#- সেই তুমি
#-সানজিদা সন্ধি
#-পর্ব-১০
জাহিনকে ফোনটা লাউড স্পিকারে দিতে বলে জাফনা পাশে দাঁড়িয়ে আহনাফ আর জাহিনের কথা শুনছে৷ জাফনার মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ ছিলো আহনাফের কথার উপর। তবে এখন সেটা কমে গিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ফ্ল্যাটে রওনা দিলো সে।
জাফনা চলে যাওয়ার পরপরই জাহিন আহনাফকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এসব কী বলেছো জাফনাকে? তোমার বউ প্রেগন্যান্ট মানে কী? আর তোমার বউ এলো কোথা থেকে?”
জাফনাকে থামিয়ে দিয়ে আহনাফ বললো,” আচ্ছা! তুই আগে বলতো জাফনা তোকে কী জিজ্ঞেস করেছে?”
বহুদিন পরে আহনাফের মুখে তুই ডাকটা শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো জাহিন। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো,” কতদিন পরে তুই করে ডাকলে! ”
আহনাফ মুচকি হেসে বললো,” তুই করেই তো ডাকি। কিন্তু সবার সামনে ডাকতে কেমন জানি লাগে ময়না পাখি। এবার তুই বলতো জাফনার কাহিনী। ”
জাহিন সোফায় বসে গালে হাত দিয়ে চোখদুটো বড়বড় করে বলতে লাগলো,” জানো ভাইয়া! জাফনা আপু এসে আমাকে বললো, আচ্ছা জাহিন, সেদিন তোদের বাসায় যিনি এসেছিলেন অর্থাৎ যার পিছনে তুই কাঁঠালের আঠার মতো চিপকে ছিলি সে কি বিবাহিত? আপুর কথা শুনে আমি ভাবতে লাগি আপু এসব হঠাৎ কেন জিজ্ঞেস করছে? সে তো অহেতুক কোনো কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না! আমি ওকে বললাম, সেটা তোমাকে বলবো কেন? আপু ধমকে বললো বল আছে কি না। কী ভেবে যেন আমি হ্যাঁ বলে দেই। তারপর আপু বলে আমি বিশ্বাস করিনা। যেই ছেলের বউ আছে তার পেছনে তুই চিপকে থাকবি। তাকে ফোন দিয়ে বল তার বউ কেমন আছে। আর তারপরই আমি তোমাকে ফোন দিলাম। তুমিও অকপটে স্বীকার করলে। কিন্তু আমি তোমাদের কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে এসব কী? আমায় বলো না ভাইয়া।”
পুরো বিষয়টা জাহিনকে পরে বলার আশ্বাস দিয়ে আহনাফ ফোনটা কেটে দিলো। আহনাফকে ছেড়ে অদিতির চলে যাওয়ার পরপরই আহনাফের জীবনে আরেকটা বড় ধাক্কা লাগে। তার জীবনের সবচেয়ে আদরের মানুষটা মৃত্যুবরণ করে। আর তারপরেই সে দেশের বাইরে চলে যায়। প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই প্রকৃতির নিয়মে আহনাফের খালি বুকটা পূরণ করতে চলে এসেছে জাহিন। আর জাহিন মেয়েটা এতো ভালো। আহনাফ যেন তার মাঝে ছুটকির ছায়া দেখতে পায়।
কল কেটে আহনাফ আবার গানে মত্ত হলো। ইয়ারফোন কানে খুঁজে দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতে মেতেছে সে।
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগলো আমার অকারণের সুখে
তোমার ঝাউয়ের দোলে
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
এই গানটা বাজছে এখন। গানটা শুনলেই আহনাফের কী যেন হয়ে যায় একটা। অদিতির স্মৃতিগুলো ভেতর থেকে ভীষণ নাড়া দেয় তাকে। একসাথে ফাল্গুন কাটানো।
