‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
পরেরদিন সকাল থেকে অঝরে বৃষ্টি ঝরছে। সেই সঙ্গে বইছে ঝড়ো বাতাস। এখন বাজে সকাল দশটা। অথচ অঝর বৃষ্টি আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে মনে হচ্ছে সাঁঝ সন্ধ্যা বেলা। সাথে আকাশ কাঁপিয়ে ঘন ঘন মেঘের গর্জনও শোনা যাচ্ছে।
আজকে শুক্রবার। চাঁদ তুয়াসহ সবাই বাসাতেই আছে। প্রত্যয় রাতে তুয়াকে মেসেজে জানিয়েছে, ‘টেনশন না করতে। কাজ শেষ হলে সে শীঘ্রই ফিরবে।’ তুয়া বৃষ্টি দেখছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। কলি কাঁচা মরিচ খাচ্ছে সাথে বুলি আওড়াচ্ছে। তুয়া মিষ্টি হেসে কলিকে বলল,”বলত কলি আমি কার বউ?” কলি চেঁচিয়ে বলল,’প্রত্তুয়! প্রত্তুয়! কলির উত্তর শুনে তুয়া খিলখিল করে হেসে উঠল। হঠাৎ বাতাসে বৃষ্টির ঝাপটা এসে তুয়ার মুখে লাগল। ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেয়ে তুয়া কেঁপে উঠে চোখে বন্ধ করে মৃদু হাসল।
একটুপরে, চাঁদ এসে তুয়াকে ডেকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেল। প্রত্যয়ের আব্বু আম্মুর সঙ্গে ওরা লুডুর বাজি ধরল। চাঁদ আর প্রত্যয়ের আব্বু একদল। তুয়া আর প্রত্যয়ের আম্মু অন্যদল। ওদের সামনে আছে চানাচুর মাখা আর গরম চা। চারজনে মিলে খাওয়ার সঙ্গে খেলাতে মনযোগী হল।
প্রিয়ম কালকে রাত থেকে ঘুমায়নি। এখনও সে পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে। আর বার বার ফোন চেক করছে। প্রত্যয়ের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে সে কলও দিতে পারছেনা। যদিও সে জানে প্রত্যয় সঠিক সিদ্ধান্তটাই বেঁছে নিবে। তবুও ওর টেনশন কমছেনা। টেনশনে প্রিয়মের পুরো শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। অন্যদিন হলে বৃষ্টির সময় সে গিটার নিয়ে বসত। প্রিয়ম বৃষ্টি খুব পছন্দ করে। অথচ আজ বৃষ্টি ওর কাছে বিরক্তির কারণ।
ওইদিকে প্রত্যয়ের হসপিটালে একটা পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে। পেশেন্ট হার্ট এ্যার্টাক করেছেন। এর আগে পেশেন্টের হার্টে দু’টো রিং পরানো হয়েছিল। সব মিলিয়ে পেশেন্টের শোচনীয় অবস্থা। এবার উনার হার্ট এ্যার্টাকের কারন, উনার ছেলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট প্লাস আসেনি। এজন্য রাগের বশে ছেলেকে খুব মেরেছেন। ছেলে মার খেয়ে কাল রাতে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। মূলত এই টেনশনে উনি হার্ট এ্যার্টাক করেছেন। আজ পেশেন্টের চিকিৎসা শুরুর আগে ডক্টর উনার পূর্বের রিপোর্ট এবং সমস্যা জানতে চাচ্ছেন। পেশেন্টের সহধর্মিণী সহজ সরল মহিলা। উনি কথা বলতে গিয়ে থতমত খাচ্ছেন। বার বার হার্ট এ্যার্টাককে হার্ট স্টোক বলে ফেলছেন। উনি হয়তো স্টোক আর এ্যার্টাকের ব্যাপারটা বুঝতে আনাড়ি।
মহিলার মুখে ‘হার্ট স্টোক’ কথাটা শুনে ডক্টর কাউসার মিটিমিটি হাসছেন। এতে মহিলা টা অস্বস্তিতে পরে চুপ হয়ে গেলেন। উনি স্বামী সন্তান ছাড়া অকারণে বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন না। কিন্তু আজ স্বামীর জন্য হসপিটাল অবধি ছুটে এসেছেন। এখনও উনার ছেলেটার খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাশের বাসার লোকদের সাহায্য নিয়ে উনি স্বামীকে হসপিটালে এনেছেন। লোকগুলো টাকা খরচের ভয়ে হসপিটালের ভর্তি করেই চলে গেছে। অগত্যা এখন মহিলাটিকেই ডক্টরের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে। মহিলাটার অবস্থা দেখে দুইজন নার্স বিরবির করে বলল,”এখানে প্রত্যয় স্যার থাকলে কখনও হাসতেন না। বরং সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন। আর দেখ, কাউসার স্যার কেমন করে হাসছে। বুঝলি তো? একেই বলে ডক্টর হওয়ার গরিমা।”
