সূর্য ডোবার আগে পর্ব-৩৫

0
727

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-৩৫
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।

রাজারহাটের নামকরা বেসরকারি হাসপাতালের সাততলার প্রাইভেট কেবিন। সুবিশাল জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের ইকো পার্কার আবছা জলরাশি।পশ্চিমের আকাশে সূর্য ডুবি ডুবি প্রায়, অস্তরাগ মিলিয়ে গেছে কার্তিক মাসের ঝাপসা ধোঁয়া মেঘের আড়ালে। ঝুপ করে সন্ধ্যা নামবে এবার। নীল সাদা চাদরে ঢাকা অ্যাডজাস্টেবল নার্সিংকেয়ার বেডে শুয়ে থাকা তিন্নির রুগ্ন শুষ্ক কপালের ওপর এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা উস্কোখুস্কো চুলে খেলা করে যাচ্ছে মেজর অভিমন্যু সেনের কড়াপড়া শক্ত হাতের আঙুলগুলি।
জলপাই রঙা টি শার্ট আর মেটেরঙা ট্রাউসার্স, টিশার্টের ওপর দিয়ে হাতের প্রতিটি পেশী ফুটে আছে, জায়গায় জায়গায় কিছু নতুন, কিছু পুরোনো আঘাতের চিন্হ। গায়ের রং আর একটু তামাটে হয়েছে, চোখের কোনে রাতজাগার ক্লান্তি স্পষ্ট। তবুও মানুষটির ইস্পাতকঠিন নার্ভ আর চুড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের ছাপ রুক্ষ কঠিন মুখটায় স্পষ্ট। দেখে দেখেও আশ মিটছে না তিন্নির। আরও দেখতে চায়, যেন শুষে নিতে চায় প্রতিটি মুহুর্তের ভগ্নাংশ।অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে মনের মধ্যে কিন্তু সেগুলো গুছিয়ে বলার মতো মনের জোর আর অবশিষ্ট নেই তিন্নির। অভিমন্যু বেঁচে আছে, ওর সামনে সশরীরে বসে আছে – আপাতত এই পাওয়াটুকু নিয়েই বেঁচে থাকতে চায় তিন্নি।
পরম শান্তিতে ভারী চোখের পাতা একপলকের জন্য বুজিয়ে নিতে নিতে তিন্নির ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো আবছা একটা হাসি।
— তুমি এলে তাহলে?
উত্তরদাতার গম্ভীর মুখখানি চাপা হাসিতে ভরে। রাশভারী স্বর বলে উঠলো
— হুমম! না এসে যে আর উপায় ছিল না।

সকালে কিছুক্ষনের জন্য জ্ঞান ফিরে এসেই আবার গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলো তিন্নি। ডাক্তার বলেছিলেন এটাই স্বাভাবিক, এতটা মানসিক ধকলের পর তিন্নির শরীর এখন খুবই ক্লান্ত, প্রপার রেস্ট চাই ওর। তবে কোমা থেকে ফিরেই এসেছে তিন্নি। কড়া সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল ওকে। ডাক্তারের চেকআপ করার ঘন্টাখানেক সময়টুকু ছাড়া তিন্নির বিছানার পাশ থেকে নড়ে নি অভিমন্যু, খাওয়াদাওয়াও ওখানেই সেরেছে। একমুহূর্ত যেন তিন্নিকে চোখের আড়াল করবে না ও। আয়ারা বলে বলে হয়রান!
একটু আগে ধীরে ধীরে তিন্নির ঘুম ভাঙছে দেখে ওর হাতে লাগানো স্যালাইন চ্যানেল অফ করে দিয়ে আর নাকের অক্সিজেন নল খুলে দিয়ে আটেন্ডিং সিনিয়র ডাক্তারকে ডেকে আনতে গেছেন নার্স, কেবিনে এখন একলা অভিমন্যু আর তিন্নি। দূরের ডিজিটাল ঘড়িতে চোখ পড়লো তিন্নির, সময় দেখাচ্ছে পাঁচটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। এটা ভোরবেলা নাকি বিকেলবেলা তিন্নি ঠিক বুঝতে পারলো না! ধীরগতির শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে থেমে থেমে ঘুমজড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলো
— কবে এলে? ….. মানে আমি কতদিন এভাবে … ?

প্রশ্নটা শেষ করলো না তিন্নি, অভিমন্যু অভিব্যক্তিহীন মুখ গম্ভীরগলায় বললো
— তিনবছর, সাতমাস, আঠারোদিন।

— কি-ই-ই?
ঘুমের চটকা ভেঙে গিয়ে তিন্নির খোলা মুখ আর বন্ধ হলো না, চোখ বড়ো বড়ো হয়েই রইলো দেখে হো হো করে হেসে উঠলো অভিমন্যু! তারপর বললো
— রিলাক্স সীমন্তিনী! আমি আজ সকালেই এসেছি। এখন ফ্রাইডে ইভনিং, তুমি মঙ্গলবার রাতে অ্যাডমিট হয়েছো এখানে!

এতো শারীরিক কষ্টেও খুব খুব রাগ হলো তিন্নির! এই সিচ্যুয়েশনেও কেউ এমন বিতিকিচ্ছিরি ইয়ার্কি মারতে পারে? নেহাৎ নড়ার শক্তি নেই তাই মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। চট করে ওর কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে অভিমন্যু বললো
— এরপর সবাই এসে গেলে আর দিতে পারবো না কিন্তু!

না চাইতেও লাল হয়ে গেল তিন্নির গাল, লুকিয়ে থাকা মনব্যাঙাচি অনেকদিন পর মনের ভেতর তিড়িংবিড়িং নেচে নিল একপাক ঘুরে। মুখে কিছু বলার আগেই অভিমন্যু সরে বসেছে নিজের জায়গায় আর বাইরে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ। ঝড়ের গতিতে শুভ আর দু তিনজন ডাক্তার, পেছন পেছন ফোঁপাতে ফোঁপাতে ভাস্বতীদেবী ঢুকলেন কেবিনে। অভিমন্যু উঠে জায়গা করে দিচ্ছিলো, শক্ত হাতে তিন্নি চেপে ধরলো ওর হাত। তিন্নির দিকে একবার অবাক হয়ে তাকিয়ে বাধ্য হয়ে আবার আগের জায়গাতেই বসে পড়লো অভিমন্যু!
ওদিকে কেবিন ঢুকেই ভাস্বতীদেবী প্রায় ঝাপিয়ে পড়েছেন মেয়ের গায়ে। তিন্নির মাথায়, কপালে, গায়ে হাত বুলিয়ে, চুমু দিয়ে দিয়ে অস্থির করে দিলেন মেয়েকে, আর অভিমন্যুর হাত ধরে রাখা তিন্নির ঠান্ডা দুর্বল বামহাতটি আড়ষ্ঠকাঠ হয়ে উঠেছে যেন। তিন্নির থেকে এমন একটা প্রতিক্রিয়ায় অভিমন্যু একটু অবাক হলেও মুখে কিছু বললো না, নিশ্চল বসে রইলো।

প্রাথমিক আবেগের প্রবাহ একটু কম হলে থেকে সবাইকে বার করে দিলেন ডাক্তার। ওনাদের এখন তিন্নিকে চেকআপের প্রয়োজন। ভাস্বতীদেবী আর শুভ গেলে অভিমন্যুও উঠে দাঁড়ালো, তিন্নির হাতে আলতো একটা চাপ দিয়ে বেরিয়ে যেতে বুকের পাঁজর থেকে বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তিন্নির! তারপরই ওর মাথায় স্ট্রাইক করলো — আচ্ছা! মা, শুভ কেউ অভিমন্যুকে দেখেও কোনো রিঅ্যাকশন দিলো না কেন? অভিমন্যু কি অলরেডি সবার সাথে পরিচয় করে নিয়েছে?

