সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-৩+৪

0
253

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩
বিয়ে উপলক্ষ্যে সরযূর বাপের বাড়ির লোকজন হাজির হলো, ভাই বউ সঙ্গে ভাইপো রতন। সে নামে যেমন রতন, কাজেও রত্নই বটে। বাপ, ঠাকুর্দার মৃত্যুর পরে পুরনো ওকালতি ব্যবসা তুলে দিয়ে নিজের জমি বাড়ি বেচে সংসার চালায়। তবে জমি, বাড়ি যা তার আছে তাতে বেচে খেলেও অন্তত তিন পুরুষ যে হেসে খেলে চলে যাবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। পিসি সরযূ শিব রাত্রির সলতে একমাত্র ভাইপো টিকে চোখে হারান, পয়সা কড়ির অভাব তাদের না থাকলেও সুযোগ পেলেই ভাইপোর হাতে কিছু গুঁজে দেন। ভাই বউ বিমলা প্রচণ্ড মুখরা হলেও এক মাত্র বড়লোক ননদটি কে একটুও চটান না। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই ননদ তাকে নিজের বাড়ির পাট তুলে দিয়ে এ বাড়িতে এসে থাকতে বলেছেন অনেকবার, এক্ষুনি না হলেও ভবিষ্যতে তাঁর সেরকমই কিছু পরিকল্পনা আছে।

রতন প্রায় রতিকান্তর বয়সী, দু এক বছরের ছোটো ইতিমধ্যেই দু বার বিয়ে হয়ে গেছে তার। প্রথম বউ রোগগ্রস্ত ছিলো, বাপের বাড়ি থেকে সেসব লুকিয়েই পার করা হয় তাকে, বিয়ের দুমাসের মাথায় সে মারা যায়। দ্বিতীয় বউয়ের সময় যথা সম্ভব সতর্কতা বজায় রেখেছিলো সে, কিন্তু বিয়ের দু বছর পরেও কোনো সন্তান না হওয়ায় তাকে নিজেই ফেরত পাঠিয়েছে।

ভাইয়ের বিয়েতে তাকেই বেশির ভাগ দায়িত্ব দিলেন সরযূ, ছোটো ছেলে সুকান্তর ওপর একটুও আস্থা রাখলেন না। বিয়ের রাতে পাই পয়সা দেনা পাওনার হিসেব বুঝে নেবার ভার পড়লো রতনের ওপরে, কোনো মতেই যাতে কম দিয়ে কনে পক্ষ পার না পেয়ে যায়, সে বিষয়ে তাকে লক্ষ্য রাখতে বললেন। সব থেকে জরুরি বিষয় ছিলো রতিকান্তর সুস্থ থাকা, সে যাতে বিয়ের রাতে তার মোসাহেব বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাতাল না হয়ে পড়ে সে ব্যাপারেও দায়িত্ব রতনের ওপরেই পড়লো।

যথা সময়ে বরযাত্রী রওনা হলো, বিয়ের লগ্ন ছিলো একটু বেশি রাতের দিকে। কলকাতা থেকে ভাড়া করা বাসে যখন বরযাত্রী গ্রামে পৌঁছালো, তখন কনে পক্ষ আবিষ্কার করলো বর সহ প্রায় প্রতিটি বরযাত্রীই মদের ঘোরে অচেতন। তারা বরযাত্রীদের নিয়ে মাথাই ঘামালো না, সব বরযাত্রীই সারারাত বাসের মেঝেতে পড়ে রইলো, শুধু মাত্র রতিকান্ত কে ঘরে নিয়ে গিয়ে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় খানিকটা সুস্থ করে তুলে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলো। বিয়ে নির্বিঘ্নে সমাধা হলো, রতিকান্ত মন্ত্র উচ্চারণ করলো কিনা বোঝা না গেলেও পুরোহিত নিজের কাজ করে গেলেন।

পরের দিন সকালে জ্ঞান আসার পরে রতিকান্ত আবিষ্কার করলো সে বিবাহিত, এবং রতন বুঝলো তার দেনা পাওনার হিসেব নেওয়া এই মুহূর্তে সম্পূর্ণই অর্থহীন। রতিকান্তের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন এলো না, কিন্তু রতনের বুক ভয়ে শুকিয়ে গেলো। এই কথা পিসির কানে পৌঁছলে কি হবে সেসব ভেবেই তার বিয়ে বাড়ির আনন্দ নষ্ট হয়ে গেলো। কিন্তু সকালে জ্ঞান আসার পরে দেখা গেলো কনে পক্ষ বরযাত্রী দের যথেষ্টই যত্ন আত্তি শুরু করলো, কোনো অশান্তি ছাড়াই, বিয়ে হয়ে যাওয়া সত্বেও তারা বরযাত্রীদের সব ধরনের বায়নাক্কা সামলাতে একটুও আপত্তি করলো না।

