সেই তুমি পর্ব-১৬+১৭

0
2467

# সেই তুমি
# পর্ব -১৬
# সানজিদা সন্ধি

সেই রাতের পরে অনেক কিছু বদলে যায়। আহনাফ নিজেকে দোষারোপ করে মনে মনে। অদিতিও অন্ধকারকে আপন করে নেয়। সামনে এইচএসসি অথচ অদিতি পারছে না লেখাপড়ায় মনযোগ দিতে। আহনাফ অনুতপ্ত বোধ করে অদিতির সামনে আসার সাহস করেনি। এদিকে অদিতিও নিজ থেকে আহনাফের সাথে যোগাযোগ করার অবস্থায় ছিলো না। সে মন প্রাণ দিয়ে চাইছিলো আহনাফ যেন তার সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় অদিতি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। ভুল বোঝে আহনাফকে। মান, অভিমান, বিচার বিবেচনা না করে ভুল বোঝাবুঝি তাদের সম্পর্ককে তেঁতো করে দিয়েছে। আহনাফ ভেবেছিলো অদিতিকে একা থাকতে দেওয়া উচিত এতে হয়তো সে কিছুটা সামলাতে পারবে নিজেকে। সব ভেবে আহনাফ নিজের জীবনে ব্যাক করে। জোরকদমে লেখাপড়া শুরু করে। আর অদিতি দিন দিন লেখাপড়ার থেকে বিমুখ হয়ে যায়। এইচএসসির দিন ঘনিয়ে আসে। আহনাফের প্রিপারেশন বরাবরের মতোই অসাধারণ হয়েছে। আর মেধাবী অদিতি এক রাতের করা অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে না পেরে লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার সমস্ত ভাবনা যেন সেই একরাতের ঘটনা নিয়ে।

অদিতির অবস্থা দেখে তার বাবা মা আহনাফের সাথে যোগাযোগ করে। অদিতি আর তার মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়েছে কি না জানতে চায় তারা। এরপর অদিতের অবস্থা সম্পর্কে জানায় আহনাফকে। সবটা শুনে আহনাফ ভেঙে পড়ে। সে ভেবেছিলো কী আর হয়েছে কী!

রাতে কাঁপাকাঁপা হাতে ফোন নিয়ে অদিতিকে কল দেয় আহনাফ। আহনাফের গলা শুনেই অদিতি কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিংকর্তব্যবিমূড় আহনাফ শান্তনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। দু’ঘন্টার কথা শেষে ফোন রাখে আহনাফ। অদিতিকে বোঝায় যা হয়েছে ঝোঁকের বসেই হয়েছে। সামনে পরীক্ষা তাই লেখাপড়ায় মন দিতে বলে অদিতিকে। সে কেন যোগাযোগ করেনি সেটাও বলে। আহনাফের সাথে কথা বলে অদিতি যেন প্রাণ ফিরে পেলো। নিজের ভেতরের জমানো সকল কষ্টগুলো আজ উগলে দিয়েছে। ভীষণ ফুরফুরে লাগছে তার। বই খোলার পরে খানিকটা ঝামেলাতেই পরে অদিতি। মাথা আউলিয়ে যায় তার। আহনাফকে ফোন দিয়ে লেখাপড়া নিয়ে ডিসকাস করে সারারাত ভর। বহুদিন পরের একটা সকালকে প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে অদিতির। আহনাফ কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে রাতে। অদিতি মন দিয়ে প্রশ্বাসের শব্দ শুনেছে আহনাফের। কী এক জাদু আছে যেন! ঘায়েল করে দেয় অদিতিকে।

পরীক্ষার পরে দুজনেই আশানুরূপ ফলাফল পায়। এরপর জীবনের আরো একটা নতুন অধ্যায়। অ্যাডমিশন টেস্ট, ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি। আহনাফ, অদিতি দুজনেই গভীর মনযোগ দেয় লেখাপড়ায়। কোচিং,বাসা, বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা সব নিয়েই জীবন। তবে তাদের সম্পর্কে আর কোনো সমস্যা হয়নি ততদিনে। দুজন দুই ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পরেই যেন জীবনের সমীকরণ বেশ বদলে যায়। দূরত্ব বাড়ে দুজনের। আহনাফ ভার্সিটিতে ওঠার পর নিজের বেপরোয়া স্বভাবে আরো বেশি ফিরে আসে। বন্ধু, বান্ধব, আড্ডা, পার্টি আরো কত কি! জীবনের নতুন একটা সূচনায় অদিতিকে অনাদৃত বস্তু জ্ঞান করে আহনাফ। সে তখন অদিতির চেয়ে বাকিসব নিয়েই বেশি ব্যাস্ত৷ ইন্ট্রোভার্ট অদিতি ভার্সিটিতে গিয়ে বেশ একলা হয়ে পড়ে। কলেজ জীবনের কারো সাথেই খুব একটা যোগাযোগ হচ্ছে না তার৷ সঞ্জয়ের সাথেই যতটুকু যোগাযোগ।