একজন নার্স গিয়ে একথা ডক্টর ঈশানকে জানিয়ে দিল। ডক্টর ঈশান ডক্টর কাউসারকে ডেকে সাবধান করে দিলেন। কারন ডক্টর ওয়াসিক এসব পছন্দ করেনা। এসব ব্যাপারে ওয়াসিকের কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। যেহেতু এটা ওয়াসিকেরই হসপিটাল। তাই সবাই ওর রুলস অনুযায়ী চলতে বাধ্য। আর ওয়াসিকের ভাষ্যমতে, ‘এখানে যারা আসে সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। অথবা পিএইচডি করা ডক্টর নয়, যে সব জানবে। যদি তারা সর্বজানতা হতো তাহলে এখানে আসত না। তাই হসপিটালের কোনো ডক্টর বা নার্স অকারণে যেন পেশেন্টের বাড়ির লোকদের হেনোস্তা না করে।’
ডক্টর কাউসার প্রত্যয়কে কখনই ভালো নজরে দেখেনি। তাই ঈশানের মুখে প্রত্যয়ের করা রুলস শুনে রাগ হলেও চেপে গেলেন। কারন এখন কিছু বলা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। পরে না হয় এর হিসাব চুকাবেন। ডক্টর ঈশান সুন্দর ভাবে মহিলাটার সঙ্গে কথা বললেন। এবং পেশেন্টের চিকিৎসা শুরু করলেন। আর ডক্টর কাউসার হাতের রিপোর্ট টা রেখে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।
তিন্নি বেশ কয়েকবার ওর বাবার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। স্বামী, সংসার, শশুড়বাড়ি নিয়ে ওর কোনো অভিযোগ নেই। তুরাগ ওকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেয়নি। একদম স্বাভাবিক ভাবে চলছে ওদের নতুন সংসার। তুরাগ ইলার কথা তিন্নিকে এখনও জানায়নি। সময় সুযোগ বুঝে পরে জানাবে ভেবে। আর বিয়ের পর আগ বাড়িয়ে প্রাক্তনের কথা বউকে জানানো এক প্রকার বোকামি। ঠিক! যেচে বাঁশ খাওয়ার মতো ব্যাপার। তবে এতোকিছুর পরে তুরাগ কষ্ট পায়নি বা পাচ্ছে না, তাও কিন্তু নয়। সে নিজের কষ্ট নিজে গিলে সবার চোখে স্বাভাবিক আছে।
এবং তিন্নিকে ওর প্রাপ্ত অধিকারটুকু দিয়েছে। পলকের মৃত্যুতে শুধু তুয়া নয়! আরো বেশ কয়েকজনের মনে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। তাদের মধ্যে তুরাগ একজন। সে কড়াভাবে তিন্নিতে বলে দিয়েছে, ‘এখন বাচ্চা নিবে না।’ তিন্নি তুরাগের কথা বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে।
চাঁদ গালে হাত দিয়ে রেগে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে, চাঁদ রুমে ডুকেই প্রিয়মের গালে ঠোঁটে ছোঁয়াল। প্রিয়ম রাগী চোখে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। সে ডুবে আছে অন্য চিন্তায়। চাঁদ সুযোগ পেয়ে একই কাজ পুনরায় করল। প্রিয়ম এবারও কিছু বলল না। তিনবারের বেলায় প্রিয়ম স্বজোরে চাঁদের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। চাঁদ রেগে গিয়ে প্রিয়মের কলার চেপে ধরে বলল,”একটু ভালবাসলে কি হয়? কিসের এতো অহংকার তোমার? আমাকে মানবে না তো ঢং করে আবার বিয়ে করলে কেন?” প্রিয়ম ওর কলার ছাড়িয়ে রেগে বলল,”চাঁদ অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো নয়। ভুলেও আর আমার কলারে হাত দিবে না।” চাঁদ এবার চেঁচিয়ে বলল,”এটা করব না, সেটা করব না। আসলে আমি করব টা কি বলবে আমায়? নাকি তুয়াকে চোখের সামনে দেখে আমাকে তোমার মনে ধরছে না?”