কনে বিদায়ের সময় কনের চোখে একটুও জলের আভাস দেখা গেলো না, বরং ওখানে উপস্থিত দু একজন নিমন্ত্রিত, মেয়ের বাড়ির লোকেদের অগোচরে রতিকান্ত কে যেচে সাবধানে থাকার উপদেশ দিয়ে গেলো। রতিকান্ত ওসব সাবধানবাণী ধর্তব্যের মধ্যেও আনলো না, সে সাত ঘাটের জল খাওয়া ছেলে, বউ কে কি করে পায়ের তলায় রাখতে হয় তার জানা ছিলো। বরযাত্রী যখন বর কনে সমেত কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলো, তখন মেয়ের বাড়ির লোকেদের মধ্যে একটা নিশ্চিন্ত ভাব দেখা গেলো, তাদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার ভঙ্গি দেখে রতিকান্ত না হলেও বাকি বরযাত্রীরা একটু হলেও চিন্তিত হলো।

ফেরার সময় আর গাড়িতে মাতলামি করার চেষ্টা কোনো বরযাত্রীই করলো না, আগের রাতের ঘটনা স্মরণে আসায় তারা বাস্তবিকই লজ্জিত হচ্ছিলো। বউও গোটা রাস্তাটাই চুপচাপ থাকলো, মুখ ঘোমটার আড়ালে ঢাকা থাকায় কাল রাতের ঘটনায় তার কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা বোঝা সম্ভব ছিলো না। নির্দিষ্ট সময়ে রতিকান্ত বউ নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলো, সরযূ র আশঙ্কা এবং রতনের মাতাল হয়ে পড়ে থাকা সত্বেও মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া দেনা পাওনার কথা তারা রাখলো। বউ যখন দুধে আলতায় পা রাখলো, বউয়ের পা নয় সরযূ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার সঙ্গে আনা দেনা পাওনার মধ্যে কিছু খামতি আছে কিনা সে দিকেই তাকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকলেন। বিয়ে, বৌভাত মিটে গেলো বউ তার স্বামীর আগের পক্ষের মেয়ের কথা শুনেছিল ঠিকই তবে কেও তাকে তার সামনে নিয়ে এলো না।

অষ্ট মঙ্গলা পর্যন্ত প্রতাপ সান্যাল ছেলে কে কড়া চোখে রাখলেন, একবারের জন্যেও বাড়ির বাইরে পা দিতে দিলেন না। শ্বশুরবাড়ি থেকে গাঁটছড়া খুলে আসার পর থেকেই বউয়ের সঙ্গে সত্যিই তার গাঁটছড়া খুলে গেলো, সে বিয়ের দশ দিনের মাথায় আবার তার পুরোনো পথে ফিরে গেলো।

ছেলের নতুন করে আগের জীবনে ফিরে যাওয়া নিয়ে সরযূ বা প্রতাপ সান্যাল কেউই বিশেষ মাথা ঘামালেন না। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব ছিলো না, তাই বউটি প্রায় বেশির ভাগ সময়ই দোতলায় তার নিজের ঘরে কাটাতে লাগলো, স্বামীর আগের পক্ষের মেয়ের প্রতি তার বিশেষ কোনো যত্ন নেওয়ার চেষ্টা দেখা গেলো না। মায়া বার দুয়েক শিশুটি কে তার ঘরে দিয়ে এলেও বিভিন্ন অছিলায় সে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ফেরত দিয়ে গেলো।

প্রথম মা পালিয়ে গেলো, দ্বিতীয় মায়ের তার প্রতি কোনো উৎসাহ ছিলো না, তাই শেষ পর্যন্ত শিশুটি মায়ার তত্বাবধানেই বড়ো হতে লাগলো। সুকান্ত তার ওকালতির ফাঁকে ফাঁকে ভাই ঝির খবর নিয়ে গেলেও রতিকান্ত ভুলেও তার নাম উচ্চারণ করলো না।

