সেদিন বৃষ্টি হবে পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
776

#সেদিন বৃষ্টি হবে
#সমাপ্তি পর্ব
#সামিয়া_মেহেরিন

তূর্ণার ছলছল চোখ দেখে হতভম্ব হয় উদয়। তবু নিজেকে সামলে বলে ওঠে,
“না। কেউ নও। খেতে এসো জলদি।”

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় উদয়। তূর্ণার চোখ বেয়ে জল গড়াতে চায়। কিন্তু তা গড়াতে দেয় না তূর্ণা। নাহ, অনেক হয়েছে। আর থাকবে না সে এই বাড়িতে। আর থাকবে না এই কঠোর হৃদয়হীন মানুষটার সাথে।

এই রাত বিরেতেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায় তূর্ণা। বাসার কেউ দেখেনি। দেখলে রাত ১০টার সময় একা কোনোভাবেই বেরোতে দিতো না তাকে।

দশ মিনিটের পথ হেঁটে এসে বাড়ির কলিংবেল চেপে ধরে তূর্ণা। নিলাশা বেগম এসে দরজা খুলেন। এই অসময়ে তূর্ণাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হন। তূর্ণা তাকে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। ধপ করে বিছানায় বসে পরে।

খানিকক্ষণ পরে নিলাশা বেগম কোমরে এসে তূর্ণার সামনে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ান। মুখে ঈষৎ রাগান্বিত ছাপ ফুটিয়ে বলেন,
“এই অসময়ে তুই এই বাড়িতে কেন, তূর্ণা? নির্ঘাত উদয়ের সাথে ঝগড়া করে এসেছিস তুই। আর কি পারিস তুই? আরে তোর তো উদয়ের পা ধোয়া পানি খাওয়া উচিত।”

তূর্ণা গাল ফুলিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
“উদয় উদয় করো না তো মা। ওই নামটা আমার শুনতে ইচ্ছে করে না।”

নিলাশা বেগম রেগে নেই ঠিকই কিন্তু তবু গলায় রাগী রাগী ভাব এনে বলেন,
“এবার আমি নিশ্চিত তুই নিজেই ঝগড়া করে এসেছিস। উদয় তো ঝগড়ার ধারে কাছে ঘেঁষে না। শোন এক্ষুনি তুই ওবাড়ি যাবি। উদয়ের পা ধরে মাপ চাবি বুঝেছিস?”

“মা! তুমি এতো উদয়ের তরফদারি করো কেন বলোতো।”

নিলাশা বেগম বলে ওঠেন,
“তো কি তোর তরফদারি করব? ঝগরুটে মেয়ে একটা।”

তূর্ণা মুখ ভেঙচি দেয়। মায়ের হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“মা? আজ সত্যি করে একটা কথা বলবে।”

নিলাশা বেগম মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বোঝান। তূর্ণা তাকে প্রশ্ন করে,
“মা, বিয়ের দিন আমার মুখে রুমাল চেপে আমাকে অজ্ঞান করেছিল কে?

“উদয়।”

নিলাশা বেগমের সরল স্বীকারোক্তি। তূর্ণা আবারো প্রশ্ন করে।
“আমাদেয ওই ছবিগুলো কে তুলেছিল?

“তুষার।”

“নওশাদ ভাইকে বিয়ের রাতে জামাকাপড়ের ব্যাগ কে দিয়েছিল?”

“আমি।”

তূর্ণা চোখ বুঝে একটা শ্বাস নেয়। আবারো প্রশ্ন করে,
“নওশাদ ভাই কেন বিয়েটা মেনে নেয় নি?”

“তা জানি না।”

তূর্ণা মাথা নিচু করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে। খানিকক্ষণ পর মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকায়। নিলাশা বেগমের স্থির দৃষ্টি মেয়ের দিকে। তূর্ণা বলে,
“সবই ঠিক আছে। কিন্তু ওই ছবিগুলো সবাইকে দেখানো কি খুব দরকার ছিল? সবার কথা নাহয় বাদ দিলাম। বাবা আমাকে ভুল বুঝলো। বাবার চোখে আমি ছোট হয়ে গেলাম।”

