সেদিন বৃষ্টি হবে পর্ব-০৯

0
378

#সেদিন বৃষ্টি হবে
#পর্ব_০৯
#সামিয়া_মেহেরিন

নিস্তব্ধ অপরাহ্ন। নীল আকাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা। থেকে থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যায়। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে তূর্ণাদের গাড়ি এগিয়ে যায়। আজই তারা ঢাকায় ফিরবে।

তূর্ণার মন বিষণ্ণ। আরো কিছুদিন থাকতে চেয়েছিল সে এই গ্রাম্য পরিবেশে। কিন্তু সে গুঁড়ে বালি। অফিস থেকে উদয়ের ফোন এসেছিল। দরকারি কাজে যেতে হবে তাকে।

তূর্ণা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশ দেখছে। গাড়ির জানালার কাচ নামানো। সবে দুই-তিন মিনিট হয়েছে গাড়ি চলেছে।
সহসা গাড়ি থামিয়ে দেয় উদয়। গাড়ির গতি থেমে যাওয়ায় তূর্ণা বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উদয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে। বুঝে উঠতে পারে না কেন গাড়ি থামিয়েছে সে।

উদয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকায় তূর্ণা। গাড়ির থেকে কয়েক হাত দূরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। উদয়ের একটু সময় লাগলেও মেয়েটাকে চিনে ফেলে। এটা সেই সকালের মেয়েটা।

উদয় তূর্ণাকে গাড়িতে বসে থাকতে ডলে নিজে গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটার কাছে যায়। তূর্ণা গভীর দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যেন কথা বলছে তারা। কিন্তু তূর্ণা তা শুনতে পারে না।

মিনিট পাঁচেক পর উদয় মেয়েটাকে সাথে নিয়ে গাড়ির কাছে আসে। তূর্ণা যেদিকটায় বসেছিল সেদিকে গিয়ে জানালার বাইরে থেকে তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে,
“তূর্ণা, পেছনের সিটে গিয়ে বসো।”

“হু?”
উদয়ের কথা বুঝতে সময় লাগে তূর্ণার। উদয় আবারো বলে,
“বিভা আমাদের সাথে ঢাকায় যাবে। তুমি পেছনের সিটে বসো। এখানে ও বসবে।”

তূর্ণা গোলগোল চোখ করে একবার উদয়ের দিকে তাকায়, একবার,মেয়েটার দিকে। কে এই মেয়ে? আর তাদের সাথেই বা কেন যাবে? গেলেও তার সিটেই কেন বসতে হবে? উদয়ের পাশে?

অকস্মাৎ মনে আসে সেদিনের সেই ছবির কথাটা। সাথে কেই ‘বিভাবতী’ সম্বোধনের অলিখিত চিঠিটার কথা। এই মেয়েটার নামও তো বিভা বলছে উদয়। তবে কি মেয়েটার সাথে উদয়ের কোনো সম্পর্ক আছে?

উদয় এবার ধমকে ওঠে।
“কি হলো বসে আছো কেন? বের হও।”

তূর্ণা মুখ ভার করে বেরিয়ে পিছনের সিটে বসে। আর সেই মেয়েটা সামনের সিটে উদয়ের পাশে। উদয় ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আর তূর্ণা নিজ মনে নানা ভাবনা-চিন্তায় মত্ত। এতো ভাবনা-চিন্তায় নিজেকে না ডুবিয়ে রাখলে হয়তো তার চোখে পড়তো উদয়ের বারবার তার দিকে তাকানো। গাড়ির সামনের আয়নাটায় তূর্ণার গোলগাল মুখশ্রীতেই উদয় নামক মানুষটা ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে বারবার। তাহলে কি এই কারণেই তূর্ণাকে পিছনের সিটে বসতে বলেছিল?
_______________

ঢাকায় আসার পর পেরিয়ে গেছে এক সপ্তাহ। বিভা নামের মেয়েটা উদয়দের বাসাতেই থাকে। তূর্ণা লক্ষ করেছে একয়দিনে বিভার সাথে ঊর্মিলা বেগমের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। প্রায়ই দুজন একসাথে কই যেন বেরিয়ে যায়।

