#সেই তুমি
#পর্ব ২০
#সানজিদা সন্ধি
রাত আটটা।
আহনাফ ভীষণ ধীরগতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। গন্তব্য অদিতির বাসা। অদিতি শহরের একটা বাড়ির ছয় তলায় থাকে বাসা ভাড়া করে৷ আহনাফ সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেই রেখেছে। রাত দশটা পর্যন্ত গেট খোলা থাকে। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ড নেই কোনো। নিচতলার ভাড়াটিয়ার কাছে গেটের চাবি থাকে। তিনি রাতের বেলা গেটে তালা মেরে তারপর নিজের রুমে যায়। আহনাফ অদিতির সম্পর্কে সব খোঁজখবরই নিয়েছে দেশে আসার পরে। তবে দেশের বাইরে যাওয়ার আগ অবধি অন্ধকার জগতের বাসিন্দা ছিলো সে। আহনাফের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদের পরে অদিতির পরিবার না কি আর যোগাযোগ রাখেনি তার সাথে। বিষয়টা অবাক করেছে আহনাফকে। পরের ছেলের জন্য নিজের মেয়ের সাথে কেউ এমন করতে পারে না কি? আর অদিতির শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে কোনো তথ্য পায়নি আহনাফ। মাতৃত্বকালীন ছুটির আগে সে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত ছিলো। সেখানকার ইনফরমেশন অদিতির বাবার নাম ছিলো শুধু। স্বামীর কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। আর অদিতির রেগুলার কলরেকর্ডসে শুধু তার কম্পানির লোকজনই ছিলো। বলা চলে কারো সাথেই অদিতির যোগাযোগ নেই। কিন্তু আহনাফ জানে অদিতির আরো একটা নম্বর আছে কিন্তু সেই নম্বরের খোঁজ আহনাফের অজানা বলেই হয়তো আহনাফ তার খোঁজ জানতে পারেনি যার জন্য অদিতি তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো।
আহনাফ ঠিকসময়ে গন্তব্যে এসে পৌঁছুলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো সে।
কলিংবেল বাজতেই একটা সুদর্শন মতো পুরুষ দরজা খুলে দিলো। এখন দুজন লোক একে অপরের মুখোমুখি। যারা এমন পরিস্থিতিতে একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার জন্য কোনো কালেই প্রস্তুত ছিলোনা হয়তো। দরজার ওপাশের মানুষটা জারিফ। যাকে দেখেই আহনাফের মাথা মুহুর্তের মধ্যেই ঘুরে উঠলো। বাকরুদ্ধ হয়ে, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে যাওয়ার অবস্থা তার। জারিফও চমকে গেলো। কিছু না বলেই দরজা ছেড়ে দিলো৷ আহনাফও ঘরে ঢুকলো। ঢুকেই দেখতে পেলো খাটে আধশোয়া হয়ে একজন গর্ভবতী মহিলা টিভির রিমোট হাতে আছেন। আহনাফের একটুও বুঝতে অসুবিধা হলোনা এটা তারই অদিতি। হুস তার বলাটা হয়তো ভুল হয়ে যাবে। অদিতি এখন তার নয়। অদিতি আহনাফের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর৷ আহনাফকে দেখে অদিতির হাত থেকে রিমোট পড়ে গেলো। থমকে গেলো সে। আহনাফ অদিতিকে দেখে যেন এতোদিনের জমানো সমস্ত অভিযোগ ভুলে গেলো। ততক্ষণে জারিফও ঘরে এসেছে। তিনজনই নিশ্চুপ নিস্তব্ধ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। তবে তারা তিনজন অনুভব করতে পারছে কারো মনে আর কোনো অভিযোগ, অভিমান কিছু নেই। বড় বড় ঝামেলাও বুঝি এভাবে মিটতে পারে। আহনাফ এসে অদিতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অদিতি আহনাফের ছোঁয়া পেয়েই হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। আহনাফ চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে বললো মোটা লাগছে তোমাকে। বাট স্টিল নাউ অনেক কিউট লাগছে। এরপর জারিফই কথা তুললো।
অপরাধীর ন্যায় বলতে লাগলো, ” আহনাফ তোর সাথে এতোদিনের পরিচয় অথচ তোকে কিচ্ছুটি জানাইনি আমি। আসলে অদিতির মাধ্যমেই তোকে চিনতে পারি আমি। অদিতি যখন তোর অবহেলার মরুভূমির ন্যায় প্রাণহীন হয়ে গিয়েছিলো তখনই মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আমার আগমন। অদিতিকে আমি চিনি ভার্সিটিতে এসে। তার শান্ত স্বভাব তার প্রতি আকর্ষিত করেছিলো আমাকে। তাকে প্রথমদিন প্রপোজ করতেই রাজি হয়ে যায় সে। আমি অবাক হয়েছিলাম সাথে প্রচন্ড খুশিও। এতো তাড়াতাড়ি তাকে পেয়ে গিয়েছিলাম বলে। তখন আসলে বুঝিনি সে অভিমানে আমাকে গ্রহণ করেছে। মন থেকে নয়। আমার প্রতি অদিতি বড্ড উদাসীন ছিলো । তার উদাসীনতা দেখে কিছু বুঝেছিলাম আমি। বন্ধু হিসেবে হাত বাড়াই তার দিকে। এরপর পুরো বিষয়টা জানতে পারি। তখন আসলে একপ্রকার সুযোগ নিয়েছিলাম আমি। তার একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে তার ভালো বন্ধু হই। একপর্যায়ে বন্ধু থেকে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে তার আপন হই। জানিস আহনাফ যেদিন অদিতির মুখ থেকে আমি তোর কথা জানি সেদিন আমার মনে হচ্ছিলো কেউ যেন আমার কলিজায় ভোতা ছুরি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করছিলো। আসলে যাকে ভালোবাসি তার মুখে অন্য কারো কথা আমাকে শেষ করে দিয়েছিলো। তারপর তোর খোঁজখবর নেই। অদিতি আমার কাছে চেয়েছিলো আমি যেন তোর বন্ধু হই। কিন্তু দেশে সেটা সম্ভব ছিলোনা আমার জন্য। কারণ স্কলারশিপ নিয়ে আমাকে দেশের বাইরে আসতে হতো। আর আল্লাহর হুকুমে তোর সাথে ক্যাম্পাসেই আমার দেখা হয়। ড্যানির সাথে তোর ঝামেলার সময়। সেই পুরো বিষয়টা আমি অদিতিকে জানাই। তার ইচ্ছে রাখতে তোর ভালো বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করি। পরে বুঝেছিলাম তুই মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। আমি নিজের পরিচয় লুকিয়েছিলাম দুটো কারণে। আমাদের বিয়ের বিষয়টা যেন আমার বাসায় না জানাজানি হয়। আর আমার কাছে ছাড়া অন্য কোথায় যেন তুই বিষয়টা না জানিস! আসলে আমি অদিতিকে বিয়ে করেছি এটা জাহিন ছাড়া কেউ জানে না। তুই যেদিন আমার বাসায় আসছি সেদিনও অদিতিকে ফোন করে জানাই আমি। অদিতি তোর ফোন চেক করতে বলেছিলো। লক স্ক্রিনে অদিতির ছবি দেখতে পেয়ে তাকে আবার জানাই। অদিতি সেদিন ডুকরে কেঁদে বলেছিলো আহনাফ হয় আমাকে এখনো ভালোবাসে নয়তো ভীষণ ঘৃণা করে। বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতেই জাহিন আর আমি ঘাবড়ে যাই”
আহনাফ মন দিয়ে পুরো বিষয়টা শুনলো। জারিফ আর জাহিনের অদ্ভুত আচরণের কারণ বুঝলো। তারপর অনেক কষ্টে নিজের কান্না চেপে বললো, ” আসলে জারিফ অদিতি আমার কপালে ছিলো না রে। নয়তো সুন্দর সম্পর্কটা কয়েকমাসের মধ্যেই কি করে নষ্ট হয় বলতো। দোষ তো আমার ছিলোই। কিন্তু অদিতি যেন অভিমানের বসে এমন কাজ করবে এটা তো কখনো ভাবিনি। অদিতি ছিলো আমার প্রাণ ভোমরা। তবে এই প্রাণ ভোমরাটা আমার থেকে দূরে গেলেই আমি মরে যেতাম। তাই তার চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারিনি। আড়াল করে রেখেছিলাম নিজেকে। তারপর বাহিরে চলে যাই। দেশে এসে প্রতিশোধ নিতে চাই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার প্রয়োজন নেই। অদিতি তোর মতো মানুষকে পেয়েছে আর কী চাই আমার। আমিই আসলে যোগ্য ছিলাম না অদিতির। মেয়েটার খেয়াল রাখিস বন্ধু। আর বাবা হওয়ার ট্রিট দিস। ”
কথাগুলো বলে আহনাফ জাপটে ধরলো জারিফকে। এমন পরিস্থিতির জন্য সে কখনো প্রস্তুত ছিলোনা। চোখের জল আটকাতে পারছেনা আহনাফ। তার মনে হচ্ছে যদি এখনই তার মৃত্যু হতো। অদিতি পেছন থেকে কাঁদোকাঁদো গলায় সরি বললো। আহনাফ জলভরা চোখেই অদিতির মাথায় আরেকবার হাত বুলিয়ে দিলো। সে সময়ে আহনাফের আরো কান্না পেলো। কিন্তু সে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো না। হয়তো চাইছে অদিতি দেখুক তার কান্নাটা। অদিতিও কাঁদছে আহনাফও কাঁদছে। কান্না আর নিরবতাই সব কথা বলে দিচ্ছে।
আহনাফ আর দাঁড়ালোনা। মুহূর্তেই বিদায় জানিয়ে চলে এলো। অদিতি বা জারিফ তাকে কিছু বলারও সুযোগ পেলোনা। তবে আজ জারিফ প্রশান্তির প্রশ্বাস ছাড়লো। হয়তো আহনাফ সব জেনেছে বলেই। আল্লাহর কী ইচ্ছে! অদিতি অসুস্থ বলে জারিফ সব দ্বিধা ভুলে ছুটে এসেছিলো আর আজকেই আহনাফ আসলো৷ অদিতি অন্য শহরে যেতে চায়নি। সে চেয়েছিলো আহনাফের মুখোমুখি হতে। অদিতি এখন ভীষণ রকম কাঁদছে। জারিফ তার কাছে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে কিন্তু অদিতি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে।
অদিতির কান্না থামাতে জারিফ এবার ধমকেই উঠলো। কারণ না ধমকালে হয়তো অদিতি থামতোই না। কান্নার সময় কেউ আদর করে সান্ত্বনা দিলে কান্নার বেগ কমার বদলে বেড়েই যায়।
আহনাফ গাড়িতে উঠে জাহিনের নম্বরে ডায়াল করলো। জাহিন অতি উৎসাহে হ্যালো বললো। আহনাফ মুচকি হেসে জাহিনকে পুরো ঘটনা শোনালো। জাহিনের কিছু বলার বা করার ছিলোনা। সে শুধু বললো, ” সরি ভাইয়া।”
আহনাফ বললো, “ধুর পাগলি মেয়ে। আল্লাহ কখনো কাউকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে না। অদিতির বিনিময়ে আমি তোর আর জারিফের মতো মহামূল্যবান সম্পদ পেয়েছি।”
চলবে,,,