আহনাফ দিনদিন যেন অদিতির থেকে খানিকটা দূরেই সরে যাচ্ছে। ভেসে আসা কথায় অদিতি জানতে পারে আহনাফের নতুন গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। মাথায় আকাশ ভেঙে তার। আহনাফের কাছে সরাসরি জানতে চায় পুরো বিষয়টা। আহনাফ যা বলে তাতে কোনো সুস্থ মানুষের মেজাজ ঠিক থাকতে পারে না। অদিতি গম্ভীর গলায় আহনাফকে জিজ্ঞেস করে, ” আহনাফ তুমি না কি নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছো?”
অদিতির গম্ভীর গলা শুনে আহনাফ হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, ” হ্যাঁ জড়িয়েছি। মেয়েটার নাম লিনা। অনেক স্টাইলিশ বুঝলে? নিজে থেকে এসে প্রপোজ করেছে তাই আমিও একসেপ্ট করে নিলাম! ”

আহনাফের উত্তর শোনার পরে অদিতির রাগের চেয়ে কষ্ট বেশি হলো। বুকে অদ্ভুত চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়েছে তার। মাঝে মধ্যেই এরকমটা হয় তার সাথে। অদিতির গলা ভারী হয়ে গেলো। কন্ঠস্বর যেন ক্রমাগত রোধ হয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সে আহনাফকে বললো, ” আমার কী হবে আহনাফ? আমি যে তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া তো ভীষণ কষ্ট হবে আমার। তোমার উপর অন্য কেউ অধিকার ফলাবে অন্যকাউকে ভালোবাসবে এটা আমি কীভাবে মেনে নিবো?”

অদিতির কন্ঠ শুনে আহনাফ বুঝলো বিষয়টা খানিকটা গোলমেলে হয়ে গেছে। তারপরেও দমফাটানো হাসি দিয়ে সে বললো, ” ধুর! আমি তোমারই আছি। টাইমপাস করতে ইচ্ছে করছে তাই রিলেশনে জড়িয়েছি। ”
অদিতির পাল্টা উত্তর দেয়, আমার সাথেই টাইমপাস করো।

অদিতির কথা গুলো বোকা বোকা মনে হয় আহনাফের কাছে । আহনাফ সরাসরি বলে আমি নতুন কারোর সান্নিধ্য চাচ্ছি অদিতি। বোঝার চেষ্টা করো।

অদিতির আর কিছু বলার থাকে না। কিইবা বলবে সে। আহনাফ যা বলে সেটাই করে। কেউ তাকে তার মতামত থেকে দূরে সরাতে পারে না। এদিকে অদিতি না পারছে আহনাফকে কিছু বলতে আর না পারছে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে। কোন মেয়েটাই বা পারে তার প্রিয় মানুষের অধিকার অন্য কাউকে দিতে।
আহনাফের এরকম বেপরোয়া কাজকর্মের জন্য অদিতি ভেতর থেকে একা হয়ে পড়ে ভীষণ। এমন সময় তার জীবনে আসে নতুন একজন। যার আগমন তাকে হাসতে শিখিয়েছে। কঠিন পরিস্থিতিকে শক্ত হাতে সামলাতে শিখিয়েছে।

পুরনো স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আহনাফের দুচোখ ভরে উঠলো জলে। সে সময় যদি মরিচিকার পিছনে না ছুটে অদিতিকে আগলে রাখতো সে তাহলে হয়তো আজকের অদিতির বাচ্চাটা তার হতো। অদিতির চলে যাওয়ার পরে আহনাফ দেশের বাহিরে চলে যায়। দেশে ফিরে সে অদিতির বিষয়ে খোঁজখবর নেয়। জানতে পারে অদিতি বিবাহিত। আহনাফের সাথে সম্পর্ক পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই সে বিয়ে করে নেয় তার জীবনে আসা নতুন মানুষটিকে। আহনাফ অনেক চেষ্টা করেও অদিতির স্বামীর কোনো খোঁজ পায়নি। তবে অদিতি কোথায় আছে, কোন অবস্থায় আছে সবকিছু তার নখদর্পনে থাকতো। কদিন আগে আহনাফ জানতে পারে অদিতি মা হতে চলেছে। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে তার। আবারো একটা ধাক্কা খায় সে। কিন্তু কিছুই করার নেই।

