সেই তুমি পর্ব-০৯

0
3070

#-সেই তুমি
#-পর্ব-৯
#-সানজিদা সন্ধি

আবির চৌধুরীর কথা শুনে সঞ্জয়ের মনে হলো কেউ যেন তার কানের মধ্যে গরম শিসা ঢেলে দিয়েছে! এসব কী বলছেন তিনি? আচ্ছা অদিতি কি নিজ থেকেই আহনাফকে ছেড়ে গিয়েছে? না কি সে কোনো কারণে বাধ্য হয়েছিলো আহনাফকে ছাড়তে?

সঞ্জয়ের জানামতে অদিতি ভীষণ ভালোবাসতো আহনাফকে। অপরদিকে আহনাফ সম্পর্কটাকে নিজের আয়ত্তে রাখতে চাইলেও কখনো সম্পর্কটাকে আগলায়নি। সে অদিতির প্রতি ভালোবাসার অধিকার থেকে তাকে সবসময় নানান বিষয়ে ফোর্স করতো কিন্তু কখনো তাকে বুঝতে চাইতো না। সময় দিতো না। কিছু কিছু সময়ে ভালোবাসার চেয়ে বোঝাপড়াটাই জরুরি হয়ে পড়ে।

সঞ্জয়ের মাথায় এখন একটাই চিন্তা! কী করে অদিতির খোঁজ পাবে সে। সঞ্জয়ের যে ভীষণ দরকার এখন অদিতিকে। এটা ঠিক দীর্ঘদিন কারো সাথে যোগাযোগ ছিলো না সঞ্জয়ের। তারমানে এই নয় প্রত্যেকের জন্য তার দুশ্চিন্তা হয়নি! সবার কথা জানতে ইচ্ছে করে নি তার!

রাত যত গভীর হতে লাগলো আহনাফের ছটফটানি ততো বাড়তে লাগলো! সঞ্জয়ের সাথে বাজে ব্যবহারের জন্য দুঃখিত সে। কিন্তু কী করতো সে? কেউ অদিতিকে নিয়ে মাতামাতি করলে শরীর জ্বলে ওঠে আহনাফের! অদিতি একটা ভণ্ড, প্রতারক মেয়ে। অদিতিকে নিয়ে ভাবনার মাঝেই হুট করে জাফনার চিন্তা মাথায় চলে আসে আহনাফের। আর এই এক মেয়ে হয়েছে! অকারণে আহনাফের জেদ বাড়াচ্ছে। শুরুর দিকের ঘটনার পরে আহনাফ ভেবেছিলো মোটামুটি একরকম শাস্তি দিয়ে জাফনার চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দেবে নিজের জীবন থেকে। তার জীবনে শুধু একটাই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর সেটা হলো অদিতি। কিন্তু না! এই জাফনা বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। জাফনার কথা ভাবতে ভাবতেই তার নম্বরে ফোন দিলো আহনাফ৷ স্কুলের একফাঁকে এটেন্ডনেস খাতা থেকে তুলে নিয়েছিলো নম্বরটা! কিন্তু কে জানে এটা তার বাবা মায়ের, না কি তার? বেশি কিছু না ভেবেই আহনাফ জাফনার নম্বরে কল দিলো।
কল রিসিভ হতেই আহনাফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ফোনের ওপাশ থেকে কেউ বলছে,”বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ অ্যা অ্যা, উফ ইচ্ছে করছে এই দত্ত কাকুকে গুলি মেরে উড়িয়ে দেই! কিন্তু গুলি মারবো কী করে? সে তো মরেই গিয়েছে! অ্যা অ্যা বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ! ” কথাগুলো শুনেই আহনাফ চমকে গেলো। জাফনা যে পড়তে পড়তেই ফোন উঠিয়েছে এটা সে ভালোই বুঝতে পারছে! কিন্তু সে যে ফোন রিসিভ করেছে এটা তার খেয়াল নেই? আর এভাবে কেউ পড়ে না কি? তবে জাফনার পড়ার ধরণ শুনে আহনাফ খিলখিল করে হেসে উঠলো! জাফনা ফোনটা কানেই ধরে রেখেছিলো। কারো হাসির শব্দে সে সম্ভিত ফিরে পায়। আননোন নাম্বার দেখে সে তড়িঘড়ি করে সালাম দেয় আর নিজের বোকামির কথা ভেবে মাথায় একটা চাটি মারে।

