সূর্য ডোবার আগে পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
1684

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-৩৬ (অন্তিম পর্ব)
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।

কার্তিকের শেষ, হিম হিম ঠান্ডা হাওয়া শরীরে অল্প কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। নি:শব্দ পায়ে তিনতলার ছাদে এসে তিন্নিকে কোল থেকে নামিয়ে দিল অভিমন্যু।

আজ রাসপূর্ণিমা, সাদা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে মসৃন শ্বেতপাথরে বাঁধাই করা ছাদ। ঝকঝকে কালো আকাশে কালপুরুষ স্পষ্ট। মাসকয়েক আগেও এই ছাদে ঝোলানো থাকতো সারি সারি মাটির কলসি – পিহুর টার্গেট প্র্যাক্টিসের জন্য। এখন পিহু খিদিরপুরের কাছে একটা মাঠে যায় ট্রেনিং করতে, তাই ছাদ থেকে ওসব সরিয়ে ফেলা হচ্ছে, পরিবর্তে ছাদের ঠিক মাঝখানে বসানো হয়েছে একটা দোলনা। অভিমন্যুদের বাড়ির ছাদটা এমনিতে বিশাল, অনেকবছর আগে এই ছাদে অভিমন্যুর মায়ের হাতে তৈরী শখের বাগান ছিল, রকমারি ফুল আর অর্কিডে সাজানো থাকতো ছাদ, ঠিক যেন ঝুলন্ত বাগান। আজ বিশাল ছাদটি খাঁ খাঁ ফাঁকা , কেবল নৈঋতকোণের আলসের একপাশে আছে অযত্নের মধ্যেও বেড়ে ওঠা একটি গোলাপি বোগেনভোলিয়ার ঝার, তারই সাথে জড়িয়ে আর একটি লতানে গোলাপগাছ। থোকা থোকা লাল বুনোগোলাপ ফুটে আছে, হিমে ভেজা ঝরাপাঁপড়ি আর শুকনো পাতা রাশ হয়ে আছে তার নিচটায়। নরম মিষ্টি গন্ধে চারদিক সুবাসিত। একটু আগের তিন্নির এলোমেলো হয়ে থাকা মনটা কোমল আমেজের এমন নরম মিষ্টি পরিবেশে এসে হঠাৎ ভালো হয়ে গেলো যেন। পাখির মতো ডানা মেলে হালকা পায়ে চষে ফেললো এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, তারপর খুশির চোটে চট করে একটা গোলচক্কর ঘুরে নিলো, ঝলমলে ছেলেমানুষি হাসিতে উদ্ভাসিত ওর মুখ। অভিমন্যুর দিকে ফিরে বললো
— দারুন সুন্দর তো তোমাদের ছাদটা! ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যাই সারাজীবন।
—- ইওয়োর উইশ ইজ মাই কম্যান্ড।

স্থির দৃষ্টিতে অভিমন্যু তাকিয়ে ছিল তিন্নির দিকে। সাদা জোৎস্নায় তামাটে কঠিন মুখটি কেমন রহস্যাবৃত লাগছে। কি এক অজানা অনুভূতিতে বুক দুরুদু্র করে উঠল তিন্নির। একটু আগের উচ্ছলতা হঠাৎই শান্ত হয়ে এল, বড়ো বড়ো চোখের পাতা পিটপিট করে বললো — মানে?
— যা তুমি বললে ….. তোমাকে আটকে রাখি এখানে, সারাজীবন।
খুব সন্তর্পনে ছাদের দরজাটা এদিক থেকে বন্ধ করে দিলো অভিমন্যু।
লোহার ভারী দরজার গায়ে হেলান দিয়ে কেমন একটা পাগলকরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তিন্নির দিকে, চোখের পলক পড়ছে না ওর। সেদিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তিন্নির। তলপেটে পাক খাচ্ছে অনুভূতিরা, না চাইতেও কানের লতি লাল হয়ে উঠেছে। একমুহূর্ত থমকে গিয়ে জোর করে হেসে বললো
— তখন থেকে কি দেখে যাচ্ছো বলো তো অমন করে?
— তোমাকে।

স্পষ্ট উত্তর কিন্তু সেই পাগল করে দেওয়া চাহনি আর মাতাল করে দেওয়া কণ্ঠস্বরের দ্বৈত্ব আক্রমণে শরীর অবশ হয়ে এলো তিন্নির। হঠাৎ খেয়াল হলো বিগত দিনকয়েক সামনাসামনি, পাশাপাশি থেকেও বলতে গেলে এই প্রথমবার ওরা “একা”, আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তির সামান্য উপস্থিতি ছাড়া।

— ধ্যাৎ!
এছাড়া আর কোনো শব্দ বেরোলো না মুখ দিয়ে।হৃৎপিণ্ডের লাবডুব মাত্রা ছাড়ানোর আগে লজ্জায় লাল হয়ে চোখ নামিয়ে নিলো তিন্নি, তারপরই আবার মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো অভিমন্যু একই ভাবে দরজার গায়ে পিঠ ঠেসিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, বাদামি চোখদুটো ধিকিধিকি জ্বলছে ঠান্ডা আগুনের মতো। ধীরে ধীরে থেমে থেমে থেমে অভিমন্যু বললো — যে জন্য তোমাকে এখানে নিয়ে আসা, কথাটা সেরে নেওয়া যাক?

গা শিরশিরয়ে, গলা শুকিয়ে আসলো তিন্নির। অভিমন্যুর এই গলার স্বরটা ভীষন পরিচিত, বজ্রবিদ্যুৎ সহ আসন্ন ঝড়ের আগের সঙ্কেত। আবার কি নিয়ে বকাবকি শুরু করবে অভিমন্যু? হ্যাঁ / না কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো তিন্নি।
গুনে গুনে দুইসেকেন্ড পর শান্ত আগুন দপ্ করে জ্বলে উঠলো, বুকের রক্ত কাঁপিয়ে দেওয়া গম্ভীর গলায় অভিমন্যু বললো — কেন আমায় এতোটা ভালোবাসলে সীমন্তিনী? কেন আমার জন্য তোমার এতোটা পাগলপন যে টিভিতে একটা খবর দেখে তুমি……
কথাটা শেষ করতে পারলো না। পোড়খাওয়া আর্মি অফিসারের পাথরকঠিন মনটাও কেঁপে উঠলো একবার তারপর আবেগের লাভাস্রোত সংযত করে নিয়ে বললো — গত সাতদিন ধরে এই একটা প্রশ্ন আমায় একমুহুর্ত স্বস্তি দিচ্ছে না! শুতে দিচ্ছে না, বসতে দিচ্ছে না, খেতে দিচ্ছে না! আমি ভগবানে বিশ্বাস করি না, মিরাক্যেল আমি মানি না। তাও, গত সাতদিন ধরে যা যা ঘটে চলেছে তা আমার যুক্তির বাইরে। কি করে এমনটা সম্ভব!! এমন পাগলের মতো কেন তুমি ভালোবাসলে আমায়? পাঁচমিনিটের ফোনকল ছাড়া তোমায় তো কিছুই দিতে পারি নি!

অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের বন্যায় খেই হারিয়ে ফেললো তিন্নি। কি বলবে ভেবে উঠতে পারলো না। পা কাঁপছিল ওর। শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে ধপ করে কখন যে বসে পড়েছিল দোলনাটিতে! শেষকথাটি কানে যেতে ধীরে ধীরে বললো —- আমি তো তোমার কাছ থেকে নিজের জন্য কিছু চাই নি অভিমন্যু। আমি শুধু তোমায় ভালোবেসেছি, কোনো দাবী ছাড়া!
— কেন? কেন ভালোবাসলে আমায়?

কি বলতে চাইছে অভিমন্যু!
হিমজড়ানো একরাশ ঠান্ডা হাওয়া কোথা থেকে ছুটে এসে সারা গায়ে শিরশিরানি ধরিয়ে দিতে আমূল কেঁপে উঠলো তিন্নি। দুর আকাশে চাঁদের গায়ের কলঙ্কের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই পাঁজর চিঁরে ঠিকরে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস।
সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলো তিন্নি, উদাসস্বরে বললো — জানি না অভিমন্যু! বিশ্বাস করো, কেন তোমাকে ভালোবাসলাম সে প্রশ্নের উত্তর আমিও খুঁজেছি অনেকবার! হয়তো আমার জীবনের অন্ধকারতম দিনগুলিতে দেবদুতের মতো, আমার গার্ডিয়ান আ্যন্জেল হয়ে বারবার আমার প্রাণ, আমার সম্ভ্রম বাঁচালে বলে? না চাইতেও নির্দ্বিধায় আমার ভালোমন্দর সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলে বলে? না কি তোমাকে নিয়ে আমার মনের মধ্যে গড়ে ওঠা অতৃপ্ত কোনো ফ্যান্টাসি? নিজেকে হাজারবার প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পাই নি অভিমন্যু, তাই জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দিয়েছি।

ধীর পদক্ষেপে দুই পা এগোলো অভিমন্যু। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বেতের দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকা আসমানি রঙা কুর্তি পাজামায় অপরূপা সেই নারীর দিকে, তার কাঁধ ছাপানো এলোমেলো সর্পিল ঘুঙরালো চুল, লাল হয়ে আসা ছলছলে দীঘলকালো চোখ, হেমন্তের শীতল বাতাসে পাতলা গোলাপি ঠোঁট কাঁপছে তিরতির। নিজেকে আজ আর আটকাতে পারছেন না মেজর। ইস্পাতকঠিন নার্ভ আর চরম সংযমী মানুষটারও সেল্ফ কন্ট্রোল আজ চুরমার হয়ে যাচ্ছে, হরমোনরা খেলা করছে। ইচ্ছে করছে ওই নারীকে আজ মিশিয়ে নিতে নিজের সাথে। ঘনিয়ে আসা স্বরে বললো — শুধু একটা কারণ বলো সীমন্তিনী। আজ আর মাল্টিপল চয়েজ আ্যনসার দিলে চলবে না।

ভাবের জগতে যেন হারিয়ে গেছে তিন্নি। নিজের মনেই হেসে ফেলে বললো — মাত্র একটাই কারণ? সে তো সম্ভব নয় অভিমন্যু!

তারপর একটু থেমে যেন ভেবে নিলো মনে মনে। ছলছলে হয়ে আসা চোখ নিয়ে অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে বললো — তোমার পরিমিত কর্ত্যব্যবোধ, নারীকে সম্মান দেওয়ার বোধ, তোমার শিভ্যালরি, তোমার কণ্ঠস্বর, তোমার চোখের গভীরতা, তোমার ভীষন পুরুষালী গন্ধ – এই সবকটাই আমার বড্ড প্রিয়! কোনটা ছাড়বো বলো তো?

ঘন হয়ে এলো অভিমন্যুর গলা, প্রিয় নারীটির নরম শরীর থেকে আসা মিষ্টি মেয়েলী গন্ধ যেন পাগল করে তুলছে ওকে। আরো দুই পা এগিয়ে এসে তিন্নির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো, দুহাতে ওর উরু জড়িয়ে নিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো — আর?

নিষিদ্ধ চাহিদাগুলো বুকের ভেতর থেকে উথলে আসছে প্রায়। চোখ সরিয়ে নিলো না তিন্নি, বলে যেতে লাগলো নিজের মতো — আরো জানতে চাও? তোমার বুকের ওম, তোমার শক্ত হাতের ছোঁয়া, তোমার দুষ্টুমি মাখা হাসি, তোমার পাগল করে দেওয়া চাহনি, না ছুঁয়েও চোখ দিয়ে আমাকে ছুঁয়ে যাও তুমি বারবার, ভাবো আমি বুঝতে পারি না? এই সবকটাও যে আমার বড্ড প্রিয় অভিমন্যু।

নিজেকে আটকালো না অভিমন্যু, সম্মোহিতের মতো তিন্নির নরম কোলে এবার মুখ গুঁজে দিলো, জড়িয়ে আসা স্বরে বললো— আর?
কেঁপে উঠলো তিন্নি। অভিমন্যুর হাতের বেড় আর একটু শক্ত হয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরতে কম্পিত স্বরে বললো — তোমার অনমনীয় পৌরুষ, তোমার তেজদীপ্ত পদচারনা, তোমার ইন্টেলিজেন্স, তোমার সাহস, তোমার বীরত্ব…..আর কি জানতে চাও অভিমন্যু? আর কি চাও তুমি আমার থেকে?

বলতে বলতে গলার স্বর ভেঙে গেল তিন্নির, চোখের কোণা চিকচিক করে উঠলো। ততক্ষনে এক ঝটকায় দোলনা থেকে উঠিয়ে বলিষ্ঠ দুহাতে ওকে জড়িয়ে নিয়েছে অভিমন্যু। নিজের প্রস্তরকঠিন বুকে ওর নরম শরীরটা মিশিয়ে নিয়ে সবল আলিঙ্গনে তিন্নিকে প্রায় পিষে ফেলতে ফেলতে বললো — তোমাকে চাই। তোমার সবটা নিজের মধ্যে মিশিয়ে নিতে চাই সীমন্তিনী, তোমার সাথে খোলা আকাশের তারা দেখতে চাই, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে চাই, তোমার শরীরের উত্তাপে নিজেকে সেঁকতে চাই, তোমার চোখে নিজেকে দেখতে চাই, তোমার সিঁথিতে নিজের নামের সিঁদুর রাঙাতে চাই।

বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো তিন্নির, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলো ওর। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়ছিলো সারা শরীরে, পেটের ভেতর কেমন গুড়গুড় আওয়াজ হচ্ছে, হৃৎপিন্ডের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ। তিন্নির নিরুচ্চারিত অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে ফুটে উঠলো অভিমন্যুর গলায়। বুকের ওপর থেকে তিন্নিকে সরিয়ে দিয়ে একই রকম নেশা ধরিয়ে দেওয়া পাগলকরা স্বরে জিজ্ঞেস করলো
— তুমি কি চাও সীমন্তিনী?

