সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব-৩৮+৩৯

0
380

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩৮]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রত্যয় উঠে দাঁড়াতেই ইচ্ছে ছোট ছোট হাতে থাবা দিয়ে ডেকে উঠল ,”প্রত্তুয়! প্রত্তুয়! আমি ডাকচি দলজা খুলো! আমি তোমাল কাচে ধুমাবো।”

প্রত্যয় একবার তুয়ার দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে দিল। ইচ্ছে একটা পুতুল হাতে নিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তুয়া শুয়ে থেকে ইচ্ছেকে বলল,”ইচ্ছে গল্প শুনলে জলদি আয়। প্রত্যয় আমাদের গল্প শুনাবে।” গল্পের কথা শুনে ইচ্ছে দৌড়ে বিছানায় কাছে গেল। কিন্তু উঠে না পেরে বেডশীট ধরে ঝুলতে লাগল। প্রত্যয় হেসে ইচ্ছেকে বিছানায় উঠিয়ে নিজেও বসল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল প্রত্যয়কে নিয়ে। তুয়া ইচ্ছে দু’জনেই প্রত্যয়কে পাশে নিবে। এই নিয়ে দু’জনের সমানে ঝগড়া চলছে। প্রত্যয় বসে বসে ওদের ঝগড়া দেখে হাসছে। ওর কাছে বেশ লাগছে দু’জনের ঝগড়া। অবশেষে প্রত্যয়কে মাঝখানে রেখে তুয়া ইচ্ছে দু’জনে প্রত্যয়ের দুই বাহুতে মাথা রাখল। এবার দু’জনের মুখে ফুটল মিষ্টি হাসি।

প্রত্যয় দু’জনের কপালে আদর দিয়ে গল্প বলতে লাগল,” এক দেশে এক রাজা ছিল। তার একটা পুতুলের মতো রাজকন্যা ছিল। কিন্তু রাজকন্যা বড়দের নাম ধরে ডাকত। নিষেধ করলেও বারণ শুনত না। রাজকন্যা একদিন পুকুর পাড়ে বসেছিল। সেই পুকুরের একটা কচ্ছপ রাজকন্যার আঙ্গুল খেয়ে নিয়েছিল। সেদিন রাজকন্যা খুব কেঁদেছিল। তারপরেও রাজকন্যা বড়দের নাম ধরে ডাকত। কারো কথা শুনত না। রাজকন্যার ব্যবহারে কচ্ছপটা খুব রেগে ওর পুরো হাত খেয়ে নিয়েছিল।”

এতটুকু বলে তুয়া প্রত্যয় ইচ্ছের দিকে তাকাল। ইচ্ছে ছলছল চোখে ওর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। তুয়া অবাক হয়ে ইচ্ছেকে জিজ্ঞাসা করল,
“কি রে তুই কাঁদছিস কেন?”
“আমাল হাত কুচ্ছুপ খেয়ে নিবে।”

প্রত্যয় হেসে ইচ্ছেকে জড়িয়ে ধরে বলল,”ইচ্ছেমণি তুমি আর বড়দের নাম ধরে ডেকো না। তাহলে কচ্ছপ তোমার হাত খাবেনা।” ইচ্ছে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে কান্নারত কন্ঠে বলল,” প্রত্তুয় তুমাকে কি বলে ডাকব?” প্রত্যয় হেসে ইচ্ছেকে ওর বুকের উপর শুইয়ে বলল,”তোমার যেটা ডাকতে ইচ্ছে করে।” ইচ্ছে গালে হাত দিয়ে ভেবে বলল,”আচ্ছা! আমি পলে তোমালে বলব।” তারপর প্রত্যয় মজার একটা গল্প বলতে লাগল। গল্প শুনতে শুনতে তুয়া আর ইচ্ছে দু’জনেই ঘুমিয়ে গেল। কয়েকদিন পর ইচ্ছেকে স্কুলে ভর্তি করানো হবে। ওর আদুরে ডাক শুনতে ওর ভালো লাগে। কিন্তু বাইরের কোনো পরিবেশে সবাই ভাল চোখে দেখবেনা। ইচ্ছে বড় হবে! এখন থেকেই ওর ভুল গুলো ধরিয়ে দিতে হবে। আর অবশ্যই সেটা বুদ্ধি খাঁটিয়ে। মূলত একারণেই প্রত্যয় ইচ্ছেকে গল্পের মাধ্যমে বোঝাল।

চাঁদ কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আর প্রিয়ম বেলকণিতে বসে আকাশ দেখছে। এখন চাঁদ আর ওর সম্পর্কটা একধাপ এগিয়ে গেছে। যদিও সে ইচ্ছে করেই এগিয়েছে। তবে এটাও সত্যিই, প্রিয়ম সেদিন চাঁদকে ভালবেসে কাছে টানেনি। শুধু দায়িত্ব আর মায়ার টানে আপন করেছিল। ওরা এতোদিন একসঙ্গে আছে। চাঁদের প্রতি ওর ভালবাসা না জন্মালেও মায়া সৃষ্টি হয়েছে। এটা প্রিয়ম কখনই চাঁদকে বুঝতে দেয়নি। কারন সে তার অনুভূতি কখনই প্রকাশ করতে পারেনা। এতোদিন প্রিয়ম চাঁদকে শাষণ করলেও ঘৃণা করেনি। আর ছন্নছড়া গতিতে কারো জীবন চলেনা। প্রিয়ম এটাও বুঝে, সে ভালো থাকলে বাসার সবাই ভালো থাকবে। বিশেষ করে কলিজার টুকরো ভাই প্রত্যয়! ওর সুপ্ত ভালবাসা আর আবেগ ওর মধ্যেই থাকুক। ওর আপনজনদের জন্য ওকে ভালো থাকতে হবে। এখন হয়তো চাঁদের প্রতি ওর মায়া কাজ করছে। কিছু দিন পর এই মায়া হয়তো ভালবাসায় পরিণত হবে।

