সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-১+২

0
711

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ১
সময়টা সত্তর দশকের মাঝামাঝি, উত্তর কলকাতার প্রখ্যাত বনেদী সান্যালদের ছোটো তরফ, প্রতাপ সান্যালের বাড়িতে জন্ম হলো অদ্বিতীয়ার। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তার জীবনে যা ঘটলো তা বোধহয় দ্বিতীয় কারোর সঙ্গে কোনোদিনও ঘটে নি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সে কিছুটা হলেও সার্থকনামা, তাকে জন্ম দিয়েই তার মা হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে গেলো! যদিও যতো সহজে পালিয়ে গেলো বলা হলো, পালিয়ে যাওয়ার পেছনের ঘটনা ততো সহজ নয়!

বনেদী বড়লোক প্রতাপ সান্যালের দুই পুত্র, রতিকান্ত আর সুকান্ত। বনেদী সান্যালদের বংশগত ওকালতি ব্যবসার ধারা কে অক্ষুন্ন রেখে সুকান্ত এ ব্যবসায় যোগদান করলেও বরাবরই প্রতাপ বাবুর বড়ো পুত্র রতিকান্ত অন্য ধাতুতে গড়া। বাবার বিরোধিতা করাই ছোটো থেকে তার জীবনের উদ্দেশ্য, বাবা বাঁয়ে বললে সে ডাইনে যায়। সে বড়লোক বাপের বখাটে ছেলে, বাবার টাকা পয়সা নয় ছয় করার বিভিন্ন উপায় নিয়মিত খুঁজে বার করতে তার জুড়ি মেলা ভার।

বড়লোক বাপের টাকা উড়িয়ে দেওয়ার উৎকৃষ্ট উপায় হিসেবে সে ছোটো থেকেই সিনেমার নায়ক হবার স্বপ্ন দেখতো। বাপের পয়সা আর বনেদিয়ানা এই দুয়ের ভরসায় সে একটি ছবিতে অভিনয় করেছিলো, হলে মুক্তি পাবার পরে প্রশংসাও জুটে ছিলো মন্দ না। কিন্তু ওই প্রশংসাটুকুই সার, পরবর্তী তে আর কোনো ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ তার আসে নি। অভিনয় দক্ষতা ছাড়া বাপের টাকায় খুব বেশি দিন নায়ক হয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হবে না বুঝেই সে ওই আশা ত্যাগ করলো।

বড়লোকদের মোসাহেবি করার লোকের অভাব হয়না কখনোই, রতিকান্তরও সেই রকম কিছু বন্ধুবান্ধব ছিলো। যারা তাকে গুরু বলে মেনে নিয়েছিলো এই কারণেই কারণ খরচ খরচটা বরাবরই রতিকান্তই করতো। গাঁটের কড়ি খরচা করতে না হলে আর গুরু মানতে অসুবিধা কোথায়! কিছুদিন চুপ করে বসে থেকে বাপের টাকা ওড়ানোর নতুন পদ্ধতি খুঁজে দেখতে গিয়ে তার মোসাহেবি করা কিছু এইরকমই উৎকৃষ্ট বন্ধুদের সৌজন্যে সে নতুন পথের সন্ধান পেলো।

কিছুদিনের মধ্যেই বনেদী বড়লোকদেরদের যে অনেক ভালোর সঙ্গে কিছু খারাপ গুণও থাকে, সে সবই তার আয়ত্বে এসে গেলো, সে উত্তর কলকাতার কুখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লীতে যাতায়াত শুরু করলো।

সেখানে যাতায়াতের সুবাদেই চরিত্রের যে টুকু ভালো গুণ ছিলো, যদিও আদৌ কিছু ছিলো কিনা সে বিষয়ে যথেষ্টই দ্বিমত আছে, তবু সেই বাকিটুকুও জলাঞ্জলি দিয়ে সে মদের নেশা ধরলো। ছেলের উচ্ছন্নে যাওয়ার খবর যদিও প্রতাপ সান্যালের কানে পৌঁছালো, কিন্তু একটু দেরীতে, তিনি রাশ টেনে ধরার আগেই বাকি ষোলোকলা পূর্ণ করে রতিকান্ত কোথা থেকে কে জানে, এক মহিলা কে সিঁদুর পরিয়ে এনে ঘরে তুললো।