পিট্যুইট্যারী নিঃসৃত হরমোনের স্রোতে ভেসে যাওয়া আটকাতে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে তিন্নি অপলক তাকিয়ে থাকলো অভিমন্যুর দিকে। রক্তের নোনতা স্বাদ জিবের আগায়। সে’ও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল না! রাসপূর্ণিমার সাদা জ্যোৎস্নার আলোতে চোখে চোখে বয়ে গেলো নিঃশব্দ বিদ্যুৎতরঙ্গ। কয়েকসেকেন্ড পর স্পষ্ট গলায় তিন্নি বললো — তোমাকে।

শরীরের শিরা ধমনীর ভেতর দিয়ে রক্তকণিকারা ততক্ষনে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। অজগরের মতো সম্মোহনী দৃষ্টিতে তিন্নিকে বেঁধে ফেলে শেষবারের মতো সাবধানী হলো অভিমন্যু, মোহবিষ্ট, জড়ানো গলায় বললো
— ডাক্তার কিন্তু বলেছে বেশি উত্তেজনা তোমার হার্টের জন্য ভালো নয়।
— বলুক।

একটি থমকানো মুহুর্ত, তারপরই বাঁধভাঙা জলোচ্ছাসের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তিন্নি অভিমন্যুর বুকে, নিজের ঠোঁটদুটো মিশিয়ে দিলো অভিমন্যুর ঠোঁটে আর দুইটি বলিষ্ঠ হাতে ওর হালকা শরীরটা কোলে উঠিয়ে নিয়ে পরম আবেশে তিন্নির নরম ঠোঁটগুলো কামড়ে ধরলো অভিমন্যু। ঠোঁটে, গালে, কপালে, ঘাড়ে,গলায়, বুকে আদরের পর আদরে ভরিয়ে দিতে লাগলো ওকে।
আগুনে রসায়নে মিশে উদ্দাম ভালোবাসা। ওদের ভালোবাসা স্থান-কাল-পরিবার-পরিজন-সমাজ-লোকের কথা – কিচ্ছু মানে না। একে অপরের পরিপূরক ওরা, আর কিচ্ছু ওরা চায় না। ঐকান্তিক শরীরি চাহিদা, প্রবল অধিকারবোধ আর বাঁধনছেঁড়া তীব্র পাগলামির সংমিশ্রনে গড়ে উঠলো একটি তেজস্ক্রিয় বলয়। যে তেজস্কিয়তার তপ্ত নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছে তিন্নির মুখ, প্রতিটি চুম্বনে, উষ্ণ আলিঙ্গনে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। শান্ত হেমন্তের রাতে অকাল কালবৈশাখীর দুর্বীনিত ঝড় বয়ে গেল যেন।
চতুর্দিক লন্ডভন্ড করে অবশেষে যখন শান্ত হলো পৃথিবী, অনেকক্ষন পর অভিমন্যু ছাড়লো তিন্নিকে।বিস্মিত, পরিপূর্ণ, তৃপ্ত। দুজনের ঠোঁট ফুলে গেছে, মুখ লাল হয়ে গেছে। আলতো করে তিন্নিকে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে, বুজে থাকা চোখের পাতায় আরো দুটো নরম চুমু এঁকে দিলো অভিমন্যু।
তিন্নি কেঁপে উঠলো আরেকবার, ওর মুখের ওপর ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে সরিয়ে দিতে দিতে গলায় একটা শব্দ করে হাসলো অভিমন্যু
— আ্যন্ড দ্যাট রাস্কেল লেফ্ট ইউ বিয়িং ফ্রীজিড?

মিষ্টি নরম স্বপ্নের ঘোর কেটে গেল তিন্নির। কড়া থাপ্পড়ে বাস্তবে ফিরে এলো যেন।
.
.
.
.
বিস্ফারিত চোখজোড়া কোটর থেকে বেরিয়েই আসবে প্রায়। মুখের হাঁ আর বন্ধ হলো না তিন্নির।অনেকগুলো অবাক প্রশ্ন গলার কাছে ছটপট করছিল বেরোনোর জন্য, একটু আগের উদ্দাম চুম্বনের চিন্হস্বরূপ ফুলে ওঠা ঠোঁটদুটো অস্ফুটে নড়ে উঠলো
—- মানব?? তুমি কি করে জানলে?

বড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেললো অভিমন্যু। দুর অন্ধকারে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললো — “জানা”টা আমার কাজ সীমন্তিনী। জুনের সেই বিকেলে তোমাকে ক্যাম্পে পোঁছে দিয়েই আমি ইনিশিয়াল ইনফর্মেশন নিয়ে নিয়েছিলাম – তোমার ফোন নাম্বার, বাড়ির ঠিকানা, মেডিক্যাল হিস্ট্রি, ব্লাডগ্রুপ, তোমার বাবার নাম, অফিস, তোমাদের দুই ভাইবোনের কলেজ, তোমার কলেজ পার্সেন্টেজে স-ব। রাতে টেন্টে তোমার সাথে ডিনার করার সময় সেগুলো ভেরিফাই করতে হয়েছিলো ইনকেস তুমি কিছু লুকোচ্ছো কিনা, মিথ্যে বলছো কিনা। হয়তো তোমার খারাপ লাগবে কিন্তু দেশের সুরক্ষা তোমার-আমার মতো নগন্য মানুষের থেকে অনেক বড়ো, তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্বন্ধে সব খবর না নিয়ে কিছুতেই ওই ক্যাম্পে সে রাতে তোমায় রাখা যেত না!

চড়াইপাখি ঢুকে যাওয়ার সাইজের মুখের ছোট্ট হাঁ বন্ধ করে নিলো তিন্নি। সিকিমের সেই মিলিটারি তাঁবুতে, প্রথমদিককার ফোনের কথোপকথনগুলো এখন যেন স্পষ্ট হলো কিছুটা। সবটা হজম করতে করতে বললো
—- বুঝলাম, তারপর?