পরেরদিন নতুন দিনের সূচনা হলো। প্রিয়ম বিকালের দিকে চাঁদ আর ইচ্ছেকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। চাঁদ এই প্রথম প্রিয়মের সঙ্গে পার্কে এসেছে। পার্কে অনেক বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে। বাচ্চাদের বাবা মাও তাদের সঙ্গে আছে। ইচ্ছে একটা বেলুন নিয়ে একটু দূরে খেলছে৷ চাঁদ আর প্রিয়ম ঘাসের উপর বসে আছে। চাঁদ বাদাম খাচ্ছে আড়চোখে প্রিয়মকে দেখছে। ইচ্ছে একা একা খেলছে আর হাসছে। হঠাৎ একটা বাচ্চা খেলার ছলে পড়ে গিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সে ব্যাথা পেয়ে, ‘বাবা! বাবা!’ করে কাঁদছে। বাচ্চার বাবা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে আদর করতে লাগলেন।
ইচ্ছে তখন প্রিয়মের কাছে দৌড়ে আসল। কিছু একটা ভেবে ইচ্ছে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলল,”প্রিউুম! আমি তোমালে বাবা বললে লাগ করবা? আমি তোমালে বাবা বলি?” প্রিয়ম একথা শুনে থমকে গেল। সে ইচ্ছেকে কোলে তুলে পুরো মুখে আদর দিয়ে বলল,” না সোনা একটু রাগ করব না। তোমার যতোখুশি তুমি বাবা ডাকো।”

ইচ্ছে প্রিয়মের গলা জড়িয়ে ধরে ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বলল,”সুত্যিই প্রিউুম! সলি সলি তুমি লাগ কলবা না বাবা?” প্রিয়ম খুশিতে ছলছল চোখে বলল,”উহুম! একদম সত্যি সোনাপাখিটা।” চাঁদ কিছু বলল না শুধু চোখের কোণে পানিটুকু মুছে নিল। সে জানে বাবা মা না থাকার কষ্ট। ইচ্ছে এখন ক্ষণে ক্ষণে প্রিয়মকে বাবা ডাকছে। প্রিয়ম বাবা ডাকের অনুভূতি অনুভব করতে পারছে। তারও যেন খুশির অন্ত নেই। সন্ধ্যায় পর বাসায় ফিরে সবাই ইচ্ছের ডাক শুনে অবাকের সঙ্গে খুশিও হলো। (আমার দেরীতে গল্প দেওয়ার জন্য সাইলেন্ট পাঠক/পাঠিকারা দায়ী। যেমন আপনাদের মনমতো আপনারা সাইলেন্ট থাকেন। তেমনি আমিও আমার মনমতো গল্প পোষ্ট করি। তাই আমার দিকে অযথা আঙ্গুল তুলবেন না। আপনারা রেসপন্স বাড়ান, তাহলে আমিও গল্প রেগুলার দিব।)

এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর, প্রত্যয় অনেকগুলো পেশেন্ট দেখে জামিলকে জিজ্ঞাসা করল,” আর কতজন আছে?” জামিল একবার বাইরে তাকিয়ে বলল,”স্যার, দুইজন স্পেশাল পেশেন্ট বাকি আছে। এখন কি উনাদের পাঠাব?” প্রত্যয় মৃদু হেসে ইশারায় পাঠাতে বলল। ওর কাছে সব পেশেন্ট সমান। এ বিষয়ে সে যুক্তি তর্ক করতে ইচ্ছুক নয়। আর বুদ্ধিমানরা সহজে তর্কে জড়ায় না। তাদের মধ্যে প্রত্যয় একজন। জামিল বাইরে গিয়ে পেশেন্টদের পাঠাল। ইচ্ছে দরজায় উঁকি মেরে ভেতরে ঢুকে বলল,”ডাকতাল আমাল আপুকে সূচ দাও।” প্রত্যয় ইচ্ছেকে দেখে উঠে কোলে তুলে নিল। তুয়া তখন ভেতরে প্রবেশ করে বলল,”তোকে দিবে।” প্রত্যয় ওদের দেখে হেসে বলল,” বাহ! দুই জান্নাত একসঙ্গে বেশ তো।”

ওরা প্রত্যয়কে না জানিয়ে হসপিটালে এসেছে। প্রত্যয় আসার সময় বলেছিল, ‘সে দুপুরে বাসায় আসবেনা। পেশেন্ট দেখে ওটিতে ঢুকবে।’ এজন্য তুয়া হালকা খাবার নিয়ে এসেছে। ইচ্ছে ওর গলায় থ্যাথোস্কোপ ঝুলিয়ে সবকিছু ঘেঁটে দেখছে। ওটি থাকলে প্রত্যয় ভারী খাবার এড়িয়ে চলে। এজন্য ওদের নিয়ে হালকা নাস্তা করল। প্রত্যয় এখন ওটিতে ঢুকব। তাই জামিলকে বলল ওদের বাসায় পৌঁছে দিতে। তিনজনে একসঙ্গে বের হয়ে দেখল, একটা মেয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বলছে, “বাবাই! আমি যাবো না বাবাই। আমি খুব ভয় পাচ্ছি, প্লিজ বাবাই।” এই মেয়েটার অপারেশন করতে যাচ্ছে প্রত্যয়। মেয়ের হার্টে মেজর সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইচ্ছের ‘বাবাই’ ডাকটা পছন্দ হলো। তাই সে প্রত্যয়ের শার্টের বোতাম খুঁটরে বলল,”প্রত্তুয় বাবাই মেয়েতা তাঁদছে কেন? ওলে কি সূচ দিয়েচো?”