অদিতির বাসন্তী শাড়ি পড়ে আসা। একসাথে বই মেলা ঘোরা। কিন্তু নাহ! সবকিছু ফেলে অদিতি একটা বাস্টার্ডের কাছে চলে গেছে। মুহূর্তেই মাথা খারাপ হয়ে গেলো আহনাফের। আহনাফ এখনো জানে না কার জন্য অদিতি তাকে ছেড়ে গিয়েছে। জানলে আর ছেলেটার খোঁজ পেলে হয়তো তাকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলবে আহনাফ। তবে অদিতির চলে যাওয়ার পেছনে কি আহনাফের ত্রুটি ছিলোনা? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো আহনাফ। তার অবচেতন মন তাকে বলে দিলো দোষ তারও ছিলো। সে কখনো অদিতিকে আগলায়নি। তার ভাবনা ছিলো অদিতি তো আমারই। তাকে নিয়ে এতো মাতামাতির কী আছে? কে জানতো! স্বার্থহীন অদিতি নিজের ভালোর জন্য একটা সময় স্বার্থপর হয়ে যাবে।
মেজাজ বিগড়ে যেতেই রেলিং এ জোরে লাথি মারলো আহনাফ। কাটা পা টাতেই আবার ব্যাথা। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। তবে এসব এখন আহনাফের মাথায় নেই।
শুধু অদিতিকে শাস্তি দেওয়াই তার লক্ষ্য। কেন ছাড়লো সে? কেন এতো স্বার্থপর হলো? কেন স্বার্থহীন থেকে তাকে আগলে রাখলো না। হাজারটা কেন এর ভীড়ে উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত আহনাফ।
নিজের সমস্ত জিনিসপত্র তন্ন তন্ন করে একটা ডায়েরি খুঁজতে ব্যাস্ত সঞ্জয়। ডায়েরিটা পেলে একটা সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া যাবে অদিতির খোঁজ পাওয়ার। ডায়েরিটা সঞ্জয় খুব যত্ন করেই রাখে। কিন্তু এখন প্রয়োজনের সময় খুঁজে পাচ্ছে না। প্রয়োজনের সময় কিছু খুঁজে না পাওয়ার চেয়ে বিরক্তিকর এবং বিব্রতকর কিছুই নেই। সঞ্জয় মাথা গরম করে খুঁজছে বলে আরো পাচ্ছে না। এখন রীতিমতো কান্না পাচ্ছে তার। মনে মনে কয়েকটা গালিও দিলো নিজেকে। ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ার পড়েই তার আলমারি খুলে দেখার কথা মনে পড়লো। এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে আলমারি খুলে পেয়ে গেলো তার কাঙ্খিত ডায়েরিটা। ডায়েরিটা সে কখন যে এখানে রেখেছিলো তার মনে নেই। প্রথম পাতায় চোখে বুলাতেই অদিতির নম্বর ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। নম্বর পাওয়ার পরেই তার মনে পড়লো অদিতি তো এখন এটা নাও ব্যবহার করতে পারে। কথাটা ভাবতেই সঞ্জয়ের বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে নম্বরটায় ডায়াল করতেই কারো কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। আর সঞ্জয়ের মনে এলো অদ্ভুত প্রশান্তি।
অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলো অদিতি। ইদানীং আহনাফের স্মৃতি তাকে বড্ড বেশি পোড়াচ্ছে। ফোনের রিংটোনে সম্বিত ফিরে পেয়ে পাশ ফিরে ফোন হাতে নিয়ে আননোন নাম্বার দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলো সে। নম্বরটা তার বহু পুরনো হলেও গুটিকতক মানুষ ছাড়া কেউ জানে না এটা। আর সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে চায় বলে এটাই ব্যবহার করে সে ইদানীং ।তাই কে ফোন দিয়েছে তা একটু ভাবালো তাকে। কাছের মানুষের নম্বর ভেবে ফোন রিসিভ করতে সে অবাকই হলো।
প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলো না অদিতি। এতদিন পরে পরিচিত একটা নাম শুনলো সে। এটা কি সত্যিই সম্ভব? এতদিন পরে কেন অতীতের মুখোমুখি অদিতি?