ঠোঁটের কোণায় পাতলা হাসি ফুটে উঠলো অভিমন্যুর। সে হাসি ওর চোখ স্পর্শ করলো না।
—- তারপর যখন দেখলাম তোমার ওপর আমিও একটু একটু দুর্বল হয়ে পড়েছি, তখন তোমার পার্সোনাল লাইফ নিয়েও একটু নাড়াচড়া করলাম হুইচ আই এগ্রি, আই ওভারস্টেপড্ দ্য বাউন্ডারি। তোমার কলেজহিস্ট্র্যি খুঁজে বার করা খুব একটা কঠিন কাজ ছিলো না, দু-তিনটে আ্যলুমিনি গ্রুপ থেকেই সব জানতে পারলাম, ইনক্লুডিং দ্য হিউমিলিয়েশন ইউ হ্যাড টু ফেস ইনফ্রন্ট অফ এভরিওয়ান। ট্রাস্ট মি, রাস্কেলটাকে হাতের কাছে পেলে ওর মুখ ভেঙে দেব আমি!

ছাদের আলসেতে শরীর হেলান দিয়ে কথাগুলি শুনতে শুনতে কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল তিন্নির! নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সব পুরোনো কথা ভোলা যায় না! বহুবছর পর আচমকা পুরোনো ক্ষতস্থানটি দেখলেও ব্যাথার জায়গাটি মনে মনে চিনচিন করে ওঠে! হয়তো এই কথাগুলোর আজকের রাতটিতে বলার কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। মনের ভাবটা লুকিয়ে নিয়ে জোর করে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো
— থাক, অনেক হয়েছে! আর বীরত্ব দেখাতে হবে না!

—- বীরত্ব না সীমন্তিনী, তোমার সাথে স্কাউন্ড্রেলটা ওরকম ব্যবহার করেছে, ভাবলে আমার গায়ের রক্ত ফুটে উঠতো।

কেন এসব কথা আজ, এখন বলছে অভিমন্যু? তিন্নির যে একটুও ভালো লাগছে না শুনতে! বড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেলে অভিমন্যুর একটা হাত নিজের কোমল মুঠিতে নিলো তিন্নি। নরম গলায় বললো — এদিকে তাকাও? তুমি না বলেছিলে আমার পাস্ট নিয়ে তোমার কোনো মাথাব্যথা নেই?

উত্তপ্ মরুভুমি যেন সিক্ত হলো দুইটি বৃষ্টিধারায়। অভিমন্যুর কঠিন মুখটি ধীরে ধীরে নরম হয়ে এলো। তারপর তিন্নিকে জড়িয়ে নিলো বুকে। নিজের পরম নির্ভরতার জায়গাটিতে ফিরে এসে চোখ বুজিয়ে নিলো তিন্নি। চুপ করে শুষে নিচ্ছিলো অভিমন্যুর বুকের ওম, নিজস্ব পুরুষালী গন্ধ। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর রাতজাগা একটা পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেলো ওদের মাথার ওপর দিয়ে, সম্বিৎ ফিরে পেলো দুজনেই। নিজের বুকের ওপর থেকে তিন্নিকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর ধরে রাখা হাতটিতে আলতো একটা চুমু দিয়ে অভিমন্যু বললো — ভেবেছিলাম নেক্সট ছুটিতে যখন বাড়ি আসবো, প্রথম দেখা হওয়ার দিন এটা পরিয়ে দেব তোমার হাতে, সে তো হলো না আর……

বলতে বলতে পাকা ম্যাজিশিয়ানের মতো জীনসের পকেট থেকে নীলরঙা পাথর বসানো সোনার একটি আংটি বার করে মিলিসেকেন্ডের মধ্যে তিন্নির বামহাতের অনামিকায় পরিয়ে দিলো অভিমন্যু।

হৃৎপিণ্ডের লাবডুব বন্ধ, ঘটনার আকস্মিকতায় নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলো তিন্নি। প্রতিটি রোমকূপ খাড়া হয়ে থাকলো, ফুরফুরে প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াতে লাগলো পেটের মধ্যে, কানে মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ। তিন্নির গোল গোল অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে অভিমন্যু হালকা হেসে বললো —- মা’র আংটি….. তুলে রাখা ছিলো এ বাড়ির পুত্রবধূর জন্য।

থমকানো মুহুর্তের পর আরেকটি জলোচ্ছাস।
অধরের সাথে অধরের আরো একটি নাতিদীর্ঘ ভেজা চুম্বন। একজনের কোমলশরীর গরম মোমের মতো মিশে গেল আরেকজনের পাথরকোঁদা বুকে। চোখে জল, মুখে হাসি। গোলাপি হয়ে আসা গাল বেয়ে দুইফোঁটা গরম অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গমরঙা শীর্ণ হাতটির ওপর। কেঁপে আসা আবছা স্বরে তিন্নির ঠোঁটদুটি নড়ে উঠলো
— আই লাভ ইউ।
তিন্নির কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে অভিমন্যু হাসলো
— আই লাভ ইউ টু।

আজকের দিনটি সত্যি মনে রাখার মতো! চমকের পর চমক!
অভিমন্যুর চওড়া চিজেলকাট বুকে মাথা রেখে নরম চাঁদের আলোয় আংটিটি ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎই একটা কথা মনে পড়ে গেলো তিন্নির আর এমন ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো জমাট বাঁধা মিষ্টি মিষ্টি ফিল্মি প্রেমঘন আ্যটমোস্ফিয়ারেও পেটের ভেতর থেকে গুলগুলিয়ে হাসি উঠে এলো ওর। অবাক জিজ্ঞাসায় অভিমন্যু ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে চোখের জল মুছে নিয়ে কান এঁটো করা হাসি হাসলো তিন্নি!
— ভাবছি, এইবার মায়ের চিন্তা শেষ! গান্ধর্বমতে মেয়ের বিয়ে হয়েই গেলো, এবার শুধু বৈদিকমতে সাত পাক ঘুরে নিলেই হয়।
অভিমন্যুর মুখের পেশী একটু শক্ত হয়ে উঠলো, চোখের দৃষ্টি স্থির আর কথাটা বলেই লজ্জায় লাল-গোলাপি-নীল প্রজাপতির ডানা হয়ে উঠলো তিন্নি। ছলছলে চোখে নিজেকে অভিমন্যুর থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো
— মজা করছিলাম অভিমন্যু! নাথিং সিরিয়াস!