ঘুম থেকে উঠে জাফনা বুঝতে পারে তার প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। বেডসাইড থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে। পানি খেতেই তার প্রচন্ড তিতকুটে ভাব অনুভূত হয়। জাফনার মা বেশকয়েকবার দরজার সামনে এসে ঘুরে গিয়েছেন। জাফনা লেখাপড়ায় বিষয়ে বেশ সচেতন। কলেজ বা টিউশনি ফাঁকি দেয় না। সেই জাফনারই আজ কোনো খবর নেই। অথচ টিউশনির সময় হলো বলে। জাফনা টেবিলে খেতেও আসেনি। শরীর খারাপ করেছে কি না এই চিন্তায় তিনি বারবার পায়চারি করছেন জাফনার ঘরের সামনে। ঘরের দরজার বেশ কয়েকবার টোকাও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সারা শব্দ না পেয়ে তার চিন্তার পরিমাণ আরো খানিকটা বেড়ে গেলো। আরেকবার টোকা দিতেই জাফনা সারা দিলো। তার কন্ঠস্বর কেমন যেন লাগলো। দূর্বল পায়ে উঠে দরজা খুলে দিলো জাফনা। তার মা গায়ে হাত দিয়েই চমকে উঠলেন। জাফনার শরীর প্রচন্ড গরম। মুহুর্তেই তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। জাফনাকে বিছনায় শুইয়ে দিয়ে খাবার আর ঔষধ আনতে চলে গেলেন। জাফনার মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। তার কাছে মনে হয় তার মা পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মা। প্রতিটা সন্তানের কাছেই মনে হয় এটা। আসলে পৃথিবীর প্রতিটা মা সুন্দর। সে যেমনই হোক না কেন তার ভেতরে যে মাতৃসত্তটা আছে তার সৌন্দর্যের বর্ননা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একজন মানুষ ব্যাক্তি হিসেবে অনেক রকম হতে পারেন কিন্তু মা হিসেবে সে সবসময়ই তার সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ ভাবেন।
চলবে,,,,,,

#সেই তুমি
#পর্ব ১৭
#সানজিদা সন্ধি

একজন মানুষের মাথায় অনেক সময় অনেক উদ্ভট চিন্তা আসে। যেগুলোর কোনো যুক্তি নেই। কোনো যুক্তি দিয়ে বিচার করাও সম্ভব নয়। তেমনই জাফনার এখন ইচ্ছে করছে আহনাফের সাথে ঝগড়া করতে। কেন এই ইচ্ছে সেটা তার হয়তো অজানা আর নয়তো সে কিছু বুঝতে পেরেছে। জাফনার মনে হচ্ছে এই এক্ষুনি যদি সে আহনাফের সাথে ঝগড়া করতে পারে তাহলে তার জ্বর তার সাথে ব্রেকাপ করে চলে যাবে। তাই অতশত না ভেবে জাফনা আহনাফকে ফোন দিলো। জাফনার নম্বর ফোনে দেখে আহনাফ রিসিভ করলো তারপর জাফনার উদ্ভট কথাবার্তা শুনে ঘাবড়ে গেলো। ওপাশে ফোন রিসভ হতেই জাফনা কোমল স্বরে বললো, ” আজ আপনি ক্লাসে আমাকে ধমকেছিলেন কেন? আমার কষ্ট হয়নি বুঝি? কেন ধমকালেন বলুন। ” তারপরেই ঝগরুটে কন্ঠে জাফনা বললো,” এই আপনি কেন আমাকে বকেছেন হ্যাঁ? আমি আপনার মা,মেয়ে, বোন না কি বউ লাগি? কেন বকলেন?” বলেই আহনাফকে কোনো ধরনের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে খট করে ফোন কেটে দিলো। জাফনার এখন ভীষণ ভালো বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে যুদ্ধ জয় করে এসেছে। জ্বরটাও কমে গিয়েছে না কি? কে জানে! জাফনা একনাগাড়ে অভিযোগ করে ফোন কাটার পরে আহনাফ বিড়বিড় করে বলে এমন অদ্ভুত মেয়ে আমি আমার গোটা জীবনে দেখিনি। এ মেন্টালি ঠিক আছে না কি সেটা নিয়েও আহনাফের জোরালো সন্দেহ হচ্ছে। নয়তো কেউ কোমল স্বরে কথা বলার পরেই আবার ধমকে ওঠে কীভাবে।

