সেই তুমি পর্ব-১৯

0
2288

#সেই তুমি
#সানজিদা সন্ধি
পর্ব ১৯
ছয় তলা থেকে নিচের দিকে তাকাতেই মাথা চক্কর কেটে উঠলো জাফনার। ক্ষুধার্ত শরীরে পড়ে যাওয়ার অবস্থা প্রায়। শেষবার সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে পিলার ধরে এক পা এগিয়ে দিলো সে। তারপরেই কী যেন ভেবে রেলিং থেকে মুহূর্তের মধ্যেই নেমে গেলো ৷ এতক্ষণে সে বুঝে গিয়েছে আর যাইহোক এখান থেকে ঝাঁপ দেওয়া তার কর্ম নয়।

জাফনাকে নামতে দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো আহনাফ। জাফনাকে উপরে উঠতে দেখেই সে নিঃশব্দ পায়ে উপরে উঠে এসেছে তার পিছুপিছু। জাফনা খেয়াল করে নি। হাসতে হাসতে আহনাফের জান যায় অবস্থা। হাসির তালে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না সে। কোনোরকমে জাফনার কাছে গিয়ে হাসি থামালো। তারপর বলতে লাগলো,” হলো তো বাহাদুরি দেখানো? শুধুশুধু বোকার মতো কষ্ট করে ছয় তলা অবধি উঠলে। শুনো তোমার সম্পর্কে এতদিনে যতটুকু বুঝেছি তাতে কিছুসময় তোমাকে বোকা আবার কিছুসময় বুদ্ধিমান মনে হয়েছে। আমি জানতাম তুমি লাফ দেবে না। মোটামুটি একটা ধারণা ছিলোই৷ আর একটা সত্যি বিষয় জানো? তুমি যদি লাফ দিয়ে পড়ে মরে যেতে তাহলে আমার তোমার জন্য বিন্দুমাত্র সহানুভূতি আসতো না। কারণ যেই মেয়ে কয়েকদিনের পরিচয়ে অন্য একটা ছেলের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নিজের সুন্দর জীবন বিসর্জন দিতো তার জন্য আবার কীসের সহানুভূতি। শোনো জাফনা৷ জীবন ভীষণ মূল্যবান। এই জীবনটাকে ভালোবাসতে শিখতে হয়। আমি সেইসব মানুষকে সম্মান করি যারা নিজেকে ভালোবাসে। তবে হ্যাঁ তোমাকে এটাও দেখতে হবে নিজেকে ভালোবাসতে গিয়ে, নিজে ভালো থাকতে গিয়ে তোমার সাথে সম্পর্কিত কারো জীবন যেন নষ্ট না হয়।”

শেষের কথাগুলো বলে কিছুটা সময় উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালো আহনাফ। আর জাফনা এদিকে হা হয়ে আহনাফের কথাগুলো শুনলো। আহনাফের প্রতি কেন জানি হুট করেই অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো। এই ভালো লাগা আগের সব মুগ্ধতাকে হার মানায়।

নিজের কথা শেষ করে জাফনাকে ধমকালো আহনাফ। বললো, ” শুধু ফাঁকি বাজির তাল তাইনা? জলদি ক্লাসরুমে যাও। আর আজকে যদি ঠিকঠাক ভাবে প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারো তাহলে পুরো ক্লাস কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবো।

জাফনাও মুচকি হেসে বললো, ” ইস কী যে বলেন না স্যার! সবার সামনে আপনার কান ধরবো কীভাবে আমি? আমার বুঝি লজ্জা করবে না?” জাফনার কথা শুনে আহনাফ বোকা বনে গেলো। এই মেয়ে কনফিউজিং। ভীষণ কনফিউজিং।