পাড়ায়, আত্মীয়মহলে মুখরোচক আলোচনা শুরু হলো, মহিলার পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন রকম মতামত উঠে আসতে লাগলো, কেউ কেউ তাকে সেই কুখ্যাত পল্লীর বাসিন্দা বলে সন্দেহ করলেও দোর্দন্ডপ্রতাপ সান্যাল মশাইয়ের ভয়ে মুখ খুললো না। প্রতাপ সান্যাল ধুরন্ধর লোক, তিনি কাউকে তাঁর ক্ষোভের বিন্দুমাত্র কিছু বুঝতে দিলেন না।

উকিল প্রতাপ বাবু তাঁর উকিলি বুদ্ধি কে কাজে লাগিয়ে প্রতিটা পদক্ষেপ মেপে মেপে ফেলতে লাগলেন। প্রথমেই তিনি রতিকান্ত কে ত্যাজ্য পুত্র করার ভয় দেখালেন, বাবার টাকাই তার বড়লোকি চালের উৎস ছিলো, সে টাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় বাস্তবিকই রতিকান্তের মনে চিন্তার সঞ্চার করলো। বাবার হুমকির ভয়েই হোক বা অন্য কোনো কারণে, তার দু একদিন পরেই রাতে বাড়ি ফিরে একদিন বউয়ের সঙ্গে তুমুল বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লো রতিকান্ত। সেই রাত ভোর চলা অশান্তির যে শুরু হলো তার আর শেষ হলো না, দিনের পর দিন তার বাড়বাড়ন্তই দেখা যেতে লাগলো।

এই অশান্তির সুযোগে মাস খানেকের মধ্যেই ছেলে কে লুকিয়ে ডেকে দেওয়া হুমকি সুকৌশলে বাড়ির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন প্রতাপ সান্যাল, দু একদিনের মধ্যেই চাকর বাকরদের আলোচনার টুকরো টাকরা শব্দ রতিকান্তের বউয়ের কানেও পৌঁছে গেলো। বউটিও যথেষ্টই ধুরন্ধর ছিলো, সে নায়ক রতিকান্ত নয়, বড়লোক বাপের বড়লোক পুত্র রতিকান্ত কে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। এক্ষণে তার বনেদী বাড়ির বউ হবার স্বপ্ন স্বামীর ত্যাজ্য পুত্র হওয়ার সম্ভাবনায় প্রায় অধরা হতে দেখে সে অস্থির হয়ে উঠলো।

একদিন সন্ধ্যে বেলায় রতিকান্ত তার রাত সফরে বেরিয়ে যেতেই সে শ্বশুরমশাই এর ঘরে উপস্থিত হলো, এবং সে যে দু মাসের সন্তান সম্ভবা এই তথ্য জানিয়ে সে সান্যাল মশাইয়ের পায়ে ধরে পড়লো। ছেলের বউ সন্তানসম্ভবা এ তথ্য তাঁর জানা ছিলো না, তিনি কিছুটা হলেও বিপদে পড়লেন। বনেদী বংশ, বনেদী রক্তের গর্বে গর্বিত প্রতাপ বাবু, তাঁর বংশের হবু বংশধর সমেত মা কে বাড়ি থেকে তাড়াতে একটু দ্বিধান্বিত হলেন। ছেলের বউ কান্নাকাটি করে বিদায় নেওয়ার পরে তিনি স্ত্রী সরযূ কে ডেকে পাঠালেন।

সরযূও এসবের কিছুই জানতেন না, বউ তাঁর থেকে এবং তিনি বউয়ের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন সেই আসা থেকেই। প্রতাপ সান্যাল প্রথমেই এই কাণ্ডটির খবর না রাখার জন্যে স্ত্রীর ওপরে বিরক্তি প্রকাশ করলেন, কি করে এক মাস বিয়ের বউ দু মাসের পোয়াতি হয়, সে ব্যাপার স্ত্রীর নজর এড়িয়ে গেলো কেনো তার কৈফিয়ত দাবি করলেন। তারপরে এই মুহূর্তে কি করণীয় সে ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গেই পরামর্শ করতে বসলেন।

