রা হাই সোসাইটির মানুষ হয়েও নাক কুঁচকাল না। বরং সবার সাথে অল্পতে মিশে গেল। তিন্নির দাদী তো প্রত্যয় আর প্রিয়মের ব্যবহার দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

সৌন্দর্যপুর থেকে ঢাকা দীর্ঘ জার্নির পথ। তাই সবাই তুয়াদের বাসাতে থেকে গেল। একতলা বিশিষ্ট পরিপাটি করে সাজানো গুছানো বাড়িটা। চারটা রুম, ড্রয়িংরুম, রান্নাঘর। বউ আনার পর রাতের খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে সবাই শুয়ে পরেছে। তিন্নি তুরাগের এক রুমে। তার পাশাপাশি দু’টো রুমে প্রত্যয় তুয়ার বাবা মা। গেস্ট রুমে এবং ড্রয়িংরুমে আত্মীয়রা। আর তুয়ার রুমে ওরা চারজন। তুয়ার বেডে চাঁদ তুয়া মাঝে আর প্রত্যয় প্রিয়ম শুয়েছে দুই ধারে।। এদিকে, তুয়া আর চাঁদের গল্প শেষ হচ্ছে না। আজকে সারাদিনের কার্যকলাপ নিয়ে তারা গল্প জুড়ে দিয়েছে। প্রিয়ম চাঁদের হাসি দেখে বার বার বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছে। কারণ অকারণে হাসাহাসি ওর মোটেও পছন্দ নয়।

প্রত্যয় এক হাতে ভর দিয়ে শুয়ে প্রিয়মকে বলল,”প্রিয়ম আফজাল চাচা ফোন করেছিলেন। তোমার কথা জানতে চাচ্ছিলেন। তুমি উনার সঙ্গে কথা বলে নিও।” প্রিয়ম বিশ্রী একটা গালি দিতে গিয়েও, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,”এই লোকটা কি বনমানুষই থেকে যাবে?” ততোক্ষণে চাঁদ তুয়া গল্প বন্ধ করে ওদের কথা শুনছে। চাঁদ ওর দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বলল,”আমি বাদে আরেকটা বনমানুষ আছে? বাহ্! শুনে বেশ ভালো লাগল।” প্রিয়ম চাঁদকে নখ কাটতে দেখে ওর হাতের উপর বারি মারল। চাঁদ দ্রুত মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল। প্রত্যয় হেসে বলল, “আসলে আফজাল ভাই খুব মজার একটা মানুষ। উনার কাজই প্রিয়মকে পচাঁনো।” তুয়া এবার বলল,”কেন ভাইয়াকে পঁচায় কেন? নিশ্চয়ই কোনো কাহিনী আছে?” প্রত্যয় হেসে বলল, “হুম, কাহিনীটা হলো প্রিয়মের খাৎনার সময়কার।”

প্রিয়ম ফট করে উঠে বসে করুণ সুরে, ”প্লিজ ভাইয়া এদের বলিও না। এরা আমার মান ইজ্জত আর রাখবে না।” একথা শুনে চাঁদ লাফ মেরে বসে বলল,”ভাইয়া বলেন, প্লিজ! কথাটা বললে, দোয়া করব আপনাদের যেন টুইন বেবি হবে।” এই কথা শুনে চারজনের মধ্যে হট্টগোল বেঁধে গেল। ওদের হট্টগোল শুনে প্রত্যয়ের আম্মু রুমে আসলেন। চাঁদ তুয়া উনাকে প্রিয়মের সেই সময়কার কাহিনীটা বলতে বলল। উনি হেসে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসলেন। চাঁদ তুয়া হুড়মুড় করে উঠে বালিশ নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। দু’টো বালিশ এক করে শাশুড়ি আর বউরা মিলে শুয়ে গল্প করে লাগলেন। প্রত্যয়ের আম্মু তখন হেসে বলতে লাগলেন,