চোখের পলক পড়ছিলো না অভিমন্যুর। জল টলটল দুখানি মায়াবী গভীর চোখ ওরই দিকে চেয়ে আছে..ঠোঁট দুখানি নড়ছে কিন্তু কানে কিছুই যাচ্ছে না। মিষ্টি মিষ্টি আবেশের ঝুরঝুরে চোরাবালিতে ডুবে যেতে যেতে কি যেন একটা অন্যরকম অভিব্যক্তির বিদ্যুৎ খেলে গেল অভিমন্যুর মুখে, আড়চোখে তাকিয়ে তিন্নি ঠিক ধরতে পারলো না! ভরাট রাশভারী সেই গলাটি ফিরে এসেছে আবার! তিন্নির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অভিমন্যু বললো —- তখন ভেবেছিলাম ইট উইল বি এনাফ ফর নাউ কিন্তু এখন দেখছি ইট ডাজ নট কমপ্লিট ইউ।
—- হুহ্? মা-নে?
অবাক চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো তিন্নি। ততক্ষনে আলসের পাশের লতানে গোলাপগাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ে নিয়েছে অভিমন্যু, তিন্নির দিকে হাত বাড়িয়ে আছে।
এইবার সত্যি সত্যিই পেটের ভেতর থেকে সাবান ফেনার মতো গুলগুলিয়ে হাসি বেরিয়ে এলো তিন্নির। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো কলকলানি হাসিতে ফেটে পড়ে বললো — কি? কানে গোলাপ ফুল গুঁজলে আমায় কমপ্লিট লাগবে দেখতে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?

চাপা হাসিতে ভরে অভিমন্যুর মুখ। সহজাত শান্ত গলায় বললো — না ম্যাডাম! বৈদিক/গান্ধর্ব মত ছাড়াও আরো একটা মত আছে বিয়ের – রাক্ষস বিবাহ। ভাবলাম…. আর্মিম্যানের সাথেই যখন সারাটা জীবন কাটাবে ঠিক করেই ফেলেছো তখন না হয় আমার রক্তেই প্রথম সিঁদুরটা পড়ো।

নিজের কানকেও বিশ্বাস হলো না, কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো তিন্নি! অভিমন্যু কি মজা করছে ওর সাথে?এত ক্যাজুয়ালি এমন গভীর কথা কি করে কেউ বলতে পারে? সবটাই কি ছেলেখেলা এর কাছে?
বিস্ফারিত চোখে তিন্নি তাকিয়ে রইলো নিস্পলক, মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও বেরোলো না।
একটু আগের আবেগের বহিঃস্রোতে তিন্নির কৃষ্ণকালো চোখদুটিতে টলটল করছিলো জল, কার্তিক পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সেই অশ্রুতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে ততক্ষনে হাতে ধরে থাকা গোলাপকাঁটা দিয়ে বুড়োআঙ্গুল কেটে নিজের রক্তে তিন্নির সিঁথি রাঙিয়ে দিয়েছে অভিমন্যু। আলতো হাতে তিন্নির থরথর করে কাঁপতে থাকা মুখটা তুলে বললো — বেশ লাগছে কিন্তু।

নাহ!
ছাপিয়ে আসা বন্যাগুলো আর ধরে রাখা গেলো না। টপটপ করে দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অবিরল ধারায় নোনতা জল, চুমুর পর চুমুতে একটি একটি করে সেই নোনতা জল শুষে নিয়ে তিন্নির কানে কানে অভিমন্যু বললো — আরেকবার কি ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করা যায়, ম্যাডাম?
বুকের ভেতরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তীব্র আবেগের বিন্দুরা। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে হৃদপিণ্ডের লাবডুব শব্দ। “আনরোমান্টিক ভূত”টাকে উদ্দাম আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলে তার পুরুষালি ঠোঁটদুটো সজোড়ে কামড়ে ধরলো তিন্নি। হিম হিম সাদা জোৎস্নায় মিশে থাকা কান্নাভেজা উচ্ছাসে আর প্রবল উন্মাদতায় দুইটি শরীর ভেসে গেল হেমন্তের পূর্ণিমার রাতে।

**************************__****************************

সকাল সাড়ে ন’টা দশটা হবে হয়তো। সদ্য স্নান সেরে নীলিমাদেবীর দেওয়া হালকা গোলাপি একটা শিফন শাড়ী পড়ে আলতো নক করে অভিমন্যুর ঘরে এলো তিন্নি। কাল রাত থেকেই মনটা ওর ফুরফুরে; পা যেন মাটিতে নয়, হাওয়ায় ভেসে। অন্য রকমের আনন্দের জোয়ার সারা শরীরে,সদ্য স্নান করে স্নিগ্ধ লাবণ্য, গমরঙা ত্বক ঈষৎ লালচে হয়ে আছে, ভিজে চুলগুলো পাকিয়ে আছে মুখের চারপাশে, কাঁধে, পিঠে। ঘরে ঢুকে তিন্নি অবাক – বিছানা শূন্য। চোখ ঘুরিয়ে দেখলো বারমুডা আর একটা পাতলা টিশার্ট পরে অভিমন্যু বসে আছে সিঙ্গেল সোফায়, কোলের ওপর খোলা ল্যাপটপ, সিরিয়াস মখে কি কাজে ডুবে, সে’ই জানে। মাথার চুলগুলো উস্কোখুস্কো, বাসী জামাকাপড়ে কেমন অন্যরকম, তিন্নিকে দেখেই শিশুর মতো অনাবিল আনন্দ ফুটে উঠলো ওর চোখে। তিন্নির ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই মেয়েলী সিক্তশরীর, বডিওয়াশ-শ্যাম্পু-লোশনের মিলিত সুবাস, কেমন একটা মিষ্টি সুকোমল সৌরভে সারা ঘরটি ভরে গিয়েছিলো মুহুর্তের মধ্যে, গোলাপী শিফন শাড়ি পড়া সদ্যস্নাত তিন্নির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো অভিমন্যু, অপলক।
মেজর অভিমন্যু সেন আর বারমুডা? ঠিক মেলানো যায় না, যেন পাশের বাড়ির ছেলে। বয়স যেন এক ঝটকায় কমে গেছে দুই তিন বছর। কাছে গিয়ে আদর করে উস্কোখুস্কো চুলগুলো আরো ঘেঁটে দিলো তিন্নি, হাতে ধরে রাখা প্লেট থেকে একটা সন্দেশ মুখের সামনে ধরে মিষ্টি করে বললো — গুড মর্নিং মিস্টার অভিমন্যু সেন! প্রসাদটা খেয়ে নিন দেখি তো?
অভিমন্যু কোলের থেকে ল্যাপটপটা সরিয়ে রাখলো সামনের কফি টেবিলে, মুখ হাঁ করে মিষ্টিটা টুপ্ করে গিলে নিয়ে বললো —- গুড মর্নিং মিসেস সেন! এতক্ষনে আসার সময় হলো?