বিয়ের পরে প্রায় মাস দুয়েক গড়িয়ে গেলেও নতুন বউয়ের কাছ থেকে কোনো সুসংবাদ পাওয়া গেলো না, সরযূ প্রথমে মনে মনে তারপরে তাকে প্রকাশ্যেই গালি গালাজ করতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে দাসী মহলেও এ খবর ছড়িয়ে পড়লো। বউটি চুপ চাপ শুনে যেতে লাগলো, তার কাছ থেকে একবারের জন্যেও কোনো প্রতিবাদ না আসায়, সরযূ তাঁর গালিগালাজের পরিমাণ ক্রমশ বাড়াতে থাকলেন।

এমন সময়ে একদিন ঘোরতর বর্ষার মধ্যে প্রায় দু রাত অন্য কোথাও কাটানোর পরে এক হাঁটু কাদা মেখে রতিকান্ত সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। সে যখন বাড়িতে ঢুকলো, তখন নতুন বউ স্নান করে উঠোন দিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলো এবং নিয়ম মতো রান্না ঘরের দাওয়ায় বসে সরযূ তাকে গালাগালি করছিলেন।

ছেলে কে ঢুকতে দেখেই সরযূ র নতুন করে শোক উথলে উঠলো, না হওয়া বংশধরের শোকে তিনি প্রায় মরাকান্না জুড়ে দিলেন, মা কে কাঁদতে দেখে রতিকান্তের পুরুষ স্বত্বা হটাৎ করেই জেগে উঠলো, সে কোনো কারণ জানার চেষ্টা না করেই বউয়ের গালে সজোরে এক চড় কষিয়ে দিলো। রতিকান্তের চড় মারার শুধু অপেক্ষা টুকু ছিলো আপাত শান্ত বউ মুহূর্তের মধ্যে রণ চণ্ডী মূর্তি ধারণ করে, এক লাফ দিয়ে উঠে উঠনের কোনে উনুন ধরানোর জন্যে পড়ে থাকা চ্যালা কাঠ তুলে নিয়ে,

ওরে আমার মায়ের সুপুত্তর রে! নিজের মুরোদ নাই যার, সে আবার অন্যের দোষ ধরতে আসে!

বলতে বলতে এক বাড়িতে রতিকান্তের পিঠে সেই চ্যালা কাঠ ভেঙে ফেললো। ঘটনার আকস্মিকতায় সরযূর কান্না বন্ধ হয়ে গেলো, রতিকান্ত পিঠের ব্যাথা ভুলে বউয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। এই একটি বাক্যই যথেষ্ট ছিলো, বউ হাতের ভাঙা কাঠের টুকরো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রতিকান্তর পাশেই থুঃ করে একদলা থুথু ফেলে পাশে রাখা কাচা শাড়ি হাতে তুলে দোতলায় নিজের ঘরের দিকে রওনা হলো।

কয়েক মুহূর্ত পরেই রতিকান্তের সম্বিত ফিরল, সে চারদিক থেকে তাকিয়ে থাকা দাসী চাকরদের অবাক দৃষ্টির সামনে দিয়ে তড়িঘড়ি দোতলার সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। সরযূ রান্না ঘরে বসে রইলেন, কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর সেই দুঁদে ভাব উধাও হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পরে তিনি বউয়ের ভাইদের তাকে পার করার তাড়ার পেছনের আসল রহস্য বুঝতে পারলেন, এবং রতন লক্ষ্য না রাখা সত্বেও কেনো তারা দেনা পাওনা নিয়ে কোনো ঝামেলা বাড়াতে চায় নি সেটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হলো। ত্রাতা হিসেবে এই বিপদে সান্যাল মশাই কে পাশে পাবার চেষ্টায় নিজের ঘরের দিকে রওনা হলেন।

ওরে বাবারে! কি বউ নিয়ে এলুম গো! এ তো ফিরে যাবার বান্দাও নয় গো! এখন আমি কি করি! ভাইরা একে ফেরত নেবে না সে আমি একদিন গিয়েই বুঝেছি! সেই ভেবেই তো এনেছিলুম, কিন্তু সে যে এরকম মা কালী তখন তো বুঝিনি! আমার রতিটাকে আর একটু হলেই মেরে ফেলছিলো গো!! সেতো ভয়ে সিঁটে গেছে একদম!