নিশ্চয়ই করেছে! কিন্তু তার রেসাল্ট কি হলো? ? হাঁকুপাঁকু করে জিজ্ঞাসাগুলো গলার কাছে ছটপট করছিল বেরোনোর জন্য, বুকের ভেতরটা আবার দুরদুর করে উঠলো তিন্নির, মনিটরে ধরা পরে গেলো দুরন্ত গতিতে চলা হৃৎস্পন্দন।
— চুপচাপ শান্ত হয়ে শুয়ে থাকুন! নয়তো আপনার হাজব্যান্ডকে আর এই রুমে আ্যলাও করা হবে না।

পাশে রিডিং নিতে ব্যস্ত থাকা নার্সের কড়া ধমকে তিন্নি চুপসে গেলো।

হাজব্যান্ড!?
এই সেরেছে! এরা আবার ভুল করে অভিমন্যুকে তিন্নির হাজব্যান্ড ভেবেছে নাকি?!
বয়স্ক নার্সদিদির ভুল শোধরাতে গিয়েও মুখ টিপে নিলো তিন্নি। আচমকা মনে হলো “হাজব্যান্ড” শব্দটার মধ্যে কেমন একটা প্রভুত্ব মেশানো কন্ট্রোলিংয়ের গন্ধ আছে না? মুখের ভেতরটা কেমন জানি তেঁতো হয়ে উঠলো তিন্নির, সিডেটিভের কড়া ওষুধের প্রভাবেই হয়তো।

**************************__****************************

ঘন্টাপাঁচেক আগের কথা!
নার্সিংহোমের রিসেপশনে রুগীর আত্মীয়দের বসার জায়গায় একটি নিরিবিলি কোণায় চুপ করে বসেছিলেন ভাস্বতীদেবী, রঞ্জনবাবু। ভাস্বতীদেবীর মুখে আশঙ্কা মিশ্রিত চিন্তার ভ্রুকটি।

হিসেবে মিলছে না, কিচ্ছু হিসেবে মিলছে না। তিন্নির বোধবুদ্ধির ওপর কোনোদিনই তেমন ভরসা ছিল না ভাস্বতীদেবীর। মেয়েটা একই সাথে বোকা -সরল ওদিকে মেধাবী আর জেদি। এমন ভয়ানক চারিত্রিক কম্বিনেশনে মেয়ে যে ঠিক কাকে পছন্দ করে মন দেওয়া নেওয়া করেছে সেই ভয়েতেই সাততাড়াতাড়ি তিন্নির বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেছিলেন ভাস্বতীদেবী। মনে মনে ভেবেছিলেন মাসকয়েক আগে বেড়াতে গিয়ে সায়ক নামের ছেলেটার সাথেই তলায় তলায় প্রেম চালাচ্ছে তিন্নি ! সেই ধারণার চুরমার হয়ে গেলো সায়ক যখন শুভকে গায়ে পড়ে মেসেজে করে তিন্নি সম্বন্ধে অশ্লীলতায় ভরপুর একগাদা কালিমাখানো গালগল্প জানিয়েছিল। নিজের মেয়ের সম্বন্ধে অপমানকর নোংরা মন্তব্যগুলো পড়ে ক্রোধে হিতাহিতজ্ঞানশুন্য হয়ে গেলেও পরে ওঁনারও মনে হচ্ছিলো তিন্নির নামে এই কথাগুলো একটু আজগুবিও বটে। ওঁনার ভীরু ভীরু সাধাসিধে মেয়ের এতো সাহস নেই যে এমন বিপদজ্জনক প্রেম করবে, তাও আবার ওঁনারই নাকের তলায়। কিন্তু তাও……

যা রটে তার কিছু তো বটে।
আজ আবার এই ছেলেটিকে দেখে ওঁনার মন বলছে হয়তো সায়ক যা যা বলেছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হলেও প্রায় সবটাই সত্যি। হ্যাঁ! প্রেমে পড়ার মতো চেহারা বটে ছেলেটার, তার সাথে তেমনি ব্যক্তিত্ব। বয়সে তিন্নির থেকে চার পাঁচ বছর বড়ই হবে হয়তো। লম্বা সটান চেহারা, মুখ চোখ দিয়ে আগুনে ব্যক্তিত্ব আর আত্মবিশ্বাসের ছটা যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। যদিও, কথা বলার ধরণ একটু রূঢ় আর চাঁচাছোলা, কেমন কর্তৃত্বপূর্ণ ব্যবহার – যেন কথা বলছে না, অর্ডার করছে। আজ সকালেই নাকি সে ফিরেছে কোন সুদুরের পোস্টিং থেকে, আবার আসার আগেই তিন্নিকে প্রাইভেট কেবিনে শিফ্ট করিয়ে দিয়েছে, নার্সিংহোমে পা রাখার পর থেকে নিজেই ডাক্তারের সাথে কথা বলছে, ছোটাছুটি করছে। অন্যদিকে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়ে ভাস্বতীদেবী একইসাথে লজ্জিত এবং বিস্মিত হয়েছিলেন যখন প্রত্যক্ষ্য করলেন তিন্নির মেডিকেল হিস্ট্রি নিয়ে অপরিচিত এই ছেলেটি ওঁনাদের থেকেও বেশি জানে, তারই সাথে সাথে তিন্নির সকল পছন্দ/অপছন্দ ছেলেটির ঠোঁটস্থ। তারপর তো আবার ছেলেটি তিন্নির সাথে ঘণ্টাকয়েক কাটানোর পরই তিন্নির জ্ঞানও ফিরে এলো!
তিনদিন পর তিন্নির জ্ঞান ফিরে আসতে অবশ্যই খুশি হয়েছিলেন ওঁনারা সবাই, তারই সাথে বুকের ভেতরটাও কি হালকা চিনচিন করে ওঠে নি… কে এই অপরিচিত ব্যক্তি যার কাছে ওঁনারা – মা বাবা ভাই সবাই তুচ্ছ! এতদিন তো কম চেষ্টা করেননি তিন্নিকে সুস্থ করে তোলার কিন্তু যা ওঁনারা তিনদিনে করতে পারলেন না, ছেলেটি মাত্র চার পাঁচঘন্টায় সেই অসাধ্যসাধন করে ফেললো? মেয়ের জীবনে কি তবে ওঁনাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে এসেছে?

দীর্ঘশ্বাসটি গোপন করে নিলেন ভাস্বতীদেবী।

শুভ লাফাতে লাফাতে আসছিলো অভিমন্যুকে সাথে নিয়ে, নার্সিংহোমের “স্ট্রীক্টল্যী সাইলেন্স” ডেক্যোরাম ভুলে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠেছিল প্রায়
—- মাআ! এই হলো অভিমন্যুদা! কাল রাতে যে ফোন করেছিলো, দিদিকে কেবিনে শিফ্ট করিয়ে দিল…..

— শুভ, তুমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসবে? তোমার মা বাবার সাথে আমার কিছু কথা আছে!

শান্ত পরিমিত প্রশ্নটিতে অনুরোধের বদলে আদেশের সুর স্পষ্ট। থমকে গিয়ে কথা না বাড়িয়ে শুভ চলে গেল। রিসেপশনে রুগীর আত্মীয়দের বসার জায়গায় এখন কেবল ভাস্বতীদেবী, রঞ্জনবাবু এবং অভিমন্যু!

খরচোখে অভিমন্যুকে মেপে যাচ্ছিলেন ভাস্বতীদেবী। তারপর মুখ খুললেন
— তুমিই কি সেই? আর্মির সেই লোক যার কথা …এই বলো না, তিন্নির অফিসের সেই ছেলেটা…. !
ভাস্বতীদেবী ঠ্যালা দিলেন রঞ্জনবাবুকে।

অভিমন্যু আর রঞ্জনবাবু একসাথে বলে উঠলেন — সায়ক?!