নিলাশা বেগম নিঃশব্দে হেসে বলেন,
“বিয়ের পর প্রথম যেদিন তোরা এই বাসায় এসেছিলি, সেদিনই উদয় তোর বাবাকে সব বলে দিয়েছিল। তোর বাবা খানিক সময়ের জন্য তোকে ভুল বুঝেছিল ঠিকই,কিন্তু উদয়ের বোঝানোর পর তার ভুল ধারণা ভেঙে যায়।”

নিলাশা বেগম তূর্ণার দাকে তাকান। দেখেন তূর্ণার সম্পূর্ণ মনোযোগ তার দিকেই। মৃদু হাসেন তিনি। অতঃপর সামান্য রাগ দেখিয়ে বলেন,
“অনেক কথা হয়েছে। এখন তুই ওই বাড়ি ফিরবি।”

নিলাশা বেগম উঠে দাঁড়ান। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হন। কিছু একটা ভেবে আবার তূর্ণার দিকে ফেরেন।

“তূর্ণা, আরেকটা কথা। তোর আর উদয়ের ছবি তোলার প্ল্যানটা কিন্তু আমার আর তুষারের ছিল। উদয় এটাতে রাজী ছিল না। কারণ এতে তোর অসম্মান হতো। কিন্তু আমি আর তুষার জোর করেছিলাম অন্য কোনো উপায় না পেয়ে।”

নিলাশা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নেন। তূর্ণা পিছু ডাকে।

“মা, এতো কাহিনী করার কি দরকার ছিল বলোতো। আমাকে একবার বললেই পারতে।”

নিলাশা বেগম দাঁত কিরমির করে বলেন,
“বললেই যেন নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিতি।”

তূর্ণা মুখ ভেঙিয়ে বলে,
“একবার বলেই দেখতে। দুই সেকেন্ডে তিন কবুল বলে দিতাম।”

“হয়েছে হয়েছে এবার উঠো। ওবাড়ি যাও।”

“উফ্ মা, কি শুরু করলে বলোতো। আমি কি এ বাড়িতে একদিন থাকতেও পারবো না নাকি? আর এত রাতে আমি একা যাবো কীভাবে?”

নিলাশা বেগম মুখ ভেঙিয়ে বলেন,
“তো আসার সময় একা কেমনে এসেছিস? তুষারকে বলছি দিয়ে আসবে।”

নিলাশা বেগম চলে যেতে নিলে তূর্ণা আবার পিছু ডাকে।
“মা, তুমি উদয়ের হাতে আমাকে তুলে দেওয়ার জন্য এতো উতলা কেন হয়েছিলে? উদয়ের প্রতি তোমার এতো বিশ্বাস কেন?”

নিলাশা বেগম নিঃশব্দে হাসেন। গলার স্বর নরম করে বলেন,
“যে মানুষটা বছরের পর বছর আমার মেয়ের জন্য অপেক্ষা করে গেছে, তার উপর আমার বিশ্বাস সে কোনোদিন মাঝরাস্তায় আমার মেয়ের হাত ছেড়ে দেবে না। যে মানুষটা দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করবে বলে দিনের পর দিন অপেক্ষায় কাটিয়েছে, আমার বিশ্বাস সে কোনোদিন দুই পরিবারের কোনটাই অবহেলা করবে না। আমার মেয়ের সামান্য অসুস্থতায় যে মানুষটার চোখে জল চলে আসে, আমার বিশ্বাস সে আমার মেয়েকে সারাজীবন আগলে রাখবে। যে মানুষটা নিজের পবিত্র ভালোবাসায় হারামের তকমা লাগাবে না বলে দূর থেকে আমার মেয়েকে একতরফা ভালোবেসে গেছে, আমার বিশ্বাস সে আমার মেয়েকে সারাটা জীবনই ভীষণ ভালোবাসবে। একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সবথেকে প্রয়োজনীয় জিনিসটা হলো ভালোবাসা। আর উদয় যদি তোকে ভালো না বাসে, তবে আমি বলব এই দুনিয়ায় কেউ কাউকে ভালোবাসে না। তবে হ্যাঁ এখানে একটা কথা আছে। তা হলো উদয় নিজের ভালোবাসা কখনো প্রকাশ করে না। আড়ালে থেকে নিভৃতেই ভালোবেসে যায়।”