গিন্নীর মুখে সব কথা শুনেই, তৎক্ষণাৎ বুদ্ধিমান প্রতাপ বাবু, তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ ভেবে নিলেন, এ ছেলে কে যদি কেউ একটু হলেও পথে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে এই বউই, কিন্তু সরযূ সেটা বুঝবেন না! তিনি পুত্র স্নেহে অন্ধ। কয়েক মিনিট ভেবে নিয়ে তিনি গিন্নী কে বললেন,

গিন্নী, এখনো আগের বউয়ের মরার খবর লোকে ভোলেনি, এর মধ্যে এর কিছু হলে সামলানো মুশকিল হবে! বউ না হোক ঘরের ঝি হয়েই থাক না হয়! একে তোমার হেঁসেলে ঢুকিয়ে দাও, বামুনের হাতে হাতে করুক একটু!!

একটু মনঃক্ষুন্ন হলেও স্বামীর কথার যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারলেন না সরযূ, তাই দ্বিতীয় পন্থা হিসেবে একটু ভয়ে ভয়েই মায়া কে দিয়ে বউ কে ডাকিয়ে নিয়ে এসে হেঁসেলে হাত লাগানোর কাজে বহাল করলেন। ভাইদের সংসারে রীতিমত খেটে খেতেই অভ্যস্ত ছিলো নতুন বউ সরলা, তাই বিনা প্রতিবাদেই সে এ কাজে সামিল হলো। সান্যাল গিন্নী হাঁফ ছাড়লেন, পটের বিবি হয়ে দোতলায় বসে না থেকে কিছু তো কাজে আসুক।

রতিকান্ত সেই যে চ্যালা কাঠের বাড়ি খেয়ে দোতলায় নিজের ঘরে উঠলো, তিন দিন আর তার খাট থেকে নামার ক্ষমতা থাকলো না। তবে প্রতাপ সান্যাল যা আশা করেছিলেন তা ঘটলো না, সুস্থ হয়েই সে রাত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লো, ফারাক একটাই এ বার থেকে সে দিন সাতেক ছাড়া বাড়ি ফিরতে লাগলো, আর বউয়ের বাড়ি খাবার ভয়ে, ভুলেও দোতলায় শুতে উঠলো না, নিচের বৈঠকখানায় পড়ে থাকতে লাগলো।

শিশুটি যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই পড়ে থাকলো, না সরযূ তার দায়িত্ব নিলেন, না ছেলের বউ কে দায়িত্ব নিতে বললেন। নতুন মায়ের সঙ্গে অদ্বিতীয়ার কোনো রকম সম্পর্কই গড়ে উঠলো না।
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪
মেয়েটির কই মাছের প্রাণ, বাবা, ঠাকুমার লাথি ঝাঁটা খেয়ে, নতুন মায়ের অবহেলা সহ্য করেও, মায়ার সাহায্যেই সে তার নারী জন্মের প্রথম সাত মাস কাটিয়ে ফেললো। সাত মাসের মাথায় নাতনির অন্নপ্রাশন এর আয়োজন করলেন প্রতাপ বাবু। যে অনুষ্ঠান তিনি ছেলের বিয়েতে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, সেই অনুষ্ঠান করে তিনি তাঁর সুপ্ত ইচ্ছে পূরণ করলেন।

ধুমধাম করে অন্নপ্রাশন হলো, সান্যাল পরিবারের কাছে দূরের কোনো আত্মীয়স্বজন সেখানে নিমন্ত্রিত হতে বাদ গেলোনা। উকিল প্রতাপ বাবু কোনো কাজই বিনা উদ্দেশ্যে করেন না, গিন্নী নাতনি কে নিয়ে আদিখ্যেতায় বিরক্ত হলেও তাঁর উদ্দেশ্য অন্য ছিলো। অদ্বিতীয়া তাঁর দাবার চালের বোড়ে মাত্র, তাকে সামনে রেখে তিনি নিজের বংশের কলঙ্ক মুছে ফেলার চেষ্টা চালালেন।

অন্নপ্রাশনের দিন প্রতাপ সান্যাল যে বৈভব প্রদর্শন করলেন, তাতে অন্য সান্যালদের চোখ টাটালো। অনুষ্ঠানে প্রায় সব শরিকই উপস্থিত ছিলেন, তাদের মৃদু ফিসফাস চাকর বাকরদের কল্যাণে ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে প্রতাপ সান্যালের কানে পৌঁছালো। তিনি মনে মনে যথেষ্টই গর্বিত হলেন, নাতনির মুখেভাত তো অজুহাত মাত্র,আসলে তো শুধুই তাঁদের বৈভব দেখানোর প্রচেষ্টা, এবং তাতে তিনি ভালো ভাবেই সফল হয়েছেন।