সারাদিনের কোলাহলকে সঙ্গী করে একটা দিন গোধুলির সান্নিধ্যে চলে এসেছে। শীতকাল তাই সন্ধ্যা তাড়াতাড়িই হয়। আহনাফের ড্রইং রুমে টিভি চলছে। কী যেন একটা সিরিয়াল! তারা খালা বসে বসে মনযোগ সহকারে দেখছেন। আহনাফকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখেই তিনি তড়িঘড়ি রিমোট হাতে টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করতে উদ্যত হলেন। আহনাফ এসব একদম পছন্দ করে না। অনেকবার তিনি তারা খালাকে এসব দেখতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু তারা খালার নেশা যেন কাটে না। সুযোগ পেলেই টিভির সামনে এসে সিরিয়াল খুলে বসেন তিনি। কোন চরিত্রের কী হলো এসব তাকে বড্ড ভাবায়। তাদের দুঃখে হাসেন আবার তাদের দুঃখে কাঁদেন। আহনাফ টের পেলো তারা খালা সিরিয়াল দেখছেন। বরাবরের মতো শান্ত স্বরে সে বললো এসব দেখা ভালো নয় খালা। অন্যকিছু দেখতে পারো তুমি। বলেই হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলেন বাড়ির বাগানটায়।

লাইটের আলোয় উজ্জ্বল বাগান। শিরশিরে বাতাস বইছে। বাগানের দোলনাটায় বসে আহনাফ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। দেশে ফেরার পরে অদিতিকে খুন করার প্ল্যান করে আহনাফ। কারণ যে আহনাফকে কষ্টে রেখে সুখে আছে তাকে আহনাফ কিছুতেই সুখে থাকতে দেবে না। সবকিছু ভেবেই রেখেছিলো সে। এ অনুযায়ী কিলারের সাথে সমস্ত হিসাব কষেছিলো। যার একটা ফোনের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে থাকতো আহনাফ। কখন, কীভাবে, কোন অবস্থায় অদিতিকে মারবে সব যেন ছক কষা। তবে যখন আহনাফ জানতে পারলো অদিতি মা হতে চলেছে মুহূর্তেই সে থমকে গেলো। অদিতিকে এখন কীভাবে খুন করবে সে? অদিতির পেটে যে একটা নিষ্পাপ প্রাণ বেড়ে উঠছে। আহনাফ কী করে তাকে খুন করবে। অদিতি নাহয় আহনাফকে ছেড়ে গিয়েছিলো বলে তার প্রতি আহনাফের রাগ। কিন্তু বাচ্চাটা তো কোন অন্যায় করে নি। আহনাফ কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে গেলো। মানসিক যন্ত্রণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অদিতিকে শাস্তি না দিতে পারলে সে শান্তি পাবে না। কিন্তু শাস্তি দেবেই বা কীভাবে। আহনাফের অবস্থা এখন শাঁখের করাতের মতো। কোনো দিকেই যেতে পারছে না সে। দোলনায় দোল খেতে খেতে আহনাফের মাথায় আগের দিনগুলোর কথা এলো। আসলে তালি কখনো একহাতে বাজেনা। যেকোনো ঝামেলায় দুতরফেরই দোষ থাকে। তবে কারো হয়তো কম আর কারো বেশি । আহনাফ অদিতিকে অবহেলা করেছে ঠিকই। কিন্তু অদিতি তো ধৈর্য ধরে আহনাফকে আগলাতে পারতো। বেঁধে রাখতো পারতো। আসলে সে মুহূর্তে কী হলে কী হতো সেসব ভাবতে পারছে না আহনাফ। নিয়তি ভেবে সেসব নিয়ে মাথা ঘামানো ছাড়লো। কিন্তু বেহায়া মনটা তার মস্তিস্ককে আবার পুরনো দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। অদিতির হাসি,কান্না কথা বলার ভঙ্গি মনে পড়তেই আহনাফের অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগলো।

আহনাফ বরাবরই ভীষণ রাগি একটা ছেলে। তবে অদিতি খুব স্মুদলি তাকে সামলাতে পারতো। তাই এখনো যখন সে রেগে ওঠে অদিতির কথা মনে আসে তার। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। অদিতি নেই তার রাগ সহ্য করার জন্য। সামলানোর জন্য।

রাত বারোটা। ল্যাপটপের কি বোর্ডে খটখট শব্দ তুলে টাইপ করছে আহনাফ। স্টুডেন্টদের ক্লাস টেস্টের জন্য প্রশ্ন রেডি করছে সে। এমন সময় মালিহার ফোন এলো। আহনাফের চোখমুখ কুঁচকে গেলো। বিড়বিড় করে বললো, “অসহ্যকর! ফোন দেওয়ার আর সময় পেলো না!”