প্রিয়ম সর্বশক্তি দিয়ে আবার চাঁদের গালে থাপ্পড় বসাল। চাঁদ চিৎকার করার আগে প্রিয়ম ওর গলা চেপে ধরে বলল,”চুপ! আর ফাইনালি শুনে রাখ, থাকতে হলে এভাবেই থাক! নয়তো বেরিয়ে যা। আর একবার তুয়ার নাম নিলে সত্যিই তোকে মেরে পুঁতে দিব। ”
কথাটা বলে প্রিয়ম চাঁদকে ধাক্কা মেরে বেলকণিতে চলে গেল। তখন ওদের দরজার পাশে থেকে কেউ সরে গেল। সেই ব্যাক্তি এমন কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এদিকে চাঁদ মেঝেতে শুয়ে কাঁদতে লাগল। সে প্রিয়মের থেকে একটু ভালবাসা চায়। সবার মতো সেও সুখের সংসার গড়তে চায়। কিন্তু প্রিয়ম চাইলেও পারেনা স্বাভাবিক হতে। ওর নিষ্ঠুর মনটা ওর কথা শোনে না। কারন ওর বেহায়া মনটা এখনও কাউকে ভালবাসে।
রাত আট টার দিকে প্রত্যয় ওর কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাল। একটা বাসায় ঢুকে সে আশে পাশে চোখ বুলাল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, “আপনি কি প্রত্যয়?” প্রত্যয় পেছনে ঘুরে একজন যুবককে দেখতে পেল। সে কিছু বলবে, তার আগে কেউ ওর নাম ধরে ডেকে উঠল। প্রত্যয় সামনে তাকিয়ে তাৎক্ষণিক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আর ইচ্ছে দৌড়ে এসে প্রত্যয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ইচ্ছের কন্ঠে সেই আদুরে ডাক, “প্রত্তুয়! প্রত্তুয়! তুমি এছেছো?” প্রত্যয় ইচ্ছেকে ওর বাহুডোরে আবদ্ধ করল। সায়ন দুরে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনকে দেখছে। প্রত্যয় ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে আদুরে সুরে বলল,” খুব দুঃখু পেয়েছ আমার ইচ্ছেমণিটা?”
ইচ্ছে ঠোঁটে উল্টো কেঁদে প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখল। ইচ্ছের কপালে, হাতে,পায়ে, ব্যান্ডেজ দেখে প্রত্যয় খুব কষ্ট পেল। তখন সায়ন মুচকি হেসে বলল,”ইচ্ছেমনি রোজা ফুপির সঙ্গে যাও। আমি তোমার প্রত্যয়ের সঙ্গে একটু কথা বলি।” ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে বলল,”কেনু কতা বলবা? এতা তু আমাল প্রত্তুয়।” প্রত্যয় মৃদু হেসে বলল,”রাজকন্যা রা সব কথা শুনে। আর তুমি তো বেস্ট রাজকন্যা।” ইচ্ছে ঠোঁটে ফুলিয়ে কান্নারত কন্ঠে বলল,”তুমি চলে যাবা না? আমি কুন্তু তোমাল সাতে যাব।”
প্রত্যয় ইচ্ছের কপালে আদর দিয়ে বলল,”আমি যাব না সোনা। তুমি যাও! আমি এখানেই আছি।” ইচ্ছে ঘাত কাত করে সম্মতি দিয়ে রোজার কাছে গেল। সায়ন ইচ্ছের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রত্যয়কে জানাল। যদিও ইচ্ছের আব্বু আম্মুর এখনও নিখোঁজ। ইচ্ছের আব্বু আম্মু পাচার চক্রের খপ্পরে পড়েছে। যে মানুষ পাচার করত সে ইচ্ছেদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকত। তার নাম মাহিম। মাহিমের ছেলে ছিল ইচ্ছের খেলার সঙ্গী। দুই পরিবারে যাওয়া আসার মাধ্যমে ইচ্ছেদের অনেক তথ্য মাহিম জেনেছিল। তাছাড়া ইচ্ছের আম্মু সরল মনে অনেক গল্পই উনাদের কাছে করেছিল। এমনকি পরিবারের কারো সঙ্গে উনাদের যোগাযোগ নেই, একথাও বলেছিল।
দুইদিন আগে মাহিবের বউ ইচ্ছেদের দাওয়াত করেছিল। এবং খাবারের সঙ্গে কড়া ডোজের মেডিসিন মিশিয়ে ইচ্ছের বাবা মাকে খাইয়েছে। মেডিসিন মিশ্রিত খাবার খেয়ে উনাদের শরীর অসাড় হয়ে সেন্স হারিয়ে ফেলে। তারপর সুযোগ বুঝে মাহিম ওর লোকদের সাহায্য নিয়ে উনাদের গাড়ি তোলে। ইচ্ছেও তাদের সঙ্গে ছিল। ইচ্ছের কিডনিটাও ওদের টার্গেট ছিল। সমস্যা হল, ওদের বস বাচ্চা কিংবা বাচ্চার কান্না সহ্য করতে পারেনা। আর ইচ্ছে তখন বাবা মায়ের সাড়া না পেয়ে অনবরত কাঁদছিল। তাই মাহিম রেগে চলন্ত গাড়ি থেকে ইচ্ছেকে ছুঁড়ে ফেলেছিল। ইচ্ছে ছিটকে পড়ে বুকে, পেটে, কপালে খুব আঘাত পেয়ে সেন্স হারিয়েছিল।