মিসেস সেন?
কালকের উদ্দাম সন্ধ্যেটার কথা মনে পড়তেই গালদুটো কাশ্মীরি আপেলের মতো টুকটুকে লাল হয়ে উঠলো তিন্নির, আরো বেশিদুর এগোনোর আগেই ঝটপট প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললো
— তুমি ঘরে বসে আছো কেন? বাইরে সবাই ওয়েট করছে তোমার …..
— আর আমি ওয়েট করছিলাম তোমার জন্য, বসো।
হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় অভিমন্যু ওকে টেনে নিলো কোলের ওপর, আচমকা হ্যাঁচকা টানে অভিমন্যুর চওড়া বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েই তিন্নি ছটফটিয়ে উঠলো — কি হচ্ছে কি? দরজা খোলা রয়েছে, কেউ দেখে ফেলবে।

অভিমন্যুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তিন্নির কাঁধে এলিয়ে থাকা ভিজে চুলে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে জড়ানো স্বরে বিড়বিড় করলো — দেখুক। আজ হঠাৎ শাড়ী?

নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় তিন্নি ছটফটিয়ে হাত পা নাড়তে নাড়তে বললো — নীলিমাদি দিলেন, আমার তো কোনো জামাকাপড় নেই এখানে।
—হুমম, বিকেলে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

হেসে ফেললো তিন্নি। কাঁধের ওপর থেকে অভিমন্যুকে জোর করে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললো —আজ্ঞে না! আজ বিকেলে বাড়ি যাচ্ছি আমরা!
— নাহহ্!
— কি নাহ? দিব্বি যাচ্ছি।
আরো শক্ত করে অভিমন্যু চেপে ধরলো তিন্নিকে, ওর নরম শরীরে মুখ গুঁজে দিয়ে, শরীরের ঘ্রান নিতে নিতে বললো — কে যেতে দিচ্ছে? আমি এখন তোমাকে ছাড়বো না। আর এতো ছটফট করো না, আদর করতে দাও।
শেষের কথাটা অনেকটা বাচ্চাদের মতো আবদার। ঠোঁটের কোণে হাল ছেড়ে দেওয়ার হাসি ফুটে উঠলো তিন্নির, জোর করে অভিমন্যুর মুখখানি দুহাতে ধরে চোখে চোখ রেখে বললো — অভিমন্যু! কি বলে আটকাবে তুমি ?

এক মুহূর্ত থমকালো অভিমন্যু তারপর তিন্নির নরম শরীরে ছোটো ছোটো চুমুর আদরে ভরিয়ে দিতে দিতে জড়ানো গলায় বললো —ডাক্তারের সার্টিফিকেট চাও? তারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

অভিমন্যুর নিজস্ব পুরুষালী ঘ্রান, বলিষ্ঠ বাহুর সবল পেষন আর এতগুলো চমুর আদরে দিশেহারা হয়ে হারিয়ে যেতে যেতে চোখ বন্ধ করে নিয়ে তিন্নি অস্ফুটে বললো
— তুমি একটা পাগল!
— হুমম।

এক দুই সেকেন্ড চুপ। “আনরোম্যান্টিক ভুত”টার কড়াপড়া হাতে নিজেকে সমর্পন করে আদরে ডুবে থেকে আবার ছটফটিয়ে উঠলো তিন্নি, — কি করছিলে বললে না? বিরক্ত করলাম এসে?

এইবার সোজা হয়ে বসলো অভিমন্যু। তিন্নিকে কোলের ওপর বসিয়ে রেখেই ল্যাপটপটা টেনে নিলো— তোমার আ্যড্রেস প্রুফ আর ডেট অফ বার্থ প্রুফ এদুটোর সফ্ট কপি আমায় মেল করে দিয়ো তো।
হেসে ফেললো তিন্নি — কেন? আমার ওপর নজর রাখার জন্য স্পাই রাখবে?
মজার ছলে কথাটা বললেও অভিমন্যুর চোখের দিকে তাকিয়ে সে হাসি আটকে গেলো তিন্নির। স্থির চোখে কয়েকপল তাকিয়ে থেকে অভিমন্যু বললো — নাহ, সে দরকার আর হবে না। ওগুলো ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিসে দিতে লাগবে।

সকাল সকাল প্রেম প্রেম নেশার চটকাটা ভেঙে গেল এবার। চমকানির বিহবলতাটুকু কেটে গেলে তিন্নি চেঁচিয়ে উঠলো প্রায় — হো–আট?
নিঃশব্দ হাসিতে ভরে অভিমন্যুর মুখ। তিন্নি আবার জিজ্ঞেস করলো — মানে?
— কি মানে?
— ম্যারেজ রেজিস্টার মানে?

কাঁচপুতুলের মতো তিন্নিকে কোলের থেকে উঠিয়ে পাশে সোফার হাতলে বসিয়ে দিলো অভিমন্যু। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ঝুলিয়ে বললো — হুমম, হাতে একমাসের ছুটি। যাওয়ার আগে রেজিস্ট্রিটা করে যাবো।
তিন্নির একটুও হাসি পাচ্ছে না, একবগ্গা জেদি ঘোড়ার মতো প্রশ্ন করলো
— কেন?
— কেন মানে?
তিনসেকেন্ড পর থম মেরে যাওয়া গলায় তিন্নি বললো — এখনই কেন? এতো জলদি?
একটুর জন্য চুপ থেকে একটা ভুরু উঁচিয়ে অভিমন্যু প্রশ্ন করলো, চোখে ওর মিটিমিটি হাসি লেগে — কেন, আমাকে তোমার পছন্দ হয় নি? বিয়ে করবে না? কাল রাতে তো আপত্তি করলে না?

চোখ পাকিয়ে তাকালো তিন্নি তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
বিয়ে!
কাল রাতের মুহুর্তগুলো ছিল একান্ত ব্যক্তিগত কিছু সময় যা আর কারো সাথে শেয়ার করার নয়। চুড়ান্ত উন্মাদতা, পরষ্পরকে প্রথমবার পাওয়ার নেশায় দুজনেই আর নিজেতে ছিল না। তা বলে রেজিস্ট্রি? এখনই?
বিয়ে শব্দটা শুনলেই বুকের ভিতর থেকে কেমন একটা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে তিন্নির, মনে হয়, সব স্বাধীনতা খর্ব। কারো একজনের কর্তৃত্বে, অধীনে থাকা সারাজীবন, এক্সপেকটেশন পূরণ করার সামাজিক চাপ। বিয়ের পর যদি অভিমন্যুর সাথে এই পাগলকরা সম্পর্কটার কোনো অস্তিত্ব না থাকে? যদি সেই দুর্বিনীত আ্যডভেঞ্চার, গা ছমছমে রোমাঞ্চকর গোপন প্রেমগুলো হারিয়ে যায়? নাহ্! এই বাঁধনছেঁড়া উদ্দাম প্রেম হয়তো থাকবে না আর। হয়তো থাকবে একজন শান্ত স্ত্রীর নতমুখের কর্ত্যব্য পালনের দাবি।
কয়েক সেকেন্ডে কয়েক হাজার নেগেটিভ চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে নিমপাতা গেলার মতো মুখ হয়ে আছে তিন্নির।
অভিমন্যু অধীর আগ্রহে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখেও একটা প্রতিরোধ মেশানো কেঁপে যাওয়া গলায় বললো — এখনই রেজিস্ট্রি কেন? আরো কয়েক মাস পর হলে ক্ষতি কি! বিয়ে একটা অনেক বড়ো ব্যাপার অভিমন্যু, অনেক দায়িত্ব, সব কিছু পাল্টে যাবে!…..
অভিমন্যু এবার একটু গম্ভীর হলো। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বললো — আই নো দ্যাট, বাট রেজিস্ট্রি করে রাখলেও যেমন চলে আসছে তাই চলবে।
তিন্নি কিছু বললো না। নিস্পন্দ হয়ে বসে রইলো। কেমনজানি সবকিছু বড্ডো বেশি পারফেক্ট লাগছে, কি এক অজানা আশঙ্কায় বুক দুরদুর করে উঠলো ওর। তিন্নির ফ্যাকাসে হয়ে আসা মুখের দিকে কয়েকপল অবাক চোখে চেয়ে রইলো অভিমন্যু, বোধহয় পড়ে নিলো ওর মন। তারপর তিন্নির ঠান্ডা হয়ে আসা হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললো —- কেন ভয় পাচ্ছো সীমন্তিনী?

ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস হয়ে গেলো তিন্নি, অভিমন্যুর বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললো — তুমি আমাকে কতটুকু চেনো অভিমন্যু? ফোনে কথা বলা ছাড়া আমরা একে অপরকে কতটুকুই বা চিনি? হাতেগোনা কয়েকটা দিন মাত্র একসাথে সময় কাটিয়েছি! তোমার মনে হয় না বড্ডো তাড়াহুড়ো করছি আমরা?

একটা ঘন নিশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো অভিমন্যু। এবার একটু সিরিয়াস হয়েছে দেখে তিন্নি সাহস করে মনের কথাটা বলেই ফেললো —আমাকে একটু সময় দাও অভিমন্যু, মেন্টাল প্রিপারেশনের জন্য। তাছাড়া, বাড়িতে মানে … বাবাকে কি বলবে?
হেসে ফেললো অভিমন্যু। — তোমার বাবা তো রাজি।
আরেকবার চমকে উঠলো তিন্নি। বিষম খেয়ে বললো — বাবা রাজি মানে? তুমি কথা বলেছো? কখন বললে?
একটাও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দ হাসিতে ভরে রইলো অভিমন্যুর মুখ।তাই দেখে তিন্নির পরের প্রশ্নটাও ছিটকে বেরিয়ে এলো — আর মা?
— ম্যানেজ করে নেবো।
এবার আর না হেসে পারলো না তিন্নি। চিকচিকে চোখ নিয়ে অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে বললো
— খুব কনফিডেন্স তোমার, না?

হাত বাড়িয়ে তিন্নির গাল টিপে দিলো অভিমন্যু। হাসিমাখা গলায়্ বললো
— হুমম্…শুধু বৌ’টা মেনে গেলেই ল্যাঠা চুকে যায়।

চোখের না দেখা জলটা মিশে গেল গলায়, ভিজে আসা স্বরে তিন্নি বললো — আমি তো তোমারই অভিমন্যু। কাল রাতের পর থেকে নয়, শিয়ালদা স্টেশন ছেড়ে যাওয়া চলন্ত ট্রেনে সেই প্রথম দেখার দিন থেকে! মাত্র একটা কাগজের সই তোমার আমার সম্পর্কটা কি এমন বদলে দেবে?

একটা নিশ্বাস ফেলে অভিমন্যু আবার তিন্নিকে বসিয়ে নিলো কোলের ওপর। কড়াপড়া শক্ত আঙ্গুলগুলো খেলা করে গেলো তিন্নির ভিজে চুলে, খোলা পিঠে। এবার আর আপত্তি করলো না তিন্নি, চুপচাপ অভিমন্যুর হাতে নিজেকে ছেড়ে দিল। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আলতো হাতে ওর নিচু হয়ে থাকা চিবুক তুলে ধরে অভিমন্যু বললো — কাগজের সইটা করা থাকলে তোমার নামের সাথে আমার নামটাও জোড়া থাকবে ,সোনা। সবার থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, যখন খুশি আমার কাছে তুমি আসতে পারবে, আমার সাথে থাকতে পারবে… আরও যা যা করতে ইচ্ছে হয় তোমার, সব করতে পারবে…. আরো কিছু বলবো?

বলতে বলতে গলা ঘন হয়ে এলো অভিমন্যুর, তিন্নির ঠোঁটের পাশে, গালে ছুঁয়ে গেল আঙুল, সিঁথিতে এঁকে দিল একটা দীর্ঘ চুম্বন!
অভিমন্যুর বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো তিন্নি, ওর হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনতে শুনতে মনের মধ্যে ফুঁসে ওঠা প্রতিবাদী ঝড়গুলো শান্ত হয়ে এলো ধীরে ধীরে। নেশালু এই স্বরটার সাথে যে আর তর্ক করা যায় না। অনেকক্ষন চুপ করে থেকে বললো​ — নাহ! থাক!

স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো তিন্নি অভিমন্যুর গাঢ় বাদামী চোখের দিকে, ওর চওড়া কপাল, খাড়া নাক, ঠোঁটদুটো….. দৃষ্টি দিয়ে সবকটি ছুঁয়ে গেলো যেন। এই মানুষটিকে ও ভালোবাসে, এর জন্য ও সবকিছু করতে পারে, নিজেকে লুটিয়ে দিতে পারে, জীবন তো তুচ্ছ। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল তিন্নি, অভিমন্যুর হাত সরিয়ে কোল থেকে উঠতে গেলো, দুচোখ ভর্তি প্রশ্ন নিয়ে আটকে নিলো সে — কোথায় যাচ্ছো?

বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তিন্নি, মুখের ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। শুধু হার মেনে নেওয়া মৃদু গলায় বললো — ফোনটা নিয়ে আসি, সফ্টকপিগুলো মেল করে দিচ্ছি তোমায়।

একমুহূর্ত বোধহয় অভিমন্যুর বিশ্বাস হলো না তিন্নি কি বলছে। তারপর ওর গাঢ় বাদামী চোখদুটোয় বিদ্যুৎ জ্বলে উঠলো যেন। শক্ত করে তিন্নিকে চেপে ধরে ওর কানের মধ্যে ভরাটঘন গলায় বললো
— পরে করলেও চলবে। আপাতত শুধু দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আমার কাছে এসো।

কালরাতে ছাদের সেই উদ্দাম মুহুর্তগুলো আবার ফুটে উঠলো মনের দৃশ্যপটে। তলপেটের ভেতর থেকে সেই একই রকম অনুভূতিগুলো পাক খেয়ে খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে, উঠে আসছে গলার কাছে। সম্মোহিতের মতো তিন্নি তাকিয়েই রইলো অভিমন্যুর দিকে, ঠোঁটে ঠোঁট মেলানোর ঠিক আগের মুহূর্তে দূর থেকে ভাস্বতীদেবীর গলার আওয়াজ শোনা গেলো
— তিন্নি? কোথায় গেলি? জলখাবারটা খেয়ে যা।

নিষিদ্ধ চাহিদার চটকা ভেঙে গিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো তিন্নি।অভিমন্যুর এক্সপ্রেশন চেন্জ হলো না যদিও। একবারের জন্যও হাতের বাঁধন আলগা না করে ওর নরম বুকে মুখ ডুবিয়ে ফিসফিস করে বললো — এখন না, প্লিজ। পাঁচ মিনিট পর।

বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো যেন! এই ডাক, এই অনুরোধ তিন্নি ফিরিয়ে দেয় তার সাধ্যি কি। তাও জোর করে অভিমন্যুর হাত ছাড়িয়ে উঠে পড়লো সোফা থেকে, ওর আহত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই দরজার কাছে হালকা পায়ে উড়ে গেলো প্রায়! তারপর অভিমন্যুকে অবাক করে দিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়ার আগে রিনরিনে গলা তুলে চেঁচিয়ে উঠলো — পনেরো মিনিটে আসছি মা, একটা ইম্পরট্যান্ট ফোনকলে ব্যস্ত।

পেছন থেকে ততক্ষনে একজোড়া পুরুষালি হাত চাপা হাসির শব্দের সাথে সাথে ওকে জড়িয়ে তুলে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলেছে প্রায়।

**************************__****************************
উপসংহার

সাড়ে তিনসপ্তাহ পর ……
পিহু এখন জোর কদমে প্র্যাক্টিসে মেতে। হাতে আর এক বছরের কম সময়, প্যারা অলিম্পিকের সিলেকশন হতে।

শুভ এখন বারিন’দার জিম ছেড়ে রাজ্যসরকারের পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক করেছে পুলিশসার্ভিসে জয়েন করবে।

ভাস্বতীদেবী টিভি সিরিয়াল ছেড়ে এখন বাগানের গাছপালায় মন দিয়েছেন, মাঝে মাঝেই লোকাল ট্রেন ধরে পিহুকে দেখতে চলে আসেন দুই তিন বাটি রান্না ভর্তি করে। ওঁনার যত্নে সেই তিনতলার ছাদের বোগেনভোলিয়া আর গোলাপ গাছদুটো আকারে পরিসরে আরো বেড়েছে।

রঞ্জনবাবু আজকাল ফেসবুকে কবিতা পাঠ করেন। নিজের লেখাও দেন মাঝে মাঝে, হয়তো বেশি লোকে পড়ে না, তাও দুই তিনটে যা কমেন্ট পরে তাই নিয়েই সন্তুষ্টি।

ওহ্ হ্যাঁ!
তিন্নি আর অভিমন্যুর ম্যারেজ রেজিস্ট্রিটা হয়ে গেছে গত পরশু, সোশ্যাল ম্যারেজ আপাতত হোল্ডে আছে আগামী দুই এক বছরের জন্য, তিন্নির আপত্তি বা অনুরোধে। ঠিক হয়েছে, সপ্তাহে মঙ্গল থেকে শুক্রবার তিন্নি আর পিহু একসাথে সাথে কলকাতার বাড়িতে, শনিবার অফিস করে তিন্নি চলে যাবে শ্রীরামপুর – তার আর একটা বাড়িতে।

***************************জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহের রবিবার।
আজ অভিমন্যুর ফিরে যাওয়ার পালা, কোথায় কোন রাজ্যে পোস্টিং কেউ জানে না। পিহু আর তিন্নি দুজনে দুটো প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে অভিমন্যুর জন্য, সেই প্রদীপ জ্বলতে থাকবে অনন্তর, যতক্ষণ না সে পৌঁছে গিয়ে একটা খবর দেয়।

পৌষের মাঝে শীতের জমকালো ইনিংস, ভরপুর শীতের আমেজ সারা শহর জুড়ে। হনুমানটুপি আর শাল গায়ে জবুথুবু সবাই, হিমজমাট বিকেলে একটু ওম খুঁজতে ব্যস্ত। দক্ষিন কলকাতার অভিজাত লেনে প্রাসাদপম সাবেকি বাড়িটার ভারী লোহার গেটটার সামনে একটা সাদা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। লাল পশমিনা শাল আর সর্ষেহলুদ সালোয়ার কামিজ পড়া নরম মিষ্টি একটা মেয়ে ছলছল চোখে বিদায় জানাচ্ছে তার সদ্য “আইনত হ্যাজব্যান্ড”কে। বাদামী লেদার জ্যাকেট, মেটেরঙা ঢোলা ট্রাউজার্সে লম্বা, ছিপছিপে মেদহীন তামাটে চেহারার লোকটিকে দুর থেকে দেখেও মেয়েদের মনে হিল্লোল উঠবে বৈকি। দীর্ঘদেহী সেই বলিষ্ঠ পুরুষ তার তিনদিনের পুরোনো “আইনত বিবাহিত” স্ত্রীকে কলকাতা শহরের মাঝরাস্তার মোটামুটি ভিড়ে একটি চুমু খেলো, অনেকক্ষন ধরে। তারপর ট্যাক্সিতে উঠে পড়লো।

.
.
.
.

কেউ খেয়াল করলো না, একটু দুরে কালো হুডি আর কালো সানগ্লাস পড়া একটা লোক শীতের কলকাতার ঝরা বিকেলের ফোটো তুলতে তুলতে পাওয়ারফুল ডি.এস.এল.আর ক্যামেরাটি তাক করে তিন্নির অনেকগুলো ফোটো তুলে নিচ্ছে, বিভিন্ন আ্যঙ্গেলে, অনেকটা জুম করে। শেষ ফোটোটি তোলা রইল অভিমন্যু আর তিন্নির আলিঙ্গনবদ্ধ ফোটো। তিন্নির মুখ আউট অফ ফোকাস, অভিমন্যুর মুখটি অতিরিক্ত রকমের স্পষ্ট।
ক্রুর একটা হাসি ফুটে উঠলো লোকটার মুখে।
—- আই উইল ফিনিশ হোয়াট ইউ স্টার্টেড মেজর অভিমন্যু সেন।

*

*

*
***************সমাপ্ত (অথবা সমাপতন নয়) *****************

************ফিরে আসবো #সুর্য_ডোবার_আগে(দ্বিতীয়_অধ্যায়) নিয়ে।