তিন্নির জীবনের অপরিহার্য্য দুই প্রধান পুরুষ একে অপরের দিকে হালকা মাথা নাড়লেন, পরিচয়টা এমন ভাবে হবে বোধহয় দুজনের কেউই তা ভাবতে পারে নি।

ভাস্বতীদেবী ফিরে গেছিলেন নিজের কথায়।
— হ্যাঁ! সায়ক! তোমার কথাই তবে সায়ক জানিয়েছিলো শুভকে! কি সম্পর্ক তোমার আর তিন্নির? তুমি নাকি তিন্নিকে ফলো করছিলে আরো কতসব নোংরা নোংরা কথা…

— আহ্! চুপ করো না!
রঞ্জনবাবুর ধমক খেয়ে ভাস্বতীদেবী চুপ করে গেলেন, ওদিকে চোয়াল শক্ত উঠলো অভিমন্যুর তাও গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললো

— অবশ্যই অনুমান করতে পারছেন তার অধিকাংশই মিথ্যেকথা এবং অতিরন্জিত? সীমন্তিনীর চরিত্রে কালি ছেটানোই সায়কের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল!

— এমন কেন করবে ছেলেটা? তিন্নি নিশ্চয়ই কিছু বলেছিল ওকে? আর তোমার সাথেই বা তিন্নির কি সম্পর্ক?

এতগুলো প্রশ্নের ভিড়ে অভিমন্যু থমকে গেল! ঠিক কি বলা যায় বুঝতে পারলো না! কি নাম ওদের সম্পর্কের?

ভাস্বতীদেবী সন্দেহের চোখে তাকিয়েই রইলেন! খরখরে গলায় বললেন — তুমি কি তিন্নির বয়ফ্রেন্ড?

বছর তিরিশের মেজরকে কি বয়ফ্রেন্ড বলা যায়? অভিমন্যুর মুখে একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলো। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বললো
— সেরকমই বলতে পারেন!

— বলতে পারেন মানে? তুমি তিন্নির বয়ফ্রেন্ড? হ্যাঁ কি না সেটার স্পষ্ট জবাব দাও!

— সীমন্তিনীকে আমি ভালোবাসি, যদি একথাটাই আপনি স্পষ্ট করে জানতে চান! বাদবাকি সামাজিক সম্পর্কের সংজ্ঞা আমি মানি না।

এমন জোরালো উত্তর আশা করেননি ভাস্বতীদেবী, ভাষা হারিয়ে ফেললেন। অভিমন্যুর নিজের কানেও ওর কথাটা রূঢ় শোনালো। কি সম্বোধন করবে বুঝতে না পেরে ভাস্বতীদেবীর হাতদুটি নিজের হাতে নিয়ে সংযত নরম গলায় বললো
— মাফ করবেন। আমার হয়তো কথাটা এভাবে বলা উচিত হয় নি! আসলে আজ সকালেই কলকাতা এসে পৌঁছেছি আর তারপর থেকেই…

রঞ্জনবাবু হাল ধরলেন, মৃদুগলায় বললেন
— না ঠিক আছে, আমরা সবাই চিন্তিত। পরিবেশ আর পরিস্থিতিটাই এমন! মেয়েটা এতদিন ধরে…

তিন্নির কথা উঠতেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্নার বেগ সামাল দিলেন ভাস্বতীদেবী। কি যে হচ্ছে, কেনই বা হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ডুকরে ওঠা আবেগের ধারায় পেরিয়ে গেল বেশকিছু নীরব মুহুর্ত। তারপর অভিমন্যু নীচু গলায় আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে বললো
— আপনারা চিন্তা করবেন না। আমার উপর ছেড়ে দিন ব্যাপারটা, আমি সব সামলে নেবো। ডাক্তারের সাথেও এ বিষয়ে আমার বিশদে কথা হয়েছে।সীমন্তিনী ইজ আউট অফ ডেন্জার। আফটার এ ন্যাপ শি উইল বি আ্যবসোলিউটল্যি ফাইন।

একটু ইতস্তত করে এইবার রঞ্জনবাবু বললেন
— তোমার কথাই যেন ঠিক হয়৷ কিন্তু তুমি তিন্নিকে….., এইভাবে প্রাইভেট কেবিনে সরিয়ে দিলে…! আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার, এতোটাও তো আমাদের সামর্থ্য নেই।

— টাকাপয়সা নিয়ে ভাববেন না। সীমন্তিনী আমার দায়িত্ব, এগুলো আমার রেসপন্সিবিলিটি!

— তোমার দায়িত্ব? কেন?

রঞ্জনবাবুর প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার উত্তর।এছাড়া এ প্রশ্নের আর কোনো উপযুক্ত জবাব হয় না, এই পরিস্থিতিতে তো নয়ই। নিস্ফল অসহয়তায় অভিমন্যুর মুখের পেশী একটু হলেও শক্ত হয়ে উঠলো কি? সরাসরি উত্তর না দিয়ে মেজর বললেন

— উই অল ওয়ান্ট দ্য বেস্ট ফর হার, ডোন্ট উই?

এরপর আর কথা চলে না। একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন রঞ্জনবাবু। ভাস্বতীদেবীর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো, মুখে সেই তখন থেকেই কুলুপ আঁটা। অস্বস্তিকর নীরবতা এড়াতে অভিমন্যু গলাখাঁকড়ি দিয়ে বললো

—- আপনারা উঠেছেন কোথায়?

— রাজারহাটেই… দুর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এখান থেকে কাছেই!

— যাওয়াআসা?

— একটা গাড়ি বলে রেখেছি সবসময়ের জন্য। দেখছোই তো আমার অবস্থা…..।যাক গে! শুভর কাছে শুনলাম তুমি আজ সকালেই ফিরেছো.. কোথায় পোস্টেড ছিলে?

প্রথম আলাপের জড়তা ধীরে ধীরে কাটছে, টুকটাক আরো কিছু সাধারণ কথার পর একান্ত আন্তরিকভাবেই অভিমন্যু বললো
— কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন, সঙ্কোচ করবেন না। এখন কি আপনারা সীমন্তিনীর সাথে দেখা করবেন?

রঞ্জনবাবুও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। শান্ত স্বরে বললেন
— নাহ্ থাক। ডাক্তার তো বললো ও এখন ঘুমোবে!

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অভিমন্যু বললো
— তা ঘুমোবে। আপনারা চাইলে খাওয়াদাওয়া সেরে রেস্ট নিয়ে বিকেলে আসতে পারেন.. আমি তো রয়েইছি এখানে! সীমন্তিনীর ঘুম ভাঙলেই খবর দেবো।

রঞ্জনবাবুও তাই ভাবছিলেন। কেবিনে একজনের বেশি আ্যলাও করবে না, আর এতজনে মিলে রিশেপশনে বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না। তিন্নির কখন ঘুম ভাঙবে তাও কেউ জানে না। তার থেকে বিকেলের ভিসিটিং আওয়ার্সে আসাই শ্রেয়। আত্মীয়ের বাড়ি যতই কাছে হোক না কেন, বারবার ভাড়ার গাড়িতে হুইলচেয়ারে করে ওঁনার আসা যাওয়াও যে কষ্টকর ~ ওঁনার পক্ষে, বাকি সবার পক্ষেও। এতদিন বাধ্য ছিলেন ভাস্বতীদেবী আর শুভ একলা সামলাতে পারবে না, ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারতো না বলে। এখন তো আর সেই চিন্তা নেই। এই ছেলেটি নিজেই সব দায়িত্ব তুলে নিয়েছে নিজের চওড়া কাঁধে। এখন সেখানে ওঁনাদের অযথা হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত। তাছাড়া অভিমন্যুকে দেখে উনি আশ্বস্ত হয়েছেন। ওর কথা বলা, ব্যক্তিত্বের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আর চারিত্রিক দৃঢ়তা স্পষ্ট, উজ্জ্বল। কি যেন আছে ওর গলার স্বরে, ওর বচন ভঙ্গিমায়, যা শুনে আরো শুনতে ইচ্ছে হয়, বিশ্বাস করতে মন চায় সহজেই! স্বল্প চেনাতেই এর ওপর ভরসা করা যায়, নির্ভর করা যায়।
ভাবনার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এলেন রঞ্জনবাবু ! একটু চিন্তিত হয়ে বললেন

— কিন্তু তোমার রেস্ট?