নিলাশা বেগম থামেন। মিথ্যে রাগ মেশানো গলায় বলেন,
“শোন, সব দোষ তোর বাবার। ওই বুড়োটার জন্যই এতো কাহিনী হলো। না সে নওশাদের সাথে তোর বিয়ে দেবে বলে বেঁকে বসতো, আর না এতো প্যাঁচ লাগতো।”
_______________

তূর্ণা এবাড়ি এসেছে মিনিট পনেরো। আসার পর সবাই জিজ্ঞেস করেছিল এতো রাতে এক কোথায় গিয়েছিল সে। কোনো রকমে ইনিয়ে বিনিয়ে সামাল দিয়েছে সে।

আসার পর থেকে উদয়ের সাথে কথা বলতে চেয়েও পারছে না তূর্ণা। লোকটা তাকে এক প্রকার এড়িয়ে চলছে। যেন তাকে চেনেই না। অকস্মাৎ বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। তূর্ণা গেল দরজা খুলতে।

“নওশাদ ভাই, তুমি?”

এতো রাতে এবাড়িতে নওশাদকে দেখে বিস্মিত হয় তূর্ণা। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নওশাদকে ভেতরে আসতে বলে তূর্ণা। নওশাদ ভেতরে এসে বাড়ির সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কুশলাদি বিনিময় করে।

নওশাদ রাতটা এবাড়িতেই কাটায়। মুখে কিছু না বললেও বাড়ির সবাই যে তার আগমন খুব একটা ভালোভাবে দেখেনি তা জানে তূর্ণা। যতই হোক সে তূর্ণার প্রাক্তন স্বামী।

সকালবেলা যখন তূর্ণা আর বিভা সকালের খাবার টেবিলে গুছিয়ে রাখছিল তখন নওশাদ তূর্ণাকে ডেকে সাথে নিয়ে বাড়ির ছাদে চলে যায়।

ছাদে দাঁড়িয়ে কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই নওশাদ বলে,
“আমি এখানে কেন এসেছি তাই ভাবছিস তো?”

তূর্ণা কোনো জবাব দেয় না। কিন্তু তার মনে এটাই চলছিল। নওশাদ আবারো বলে,
“আমি তোকে মেনে নিই নি বলে তোকে উদয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলতে গেলে তোদের বিয়ে হয়েছে আমার জন্যই। তাই যতক্ষণ না আমি নিজের চোখে দেখতে পারছি তুই সুখী আসিছ কিনা, ততক্ষণ মনে কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। তাই এসেছি এখানে তুই ভালো আসিছ কিনা নিজের চোখে দেখতে।”

তূর্ণা মুচকি হেসে বলে,
“ভাইয়া, আমি যদি উদয়ের সাথে সুখী না থাকি, তবে নিশ্চিত জেনে রেখো আমি আর কারো সাথি সুখী থাকব না।”

নওশাদ মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পায়। তূর্ণা তাকে খাবার খেতে নিচে যেতে বলে নিজেও হাঁটা ধরে বাসার উদ্দেশ্যে। সহসা নওশাদ তূর্ণার ডানহাতটা ধরে আটকায়। নরম গলায় বলে,
“আমি কেন তোর সাথে বিয়েটা মেনে নেই নি জানতে চাবি না?”

তূর্ণা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় নওশাদের দিকে। নওশাদ নিজে থেকেই বলে,
“প্রথমত তোকে নিজের বোন বলেই জেনে এসেছি এতোকাল। দ্বিতীয়ত, আমার থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে, তূর্ণা। থ্যালাসেমিয়ার সব লক্ষণ আমার আছে। ডাক্তার বলেছে বড়জোর আর এক-দেঢ় বছর বাঁচবো। বাবা-মা জানে না এই বিষয়ে। আমিই বলিনি। তারা জানলে তিল তিল করে মর’বে। তার চেয়ে ভালো আমি মা’রা যাওয়ার পরই তারা জানুক। আমার অস্থায়ী জীবনের সাথে কাউকে জোরাতে চাইনি আমি।”

তূর্ণা হতভম্ব। মানুষটা তার ভাই। ভাইয়ের এমন একটা কথা শুনে কোন বোনই বা স্বাভাবিক থাকতে পারে।
___________