সরযূ বুদ্ধিমতি, বনেদী বাড়ির ছেলেদের মহিলাঘটিত এই সব কেলেঙ্কারি কে দোষ হিসেবে ধরেন না কখনই, তাঁর মতে এগুলো বনেদিয়ানারই লক্ষণ। তবে মনে মনে তিনি স্বীকার করেন যে, তাঁর পুত্র রতিকান্ত নিতান্তই গণ্ডমূর্খ, নাহলে পোয়াতি হলেই যদি সব মেয়েকেই সিঁদুর পরিয়ে ঘরে তুলতে হতো, তাহলে এসব বংশে বৈধ শরিকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু সেসব টাকা কড়ি দিয়ে মিটিয়ে নেবার সুযোগ এখন আর নেই, মাথায় সিঁদুর দেওয়ার পরে আর এসব এখন অর্থহীন।

তিনি মনে মনে অন্য পরিকল্পনা করে ফেললেন, প্রত্যেক বেস্পতিবার তাঁকে আলতা পরাতে আসে নাপিত বউ আশা, সে আসতেই তাকে জড়িবুটি আনার জন্যে বলে দিলেন। আশা এসবে সিদ্ধ হস্ত, মাঝে মাঝেই কর্তা কে বশে রাখার জন্যে, ছেলের মদের মাত্রা কমানোর জন্যে আশা র দেওয়া ওষুধ ব্যবহার করেন সান্যাল গিন্নি, ওষুধ যে সব সময় কাজ করে তা নয়, তবে একদম করেনা, এটাও তিনি বুক ঠুকে বলতে পারবেন না। ছেলের মদ কমাতে না পারলেও স্বামী কে মোটামুটি বশেই রাখতে পেরেছেন, তাঁর পরামর্শ ছাড়া সান্যাল মশাই এক পাও ফেলেন না।

সক্কাল সক্কাল, ছেলে রাত ভোর বাড়ি না ফেরার সুযোগে নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখা শিলে সেই পাতা, শিকড় বেটে কাকপক্ষী কেও জানতে না দিয়ে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে, এলাচ গুঁড়ো ছড়িয়ে, পোয়াতি বউয়ের সেবা করার নামে পুরনো কাজের লোক মায়া কে দিয়ে বউয়ের ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। সে যেনো সামনে দাঁড়িয়ে খাইয়ে, খালি গেলাস ফিরিয়ে আনে সেটা মায়াকে পই পই করে বলে দিলেন।

হটাৎ করে উথলে ওঠা শাশুড়ির দরদ দেখে মায়া এবং বউ দুজনেই সবটাই বুঝতে পারলো, মায়ার নামের সঙ্গে কাজের মিল ছিলো, সে বউয়ের ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘরের পেছনের নালা দিয়ে সে দুধ ফেলে দিলো। বউ আঁচলের খুঁট খুলে মায়ার হাতে জোর করেই একটা সিকি গুঁজে দিলো, কিছুক্ষন পরেই খালি গেলাস হাতে মায়া কে রান্না ঘরে ফেরত আসতে দেখে সান্যাল গিন্নি খুশি হলেন।

বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা করার পরেও ওষুধের কার্যকারিতা বোঝা গেলো না, বউ আর ছেলের নিয়মিত ঝগড়া, চিৎকারের আওয়াজ ঘর থেকে আসতে লাগলো, মনে মনে বিরক্ত হয়ে পরের বেস্পতিবারে আশা, আসা মাত্র তাকে গালমন্দ করতে লাগলেন সরযূ। সে মুখ চুন করে বসে রইলো, তারপরে নিদান দিলো,

এই অশুদে এতো লোকের কাজ হলো মা, আর তোমার বউয়ের হলো না! ও নিজ্জস ডাইনি মাগো!

সরযূ সহমত হলেন, এ কথা তাঁরও মনে হয়েছিলো,

সে তুই ঠিক বলেছিস আশা! আমিও তাই ভাবছিলুম! তাই বলি আমার রতি কতো ঘরেই তো রাত কাটায়, একেই ঘরে এনে তুললো কেনো বলতো! নিকঘাত বশ করেছ রতি কে! নইলে দিনে রাতে এইরম কোন্দলের পরেও সে বউ ছাড়ে না গো!