— আমার অভ্যেস আছে!
কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না রঞ্জনবাবু। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নীরব থাকলেন বেশ কিছু সময়, তারপর বললেন
— সেই ভালো। আমরা না হয় বিকেলেই আসবো। তুমি বরং তিন্নির ঘুম ভাঙলে একটা খবর দিও।

— নিশ্চয়ই।
বলে কি ভেবে হঠাৎ, দুজনকেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ফেললেন মেজর অভিমন্যু সেন। এতক্ষনে ভাস্বতীদেবীর মৌনতা ভঙ্গ হলো। অভিমন্যুর মাথায় হাত রেখে কম্পিতসুরে বললেন
— বেঁচে থাকো বাবা! ভালো থাকো। সুখে থেকো।

বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।

কতবছর পর মাতৃস্থানীয়া কারো কাছে থেকে এমন স্নেহমিশ্রিত আশীর্বাদের ছোঁয়া পেলেন মেজর। কয়েকমুহুর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গলার মধ্যে জমতে থাকা অপরিচিত আবেগ আটকাতেই হয়তো দ্রুত পা ফেলে চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিলেন মেজর অভিমন্যু সেন।

**************************__****************************

নার্সিংহোমের সাততলার কনফারেন্স রুমে পাঁচজন স্পেশালিস্ট ডাক্তার প্যানেলের সাথে কথা বলে সদ্য বেরিয়েছেন রঞ্জনবাবু আর অভিমন্যু। তিনদিন হয়ে গেছে তিন্নির জ্ঞান ফিরেছে, এখন ও সম্পূর্ণ আশঙ্কামুক্ত এবং প্রায় সুস্থই বলা যায়! ডাক্তাররাও একমত, তিন্নি এবার বাড়ি ফিরতেই পারে। এমনকি আরো কয়েকদিন বেডরেস্ট নেওয়ার পর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এড়িয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াত করলে অফিসও জয়েনও করতে পারে। সাবধানতা বলতে শুধু দেখতে হবে আবার যেন কোনোভাবেই তিন্নির সামনে কোনো মানসিক উত্তেজনার সৃষ্টি না হয়।

বাইরে এসে অভিমন্যু সহজাত কর্তৃত্বপূর্ণ রাশভারী গলায় বললো
— ডাক্তার যা’ই বলুক আপাতত সীমন্তিনীর যা শারীরিক অবস্থা তাতে আ্যম্বুলেন্সে করে শ্রীরামপুর অবধি যাওয়ার ধকল নেওয়ার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। আগামী দিনকয়েক না হয় স্বাচ্ছন্দ্যে আমার বাড়িতেই আপনারা থাকুন, কোনো অসুবিধা হবে না। নিজের বাড়ি বলেই মনে করবেন। একান্তভাবে অনুরোধ করছি। আমি সব ব্যবস্থা করে নেবো।

এ কয়দিনে ভাস্বতীদেবী আর অভিমন্যুর সম্পর্ক একটু সাবলীল হয়েছে, তাও সব জড়তা কাটে নি। অভিমন্যুর কথাটা শুনেই আঁতকে উঠলেন ভাস্বতীদেবী।অবিবাহিতা মেয়ে আর বিয়ের আগেই রাত কাটাবে এই ছেলেটির বাড়ি? সে যতই ওদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা-বাসি হোক না কেন, সমাজ বলে তো একটা কিছু আছে নাকি! হাঁ হাঁ করে উঠলেন
— না না! সে কি করে হয়? একে তো তিন্নিকে এভাবে প্রাইভেটে কেবিনে শিফট করিয়ে দিলে, আমাদের সাথে কোনো আলোচনা না করেই…. তারপর আবার তোমার বাড়িতে? না না! সে হয় না!

— কেন হয় না?

অভিমন্যুর স্পষ্ট প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দিতে পারলেন না ভাস্বতীদেবী। জিবের ডগায় এসে গিয়েছিলো “লোকে কি বলবে”। কিন্তু সেটা বললে তার উত্তরটাও কি পাবেন বোধহয় আন্দাজ করতে পারছিলেন, তাই কথাটা ঘুরিয়ে বললেন

— তোমার মা বাবা কি বলবেন? বাড়ির লোকজন… তাঁরাও?

— আপনারা আমার বাড়িতে থাকলে কারো কোনো অসুবিধা হবে না! আমি ব্যবস্থা করে আসছি।

দৃঢ়কন্ঠে কথাগুলো বলে উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই অভিমন্যু চলে গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে, বাকি আ্যরেন্জমেন্ট সেরে ফেলতেই বোধহয়।

হাঁ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে স্বামীকে একটা ঠ্যালা মারলেন ভাস্বতীদেবী
— কি গো? তুমি কিছু বলবে না?

— আপত্তি করার মতো আমি তো কিছু খুঁজে পেলাম না।

ভাস্বতীদেবীর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠলো দেখে মৃদু হেসে রঞ্জনবাবু বললেন
— সত্যিই তিন্নির যা শারীরিক অবস্থা তাতে ঝরঝরে আ্যম্বুলেন্সে করে অতটা রাস্তা যাওয়ার ধকল অনেক। আর জানোই যখন ওরা নিজেরাই নিজেদের পছন্দ করেই নিয়েছে, তুমি আমি কেন বাধা দেব?

রঞ্জনবাবুর নির্লিপ্ততায় কেমন অবাক হয়ে গেলেন ভাস্বতীদেবী। বুঝে উঠতে পারলেন না এ কি মেয়ের ওপর অভিমান নাকি ওঁনার মনের কথা। থমকে গিয়ে বললেন
— তার মানে, তুমিও বিশ্বাস করো তিন্নি সত্যি সত্যি ওই ছেলেটার সাথে রাত কাটিয়ে এসেছে?

এবার একটু গম্ভীর হয়ে উঠলেন রঞ্জনবাবু।
— ভাস্বতী!! এসব নিয়ে আলোচনা করার সময় নয় এটা!

— কেমন বাবা তুমি? এখনো মেয়ের ওপর তোমার বিশ্বাস টললো না?

— দুদিনের আলাপে পাড়ার সম্পর্কতুতো অজেনা অচেনা কারোর হাতে মেয়েকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তুলে দেওয়ার থেকে এ অনেক ভালো ভাস্বতী! আমি সর্বান্তকরনে আশীর্বাদ করবো তিন্নি নিজের ইচ্ছেয় যাকে বেছে নিয়েছে, তার সাথেই যেন ও খুশি হয়! ছেলেটা খারাপ তো নয়! শিক্ষিত, মার্যিত, ভদ্রবাড়ির সন্তান। তিন্নিকে কতটা ভালোবাসে সে তো দেখতেই পাচ্ছো!

— কিন্তু পদবী যে সেন?

— তুমি মেয়ের পদবী নিয়ে চিন্তা করবে না কি মেয়ের খুশী নিয়ে ভাববে?