প্রতাপ সান্যালের আমলেই কিছুটা হলেও তাঁর বংশ গৌরব ক্ষুন্ন হয়েছে পুত্র রতিকান্ত র জন্যে, সে দুঃখ তিনি মনেই পুষে রেখেছিলেন এতদিন। এখন রতিকান্তর বউটি কে সুকৌশলে সরিয়ে দিয়ে, তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছেন। দ্বিতীয় বার বিয়েও দিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। ছোটো পুত্র সুকান্তও পসার ফিরিয়ে এনেছেন তাঁদের পৈতৃক ব্যবসার। এই সব কিছু দেখানোর জন্যেই যে তাঁর এই মুখেভাতের বিশাল আয়োজন তা তিনিও মুখে প্রকাশ করেন নি শরিক দের কাছে বা তারাও বুঝতে দেয়নি যে তারা বুঝেছে!! কিন্তু তাঁরা সবাই বংশগত ধুরন্ধর উকিল, এই বোঝা আর না বোঝার মাঝখানের অংশটুকু তাই দু পক্ষই যথেষ্টই উপভোগ করেছে মুখেভাতে র দিনে!

হ্যাঁ, গো ছোটো বউ, রতির আগের বউটা কি সত্যিই ওই জায়গার মেয়ে ছিলো নাকি!

টানা লম্বা বারান্দায় একধারে মহিলা মহলে গল্প চলতে চলতে প্রশ্ন করলেন সুশীলা দেবী, সম্পর্কে প্রতাপ সান্যালের মাসতুতো দিদি, রতিকান্তর পিসি। যাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলা সেই ছোটো অর্থাৎ প্রতাপ সান্যালের ছোটো ভাইয়ের ছেলের বউ সুমনা মাথা নাড়লেন, চোখে মুখে বিকৃতির ভাব ফুটিয়ে তুলে বললেন,

জানি নে পিসি! কি ঘেন্না! কি ঘেন্না! ওসব নোংরা কথা শোনাও পাপ! কি ছিলো সান্যালরা আর কি হলো! মান সম্মান বলতে কিছু রইলো না গো! সেই মায়ের পেটের মেয়ের মুখে ভাতে খেতে বসতে হবে ভাবলেই গা টা কেমন গুলিয়ে উঠছে গো!

প্রসঙ্গ শুধু তোলার অপেক্ষা ছিলো, কিছুক্ষনের মধ্যেই মহিলা মহলে উপস্থিত সবাই এই ব্যাপারে সহমত হলো যে এই অনুষ্ঠানে আসা তাদের জন্যে একটুও ভালো হয় নি। কিন্তু তা সত্বেও কেউই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে একবারের জন্যেও প্রকাশ করলো না, তার কারণ একটাই, এই মুহূর্তে সুকান্তর কল্যাণেই প্রতাপ সান্যালের পরিবারই সান্যালের মধ্যে সবচেয়ে ভালো জায়গায় রয়েছে। তাই প্রতাপ সান্যালের ঘনিষ্ট দেখানোর প্রচেষ্টাই তাদের সবার স্বামীদের এখানে টেনে এনেছে।

বিশেষ করে সুশীলা দেবী আর সুমনার উদ্যেশ্য তো আরো অনেকটাই বেশি, তাদের ছেলেরাই প্রতাপ বাবুর সবচেয়ে কাছের, তারা অনেকটাই প্রতাপ সান্যালের সম্পত্তির অধিকারী হতে পারে। ছেলের ওই চরিত্রহীন বউয়ের মেয়েকে যতই ধুমধাম করে অন্নপ্রাশন দিক সান্যাল মশাই, কিন্তু বনেদিয়ানায় বিশ্বাসী প্রতাপ বাবু সব সম্পত্তি নাতনির হাতে তুলে দেবেন না বলে ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন। সেই সুযোগে বাকি অর্ধেকের ছিটেফোঁটাও যদি তাদের ভাগ্যে আসে তাহলেও তা কম নয়।