বিভা আর ঊর্মিলা বেগমের সখ্যতা তূর্ণার মনে দাগ না কাটলেও উদয়ের সাথে বিভার সখ্যতা সহ্য করতে পারে না তূর্ণা। প্রায়ই দেখা যায় দুজন কি নিয়ে যেন কথা বলছে। হুটহাট দুজন বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সবটাই তূর্ণার নজরে পড়েছে।

রাত ১১টা। তূর্ণা বিছানায় শুয়ে এদিক ওদিক করছে। ঘুম ধরা দিচ্ছে না চোখে। উদয় পাশে বসে ল্যাপটপে নিজের কাজ করছে। তূর্ণার ছটফটানি দেখে ল্যাপটপ রেখে ঘরের লাইট অফ করে দেয়। তূর্ণার পাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। ক্লান্ত থাকায় চোখে ঘুমও ধরা দিতে সময় লাগে না। উদয়ের ঘুমিয়ে যাওয়া টের পেয়ে তূর্ণা উদয়ের দিকে ফিরে। পূর্ণিমা রাত হওয়ায় চাঁদের আলোতে উদয়ের মুখশ্রী আবছা আবছা দেখা যায়। সেদিকেই অনিমেষ তাকিয়ে থাকে তূর্ণা। মনে মনে এই মানুষটাকে নিয়ে হাজারো কল্পনা-জল্পনা আঁকে। মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয় মনে বারবার উঁকি দিয়ে যায়।

সহসা বেজে ওঠে উদয়ের ফোন। তূর্ণা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাওয়ার ভান ধরে। ফোনের ওপাশ থেকে কি বলে তা শুনতে পায় না। শুধু শোনে উদয় কাউকে বলছে-এক্ষুনি আসছি।

উদয় তূর্ণার পাশ থেকে উঠে গিয়ে নিজের জ্যাকেটটা পড়ে বেরিয়ে যায়। উদয়ের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তূর্ণা উঠে বসে। কে ফোন করেছিল উদয়কে যে সে এভাবে হম্বিতম্বি করে বেরিয়ে গেল?

তূর্ণা বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দার কাছে যায়। নিচে তাকিয়ে দেখে উদয় গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসছে। আর তার সাথে রয়েছে বিভা নামের মেয়েটি।

তূর্ণা জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। সহ্য হচ্ছে না আর তার। আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে। তূর্ণা দপদপ করে পা ফেলে বিছানায় গিয়ে বসে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।

কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর হঠাৎ মাথায় আসে উদয়ের সেই ডায়েরিটার কথা। এতোদিন সুযোগই পায়নি ডায়েরিটা পড়ার। উদয় যেহেতু এখনো আসেনি তবে পড়াই যায় এখন।

তূর্ণা উঠে গিয়ে আলমারি থেকে ডায়েরিটা বের করে নিয়ে আসে। আগের জায়গাটায়ই ছিল। তাই খুঁজতে হয়নি।

সেদিন যতটুকু পড়েছিল তার পরের পৃষ্ঠা থেকে পড়তে শুরু করে তূর্ণা।

“বলেছিলাম না আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাতেও বৃষ্টি হবে! মিললো তবে আমার কথা।”

এতটুকু লিখা। পৃষ্ঠা উল্টায় তূর্ণা।

“জানো তোমার আর বৃষ্টির মাঝে অদ্ভুত সম্পর্ক আছে। প্রথমত যেদিনই তোমার সাথে দেখা হয়, সেদিনই বৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়, আর তুমিও। তৃতীয়ত, বৃষ্টি আমি চাইলেই আকাশ হতে ঝরে না, আর তোমাকেও চাইলেই আমি পাবো না।”

পরের পৃষ্ঠায় লিখা,
“ভালোবাসা কী? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা ছিল না। কিন্তু যেদিন তোমার পদচারণা ঘটেছে আমার জীবনে, সেদিন থেকে বুঝেছি ভালোবাসা কি। সাথে এও বুঝেছি, ভালোবাসার দহন যন্ত্রণা কতটা পোড়ায় মানুষকে।”

পরের পৃষ্ঠায় লিখা,
“তোমার প্রতি আমার অনুভূতি তুমি ব্যতিত তোমার আশেপাশের সবাই জানে। কি অদ্ভুত তাই না!”