ফোনটা রিসিভ হতেই যেন সঞ্জয়ের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো। কন্ঠ শুনতেই সে বুঝতে পারলো এটা অদিতি। অদিতির কন্ঠস্বর ভীষণ চেনা সঞ্জয়ের। এতো বছরে মেয়েটার কন্ঠস্বর একটুও বদলায়নি। না কি বদলেছে। সঞ্জয় নিজেই বুঝতে পারছে না!অদিতিকে নিজের জীবনের চেয়েও সে বেশি ভালোবাসে সঞ্জয়। উহুম অন্যকিছু হিসেবে নয়। বন্ধু হিসেবে। শুধুই বন্ধু হিসেবে। তবে প্রাণপ্রিয় বন্ধুর থেকেও দূরে থেকেছে সে৷
পরিচয় পর্ব শেষ হতেই দুজনে কিছুক্ষণ নীরব থাকলো। এই নীরবতাই যেন অনেক কথা বলে দিচ্ছে। একটুপরে অদিতির ফোঁপানির শব্দ শুনতে পেলো সঞ্জয়। মেয়েটা এতো আবেগী!কাছের একজনকে পেয়ে নিজের সমস্ত আবেগ ঢেলে দিচ্ছে সে। সঞ্জয়েরও গলা ধরে এলো। কিন্তু অদিতিকে বুঝতে না দিয়ে বললো, ” অদিতি দীর্ঘদিন পরে আমাদের কথা। তবে নিজেদের কথা রেখে অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি। আমার ধৈর্য সহ্য বরাবরই ভীষণ কম। নিজের মনের খোরাক মেটাতে কে কী ভাবলো সেটা না ভেবে যা করতে হয় আমি করি! দীর্ঘদিন পরে আহনাফের সাথে কথা আমার, জানতে পারি তোদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুই নিজ ইচ্ছেতে ছাড়িসনি ওকে। নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিলো!” আমাকে বল সেটা! ”
এমনিতেই কদিন ধরে আহনাফের স্মৃতি বড্ড পোড়াচ্ছিলো অদিতিকে তারউপর আবার সঞ্জয়ের মুখে আহনাফের কথা। অদিতি ভীষণ ভালো করে চেনে সঞ্জয়কে তাই কথা না বাড়িয়ে অদিতি বলতে লাগলো, ” কারণ তো ছিলোই সঞ্জয়। আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম সম্পর্কটা থেকে। আহনাফ আগে থেকেই আমার প্রতি উদাসীন ছিলো! সেই সম্পর্কের শুরু থেকে। আমি তার জন্য দিনরাত পাগলামি করতাম। আমার খেয়াল রাখতো না সে, আমার কথা শুনতে আগ্রহ দেখাতো না।উপরন্তু অহেতুক অধিকার দেখাতো। হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমি এসবে। এমন কাউকে দরকার ছিলো সেই মুহুর্তে যে আমায় বুঝবে। আর পেয়েও গেছিলাম। তাই ছেড়েছি আহনাফকে!”
অদিতির কথা শুনে সঞ্জয় নির্বাক হয়ে গেলো। তার শব্দভান্ডারের সব শব্দ যেন তার ফুরিয়ে গিয়েছে। কোনো রকমে বলে উঠলো তোর থেকে এটা আশা করিনি অদিতি। নিজের স্বার্থের জন্য তুই! ছিহ!