তূর্ণা বাসায় আসতে না আসতে কেউ তার হাতটা ধরে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তূর্ণার হাত তার পিঠের সাথে লাগিয়ে খুব জোরে মুচড়ে ধরে। উদয়ের অকস্মাৎ করা কাণ্ডে চোখে পলক ফেলতেও ভুলে যায় তূর্ণা। হাতে ভীষণ ব্যাথা লাগছে তার। এই হাত খানিকক্ষণ আগে নওশাদ ধরেছিল।

উদয় তূর্ণার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“আমার একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস আমি ব্যতিত অন্য কেউ স্পর্শ করুক তা আমি মেনে নেব না।”

খানিকক্ষণ থেমে ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি ফুটিয়ে বলে,
“শুভ জন্মদিন। তোমার গিফ্ট আমাদের বিছানার উপর রাখা আছে।”

বলেই ছেড়ে দেয় তূর্ণাকে। গটগট করে হেঁটে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

তূর্ণা হাতের ব্যাথার কথা ভুলে দ্রুত চলে যায় ঘরে। উদ্দেশ্য উদয় তার জন্য কি গিফ্ট এনেছে দেখা। কিন্তু বিছানার ওপর শুধু সেই ডায়েরিটা পায় সে। আর কিছুই নেই।

তূর্ণা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। মুখ গোমড়া করে বিছানায় বসে পড়ে। কোথায় ভেবেছিল উদয় এই প্রথম তাকে কোনো উপহার দেবে।

ডাইরিটা হাতে নাড়াচাড়া করতে থাকে তূর্ণা। সহসা মনে হলো নতুন কিছু হয়তো লেখা আছে এটাতে। তূর্ণা তৎক্ষণাৎ সেদিন যে শেষ পৃষ্ঠা পড়েছিল তার পরের পৃষ্ঠায় যায়। হ্যাঁ উদয় লিখেছে তাতে কিছু। তূর্ণা লেখাটা পড়ে। বারবার পড়ে।

“অনুমতি ছাড়া কারো ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়া অপরাধ। ঘোর অপরাধ। আর সেই অপরাধিনীকে বলি, এই ডায়েরির প্রত্যেকটি শব্দ তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। শুধু তাকেই উদ্দেশ্য করে লেখা।”
____________
আজ তুষার এসেছে উদয়দের বাড়িতে। বোনের জন্মদিন, একবার সামনাসামনি বোনকে না দেখা পর্যন্ত ভালো লাগছিল না তুষারের। তূর্ণা নিজ হাতে তুষারের জন্য খাবার রান্না করেছে।
কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তখন, যখন তূর্ণা তুষারের হাতে চায়ের কাপ দিচ্ছিল।

“তূর্ণা, তোর হাতে কীসের দাগ ওটা?”

তূর্ণা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। উদয় তার হাতটা বেশি জোরে ধরেছিল। আঙুলের ছাপ পড়ে গেছে হাতে।
তুষার তূর্ণার হাতটা ধরে ভালোভাবে পরখ করে বলে,
“আঙুলের ছাপ বলে মনে হচ্ছে। কীভাবে হলো এমন?”

তুষারের প্রশ্নের জবাব কীভাবে দিবে তূর্ণা বুঝে উঠতে পারে না। তুষার সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে-মুখে রাগের আভাস। রাগী গলায় বলে,
“উদয় তোকে আঘাত করেছে?”

তূর্ণা কীভাবে বুঝাবে নিজের ভাইকে বুঝে উঠতে পারে না। কোনোরকমে আমতা আমতা করে কিছু বলতে নিয়েও লাভ হয় না। তুষারের রাগ তখন সপ্তম আকাশে। সাফ্ সাফ্ জানিয়ে দেয় এখনই তূর্ণাকে নিয়ে সে নিজের বাসায় যাবে। উদয় কোন সাহসে তার বোনের গায়ে আঘাত করেছে? উদয়ের কাছে কোনোভাবেই তার তূর্ণাকে থাকতে দেবে না।
_____________

তূর্ণা তার বাপের বাড়িতে এসেছে ঘণ্টাখানেক হলো। তুষার তাকে বলতে গেলে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে। তূর্ণা অনেকবার বুঝাতে চেষ্টা করেছে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। উদয়ের অনুপস্থিতিতে তুষার তূর্ণাকে নিয়ে এবাড়ি চলে এসেছে।