এইবার একটু তেতে উঠলেন ভাস্বতীদেবী! মনের চিন্তাটা স্পষ্ট করে না বলে ঘুরিয়ে বললেন
— যা ভালো বোঝো করো। আমার কোন কথারই তো দাম নেই তোমাদের কাছে।

— অতি অবশ্যই আছে, তবে এ ব্যপারে তিন্নির কথার দাম আরো অনেকবেশী! জীবনটা যে ওর! আর আমি নিশ্চিত, ভুল জীবনসঙ্গী ও বেছে নেয় নি!

চুপ করে গেলেন ভাস্বতীদেবী। সে কি আর উঁনি জানেন না!? তিন্নির মতো নরম মাধবীলতাকে আঁকড়ে রাখার জন্য এমন লৌহজালকই যে দরকার।
নিজেই তো দেখছেন মেয়ে যেন চোখে হারাচ্ছে এই ছেলেকে, আর সে’ও তাই। অনভ্যস্ত চোখে হয়তো নির্লজ্জতার চরম বহিঃপ্রকাশ কিন্তু একটুক্ষন সময় কাটানোর পরই এই ভালোবাসা অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হয়। তিন্নির চোখের ভাষায় ছেলেটি বুঝে যায় তিন্নি জলের গ্লাস চাইছে নাকি বাথরুমের জন্য উঠতে চাইছে। মেয়েও তেমনি! ঘরে যে’ই আসুক না কেন একমুহুর্তের জন্যও ছেলেটির হাত ছাড়ছে না। এমনকি রঞ্জনবাবুর সামনেও না! আঁকড়ে ধরে রয়েছে সর্বক্ষন, ছেলেটি এক পলকের জন্যও চোখের আড়াল হলে মেয়ের চোখে অভিমানী জল, মুখে ভীরু হরিণশাবকের ছায়া। এত ভালোবাসাও সম্ভব?
ভাস্বতীদেবীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো আর একটি দৃশ্য! গত পরশুই হবে হয়তো বা, তিন্নির কোমা থেকে ফিরে আসার পরদিন …
ভিসিটিং আওয়ার্সে নার্সিংহোমে পৌঁছে আয়ার কাছে খবর পেয়েছিলেন~ মেয়ে বেড থেকে কারোর কোনো সাহায্য ছাড়া নামতে পারছে, একটু হাঁটাচলা করছে। শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে মেয়ের কেবিনে ছুটে এসেছিলেন ভাস্বতীদেবী আর পা আটকে গিয়েছিল ওখানেই। কেবিনে গিয়ে দেখেছিলেন, বিছানা শূন্য। জানলার কাছে অভিমন্যুর চওড়া বুকে মাথা রেখে তিন্নি নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে আর অভিমন্যু একটি হাত তিন্নির মাথায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রপট স্থির। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছে না, হয়তো প্রেমের এই অপুর্ব প্রকাশে ভাষা নিষ্প্রয়োজন। মিনিটদুই তিন কেটে গেলেও ওদের কোনো খেয়াল নেই, হয়তো আশেপাশের সবকিছু ওদের কাছে নগন্য, তুচ্ছ।

বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠেছিল ভাস্বতীদেবীর। ভালোবাসার এমন প্রবল সমর্পন এবং পবিত্র গ্রহনের ছবি উনি আগে কখনো দেখেননি। নিঃশব্দ পায়ে ফিরে এসেছিলেন স্বামীর কাছে। শুধু বলেছিলেন — “তিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছে, একটু পর যাবো।”

ছবিটা ভেসে উঠতেই বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভাস্বতীদেবী, তারপর ধীরস্বরে মনের কুচিন্তাটা ভাষায় প্রকাশ করলেন, বলতে গিয়ে বুক কেঁপে উঠলো ওঁনার।

— বলছি কি আর সাধে? এ যে আর্মিতে কাজ করে! কিছু হয়ে গেলে তিন্নি কি পারবে সহ্য করতে?

কঠিন চাবুকের আঘাতের ন্যায় চরম বাস্তব প্রশ্নটির জবাব দিতে পারলেন না রঞ্জনবাবু!

.
.

**************************__****************************

টানা সাতদিন নার্সিংহোমের টানাপোড়েন কাটিয়ে আজ বাড়ি ফেরার পালা। এখানে আসার রাতে তিন্নি ছিল বেহুঁশ, বেঁচে থাকার সব আশা হারিয়ে ফেলা জীবন্মৃত এক মানুষ যে হারিয়ে ফেলেছিলো তার ভালোবাসা, পরিবারের ভরসা। আজ সেই ভালোবাসা তিন্নির পরিবারের হাত ধরে ঘরে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। এতো আনন্দের মধ্যেও তিন্নির মনে একটাই দুঃখ এরপর কি ভাবে অভিমন্যুর সাথে ওর দেখা হবে! অভিমন্যু কি শ্রীরামপুর আসবে? এলেও বা কতক্ষন! মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো তিন্নির, এর থেকে যেন নার্সিংহোমে থাকায় ভালো ছিল! তাও তো মানুষটাকে সকাল বিকেল চোখের সামনে দেখতে পেতো শুধু রাতের সময়টুকু ছাড়া! ভারী একটা শ্বাস ফেলে চোখ ফেটে বেরিয়ে আসা নোনতা গরম জলগুলো আটকে নিয়েছিল তিন্নি , মনে মনে ভাবছিলো – কিছু করেই কি আর কয়েকটি দিন-ঘন্টা-মুহূর্ত নার্সিংহোমে কাটানো যায় না?

অভিমন্যুর এই SUV, পিহুর হুইলচেয়ারের জন্য বিশেষভাবে কাস্টোমাইজড। তাই রন্জনাবুর উঠতে কোনো অসুবিধে হয় নি। শুভ সামনে বসবে আর তিন্নি-ভাস্বতীদেবী পেছনে, অলিখিতভাবে এমনটাই স্থির ছিল হয়তো কিন্তু ব্যকসিটে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তে নীচু অথচ স্পষ্ট গলায় তিন্নি বলে বসলো
— আমি সামনে বসবো।

ভাস্বতীদেবীর চোখ বিস্ফারিত, শুভ হাত পা নেড়ে কিছু একটা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো রঞ্জনবাবু চোখের ইশারায় বারণ করলেন। শুধু সবার অলক্ষ্যে অভিমন্যুর ঠোঁটের আগায় পাতলা হাসি ফুটে উঠলো, একটাও কথা বললো না। সবাই গাড়িতে উঠলে সাবধানে তিন্নিকে প্যাসেন্জার সিটে বসিয়ে সীটবেল্ট লাগিয়ে দুবার চেক করে নিলো, তারপর গাড়ি স্টার্ট করলো।

প্রথমদিকে তিন্নি খেয়াল করে নি, নিজের ভাবনায় মশগুল থেকে ভেবেছিলো হয়তো অভিমন্যু ঘুরপথে গাড়ি চালাচ্ছে! তারপর যখন ধূসর SUV মসৃন সাবলীল গতিতে মাখনের মত পিচঢালা “মা” ফ্ল্যাইওভারও পেরিয়ে গেল তিন্নি বুঝতে পারলো আজ আর ওরা শ্রীরামপুর যাচ্ছে না। মুখ দিয়ে চাপা বিষ্ময়ের একটা আওয়াজ বেরিয়ে এলো ওর, অভিমন্যুর অভিব্যক্তিহীন চোখ তখনও রাস্তার দিকেই নিবদ্ধ, না তাকিয়েও বুঝতে পারলো একরাশ অনুচ্চারিত প্রশ্ন নিয়ে তিন্নি ওরই দিকে চেয়ে। প্যাসেঞ্জার উইন্ডোর কাঁচ একটু নামিয়ে দিতে, হুড়মুড় করে গাড়িতে ঢুকে পড়ল সকালের হিমেল বাতাস। পেছনে বসে থাকা তিনটি প্রাণী টেরও পেলো না, হাওয়ার শব্দে মিশে গেলো অভিমন্যুর স্বর। রাস্তা থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই খুব আস্তে করে অভিমন্যু বললো
— উই আর গোয়িং হোম সোনা।
গীয়ার চেন্জ করার বাহানায় অভিমন্যুর কড়াপড়া শক্ত আঙুল ছুঁয়ে গেল তিন্নির হাত।