যাইহোক পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে, তার বুদ্ধি আশাই দিলো। বউ দোতলা থেকে নিচে না নামলেও, ছাদে যায় বিকেলে নিয়মিত, সে ছাদে যাওয়ার পরে, সন্ধের অন্ধকারে তার ছাদের সিঁড়িতে সর্ষের তেল ঢেলে রাখা হলো। সারা সন্ধ্যে আশা এবং সরযূ তার পতনের শব্দের আশায় নিচে অপেক্ষা করতে লাগলো, কিন্তু কোনো আওয়াজ এলো না। তার কিছুক্ষন পরেই প্রবল চিৎকার করে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে রতিকান্ত যখন উঠোন দিয়ে তার রাত ভ্রমণের উদ্যেশ্যে রওনা হলো তখন তারা নিশ্চিত হলো, এ বউ ডাইনিই! না হলে ওই তেল পেরিয়ে সে নিচে নামলো কি করে!

গিন্নীর সব চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পরে প্রতাপ সান্যাল নিজে ময়দানে নামলেন। তিনি মনে মনেই জানেন মেয়েটি অত্যন্ত বুদ্ধিমতি এবং সাবধানী, শাশুড়ির ভালোবাসা কে সে একটুও বিশ্বাস করে নি। সে যে সেই দুধ খায়নি, বা যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে ছাদ থেকে নেমেছে এটা তিনি বুঝলেন। পরবর্তী আরও কিছু ঘটনা ঘটতে পারে এর জন্যে নিশ্চয়ই সে প্রস্তুত আছে! কিন্তু মনে মনে ভয় নিশ্চয়ই পেয়েছে, মৃত্যু ভয় বড়ো ভয়!! এই সুযোগের অপেক্ষাতেই তিনি ছিলেন, একদিন ছেলের অনুপস্থিতির সুযোগে বউয়ের কাছে টোপ ফেললেন।

শর্ত একটাই, তার চাহিদা অনুযায়ী প্রাপ্য টাকা সে পাবে, কিন্তু বংশের সন্তান কে জন্ম দিয়েই তাকে টাকা পয়সা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। ইতিমধ্যেই রতিকান্তর সঙ্গে তার বউয়ের মতবিরোধ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। তার প্রকৃত কারণ কারোর জানা না থাকলেও নিত্যদিনের চিৎকারে ক্রমশই অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল সান্যাল বাড়ি, মাতাল রতিকান্ত বাড়ি আসা কমিয়ে দিয়ে বিভিন্ন পল্লীতে থেকে যেতে শুরু করেছিলো। যদিও বা কখনো সখনো সে মাঝ রাত্তিরে বাড়ি ফিরতো, তাও তাকে বাড়ির চাকররা গাড়ি থেকে নামিয়ে চ্যাং দোলা করে বাড়িতে নিয়ে যেতো অচেতন অবস্থায়।

এইরকম সময়ে প্রতাপ সান্যালের এই প্রস্তাব বউয়ের খুব খারাপ লাগলো না। এতে তার সন্তানও বাঁচলো, তার নিজের মৃত্যু ভয়ও রইলো না। কারণ ক্রমশই সে বুঝতে পারছিলো, এদের তাকে তাড়ানোর সমবেত প্রচেষ্টার সঙ্গে সে পেরে উঠবে না। আর বাকি রইলো তার স্বামী যে ইতিমধ্যেই তার সংস্রব প্রায় ত্যাগ করে অন্য জায়গায় রাত কাটাতে শুরু করে দিয়েছে। বনেদী বাড়ির বউ হবার সাধ তার ততদিনে ঘুচে গিয়েছে, আর ত্যাজ্য পুত্র হলে, মাতাল রতিকান্তের সঙ্গে থেকে তার বিশেষ কোনো লাভ নেই বুঝেই সে এই প্রস্তাবে সম্মত হলো, নির্দিষ্ট সময়ে কলকাতার প্রখ্যাত নার্সিং হোমে মেয়ের জন্ম দিয়েই সে টাকা কড়ি বুঝে নিয়ে নার্সিং হোম ছেড়ে পালিয়ে গেলো।
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ২
অদ্বিতীয়ার মা যতটা না পালিয়ে গেলো, তাকে পালিয়ে যেতে একপ্রকার বাধ্য করা হলো বলা যেতে পারে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে তাকে দিয়ে রীতিমতো চুক্তিপত্রে সই করানো হলো, ভবিষ্যতে সে কখনো ফিরে এলে তার বিরুদ্ধে কি কি আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে সব কিছু তাকে বুঝিয়ে বললেন প্রতাপ বাবু। তবে সেও কিছু ধোয়া তুলসিপাতা ছিলো না, টাকা পয়সার লোভ তার ভালোই ছিলো। সান্যাল মশাই বিচক্ষণ ব্যক্তি, এই লোভের ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন বলেই তো টোপ ফেলেছিলেন। কিন্তু সরযূর এই ব্যবস্থাপনা খুব বেশি পছন্দ হয় নি, মা, ঝি একসঙ্গে গেলেই ল্যাঠা চুকে যেতো! তা না! সারাজীবনের মতো এই অজাত কুজাতের ঘরের রক্তের দায়ভার তাঁকেই বইতে হবে। তাও যদি বংশ রক্ষা করতে পারতো তাহলে তিনি মেনে নিতেন কিন্তু সে গুড়ে বালি! উল্টে একে পার করতে খরচা একটু বেশিই হবে। মায়ের পালিয়ে যাওয়ার খবর, বাপের মাতাল, চরিত্রহীন তকমার জন্যে তার ছেলে পাওয়া মুস্কিল। প্রতাপ সান্যাল গিন্নীর চিন্তাতে একটুও চিন্তিত হলেন না, গিন্নী কে ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ জানিয়ে পর পর একটু একটু করে কার্য সমাধা করতে লাগলেন।