রাত ১১.৩০। তূর্ণা নিজের বিছানায় শুয়ে আসে। হাতে তার উপন্যাসের বই। ভালো লাগছে না কিছুই তার। ঘুমও আসছে না। তাই বইটা নিয়েছে। কিন্তু একটা শব্দও পড়ে দেখেনি। গুনগুন করে গান গাইছে সে।

কেন রোদের মতো হাসলে না,
আমায় ভালোবাসলে না,
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না।

এই মন কেমনের জন্মদিন
চুপ করে থাকা কঠিন,
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন।

নতুন সকাল গুলো
কপাল ছুঁলো তোমারই।
দূরে গেলেও এটাই সত্যি
তুমি আমারই,
শুধু আমারই।

রোদের মতো হাসলে না,
আমায় ভালোবাসলে না,
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না।

জলে ভেজা, চোখ বোজা
ঘুম খোঁজা ভোর।
নিশানা তীর, স্মৃতির ভীড়
এলোমেলো ঘর’দোর।

মেঘ আসে, এলো কিসে
ছুঁয়ে দিলেই সব চুপ।
সেই মেঘবালিকার গল্প হোক,
শহরজুড়ে বৃষ্টি হোক
রোদ্দুর হোক আজ,
শুধুই তার ডাকনাম।

পাতা ভরা সব দু’টুকরোরা,
কালবৈশাখীর মতো মুখচোরা,
সব ভিজে যাক
শুধু বেঁচে থাক
অভিমান।

নতুন সকাল গুলো
কপাল ছুঁলো তোমারই।
বেঁধে রাখতে পারলে
তুমিও হতে…..

বাকি টুকু আর গাইলো না। সহসা মনে হলো বাইকের হর্নের আওয়াজ কানে এসেছে। তূর্ণা জটপট উঠে বসে। মনে মনে ভাবছে বোধহয় উদয় এসেছে। পরক্ষণেই আবার তার মন বিষিয়ে যায়। রাস্তা দিয়ে তো কত বাইক যাওয়া আসা করে। উদয় এতো রাতে কেন আসতে যাবে!

কিন্তু তার মন কিছুতেই মানছে না। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় যায়। বারান্দায় যেতেই দেখে উদয় নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্ণা বিস্মিত। খানিকটা দূরে তাকিয়ে দেখে উদয়ের বাইক সাইড করে। বারান্দার এই দিকটা বাড়ির পিছনের দিক। উদয় বাড়ির পেছনে দিক দিয়ে ঢুকেছে।

তূর্ণা ইশারায় উদয়কে অপেক্ষা করতে বলে। মিনিট খানেক পরে একটা শাড়ি নিয়ে এসে বারান্দার রেলিংয়ের সাথে বেধে দেয়। উদয় নিচু গলায় বারবার তাকে বারণ করতে থাকে। কিন্তু কে শুনে কার কথা!

তূর্ণা গটগট করে শাড়ি ধরে নেমে আসে। তূর্ণার গতি দেখে উদয়ের মনে হলো তূর্ণার বোধহয় যুগ যুগ ধরে এভাবে নামার অভিজ্ঞতা আছে। উদয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এক গাল হেসে বলে,
“নওশাদ ভাইকে যেদিন এভাবে নামতে দেখেছিলাম, আমারো খুব ইচ্ছে হয়েছিল জীবনে একবার হলেও এটা ট্রাই করবো।”

তূর্ণা বিশ্ব জয়ের হাসি দেয়। উদয় তার নাক টেনে দিয়ে বলে,
“হয়েছে এবার চলো। নইলে তোমার ভাই দেখলে আমাকে এখানেই পুঁ’তে রাখবে।”

তারা দুজন হাঁটতে হাঁটতে বাইকে কাছে আসে। তূর্ণা উদয়ের হাত ধরে বলে,
“এই শুনুন না। আমার না বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। পালিয়ে বিয়ে করার অনেক দিনের শখ ছিল আমার।”

উদয় কপাল কুঞ্চিত করে বলে,
“ভুলে গেছো যে আমরা বিবাহিত?”

তূর্ণা ঠোঁট উল্টে বলে,
“তো কি হয়েছে? চলুন না আবার বিয়ে করি।”

সহসা উদয়ের ফোন বেজে ওঠে। উদয়ের বাবা ফোন করেছে। কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দেয় উদয়। ওপাশ থেকে জাহাঙ্গীর সাহেব বলেন,
“উদয়, বউমাকে আনতে পেরেছিস?”