জাফনা দ্রুতপদে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ক্লাসরুমের দিকে এগোলো। আহনাফ সেখানে থেকেই কাকে যেন ফোন করে বললো, “অদিতির মার্ডার প্ল্যান ক্যানসেল করে দাও। তার গায়ে যেন হাত না পরে এখন! ” আহনাফ বহু ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অদিতিকে সে খুন করবে না। সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পরপরই খানিকটা অসহায় লাগছিলে তার। এতদিন ধরে মনকে বুঝিয়েছিলো অদিতিকে খুন করার জন্য। যখন মন বুঝে গেলো মনের মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়ায় আকাঙ্খা তৈরি হলো তখনই আবার মনকে বোঝাতে হচ্ছে অদিতিকে না মারার জন্য। তবে আজ রাতে অদিতির সাথে দেখা করতে যাবে আহনাফ। বেশ কয়েকবছর পরে মুখোমুখি হবে তারা। বিষয়টা ভেবেই আহনাফের মধ্যে নানান রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া হতে শুরু করলো৷ আহনাফের মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো নানান প্রশ্ন। অদিতি কি তাকে দেখে জড়িয়ে ধরবে? ফিরতে চাইবে তার কাছে? বিগত ভুলের জন্য অনুতপ্ত হবে? পরক্ষণই তার ভেতরের থাকা আরেকটা সত্তা তাকে উত্তর দিলো। অদিতি কেন ফিরে আসতে চাইবে? সে তো ভালো আছে। সে যদি ভালো না থাকতো তাহলে একটা কথা ছিলো। একই শহরে অদিতি, আহনাফ। কিন্তু কারো সাথে কারো দেখা সাক্ষাৎ নেই। সৃষ্টিকর্তা যদি একদিন মাঝরাস্তার কোলাহলে তাদের দেখা করিয়ে দিতো কিংবা বিরোধীদলীয়দের হরতালের দিন। যেদিন সারা শহরে ভাঙচুর চলতো একটা স্থানে আহনাফ অদিতি আটকা পরতো। অদিতি অতীতের স্মৃতি বুকে পুষে রেখে তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইতো। কিন্তু শেষ মেশ অন্য কোথাও ভরসা না পেয়ে তার বুকে আশ্রয় খুঁজতো। ইস যদি হতো এমনটা। তবে আহনাফ বোধহয় শেষবার অদিতিকে জড়িয়ে ধরে তাকে না পাওয়ার আক্ষেপ বুকে নিয়ে তাও সুন্দর ভাবে বাঁচতে পারতো। কিন্তু বাস্তবতা তো নির্মম। পাষন্ড। এসব শুধু কল্পনাতেই সম্ভব। যতো যাইহোক আহনাফ অদিতিকে ভালো তো বেসেছিলো এখনও বাসে। যদি আগলে রাখতো তবে গল্পটা হয়তো অন্য হতো। অদিতি নিজে ভালো থাকতে গিয়ে আহনাফকে বিক্ষত করলো। আহনাফও অদিতিকে কষ্ট দিয়েছিলো। আসলে দোষ যারই হোক সৃষ্টিকর্তাই তাদের মিলন চায়নি। চাইলে হয়তো গল্পটা অন্যরকম হতো।

আহনাফও দ্রুতপদে নিচে এলো। আজ রাতটা তার জন্য ভীষণ গুরত্বপূর্ণ। আজ কী হবে সে জানে না৷ তবে অদিতির সাথে দেখা করাটা তার জন্য গুরত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এভাবে আর কতদিন বাঁচবে সে।

অদিতির শরীরটা গতকাল রাত থেকেই খারাপ করছিলো। সকালে যেন বিষয়টা বাড়লোই। একটা মেয়ের গর্ভকালীন সময়ে স্বামী আর পরিবারের সাহচর্য সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। কিন্তু অদিতি কিছুই পাচ্ছে না। পাবেই বা কী করে! আহনাফের সাথে ছাড়াছাড়ির পরে অদিতির সাথে তার পরিবার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলো। আর তার স্বামী তার সাথে থাকে না কারণ সে চায়না তার পরিচয় কেউ জানুক। সে বরাবরই নিজেকে আড়ালে রেখেছে। কখন কোথায় কীভাবে যায় কেউ জানে না। মাঝখানে কদিন অদিতির সংস্পর্শে এসেছিলো কিন্তু আবার উধাও হয়েছে সে। অদিতি নিজের শারীরিক অবস্থা খারাপ বুঝে তার স্বামীকে ফোন করলো। কথা বলা শেষ করে অসুস্থ শরীর নিয়েই ঘর আর নিজেকে সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