এক দিন পর ইচ্ছের সেন্স ফিরেছে। তারপর থেকে ইচ্ছে পুলিশ অফিসার সায়নের কাছে ইচ্ছে ছিল। পাচারকারী চক্রের মাহিমের খোঁজ পাওয়া যায় নি। তবে তদন্ত করে ইচ্ছেদের বাসা খুঁজে বাসার মালিকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এবং মালিকের থেকে ইচ্ছের আব্বু আম্মুর নাম্বার সংগ্রহ করা হয়। সেই নাম্বার হ্যাক করে প্রত্যয়ের নাম্বার বের করা হয়েছে। সায়ন আর প্রত্যয় মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে। আর ইচ্ছে রুমের দরজা থেকে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। সে খেয়াল রাখছে, যেন প্রত্যয় ফাঁকি দিতে না পারে। সায়ন ব্যাপারটা খেয়াল করেও কিছু বলল না। এসব ঘটনা
শুনে প্রত্যয় কিছু বলার ভাষা পেল না। একবার পেছনে ঘুরে ইচ্ছের দিকে তাকাল। ইচ্ছে তাকে ভুবন ভুলানো হাসি উপহার দিল।
সায়ন তখন অকপটে বলল,”মিঃ প্রত্যয় আমি ইচ্ছেকে দত্তক নিতে ইচ্ছুক।”
‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
ইচ্ছেকে দত্তক নেওয়া কথা শুনে প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে নিল। ইচ্ছের আব্বু আম্মুর এখনও কোনো খোঁজ মিলেনি। আর তার আগেই সায়ন এসব ভাবছে। প্রত্যয় মনে প্রাণে চাচ্ছে, খারাপ কিছু না ঘটুক। কারন বাবা মা ছাড়া পৃথিবীটা বাচ্চার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র। সে ইচ্ছেকে যতই ভালবাসুক! কখনও বাবা মায়ের অভাব পূরণ করতে পারবেনা। এখনই সায়নের প্রস্তাবটা প্রত্যয়ের পছন্দ হলো না। তবুও সে মুচকি হেসে বলল,” আগামীতে কি ঘটবে জানি না? তবে দোয়া করি খারাপ কিছু না ঘটুক।” সায়ন কথাটা শুনে ফিচলে হেসে বলল,”আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এমন ঘটনাচক্রে খুব কম মানুষ জীবিত ফিরে আসে। আমি আগামীর কথা ভেবে আমার মত প্রকাশ করলাম।”
ইচ্ছে তখন ওদের সামনে এসে কান্নারত কন্ঠে বলল,”প্রত্তুয় আম্মু যাব। আমাল আব্বু আম্মু কই? আমি আমাল বাছায় যাব।” প্রত্যয় ইচ্ছেকে কোলে তুলে কথাটা এড়িয়ে বলল,”প্রিয়মের তোমাকে আবার প্যারা বলেছে। ওকে বকবে না তুমি?” ইচ্ছে রেগে শাহাদাৎ আঙুল তুলে নাক ফুলিয়ে বলল,”প্রিউুম পঁচা! প্রিউুম খুব খালাপ প্যালা।” ইচ্ছের কথা শুনে সায়ন আর প্রত্যয় হাসল। তারপর তিনজনে মিলে গল্পে মেতে উঠল। একটুপরে, সায়ন উঠে প্রত্যয়কে একটা রুম দেখিয়ে দিল। কালকে বেশ কিছু কাজ সেরে প্রত্যয় ঢাকায় ফিরবে। এর মধ্যে ইচ্ছের আব্বু আম্মুর খোঁজ পেলে খুব ভাল হতো।
রাত সাড়ে দশটার দিকে প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে ইচ্ছেকে নিয়ে খেয়ে নিল। গল্প শুনতে শুনতে ইচ্ছে ঘুমিয়ে গেছে। প্রত্যয় উঠে সায়নের থেকে ফাস্ট এইডের বক্স আনল। তারপর সতর্কতার ইচ্ছের ব্যান্ডেজ বদলে লাগল। মেডিসিন লাগানোর সাথে সাথে ইচ্ছে কেঁদে উঠে আবার ঘুমিয়ে গেল। প্রত্যয় স্বযত্নে ইচ্ছে হাতে পায়ে নতুন ব্যান্ডেজ করে দিল। ইচ্ছের দুই পাশে কোলবালিশ দিয়ে প্রত্যয় রুমের দরজার আঁটকে প্রিয়মকে ফোন দিল। আর মৃদু স্বরে পুরো ঘটনা প্রিয়মকে জানাল। প্রিয়ম সবটা শুনে হতবাক। ইচ্ছের সঙ্গে এতো খারাপ কিছু ঘটবে, সে কল্পনাও করেনি। প্রত্যয় প্রিয়ম দু’জনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাল। কারন এখানে ইচ্ছের সঙ্গে আরো খারাপ কিছু ঘটতে পরত। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে প্রিয়মকে টেনশন করে নিষেধ করে প্রত্যয় কল কাটল। আর ইচ্ছের কয়েকটা ছবি তুলে প্রিয়মকে পাঠিয়ে দিল। মায়াভরা মুখে ছোট্ট ফুলটার দিকে প্রিয়ম তাকিয়ে রইল। প্রিয়মের কানে ইচ্ছের বলা কথাগুলো বাজছে। মনে হচ্ছে, ইচ্ছে এখুনি রেগে ওকে বলবে,’প্রিউুম তুমি মেলা খালাপ প্যালা, প্রিউুম কানাচুর দাও!’