মহিলা মহলের আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন ওখানে উপস্থিত ভাই বউয়ের কল্যাণে তা কিছুক্ষনের মধ্যেই সরযূ দেবীর কানে পৌঁছে গেলো, গা ভর্তি গয়না আর টকটকে লাল পাড়ের গরদ সামলাতে সামলাতে তিনি উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখেই প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরে গেলো, সরযূ দেবী যে যথেষ্টই মুখরা সে খবর তাঁর ননদ বা ছোটো ভাসুরপো র বউয়ের থেকে আর বেশি কে জানে।

কিন্তু সরযুও উকিলের বউ এবং দুঁদে উকিলের মেয়ে, তাঁর বাবার সঙ্গে তাঁর উকিল শ্বশুরের সখ্যতাই তাঁকে বনেদী সান্যাল বাড়ির বউ করেছে। তাই পিতৃদত্ত ক্ষমতায় এবং স্বামীর সাহচর্যে উকিলি বুদ্ধিতে তিনি অনেক তুখোড় উকিলেরও কান কাটেন, ঘুরে যাওয়া প্রসঙ্গ কে একটুও ঘুরতে না দিয়ে আবার নতুন করে উত্থাপন করলেন তিনি, ননদের দিকে তাকিয়ে গলায় মধু ঝরিয়ে বললেন

আমার নাতনি কে দেখেছো বড়দি? এক্কেরে সাক্ষাৎ লক্ষী ঠাকুর গো! আর হবে না কেনো বলো, সান্যাল বাড়ির মেয়ে বলে কথা! সে তার মা যেখানের হোক না কেনো!! ভগবান আছেন গো দিদি, তিনি মুখ তুলে চেয়েছেন! না হলে ওই ডাইনি কি আর অতো সহজে আমার রতির ঘাড় থেকে নামতো! ওই ডাইনির জন্যে বেচারা আমার রতির অবস্থাখান কি হয়েছিলো বলো দিকি! কর্তা মশাইয়ের কাছে তো বংশের সম্মানটাই শেষ কথা, ওই মেয়ের জন্যে শেষে ছেলে কেও ছেড়ে দিচ্ছিলেন গো! ভাগ্যিস মরলো ডাইনি টা, তাই তো আমার ছেলে, নাতনি কে ফিরে পেলাম। আর আমার নতুন বৌমা! মেয়ে অন্ত প্রাণ তার, ওই মেয়ে মেয়ে করেই তো বাপের বাড়িও যেতে পারে না গো!

সান্যাল গিন্নি যে নিজেই নিজের ছেলের আগের পক্ষের বউয়ের গুণকীর্তন করতে বসবেন সে আশা বাকি মহিলারা করেন নি, এখন ঘটনা প্রবাহ অন্য দিকে ঘুরে যেতে দেখেই তাঁরাও উৎসাহ নিয়ে আলোচনায় যোগদান করলেন। সরযূ কে আসতে দেখে চেপে যাওয়া গল্প নতুন করে শুরু হলো, রতিকান্তর বউয়ের মারা যাওয়া যে সরযূর গত জন্মের পুণ্যের ফল সে বিষয়ে সবাই একমত হলো। এমনকি কেউ কেউ এ কথাও স্বীকার করলো যে রতিকান্ত বরাবরের সুবোধ বালক ছিলো, তার ওই বউয়ের আগমনই তার জীবনে নরক যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে এসেছিলো। সান্যাল গিন্নি মনে মনেই হাসলেন এবং তাঁর ননদ এবং জায়ের বউটিকে কি করে অপদস্থ করে তাদের মুখ বন্ধ করা যায় সে তক্কে তক্কে রইলেন।

নতুন বউ সরলার একটা অদ্ভুত অভ্যেস ছিলো, এমনিতে সে শান্ত শিষ্ট, শাশুড়ির হাজার গালাগালিতেও সে মুখ খুলতো না, সম্ভবত শাশুড়ির গালাগালি কে সে তার প্রাপ্য বলেই মনে করতো, খুব বেশি গুরুত্ব দিতো বলেও মনে হতো না। কিন্তু, সরযূ বাদে কারোর সমালোচনা বা অসভ্যতা সহ্য করা তার বোধহয় ধাতে ছিলো না। খুড়তুতো জা সুমনার অদ্বিতীয়ার মুখে ভাতে খাওয়া নিয়ে প্রকাশ করা ঘেন্নার কথা সে ওখানে বসেই শুনলো, তার পরে ধীরে ধীরে উঠে গেলো কোনো প্রতিবাদ না করেই।