জাফনার সালাম শুনেই আহনাফের হাসির বেগ যেন ক্রমাগত বাড়তে লাগলো।হাসতে হাসতে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কী মনে করে যেন মুহুর্তেই মধ্যেই সে সামলে নিলো নিজেকে! সালামের জবাব দিয়ে বললো, ” তো এই হচ্ছে পড়াশোনার নমুনা তাইতো? এই তুমি অসম্ভব মেধাবী? ”

ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বর শুনেই জাফনা বুঝে গেলো এটা আর কেউ নয়, আহনাফই৷ মুহুর্তেই তার মেজাজ বিগড়ে গেলো৷ জাফনার এই নাম্বারটা দীপ্তি ম্যামের রেজিস্ট্রার খাতা ছাড়া আর কোথাও নেই। তবে কি আহনাফ সেখান থেকেই নিয়েছে সেটা? আর ফোন করে তাকে এসব কেন বলছে? তবে কি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছ থেকে কোনো নোটিশ পেয়ে সে জাফনাকে ফোন দিয়েছে? উফ তাহলে তো ভালোই খেলা জমবে এবার।

জাফনা নিজের রাগ প্রশমিত করে আহনাফকে বললো, ” আমি যে মেধাবী এটা কে বলেছে আপনাকে স্যার? আমি মোটেই মেধাবী নই! আর লেখাপড়া একটু বাজেই যাচ্ছে। আমাকে কী মনে করে ফোন দিলেন?”

জাফনাকে ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় ক্ষেপে উঠতে না দেখে আহনাফ একটু চমকেই গেলো! ভাবতে লাগলো কী ব্যাপার! এই মেয়ে ক্ষেপছে না কেন? তবে কি কালকে আমাকে নাকানি চোবানি খাওয়ানোর আশায় চুপ করে আছে? আহারে! বেচারি! কালই দেখবে কী হয়!

আহনাফের নিরবতা শুনে জাফনা বললো,”কী ব্যাপার স্যার? মনে হয় চুপসে গেলেন?”

আহনাফ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ” দ্যাখো জাফনা! খানিকটা আগে প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে বললেন তিনি আমাকে অন্য কলেজে ট্রান্সফার করিয়ে দিবে। শুনে আমি খানিকটা অবাক হই! তাকে কারণ দর্শাতে বললে তিনি বলেন কোনো এক পলিটিকাল লিডারের মেয়ে চায়না আমি কলেজে থাকি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সেটা তুমি! প্লিজ জাফনা তুমি বিষয়টা মিটমাট করে নাও। নয়তো আমি মরেই যাবো! আসলে কী বলোতো আমার স্ত্রী আট মাসের প্রেগন্যান্ট। এখন আমাকে অন্য কলেজে পাঠিয়ে দিলে তো আমার বউটা একা হয়ে পড়বে। তাকে নিয়ে এ সময়ে রিস্ক নিতে চাইনা। আসলে আমি বাড়ির অবাধ্যে গিয়ে বিয়ে করেছি তো তাই কেউ আমায় সাথে নেই। প্লিজ জাফনা এরকমটা করো না!”