অদিতি হুট করেই খিলখিল করে হেসে উঠে বললো, “হ্যাঁ রে! আমি স্বার্থপর। ভীষণ স্বার্থপর। কী করবো বল। আমারও যে একটু অগ্রাধিকার পেতে ইচ্ছে করতো। ভালোবাসা পেতে মন চাইতো। অনেক কথা থাকে যেসব সকলের অজানা। আর হ্যাঁ বাস্তবতা অনেক কঠিন। এরপরে কাউকে ভরসা করতে হলে বুঝে শুনে করিস। নয়তো আমার মতো যখন তার আসল রূপ বুঝবি তখন কষ্ট হবে। ”
ফোন কেটে অদিতি বোবা কান্নায় ফেটে পড়লো। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো। তুমি আমাকে একটু আগলে রাখলে আমাকে স্বার্থপর উপাধি পেতে হতোনা আহনাফ।
চলবে,,,
#- সেই তুমি
#-পর্ব-১১
#-সানজিদা সন্ধি
আহনাফের স্মৃতি গুলো ভেবে অদিতির কান্না যেন থামছেই না। কান্না করতে করতে অদিতির দম বন্ধ হবার জোগাড়। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। পেটের বাচ্চাটা যেন বলে উঠছে, “মাম্মাম! ও মাম্মাম! তুমি কাঁদছো কেন? আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! তুমি কেঁদোনা তো! ” জীবন কাকে কখন কোন পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করাবে কেউ আগে থেকে বুঝতে পারে না। অদিতি পুরনো স্মৃতিচারণে মত্ত হয়ে গেলো !
জানুয়ারি মাস, কলেজের সব শিক্ষার্থীদের এক্সকারশন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সবাই কক্সবাজার যাবে। ২ দিন ৩ রাতের ট্রিপ। রোল নম্বর অনুযায়ী বাসের সিট হওয়ায় অন্য সেকশনের ছেলেমেয়েদের সাথে পড়ে গেলো অদিতি। নিজের সব বন্ধুবান্ধবদের ছাড়া। অবশ্য কয়েকজনের সাথে তার পরিচয় ছিলো না এমন নয়। বাস চলতে শুরু করতেই গান বাজনা শুরু হলো। সবাই একটা ছেলেকে নিয়ে ভীষণ মাতামাতি করছে। অদিতি চেনে না তাকে। সবাই ছেলেটাকে গান গাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতেই সে ধমকে বলে উঠলো আমি গান গাইতে পারবোনা। ভালো লাগে না আমার। ছেলেটার কথা শুনেই পুরো বাস জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজমান। দায়িত্বরত শিক্ষকদের মুখও যেন কালো হয়ে গেছে। অদিতি মনে সাহস নিয়ে হঠাৎ করেই গান গাইতে শুরু করলো। অদিতির গানের গলা অসম্ভব ভালো। হুট করে কেউ গান গেয়ে উঠতেই সবার নজর তার দিকে চলে গেলো৷ অদিতিকে সব শিক্ষকেরাই চেনে। অন্য সেকশনের স্টুডেন্ট হলেও বাসের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে তাকে চেনে তার গানের গলার কারণে। বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রামে গান করে সে। তবে অদিতি ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে হওয়ার ক্লাসরুম আর লাইব্রেরিই তার জগত। খুব বেশি কাউকে চিনে না সে৷ অদিতি গান গেয়ে উঠতেই সবাই সমানতালে গলা মেলাতে লাগলো। পুরো বাস মেতে উঠেছে, ” অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন, পেলাম খুঁজে এ ভুবনে আমার আপনজন” গানের সুরে। এক ধ্যানে গান গাওয়ার পরে থামলো অদিতি। পুরো বাসে হাততালির রোল। এতোক্ষণ যে ছেলেটাকে