এইসব আলোচনা চলাকালীন অদ্বিতীয়ার ঘুম ভাঙলো, তার কান্নার আওয়াজে মায়া তাকে নিয়ে এসে মহিলা মহলে উপস্থিত হলো। ফুটফুটে শিশু টি বাস্তবিকই সুন্দর, কিছুক্ষনের মধ্যেই কেউ তার মুখে চোখে, কেউ তার চুলের, চোখের মণির রঙে, গায়ের টকটকে ফর্সা ভাবে সান্যাল বংশের ছাপ খুঁজে পেলো। এব্যাপারে সবাই একমত হলো যে মেয়েটি তার মায়ের কিছুই পায়নি, তার নখ থেকে চুল পর্যন্ত পুরোটাতেই বনেদী সান্যালদের ছাপ স্পষ্ট। এমনকি কিছুক্ষন আগেই যে ছোটো বউ সুমনা তার মুখে ভাতে খেতে ঘেন্না প্রকাশ করছিলো সেও কোলে নিয়ে তাকে আদরে আদরে অতিষ্ঠ করে তুললো।

খাওয়ার পাত পড়ছিলো, পুরুষরা উঠোন লাগোয়া বারান্দায় সার সার খেতে বসেছিলো, মহিলারা হেঁসেলের ভেতরে পিঁড়ি পেতে। পুরুষদের পরিবেশন ছেলেরা করলেও, মহিলামহলের ভার বাড়ির মহিলাদের ওপরেই ন্যস্ত ছিলো। সরযূ ঘুরে ফিরে দু দিকেরই তদারকি করছিলেন, হেঁসেলে পরিবেশনের ভার সরলা আর মায়ার দায়িত্বে ছিলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, সবার পাতে খাবার পড়লেও, সুমনার কলাপাতা একেবারে খালি। সুমনার সঙ্গে সরযূও অবাক হলেন, তিনি সরলা কে সেই ভাবে কখনই গুরুত্ব দেন না, মায়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,

একি! ওর পাত খালি কেনো! কেমন পরিবেশন করিস তোরা!

ছোড়দি এখানে খাবেন না বলেছেন আমাকে, ওনার ঘেন্না লাগছে,

মায়া কিছু বলার আগেই শান্ত গলায় উত্তর দিলো সরলা, সুমনা থতমত খেলো। বাকি সবাই সকালে আলোচনা করা ঘটনা স্মরণ করে চুপ করে থাকলেও সরযূ তাঁর বদলে অন্য কেউ গিন্নী হবার সাহস দেখাবে এটা একটুও সহ্য করলেন না, মায়া কে ধমকে উঠে বললেন,

যা বলছি তাই কর! ওই পাতায় ভাত দে!

এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে, মায়া ভাতের হাঁড়ি হাতে ওঠানোর আগেই দ্রুত উঠোনে নেমে গিয়ে ওখান থেকে একটা চ্যালা কাঠ হাতে তুলে নিলো সরলা। ছেলের বউ কে চ্যালা কাঠ হাতে দেখে সেই পুরোনো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো সরযূর, তিনি কালবিলম্ব না করেই গিন্নী হবার চেষ্টা আপাতত স্থগিত রেখে ওখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করলেন। গিন্নী কে রওনা হতে দেখে চ্যালা কাঠ পাছে তার পিঠেই পড়ে একথা ভেবেই বোধহয় মায়া ভাতের হাঁড়ি থেকে হাত সরিয়ে নিলো।

আগুনটা নিভে আসছে, তাড়াতাড়ি হাতের কাজ শেষ করো মায়া দি, এই বেলা খাবারগুলো গরম না করে নিলে রাতে নষ্ট হয়ে যাবে,

বলতে বলতে শান্ত মুখে কাঠটা উনুনের ভেতরে গুঁজে দিলো সরলা। কাঠের রহস্য বোঝা সম্ভব না হলেও এর পরে সবার পাতে খাবার পড়তে লাগলো, সুমনা খালি পাতে বসে রইলেন, কেউ আর কোনো প্রশ্ন করলো না।