বনেদী সান্যাল বংশের বনেদিয়ানা ইতিমধ্যেই অনেকটাই তলানিতে এসে ঠেকেছিলো, বিভিন্ন শরিকদের ছেলেরাও অনেকেই প্রবাসী। তাদের বংশ গৌরবকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে বেশ কয়েকজন অবাঙালি মেয়েও বিয়ে করেছে। তার ফলস্বরূপ একে অপরের সমালোচনা করার খুব বেশি জায়গা কারোরই ছিলো না। নার্সিং হোমের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা আগেই সেরে রেখেছিলেন প্রতাপ বাবু, অদ্বিতীয়ার মায়ের নামের পাশে তাই মৃত ফলক বসলো।

মেয়ের জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা গেছে এরকম একটা রটনা ছড়িয়ে দেওয়া হলো, দু একজন একটু সন্দেহ করলেও প্রমাণ না থাকায় এ সন্দেহ কিছুদিনের মধ্যেই ধামাচাপা পড়ে গেলো। প্রতাপ সান্যাল মনে মনে মুচকি হাসলেন, প্রথম পুত্রবধূর মৃত্যুর খবর আস্তে আস্তে সকলের কাছেই পুরনো হয়ে গেলো। রতিকান্ত মনে মনে খুশি হলো, বউ পালানোয় সে শান্তি পেলো, নতুন নতুন ঘরে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পরে বাড়িতে যে অশান্তি হতো তা বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু মেয়ের থেকে যাওয়া তার একটুও পছন্দ হলো না, মেয়েটিও গেলেই বোধহয় সে বেশি খুশি হতো। মেয়ের থেকে যাওয়ায়, বউয়ের ওপরের রাগ সবটাই গিয়ে মেয়ের ওপরেই পড়লো রতিকান্তের, সে মেয়ের মুখ দেখতেও চাইলো না। যদিও রাগের কারণ শুধুই মেয়ের মা কিনা, সেটা জানা কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিলো না, কিন্তু মেয়ে কে দেখলেই তার মুখ ঘৃণায় বিকৃত হয়ে যেতো।