ইচ্ছের মুখে ‘প্রত্তুয় বাবাই’ ডাক শুনে তুয়া প্রত্যয় দু’জনে অবাক হলো। তুয়া ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে বলল,”কী বললি আবার বল?” ইচ্ছে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলল,
“বাবাই বলেচি, সলি।” প্রত্যয় ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে আদর দিয়ে আদুরে কন্ঠে বললে,”সরি না সোনা। আমি মোটেও রাগ করিনি। আজ থেকে আমি তোমার বাবাই আর তুমি আমার আম্মু, কেমন? তোমার এই ডাকে আমার প্রাণ জুড়িয়ে গেছে, আমার সোনা আম্মুটা।” ইচ্ছে পাশে ফিরে দেখল মেয়েটা সেখানে নেই। ততোক্ষণে নার্স তাকে ওটিতে নিয়ে গেছে। ইচ্ছে কিছু বলার আগে, ডক্টর ঈশান ইচ্ছেকে দেখে বলল,”ওয়াসিক স্যার বাবুটাকে কে? খুব কিউট তো!” প্রত্যয় মৃদু হেসে অকপটে উত্তর দিল,”আমার মেয়ে।”

রনিতের বস এখনও রনিতকে অপমান করে। কিন্তু রনিত কখনও প্রত্যুত্তর করেনা। উনি যা বলে সবটা সে মেনে নেয়। অফিসের অনেকে রনিতকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু রনিতের জেদ,’ সে বসের মন জয় করেই ছাড়বে।’ অকারণে বকা খাওয়া পরও সে এই সিধান্তে অটল। আজকাল বস রনিতকে দ্বিগুন খাটায়। কারণ বসের কাছে বাঙালী মানে, সুবিধাবাদী, লোভী, অক্ষম, গেঁয়ো এক জাতি। তাছাড়া বিশেষ এক কারণে বাঙালী উনার চোখে বিষ। রনিত আজ দুই মিনিট লেটে অফিসের পৌঁছেছে। এজন্য পানিশমেন্ট হিসেবে সে পাঁচটা ফাইল রেডি করে বাসায় ফিরতে পারবে। নাহলে ওর পুরো মাসের স্যালারি কাটা হবে।

দুই সপ্তাহ হলো চাঁদ আর তুয়ার পরীক্ষা শেষ। তুয়া, চাঁদ আর ইচ্ছে তুরাগদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। ওরা তিনদিন থাকবে ভেবে এসে সেদিনই ফিরে গেল। এখানে আসার পর ইচ্ছে আব্বু আম্মুর জন্য কান্না করছিল। তাই তুয়া ভেবেছে এখানে আর আসবে না। বরং আব্বু আম্মুকে বলবে ওকে দেখতে আসতে। চাঁদ তুয়া দু’জনে ইচ্ছেকে খুব ভালোবাসে। এজন্য তারা ইচ্ছের দিকটা আগে ভেবেছে। এদিকে, তিন্নি তুরাগের সাথে বেশ সুখে আছে। তিন্নি এখন ইলার কথা জানে। তুরাগে থেকে সব শুনে তিন্নি বলেছিল,”পূর্বের কথা বাদ এখন আপনি শুধু আমার।” তুরাগ কথাটা শুনে ছলছল চোখে হেসেছিল। এখন তুরাগের সঙ্গে ইলার যোগাযোগ নেই। তুরাগও আর পিছু ফিরে তাকাতে চাই না। এভাবে সে বেশ ভালো আছে।

দুইদিন পর, ইচ্ছের রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।
ইচ্ছের তো খুশির অন্ত নেই। ইচ্ছে এখন একা থাকতে পারবেনা। তাই ইচ্ছের সঙ্গে প্রত্যয়, প্রিয়ম, চাঁদ অথবা তুয়া থাকে। এভাবেই দিন দিন ইচ্ছে মানিয়ে নিতে শিখে যাবে।

সময় একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। দিন পেরিয়ে মাসকে বিদায় জানিয়ে বছর ছুঁই ছুঁই। ইচ্ছে এখন বুঝতে শিখছে বড় হচ্ছে! ইচ্ছেকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। সে প্রত্যয়কে বাবাই আর প্রিয়মকে বাবা ডাকে। আর তুয়া ডাকে মাম্মা আর চাঁদে মামনি। প্রত্যয়ের বাবাকে ডাকে দাদুজান। আর আম্মুকে ডাকে দাদুন। এখন ইচ্ছের নিজের পরিবার এটা। সে এখানে বেশ ভালো আছে। সায়ন মাঝে মাঝে ইচ্ছেকে দেখে যায়। এবং মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলে। আর রনিতের তো ইচ্ছের সঙ্গে কথা না বললে দিন কাটেনা। কারন ইচ্ছে এখন রনিতের প্রাণ।

সময়ের চাঁকা ঘুরতে ঘুরতে পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেল। এই পাঁচ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। প্রিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যয়ের নাম ডাক চারদিকে ছড়িয়েছে। চাঁদ তুয়া নিজেদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন চাঁদ প্রিয়মের সম্পর্কটা স্বাভাবিক। তুরাগের একটা ছেলে হয়েছে। ইচ্ছে আর মডেলিং শো করেনি। মূলত প্রত্যয় আর করতে দেয়নি। গত পাঁচ বছরে, এতোগুলো মানুষের কার্যক্রমেও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মানুষগুলো একই রকম আছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে একে অপরের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, মায়া, এবং স্নেহশীলতা। ইচ্ছে এখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ছে। সে পড়াশোনাতে যেমন মেধাবী, তেমন দুষ্টু। এখন ইচ্ছের দূর্বল পয়েন্ট প্রত্যয় আর প্রিউম। ওরা ছাড়া ইচ্ছে কারো কথা শুনতে নারাজ।

রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। প্রত্যয় ইচ্ছের প্লেটে মুরগির রান তুলে দিল। ইচ্ছে শরীর ঝাঁকিয়ে হেসে প্রিয়মকে বলল,”বাবা রান খাবে নাকি, হুম হুম?” প্রিয়ম হেসে ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে ইচ্ছেকে দিয়ে বলল,”না আম্মাজান বাবাদের রান খেতে নেই। রান খাওয়ার বয়স থাকে।” কথাটা শুনে প্রত্যয়ের আব্বু খাওয়া থামিয়ে প্রিয়মের দিকে তাকালেন। প্রিউম ছোট থাকতে একদিন ওর বাবাকে বলেছিল, “আব্বু তুমি রান খাও।” তখন উনি প্রত্যুত্তরে একথাটাই বলেছিলেন। প্রত্যয়ের আব্বু হেসে খাওয়াতে মনোযোগী হলেন। ইচ্ছে খেতে খেতেও চাঁদের সঙ্গে দুষ্টু করছে। প্রত্যয় ইচ্ছের মুখে ভাত দিয়ে বলল,”ইচ্ছেমণি, এবারের মেধা তালিকায় তোমার নামটা আমি প্রথম স্থানে দেখতে চাই।” ইচ্ছে মুরগী হাড্ডি চিবুতে চিবুতে অসঙ্কোচে বলল,
“না পারলে?”
“একটু কষ্ট পাব।”
“ইনশাল্লাহ! তোমার মেয়ে পারবে বাবাই।”
“আমি জানি সোনা আম্মু।”

তখন প্রত্যয়ের আম্মু গলা পরিষ্কার করে বললেন,”উহুম! উহুম! আমাদের বাসায় ছোট্ট মেহমান আসতে চলেছে।”

একথা শুনে সবার দৃষ্টি তুয়ার দিকে। তুয়া যেহেতু বড় বউ সবার প্রত্যাশা তুয়া প্রেগনেন্ট। কিন্তু প্রত্যয়ের আম্মু হেসে বললেন,” আগে আমাদের চাঁদের ঘরে চাঁদের কণা আসতে চলেছে।” সবাই এবার ঘাড় ঘুরিয়ে চাঁদের দিকে তাকাল। চাঁদ লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। সবাই এ খবর শুনে একসঙ্গে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ!’ প্রত্যয়ের আম্মু আরেক গাল হেসে বললেন, “ডাবল সুখবর হচ্ছে, আমাদের তুয়াও মা হবে।”

এবার সবাই চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
প্রত্যয়ের আম্মু যে মজা করছে না। এটা উনার ছলছল চোখ আর হাসি দেখে বোঝা যাচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ থেকে প্রত্যয় তুয়ার ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিল। কিন্তু তুয়াকেও কিছু বলেনি। সব মেয়ে এই খবর আগে বরদের জানায়। কিন্তু
চাঁদ তুয়া আগে ওদের বন্ধুরুপী শাশুড়িকে জানিয়েছে। শাশুড়ির কথায় হসপিটালে টেস্ট করে সিওর হয়ে সবাইকে জানাল। চাঁদের এখন তিন মাস। ওর পিরিয়ড অনিয়মত হওয়াতে সে বুঝতে পারেনি। আর তুয়ার চলছে দেড় মাস। সবার মুখে তৃপ্তি হাসি। তবে প্রিয়ম প্রত্যয়ের দিকে আর লজ্জায় তাকায়নি। যদিও এটা কাকতালীয় ঘটনা।

প্রত্যয়ের আব্বু খুশি হলেও মুখে কিছু বললেন না। উনার কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে। এ ব্যাপারটা তুয়ার দৃষ্টি এড়ালো না। প্রত্যয়ের আব্বু একজন বুদ্ধিমান মানুষ। উনার চিন্তা একটাই! এবার ইচ্ছের কি হবে? চাঁদ তুয়া নিজেদের বাচ্চা পেয়ে ইচ্ছেকে দূরে সরাব না তো? ইচ্ছে
ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হবে না তো? আর নিজের বাচ্চা কাঁদলে কেউ অন্যের বাচ্চার জন্য দৌড়ায় না। একথা চরম সত্যি। সেখানে ইচ্ছে তো…। এতোদিন সব ঠিক ছিল। এখন দু’টো বাচ্চা এসে যদি প্রত্যয় প্রিয়মসহ সবার মন বদলে যায়? মানুষের মনের উপর কারো হাত থাকেনা। তেমনি মানুষের মনও বদলাতেও সময় লাগে না।

উনার কপালের ভাঁজ আর চিন্তিত ফেস দেখে তুয়া মৃদু হেসে বলল,”আব্বু ইচ্ছের আদর কখনও কমবেনা, কথা দিলাম।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

উনার কপালের ভাঁজ আর চিন্তিত ফেস দেখে তুয়া মৃদু হেসে বলল,”আব্বু ইচ্ছের আদর কখনও কমবেনা, কথা দিলাম।” এ কথা শুনে প্রত্যয়ের আব্বু সহ সবার মুখে হাসি ফুটল। তারপর সবাই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। চাঁদ রুমে প্রবেশ করতেই প্রিয়ম চাঁদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। প্রতিবারের মতো এবারও সে অনুভূতি প্রকাশে অক্ষম। তাই চুপ করে রইল। চাঁদ প্রিয়মের নিশ্চুপতার মানে বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল,”আজ আমি পরিপূর্ণ সম্পূর্ণা।”