হোম!
অভিমন্যুর মুখ থেকে বেরোনো ওইক’টি শব্দ তিন্নির মেরুদন্ড বরাবর একটা কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো, চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো জল। মুখ ফুটে না বলতেও কি করে মানুষটা বারেবারে বুঝে যায় তিন্নির মনের গোপনতমন চাওয়াগুলো? আবেগের বহিঃস্রোত থামাতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিন্নি তাকিয়ে রইলো জানলার বাইরের ধাবমান পৃথিবীর দিকে।

জংপড়া ভারী লোহার গেট আর আর অযত্নের এলোমেলো বাগান পেরিয়ে পুরোনো আমলের বিশাল তিনতলা বাড়িটির গাড়িবারান্দার নিচে ধূসর SUV মসৃণভাবে পার্ক করলো অভিমন্যু। কাল বিকেলে ভাস্বতীদেবী আর শুভ এসে ঘুরে দেখে গেছেন এ বাড়ি, ওপরে ওঠার সিঁড়ি পরিচিত। নিচু গলায় অভিমন্যু বললো
— আপনারা নামুন, আমি সীমন্তিনীকে নিয়ে আসছি।

গাড়ি থেকে নেমে ভাস্বতীদেবী দাঁড়িয়েছিলেন তাও, স্মিতহাস্যে রঞ্জনবাবু ঠ্যালা দিলেন
— চলো, ওদের একটু আলাদা ছেড়ে দাও!

সবাই ভেতরে ঢুকে গেলেও অভিমন্যু বসেই রইলো স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে, কি যেন চলছিল ওর মনের ভেতর। চুপ করে অভিমন্যুকে দেখে যাচ্ছিলো তিন্নি।
কয়েকটি নিঃশব্দ মিনিট কেটে যাওয়ার পর ভারী একটা শ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো অভিমন্যু, প্যাসেঞ্জার ডোর খুলে বিনাদ্বিধায় পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো তিন্নিকে! ওর বলিষ্ঠ দুইহাতের মধ্যে ছটফটিয়ে উঠলো তিন্নি, প্রায় আঁতকে উঠে বললো
— কি করছো কি! ছাড়ো, আমি ঠিক পারবো!

–না, পারবে না!
অতি অনায়াসে তিন্নিকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে বুকের কাছে মিশিয়ে রাখলো অভিমন্যু। কপালে এঁকে দেওয়া ছোট্ট একটা চুমু মনে পড়িয়ে দিলো ছয়মাস আগের হিমালয়ের কোলের ছোট্ট একটি রাজ্যের পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টিভেজা একটি সন্ধ্যে – এক পল্টন সেনার মাঝে অভিমন্যুর ওকে কোলে করে মিলিটারি ট্রাকে উঠিয়ে নেওয়ার স্মৃতি।

— ওয়েলকাম হোম, সীমন্তিনী।
তপ্ত নিঃশ্বাসে মুখ পুড়িয়ে দিয়ে, পাগলকরা মাতাল ঘন হাস্কি স্বরের কথাগুলি কানে যেতে বলিষ্ঠ সেই পুরুষালি হাতের বন্ধনে আজ আরএকবার কেঁপে উঠে চোখ বুজিয়ে নিলো তিন্নি।

.
.
দোতলায় উঠে অভিমন্যু নামিয়ে দিল তিন্নিকে।
পুরোনো আমলের দেওয়ালঘড়িটা ঢং ঢং করে তখন জানান দিচ্ছে সকাল দশটা বাজলো। রোয়াকি সাবেকি ঠান্ডা সাদা মার্বেলের বারান্দার একটু দুরে রোগা পাতলা এক কিশোরী হইলচেয়ারে বসে, এলোমেলো ববছাঁট চুলগুলো ঝুঁকে আছে মুখের ওপর। দূর থেকেই তিন্নি চিনতে পারলো সে কে।

মিষ্টি রিনরিনে স্বর ভেসে এলো
— আমি কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারবো না, তোমাকেই আসতে হবে এদিকে!

— আহ্ পিহু? কি হচ্ছেটা কি ?

অভিমন্যুর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দিল তিন্নি। তারপর পিহুর হুইলচেয়ারের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে দুহাতে জড়িয়ে নিলো ওকে, যেন কতোদিনকার চেনা। দুই গালে দুইটি ছোট্ট হামি দিয়ে বললো
— হাই পিহু! আমি সীমন্তিনী… মানে তিন্নি।

পিহুর মুখে দুষ্টুমিভরা হাসি, তিন্নিকে কিছু না বলে অভিমন্যুর দিকে চেয়ে বললো
— কি ব্যাপার দাদাভাই? নভেম্বরেই ক্রিসমাস গিফট?

অভিমন্যু হেসে ফেললো, অনেকদিন আগের সেই ফোন কনভার্সেশনটার কথা মনে পড়েই হয়তো। মুখ টিপে বললো — হুমম্! ভালো?

সবকটি দাঁত বের করে কান এঁটো করা হাসি হাসলো পিহু — খুব খু-ব ভালো।

দাদা-বোনের সাংকেতিক কথার মধ্যে লুকোনো সূত্রটা যে তিন্নি নিজেই সেকথা বুঝতে ওর বেশি সময় লাগে নি, টুকটুকে লাল গাল নিয়ে চুপ করে ছিলো তিন্নি! পিহু এবার তিন্নির গলা জড়িয়ে ধরে বললো
— ওয়েলকাম টু আওয়ার ওয়ার্ল্ড বৌদিমনি। আর তোমায় ছাড়ছি না।

.
**************************__****************************

দক্ষিণ কলকাতার ভুতুড়ে সাবেকি দোতলা বাড়িটায় শেষ নভেম্বরে যেন দুর্গাপুজোর হইচই! হুড়োহুড়ি, কলকলানি, অসংখ্য প্রশ্নের বন্যা, রান্নাঘরে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে নিজের বাড়িটা নিজের চোখেই আজ অপিরিচিত ঠেকছে অভিমন্যুর। তারই সাথে বেড়ে উঠছে উদ্ভট এক অস্থিরতা। এর আগে যতবার ওরা একসাথে ছিল সেখানে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল না আর এইবার? প্রথমে নার্সিংহোমে, আর এখন বাড়িভর্তি লোক গিজগিজ করছে, এর মধ্যে তিন্নিকে একলা করে পাওয়ার কোনো উপায়ই নেই! কোথায় ভেবেছিলো শ্রীরামপুরে যেতে না দিয়ে তিন্নিকে নিজের কাছে আরো কয়েকদিন আটকে রাখতে পারবেন মেজর কিন্তু কোথায় কি! একমূহুর্ত তিন্নিকে একলা পাওয়া যাচ্ছে না! কখনো পিহু, কখনো নীলিমাদেবী আবার কখনো বা সবাই তিন্নিকে নিয়ে টানাহেঁচড়া লাগিয়েছে। এর থেকে যে নার্সিংহোমের অপরিসর কেবিনও ভালো ছিল!
দুই তিনবার তাও চেষ্টা করে দেখেছে অভিমন্যু, কিন্তু পুরোনো অ্যালবাম, পিহুর মাউথ অর্গান , নীলিমাদেবীর তিন্নিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা প্রশ্নের ভিড়ে তিন্নিকে দুই মিনিটের জন্যও একলা পাওয়া ওর পক্ষে আজ অসম্ভব। একটু একটু করে অধৈর্য্য হয়ে উঠছে অভিমন্যু! তিন্নিকে যে আর সবার সাথে শেয়ার করতে অভস্ত নন মেজর! তবে আজ দুর্দন্ডপ্রতাপ মেজরকে কেউ পাত্তা দিলে তো?! তিন্নিও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, বুঝছে সবটা আর মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে অভিমন্যুর ছটফটানি দেখে।