তাকে সঙ্গত করলেন তার মা সরযূ দেবী, তিনি দুঁদে গিন্নি, অনেক চেষ্টার পরেও যে মেয়েকে মেরে উঠতে সফল হতে পারেন নি তিনি, সেই মেয়েকে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখতে তাঁর একটুও ভালো লাগতো না। মনে মনেই সারাক্ষন গালমন্দ করতে লাগলেন শিশু টি কে, যদিও সেই বয়সে সেসব কথায় শিশুটির কিছুই এলো, গেলো না। অজাত, কুজাতের রক্তের মেয়ে কে ঘরে নিয়ে আসায় সান্যাল গিন্নীর যথেষ্টই আপত্তি ছিলো কিন্তু প্রতাপ সান্যাল শুনলেন না, ওই অজাত কুজাতের রক্তের সঙ্গে কোথাও সান্যাল বংশের রক্তও মিশে ছিলো। মায়ের পরিচয় যাই হোক, নিজের বংশের মেয়েকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না, বাপ, দাদু থাকতেও সান্যাল বংশের মেয়ে অনাথ তকমা পাবে এ তাঁর বংশের সম্মানের জন্য যথেষ্ট ছিলো না। তাই শুধু মাত্র সান্যাল বংশের রক্ত থাকা টুকু এ যাত্রা অনাথ তকমা পেয়ে অনাথ আশ্রমে পড়ে থাকা থেকে শিশুটি কে বাঁচিয়ে দিলো।

প্রতাপ সান্যাল মা এবং ছেলে দুজনকেই রীতিমত হুমকি দিলেন, দরকার পড়লে যে গিন্নি কে না হলেও রতিকান্ত কে এ বাড়ি থেকে বার করে দিতে পারেন প্রতাপ বাবু, এটা বোঝার পরে মেয়ের ব্যাপারে আর কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত হলো রতিকান্ত। বাপের ভয়ে সে চুপ করে থাকলেও, মনে মনে মেয়ের ওপরে একটুও প্রীত ছিলো না, অদ্বিতীয়া তার দুচোখের বিষ ছিলো। সান্যাল গিন্নীর স্বামীর কথায় নতুন করে আশার ওষুধের ওপরে সন্দেহ জন্মালো, যে স্বামী তাঁর কথা তে ওঠেন বসেন, তিনি তাঁর অমতে ওই মেয়ে কে বাড়ি এনে তুললেন ,এটা তে আশার ওষুধের ওপরে কিছুটা হলেও তাঁর আস্থা উঠে গেলো।

বাবার ভয়ে কিছু না করলেও সারাদিনই মেয়ের প্রতি রতিকান্ত আর তার মায়ের তীক্ষ্ণ কথা বর্ষিত হতো, সরযূ তাকে ছুঁয়েই দেখতেন না। বাড়ির পুরনো ঝি মায়ার কোলে পিঠে সে মানুষ হতে লাগলো। সে মা হারা শিশুটিকে প্রায় মাতৃ স্নেহে মানুষ করতে লাগলো।

মায়া ছাড়া বাড়িতে একমাত্র সুকান্ত শিশুটিকে সত্যিই ভালোবেসে ফেললেন, মা হারা মেয়েটি ক্রমশই ঠাকুমা, দাদুর না হোক কাকার নয়নের মনি হয়ে উঠলো। সামনে গেলেই ফোকলা মুখের একগাল হাসি সুকান্ত কে পিতৃত্বের স্বাদ দিতে শুরু করলো। কাকা সুকান্ত আস্তে আস্তে ভাইঝি কে এতোটাই ভালোবেসে ফেললেন, যে তাঁর অত্যাধিক ভাই ঝি প্রীতি সরযূর চোখেও পড়লো। বাবার স্নেহের অভাব পূরণ করার জন্যেই বোধহয় কাকা তাঁর স্নেহ দিয়ে ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো ছোট্ট মেয়েটি কে।

সুকান্তর জীবনেও ছোট্ট একটা গল্প ছিলো, তিনি তার সহপাঠিনী কে ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু তার অপরাধ ছিলো একটাই, মেয়েটি তাঁদের সমগোত্রীয় ছিলো না। অনেক চেষ্টার পরেও বাবার মত আদায় করতে না পারায় তিনি সেই সম্পর্ক থেকে সরে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু মনে মনেই চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞা করলেন। প্রতাপ সান্যালের অবশ্য সেই মেয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখায় কোনো আপত্তি ছিলো না, আপত্তি ছিলো মেয়েটিকে বাড়ির বউ করে নিয়ে আসাতে। বনেদী বাড়িতে বাড়ির বউ থাকার সঙ্গে বাইরের মেয়েদের কোনো বিরোধ থাকে না, কিন্তু সুকান্ত একটু হলেও পরের প্রজন্মের ছেলে, এসব বনেদী ভাব ধারার থেকে শত হস্ত দূরে থাকেন। তাই এসব পথে না গিয়ে তিনি অকৃতদার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এক্ষণে ভাই ঝি কে পেয়ে নিজের সন্তানের অভাব তিনি তার মধ্যে দিয়েই পূরণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