এদিকে, প্রত্যয় রুমে এসে দেখে তুয়া ইচ্ছের চুল বেঁধে দিচ্ছে। দু’পাশে দু’টো বেনুণীতে ইচ্ছেকে বেশ লাগছে। প্রত্যয় সোফাতে বসে একটা বই হাতে নিল। তখন ইচ্ছে প্রত্যয়ের কাছে গিয়ে আদুরে সুরে বলল,”বাবাই! আমাকে আরেকটা ইতু এনে দাও, প্লিজ। শূন্য খাঁচা দেখতে মোটেও ভালো লাগে না।” প্রত্যয় হাতের বইটা রেখে মৃদু হেসে বলল,”আচ্ছা! খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবে।” ইচ্ছে ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে প্রত্যয়ের গালে আদর দিল। আদরের বিনিময়ে প্রত্যয়ও তাকে আদর দিল। প্রত্যয়ের ইতু নামক পাখিটা বেঁচে নেই। হঠাৎ জ্বরে মারা গেছে। সেদিন ইচ্ছে সারাদিন খুব কেঁদেছিল। সেদিন থেকে প্রত্যয় আরেকটা ময়না পাখির খোঁজ করছে। কিন্তু সব সময় ময়না পাখি পাওয়া যায় না। তবুও সে পাহাড়ি এলাকার একজনকে জানিয়ে রেখেছে। সে পেলে এনে দিবে বলেছে।
তুয়া চুপ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের দু’জনকে দেখলে নিঃসন্দেহে মনে হয়, ওরা বাবা মেয়ে।

দু’জনে টুকটাক গল্প করে ইচ্ছে চানাচুরের বাটি হাতে নিয়ে বলল, “আচ্ছা বাবাই আমি এখন রুমে গেলাম, শুভ রাত্রি।” প্রত্যয় মুচকি হেসে প্রত্যুত্তরে বলল,”শুভ রাত্রি সোনা মা।” তুয়া নিজের চুলে চিরুণী করতে করতে বলল,”ইচ্ছে বেশি রাত জাগবেনা শরীর খারাপ করবে।” ইচ্ছে দরজার কাছে থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,”পড়া কমপ্লিট করেই ঘুমিয়ে যাব মাম্মাম, প্রমিস। আর আমার বাবাইয়ের ইচ্ছে পূরণ করতে হবে তো।”

কথাটা বলে ইচ্ছে মিষ্টি হেসে স্থান ত্যাগ করল। ইচ্ছের মাম্মাম ডাকটা তুয়ার কলিজা জুড়িয়ে যায়। ওর প্রতিটা দায়িত্বের কথা স্মরণে চলে আসে। যদিও তুয়ারও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সে এখন পারফেক্ট সহধর্মিণী এবং ইচ্ছের মাম্মাম হয়ে উঠেছে। তুয়া বসে ইচ্ছের কথা ভাবছিল। হঠাৎ প্রত্যয়ের দরজা আঁটকানোর শব্দে ভাবনার ছেদ ঘটল। দু’জনের চোখাচোখি হওয়াতে দু’জনে মৃদু হাসল। প্রত্যয় বিনাবাক্যে তুয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। তুয়া হেসে আলতো করে প্রত্যয়ের চুলে হাত ডুবাল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শুধু একে অপরের অনুভূতিকে গভীর ভাবে অনুভব করছে। তুয়া যত্ন করে প্রত্যয়ের চুল টেনে দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর, প্রত্যয় মুখ তুলে তুয়ার পেটে আদর দিয়ে বলল,” এই অমূল্য উপহারটারের আগমনে আমি খুব খুশি। অনেক অনেক ভালবাসা নিও সোনা বউটা।” তুয়া প্রত্যয়ের কপালে আদর দিয়ে বলল,”ধন্যবাদ প্রিয়।”

তারপর থেকে শুরু হলো চাঁদ তুয়ার প্রতি সবার যত্ন নেওয়া। ছোট্র ইচ্ছেও এখন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওদের যত্ন নেয়। বাসার প্রত্যেকটা সদস্য ওদের প্রতি খুব যত্নশীল। প্রত্যয় প্রিয়ম নিজেদের বউয়ের জন্য কখনও একা কিছু আনেনা। কিছু আনলে সবার জন্য আনে। ‘আমার বউ একা খাবে’ এমন মনোভাব ওদের কারো’র মনে নেই। চাঁদের খুব একটা বমি হয়না! সে প্রায় সবকিছু খেতে পারে। কিন্তু তুয়া খাবারের গন্ধও সহ্য করতে পারেনা। ওর পছন্দের জিনিসগুলোও এখন অপছন্দের লিষ্টে যুক্ত হয়েছে। তুয়ার আব্বু আম্মু এসে তুয়াকে দেখে গেছে। তাদেরও খুশির অন্ত নেই। উনারা তুয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তুয়া রাজি হয়নি। প্রত্যয়ের আব্বু আম্মুও চাচ্ছিলেন না, তুয়া যাক। কিন্তু উনারা মুখ ফুটে বলতে পারছিলেন না। তুয়ার না যাওয়াতে প্রত্যয়ের মুখে আগে হাসি ফুটেছে। আর তুয়া মূলত যায়নি চাঁদের জন্য। তুয়া বাপের বাড়ি গেলে চাঁদ মন খারাপ করত। সব মেয়েরা এই সময়টা মায়ের কাছে থাকতে চাই। আর সেখানে চাঁদের তো বাবার বাড়ি নেই। তুয়ার সিধান্তে তুয়া আব্বু আম্মু অখুশি হয়নি। বরং হেসে মাথায় হাত রেখে বলেছেন, ”আমার মা টা অনেক বড় হয়ে গেছে।”