উদয় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।
“হ্যাঁ বাবা, আমার সাথেই আছে। কিন্তু তোমার বউমার মাথায় এখন বিয়ের পোকা কিলবিল করছে। এখন নাকি আবার বিয়ে করতে হবে তাকে।”

জাহাঙ্গীর সাহেবের অকপট উত্তর,
“হ্যাঁ তো করে নে।”

“কিন্তু বাবা”

“কোনো কিন্তু না। তোর জায়গায় আমি হলে তোর মাকে নিয়ে সোজা চলে যেতাম কাজী অফিস। শোন তুই বউমাকে নিয়ে কাজী অফিস চলে আয়। যা ব্যবস্থা করার আমি করছি।”

ওপাশ থেকে কল কেটে যায়। তূর্ণা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। তূর্ণা মিষ্টি হাসি দেখে নিঃশব্দে হাসে উদয়। অন্ধকারের দরুন সেই হাসি তূর্ণার চোখে পড়ে না।

উদয় বাইকে উঠে বসে। তূর্ণা উদয়ের পিছনে বসতে বসতে বলে,
“শ্বশুরও পেয়েছি একটা হেব্বি!”

পরিশিষ্ট:

কালো মেঘে ঢেকে গেছে সুদূর অন্তরীক্ষ। অপরাহ্নকাল, কিন্তু কালো মেঘের দরুন মনে হচ্ছে যেন রাতের ঘোর অন্ধকারে ডুবে গেছে গোটা পৃথিবী। ঝুম বৃষ্টি বর্ষণে মেতে উঠেছে প্রকৃতি। বর্ষার এই ঝুম বৃষ্টিতে বৃষ্টিবিলাসে মত্ত তূর্ণা।

ছাদহীন বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনুভব করছে বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা। সহসা কারো উষ্ণ আলিঙ্গনে কেঁপে ওঠে তূর্ণা। উদয় তাকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।

তূর্ণা কানের কাছে নিজের মুখ এনে উদয় নিচু গলায় বলে,
“তুমি না বৃষ্টি বিদ্বেষী ছিলে?”

তূর্ণা নিজের মাথাটা উদয়ের বুকে ঠেকায়। মৃদু হেসে জবাব দেয়।
“যেদিন থেকে আমার বৃষ্টিপ্রেমি প্রেমিকের প্রেমের জালে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছি, সেদিন থেকে আমিও বৃষ্টিপ্রেমী হয়ে গিয়েছি।”

নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব আরেকটু ঘুচিয়ে দিয়ে উদয় তূর্ণার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
“এতো ভালোবাসো বুঝি আমায়?”

তূর্ণার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে মুহূর্তেই। খানিকটা রাশভারি গলায় বলে,
“যে কাজটা আপনি নিজে করেন না সে কাজটা আমাকে করতে বলেন কেন?”

উদয়ের কপালে কিঞ্চিত ভাঁজ পড়ে। তূর্ণাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“আমি ভালোবাসি না তোমায়?”

তূর্ণা আমতা আমতা করে বলে,
“আমি তা বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি আপনি কখনো স্বীকার করেন নি আপনি আমাকে ভালোবাসেন। তাহলে আমাকে কেন বলছেন স্বীকার করতে?”

উদয় ছোট্ট করে “হুম” বলে তূর্ণাকে নিজের বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়। ততক্ষণে বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে।
তূর্ণা উদয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে,
“ছোঁবেন না আমায়।”

উদয় কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে, “কেন?”

তূর্ণা জবাব দেয়,
“যেদিন নিজের ভালোবাসা নিজ মুখে স্বীকার করবেন, সেদিন ছুঁবেন। তার আগে না।”

বৃষ্টি ততক্ষণে পুরো থেমে গেছে। আকাশ তার জল বর্ষণে বিরতি নিয়েছে। উদয় ঠোঁট উল্টে বলে,
“করতেই হবে?”

তূর্ণা ছোট করে জবাব দেয় “হুম”।
উদয় পেছন ফিরে ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। তূর্ণা পিছু ডাকে।
“কি হলো? বলবেন না?”

উদয় থামে। তূর্ণার দিকে ফিরে বলে,
“বলব।”

“তো বলুন।”

“আজ না।”

“তাহলে কবে?”