প্রত্যয় ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে তুয়াকে ফোন দিল। ওর ফোনের অপেক্ষায় যে তুয়া বসে আছে। একথা প্রত্যয়ের অজানা নয়। তুয়া তখন আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিল। প্রত্যয়ের কল পেয়ে সে দ্রুত রিসিভ করে বলল,”স্বামী এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়ল? কেউ আপনার অপেক্ষায় আছে , কথাটা কি ভুলে গিয়েছেন?” প্রত্যয় মৃদু হেসে বলল,”জ্বি না ম্যাম ভুলিনি। তা আপনি কি রাতে খেয়েছেন?” তুয়া আহ্লাদি কন্ঠে হেসে বলল,”হুম, ডক্টর সাহেব আমি প্রত্যয় রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। এখন রোগ মুক্তির জন্য কি করা যায় বলুন তো?” প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, এই রোগের চিকিৎসা নেই। আমি চাই! আপনি সারাজীবন এই রোগে আক্রান্ত থাকুন।” তুয়া এবার আহ্লাদী সুরে বলল,”
যথাশীঘ্রই ফিরে এসো রে। আমার তুমিটাকে ছাড়া ভাল লাগছেনা।” কথাটা শুনে প্রত্যয় মৃদু হাসল। তারপর দু’জনে আর কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটল।
প্রত্যয় অতি যত্নে ইচ্ছের কপালে আদর দিয়ে পাশে শুয়ে পড়ল। সারারাত ইচ্ছে প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে ঘুমিয়েছে। কিন্তু প্রত্যয় দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না। পরেরদিন সকালে জানা গেল, মাহিম কিডনি নয় মানুষের চোখ পাচার করে। বিভিন্ন হসপিটালে সঙ্গে ওর যোগাযোগ আছে। সে টাকা বিনিময়ে সুস্থ মানুষকে মেরে অসুস্থ মানুষের চোখ সংগ্রহ করে দেয়। অদ্ভুদ! এই পৃথিবীর অদ্ভুত মানুষের চিন্তাধারা এবং তাদের কার্যক্রম।
পরেরদিন সকালে, প্রিয়ম প্রত্যয়কে ফোন দিয়ে বলল,”ভাইয়া আর কোনো খবর পেলে? ইচ্ছে এখন কেমন আছে?” প্রত্যয় থমথম গলায় বলল,”যা চায়নি তাই ই হল।” প্রিয়ম নিশ্চুপ হয়ে কল কেটে দিল। সায়ন আবারও প্রত্যয়কে একই প্রস্তাব দিল। প্রত্যয় থমথমে কন্ঠে বলল, “আমার চাওয়া ইচ্ছের ভাল থাকা।” কথাটা শুনে সায়ন বাঁকা হেসে বলল, “বলতে চাচ্ছেন, ইচ্ছে আপনার কাছেই ভাল থাকবে?” প্রত্যয়ের ইচ্ছের চুল গুলো ঠিক করে বলল,”মুখে তো অনেক কিছুই বলা যায়। কিছুদিন পর নিজে নাহয় দেখে আসবেন।”
ওইদিকে ইচ্ছের আব্বু আম্মুর লাশ মর্গ থেকে
পোষ্ট মরটার্মের জন্য পাঠানো হয়েছে। মাহিম পুলিশ আসার খবর পেয়ে মাঝ নদীতে ইচ্ছের আব্বু আম্মুর অসাড় শরীর ফেলে দেয়। এক পর্যায়ে অক্সিজেন না পেয়ে উনারা মারা যায়। আর পানি থেকে পুলিশ উনাদের লাশ উদ্ধার করে। ইচ্ছে বার বার আব্বু আম্মুর কাছে যাওয়া আবদার করছে। অবুজ মেয়েটা বুঝতেও পারছেনা। সে কত মূল্যবান কিছু হারাল। ওর সবচেয়ে আপন ছায়া ওকে ছেড়ে চলে গেল। প্রত্যয় শক্ত হয়ে সবটা সামলাচ্ছে। লাশ ঢাকায় পাঠানো নিয়ে ওকে কম কাঠ খড় পুড়াতে হচ্ছে না। এই নিয়ে পুলিশ খুব ঝামেলা করছে।
প্রত্যয় প্রিয়মকে রনিতের বাসায় গিয়ে ওর নাম্বার মেনেজ করতে বলল। তারপর রনিতকে ফোন করে ইচ্ছের নানুর বাসার ঠিকানা চাইল। রনিত জানাল, ইচ্ছের নানা নানু অনেক আগে মারা গেছে। আর ইচ্ছের মামা দেশের বাইরে থাকে। সেই সাথে প্রত্যয় রনিতকে সংক্ষেপে সবটা জানাল। রনিত অশ্রু ঝরিয়ে বলল,”ই ইচ্ছা স সোনা ক ক কই?” প্রত্যয় জানাল ইচ্ছে ওর কাছে আছে। এবং নিরাপদে আছে।তারপর সব ঝামেলা কাটিয়ে বিকেলে প্রত্যয় ইচ্ছেকে নিয়ে বেড়ি হল। আর সায়নকে বলে দিল, তুয়াদের বাসার ঠিকানায় লাশ দু’টো পাঠাতে। সায়ন ইচ্ছেকে আদর করে ওদের বিদায় জানাল। এয়ারপোর্টে যেতে ওরা সিএনজিতে উঠে বসল।