তারপর শারীরিক, মানসিক, সমস্যা গুলো নিয়ে চাঁদ তুয়ার দিন কাটতে লাগল। প্রত্যয় প্রিয়ম ওদের যথেষ্ট খেয়াল রাখে। প্রত্যয় প্রিয়ম যেই ফল কাটুক ওদের দু’জনের জন্য ফল কাটবে। দু’জনকে এক ডক্টরই দেখেন। দু’জনের জন্য আরাম দায়ক পোশাকও এক, শুধু ভিন্ন কালারের। দু’টো বউ সবার থেকে সমান ভালবাসা পায়। এখানে ইচ্ছেও বাদ যায় না। সে সবার চোখের মণি। আর পূত্রবধূদের এটা ওটা এনে খাওয়ানো প্রত্যয়ের আব্বু রোজকার কাজ। উনি আজ বিকেলে মূলত চাঁদ তুয়ার জন্য বাইরে গিয়েছিলেন। ওরা দু’জনে মুখে স্বাদ পাচ্ছে না। বমি করে ওদের রুচি বেহাল দশা। তাই উনি ওদের জন্য ঝাল করে পেয়ারা মাখা এনেছেন। চাঁদ খাচ্ছে, আর ঝালের গন্ধে তুয়ার বমি বমি পাচ্ছে। না খেলে বাবা কষ্ট পাবে ভেবে সে একপিস খেল। এবং সাথে সাথে বমি করে দিল। আর পুরো বমি গিয়ে পড়ল প্রত্যয়ের আব্বু গায়ে। তুয়া এবার লজ্জায় কেঁদে দিল। প্রত্যয়ের আব্বু হেসে তুয়াকে পানি খাইয়ে মাথা হাত বুলিয়ে বললেন,”ব্যাপার না মা এটা ধুলেই পরিষ্কার করে যাবে। কিন্তু তুই কাঁদলে আমি খুব কষ্ট পাব। দাদু হবো আর এসব না সহ্য করলে হবে?”

কথাটা শুনে চাঁদ তুয়া হাসল। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার মুখ মুছিয়ে বমি পরিষ্কার করে বললেন,”তাই তো! তোদের এ বাড়িতে ভালো রাখার জন্য এনেছি। তোরা ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকব, বুঝলি?”

এদিকে, কালকে রাতে ইচ্ছের চানাচুর শেষ। সে আজ সারাদিন চানাচুর খায়নি। প্রিয়ম চানাচুর এনেছে কিন্তু তুয়া লুকিয়ে রেখেছে। ইচ্ছে আগে অল্প করে চানাচুর নিতো। আর এখন বাটি ভর্তি করে নেয়। এতো চানাচুর খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই তুয়া লুকিয়ে রেখে। এখন ইচ্ছের স্কুল ব্যাগে চানাচুরের প্যাকেট থাকে। ক্লাস চলাকালীন শিক্ষকের আড়ালে চানাচুর খাওয়া ইচ্ছের আরেক অভ্যাস। আজ সে কোচিং থেকে ফিরে চানাচুর না পেয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। প্রত্যয় হসপিটালে আর প্রিয়ম গেছে ওর প্রোগ্রামে। এখন ওরাও কেউ বাসায় নেই। কে ওকে চানাচুর এনে দিবে? ইচ্ছে ছলছল চোখে প্রত্যয়ের আব্বুর দিকে তাকালেন। উনি
ইচ্ছেকে রুমের যাওয়ার ইশারা করলেন। ইচ্ছে উনার ইশারা বুঝে দৌড়ে রুমে চলে গেল। হ্যাঁ! ওর দাদুজান চানাচুর এনেছে। ইচ্ছে মুখে চানাচুর পুরে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলল, “দাদুজান লাভ ইউ। তোমার চুল গুলো না পাকলে তোমাকেই আমার বফ বানাতাম।” একথা শুনে সবাই হেসে উঠল। তখন প্রত্যয়ের আম্মু একটু রাগি দেখিয়ে বললেন, ” ফাজিল মেয়ে কি বললি তুই?” ইচ্ছে মুখ ভেংচি দিয়ে বাদাম খেতে খেতে বলল,”তোমার বুইড়াকে নিতে আমার বয়েই গেছে, হুম।” কথাটা বলে ইচ্ছে চানাচুর খেয়ে পড়তে বসল। এখন ওর পড়ার খুব বেশি চাপ যাচ্ছে। তাই সে অযথা সময় নষ্ট করল না।

তুরাগের ছেলের নাম রেখেছে পরাগ। পরাগ এখন হাঁটতে শিখেছে। বউ বাচ্চা নিয়ে তুরাগ বেশ সুখে আছে। সে দিনের পর ইলার সঙ্গে তুরাগের আর যোগাযোগ হয়নি। গতদিনে ইলার বান্ধবীর সঙ্গে তুরাগের দেখা হয়েছিল। ওর বান্ধবী জানিয়েছে ইলা সুইসাইড করেছে। রিকের অত্যাচার নাকি দিন দিন বেড়ে গিয়েছিল। ওকে নিয়ে রিক এক প্রকার ব্যবসা শুরু করেছিল। প্রথম প্রথম ওর বন্ধুদের আনলেও পরে কাস্টমার ধরে আনত। ইলা সে ডক্টরকে ব্যাপারটা জানালে ডক্টর বলেছিল, “মজা তুমিও নাও আর কাস্টমারদেরও দাও। এর মাঝে কিছু টাকা আসলে মন্দ কি?”