ষাট বছরের পুরোনো শ্বেতপাথরের বিশাল ডাইনিং টেবিলে আজ আর অভিমন্যুর একলা ক্যাসারোল থেকে খাবার বেড়ে নেওয়া নেই, ভাস্বতীদেবীর তদারকিতে ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত, ঝুরঝুরে আলুভাজা, বিউলির ডাল, আলুপোস্ত, পাবদার সর্ষেঝাল, চিকেনের পাতলা ঝোল, চাটনিতে সাজানো থালা। এবাড়িতে ঢুকেই রান্নাঘরের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন উনি। শুভকে দিয়ে বাজার করিয়ে এনেছেন, নীলিমাদেবীকে জিজ্ঞেস করে পিহু আর অভিমন্যুর পছন্দের খাবারগুলি রান্না করেছেন নিজের হাতে। কাল সন্ধ্যেবেলায় এ বাড়িতে পা রেখে পিহুকে দেখেই মনের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে ভাস্বতীদেবীর! এতটুকু ফুলের মতো মিষ্টি একটা মেয়ে, হুইলচেয়ারে বন্দী যার পুরো ছোটোবেলাটাই কেটেছে মা বাবার সান্নিধ্য ছাড়া। একমাত্র দাদা, সেও বছরে একবার কি দুবার বাড়িতে আসে মাসখানেকের জন্য। সবার অবহেলায়, অযত্নের মধ্যে দিয়ে, গভর্নেস আর কাজের লোকের হাতে কিশোরী মেয়েটি একা একাই বড়ো হয়ে গেলো নিজের মতো…ভেবে কেমনজানি বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো ভাস্বতীদেবীর। পারলে হয়তো নয় বছরের জমে থাকা স্নেহ একদিনেই সকল আদরে পুষিয়ে দেন ভাস্বতীদেবী, নেহাত সম্ভব নয় তাই স্বল্পসময়ে যতটা পেরেছেন, রান্নায় পুষিয়ে দিয়েছেন। থরে থরে ব্যঞ্জনে টেবিল ভর্তি দেখে পিহুর চোখ কপালে উঠেছে, নীলিমাদেবীর মুখে আন্তরিকতা মেশানো কৃতজ্ঞতার হাসি আর ভাস্বতীদেবীর মুখে তৃপ্তির ছাপ। শুধু অভিমন্যুরই কোনো তাপউত্তাপ নেই! আগের মতোই গম্ভীর, কি এক অজানা চিন্তায় ছটফটিয়ে যাচ্ছে, অন্যমনষ্কও বটে। ঘরের সাধারণ টিশার্ট ট্রাউজারে মেজরকে দেখতে লাগছে ঠিক যেন পাশের বাড়ির ছেলে, শুধু ব্যক্তিত্ব বদলায় নি।

টেবিলে বসে অন্যমনস্ক হয়ে থালায় ভাত নাড়ছিলো অভিমন্যু বেজার মুখে, পিঁক পিঁক করে ফোনে নোটিফিকেশন এলার্ট এলো। আলগোছে ফোনটা হাতে তুলে নিল, সাদা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে রোমান হরফে লেখা
“অমন প্যাঁচার মতো মুখ করে আছো কেন?”

তিন্নির মেসেজ!
ঠোঁটের কোনায় হালকা হাসি ফুটে উঠেই চারপাশে ঘিরে থাকা থাকা এতোজনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে নিজেকে সংযত করে নিলেন মেজর, দ্রুতহাতে টাইপ করলেন
— প্যাঁচানিকে একলা পেতে ইচ্ছে করছে।
— হবে না।
— তাই তো দেখছি!
তিন্নি কিছু একটা মেসেজ করতে যাচ্ছিলো ভাস্বতীদেবী ধমকে উঠলেন
— তিন্নি এই তোর এক বাজে স্বভাব! খেতে খেতেও ফোন ঘাঁটিস কেন রে??
চট করে ফোন রেখে দিলো তিন্নি, পিহু পাশ থেকে ফোড়ন কাটলো
— বৌদিমনি তো দাদাভাইকে মেসেজ করছে!

হে ভগবান!
ভাস্বতীদেবীর ডালের হাতা, বাটি থেকে আর থালা অবধি পৌঁছলো না, অভিমন্যু কেশে উঠলো জোরে আর তিন্নির কানের ডগা, নাকের ডগা সব লাল-গোলাপি হয়ে উঠলো। মনে মনে আকুল প্রার্থনা করতে লাগলো ক্রেতাযুগের মতো আরএকবার কি পৃথিবী ফাঁক হয়ে ওকে এই চেয়ার-টেবিল-ভাতের থালা সমেত গিলে নিতে পারে না??

গোলাপি মুখ নিয়ে তিন্নি আড়চোখে তাকালো অভিমন্যুর দিকে, অভিমন্যুর বাদামি চোখের স্থির হয়ে থাকা দৃষ্টিতে দুর্বল বুকের ধুকপুকানি আরো বেড়ে গেলো যেন।

সারাদিনের হুটোপাটির কোনো বিরতি নেই। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হলো, অভিমন্যুর বাড়িতে আজ যেন আসর বসেছে। শুধু গল্প আর গল্প! পিহুই বকে যাচ্ছে, রঞ্জনবাবু আর শুভোর যোগ্য সাথ তাতে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে অভিমন্যুর ছোটোবেলার আ্যলবাম দেখতে দেখতে নতমুখে তিন্নি শুনে যাচ্ছে
শুভো আর পিহুর ছোটবেলার গল্প, অভিমন্যুর পিহুকে পিস্তল চালাতে শেখানো, টার্গেট প্র্যাক্টিসের গল্প, দুঃসাহসিক কিছু আ্যডভেঞ্চার – কথার স্রোত বয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। দরজার পাশে হেলান দিয়ে অভিমন্যু দাঁড়িয়ে, মুখে একটা আলতো হাসি মাখানো। চোখের দৃষ্টি একজনের দিকেই আটকে, সে’ও যে প্রতি মিনিটে চোখ না মিলিয়ে থাকতে পারছে না। ভিড়ের মধ্যেও সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ওদের দুজনের আলাদা সংলাপ চলছে, চোখে চোখে, অতি গোপনে। হাসিঠাট্টা চলতে চলতেই টেবিলের পাশে হঠাৎ একটা পরিচিত আকার দেখতে পেলো তিন্নি। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো
— পিহু, তুমি গিটারও বাজাও?

মিটিমিটি হাসছিলো পিহু। তিন্নির দিকে তাকিয়ে বললো
— দাদাভাই গিটার বাজায়, জানো না?

— তোমার দাদাভাই আমাকে কিছু বলে না পিহু।

গলাটা একটু ভারী হয়ে এলো তিন্নির, বোধহয় মিশে গেলো একটু অভিমানী স্বর। ধরতে পেরে পিহু তিন্নিকে চোখ মেরে বললো
— ওটা একটা গাধা!
এই দাদাভাই, এদিকে আয়। বৌদিমনিকে গান শোনা এবার!

ঘরের সবার চোখ তখন অভিমন্যুর ওপর! বিব্রত হয়ে পড়ে অভিমন্যু বললো
— আঃ পিহু! কি শুরু করলি কি?