কাকার ভাই ঝির প্রতি অতি বাৎসল্য দেখে উদগ্রীব হয়ে ছোটো পুত্রের বিয়ের জন্যে সান্যাল মশাই কে ধরে বসলেন সান্যাল গিন্নি, বউ এলে, নিজের সন্তান হলে ভাই ঝির থেকে তাকে দূরে সরানো যাবে। কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও সুকান্ত বিয়ে করতে রাজি হলেন না, বাবা কে সরাসরি জানালেন বাবা চান না বলে তিনি সহপাঠিনী কে বিয়ে করেন নি ঠিকই কিন্তু তার বদলে অন্য কাউকে বিয়ে করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে তিনি ভাই ঝি আর ওকালতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

সুকান্ত বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করা তে আত্মীয় স্বজনরা উৎসাহী হয়ে উঠলেন, প্রতাপ সান্যালের এতো সম্পত্তি শেষ পর্যন্ত কার কাছে যাবে এই চিন্তা তাদের সকলকেই সান্যাল বাড়ির ঘনিষ্ঠ দেখানোর চেষ্টায় লিপ্ত করলো।

প্রতাপ বাবু নিজেও উকিল মানুষ, আত্মীয় স্বজনদের অতি উৎসাহের কারণ বুঝতে তাঁর দেরি হলো না, তিনিও মনে মনে এটাই চাইছিলেন। তাঁর জানা ছিলো নাতনির জন্মবৃত্তান্ত ভবিষ্যতে তার বিয়ের সময় সমস্যা তৈরি করতে পারে, এই সুযোগে তিনি ভবিষ্যতে যে অদ্বিতীয়াই তাঁর অর্ধেক সম্পত্তির মালিকানা পাবে এই তথ্য সুকৌশলে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন। সান্যাল বাড়িতে শুভাকাঙ্ক্ষীদের যাতায়াত বেড়ে গেলো, কিছুটা বাকি সম্পত্তির মালিকানা কার হাতে গেলো জানার জন্যে, কিছুটা ভবিষ্যতে অদ্বিতীয়ার পাত্র হিসেবে নিজের কাছের কোনো আত্মীয়ের ছেলে কে দাবি করে।

সরযূ বিরক্ত হলেন, এই ধরনের বোকামি তাঁর অতি বুদ্ধিমান উকিল স্বামী কি করে করলেন সে বিষয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

এ তুমি কি করলে গো! ওই অজাতের রক্ত সান্যালদের বাড়ির দখল নেবে! বেঁচে থাকতে আমায় এও দেখতে হবে শেষে!

প্রতাপ সান্যাল মুচকি হাসলেন,

এতো বড়ো উকিলের বউ তুমি গিন্নী, আর এটুকু বোঝো না! ওই রটনাই তো ওই মেয়ের পাত্র আনবে গো! পার করতে গেলে এটুকু গল্প থাকা দরকার, পাত্র পক্ষ তো ওই লোভেই আসবে! বলা আর লিখে দেওয়া যে এক নয় সেকথা আজ তোমাকেও বুঝিয়ে বলতে হবে নাকি! তুমি বরং রতির জন্যে মেয়ে দ্যাখো, আমার বংশধর লাগবে!

সরযূ শান্তি পেলেন, মনে মনে স্বামী কে বোকা ভাবার জন্যে আফসোস করতে লাগলেন, এবার তিনি নিজেও মহিলা এবং দাসী মহলে একই কথা আলোচনা করতে শুরু করলেন। খুব তাড়াতাড়ি সে কথা ছড়িয়ে গেলো। প্রতাপ সান্যালের কথা কে সত্যি করেই ছোটো থেকেই অদ্বিতীয়ার পাত্রের কোনো অভাব থাকলো না, সবাই তার ছেলের জন্যে অদ্বিতীয়া কে বউ হিসেবে ভাবতে লাগলো। ছোট্ট শিশুটি জানলোও না সে কতটা মূল্যবান, সে তার ছোট্ট মাস দুয়েকের জীবনে কারোর অবহেলা তো কারোর ভালোবাসা পেয়ে একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠতে লাগলো।