নিয়ে মাতামাতি করছিলো সবাই সেই ছেলেটিও অদিতির দিকে ফিরে তাকালো। ছেলেটাকে দেখে অদিতির বুকে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো! কোনো মানুষ এতো সুন্দর হয় কী করে ভেবে পেলোনা অদিতি। শ্যামলা বর্ণের ছেলেদের ভীষণ পছন্দ তার। ফর্সা দেখলে অবশ্য মেয়েলি লাগে তার কাছে। সেই অদিতিই প্রথমবার কোনো ফর্সা ছেলেকে দেখে থমকে গেলো। সিল্কি চুল, চাপ দাঁড়ি, ছোট ছোট চোখ সবকিছু যেন নেশা ধরানো। জীবনের সতেরোটি বসন্ত পেরিয়ে আঠারো বসন্তে পা রাখতে না রাখতেই তার মনে ফাগুন হাওয়া লাগলো! হুম আজ অদিতি আঠারো বছরে পা দিয়েছে। এই দিনটা অন্যসব সাধারণ দিনের মতোই লাগে তার কাছে। খুব একটা বিশেষত্ব দেখে না সে এর মধ্যে। তবে আজ যেন তার মনে হচ্ছে দিনটা একটু না অনেক বেশিই স্পেশাল। হুট করে একজন শিক্ষকের ডাকে অদিতি হকচকিয়ে উঠলো! স্যার বললো আরেকটা গান গাইতে তাকে। অদিতি সবসময়ই এককথার মেয়ে। যেটা করবে না সেটা সরাসরি বলে দেয় আর তাকে দিয়ে সেটা কেউ করাতেও পারে না। তবে যেটাতে তার মন সায় দেবে সেটা করতে তাকে একেবারের বেশি দুবার বলতে হয় না। গান গাওয়ার ইচ্ছে থাকায় স্যার বলার সাথে সাথেই সে চট করে গাইতে শুরু করলো। ” মোর ভাবনার কী হাওয়ায় মাতালো! দোলে মন দোলে অকারণ হরষে। ” অদিতির গলায় যেন জাদু আছে। পুরো বাস সম্মোহিত হয়ে রইলো তার গানের জাদুতে৷ তার গান শেষ হতেি সব স্টুডেন্টরা সম্মেলিত ভাবে আনন্দ করতে লাগলো। আর অদিতির সমস্ত ভাবনা পড়ে আছে এখন তার সিট থেকে তিন সিট এগিয়ে সামনে বসা ছেলেটার দিকে! যেহেতু ছেলেটা তারই ক্লাসমেট তাই খুব একটা সমস্যা হবে না তার বিষয়ে ইনফরমেশন জোগাড় করতে। অদিতি তার পাশে বসা মালিহাকে জিজ্ঞেস করলো ছেলেটার ব্যাপারের! মালিহার সাথে তার আগে থেকেই পরিচয়। ছেলেটার কথা জিজ্ঞেস করতেই মালিহা ফোঁস করে উঠলো। বললো, ” অদিতি তুমি ওর কথা কেন আমায় জিজ্ঞেস করছো?”
মালিহার এমন আচরণের হেতু বুঝলো না অদিতি। সে তো শুধু জানতেই চেয়েছে একজনের ব্যাপারে। আর জানতে চাওয়া তো আহামরি দোষের কিছু নয়। এদিকে অদিতি তার প্রিয় মানুষের ব্যাপারে জানতে চাওয়ায় ফোঁস করে উঠেছে মালিহা। ছেলেটার নাম আহনাফ। কলেজের হার্টথ্রুব। শত শত মেয়েরা তার জন্য পাগল। সে ও পছন্দ হলে কাউকে ফেরায়না। বলা চলে প্লে বয়। তবে কোনো এক কারণে মালিহাকে পাত্তা দিচ্ছে না আহনাফ। এ কারণে কারো মুখে আহনাফের নাম শুনলেই জ্বলে ওঠে সে।
অদিতি এসব থেকে বরাবরই দূরে থাকায় আহনাফের বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু এখন তারও আগ্রহ জেগেছে আহনাফের জন্য।
অদিতিকে ভ্রু কুঁচকাতে দেখে মালিহা কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, ” আসলে কী বলোতো! তুমি যার কথা জিজ্ঞেস করছো সে হচ্ছে আহনাফ। কলেজের মেয়েদের হার্টথ্রুব আর বড়লোক বাবার সন্তান। আমি তাকে একদমই পছন্দ করিনা। সে একটা প্লে বয়। অনেক মেয়ের সাথেই সম্পর্ক তার!”