— না না! হোক না, ক্ষতি কি? আর শুধু তিন্নি কেন, আমরাও শুনি!

স্মিতহাস্যে বলে উঠলেন রঞ্জনবাবু, শুভও ঝোলাঝুলি করতে লাগলো। ওদিকে অভিমন্যু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিন্নির দিকে, ও কি বলে শোনার জন্য। কিন্তু তিন্নির বোধহয় অভিমান হয়েছে। মাটির দিকে চোখ আটকে চুপ করে রইলো একটা কথাও বললো না, তাকালোও না একবার।
হালকা হেসে হাত বাড়িয়ে গিটারটা টেনে নিলো অভিমন্যু, বসলো তিন্নির মুখোমুখি। অনেকদিনের ধুলোঝুল ঝেড়ে টুংটাং আওয়াজে টিউনিং ঠিক করতে একটু সময় লাগলো, তারপর সুর তুললো —

Khenchi Yeh Tujhse Qismet Ki Lakeer
Hathon Mein dikhta tha woh pyaar
Teri Hi Aadat Kuchh Par Si Gayi
Chahat Ka Aisa Tha Khumaar
Neend Na Ayein Raton Mein Kyun
Bichhrey Lamhon Ko Lauta Dein Tu..

বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো তিন্নি, চোখ দুটো ভরে উঠলো নোনতা জলে, তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো খোলা জানলার পাশে, অভিমন্যুর দিকে পিছন ফিরে।
গিটারের এক একটা স্ট্রিং তিন্নির মনে ঝড় তুলছিলো। “জল” ওর প্রিয় ব্যান্ড, এই গানটি ওর প্রিয় গান।এই একটি গান রিপীট মোডে শুনতে শুনতে রাতের পর রাত নির্ঘুম চোখে কাটিয়েছে তিন্নি , অভিমন্যুর কথা ভেবে। অফিসের ক্যাফেটেরিয়ায়, ট্রেনে বাসে.. যখনই কষ্ট পেয়েছে, যখন খুশি হয়েছে! অভিমন্যুর সাথে জড়িত প্রতিটি ইমোশন এই একটি গানের সাথে জড়িয়ে। হুড়মুড় করে স্মৃতিরা ভিড় করে এলো মাথায় – প্রথম দেখা হওয়ার দিন থেকে আজ অবধি অভিমন্যুর প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি চাহনি, প্রতিটি চুমু, প্রতিটি আলিঙ্গন! আজকের অভিমন্যুর এই গান, এই মুহুর্তগুলি যে তিন্নির “একার” জন্য! সেখানে এতজনের উপস্থিতি যেন সহ্য হচ্ছে না ওর। একটু নিরালার যে বড্ডো দরকার! খুব ইচ্ছে করছে, একছুটে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই মানুষটির কঠিনবুকে, নিজেকে মিশিয়ে নেয় ওর সাথে। আজ যে আর নিজেকে সংযত করা যাচ্ছে না।

ঘরের পরিবেশ অন্যরকম হয়ে উঠেছে ততক্ষনে। আর কারোদিকে চোখ নেই, গানের প্রতিটি শব্দ একজনের প্রতি নিবদ্ধ, একজনকে উদ্দেশ্য করেই অভিমন্যুর গিটার বেজে চলেছে। দাবানল স্বরূপ দাউদাউ আগুনে কেমিস্ট্রির আঁচ সবারই গায়ে এসে লাগছে। একদৃষ্টিতে তিন্নির দিকে তাকিয়ে অভিমন্যু গান শেষ করলো যখন, ভাস্বতীদেবী উঠে চলে গেছেন রান্নাঘরে, আর কোনো সংশয় নেই ওঁনার। তিন্নি ঠিক মানুষকেই পছন্দ করেছে, আজ এই প্রথমবার মেয়ের সুখে সুখী হয়ে উঠলেন ভাস্বতীদেবী! জলভরা চোখে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন – এদের দেখো ঠাকুর, এদেরকে সারাজীবন সুখে রেখো।

অভিমন্যুর চোখ এখনো তিন্নির দিকে আটকে, মুখের সবকটি পেশী স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে ধীরে ধীরে। কেমন জ্বলজ্বল করছে চোখগুলো। শুভ অতসব খেয়াল করেনি। উৎসাহে ফেটে পড়ে বললো
—- অভিমন্যুদা তুমি তো দারুন বাজাও! তবে জানো, দিদিও খুব ভালো কবিতা বলে! এই দিদি, উঠে গেলি কেন! একটা কবিতা শোনা না?

গম্ভীর কণ্ঠে হালকা হেসে তিন্নির হয়ে উত্তর দিলো অভিমন্যু – এখন থাক! ওর শরীর খারাপ।

একহাত জিব কেটে শুভ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, রঞ্জনবাবু হঠাৎ বললেন
— শুভ আমার সাথে একটু ওঘরে চল তো? ব্যাগ থেকে প্রেসারের ওষুধটা খুঁজে দিবি!

— প্রেসারের ওষুধ তো সকালে খাও এখন বিকেলে কি করবে?
— কাল সকালের জন্য লাগবে, চল।

নীলিমাদেবীও পিহুকে বললেন — ইয়ে ..পিহু … একটু আমার সাথে এসো তো, তোমার ঘরে চশমাটা ফেলে এসেছি বোধহয়!

মাথায় চশমা আটকে অভিমন্যুর দিকে আলতো হেসে নীলিমাদেবী পিহুকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ঘরে শুধু অভিমন্যু আর তিন্নি।

অভিমন্যু ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো তিন্নির পেছনে, কয়েকটি নিঃশব্দ মুহুর্ত, তারপর ঘন গলায় বললো —- কাঁদছো কেন?

নিঃশব্দে ফুলে উঠলো তিন্নির পিঠ।
সব প্রশ্নের কি উত্তর হয়? তিন্নি নিজেও কি জানে কেন কাঁদছে? দুঃখে কাঁদছে না কি আনন্দে? দুইকাঁধে হাত দিয়ে আলতো করে ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিতে গিয়েও নিজেকে আটকে নিলো অভিমন্যু। এখানে না, এভাবে না।

চোখের জলে ভেজা মুখখানির দিকে চেয়ে থেকে নরম গলায় বললো — ছাদে যাবে সীমন্তিনী?

— চলো।

রান্নাঘর পেরোতে গিয়ে আস্তে করে ডাকলো – – মা, আমরা একটু ছাদে যাচ্ছি।

— এই শরীরে?
চমকে উঠে বকতে গিয়েও নিজেকে আটকে নিলেন ভাস্বতীদেবী। তিন্নির অলক্ষ্যে চোখের জল মুছে নিয়ে রান্নাঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন
– আচ্ছা যা! সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উঠিস, তাড়াহুড়ো করিস না। অভিমন্যু তুমি একটু দেখো, বাবা।
—- হ্যাঁ! আপনি চিন্তা করবেন না!

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তিন্নি আপনমনেই হেসে ফেললো।
— কি?
অভিমন্যুর গলাতেও চাপা হাসির আভাস।
— মা’কে তো একদম ম্যানেজ করে ফেলেছো দেখছি!

সিঁড়ির ল্যান্ডিংটা পেরিয়ে দোতলার দৃশ্যপট অদৃশ্য হতেই টুপ করে তিন্নিকে কোলে তুলে নিলো অভিমন্যু। পাঁজাকোলা করে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মিটিমিটি হেসে বললো
—- কেন? হিংসে হচ্ছে?

নিজের শরীরের ভার তিন্নি ছেড়ে দিয়েছে অভিমন্যুর বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে।বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা একরাশ আবেগের ভেলায় ভেসে যেতে যেতে একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললো
—- নাহহ্।

চলবে
***********************__******************************