আস্তে আস্তে অন্ন প্রাশন পর্ব মিটে গেলো, দুপুরের ভোজন পর্বের শেষে যখন এক এক করে অতিথিরা বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন সরযূ এগিয়ে এলেন। বড়দি সুশীলা কে গাড়িতে তুলে দেবার জন্যে প্রতাপ সান্যাল নিজে উপস্থিত ছিলেন। সুশীলা দেবীর বাতের ব্যথার কথা সবার জানা, তা সত্বেও এই শরীরেই যে তিনি ভাইয়ের বাড়ি আসার কষ্ট করেছেন তার জন্যে বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে সরযূ মাসতুতো ননদের পায়ে হাত দিলেন। হাতে ধরে রাখা মিষ্টির প্যাকেট ননদের হাতে দিয়ে বললেন,

বড়দি, খুব ভালো লাগলো তুমি এলে, তোমার ভাই তো বলছিলো এই শরীরে দিদি কিছুতেই আসতে পারবে না! আমি কিন্তু জানতুম তুমি আসবে, রতি কে কি তুমি কম ভালোবাসো! সেই ছোটো থেকেই রতি কে তো তুমি তপুর সঙ্গে কখনো আলাদা করে দেখোনি গো! তা হ্যাঁ গো বড়দি! কথায় কথায় তপুর খবর নিতে ভুলেই গেছি একদম! সে ভালো আছে তো? কবে ফিরবে গো দেশে? বেশি দেরি করো না, সে ফিরলেই একখান ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দাও দিকি, আমরাও আনন্দ করি এট্টু! ওসব বিদেশ বিভুয়ে কোন ম্লেচ্ছ মেয়ের পাল্লায় পড়ে যায় আবার!! দিনকাল তো ভালো নয়! খানিকটা যেনো সেদিন তপুর ব্যাপারেও ভাসা ভাসা শুনলুম, কে যে বললো ছাই! দরকারের সময় আর মনে পড়ে না!

আর একটুও অপেক্ষা করলেন না সুশীলা দেবী, তাঁর পুত্র টি যে ইতিমধ্যেই বিদেশিনী বিয়ে করে ফেলেছে সে কথা তাঁরা কর্তা গিন্নি যতই লুকিয়ে রাখতে চান না কেনো, সে খবর যে ভাই বউয়ের অজানা নয় সেটা বুঝেই তাড়াতাড়ি ড্রাইভার কে গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়ে ফেললেন। নিজে যাবার জন্যে তৈরি হয়েই গম্ভীর মুখে জ্যেঠ শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুমনা, প্রতাপ সান্যাল ভাই পো বউয়ের দিকে তাকালেন,

ভালো করে খেয়েছো তো মা?

শ্বশুরের প্রশ্নে মাথা নাড়লেন সুমনা, সত্যি কথা বলার সাহস তাঁর ছিলো না। বলতে গেলে কিসের পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনা ঘটলো, তাও তাঁকে বিস্তারিত বলতে হতো, তাতে তিনিই বিপদে পড়বেন সেটা বুঝেই তিনি মুখ বন্ধ রাখলেন।

একটু পরেই সুমনার স্বামী রথীন বেরিয়ে এলেন, তাঁকে দেখেই তড়িঘড়ি,

বড়ো মা এলুম গো! খুব সুন্দর মেয়ে হয়েছে আমাদের!

বলতে বলতে গাড়িতে চেপে বসলেন সুমনা, স্বামীর দিকে তাকিয়ে দ্রুত উঠে আসার ইশারা সরযূর চোখ এড়ালো না, দেওরপোর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন,

যাও বাবা, ছোটো বৌমা বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মেয়ের ধকল সামলাতে সামলাতে, সেই সকাল থেকে ওর কোলেই ঘুরছে তো!

রথীন একটাও কথা না বলে গাড়িতে চেপে বসলেন, তাঁর উকিলি বুদ্ধি তাঁকে এক্ষেত্রে চুপ করে থাকার পরামর্শই দিলো, জ্যেঠিমা যে তাঁর উত্তরের অপেক্ষাতেই আছেন সেটা বুঝেই তিনি সযত্নে এই টিপ্পনী টুকু এড়িয়ে গেলেন।

আত্মীয় স্বজনরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে তাদের নিন্দেয় বসলেন সান্যাল গিন্নী, মহিলাদের মুখে ঈর্ষার ছাপ তাদের দুজনকেই আনন্দ দিচ্ছিলো। মনে মনে ছেলের বউয়ের ওপরে খুশি হলেও, তাঁর কতৃত্ব চলে যাওয়ার কথা আত্মীয় স্বজনরা বুঝে ফেললো কিনা এ চিন্তাও তাঁর কম ছিলো না।
ক্রমশ