“তাহলে শোন সেই কাহিনী। আমার দুই ছেলে দুই মেরুর। যেমন, প্রত্যয় ছোট থেকে খুব শান্ত স্বভাবের। ওর পেট ভরা থাকলে আর জ্বালাত না। ওকে শুয়ে রাখলে একা একা হাত পা নেড়ে একমণে খেলত। কিন্তু খালি গায়ে রাখলে কানের পর্দা ফাটানোর মতো চিৎকার করে কাঁদত। এতটুকুন বাচ্চা তাও খালি গায়ে থাকতে চাইত না। তবে প্রিয়ম আমাকে খুব জ্বালিয়েছে। ওকে চিৎ করলেও ভ্যা, কাত করলেও ভ্যা করত। তো শোন তাহলে আসল কাহিনী। প্রিয়মের খাৎনার দিন ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই মিলে খুঁজেও ‘

উনি বাকিটুকু আর বলতে পারলেন না। তার আগে প্রত্যয়ের আব্বুর ডাক শুনে উঠে চলে গেলেন। আর বললেন পরে শুনাবেন। চাঁদ তুয়া মন খারাপ করে আপসোস করতে থাকল। ওদের আপসোসের কথা শুনে প্রত্যয় প্রিয়ম মিটিমিটি হাসতে লাগল। প্রিয়ম তখন ইশারায় প্রত্যয়কে বলেছিল, ওর আম্মুকে থামাতে। না হলে ওদের ইজ্জত শেষ করে দিবে। ভাইয়ের সঙ্গে নিজের সন্মানের কথা ভেবে প্রত্যয় ওর আব্বুকে মেসেজ করল, আব্বু, আম্মু বেশি রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে।” প্রত্যয়ের আব্বু ছেলের মেসেজ দেখে হেসে উনার সহধর্মিণীকে ডেকে নিলেন। ‘আব্বু আম্মুকে রুমে ডেকে নিন বা রুমে ঘুমাতে নিয়ে যান।’ দু’টোই কথায় শুনতে দৃষ্টিকটু দেখায়। এজন্য প্রত্যয় একটা কথা দিয়ে দু’টো কাজ সারল। চাঁদ তুয়া মেঝেতে শুয়ে ফন্দি আটঁল। তারপর চাঁদ উঠে বেডে চলে গেল। আর তুয়া প্রত্যয়কে ইশারায় ডেকে ছাদে নিয়ে গেল। প্রিয়ম চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে ছিল। এজন্য সে আর কিছু জানতে পারল না।

রনিত ওর ফ্ল্যাটের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মাসের সংসার, খুনশুঁটি, ভালবাসা, রাগ অভিমানের কথাগুলো সে স্মৃতিচারণ করছে। এখন যতোদিন যাবে, স্মৃতি গুলো অতীতের খাতায় জমা হবে। আর নিখুঁত ভাবে মনের কোণে জীবিত হয়ে থাকবে। রনিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফির মগটা হাতে নিল। সে ঘুম থেকে যখন উঠতে চাইত না। তখন পলক রেগে বলত,”এই লোক! এই! উঠুন না।”

পলকের এই রাগ মিশ্রিত কথাটা রনিত খুব মিস করে। সে খুব করে চাই, পলক ফিরে আসুক। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়। রনিত জার্মানিতে এসে ওর কাজের চাপটা খুব বেড়েছে। একাকীত্ব, ব্যস্ততা, কলিগদের সঙ্গে সৌজন্যে মূলক কথাবার্তা। এসব নিয়েই ওর সময়গুলো কাটছে।

চলমান জীবনের চাকা নিজ গতিতে বয়ে চলছে। সময়ের কাটা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সে সঙ্গে সবার ব্যস্ততা নিয়ে কেটে গেল, আরো দু’টো মাস। ইচ্ছে পরিপাটি একটা রুমে চুপটি করে বসে চানাচুর খাচ্ছে। ওর বাম হাতে আছে গোলাপি রংয়ের টেডি বিয়ার। ইচ্ছের পাশে বসা লোকটি ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে বললেন,”আম্মু তোমার নাম কি?” ইচ্ছে চানাচুরের মধ্যে থাকা বাদামটা মুখে পুরে বলল,”আমাল নাম ইচ্ছেমুণি। তোমাল নাম কি?” লোকটি হেসে ইচ্ছের গাল টেনে বললেন,”আমার নাম সায়ন।” ইচ্ছে মিষ্টি হেসে,’ওহ’ বলে আবার চানাচুর খাওয়াতে মন দিল। সায়ন ইচ্ছেকে পরখ করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল,” ইচ্ছেমণি তুমি আব্বু আম্মু বাদে আর কাকে কাকে ভালবাসো?”