ইচ্ছে প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে বসে আছে। প্রত্যয় প্রিয়মকে একটা মেসেজ করল। প্রিয়ম প্রত্যয়ের মেসেজ পেয়ে কাজে লেগে গেল। ইচ্ছে বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখছে। আর হাজারও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে প্রত্যয়ের দিকে। যেমন: আকাশে পাখি উড়ে কেন? বুনো ফুলগুলো কি কেউ চুরি করে? সিএনজি উড়ে যেতে পারেনা কেন? রাস্তায় এতো মানুষ কেন? ইচ্ছের প্রশ্নের একটা উত্তরও প্রত্যয়ের জানা নেই। তবুও কিছু একটা বলে ইচ্ছেকে বুঝ দিচ্ছে। সিএনজি ওয়ালা ইচ্ছের কথা শুনে হাসলেন। একটুপরে,
প্রত্যয় মুচকি হেসে আদুরে সুরে বলল,”ইচ্ছে এবার থেকে আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব, মজা করব, ঘুরব। জানো, প্রিয়ম, চাঁদ, তুয়া, তোমাকে কত্ত মিস করে?” ইচ্ছে একটা চিপস মুখে পুরে বলল,”না! আমি আব্বুল কাছে থাকব। আমি আব্বু আম্মুকে মিচ করচি।” কথাটা শুনে প্রত্যয়ের হাসিটা মলিন হয়ে গেল। ইচ্ছেকে সামলাবে কি করে একটা নিয়ে প্রত্যয় খুব চিন্তিত। সে তো মৃত্যুর মানে বোঝে না। ইচ্ছে বুঝবেও না এই কঠির সত্যের মানে। ওইদিকে, সায়ন মর্গের কাজ সেরে লাশ দু’টো এ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিল। আর প্রত্যয়কে মেসেজ করে জানিয়ে দিল। প্রত্যয় ফ্ল্যাইটের মাধ্যমে ইচ্ছেকে নিয়ে ঢাকার পৌঁছে গেল। সরাসরি বাসায় গিয়ে ওদের আগের ফ্ল্যাটে উঠল। ইচ্ছে প্রত্যয়ের গলা ধরে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল।
পরেরদিন তুয়া চাঁদ একসঙ্গে রাস্তায় হাঁটছে। চাঁদ স্কুলে আর তুয়া যাচ্ছে কলেজে। রিকশা পাচ্ছে না তাই দু’জনে হাঁটছে। চাঁদের চোখ মুখ এখনও ফুলে আছে। তুয়া চাঁদের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,” প্রত্যয়ের সূত্র ধরেই ওর বাসায় পা দিয়েছিলাম। সাথে ওয়াদা করেছিলাম সংসারের সবাইকে ভাল রাখব। কিন্তু একটা মানুষ সবাইকে সবদিক থেকে ভাল রাখতে পারেনা। আমিও পারিনি! আমি কখনও চাইনি, আমার জন্য আমার সংসারের কেউ কষ্ট পাক। আর এটাও সত্যি, তোমাকে জা হিসেবে নয়! তোমাকে আমি বোন হিসেবে মনে করি এবং ভালও বাসি। এজন্য বলছি, যদি তোমার সঙ্গে কোনো অন্যায় করে থাকি। তাহলে আমাকে দু’টো থাপ্পড় দিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দিও। তবুও মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখ না। সংসারে অশান্তি হলে আব্বু আম্মু কষ্ট পাবে। লোকে প্রত্যয় প্রিয়মের দিকে আঙ্গুল তুলবে।” চাঁদ অবাক হয়ে তুয়ার দিকে তাকাল। তুয়া কখনও ওর সাথে এমনভাবে কথা বলেনি। তবে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে চুপ রইল। তুয়া ওর কন্ঠস্বরকে গম্ভীর করে বলল,” আর হ্যাঁ, প্রত্যয় ছাড়া আমার কারো প্রতি না আসক্ত ছিল, আর না আছে। এমন কাজ কখনও করব না যাতে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক নষ্ট হয়। অন্যের প্রতি আসক্তি হওয়ার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়।”