“সেদিন, যেদিন বৃষ্টি হবে। ভীষণ বৃষ্টি হবে। তুমুল বর্ষণে সিক্ত হবে পথঘাট। এ শহরের তৃষাতপ্ত ভূমি বর্ষণের জলে নিজের তৃষ্ণা মেটাবে। দুনিয়ার সব রিক্ততা-শূন্যতা ভুলে তুমি সিক্ত হবে সেই বর্ষণে। আমি সিক্ত হবো সেই বর্ষণে।”
_____________
দিন কেটে যায়, সপ্তাহ কেটে যায়। কিন্তু বৃষ্টি আর নামে না। প্রণয়াসক্ত প্রেমিকার তৃষ্ণা মিটাতে কৃপণা আকাশ তার জল ঝরায় না এই ইট-পাথরের পৃথিবীতে।

রাত তখন ০১.৪৬। ঝুমঝুম আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তূর্ণার। ধরফরিয়ে উঠে বারান্দার থাইগ্লাসটা খুলে দেয়। বৃষ্টি হচ্ছে। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে।

ঘুমে বিভোর উদয়কে টেনে হিঁচড়ে বিছানা থেকে নামায় তূর্ণা। উদয় ঘুম ঘুম চোখ খুলে দেখে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। তূর্ণা টানতে টানতে নিয়ে যায় উদয়কে বারান্দায়। মুহূর্তেই তুমুল বর্ষণে দুজনে ভিজে একাকার।

তূর্ণা উদয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে,
“দেখুন বৃষ্টি হচ্ছে! আজ না আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করার কথা।”

উদয় নিঃশব্দে হাসে। তূর্ণার গালে নিজের ঠাণ্ডা হাতটা রেখে তূর্ণার চোখে চোখ রাখে।

“প্রথমবার কবে তোমার প্রেমে পড়েছিলাম জানো?”

তূর্ণা জানে। ডায়েরিতে পড়েছিল। কিন্তু তাও উদয়ের মুখে শোনার লোভ সামলাতে না পেরে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।

উদয় কিছু বলতে নিয়েও থেমে যায়। বৃষ্টির ফোঁটা তাদের গায়ে আর পড়ছে না। আকাশ বিরতি নিয়েছে বর্ষণে। উদয় হাসে। ঘরে চলে যায়। তূর্ণা আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের স্বরে বলে,
“এতো কিপ্টা কেন তুমি হ্যাঁ? আরেকটু বৃষ্টি দিলে কি হতো?”

পলকেই আবারো বৃষ্টি নামে। প্রেমিকার তৃষ্ণার্থ হৃদয় এবার হয়তো তৃষ্ণা মেটানোর উপায় পাবে।

এবার আর উদয়কে ডাকতে হয় না। নিজে থেকেই বারান্দায় আসে। থাইগ্লাসটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে তাতে হেলান দিয়ে বলে,
“তোমার উপর আমি অগণিতবার প্রেমে পড়েছি। প্রথমবার যেদিন তোমার প্রেমে পড়েছিলাম সেদিন বৃষ্টি ছিল। দ্বিতীয়বার যেদিন তোমার প্রেমে পড়েছিলাম সেদিন বৃষ্টি ছিল। তৃতীয়বার যেদিন তোমার প্রেমে পড়েছিলাম সেদিন বৃষ্টি ছিল। আমি যতবার তোমার প্রেমে পড়েছি সেদিনই বৃষ্টি হয়েছে। আজও তোমার প্রেমে পড়েছি। দেখো, আজো বৃষ্টি হচ্ছে। আমি জানি আমি আবার তোমার প্রেমে পড়বো। আর সেদিন! সেদিন বৃষ্টি হবে। ভীষণ বৃষ্টি হবে।”

বলতে বলতে উদয় তূর্ণার কাছে চলে আসে। নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে উদয় তূর্ণাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। তূর্ণাও দুহাতে উদয়ের পিঠ জড়িয়ে ধরে। নিরব কথোপকথন চলে খানিকক্ষণ। আর তারপর! তারপর বৃষ্টির বেগ বাড়ার সাথে সাথে সূচনা হয় দুজনের প্রণয়ের নতুন এক অধ্যায়ের।

সমাপ্ত