একথা শুনে ইলার নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। আর এসব থেকে বাঁচতে সুইসাইডের পথ বেঁছে নেয়। পরে ইলার ডায়রি পেয়ে পুলিশ রিককে গ্রেফতার করে। এবং সেই ডক্টরের লাইসেন্স ক্যানসেল করে। ওরা দু’জনে এখন কারাগারে বন্দী। এ ঘটনা শুনে তুরাগ কষ্ট পেলেও কিছু বলল না। আর কি বা বলবে? ইলা তো নিজে ওদের সম্পর্কটা নষ্ট করেছে। তাছাড়া সে তুরাগ বাদে অনেক ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তাদের থেকেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছে। তারপর সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছে। আজ ওর লোভ ওকে ধবংস করল।

রনিত থম মেরে ওর কেবিনে বসে আছে। আজ ওর কলিগের থেকে বসের সম্পর্ক অনেক কিছু জেনেছে। বসের বাঙালীদের অপছন্দের কারণ উনার মেয়ে। উনার মেয়ে এক বাঙালী ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে। টূরে এসে বসের মেয়ে রোজের সঙ্গে ছেলেটার পরিচয় হয়েছিল। আর সেখান থেকে তাদের প্রেমের সূত্রপাত। আর ছেলেটা বেকার ছিল। তাছাড়া উনাদের সোসাইটির সঙ্গে মানানসইও ছিল না। এজন্য উনি মেয়েকে এই সম্পর্কটা এগোতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মেয়ে উনার কথা অমান্য করেছিলেন। তাই বস রেগে আজ পর্যন্ত মেয়ের খোঁজও নেয়নি। উনার ভাষ্যমতে, ‘যে মেয়ে বাবার সন্মানের কথা ভাবে না। তাকে উনি মেয়ে হিসেবে মানেন না।’ এই ঘটনার পর থেকে বাঙালী ছেলেরা উনার চোখের বিষ। উনার মনে হয় সব বাঙালী এমন ধাঁচের। এটাও
জানা গেছে, ছেলে এখন বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার পদে নিযুক্ত আছে। এসব শুনে রনিত খোঁজ নিয়েছে। এবং জানতে পেরেছ সে ছেলে হচ্ছে পুলিশ অফিসার সায়ন। আর সায়নের বউ রোজের সমস্যা কারণে এখনও ওদের বাচ্চা হয়নি। তাই সে ইচ্ছেকে দত্তক নিতে চেয়েছিল।

এদিকে, দিশা এখনও বাচ্চা নিতে ইচ্ছুক নয়। সে ভাবে বাচ্চা মানে প্যারা। আর অল্প বয়সে বাচ্চা নিয়ে শারীরিক গঠন নষ্ট করার মানেই হয়না। স্ত্রীর মাঝে আকষর্ণীয় কিছু না থাকলে স্বামী পরনারীতে আসক্ত হয়। রনিতের মাও বার বার বলেন একটা বাচ্চা নিতে। কিন্তু দিশার একই কথা, ‘তার মনমতো সময়ে বাচ্চা নিবে। কারো কথা শুনে সে ডুবতে রাজি নয়।’ এজন্য রনিতের আম্মুর আর কিছু বলেন না।

চাঁদের এখন আট মাস চলছে। মাঝ রাতে হঠাৎ পেটের ব্যাথায় ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠল। বাচ্চাটা মনে হচ্ছে স্বজোরে কিক মেরেছে। আর ব্যাথাতে সে কুঁকিয়ে উঠেছে। প্রিয়ম আলতো করে চাঁদের পেটে হাত বুলিয়ে হেসে বলল,”এমন করে না সোনা বাবা টা! আম্মু তো ব্যাথা পাচ্ছে।” একথা বলতে বলতে আরেকটা লাথিতে চাঁদ প্রিয়মের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। প্রিয়ম আর এই কাহিনীর বিচার করতে পারল না। সে হেসে চাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।

প্রত্যয় সারাদিন হসপিটালে থাকে। কিন্তু ওর মন তুয়াতে সীমাবদ্ধ । সারাদিনে কতবার খবর নেয় তার হিসেবে নেই। রাতে প্রত্যয় তুয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ তুয়া প্রত্যয়ের বুকে বমি করে দিল। প্রত্যয় দ্রুত উঠে তুয়ার কপালে চেপে ধরে মুখ মুছিয়ে পানি খাওয়াল। কিছুক্ষণ আগে তুয়া একটা আপেল খেয়েছিল। সেটাই এখন তুলে দিল। প্রত্যয় তুয়াকে সোফাতে বসিয়ে বেডশীট বদলে শুইয়ে দিল। আর নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে হালকা কিছু খাবার আনল। তুয়াকে খেতে দিলে সে কেঁদে কেঁদে বলল,”খুব জ্বালাচ্ছি সবাইকে। সারাদিন কষ্ট করে রাতেও আমার জন্য ঘুমাতে পারছ না। আমার না মরে যেতে ইচ্ছে করছে।” প্রত্যয় মৃদু হেসে তুয়ার কপালে আদর দিয়ে বলল,”ধুর পাগলি! কষ্ট না করলে বাবা হওয়ার যায় না। আর আমার সোনা বউটার কষ্টের কাছে আমার কষ্ট কিছু না।” তুয়া আদুরে বাচ্চার মতো প্রত্যয়ের বুকে চুপটি করে পড়ে রইল। আর প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার মাথাতে হাত বুলাতে লাগল।

সবার আদর ভালবাসা আর যত্ন নিয়ে দিনগুলো কেটে গেল।
আর নিদির্ষ্ট সময়ে সুষ্ঠুভাবে চাঁদের মেয়ে প্রিয়। আর তুয়ার ছেলে প্রাণের আগমন ঘটল। চাঁদের ডেলিভারির দিন প্রিয়ম টেনশনে প্রচন্ড অস্থির ছিল। সে পারছিল না চাঁদের সব কষ্ট এক নিমিষে মুছে দিতে। চাঁদের চিৎকার যেন প্রিয়মের কলিজায় গিয়ে বিঁধছিল। তারপর কষ্টের সীমানা অতিক্রম করে প্রিয় উচ্চশব্দে কেঁদে উপস্থিতি জানান দিল। প্রিয়ম ছোট্ট প্রিয় কে বুকে জড়িয়ে ধরে সবার সামনে কাঁদল। বাবার হওয়ার অনুভূতি এতো মিষ্টি ওর জানা ছিল না। প্রিয়মের কান্না দেখে ছোট্ট প্রিয় ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। মেয়ের তাকানো দেখে প্রিয়ম কাঁদতে কাঁদতে হেসে উঠল। আর ভাইয়ের এমন কান্ড দেখে প্রত্যয় মৃদু হেসে চোখ জুড়াচ্ছিল।