স্বামীর কথামতো বড়ো ছেলের জন্যে নতুন করে পাত্রীর সন্ধান শুরু করলেন সরযূ, বনেদী পরিবারে ওই রকম টুকটাক দোষ কে কেউই বিশেষ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না, তাই ঘটকরা নিত্য নতুন পাত্রীর সংবাদ আনতে লাগলো। রতিকান্তের বাড়িতে একটা বউ থাকা বা না থাকাতে খুব বেশি কিছু অদল বদল হওয়ার চিন্তা ছিলো না তাই মায়ের এই নতুন বিয়ের প্রস্তাবে সে সহজেই সম্মতি জানালো।

ভাইয়ের বিয়ে না করার খবর ইতিমধ্যেই আত্মীয় মহলে রটে গিয়েছিলো, তাই রতিকান্তর সু পাত্রী জোগাড় হতে সমস্যা হলো না। ঘটকের দেওয়া দু তিনটে পাত্রী দেখে আসার পর কলকাতা থেকে অনেক দূরের অজ পাড়াগাঁয়ের একটি মেয়ে কে সরযূ র পছন্দ হলো,মেয়েটি একটু বয়স্কা, কিন্তু বেশ চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির, বিয়ের বয়স একটু হলেও পেরিয়ে গেছে। পছন্দ হবার পেছনে নির্দিষ্ট কিছু কারণ ছিলো। প্রথমত রতিকান্তর গুণ কীর্তন বউয়ের বাপের বাড়ি অবধি পৌঁছানোর সুযোগ কম ছিলো, এতদূরে বাপের বাড়িতে আসা যাওয়ার বা বাপের বাড়ির আত্মীয় কুটুম আসার সুযোগও কম। দ্বিতীয় এবং মুখ্য কারণ ছিলো মেয়েটির বাপ মা নেই, দাদাদের সংসারে গলগ্রহ, তাই এই মেয়েকে পার করার পর আর ফেরত দাদারা নেবে না। রতিকান্তের সঙ্গে লাথি ঝাঁটা খেয়েও থেকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

মেয়ের দাদারা যে বোন কে যে করেই হোক পার করতে ইচ্ছুক এটা বুঝেই সরযূ টুকটাক দেনা পাওনার কথাও তুললেন, সব না হলেও কিছুটা দিতে তারা রাজি হলো। সরযূ কে গাড়ি থেকে নামতে দেখে গ্রামের লোকজন হা করে তাকিয়ে ছিলো, দু একজন খেজুরে আলাপ করার জন্যে এগিয়েও এসেছিলো, কিন্তু পাছে বেশি প্রশ্নে আবার ছেলের কথা বেরিয়ে যায় তাই তিনি তাদের এড়িয়ে গেলেন। মেয়ের দাদা, বৌদিরাও পাড়া পড়শী দের এড়িয়ে গেলেন, বিয়ে ভেস্তে দেওয়ার ব্যাপারে তাদের জুড়ি মেলা ভার। যাইহোক মাত্র একদিনের কথায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো, বাড়ি ফিরেই মাস খানেকের মধ্যেই খুব বেশি জানাজানি হবার আগেই ছেলের বিয়ের দিন ঠিক করে ফেললেন সরযূ। ছেলের প্রথম বিয়ে তে কোনো শখই পূরণ হয়নি, দ্বিতীয় বিয়ে তে সেসব শখই পূরণ করার ইচ্ছে ছিলো তাঁর। কিন্তু প্রতাপ সান্যাল রাজি হলেন না, বউ পালানোর মাত্র তিন মাসের মাথায় লম্পট, মদ্যপ ছেলের দ্বিতীয় বউ নিয়ে মাতামাতি তে আত্মীয় স্বজনরা কিছু সমালোচনার সুযোগ পাক, সেটা তিনি চাইলেন না। তিনি মনে মনে নিজের বৈভব প্রদর্শনের জন্য অন্য কিছু ভেবে রাখলেন।

বাবার বিয়েতে ছোট্ট অদ্বিতীয়া, মায়া তার কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কাকার কোলে কোলে ঘুরতে লাগলো। আত্মীয় স্বজনরা তার ভাগ্য দেখে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো, সৎ মা যে মেয়েটিকে একটুও যত্ন করবে না এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিলো।
ক্রমশ