ইচ্ছে গালে হাত দিয়ে ভেবে হাতের আঙ্গুল গুনে গুনে বলতে লাগল,”প্রত্তুয়, প্রিউুম, তুয়া আপু, চাঁদ আপু, তুলাগ ভাইয়ু, লনিত মামা, পলুক মামুণি, আল মামুণির পেটেল ছোট্টু বাবুকে ভালুপাশি।”

সায়ন ইচ্ছের বলা নাম গুলো দ্রুত নোট করে নিল। তারপর ইচ্ছের গালের লেগে থাকা বাদামের খোসা ফেলে বলল,”বাব্বাহ্! তুমি এত্তোজনকে ভালবাসো? তা এদের সবার মধ্যে কে তোমাকে বেশি ভালবাসে?” ইচ্ছে এবারও ঠোঁট উল্টে ভেবে বলল,”প্রত্তুয়, প্রিউুম আল তুলাগ জানপাখি।” সায়ন এই তিনজনের নাম চিহ্নিত করে হাসল। তারপর পাশের লোকটাকে ইশারা করলে উনি চলে গেল। আর সায়ন ইচ্ছের সঙ্গে আরো গল্প করতে লাগল।

গত সপ্তাহ থেকে প্রত্যয়ের পেশেন্টের চাপ খুব বেশি। ব্যস্ততা নিয়ে ওর সময় অতিবাহিত হচ্ছে। সে তুয়াকেও খুব একটা সময় দিতে পারছেনা। প্রত্যয়ের ব্যাপারটা বুঝে তুয়া কিছু বলেনি। আজ সকালে পেশেন্ট দেখার সময় প্রত্যয়ের ফোনে বেশ কয়েকবার কল এসেছিল। ফোন সাইলেন্ট থাকায় প্রত্যয় বুঝতে পারেনি। সব পেশেন্ট দেখে ফোনটা হাতে নিয়ে
অচেনা নাম্বার থেকে পঁচিশটা কল দেখল। জুরুরী ভেবে তাৎক্ষণিক কল ব্যাক করল। সেই নাম্বারে বেশ কিছুক্ষন কথা বলে প্রত্যয় কল কেটে। কপালের ঘাম মুছে প্রত্যয় জামিলকে ডাকল। জামিল এসে দাঁড়াতেই, প্রত্যয় ওকে ইমার্জেন্সি এয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করতে বলে বেরিয়ে গেল।
প্রিয়ম তখন বাসাতেই ছিল। চাদঁ তখন স্কুলে আর তুয়া ছিল ওর কলেজে। প্রত্যয় বাসায় ফিরে প্রিয়মকে ওর রুমে ডাকল। এবং দুই ভাই কিছু নিয়ে আলোচনা করল।

একপর্যায়ে প্রত্যয় খেয়াল করল প্রিয়মের চিন্তিত মুখশ্রীটাকে। তাই সে প্রিয়মকে আশস্ত করতে মুচকি হেসে বলল,” উহুম! টেনশন করো না। তুমি সবাইকে নিয়ে সাবধানে থেকো। ইনশাআল্লাহ! আমরাও জলদি ফিরে আসব।”

প্রিয়ম ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,”ভাইয়া, খারাপ কিছু হবে না তো? ব্যাপারটা সুষ্ঠুভাবে সমাধান হবে তো?”

অজানা এক ভয়ে দু’জনেরই বুক কাঁপছে। তবুও প্রত্যয় নিজেকে শক্ত রেখে প্রিয়মের কাঁধে হাত হাত রেখে বলল, “আল্লাহ ভরসা।”

তারপর প্রত্যয় জামিলের কল পেয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। আর প্রিয়ম প্রত্যয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,”সফল হয়ে ফিরো ভাইয়া। আমি তোমাদের অপেক্ষায় রইলাম।”

To be continue….!!