শেষ বলা কথাতে চাঁদের কাছে সবটা স্পষ্ট হয়ে গেল। চাঁদ মাথা নিচু করে নিল। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ অবধি এসে গেছে। পাশেই চাঁদের স্কুল। তুয়া চাঁদকে সাবধানে যেতে বলে নিজে কলেজে ঢুকে গেল। চাঁদ ছলছল চোখে তাকিয়ে স্কুলের পেছনে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসল। ওর চোখের পানি ঝরঝর করে ঝরে ঘাসের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। তুয়ার কথার মানে চাঁদের বুঝতে বাকি নেই। তুয়া যে কষ্ট পেয়েছে কথা মাধ্যমে সেটা বোঝা গেল। চাঁদের নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। চাঁদ চোখ মুছে টলটলে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে রইল। জীবনটা সরল রেখার মতো হলে বেশ হতো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। কারন জীবন চলে তার সমীকরণে। যে সমীকরণের সমাধান মিলানো আমাদের সাধ্যের বাইরে।
আজকাল প্রিয়মের অবহেলা চাঁদ সহ্য করতে পারেনা। প্রিয়ম তো বলেছিল, সে নতুন করে শুরু করবে৷ কিন্তু সে ব্যর্থ! চোখের সামনে তুয়াকে প্রতিনিয়ত দেখে ওর মনটা এখনও তুয়াতেই সীমাবদ্ধ। মনের উপর কারো হাত থাকেনা। তেমনি প্রিয়মেরও নেই। আজকাল তুয়ার প্রতি চাঁদের বড্ড হিংসে হয়। মনে হয় তুয়ারই সব দোষ। তুয়ার জন্যই প্রিয়ম ওকে অবহেলা করছে। প্রত্যয় প্রিয়ম দু’জনেই তুয়ার ভালবাসে, কিন্তু কেন? চাঁদ কোনদিক থেকে কম? কেন প্রিয়ম ওকে ভালবাসে না? তুয়ার থেকে সেও তো কম সুন্দর নয়! তাহলে কেন প্রিয়ম এমন করে? চাঁদের মস্তিষ্কের এমন আরো প্রশ্ন এসে ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ চাঁদের মনটা বড্ড বিষন্ন। তাই সে চুপ করে পুকুর পাড়ে বসে রইল।
আর একসপ্তাহ পর তুয়ার এইচএসসি পরীক্ষা। কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে পড়তে বসেছে। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে পড়তে দেখে চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে প্রিয়ম হন্তদন্ত হয়ে এসে তুয়ার রুমের দরজা নক করল। তুয়া প্রিয়ম দেখে ভ্রু কুঁচকে নিল। প্রিয়ম দরজাতে দাঁড়িয়েই তুয়াকে বলল,”বের হও! শীঘ্রই চল।” তুয়া ভ্রু কুঁচকে করল,”কোথায় যাব? আমি এখন কোথাও যাব না।” তুয়ার এমন ব্যবহারে প্রিয়মে বেশ অবাক হল। তখন প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু এসে তুয়াকে তাড়া দিলেন। অগত্যা তুয়াসহ সবাই একসঙ্গে বের হল। গাড়িতে বসে একটু এগোতে ওরা চাঁদকে আসতে দেখল। মাঝরাস্তা থেকে চাঁদকে ওদের সঙ্গে নিল। তুরাগদের বাসাতে এসে গাড়ি থামল। তুয়ার মনে একটা ভয় কাজ করছে। সে দৌড়ে সিঁড়ির কাছে পা রাখবে তখন ওর আব্বু, আম্মু, তুরাগ এবং তিন্নিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সবার চোখে পানি। বাগানের দিকে পাশাপাশি দু’টো কাফন পরা লাশ দেখে তুয়া জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকাল। কয়েক পা এগিয়ে লাশ দু’টো দেখে ওর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। হঠাৎ ইচ্ছে কথা মনে