মালিহার কথা শুনে অদিতির মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো! জীবন প্রথম কোনো ছেলের প্রতি তার আগ্রহ জেগেছে আর সেই ছেলেই কি না এমন!
অদিতিকে মুখ কালো করতে দেখে মালিহা স্বস্তির প্রশ্বাস ছাড়লো। মালিহা চাইছিলো আহনাফের প্রতি অদিতির মনে যেন বাজে চিন্তা ঢুকে যায়। তাতে আর কিছু হোক বা না হোক। মালিহার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী তো কমবে।
আহনাফের ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য মালিহাকে ধন্যবাদ দিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে লাগলো অদিতি। এই দীর্ঘ পথ গান শুনেই পারি দেবে সে।
এদিকে আহনাফ অদিতিকে আগে থেকেই চেনে তার গানও শুনেছে। তবে আজকে অদিতিকে দেখে তার একটু অন্যরকমই লাগলো। হুট করেই মনে ধরে গেলো অদিতিকে।
আহনাফ ইতিমধ্যে বহু মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। অষ্টম শ্রেণি থেকেই রিলেশনে সে। কিছু না বুঝলেও কোনো আবেগ না থাকলেও টিনেজাররা অনেক সময় তথাকথিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আহনাফও তাদেরই একজন। একজনকে পছন্দ হয় তার সাথে দু এক মাস সম্পর্কে থেকে ব্রেকাপ করে। এমন ভাবেই অদিতিকে মনে ধরে তার। কিন্তু সে তো নিজ থেকে অদিতির কাছে যাবে না। অদিতিকেই আনবে সে নিজের কাছে। এই ভাবনা ভেবে সবার সাথে আনন্দে মেতে উঠলো আহনাফ। আহনাফকে সবার সাথে মিশতে দেখে শিক্ষকেরাও স্বস্তির নিশ্বাস নিলো। বড়লোকের ছেলে। গো ধরে থাকলেও বিপদ।
ফোনের শব্দে ভাবনার সুতোয় টান পড়লো অদিতির। ইদানীং ফোনটা তার ভীষণ অসহ্য লাগছে৷ স্ক্রিনে তার স্বামীর নম্বর দেখে সে রিসিভ করে কাঁদতে লাগলো আর বললো, “আহনাফের স্মৃতিরা তাড়া করছে আমাকে।”
তার স্বামী তাকে শান্তনা দিয়ে খুনসুটিতে মত্ত হয়ে পড়লো।
অদিতি অপর পাশের মানুষটার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠছে। লোকটা এতো ভালোবাসে তাকে। সে সাথে থাকলে মনে হয় আহনাফকে ছেড়ে সে সঠিক মানুষের কাছেই এসেছে। আর যাই হোক আহনাফের মতো অবহেলা করে না মানুষটা। বরংচ হাজারগুন ভালোবাসা দিয়ে অদিতিকে ভালো রাখে। মাঝে মাঝে কিছু সিদ্ধান্ত সঠিকও হয়ে যায়।
ঘরে এসে পায়ের ব্যাথায় কাতরাচ্ছে আহনাফ। বেশ ভালোই চোট লেগেছে তার। তারপরেও ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার বা মেডিসিন নেওয়ার কোনো লক্ষ্মণ নেই তার মধ্যে।
আতিয়া চৌধুরী আহনাফের কাছে আসার জন্য রেস্ট নেওয়া ছেড়ে উঠে এলো। আর তারপরেই আহনাফের গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলো সে। বেহুশ হয়ে আহনাফের কাছে এসেই তার পায়ে হাত দিয়ে চেক করতে লাগলো। আর ডক্টরকে ফোন দিলো। মায়ের ভালোবাসা কতো অদ্ভুত হয়। নিজে অসুস্থ অথচ ছেলের কী হয়েছে সেটা নিয়ে পাগল।
চলবে,,