আহনাফের কাঁদো কাঁদো গলা শুনে জাফনার কী যেন হয়ে গেলো। নরম গলায় কিছু বলতে গিয়েও গম্ভীর কন্ঠে সে বললো, ” ডোন্ট ওয়ারি। কালকে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে গিয়ে আমি বিষয়টা দেখে নিবো। আপনি চিন্তা করিয়েন না।” এরপর খট করে ফোনটা কেটে দিলো জাফনা। হুট করে তার বুকে কেমন যেন চিনচিন ব্যাথা করতে শুরু করলো। সেদিকে মনযোগ না দিয়ে বইয়ে মুখ গুঁজলো সে। কিন্তু কী এক অস্থিরতা যেন তাকে গ্রাস করেছে। কিছুতেই মন বসাতে না পেরে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে পড়ার টেবিল ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়লো সে।
আর এদিকে আহনাফ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আহনাফের সাথে পাঙ্গা নেওয়া এতো সহজ নয়। বাবার কাছে এ বিষয়ে কোনো কৈফিয়ত দিতে ইচ্ছুক ছিলোনা আহনাফ। তাই শর্টকাটে বিষয়টা মিটমাট করে নিলো সে। এতো সহজে কাজ হবে সেটা অবশ্য ভাবেনি। মেয়ের মন নরম আছে।

বিছানায় থাকা হেডফোনটা কানে দিয়ে আহনাফ ছাঁদে উঠলো। পুরো ছাঁদ বৃষ্টির পানি দিয়ে ভেজা। পানি পায়ে লাগতেই ঠান্ডায় গা কেঁপে উঠলো তারউপর শিরশির বাতাস। এসব উপেক্ষা করে আহনাফ গানে মত্ত হয়ে পড়লো। গান শুনলেই অদিতির কথা মনে তার। অদিতির কন্ঠ অসম্ভব মিষ্টি ছিলো। শুনলেই যেন ঘোর লেগে যেতো। আহনাফ গান খুব একটা ভালোবাসতো না। অদিতির গলার প্রেমে পড়ে গানের প্রতিও ভালোবাসা।
আহনাফ কোনো না কোনো স্থান থেকে অদিতির প্রতি ভীষণ রকম দূর্বল। এসব রাগ, জেদ সত্যি করে তার মন থেকে আসে না। যেটা মন থেকে আসে তা হলো কিছু সুন্দর মিষ্টি অনুভূতি। আর রাগ, জেদ, ঘৃণা আহনাফের নিজের তৈরি এক অদৃশ্য দেয়াল। আহনাফের অবচেতন মন অদিতিকে এখনো ভালোবাসে। কিন্তু রাগ,জেদের মিথ্যা দেয়াল তার সচেতন মনের সাথে অবচেতন মনের মিলন ঘটতে দিচ্ছে না।

রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতে মত্ত আহনাফ ছাঁদের রেলিং ধরে এক পলকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ! তবে আহনাফের মনে হচ্ছে সেখানেই যেন তার সমস্ত শান্তি।

গানের মাঝখানে ফোনের রিংটোন বাজায় স্ক্রিনে চোখ বুলালো আহনাফ। জাহিনের ফোন। আচ্ছা জাদু আছে না কি এই মেয়ের মাঝে? তার একটা ফোনই আহনাফের মনে প্রশান্তির নির্মল বাতাস বয়ে আনে। ফোন রিসিভ করতেই আহনাফ শুনতে পেলো জাহিনের খিলখিল করা হাসি। আর তার পাশেই জাফনার উচ্চস্বর৷ জাহিন বলতে লাগলো,” কী ব্যাপার! তোমার স্ত্রী কেমন আছে?” আহনাফ বুঝলো জাফনা ঘটনার সত্যতা জানার জন্য জাহিনদের বাসায় এসেছে। জাফনাকে যতটা বোকা ভেবেছিলো সে, জাফনা ততটা বোকা নয়। আহনাফ কোথায় যেন শুনেছিলো সুন্দরী মেয়েরা বোকা হয়। কিন্তু জাফনার ক্ষেত্রে বিউটি উইথ ব্রেণ কথাটা প্রযোজ্য।
জাহিনের কথা শুনে না ঘাবড়ে আহনাফ বললো, ” আমার স্ত্রী ভালো আছে! ” কারণ আহনাফ জানে জাহিন ঠিক বুঝতে পারবে আহনাফের এসব বলার পিছনে কারণ আছে আর জাহিন সব সামলাতেও পারবে।

চলবে,,,