করে তুয়া আঁতকে উঠল। পিছনে ফিরে কিছু বলার আগে প্রত্যয়ের কোলে ইচ্ছেকে দেখে চুপ হয়ে গেল। পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে থমথমে অবস্থা। জানাযার জন্য ফ্ল্যাটে সবাই এবং আরো মানুষ জমায়েত হয়েছে। ইচ্ছে উপস্থিত সবাইকে দেখছে। হঠাৎ ইচ্ছে প্রত্যয়ের কোল থেকে নেমে ওর আব্বু লাশের কাছে গিয়ে বলল,”আব্বু কোলে যাব। আম্মু তোমলা এমন জামা পললে কেনু? তোমলা ঘুমাচ্ছ? ইচ্ছের কথা শুনে প্রিয়ম গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিল। ইচ্ছে চোখ বড় বড় আগ্রহ নিয়ে ওর আব্বু আম্মুকে দেখছে। ওর আব্বু আম্মু এমন সেজেছে কেন? এতো মানুষ ওর আব্বু আম্মুকে দেখছে কেন? ইচ্ছে প্রিয়মের কোলে থাকবেনা। সে ওর আব্বুর কোলে যাবে। ইচ্ছে প্রিয়মের কোলে থেকে ছোটাছুটি করতে লাগল। কয়েকজন লোক এসে খাটিয়া কাঁধে তুলে নিলেন। ইচ্ছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে,”আম্মু! আম্মু! আমাল দুঃখু হচ্ছে! আমি তোমাল কোলে যাব। আব্বু! আব্বু আমি ডাকছি। তোমাকে ডাকছি! আব্বু! বাবা! বাবা! প্রিউুম! প্রিউুম আমাকে ছালো! আমি আব্বু যাব।”
ছোট্ট ইচ্ছের আত্মানার্দে সবার চোখ ভিজে গেল। প্রত্যয় সবাইকে এগোতে বলে ইচ্ছেকে কোলে নিল। ইচ্ছের কান্না দেখে প্রত্যয় প্রিয়মের চোখে অশ্রু ঝরছে। ইচ্ছে ওর হাত বাড়িয়ে ওর আব্বু আম্মুকে ডেকে যাচ্ছে। সব পুরুষরা একে একে কবরস্থানের গিয়ে হাঁটা ধরল। ইচ্ছেকে সামলানো যাচ্ছে না। প্রিয়ম ইচ্ছের আত্মনার্দ সহ্য করতে না পেরে চোখ মুছতে মুছতে কবরস্থানের দিকে হাঁটা ধরল। ইচ্ছের আব্বু আম্মুর জানাযাতে অসংখ্য মানুষ হয়েছে। প্রত্যয় জানাযাতে শরীক হবে কিন্তু ইচ্ছের জন্য যেতে পারছেনা। ওর বুকে সাথে লেপ্টে গিয়ে ইচ্ছে আব্বু! আম্মু! বলে চিৎকার করে কাঁদছে। চাদঁ তুয়াসহ মহিলারাও খুব কাঁদছে। ইচ্ছেরা এখানে ছিল। তাদের সঙ্গে সবার চেনাজানা আছে। ইচ্ছে প্রত্যয়ের হাত থেকে নিজেকে ছুটিয়ে দৌড় দিল। ওর আব্বু আম্মুকে যেদিকে নিয়ে গেছে সেও ওই পথে দৌড় দিল। তখন তুরাগ দৌড়ে গিয়ে ইচ্ছেকে ধরে নিল। ইচ্ছে তুরাগকে কিল, ঘুষি, খামচি, কামড় দিয়েও নিজেকে ছুটাতে পারল না। তুরাগ শক্ত করে ইচ্ছেকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখল। আর প্রত্যয় এসে ইচ্ছের বাহুতে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করল। তারপর ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ইচ্ছের চোখে ঘুম নেমে এলো। প্রত্যয় ইচ্ছেকে কোলে নিল তখন ইচ্ছে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,”প্রত্তুয়! আব্বু যাব! আমালে আম্মুল কাচে নিয়ে চল। আমি আম্মুর কোলে ঘুমাব।”
এই কথা বলতে বলতে ইচ্ছে ঘুমিয়ে গেল। প্রত্যয় ইচ্ছের চোখ মুছে বিছানায় শুইয়ে দিল। তুয়াকে ইচ্ছের খেয়াল রাখতে বলে প্রত্যয় অযু করে বেরিয়ে গেল। প্রত্যয় কবরস্থানে উপস্থিত হলে জানাযা শুরু হল। জানাযা শেষে ইচ্ছের আব্বু আম্মুর দাফন কাজ সম্পূর্ন হল।
চাঁদ কারো থেকে মাহিমের নাম শুনে ঘৃণা নিয়ে মনে মনে বলল,” তুই আসলেই জানোয়ার মাহিম। প্রতিনিয়ত এতো মানুষ মরে তুই মরতে পারিস না। তোর মরণ হয় না কেন? মাসুম বাচ্চাটার চোখের পানি মূল্য তোকে দিতেই হবে, মিলিয়ে নিস।”
চলবে।