জাফনা ক্লাসে এসে বইয়ে কম আহনাফের চিন্তায় বেশি মগ্ন হলো। সে ভাবছে আজ বাসায় গিয়ে তার বাবাকে বলবে, ” বাবা শোনো! আমি আমার স্যারকে ভালোবাসি৷ বিয়ে করতে চাই৷ তুমি ব্যাবস্থা করো। ” তার বাবা নিশ্চয়ই ঘাবড়ে যাবে। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইবে তার দিকে। তারপর বলবে, তুমি সত্যি বিয়ে করবে মা? না কি প্র্যাংক করছো আমার সাথে? একটুপরেই বলবে, না বাবা আমি বিয়ে করবো না। ভালো লাগছে না। জাফনার বাবার কথা শুনে সে চোখ গোলগাল করে তাকাবে। তারপর বলবে, ” আমি মোটেই প্র্যাংক করছিনা বাবা। আমি সিরিয়াস! ” কথাটা শুনেই তার বাবা নাচতে নাচতে বিয়ের আয়োজন করবে। একে একে সবাইকে জানাতে উদ্যত হবে। আর জাফনা খানিকটা ভ্রু কুঁচকে বলবে বাবা পাত্রকে রাজি করাতে হবে। সে বোধহয় সহজে রাজি হবে না। জাফনার কথা শুনে সাজ্জাদ খানের মুখ কাঁচুমাচু হয়ে যাবে। এরপর একটা বোকাবোকা হাসি দেবে সে।

সাজ্জাদ খান চৌকস, বুদ্ধিমান রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। কিন্তু মেয়ের কাছ আসলেই যেন তিনি বাচ্চা হয়ে যান। বোকাবোকা সব কাজকর্ম করেন।

জাফনা পুরো বিষয়টা ভেবে আপনমনে খানিকটা হাসলো। তারপর মনিরা ম্যাম ক্লাসে আসতেই দাঁড়িয়ে গেলো। মনিরা ম্যাম জাফনার অন্যতম প্রিয় শিক্ষকদের একজন। বাংলা পড়ান তিনি। মনিরা ম্যামের ক্লাস শেষ হতেই আহনাফ ক্লাসে এসে ঢুকলো৷ দশমিনিট পড়া রিভিশন করতে দিয়ে শুরুতেই জাফনাকে পড়া ধরলো। আহনাফকে দেখেই জাফনার পড়া গুলিয়ে গেলো। আমতা আমতা করতে লাগলো সে। আর জাফনার পারফরম্যান্স দেখে আহনাফ বেদম ধমক দিলো। চেঁচিয়ে বললো, ” এই তোমার সমস্যাটা আসলে কোথায় বলোতো ! আমার জানামতে তুমি একটা ভালো স্টুডেন্ট। কিন্তু তোমার ভালো পারফরম্যান্স আমি একদিনও দেখলাম না। ”

জাফনা খানিকটা নেকি সুরেই বললো সে কি আমার দোষ না কি স্যার? আপনাকে দেখলেই তো পড়া গুলিয়ে ফেলি আমি।

জাফনার উত্তর শুনে আহনাফ বললো ঠিকমতো পড়াশোনা করে আসলে কখনোই গুলাতে না। সব লেইম এক্সকিউজ।

কিন্তু জাফনা তো জানে এসব সত্যি কথা।

অদিতি, আহনাফ, জাফনা, স্বাভাবিক কাজকর্মের মধ্যে থেকেও তাদেরই তিনজনের মাথায় চলছে আলাদা আলাদা চিন্তা।
কেউ নতুন জীবনে প্রবেশের প্রত্যাশায়। কেউ প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আবার কেউবা অতীত ভোলার প্রচেষ্টায়।

চলবে,,