পৃষ্ঠা উল্টায় তূর্ণা।
“আমার হৃদয়ের বিরহ যন্ত্রণা তুমি কি কখনোই বুঝবে না? নিজের অজান্তেই আমি নামক মানুষটাকে তুমি আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছো, তা কি টের পাও তুমি?”

পরের পৃষ্ঠায় লেখা,
“সে আমার না হোক, তবু আমার সম্মুখে অন্যকারো না হোক।”

তূর্ণার হৃদয় কেঁপে ওঠে। এই কথাটার ভার তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বহন করতে পারে না। কোনো রকম নিজেকে সামলে পৃষ্ঠা উল্টায়। কিন্তু কিছু লেখা পায় না। পরের আরো কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখে তবু কিছু লেখা নেই। এতটুকুই লেখা। ডায়েরিটা আগের জায়গায় রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ে তূর্ণা।

রাত ১২.৩০টার দিকে বাড়ি ফেরে উদয়। তূর্ণা জেগেই ছিল কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। উদয় গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

রাত আধো ঘুম, আধো জাগরণে কেটে যায় তূর্ণার।
ভোরের আলো ফুটেছে খানিকক্ষণ আগে। ঘড়িতে বাজে ৬.৩০। উদয়ের ফোন বেজে ওঠে। তূর্ণার চোখ থেকে ঘুম আগে থেকেই পালিয়েছে। চোখ বুজে শুয়ে ছিল কেবল।

উদয় ঘুম ঘুম চোখ মেলে ফোনটা হাতে নেয়। কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কি যেন শুনে আগের মতোই বলে সে তাড়াতাড়ি আসছে।

বিছানা ছেড়ে উঠে কোনোরকম মুখটা ধুয়ে জ্যাকেটটা পড়ে বেরিয়ে যেতে নেয় উদয়। ঘরের দরজাটা যেই না খুলেছে অমনি কানে বাড়ি খায় তূর্ণার থমথমে গলার আওয়াজ।

“এতো সকালে কোথায় যাচ্ছেন?”

তূর্ণা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তার গম্ভীর দৃষ্টি উদয়ের দিকে আবদ্ধ। উদয় বলে ওঠে,
“দরকারি কাজ আছে। যেতে হবে।”

তূর্ণা তাচ্ছিল্যে হেসে বলে,
“হ্যাঁ, কি কাজ বুঝতেই তো পাচ্ছি। আর কাজটা কার সাথে তাও বুঝতে পারছি। আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো। গ্রামে কি আদেও কোনো কাজে গিয়েছিলেন, নাকি নিজের জন্য রক্ষি’তা খুঁজতে গিয়েছিলেন?”

কথাটা বলতে দেরি হয়েছে তূর্ণার কিন্তু গালে থাস করে থাপ্পড় পড়তে দেরি হয়নি। উদয় অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তূর্ণার দিকে। তূর্ণা কোনো রকমে নিজের কান্না থামিয়ে উদয়কে কিছু বলতে নিবে তার আগেই উদয় বিছানায় পড়ে থাকা তূর্ণার ওড়নাটা ভালোমতো তূর্ণার গায়ে জড়িয়ে দেয়। সময় নষ্ট না করে তূর্ণার হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে বাসার বাইরে নিয়ে আসে। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে উদয়।
____________

উদয় তূর্ণাকে নিয়ে একটা হাসপাতালে আসে। তূর্ণা কিছুটা অবাক হয়। এটা সেই হাসপাতাল যেটায় আসমার সাথে এসেছিল তূর্ণা।

আগের ন্যায় তূর্ণার হাতখানা শক্ত করে ধরে টানতে টানতে হাসপাতালের ভিতর নিয়ে যায় উদয় তূর্ণাকে। একটা কেবিনের ভিতর নিয়ে আসে।

কেবিনটায় আগে থেকেই উপস্থিত ছিল বিভা আর নওরিন। আরো একজন ছিল সেই কেবিনে যাকে দেখে তূর্ণা হতভম্ব।

হাসপাতালের সাদা বিছানায় শুয়ে আছে এক পুরুষ। দেখতে হুবহু উদয়ের মতো। শুধু পার্থক্য এই যে উদয়ের গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ। আর বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকা উদয়ের মতো মানুষটার গায়ের রঙ ফর্সা।

চলবে!