ফোন রিসিভ হতেই মালিহা খানিকটা আদেশের সুরে বললো কাল আমার সাথে রেস্টুরেন্টে মিট করবে। যা শুনে আহনাফের মেজাজ বিগড়ে গেলো। আহনাফ বললো,” তুমি আমাকে অর্ডার করার সাহস পাও কীভাবে? আমি কেন তোমার সাথে মিট করবো। মালিহা ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে বললো তুমি আমার সাথেই মিট করবে। কাল থেকে বিয়ের প্ল্যান করবো আমরা। মাঝরাত্তিরে মালিহার অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তা আহনাফের মেজাজ বিগড়নোর জন্য যথেষ্ট। একেই নিজের জীবনের নানান সমস্যা, চিন্তায় আছে সে তারউপর আবার মালিহার ফ্যাঁচফ্যাচানি। রেগে গিয়ে তুইতোকারি শুরু করলো আহনাফ। বললো,” তুই কে রে? আর আমাকে অর্ডার করার সাহস পাস কীভাবে? স্টুপিড মেয়ে। সাহস বেড়েছে খুব? কলেজ জীবন থেকে পিছনে পরে আছিস এখনো আমাকে জ্বালাচ্ছিস। তখন তো ভালোই হেবলি আর ভীতু ছিলি। এখন এতো কলিজা বাড়লো কীভাবে?”

মালিহা বললো,” তখন বোকা ছিলাম ঠিকই। কিন্তু এখন আর নেই। আমি তোমাকে চাই আহনাফ। এবার তো তোমাকে আমার করেই নেবো। কি? হবেনা আমার? ”

মালিহা কলেজ থেকেই আহনাফের জন্য পাগল। জেদ থেকেই বেশি করে পেতে চায় আহনাফকে। কিন্তু আহনাফ কেন যেন অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ালেও মালিহার প্রতি আগ্রহী হয়নি কখনো। যা মালিহার জেদ ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো। অনেকবার প্রপোজ করেছে সে আহনাফকে। কিন্তু আহনাফ কখনো গ্রহণ করেনি। ভার্সিটিতে ওঠার পরেও মালিহা পিছু ছাড়েনি আহনাফের। কিন্তু আহনাফের উত্তর না তেই আটকে আছে। এরপর হুট করে হারিয়ে যায় মালিহা। নিজেকে প্রস্তুত করে সবদিক থেকে। নিজের রাগ বাড়ায়। ভয় ভীতি কমায়। আর এখন যখন সে আহনাফের এতো কাছাকাছি তখন কী করে আহনাফকে যেতে দেয় এবার।

মালিহার ট্যারাট্যারা কথা শুনে ফোনটাই আছাড় মারলো আহনাফ। এরপর আবার প্রশ্ন তৈরীতে মত্ত হলো।

ফোন কেটে যাওয়ায় মালিহা হতাশ হলোনা খুব একটা। দেখা তো হবেই তাদের। কলেজে থাকতে অদিতি,ভার্সিটিতে উঠে অদিতির সাথে যুক্ত হয়েছিলো আরো কয়েকটা মেয়ে। মালিহা আর সুযোগ পেলো কই!

জাফনা বিছানায় শুয়ে সিলিং এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে ভেতর থেকে অনুভব করতে পাচ্ছে আহনাফের প্রতি তার দূর্বলতা। সে নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত। অনুভূতিগুলো অন্য কারো প্রতি আসতে পারলো না? এটা যে নিছক ভালো লাগা নয় সে জাফনা ভালো মতোই বুঝতে পারছে। এর আগেও জাফনার কিশোরী মনে অনেকের প্রতি ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু আহনাফের জন্য এখন যেমন লাগছে তা কারো জন্যই অনুভব করেনি জাফনা। আহনাফের মতো একটা কর্কশভাষীর প্রেমে পড়েছে ভাবতেই নিজের প্রতি ক্রমশ বিরক্তি বাড়তে লাগলো জাফনার। এসব কোনো কথা? মনে মনে জাফনা বলতে লাগলো, ” হুর! কী মন আমার! প্রেমে পড়ার জন্য আর কাউকে পায়নি? স্ট্রেঞ্জ! এখন আমি এই রাক্ষস টাকে কীভাবে প্রেম নিবেদন করবো? এসব বললেই তো কাঁচা গিলে ফেলবে আমাকে। কিন্তু তাকে কিছু না বলেও তো আমি শান্তি পাবোনা। আগেরবার ডেয়ারের জন্য আই লাভ ইউ বলেছিলাম এবার সত্যি সত্যি বলতে হবে। এ কী নিয়তি! ”

চলবে,,,