তুয়ার বেলায় তুয়া প্রত্যয়কে ছাড়া ওটিতেই ঢুকতে চাচ্ছিল না। ওর একটাই কথা ছিল,’জানিনা আমার সঙ্গে কি ঘটবে? আমি সব অবস্থাতে তোমাকে চাই।’ সেদিন প্রত্যয় তুয়ার কথা মতো ওটিতে থাকতে ঢুকেছিল। ডেলিভারীর সময় তুয়ার প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিল। কিছুতেই ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছিল না। প্রত্যয় শান্ত থাকলেও বোঝাতে পারেনি ওর বুকের তোলপাড়। তুয়ার আত্মনার্দ প্রত্যয়ের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তবুও ওর প্রচেষ্টা এবং কাজ থামায়নি। প্রত্যয় ওর ছেলের নাড়ি নিজে কাটল। আর এই অদ্ভুত সুন্দর অনুভুতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। প্রত্যয় শুভ্র তোয়ালে পেঁচানো ছেলের কপাল আদর দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,”আসসালামু আলাইকুম সোনা বাবাটা। সুন্দর এই পৃথিবীতে তোমাকে সু-স্বাগতম।”

ছেলের বাবার কথা বুঝতে না পারলেও চোখ খুলে বাবাকে দেখল। কিছুক্ষণ পর তুয়াকে কেবিনে দেওয়া হল। একে একে সবাই দেখা করে যাওয়ার পর প্রত্যয় তুয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,”প্রচন্ড ভালবাসি তোমাদের।” তুয়াও দূর্বল গলায় প্রত্যুত্তরে বলল, “আমরাও বাবুর আব্বু।”

এদিকে, ইচ্ছের আবদার ছিল প্রত্যয়ের পর সে প্রাণকে আগে কোলে নিবে। প্রিয় কে নিতে পারেনি সেদিন ওর পরীক্ষা ছিল। তাই প্রত্যয় প্রাণকে ইচ্ছের কোলে তুলে দিল।ছোট্ট প্রাণের কান্না দেখে সেও ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিল। ইচ্ছে
প্রাণের দিকে তাকিয়ে কেঁদে বলল, “আমার ছোট্ট পাখিটা কাঁদিস না। আমি তোকে চানাচুর খাইয়ে তাড়াতাড়ি বড় করে তুলব।”

তিন বাচ্চার হাসি কান্নাতে প্রত্যয়দের বাসাটা গমগম করছে। ইচ্ছে প্রত্যয়ের চাওয়াটা রেখেছে। সে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। তাই প্রিয়ম ইচ্ছেকে স্বর্ণের প্রজাপতি লকেট উপহার দিয়েছে। আর প্রত্যয় চাঁদ তুয়ার মতো একই বেসলেট উপহার দিয়েছে। ইচ্ছের বেসলেটের মাঝখানে ‘ইচ্ছেমণি’ লিখা আছে। ইচ্ছে বেসলেট টা আর হাত থেকে খুলেনি! বরং সব সময় হাতে পরে থাকে। প্রত্যয়ের আব্বু ইচ্ছেকে দারুণ একটা ড্রেস দিয়েছে। ইচ্ছে ওর মডেলিং শো এর টাকা দিয়ে প্রান ও প্রিয় কে ড্রেস আর স্বর্ণের চেইন উপহার দিয়েছে। আজকে পার্ট নিয়ে কিছু বলুন। আর পরবর্তী অর্থাৎ সমাপ্ত পার্টের জন্য অপেক্ষা করুন, ধন্যবাদ।

আর এভাবে হাসি খুশিতে কেটে গেল আরো কয়েকটা মাস।
কিন্তু হঠাৎ দিশার আগমনে সবার মনটা বিষিয়ে গেল। দিশা যুক্তি আর আবদার শুনে সবাই থমকে গেল। প্রত্যয় প্রিয়ম তখন বাসায় ছিল। ওরা তখনও বুঝতে পারছিল না দিশার উপস্থিতির কারণ। তুয়া কিছু বলার আগে দিশা হাউমাউ করে কেঁদে প্রত্যয়ের পা জড়িয়ে ধরল। দিশার এমন কাজে সবাই হতবাক। প্রত্যয় দ্রুত ওর কোলে থাকা প্রিয় কে তুয়ার কোলে দিয়ে দিশার থেকে ওর পা ছাড়িয়ে নিল। এবং দিশাকে তুলে সোফাতে বসাল। এদিকে ছোট্ট প্রিয় প্রত্যয়ের কোলে যাবে বলে কান্না জুড়ে দিয়েছে। সে আবার প্রত্যয়ের অন্ধভক্ত। প্রত্যয় প্রিয়কে কোলে নিতেই প্রিয় থেমে গেল। অপর সোফাতে চাঁদের কোলে তখন প্রান ঘুমাচ্ছিল।

সবার দৃষ্টি তখন দিশার দিকে। দিশা সবার দৃষ্টির মানে বুঝে কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে বলল,

“ডক্টর বলেছে আমি কখনও মা হতে পারব না। দয়া করুন আমাকে! প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আমি দুই হাত পেতে আজ সাহায্য চাইতে এসেছি। ইচ্ছেকে আমি নিতে এসেছি ভাই, প্লিজ।”

চলবে।